প্রণয়ীনি পর্ব -০১

আমার আপুর ভাসুর ছিলেন আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে অহংকারী ব্যাক্তি। রুদ্র রওশন চৌধুরী! যার শি*রায় শি*রায় দম্ভ। মে*জাজ প্রতিটি ধমনীর ফাঁকে। এমন একগুঁয়ে লোক আমি দুটি দেখিনি। আগে আপুর কাছে এরকম হাজারটা বিশেষন শুনলেও,বিশ্বাস করে উঠিনি। এরকম হয় নাকি?কিন্তু না,উনি সত্যিই তাই। যেদিন প্রথম অভ্র ভাইয়ারা,মানে আপুর বর আর তার পরিবার আপুকে দেখতে আসে সেদিনই প্রথম দেখলাম রুদ্র নামক লোকটাকে। গাড়ি থেকে সবার শেষে নেমেছিলেন উনি। আমরা তখন অতিথি অভ্যর্থনার খাতিরে দাঁড়িয়ে। তকতকে পোশাক, লম্বা-চওড়া, ফর্সা লোকটাকে দেখেই আমার মাথা ঘুরে গেল। বলা বাহুল্য,ক্রাশ নামক হুমড়ি খেলাম ওনার ওপর। এত সুন্দর পুরুষ হয়? এই উনিশ বছরের জীবনে দেখিনি আমি। যখন জানলাম ইনিই আমার হবু দুলাভাইয়ের একমাত্র বড় ভাই, আমার চোখ জ্ব*লে ওঠে আনন্দে। এমন মানুষ কী না আমার বেয়াই হবে?
কিন্তু সেই আনন্দ আমার বেশিক্ষন টেকেনি। যখন আমার হাতের গোলাপজল ওনার ওপর ছিটিয়ে দিলাম আর উনি গরম চোখে চেয়ে বললেন,
” হোয়্যাট দ্যা হেল!
আমার ক্রাশ নামক খাদ্য সেখানেই আহুতি দিলো। এমন কর্কশ ভাষা! তাও এমন সুশ্রী চেহারায়? মেনে নিতে পারিনি। ক*ষ্টে,দুঃ*খে, অদৃশ্যভাবে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেলাম। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। দাঁত চেপে বিড়বিড় করলেন। ঝরঝরে ইংরেজিতে আমাকে বলে গেলেন
” ইডিয়ট! ”
তারপর বাকিদের সঙ্গে ঢুকে গেলেন ঘরে। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। পরপর ঘটনা গুলো যখন মাথায় ঢুকলো হুশ ফিরতেই নিজের ওপর চরম বিরক্ত হলাম।
‘ এইরকম একটা নাক উঁচু লোকের ওপর ক্রাশ খেয়েছি? ছি সেঁজুতি! ছি!’

হ্যাঁ নাক উঁচুই তো। সামান্য গোলাপ জলের ছিটেতে যার গা জ্বলে উঠল,তাকে দেয়ার মত এর থেকে সুন্দর বিশেষন খুঁজে পাইনি।
এরপরে ঘটল আরেক ঘটনা। মেহমানদের সামনে আম্মু আমাকেই দিয়েছিলেন নাস্তা পরিবেশনের দায়িত্ব। আপু তখন শাড়ি, চুরি পরে এক হাত ঘোমটা দিয়ে সোফায় বসে। ওর শ্বশুর বাড়ির লোক বলতে শুধু ওর শ্বাশুড়ি, আর ওর ভাসুর। একটা কথা না বললেই নয়, অভ্র ভাইয়ার সাথে এই লোকের আদ্যোপান্ত মিল নেই। অভ্র ভাইয়া, ওনার মা দুজনেই ভীষণ হাসিখুশি আর মিশুকে। সেখানে ওনার বড় ভাই প্রচন্ড গম্ভীর। আসার পর থেকে এক টুকরো হাসি আমি ওনার ঠোঁটে দেখিনি। না আলাপ করানো সময়ও ছিলনা। আপু আর ভাইয়ার লাভ ম্যারেজ। দীর্ঘদিন প্রেমের পরিনতি দিতে আজ বিয়ের দিনক্ষন পাঁকা করা হবে। সেই খুশি একটু পরপর ঝলকে উঠছে ওদের চোখেমুখে।
কিন্তু বিপত্তি বাধল আরেক জায়গায়, রুদ্র নামক হিংসুটে লোকটা তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। মূলত কল আসায় উঠে গেছিলেন উনি। আম্মু তখন আমাকে গুছিয়ে বললেন,
” যা তো সেঁজুতি, ওনাকে চা টা দিয়ে আয়।

আমি বরাবরই বাধ্য মেয়ে। চায়ের কাপ তুলে গুটিগুটি পায়ে ওনার কাছে গেলাম। চায়ের কাপটাও বাড়িয়েছি কেবল,উনিও ধ*মকে উঠলেন কাউকে। আমার হাত কেঁ*পে উঠল। আর ব্যাস! গরম চা ফেলে দিলাম। কিছুটা মেঝেতে,কিছুটা গয়ে পরল ওনার হাতের ওপর। এরপর আর কী! ছোটখাটো ব*জ্র পরল বসার ঘরে। ভড়কে তাকালেন উনি। কিড়মিড় করে বললেন সেই তিন খানা শব্দ,
” হোয়্যাট দ্যা হেল?
তারপর বললেন,
” দেখে কাজ করতে পারেন না? অন্ধ? চোখ থাকে কোথায়?

আমি প্রথম দিকে ভীষণ অনুতপ্ত হয়েছিলাম। চা ফেলেছি দোষ তো আমারই। কিন্তু ওনার তপ্ত কন্ঠে সেই অনুশোচনা মাটি চা*পা পরেছে। এভাবে বলার কী আছে? আমি কি ইচ্ছে করে ফেলেছি? কোমড় বেধে ঝ*গড়া টা ঠিক করে করতে পারিনি বাড়ির বয়স্ক দের সামনে। শুধু মিনমিন করে বললাম
” স্যরি!
ওনার বিকৃত মুখভঙ্গি তখনও পাল্টালোনা। চা পরেছিল ওনার দামি ঘড়ির ওপর। হাতে পরলে একটা কথা, ভাবতাম পু*ড়ে গেছে তাই এত হম্বিতম্বি। কিন্তু তাতো নয়! উনি একটু আগের মতোই টিস্যু দিয়ে ঘড়ি মুছতে মুছতে বাঁকা চোখে একবার আমার দিকে দেখলেন।
দৃষ্টিতে কি ছিল আমি জানিনা। অথচ আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠান্ডা হয়ে গেল। বাদামী আইরিশ দুটোতে কি মেশানো ছিল কে জানে?

ওনার মা উঠে এলেন। আহ্লাদ করে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” দেখি দেখি কোথায় পু*ড়েছে? জ্ব*লছে নাকি?
আর আমার আম্মু এক কাঠি ওপরে গিয়ে ধ*মকে উঠলেন আমায়। বললেন,
” এই সেঁজুতি, সমস্যা কী তোর? চা ফেলে দিলি কী করে? এই মেয়েটাও না,একটা কাজ যদি পারে। তুমি কিছু মনে কোরোনা বাবা। মলম আনছি আমি।

শেষ টুকু রুদ্রকে খুব নরম কন্ঠে বললেন আম্মু। সকলের সামনে আমার মান ইজ্বতের জলাঞ্জলি দয়ে উঠতেও নিলেন মলম আনতে। তখনই লোকটা রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” দরকার নেই। আমার হাতে পরেনি।
তারপর আবহাওয়া শীতল হলো ফের। অভ্র ভাইয়া আর আপুর বিয়ের দিন ঠিক হলো। আন্টি মেয়ে দেখে পছন্দ করে আংটি অবধি পরিয়ে গেলেন। খুশি তখন রমরমিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। বাবা আপুকে বললেন, ভাইয়াকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে। দেখানো তো ছুঁতো,আসলে ওদের আলাদা ভাবে কথা বলতে দিয়েছে। আমি কী বুঝিনা? সবে ইন্টারপাশ করলে কী হবে? আমি সব বুঝি।

আপু আর ভাইয়া আলগোছে উঠে গেল। আমাদের এক তলা পাকা বাড়ি। বাবার পৈতৃক ভিটা। শুনেছি অনেক খাটুনির পর দাদামশাই উত্তরার মাটিতে এক খন্ড জমি কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে বাড়ি করার পর বেশিদিন থেকে যেতে পারেন নি। পাড়ি জমালেন দূর দেশে।
আম্মু আমাকে ইশারা করলেন খালি কাপ প্লেট নিয়ে যেতে। যখনই তুলতে যাব, আপুর হবু শ্বাশুড়ি প্রশ্ন করলেন
” তুমি কীসে পড়ছো সেঁজুতি?
আমি ঘাড় বেঁকে তাকালাম,
” অনার্সে ভর্তি হয়েছি আন্টি। ক্লাশ এখনও শুরু হয়নি।”
” বাহ ভালো! কি এসেছিল রেজাল্ট? ”
” 4.84 ”
” ভালো পেয়েছ।”
” কী নিয়ে পড়ছো তাহলে এখন?”
” ফ্যাশন ডিজাইনিং ”
কথাটা বলার সময় রুদ্র একবার ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে আড়চোখে তাকালেন।
আন্টি হৈহৈ করে বললেন,
” তাই? আমার রুদ্রর ও তো ফ্যাশন নিয়ে ব্যবসা।”

আমি ঠোঁট গোল করে ‘ও’ বোঝালাম। এরপর এঁটো কাপ প্লেট তুলে হাঁটা ধরলাম কিচেনে।
পেছনে টের পেলাম বাবা,আম্মু,আন্টি এরা সবাই গল্প জুড়েছেন। আমার খুব চিন্তা হলো রুদ্র লোকটাকে নিয়ে।
এই লোক কথা না বলে কীভাবে থাকে? একটা মানুষ কী করে পারে এরকম চুপচাপ থাকতে? আমিতো পারিনা। একটুও না। কথা না বলতে পারলে আমার দম আটকে আসে। কষ্ট কষ্ট লাগে।
একটা গ্লাস তুলে ট্যাব ছেড়ে ধুঁতে নিয়েছি কেবল তখন টের পেলাম কেউ একজন পেছনে এসে দাঁড়াল। আমি তৎক্ষনাৎ ঘুরে তাকালাম। প্রচন্ড বিস্মিত হলাম ওনাকে দেখে। উনি টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে।
আমাকে বললেন,
” ছাদে চলুন।
বললেন না হুকুম করলেন ঠিক বোঝা গেল না। আমি চোখ পিটপিট করে চেষ্টা করলাম বুঝতে। তখনি বাবা পেছন থেকে জানালেন,
” সেঁজুতি, রুদ্র আমাদের ছাদ দেখতে চাচ্ছে,তুমি একটু নিয়ে যাও।

আমি মাথা কাত করলাম। কোমড় থেকে ওড়নার প্যাচ ছাড়িয়ে বললাম,
” আসুন।
পা বাড়ালাম ওনার সামনে। তবে স্পষ্ট টের পাচ্ছি ওনার জুতোর শব্দ। গটগট করছে সিড়িতে। ছাদে আসার পর উনি গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালেন। নিচে তাকালেন,আশপাশ দেখলেন। এরপর ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। পিঠে ঠেস দিয়ে পকেটে দুহাত গুঁজে বললেন,
” আপনার নামের মানে কী?”
থেমে থেমে বললাম,
” স..সন্ধ্যা প্রদীপ!”
” নামের সঙ্গে তো আপনার কোনও মিল নেই। ”
আমি থমকে বললাম,
” কেন? ”
উনি জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়লেন,
” কে রেখেছে নাম?”
” বাবা।”
” পালটে অন্য কিছু রাখতে বলবেন। যেটাতে আপনাকে মানায় না সেটা অহেতুক। ”
কী অপমান! ভাবা যায়? আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, আমার যা ইচ্ছে নাম হোক,তাতে আপনার কী? কিন্তু মুখ ফুটে বের হলোনা। বাড়িতে আসা মেহমানদের সঙ্গে অ*ভদ্রতা করব এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনা। চুপচাপ হজম করলাম ।
ঠিক তখন ছাদে হাজির হলো আপু আর ভাইয়া। হাসতে হাসতে এসেছিলেন দুজন। রুদ্রকে দেখতেই অভ্র ভাইয়ার হাসিটা দপ করে নিভে গিয়ে মুখ চো*রের মত হয়ে গেল।
কেলিয়ে রাখা দাঁত গুলো ঢুকে গেল ঠোঁটের গহব্বরে। আপুকে পেছনে ফেলে দ্রুত গিয়ে ভাইয়ের পাশে দাঁড়ালেন। অবাক অবাক কন্ঠে বললেন,
” ভাই,তুমি ছাদে?”
উনি শুধু বললেন,
” হ্যাঁ। ”
আপু আগ বাড়িয়ে শুধাল,
” আমাদের এই ছোট বাড়ি কেমন লেগেছে ভাইয়া?”
আমিও উত্তর জানতে ওনার দিকে তাকালাম। উনি একদম আমার দিকে চেয়ে থেকেই বললেন,
” ভীষণ সুন্দর!
আমার কেমন যেন লাগল। ওনার দৃষ্টি, ওনার কন্ঠ। অন্য রকম। চট করে চোখ ফিরিয়ে আপুকে বললাম,
” নিচে যাই।”
অভ্র ভাইয়া আটকে দিয়ে বললেন,
” আরে কোথায় যাবে? একমাত্র শালি আমার,আলাপ করি ঠিকঠাক। ”
আমি মৃদূ হাসলাম ভাইয়ার দিক তাকিয়ে। তখনও স্পষ্ট বুঝতে পারছি রুদ্র আমাকেই দেখছেন। না তাকালেও আমার গলা শু*কি*য়ে এলো। এভাবে কী দেখছেন উনি?

সব কিছুর পাঠ চুকিয়ে ভাইয়ারা যখন বাড়ি ফিরবেন আমি তখন দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সবাই সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে যখন হঠাৎই রুদ্র এসে পাশে দাঁড়ালেন আমার। ওনার উপস্থিতি টের পেয়ে আমি চোখ তুলে তাকালাম। উনি খানিকক্ষন চেয়ে রইলেন। অনড় সেই চাউনি। এরপর আরেকটু এগিয়ে এলেন। আমার কৌতুহল হলো। উনি এমন করছেন কেন? পরপর হাতের মুঠোয় ওনার হাতের স্পর্শ পেলাম।
উনি চলে গেলেন। ওনাদের গাড়িটাও চলে গেল। শুধু আমিই মুঠোতে কাগজের টুকরো নিয়ে মূর্তি বনে দাঁড়িয়ে।

হুশে ফিরলে মুঠোর কাগজ সামনে ধরলাম চোখের। সারা শরীর অকারনে কাঁ*প*ছিল আমার। কাগজ নয়,দলিত -মথিত টিস্যু। ভাঁজ খুলতেই লেখা দেখলাম,
” সেঁজুতি নয়, আপনার নাম হওয়া উচিত জোনাকি পোকা। যারা অন্ধকারে টিমটিমে আলো দেয়। যার নরম রশ্মি দেখলে অন্তঃস্থল জুড়িয়ে যায় শীতলতায়। গেথে যায় দৃষ্টিতে। ঢুকে যায় মস্তিষ্কে। এই যেমন আমার হলো আজ। কেন হলো, আছে উত্তর?

#প্রণয়ীনি
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি :লেখনীতে
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here