প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -১৬+১৭+১৮

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৬তম_পর্ব

চোখ বুজে গান শুনছিলো অনল। ধারা মুখে হাত দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের কিরণে প্রিন্স উইলিয়ামকে যেনো আরোও সুন্দর লাগছে। হঠাৎ চোখ খুললো অনল। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,
“কি দেখিস?”
“তোমাকে”

ধারার “তোমাকে” টুকু মস্তিষ্কে ধাবণ করতে সময় নিলো অনলের৷ মস্তিষ্ক জুড়ে যেনো মেয়েটির ঘোর লাগানো স্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য স্তদ্ধ হয়ে গেলো সে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। পড়ন্ত বিকেল, পশ্চিমে লাল আভা গাঢ় হচ্ছে। প্রস্তুতি হচ্ছে ব্যস্ত দিনের সমাপ্তির। ঈষৎ লালচে আলো আছড়ে পড়ছে ধারার ঘোর লাগা চোখে। তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত মাদকতা। অনল চোখ রাখলো ধারার সেই মাদকতাপূর্ণ চঞ্চল চোখে। দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। শুধুই নীরবতা। সময়টা যেনো থেমে গেছে। আশেপাশের কোলাহল যেনো তাদের ছুতে পারছে না। অনল অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। একবার ইচ্ছে করলো প্রশ্ন করতে, “কেনো?” কিন্তু প্রশ্নটি করা হলো না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লালচে রঙ্গে নীলাম্বরে ছেয়ে গেছে। পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে। অনল চোখ সরিয়ে নিলো। আশেপাশের গান থেমে গেছে। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অনল হাটু ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নরম গলায় বললো,
“বাসায় যেতে হবে”

ধারার ঘোরে পড়লো ছেদ৷ স্বম্বিত ফিরলো তার। উপলদ্ধি করলো এতো সময় নির্লজ্জের মতো শুধু অনলকেই দেখেছে সে। তার থেকেও বেশি লজ্জা পেলো যখন স্মরণ হলো একটু আগের বলা কথাটা, সে অকপটেই অনলকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখার কথাটা স্বীকার করে নিয়েছে। না জানি অনল ভাই কি ভাবছে! কি চলছে তার মনে! সে কি রাগ করেছে! নাকি লজ্জা পেয়েছে! নাকি বিরক্ত হয়েছে! ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দিনের আলো মিলিয়ে গেছে, নদীর পাড়ে আঁধার নেমে গেলো এসেছে। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। অনল অপেক্ষা করলো না ধারার জন্য। অনলকে চলে যেতে দেখে পিছু নিলো ধারা। কিশোরী মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিলো। তখনের কথা এবং কাজে কি সে রাগ করেছে! কেনো করেছে রাগ! নিজের স্বামীকে দেখা তো খারাপ নয়! আর যদি রাগ না করে থাকে তবে এমন এড়িয়ে যাচ্ছে কেনো! উত্তর পেলো না ধারা।

সারাটা রাস্তা কোনো কথা হলো না তাদের মাঝে। ধারাও কোনো কথা বলে নি, অনল ও নয়। শুধু বাইকে উঠতে উঠতে বলেছিলো,
“সাবধানে বসিস, আমি একটু জোরে চালাবো”

এটুকুই তাদের মাঝে কথা হয়েছে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলো। ধারা বুঝলো না, অনলের আচারণের কারণ। হয়তো অনল নিজেও জানে না এই কারণ। অন্য চারটে সম্পর্কের মতো তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়, এক অদ্ভুত জড়তা দুজনের মনেই উঁকি দিচ্ছে। অনলের মনে হচ্ছে তাদের দুজনের মাঝে একটা কাঁচের দেওয়াল আছে, যা ভেদ করাটা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ধারাকে আঘাত করতে চায় না। নিজেও আঘাত পেতে চায় না। তাই দ্বিধাবোধ হয়। তাদের সম্পর্কের কি আদৌও ভবিষ্যৎ আছে! নাকি এটা শুধুমাত্র দাদাজানের একটা জেদ হয়েই থেকে যাবে! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অজানাই রয়ে গেছে। তাই নিজ থেকে দু কদম এগোলেও দু কদম পিছিয়ে আসে সে। ফলে তার অবস্থানটা একই জায়গায় আছে। ধারাও আগায় নি! ফলে সম্পর্কটা এখনো একমাস পূর্বের মতোই আছে______

বাসায় পৌছালো রাত নয়টার দিকে। ধারা বিনা বাক্যে ভেতরে চলে গেলো। মনে থেকে গেলো তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের উৎপন্ন প্রশ্ন। বাসায় প্রবেশ করতেই আশা এবং এশা ছুটে এলো অভিযোগের পুটলি নিয়ে। তাদের ছাড়া কেনো ঘুরতে যাওয়া হলো। ধারা ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আরেকবার নিয়ে যাবো”

অনল কারোর সাথে কথা বললো না। সোজা নিজ ঘরে চলে গেলো। এশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো অনলের যাবার দিকে। তারপর বলে উঠলো,
“অনল ভাইরে কি কু’ত্তায় কামড়াইছে? মুখটা এমন ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো করে রাখছে কেনো?”
“জিজ্ঞেস করে আয়”

ধারা ওর চুলটা খানিকটা টেনে কথাটা বললো। এশা বা হাতে মাথা ঢলতে ঢলতে বললো,
“বলবা না বলে দিলেই হয়। ভয় দেখাও কেনো!”

ধারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুবি দুটোর কান ধরে বললো,
“মেয়েটা মাত্র বাড়ি আসছে, একটু শান্ত দে। আর তোদের পড়া নেই! সারাক্ষণ টো টো কোম্পানির ম্যানেজারি করিস? যা নিজের রুমে পড়তে যা”

ধারা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ব্যাগটা নিয়ে নিজ ঘরে চলে গেলো। এশা এবং আশাও বাধ্য হয়ে নিজ ঘরে গেলো। মায়ের কান মলায় ফর্সা কান লাল হয়ে গেছে। তবে এশা ক্ষান্ত হলো না। ফিসফিসিয়ে বলল,
“কুছ তো গারবার হ্যা দায়া, পাতা লাগাও”

অপরদিকে ঘরে প্রবেশ করে অনলকে দেখতে পেলো না ধারা। বাথরুম থেকে ঝর্ণার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তাই আন্দাজ করা কঠিন হলো না মানুষটি কোথায়। ধারা নিজের ব্যাগটা রেখে দিলো। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। এতো লম্বা সময় বাইকে বসে মাজা ধরে এসেছে। মিনিট বিশেক বাদে অনল বের হলো টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। বের হতেই তার চোখ গেলো শুভ্র বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমন্ত কিশোরীর দিকে। অনলের পা জোড়া এগিয়ে গেলো তার কাছে। বসলো কিশোরীর পাশে৷ ঘোর লাগা চোখে দেখছে কিশোরীকে। এক সময় বা হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিলো। ধীর গলায় বললো,
“আমাকে আর পাগল করিস না ধারা, একটা মানুষ বারবার ম’র’তে পারে না”

কথাটা নিস্তব্ধ ঘরেই আটকে রইলো। ঘুমন্ত কিশোরীর সেটা শোনা হলো না______

******

ক্যাফেটেরিয়ায় বন্ধুমহলের মধ্যে বসে আছে ধারা। শফিক স্যারের লিনিয়ার এলজ্যাবরা ক্লাস আজ হবে না। তাই বন্ধুমহল জড়ো হয়েছে ক্যাফেটেরিয়ায়। অবসর সময় কিভাবে কাটাতে হয় তা দিগন্ত এবং অভীকের কাছ থেকে শেখা উচিত। তাদের মধ্যে লেবু খাবার প্রতিযোগিতা চলছে। যে হারবে সে অপরজনের বাকি খাতা পরিশোধ করবে। রফিক মামা দশটা কাগজী লেবু কেটে দিতে বলেছেন। অভীকের বাকি খাতায় জমেছে ২৫৬৭ টাকা, দিগন্তের বাকি খাতায় জমেছে ২৪৬৮ টাকা৷ যেই জিতুক না কেনো তার বাকী টাকা পরিশোধ হবে। সেই আনন্দে রফিক মামার মুখ চকচক করছে। সে এই দশখানা লেবুর টাকা নিবে না। কারণ ২০০ টাকার বিনিময়ে তার যদি বাকি পরিশোধ হয় সেটাও বা কম কিসে! নীরব অতিউৎসাহীত ভাবে তাদের সাপোর্ট করছে। মোবাইল ফোনে ভিডিও ও করছে। ভার্সিটির গ্রুপে শেয়ার করবে সে। ধারার এদিকে খেয়াল নেই। দুটো দামড়া ছেলে লেবু খাবে এটা দেখার কি হলো! মাহিটা যদি থাকতো তাহলে আর খারাপ লাগতো না। কিন্তু জনাবা এখনো ক্যাম্পাস ই আসে নি। মাহির সাথে বন্ধুত্বটা আজকের না। সেই ছেলেবেলার, শুধু ধারা এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বিধায় সেও ভর্তি হয়েছে। দুজন দুজনকে ছাড়া চলতে পারে না। যতই দিগন্ত, অভীক, নীরব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোক না কেনো! মাহির সাথে যেনো মনের টানটাই আলাদা। এই যদি আজ মাহি থাকতো তবে মনের মাঝে জন্ম নেওয়া নবাগত ঝড়ের কথাগুলো তাকে বলতে পারতো। অনল ভাইয়ের প্রতি জন্মানো দূর্বলতাগুলোও বলতে পারতো। কিন্তু সে তো নেই, রাগ করে মাধবীর সাথে ঘুরছে। ধারা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এদিকে সামনের দুটো বা’দ’রের মুখ টকের কারণে বিকৃত হয়ে গিয়েছে। তবুও হাল ছাড়ছে না। আজ একজনের বাকি পরিশোধ হবেই। এর মাঝে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় মাহি। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“কথা আছে”

মাহির কথাটা শুনতেই কিছুটা বিস্মিত হয় ধারা। কিছুসময় ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে। অপরদিকে অভীক এবং দিগন্তে নিজেদের প্রতিযোগিতা থামিয়ে দেয়। মাহি এবং ধারার ভেতরে বরফ গলছে। আজ তিনদিন পর মাহি ধারার সাথে কথা বলছে! এ যেনো আশ্চর্য! ধারা মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। ধারা দাঁড়াতেই মাহি বেড়িয়ে যায়। ধারাও পিছু নেয় মাহির। দিগন্ত লেবুর সপ্তম পিছ মুখে তুলতে তুলতে বলে,
“যাক, মাহি চু’ন্নীর সুবুদ্ধি হইছে”

বিল্ডিং পাশের সিড়িতে এসে বসে মাহি। ধারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বারবার ব্যাগের ফিতা টানছে। মাহি তীর্যক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“কিছুই বলার নেই তোর?”
“কি বলবো?”

উলটো তেজ দেখিয়ে কথাটা বলে ধারা। মাহি ভ্রু কুচকায়। বিরক্তি যেনো বাড়লো। কন্ঠ আরোও ঝাঁঝালো করে বললো,
“বিয়ের কথাটা লুকালি কেনো? তুই তো জানতি আমি অনল ভাই এর প্রতি দূর্বল। উনত্রিশ বার তাকে চিঠি দিয়েছি।আর প্রতিবার সেটা ব্যার্থ হয়েছে। তুই যদি না লুকাতি সেটা আঠাশ বার ই হতো। ন্যাড়ার মতো সরাসরি আমি অনল ভাইকে প্রপোজ করতাম না”
“সেটা বলার জন্য তো ফোন করেছিলাম, ধরেছিলি! যেয়ে বসেছিলি মাধবীর পাশে। তা এখন শুনবি কেন?”

ধারাও কম নয়, সে তার রাগ অক্ষত রেখে কথাটা বললো। মাহি মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর শান্ত গলায় বললো,
“ক্ষোভ হয়েছিলো। অপমানিত, লজ্জিত হবার ক্ষোভ। এখন সেটা ঠান্ডা হয়েছে তাই শুনতে চাচ্ছি। বান্ধবীর উপর এটুকু ক্ষোভ তো হতেই পারে! ভেবেছিলাম, রাগ করলে তুই ও ভাঙ্গাবী। কিন্তু উলটো তুই ও ভাব মারতেছিস। নেহাত হারাতে চাই না এই বন্ধুত্ব। তাই নিজের ক্ষোভের আগুনে পানিটাও নিজেই ঢাললাম। যতই হোক, আমার তো আর বান্ধবী নেই”

মাহির কথাটা শুনে নিজেকে আটকাতে পারলো না ধারা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কন্ঠে বললো,
“তুই ই তো আমার ফোন ধরিস নি, জানিস আমি কতো ফোন করেছি। তোর জন্য চকলেট ও নিয়ে এসেছিলাম৷ উলটো তুই মাধবীর সাথে গিয়ে বসলি। আমার ও রাগ হলো। সরি”

দুই বান্ধবীর মাঝে জমা অভিমান জল রুপে দুজনের চোখে জমলো। কন্ঠে ভার হলো। মাহিও গলে গেলো, ধারাকে জড়িয়ে ধরলো। কতসময় তারা কাঁদলো জানা নেই। একটা সময় মন শান্ত হলো। দুজন চোখ মুছলো। বান্ধবীদের মাঝে হয়তো অভিমান হবার কোনো যুক্তি থাকে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারেও অভিমান হয়। মাহি নাক টেনে বললো,
“এবার কাহিনী বল”

ধারা সবটুকু খুলে বললো। নানাভাই এর অসুস্থতা, তার জেদ, অনল ধারার বিয়ে এবং সেই বিয়ে লুকানোর কারণ। মাহি শান্ত হয়ে শুনলো। আসলে পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো যে ধারা চাইলেও কিছু বললো না। মাহি বিজ্ঞের মতো সব শুনলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কি ভালোবাসিস অনল ভাই কে”

ধারা চুপ করে রইলো। নিজের মনটাকে অনেক উথাল-পাতাল করলো। মাহি অপেক্ষা করছে উত্তরের। কিছুসময় চুপ করে থেকে ধীর গলায় বললো,
“ভালোবাসা কি আমি জানি না, তবে এটুকু জানি মানুষটাকে কেন্দ্র করেই যেনো আমার সব কিছু। তেরোটা বছর যাকে বিরক্ত লাগলো, দুচোখের বিষ ছিলো। সেই মানুষটাকেই এখন সারাক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে। তার কঠিন মুখশ্রী, গম্ভীর কন্ঠ সব ই আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। অজান্তেই লজ্জা পাই, অজান্তেই হাসি। আবার অজান্তেই অভিমান হয়। প্রণয় আমার কাছে আজও প্রহেলিকা। আমি জানি না প্রণয় কাকে বলে, তবে এটুকু জানি আমি বাজে ভাবে ফেসে গেছি। অনল ভাই যেনো একটা উত্তপ্ত নেশা। আমি প্রতিনিয়ত শুধু ডুবছি আর ডুবছি”

মাহি ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
“বান্ধবী তুমি আসলেই ফেঁসে গেছো। যাক খুশি হলাম অবশেষে তোমার রুচি এবং চোখ ভালো হলো। আমি তো ভেবেছি এখনো ওই প্লাবন ভাইতেই আটকে আছিস। তা অনল ভাই জানে ব্যাপারটা!”
“নাহ, উনাকে দেখলেই তো সব ভাষা উড়ে যায়”

মাহি কিছুসময় ভাবলো৷ তারপর বললো,
“তোর জন্য আমি আমার ব্যর্থ হৃদয়ের জ্বালা ভুলতে রাজি। যাহ, দিলাম তোকে অনল ভাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, যেহেতু অনল ভাই ও বিয়েতে ভেটু দিয়েছিলো তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে সে কি তোকে ভালোবাসে কিনা! তাই আমার মতো ভুল তুই করবি না। আমাদের আগে জানতে হবে অনল ভাইয়ের মনে স্থান নেওয়া সেই নারীটি কে!”
“কিভাবে জানবো! উনি তো উড়িয়ে দেয় কথা। আর আমি এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই ক্যালকুলাস ধরিয়ে বলে অংক কর”
“এটাও আমাকে বলতে হবে? উফফ! আমার নাড়িনক্ষত্র যেমন তুমি জানো। তেমন অনল ভাইয়ের নাড়িনক্ষত্র জানে তার বন্ধুরা। অনল ভাইয়ের বন্ধুদের থেকে জানবি তার কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো কি না! সবার রুচি তো তোর মতো না। আমি শিওর অনল ভাই এর পেছনে মানুষ পাগল ছিলো।”

মাহির কথায় ধারা খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লো। মরা কন্ঠে বললো,
“যদি সত্যি অন্য কাউকে ভালোবাসে অনল ভাই? কি হবে?”
“তুই আমার বান্ধবী, আর নেগেটিভ কথা বলিস কেনো? বি পজেটিভ। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী— মনে রাখবি, তুই অনল ভাইয়ের বউ। যদি কেউ থেকেও থাকে তাকে খেদিয়ে জায়গা করে নিবি”

মাহির কথায় হেসে দিলো ধারা। মনের ভেতর জমা পাথর আজ নেমে গেছে। মনের যখন কথা খুলে বলে আর মনটা হালকা। হয়তো এজন্য এই মানুষগুলোকে বন্ধু বলে।

কেটে গেছে সপ্তাহ, ধারা বায়না ধরলো বাড়িতে প্লাবণ এবং স্মৃতিকে দাওয়াত করবে। সাথে ইকরাম এবং রবিন ও আসবে। বড়মার সম্মতি পেলেও অনলের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মতলব কি তোর?”
“বারে তাদের বিয়ে খেলে, অথচ একটু দাওয়াত করবে না? ছি ছি কি কিপ্টে বন্ধু”

ধারার যুক্তির কাছে উত্তর পেলো না অনল। কিন্তু তার সন্দেহ হলো বেশ। ধারা সুবিধার নয়। যে মেয়ে হলুদের দিন বরের পেট খারাপ করতে পারে না জানি কি বুদ্ধি আটছে। তাই নিজ দায়িত্বে খাবারের উপর নজর দিলো সে। বলা যায় না! দেখা গেলো তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের আবার কোনো ষড়যন্ত্র। অবশেষে শুক্রবারে সবাই দুপুরে জমায়াত হলো। আড্ডা, গল্পে মুখরিত বাড়ি। জামাল সাহেব রবিনকে দেখে বললো,
“কি রে, তোমার পাশ হইছে?”

রবিন এই বন্ধুমহলের ফেলু ছাত্র। জামাল সাহেবের কথায় লজ্জা না পেয়ে সরাসরি বললো,
“আপনার নাতি ছিলো, তাই তো এখন খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি”

খাবার পর ছাঁদে চায়ের আড্ডা বসলো। স্মৃতির সাথে বেশ সখ্যতা হলো ধারার। আড্ডা জমলো। ভার্সিটির কুকীর্তি, সুকীর্তি নানা গল্প উঠলো ধোঁয়ার সাথে। এর মাঝে অনলের ফোন বাজলো। কথা বললে সে একটু দূরে গেলো। সেই ফাঁকে প্রশ্ন করলো ধারা,
“আচ্ছা, অনল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ছিলো না?”

ধারার প্রশ্নে হেসে দিলো প্লাবণ এবং ইকরাম। হাসি থামিয়ে প্লাবণ বললো,
“কেনো জলধারা, বরের তথ্য নিচ্ছো বুঝি!”
“নিতেই পারি”
“চিন্তা করো না, তোমার বরটি ছিলো কষা মানুষ, নিরস না’রী’বি’দ্বে’ষী। কোনো নারীর গা ঘেষা দূরে থাক কথাও বলতো না। তাই নিশ্চিন্তে থাকো। তার কোনো মেয়ে ঘটিত কেলেঙ্কারি নেই”

ইকরাম ও সহমত দিলো। কিন্তু এর মাঝেই রবিন গম্ভীর মুখে বললো,
“সব রটনা, অনন্যার কথা ভুলে গেলে চলবে। আরে ফিজিক্সের টপার অনন্যা……#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৭তম_পর্ব

ইকরাম ও সহমত দিলো। কিন্তু এর মাঝেই রবিন গম্ভীর মুখে বললো,
“সব রটনা, অনন্যার কথা ভুলে গেলে চলবে। আরে ফিজিক্সের টপার অনন্যা”

রবিনের কথাটা যেনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টির আকাশের বিশ্রী বজ্রপাতের মতো ঠেকলো ধারার নিকটা। প্লাবনের কথায় যাও একটু স্বস্তি পেয়েছিলো। সেই স্বস্তিখানা স্থায়ী হলো না। যাও একটু শান্তির প্রহর বইছিলো হৃদয়ে সেটুকু একারেই নষ্ট করে দিলো সামনে থাকা চায়ের মাঝে বিস্কিট ডুবিয়ে খাওয়া মানুষটি। নিজের অনুভূতির লহর কোনো মতে আটকে আমতা আমতা গলায় ধারা বললো,
“টপার অ..অনন্যা কে?”

রবিন তখনও বিস্কিট খাচ্ছে। তার উত্তর দেবার আগেই ইকরাম মুখ বাকিয়ে বললো,
“ও, আমরা তো জানতাম ই না! তুমি জানলা কেমনে? অফ যা গা’ধা, আজাইরা। ধারা ওর কথা কানে তুলো না। অনন্যার সাথে অনলের কিছুই ছিলো না”
“নিজেকে কি অন্তিম মাহমুদ ভাবিস! খুব না একেবারে! তোরা গা’ধা। অনন্যা যে অনলের জন্য প্রতিদিন রান্না করে আনতো সেবেলা? শোনো ধারা, তোমার কষা বড় আর টপার অনন্যার কঠিন সিন ছিলো। এখন এদের কথা যদি বিশ্বাস করে আমাকে অবিশ্বাস করো সেটা তোমার ব্যাপার”

ইকরামকে সম্পূর্ণ থামিয়ে নির্লিপ্ত চিত্তে কথাখানা বললো রবিন। ধারা পড়লো মহা বিপাকে। বুকের অন্তস্থলে “সানজিদা” এর মতো ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। ভীষণ মাত্রা তার। হৃদয়ের আঙ্গিনায় সবকিছু উথাল পাতাল করে দিচ্ছে। সেই ঘূর্ণিঝড়ে কিশোরী মনে নব্য ফুটন্ত প্রণয় হারাবার ভয় উঁকি দিলো। নিকষকালো বিশ্রী ভয়। এতো কিছুর মাঝে ধারা আবারো অনুভব করলো সে সত্যিই প্রণয়ের বীজ বুনছে, অনল নামক প্রণয় বীজ। মাহির উপদেশ খানা স্মরণ করে বুকে একরাশ সাহস সঞ্চয় করলো সে। রবিনের মুখোমুখি হয়ে বললো,
“করলাম বিশ্বাস, এবার বলেই এই টপার অনন্যা কে?”
“তাহলে শোনো, ভার্সিটিতে আমি, অনল আর ইকরাম ছিলাম গণিতের ছাত্র। আর প্লাবণ ছিলো ফিজিক্সের। প্লাবণের সাথে পরিচয় হয়েছিলো অনলের মাধ্যমে। আমাদের ৪ জনের বন্ধুত্ব বেশ কড়া হলো। তখন একদিন টপার অনন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো প্লাবণ। অনন্যা ছিলো ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট গার্ল। মেয়েটি যেমন গুনে তেমন রুপে। আমাদের ভার্সিটির সব থেকে সুন্দরী নারী ছিলো সে। সিনিয়র, জুনিয়র, ক্লাসমেট সবাই ওর উপর ফিদা। তাহলে অনল কি জিনিস। তবুও তোমার বরের আলগা ঢং, সে প্রথমে অনন্যার সাথে কোনো কথা বলতো না। তবে অনন্যার মতে যে তার প্রতি কিছু কিছু আছে সেটা ভালোই বুঝা যেতো। অনন্যা অনলের সাথে হেসে কথা বলতো, তার কাছে অহেতুক গণিত বুঝতো। সেকারণে তাদের সখ্যতাও একটু বাড়লো। তারপর এলো সেই মূহুর্ত যখন তাদের এই সখ্যতা ভালোলাগায় পরিণত হলো”
“যা ব্যাটা, যাচ্ছে তাই”

রবিনের সুন্দর গোছানো গল্পে ভেটু দিলো প্লাবণ। বিরক্তিতে তার কপাল কুচকে আছে। রবিন উলটো প্রশ্ন করলো,
“একটা কথাও কি মিথ্যে ছিলো?”
“মিথ্যা ছিলো না, তবে যেমনে বলছিস সখ্যতা ভালোলাগায় পরিণত হলো এমন কিছুই হয় নি। হয়তো অনন্যা ওকে পছন্দ করতো কিন্তু অনল নয়”
“প্লাবণ দু মিনিট একটু থামেন, রবিন ভাই শেষ করেন।”

ধারা কঠিন আগ্রহ নিয়ে প্লাবণকে থামালো। প্লাবণ মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রবিন আবারো নিজেকে শ্রেষ্ঠ গল্পকারে পরিণত করলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“যা বলছিলাম, তখন ইন্ট্রা ভার্সিটি একটা প্রোগ্রাম হলো। কম্পিটিশন বলতেই পারো, সেখানে আমাদের ভার্সিটি থেকে একটা টিম গেলো। সেই টিমে ছিলো আমাদের অনল, অনন্যা, সিএসসি একটা ছেলে আর মাইক্রোবায়োলজির একটা ছেলে। সেই কম্পিটিশনের পর যেনো সব বদলে গেলো। লাইব্রেরিতে অনল এবং অনন্যাকে দেখা যেতে লাগলো। অকারণে অনন্যা আমাদের সাথে আড্ডা দিতো। আহা! অনন্যার রান্নার কি স্কিল ছিলো! পোস্ত ইলিশ, বোয়াল মাছের তরকারি, বেগুন ভর্তা, গরুর কালোভুনা। অনলের জন্য ও রান্না করে আনতো। আর সেই উছিলায় আমরা খেতাম। ভার্সিটির সবাই জানতো এদের মাঝে কিছু তো চলছে। দুজন ই টপার, দুজন সুন্দর, একেবারে তাহসান-মিথিলা। কিন্তু ওই যে তাহসান-মিথিলার মতো ওদের জুটিও টিকলো না। ফোর্থ ইয়ারে কিছু একটা তো হলো! দুজন দুজনকে দেখেও অদেখা ভাব দিতো। অনলকে কতবার জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিলো না। তারপর সেমেস্টার ফাইনাল শেষ হলো। অনল আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলো। অনন্যাও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট৷ ভাবলাম এবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না! অনন্যা পারি দিলো অস্ট্রেলিয়া। আর সেই সুযোগে প্লাবণ হইলো টিচার৷ নয়তো এই প্লাবণের বেল ই ছিলো না। আহারে! অনন্যার রান্না, ওদের এই ঝামেলায় শা’লা আমার পেটে লা’থি পড়লো”

রবিন আফসোসের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধারার গোলমুখটা লম্বা থেকে লম্বাটে হচ্ছে। উজ্জ্বল মুখশ্রীতে আষাঢ়ের মেঘমেদুর জমেছে। অনন্যার বর্ণনায় সে মোটামুটি বুঝে গেছে সে ছিলো আদ্যোপান্ত কেট মিডলটন। প্রিন্স উইলিয়ামের সাথে যে তাকেই মানায়। ধারার কৃষ্ণ মুখশ্রীটা স্মৃতির চোখে পড়লো। সে এই গুমোট পরিবেশ হালকা করতে বলে উঠলো,
“রবিনের বাজে কথাগুলো শুনো না। এই যে কাহিনী ছিলো এটা ওর অলস মস্তিষ্কের বানোয়াট ছাড়া কিছু না! হতেই পারে অনন্যার সাথে অনলের খুব ভালো খাতির ছিলো। মাঝে মাঝে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। তবে সেই বন্ধুত্বকে প্রণয়ের পরিচয় দিতে হবে এটা তো ঠিক নয়। আর অনল যথেষ্ট স্ট্রেটকাট ছেলে, ওর মাঝে এই লুকোচুরি ব্যাপারটা নেই। যদি অনন্যা ভালোই লাগতো অন্তত প্লাবণ জানতো”
“হ্যা, আমি তো জানতাম অনল আমার থেকে কিছু লুকায় না”

স্মৃতির কথায় যোগদান করলো প্লাবণ। ধারা তবুও কেনো যেনো আশ্বস্ত হতে পারলো না। অনলকে সে যতবার জিজ্ঞেস করেছে সে বিচিত্র হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেছে। তাই তার হৃদয়ের কথাটা এখনো যে অজানা। সবার দৃষ্টি তার দিকে বিধায় খানিকটা জোরপূর্বক হাসলো সে। নরম গলায় বললো,
“আরে! আমাকে নিয়ে পড়লে কেনো! আমি তো জানি রবিন ভাই কেমন গল্প বানায়৷ ঢোপ দেওয়ায় তার উপরে কেউ নেই। আমি তো শুধু শুনছিলাম সে কতো দূর যেতে পারে৷ গল্পের সিড়ি যে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে এটা ভাবি নি”
“তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করলে ধারা?”

হতাশামিশ্রিত কন্ঠে রবিন বললো। ঠিক তখন ই আগমন ঘটলো অনলের। ভ্রু কুচকে চাঁপা স্বরে বললো,
“কে অবিশ্বাস করছে তোকে?”
“তোর এই স্বার্থপর বন্ধুরা এবং তোর এই পিচ্চি বউ”
“কেনো?”
“কেনো আবার! তোর আর অনন্যার মধ্যে যে সিন ছিলো মোটেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না”

অনন্যার নাম শুনতেই অনলের হাসি মিলিয়ে গেলো। প্রসন্ন মুখখানা কঠিন হয়ে উঠলো মূহুর্ত। বহু বছর বাদে এই নামটা শুনবে আশা করে নি। ভ্রু জোড়া আরোও বেশি কুঞ্চিত হলো। চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো রবিনের দিকে। রবিন তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো। কারণ অনন্যার নাম উঠলেই এই বান্দার মুখের রঙ পালটে যায়। অনল আঙ্গুলের ঢগা দিয়ে কপাল ঘষলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“অপ্রয়োজনীয় কথা বলাটা তোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্বভাবটা বাদ দে। বয়স তো হচ্ছে, একটু বড় হ”
“কেনো, পুড়লো বুঝি!”

রবিন বাঁকা হেসে কথাটা বললো। অনল ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। দূর্বোধ্য সেই হাসি। কেউ না বুঝলেও এই হাসির অর্থ প্লাবণ জানে। অনলের এই হাসির অর্থ “বেশি বকিস না, মা’র একটাও মাটিতে পড়বে না”। অনল ধারার পাশে বসলো। একটা ক্লিপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শোন ধারা, কিছু মানুষের সব কথা বিশ্বাস্য, কিছু মানুষের অর্ধেক। আর রবিন প্রজাতির সব কথাই অবিশ্বাস্য। যা বলে এক কান দিয়ে শুনবি আর আরেক কান থেকে বের করে দিবি। চুল উড়ছে তোর, বেঁধে নে”

ধারা ক্লিপ্টা হাতে নিলো। খোলা অবাধ্য চুলগুলো খোঁপায় বাধলো। ইকরাম থমথমে পরিবেশ হালকা করতে আড্ডার মোড় ঘোরালো। আড্ডা আবারো জমলো। অনল ও তার কঠিন মুখশ্রী স্বাভাবিক করে নিলো। সন্ধ্যার চা নাস্তার পর বন্ধুমহল বিদায় নিলো। যাবার সময় প্লাবণ বরাবরের মতো ধারার হাতে দুটো ইকলেয়ারস ধরিয়ে বললো,
“রবিনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো জলধারা। তুমি এবং অনল আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমি চাই তোমরা সুখী হও৷ এখন একসাথে হবে না আলাদা সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে এইসব উটকো চিন্তার জন্য নিজেদের মাঝে দূরত্ব করো না”

প্লাবণের কথার মর্মার্থ ভালো করেই বুঝতে পারলো ধারা। প্রত্যুত্তরে কেবল হাসলো সে। তবে ক্ষীণ খচখচানিটা যেনো রয়েই গেলো, হয়তো নিজ সুপ্ত প্রণয়ের মানুষটিকে হারানোর ভয় ই এই খচখচানি________

ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে৷ ধারাদের বাসায় সাড়ে নয়টার দিকেই খাবার খাওয়ার প্রথা। জামাল সাহেব তাড়াতাড়ি খান। এবং তিনি একা খাওয়া পছন্দ করেন না। বাড়ির প্রতিটি প্রাণীর তার সাথেই বসে খেতে হবে। সেটা তার ক্ষুদা লাগুক বা না লাগুক। যদি তখন না খাওয়া হয় তবে তার খেতে হবে একা। কেউ তার অপেক্ষা করবে না। এতো বছরেও এই প্রথা বদলায় নি। আজও তাই হলো। সবার খাবার ঠিক সাড়ে নয়টায় ই শেষ। শুধু অনল বাদে। বন্ধুদের যাবার পর থেকেই বান্দা ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। আড্ডার মাঝে ফোন এসেছিলো ভার্সিটি থেকে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে তাকে। সেটাই করছে সে। ধারা দু চার ডেকেছিলো কিন্তু বান্দা উত্তর দেয় নি। সে তার ল্যাপটপেই মাথা ডুকিয়ে রেখেছে। অবশেষে হতাশ হয়ে খেতে চলে গেলো সে।

খাবার শেষে প্লেট হাতে রুমে ঢুকলো ধারা। বড় মা ছেলের চিন্তায় দিশেহারা। তাই ধারার হাতেই খাবার পাঠিয়েছে। ধারাও মানা করতে পারলো। কারণ তার ও চিন্তা হয় লোকটির জন্য। রুমে প্রবেশ করতে দেখা গেলো অনল তখন ও তার কাজে ব্যাস্ত। ধারা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“ল্যাপটপটির যদি মুখ থাকতো তবে সে মানবাধিকার মা’ম’লা করতো তোমার নামে। সেই কখন থেকে এর উপর অত্যাচার চালাচ্ছো। এবার ক্ষান্ত দেও”
“কালকে এই ফাইল অফিসে জমা দিতে হবে। হেড স্যারের ফোন ছিলো। মিটিং আছে”
“অসব বুঝি না, খেয়ে নাও। বড় মা খাবার পাঠিয়েছে”
“খাইয়ে দে”

ল্যাপটপ থেকে মাথা না তুলেই নির্বিকার ভাবে কথাটা বললো অনল। ধারা অবাক চোখে তাকালো অনলের দিকে। অনলের মুখ থেকে এমন কোনো কথা অত্যন্ত আকষ্মিক ঠেকলো। সে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। ঘরে আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে অনল আবার বললো,
“কি হলো, খাইয়ে দে”
“তোমার হাত নেই?”
“কাজ করছি তো ধারা”

এবার চোখ তুললো অনল। অসহায় চাহনীতে তাকালো ধারার দিকে। যেনো যে সেই দুর্ভিক্ষের মানুষটি যে এখন ই না খেলে জ্ঞান হারাবে। কিন্তু তার কাজ ফেলে খাওয়াটা হবে পাপ। তাই সে নিরুপায়। ধারা কিছু বললো না, চেয়ারটা টেনে অনলের পাশে বসলো। লোকমা তুলে লোকটির মুখের সামনে তুললো। লোকটি ও দিব্বি খেতে খেতে মনোযোগী হলো কাজে। ধারার মনে হলো সময়টা যদি থেমে যেতো তবে হয়তো মন্দ হতো না। এ যেনো অন্যরকম ভালোলাগা৷ এক অন্যরকম শিহরণ। প্রিয় মানুষটার আশেপাশে থাকতেও বোধহয় ভালো লাগে। ধারার মন আকাশে যেনো এক পশলা বৃষ্টির পর রঙ্গিন রংধনু উঠেছে। ধারা সবটুকু খাবার অনলকে খাওয়িয়ে দিলো। আর অনল বিনা অভিযোগে খেয়েও নিলো। ধারা বেশ অবাক হলো, কারণ অনল একটি বার ও করলা ভাজি নিয়ে অভিযোগ করে নি। যেখানে তার অতীব অপছন্দের খাবার সেটা। ধারা যখন খাবার খাওয়ানোর পর উঠে যেতে নিলো তখন হাতখানা টেনে ধরলো অনলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“একটু বসবি, কিছু বলার ছিলো”………..
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৮তম_পর্ব

ধারা সবটুকু খাবার অনলকে খাওয়িয়ে দিলো। আর অনল বিনা অভিযোগে খেয়েও নিলো। ধারা বেশ অবাক হলো, কারণ অনল একটি বার ও করলা ভাজি নিয়ে অভিযোগ করে নি। যেখানে তার অতীব অপছন্দের খাবার সেটা। ধারা যখন খাবার খাওয়ানোর পর উঠে যেতে নিলো তখন হাতখানা টেনে ধরলো অনলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“একটু বসবি, কিছু বলার ছিলো”

অনলের বলার ধরণটা অন্যরকম ঠেকলো ধারার কাছে। কি বলার থাকতে পারে অনল ভাইয়ের! মূহুর্তেই হাজারো চিন্তা দলা পাকালো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে। আচ্ছা, অনল ভাইয়ের বন্ধুদের বিনা নোটিশে নিমন্ত্রণের জেদের কথাটা তুলবে নাকি অনন্যা আপুর ব্যাপারে কিছু বলবে! অনন্যার কথা স্মরণ হতেই মুখখানা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ধারার। সে ঈষৎ ঘাবড়ালো। ঠোঁট জোড়া ভিজালো৷ তারপর চোখ ছোট ছোট করে সুঁচালো নজরে নিপুনভাবে খুতিয়ে দেখতে লাগলো অনলকে। অনলের মুখশ্রী নির্বিকার। চোখ বরাবরের মতো শান্ত। চাহনী শীতল। ফলে মুখশ্রী দেখে অনলভাই এর মনের খবর জানার অভিযান ব্যর্থ হলো। নাহ! এখানে বসে থাকাটা সুবিধের হবে না। তাই ধারা নরম গলায় বললো,
“হাতটা ধুয়ে আসি? এটো হাতে বসতে ভালো লাগে না”
“বেশ, তাড়াতাড়ি আয়। আর শোন পালাবার চেষ্টা করবি না। সোজা হাত ধুয়ে এখানে আসবি”

অনল আবারো ল্যাপটপে নজর দিলো৷ তবে ধারার মনে হলো অনলের মৃদু কন্ঠটি ঈষৎ কঠিন হয়ে গেলো। ধারা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো, সে পালাবে না। মাঝে মাঝে ধারা বেশ অবাক হয়! তার মনের খবর লোকটি কিভাবে বুঝে যায়! পালাবার ফন্দিই করছিলো ধারা। ভেবেছিলো প্লেট রাখার নামে বড়মার ঘরে চলে যাবে অথবা বি’চ্ছু গুলোর ঘরে আশ্রয় নিবে। কিন্তু হলো না। ফলে ভদ্র মানুষের মতো প্লেট রেখে, হাত ধুয়েই আবার ফেরত আসতে হলো।

ধারা অনলের সম্মুখে বসে আছে, অনল ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে ধারার দিকে চেয়ে আছে সে। সময় পার হচ্ছে এবং ধারার মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধ ঘরটি এবং অনলের শান্ত চাহনী যেনো তাকে ক্রমশ গি’লে খা’চ্ছে। চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং ঈষৎ ভয়ের দরুন দাঁত নিয়ে নখ কামড়াতে লাগলো সে। তখনই অনলের তীক্ষ্ণ স্বর কানে এলো,
“নখ কামড়াস বলেই তুই দিন দিন আরোও বেশি স্টু’পি’ড হয়ে যাচ্ছিস। সাধে কি ফেলুরানী বলি”

সাথে সাথেই হাত নামিয়ে নিলো ধারা। আমতা আমতা করে বললো,
“কি জানে বলবে বলছিলে!”
“আজ হুট করে আমার বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছিলি কেনো? মতলব কি ছিল?”

ধারা যে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো। অনল সেই প্রশ্নই করলো, কেনো বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হলো। মাস্টারমশাই এর শ’কু’নী চোখ থেকে বাঁচা অসম্ভব৷ ধারাও কম নয়, নিজের প্রতিরক্ষার উত্তর তৈরি। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“নতুন দম্পতিকে দাওয়াত করতে মন চাইলো, তাই করেছি। বাহ রে! তাদের বাড়ি তিনটে দিন খেয়ে দেয়ে এসেছি এটুকু তো করাই যায়। এটাকে কার্টেসি বলে। আর প্লাবণ ভাই আর স্মৃতি আপু থাকবে তাহলে ইকরাম ভাই আর রবিন ভাই বাদ কেনো যাবে! তাই দাওয়াত দিলাম”
“সত্যি?”

অনলের চাহনী ক্রমশ সূঁচালো হলো। ধারা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“হু”
“না আমি ভাবলাম তোর আমার অতীত ঘাটার শখ হয়েছিলো। তাই ওদের ডেকেছিস। ওদের থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সব নাড়িনক্ষত্র জানবি। ভুল ছিলাম তাহলে। অবশ্য তুই কি এতো ব’ল’দ নাকি! তোর কাছে তো এখনো দুখানা ইচ্ছে বাকি আছেই। চাইলেই সে দুটো সহজেই ব্যাবহার করে আমার থেকেই সব জানতে পারতি। নিশ্চয়ই আমার খবর আমার থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না”
“তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই তুমি বলে দিবে?”

ধারা প্রশ্নটি করতেই জিহ্বা কাটলো। অনলের ফাঁদে সে পা দিয়ে দিয়েছে। অনল ঠোঁট চওড়া হলো। বাকা হেসে বললো,
“বউ এর দেখি আমার সম্পর্কে বিস্তার কৌতুহল! তা এতো তাল না করে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতি!”
“তুমি তো খালি এড়িয়ে যাও”
“তা এই বিশাল তথ্য যোগাড় করার কারণ জানতে পারি”

ধারা চুপ করে রইলো। কারণ তো আছেই, কিন্তু সেটা গলা অবধি এসেই দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মুখে বলতে পারছে না সে। নিজের প্রণয়ের মানুষের বিস্তারিত খোঁজ দেওয়া মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু হুট করেই এই কথাটা জাহির করা যায় না। যেখানে প্রথম থেকে সেই এই মানুষটির বিরোধিতা করে এসেছে। ধারা আমতা আমতা করে বললো,
“রুমমেট সম্পর্কে কৌতুহল হওয়া কি খারাপ কিছু?”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর ধারার নাকটা একটু টেনে বললো,
“এতো বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কি করে! যাক, আমার ইহকালে কোনো নারীর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। অনন্যা আমার খুব ই ভালো বান্ধবী ছিলো বটে। কিন্তু সেই বন্ধুত্বটা আর নেই। কারণ স্বার্থপর মানুষ আমার অপছন্দ। বন্ধুত্বের নামে যদি সে আমাকে ব্যাবহার করে তবে আমি তো মেনে নিবো না। একারণেই শেষ কটা দিন সেই মেয়েটির মুখদর্শন ও করি নি আমি। তাই নিজের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের নষ্ট চিন্তা গুলো ঝেড়ে ফেলো ফেলুরানী”

অনলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ধারা। পেটের মধ্যে হাজারো প্রজাপতি যেনো ডানা মেলেছে। মনের এক কোনায় জমে থাকা খচখচানিটা নিমিষেই বাস্পে পরিণত হচ্ছে। মূর্ছা যাওয়া প্রণয় পুষ্পটি এক পশলা শীতল বৃষ্টির ছোঁয়া জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অজান্তেই তার ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু পরমূহুর্তেই মাহির কথাটা মনে পড়লো ধারার। সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
“তাহলে মাহিকে কেনো বললে “এক হৃদয়ে দু নারীর স্থান হয় না”? তোমার হৃদয়ে স্থান পাওয়া নারীটি কে?”
“তোর কি মনে হয়?”

ধারার চঞ্চল চোখে চোখ রেখে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করলো অনল। তার চাহনী আরোও শান্ত, স্থির। ঠোঁটের কোনে বিচিত্র হাসি। ধারা কিছুসময় তাকিয়ে থাকলো অনলের চোখের দিকে। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করাটা যেনো একটা বিশ্রী স্বভাব অনলের। এই স্বভাবটি অতীব অপছন্দের ধারার। মূহুর্তেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে হিনহিনে স্বরে ধারা বললো,
“আমি কি অন্তর্যামী? না বললে তোমার মনের কথা কিভাবে বুঝবো! আমি তো তোমার মনে বসে নেই!”

অনলের হাসিটা যেনো চওড়া হলো। দূর্বোধ্য সেই হাসি। তারপর উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানার বালিশটা ঠিক করতে করতে বললো,
“ওটা ফাও বলেছিলাম, যেনো মাহি আমাকে আর উত্যোক্ত না করে। নারী মানেই আস্তো ঝামেলা, যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল”

তারপর শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে প্রায় সাথে সাথেই আবার খুললো, মাথা উঁচিয়ে বললো,
“তোর তিনটে ইচ্ছে ফিট্টুস, আর একটা আছে। বুঝে শুনে খরচা করিস”
“একটা কেনো! দুটো আছে”
“সামান্য যোগ, বিয়োগেও তুই কাঁচা। সাধে কি ফেলুরানী বলি? সেদিন যে রিসোর্টে নিয়ে গেলাম সে বেলা! ওখানে তো একটা ইচ্ছে শেষ”
“এটা কিন্তু চিটিং”
“আন্দোলন কর তাহলে”

বলেই কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লো অনল। ধারা সেখানেই বসে রইলো। কিছুসময় চোখের দৃষ্টিতে ক্রোধানল উগরালো। কিন্তু লাভ হলো না। লোকটি দিব্ব্যি ঘুম। পরমূহুর্তেই শান্ত হলো সে। আনমনেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো। যাক ময়দান ফাঁকা, এবার শুধু গোল করা বাকি_________

*****

জ্যৈষ্ঠের শেষ দিন, জ্বালাময়ী গরম। মাথার উপর ঘুরন্ত ফ্যানটিও যেনো শান্তি দিতে পারছে না। সর্বোচ্চ স্পিডে ঘুরছে তবে গরম একবিন্দু কমছে না। তরতর করে ঘামছে ধারা। সামনে থাকা গরম চা টা যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত জিনিস মনে হচ্ছে। তবুও সে সেটা খাচ্ছে। আর খাতায় গণিত কষছে। শনিবার বিধায় ভার্সিটি বন্ধ। তবুও শান্তি দেয় নি প্রিন্স উইলিয়াম। নাস্তা গলা থেকে নামার আগেই গম্ভীর স্বরে বললো,
“খেয়েই পড়তে বসবি”

বড় মা যা একটু প্রতিবাদ করতে চাইলেন কিন্তু ছেলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে চুপসে গেলেন। তাই বাধ্য হয়েই মুখ ফুলিয়ে পড়তে বসেছে ধারা। কখন থেকে এক চ্যাপ্টারের ম্যাথ ই করছে কিন্তু কিছুই পারছে না। লিনিয়ার এলজ্যাবরা টি পৃথিবীর সবথেকে বড় শত্রু হয়ে গিয়েছে। যা একটু ফেসবুকে ঢু মারবে সেটাও হলো না। প্রিন্স উইলিয়াম মোবাইল নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে। এর মাঝেই উপস্থিত হলো এশা এবং আশা। তাদের হাতে হাইয়ার ম্যাথের বই এবং খাতা। তাদের দেখেই ধারার চোখ চকচক করে উঠলো। অনল তাদের দেখেই ভ্রু কুচকালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কি চাই?”
“মা পাঠিয়েছে”

বলেই আঠাশটা দাঁত বের করে হাসলো৷ যার অর্থ “আমাদের পড়াও”। অনল কপাল ঘষলো বা হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে। এই দুজনকে পড়ানো মানেই মাথার পোকা বের করে দেওয়া। যত দুনিয়ার আজিব প্রশ্ন আছে সব করবে। আপাতত তিনটে স্যার হাতে পায়ে ধরে পালিয়েছে। তারা নাকে খড় দিয়ে বলেছে,
“ম’রে গেলেও এদের পড়াবে না।”

ফলে যতবার ই ইলিয়াস কোনো নতুন স্যারের খোঁজ পাচ্ছে তারা প্রথমেই জিজ্ঞেস করছে,
“এটা কি সেই এশা আশা”

ইলিয়াস অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,
“সেই এশা আশা বলতে?”
“যাদের বাড়ি থেকে শিক্ষক পালায়”

ইলিয়াসের বুঝতে বাকি থাকে না, এই মহল্লায় তার মেয়েদের বেশ নাম হয়েছে। সুতরাং তাদের পড়ানোর জন্য মাস্টার পাওয়াটা দুষ্কর ই নয়, অসম্ভব। ফলে রুবি অনলকে অনুরোধ করেছে যেনো মেয়েদুটোকে ছুটির দিন পড়াতে৷ অনল মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
“মুখ বন্ধ করে ধারার পাশে যেয়ে বসবি। যা করতে বলবো চুপ করে করবি। টু শব্দ করেছিস তো কান টেনে লম্বা করে দিবো।”
“মুখ বন্ধ করলে প্রশ্ন করবো কিভাবে? আর প্রশ্ন না করলে শিখবো কিভাবে অনল ভাই? তুমি না মাষ্টার? তুমি এটাও জানো না! বাচ্চাদের প্রশ্ন করতে হয়। নয়তো ওরা হয় গা’ধা। কারণ গা’ধারা প্রশ্ন করে না”

এশার সাথে সহমত জানিয়ে আশা বলে উঠলো,
“আজ যদি নিউটন প্রশ্ন না করতো তাহলে তো মহাকর্ষ আবিষ্কার হতো না। অনল ভাই তুমি আমাদের হতাশ করলে”

আশার কথাটা শেষ হলো না তার পূর্বেই অনল বি’চ্ছু জমজের কান দুটো টেনে ধরলো, তারপর বললো,
“প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস?”
“আহ! লাগছে, সরি সরি”
“মনে থাকে যেন”

বলেই কানটা ছেড়ে দিলো অনল। এশা কান ডলতে ডলতে স্বর খাঁদে নামিয়ে হতাশার সাথে বললো,
“বুঝলি আশা, এই পাষান দুনিয়ায় বরাবর ই দূর্বলের উপর সবলের রাজত্ব। আজ আমরা নিরুপায় বলে। মায়ের ভয় না থাকলে এই পুথিগত বিদ্যার স্যারের কাছে আসতে হতো না”
“ঠিক”

বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশা। অনল তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কিছু বললি!”
“না, না”

বলেই ভেতরে যেয়ে বসলো তারা। অনল পড়ানো শুরু করলো। আধা ঘন্টা পর ই তিনজনের অবস্থা নাজেহাল৷ কোনো মতে ছুটে পালাতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতো। কিন্তু লাভ নেই। অনল অনড়, তার ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো না। সে নির্বিকার চিত্তে বসে রয়েছে। তার একের পর এক অংক করতে দিচ্ছে। ধারা অসহায় হয়ে বললো,
“অনল ভাই, ব্রেক দাও। আর মাথায় ঢুকছে না। এর পর বই টাও বলে উঠবে ছাড় মা, কাইন্দে বাঁচি”
“সহমত, আমরাও ব্রেক চাই। এই উৎপাদকে বিশ্লেষণের চোটেই আমরাই বিশ্লেষিত হয়ে যাবো অনল ভাই”

তিনজনের ক্রমশ চিৎকারে হাল ছাড়লো অনল। বিরক্ত কন্ঠে বললো,
“যা পাঁচ মিনিটের ব্রেক”
“পাঁচ মিনিট তো এই ঘর থেকে বের হতেই শেষ হয়ে যাবে”

এশার কথায় তীর্যক চাহনী নিক্ষেপ করলো অনল। ফলে তাদের আন্দোলন সেখানেই থেমে গেলো। এশা ধারার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এই, খা’টা’সের সাথে থাকো কিভাবে?”
“মাঝে মাঝে নিজেকেও একই প্রশ্ন করি”

এর মাঝেই কলিংবেলের শব্দ শোনা গেলো। এশা তখনই ছুটে গেলো সদর দরজায়। দরজা খুলতেই অবাক হলো সে। একজন মধ্যবয়স্ক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা অনলের কাছাকাছি, শুভ্র তার মুখশ্রী, ঠোঁটে অমায়িক হাসি। পরণে কালো পোলো শার্ট এবং গাঢ় নীল ডেনিম জিন্স। হাতে একখানা দামী টাইটানের ঘড়ি। এশা অবাক কন্ঠে অপরিচিত যুবককে জিজ্ঞেস করলো,
“কাকে চাই?”
“এটা কি জামাল চৌধুরীর বাড়ি”
“জ্বী! আপনি কে?”
“আমার নাম দীপ্ত, আমি সেলিম আহমেদের বন্ধুর ছেলে……….

চলবে

(

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here