#প্রণয়
#পর্বঃ৩০
#তানিশা সুলতানা
রাত বারোটা বেজে গেছে। এখনো সূচক আসছে না। ঘুমে তানহার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খুব কষ্টে জেগে আছে। একটু পর পর চোখে পানি দিয়ে আসছে।
সূচকের পড়ার টেবিলের ওপর মাথা এলিয়ে দেয় তানহা। সামনে প্লেট ভর্তি বিরিয়ানি আরেকটা প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
রাত একটা ছুঁই ছুঁই তখন সূচক বাড়িতে আসে। দুই তিন বার বাড়ির মেইন দরজায় কড়া নারতেই ঘুম ঘুম চোখে তমাল দরজা খুলে দেয়। সূচক বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। তমাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে রুমে চলে যায়।
সূচক রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ভীষণ ক্লান্ত সে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে। পেটে ভীষণ খিধে তবুও খেতে ইচ্ছে করছে না।
এতো পরিশ্রম আগে কখনো করে নি ও।
হঠাৎ চোখ পড়ে জানালার পাশে থাকা টেবিলে ওপর মাথা এলিয়ে দেওয়া তানহার দিকে। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে। ক্লান্তি অনেকটা চলে যায় সূচকের। উঠে বসে। গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। জুতো জোড়াও খুলে নি। আনমনে হাসে সূচক।
এলোমেলো চুল গুলো বা হাতে পেছনে ঠেলে জুতো জোড়া খুলে রুমের এক পাশে রাখে। শার্টটা খুলে গায়ে গামছা জড়ায়।
তারপর তানহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুখন তানহার ঘুমন্ত মুখ টার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চুল ধরে জোরে টান দেয়।
তানহা চোখ মুখ কুঁচকে উহহহ শব্দ করে ওঠে। কয়েকবার পাপড়ি ঝাঁপড়ে চোখ খুলে। সূচককে সামনে দেখে ঘুম উবে যায়। বড়বড় চোখ করে তাকায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে খুশির ছায়া।
“জলদি খাবার রেডি কর। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
বলেই সূচক ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। তানহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এলোমেলো চুল গুলো হাত খোপা করে ফ্লোরে মাদুর পেতে নেয়। তারপর সেখানে দুটো প্লেট জগ গ্লাস সব কিছু নামিয়ে দুই প্লেটেই বিরিয়ানি বেরে তাতে শশা পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সূচকের।
কিছুখন পরেই সূচক বেরিয়ে আসে চুল মুছতে মুছতে। পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর হাতা কাটা গেঞ্জি।
হাতের ভেজা গামছাটা তানহার ওপর ছুঁড়ে মেরে খেতে বসে যায় সূচক। তানহার বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে মুখের ওপর থেকে গামছা সরিয়ে সেটা বারান্দার দড়িতে মেলে দেয়।
তারপর এসে সূচকের পাশে বসে নিজের প্লেটটা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে।
সূচক কোনো কথা না বলে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। যেনো কতোদিন অনাহার ছিলো। তানহার মনটা প্রশংসা পাওয়ার জন্য আকুপাকু করছে। কখন সূচক বলবে ” কে রান্না করেছে রে?”
কিন্তু সূচক বলছে না। গপগপ করে এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়া শেষ করে গামলা থেকে আবারও নিচ্ছে। কিন্তু প্রশংসা করছে না।
তানহা সূচকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাবার মুখে দিচ্ছে। সূচকের পাতের শশা শেষ। তানহা একটা শশাও খায় নি। আসলে ও ভুলেই গেছে।
সূচক তানহার পাতের শশা নিয়ে খেতে থাকে।
“রান্নাটা আমি একা একাই করেছি। একদম একা একা।
সূচকের থেকে রেসপন্স না পেয়ে নিজেই বলে তানহা। সূচক এক পলক তাকায় তানহার দিকে।
” হুমম
শুধু এটুকুই বলে সূচক। তানহার মনটা একদম ভেঙে যায়। খাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। একটুও প্রশংসা করা যেতো না কি?
নাক ফুলিয়ে প্লেট রেখে উঠে দাঁড়ায় তানহা।
“এক পা নরলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো আমি। চুপচাপ খাবারটা শেষ কর।
সূচক তানহার কামিজের এক অংশ শক্ত করে ধরে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে।
তানহা চোখে এবার পানি চলে আসে। অভিমানে মুখটাকে একটুখানি করে বসে পড়ে। সূচকের দিকে মাথা তুলে তাকাচ্ছেও না। চুপচাপ নাক টানছে আর মুখে খাবার পুরছে।
সূচক খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তানহা প্লেট গুছিয়ে চলে যেতে নেয়।
” এভাবে রাত জেগে থাকবি না। দশটার মধ্যেই খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। আর একদিন দেখলে আমি আর বাড়িতেই ফিরবো না।
চোখ বন্ধ করে খুব শান্ত গলায় বলে সূচক। তানহার ছোট্ট মনটা ভীষণ ভাবে আঘাত পায়। গাল বেয়ে টুপটাপ করে পানি পড়তে থাকে।
“হ্যাঁ একদম রাত জাগবো না। সামনেও যাবো না আপনার। পঁচা বেডা।
তানহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে চলে যায়। সূচক নিঃশব্দে হেসে ফেলে।
সারা রাত ঘুমায় নি তানহা। বিছানার এক কোনায় বসে কান্না করে গেছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। এতো অবহেলা কেনো করছে উনি? ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে।
অশান্ত মনকে অবশেষে ফজরের আজানের সময় শান্ত করে। মনে মনে কড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একদম কথা বলবে না সূচকের সাথে। আশেপাশেও ঘেসবে না। তানহাকে ইগনোর করেছে? এবার তানহাও করবে। তখন দেখবে কেমন লাগে???
সাত সকালে ইমনের কল পেয়ে মেজাজ বিগড়ে যায় তোহার। ভোর ছয়টা বাজে। এখন কল দেওয়ার সময়? তোহার তাজা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলো?
দাঁতে দাঁত চেপে তোহা কলটা রিসিভ করে ফোন কানে দেয়।
কিছু বলবে তার আগেই ইমন বলে ওঠে
“তোমার ভাই আমার তাজা ঘুম ভাঙালো। তাই আমি তোমার তাজা ঘুম ভাঙালাম। হয়ে গেলো না ইকুল ইকুল?
এক গাল হেসে বলে ইমন। তোহা কিচ্ছু বলে না। দাঁতে দাঁত চেপে সয্য করে।
” ভাবছি প্রেম করবো। সিঙ্গেল থাকা যাচ্ছে না আর। পরে না হয় তুমি যখন বিয়েতে রাজি হবে তখন বিয়ে করে নেবো।
তো এখন মেয়ে খুঁজে দাও তুমি। নাহলে তুমি নিজেই রাজি হয়ে যাও।
সাধের ঘুম বাদ দিয়ে ইমনের সাথে খেজুরে আলাপ করার টাইম একদমই নেই তোহার। তাই খট করে কল কেটে দিয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে।
তানহা নামাজ পড়ে রান্না ঘরে চলে গেছে। রাতে মায়ের মাথা ব্যাথা ছিলো। এতসকালে কখনোই উঠবে না। বড়মা একা একা রান্না করবে। তাই তানহা সাহায্য করতে গেছে।
সারা রাত কান্না করার ফলে চোখ মুখ ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে।
মাথায় ওড়না টেনে কিচেনে পা ফেলতেই সামনে পড়ে সূচকের। সূচকের হাতে গরম কফি। তানহা এক পলক সূচকের হাতের দিকে তাকিয়ে এক পাশে দাঁড়ায়।
“এতো সকালে উঠেছিস কেনো?
সূচক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে।
তানহা উওর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছুটা অবাক হয় সূচক। কিন্তু পাত্তা দেয় না। এখন একে পাত্তা দিল গেলে বের হতে দেরি হয়ে যাবে।
তাই কফির মগের চুমুক দিতে দিতে রুমে চলে যায়।
পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যাকে বলে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একজন প্রকৃত বন্ধু আরেক জন বন্ধুর জন্য সব করতে পারে।
এই যে ইমন সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং এর দরজা খুলে বসে আছে।
মশা তাড়াচ্ছে। বাবার অঢেল সম্পদ থাকার পরেও সে সূচকের সাথে ভাগে কোচিং সেন্টার খুলেছে।
বিশ দিন হলো এই কোচিং সেন্টারের বয়স। বাবার থেকে টাকা নিয়ে কলেজের পাশে একটা টিনের ঘর ভাড়া নিয়েছে। তাতে ব্রেঞ্চে টেবিল বোর্ড মার্কার বই সব কিছু ইমন কিনেছে।
সূচকের হাতে দশটা টাকাও ছিলো না। তাই সে টাকা দিতে পারে নি। ইমনের থেকে নিতেই ইতস্তত বোধ করছিলো। পরে ইমন ওকে স্বাভাবিক করার জন্য বলেছে ” আমি আর তুই তো ভাগে খুলছি কোচিং সেন্টার। মাস শেষে স্টুডেন্টরা টাকা দিলে না হয় আমাকে বেশি টাকা দিস”
তার পরই রাজি হয়েছে সূচক।
বারো জন স্টুডেন্ট নিয়ে শুরু করেছে কোচিং সেন্টার। পাঁচ জন্য ইংলিশ পড়ে বাকি সাত জন্য আইসিটি।
তবে ইমনের বিশ্বাস সামনে মানে একশত স্টুডেন্ট হবেই। কিন্তু সূচক ভরসা পাচ্ছে না।
সাতটা থেকে আইসিটি পড়ানো হয়। সূচকে পড়াই। ইমন স্টুডেন্টের মতো বসে থাকে।
সাতটায় স্টুডেন্টরা চলে আসে। সাথে সূচকও আসে। সূচকের সাত জন স্টুডেন্টের মধ্যে পাঁচ জন মেয়ে আর দুই জন ছেলে। একজন স্টুডেন্টও একদিনও কামায় দেয় না। প্রতিদিন পড়তে আসে।
_________
আজকে সূচক ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়েছে বলে সাদিয়া বেগম ভীষণ চিন্তিত। কোথায় যায় ছেলেটা?
এমনিতে তো প্রতিদিন খাবারটা অন্তত খেয়ে যায় আজকে কি হলো?
তানহারও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সূচক খায় নি বলে ওরও খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই না খেয়েই স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নেয়।
চলবে