প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -১৩+১৪+১৫

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৩তম_পর্ব

বই এর উপর ই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ধারা। ল্যাপটপের কাজ শেষে পাশে তাকাতেই দেখলো মহারাণী ঘুমে কাঁদা। গণিতের খাতা কাটাকুটিতে ভরপুর। এর মাঝে ছোট্ট করে লেখা,
“নিরস, কঠিন, খ’চ্চ’র মানব”

অনল লেখাটি দেখে হাসলো। তারপর সব বন্ধ করে ধারাকে তুলে নিলো কোলে। তখনই চোখ মেলে তাকালো ধারা। দুজনের চোখাচোখি হলো। হুট করে এমন চোখ খোলায় অনল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ধারার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বুঝে উঠতে পারছে না কি করা উচিত। তার মুখখানা সেই চোরের মতো হয়ে গেলো যে কিনা চুরি করার আগেই ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু মাস্টারমশাই তো চুরি করতে যাচ্ছিলেন না। তিনি তো শুধু ধারাকে বিছানা অবধি পৌছে দিয়ে যাচ্ছিলেন। অনল বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলো। একবার মনে হলো এখন ই ধারাকে কোল থেকে নামিয়ে দিবে, কিন্তু ব্যাপারটা কি শোভনীয় দেখাবে। আবার মনে হলো ধারার সেই শান্ত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে নিজ কার্য সম্পাদন করবে। কিন্তু দুইটি উপায়ের কোনটি বেছে নিবে বুঝে উঠতে পারলো না। আর ধারার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করাটা যেনো দায় হয়ে উঠেছে। অপরদিকে নিজেকে প্রিন্স উইলিয়ামের কোলে আবিষ্কার করে বেশ বড়সড় ঝটকা খেলো ধারা। অজান্তেই হৃদস্পন্দনের বেগ বাড়লো। বুকটা যেনো হাতুড়ি নিয়ে রীতিমতো জেমস এর গানের তালে ড্রাম বাজাচ্ছে। হাত পা অসাড় হয়ে গেলো ধারার। মেরুদন্ড বেয়ে উষ্ণ রক্ত বয়ে গেলো তার৷ একঅন্যরকম শিহরণে নরম গাল জোড়ায় রক্ত জমতে লাগলো। লজ্জাবতী গাছের সকল লজ্জা যেনো তাকে ঘিরে ধরলো। মার্কেটে অনলকে আকষ্মিকভাবে জড়িয়ে ধরার সময় ও এমনটা অনুভূত হয় নি ধারার। বেশ কিছুক্ষণ প্রিন্স উইলিয়ামের দীঘির মতো শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এই কাজটা যে বড্ড বিপজ্জনক কিছু সেটা টের পেতে সময় নিলো না। হৃদয়ের মধ্যস্থলে যখন অস্বস্তিখানা মাত্রা ছাড়ালো তখনই চোখ বুজে নিলো ধারা। সে এই অদ্ভুত অনুভূতির জোয়ার সামলাতে পারছে না। এক অজানা আতঙ্ক জন্মালো ধারার বুকে। কেনো এই আতঙ্ক! প্রণয়ের শুভারম্ভের নাকি অজান্তেই অনলের চোখে গভীরত্বে বিলীন হয়ে যাবার জানা নেই ধারার। তবে অনুভূতি গুলো অন্যরকম। চুম্বকের ন্যায় এই আকর্ষণ। অজান্তেই প্রিন্স উইলিয়ামের প্রতি এক দূর্বলতা তৈরি হচ্ছে কিশোরী ধারার হৃদয়ের অন্তস্থলে। এই দূর্বলতাটা সে অনুভব করতে পারছে তবে এর উৎস টা তার অজানা। তার মনে হচ্ছে অজান্তেই চোরাবালিতে পা রেখেছে সে, যেখানে তলিয়ে যাওয়া অবধারিত_____

ধারা চোখ বুজে নিলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় অনল। হাফ ছেড়ে যেনো বেঁচেছে সে। সে ভাবলো ধারা হয়তো এখনো ঘুমের মাঝেই। হয়তো চোখ এমনেই খুলেছে, তার ঘুম ভাঙ্গে নি। কথাটা ভাবতেই বিব্রতবোধটা খানিকটা কমলো অনলের। চটজলদি ধারাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো সে। তারপর লাইটটি বন্ধ করে বারান্দায় চলে গেলো। হৃদস্পন্দনের গতি অজান্তেই বেড়ে গেছে। ঘরের নিস্তব্ধতায় শ্বাস নিতেও যেনো অস্বস্তি হচ্ছিলো অনলের। বারান্দার রেলিং দুহাত রেখে কিছুসময় জোরে জোরে শ্বাস নিলো সে। কানজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল একবার পেছনে তাকালো। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্রিমা, রুপালী আলো বারান্দা হয়ে প্রবেশ করছে আঁধারে নিমজ্জিত নিস্তব্ধ ঘরে। আলো আধারের এই মায়াবী খেলায় শুভ্র বিছানায় শায়িত নারীটির দিকে অপলক নজরে তাকিয়ে থাকলো অনল। বুকের অন্তস্থলে এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো তার। পরমূহুর্তেই নজর সরিয়ে নিলো। ঘুমন্ত কিশোরীটি কি যুবকের এই ব্যাথাটি অনুধাবণ করতে পারবে? হয়তো না! তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো অনল। ক্লান্ত চোখজোড়া তাকিয়ে রইলো শূন্য আকাশের সেই পূর্ণ চন্দ্রিমার দিকে। অপেক্ষা সেই প্রহরের, যখন কিশোরী হৃদয়েও প্রণয়ের ফুল ফুটবে_________

********

ধারার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। চোখ মেলে তাকালো সিলিং এর দিকে। মরচে পড়া আদিমযুগের ফ্যানটা ঘুরছে। ক্যাচর ক্যাচর শব্দ হচ্ছে। ফ্যানটা সবসময় এমন শব্দ ই করে, কিন্তু তার অস্তিত্ব শুধু নিস্তব্ধতায় বুঝা যায়। ধারা পাশ ফিরলো। মোটা কোলবালিশের প্রাচীরের ওপারে ঘুমন্ত যুবকের শান্ত মুখশ্রী দেখতে পেলো সে। প্রিন্স উইলিয়ামকে ঘুমন্ত অবস্থায় সবথেকে ভালো লাগে ধারার। নেই কোন তিক্ত বাণী, কঠিন মুখশ্রীটাও শান্ত বাচ্চার মতো স্নিগ্ধ দেখায়। কঠিন মুখশ্রীটা বরাবর ই নির্বিকার ছিলো। তার মনে কি চলতো কখনোই আন্দাজ করতে পারতো না ধারা। তবে এখন পারে, মাঝে মাঝে এই মুখশ্রী বিব্রত হয়, মাঝে মাঝে উৎকন্ঠা দেখা যায়, কখনো গম্ভীর তো কখনো হাস্যজ্জ্বল। প্রিন্স উইলিয়াম ও যে সাধারণ মানুষের মতো আবেগপ্রবণ হতে পারে সেটা আগে না জানলেও এখন জানে ধারা। আনমতেই হাসলো সে। মনের মাঝে এক অবাধ্য চিন্তা মাথাচড়া দিলো। এই ঘুমন্ত শান্ত মুখশ্রীটা একবার ছুয়ে দেখার অবাধ্য ইচ্ছে। পরমূহুর্তেই নিজেকে শাসালো কঠিন ভাবে। মুখের প্রায় কাছে যাওয়া হাতখানা টেনে নিলো। আজকাল অবান্তর ইচ্ছে তার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্কটা জুড়ে প্রকট ভাবে অনলভাই বিস্তার করছে। এটা ঠিক নয়। প্রচন্ড বিপজ্জনক ব্যাপার। মাথা ঝাকালো ধারা। তার অবাধ্য চিন্তাগুলো এক গভীর প্রকোষ্ঠে তালাবদ্ধ করলো। তারপর উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। ধারা চলে যেতেই চোখ খুললো অনল। ঠোঁট খানা বিস্তারিত হলো। ফুটে উঠলো বিচিত্র হাসি_________

ক্যাফেটেরিয়ায় বসেছে বন্ধুমহল। আজ তারা গম্ভীর। কারোর মুখে হাসি নেই। দিগন্ত যে কিনা সর্বদা ব্রেকিং নিউজ দেবার তালে থাকে তার মুখও রক্তশূন্য। ক্যান্টিনের রফিক মামা খানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
“কি গো সামুচা দিবো নি?”

নীরব খানিক থমথমে গলায় বললো,
“না মামা, সামুচায় দুঃখ ঘুচবে না। তুমি বরং ডিম প্যাটিস দাও”
“হইছে টা কি! এমন মুখ লটকায় আছো কেনো? সবগুলোরে দেখে মনে হচ্ছে এক একটারে কেউ পি’ডা’ই’ছে”
“হাতে মা’রে নি মামা! ভাতে মা’রছে”

রফিক মামা খানিকটা অবাক হলেন। তার মুখে কৌতুহল জাগলো। ধারাদের এই দলের সাথে তার খাতির অন্য রকম। সারা ভার্সিটির খবর এই দলের কাছ থেকেই পাওয়া যায় কি না। নীরব হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কন্ঠ বসা। ভারাক্রান্ত গলায় বললো,
“আমাদের নতুন কোর্স টিচার এবার আমাদের নাকানি চুবানি খাওয়িয়ে ছাড়বেন। আমি ব্যাতীত একজন ও পাশ করবে কি না সন্দেহ”

নীরবের কথা শুনে কৌতুহল মরে গেলো রফিক মামার। ভেবেছিলো বড় কোনো খবর কিন্তু এটা তো ভার্সিটির হরহামেশার কথা। ছেলেমেয়ে রিটেক খায় এটা নতুন কি! খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
“এ আবার এমন কি! রিটেক খাইয়ে এক বছর ঝুইলে থাকবা, এটা তো খুব ই নর্মাল। আমি ভাবলাম কি না কি!”

রফিক মামার কথায় আশ্বস্ত হলো না তারা। তারা এখনো আগের মতোই বসে রয়েছে। তাদের ক্লাস এসেসমেন্টের রেজাল্ট দিয়েছে। নীরব ব্যাতীত একজন ও ৪ কিংবা ৫ এর উপরে পায় নি। দিগন্ত ভেবেছিলো সারপ্রাইজ টেস্ট টা হয়তো অনল স্যার বাদ দিবেন কিন্তু সে তা করে নি। এখানেই নম্বর এমন নাজেহাল, মেইন পরীক্ষায় যে কি হবে সেটা নিয়ে এই চারজন খুব ই চিন্তিত। এর মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“এই ব্যাটাকে প্রথম থেকেই বিরক্ত লাগে, কি শত্রুতা কে জানে। অন্তত পক্ষে স্টেপের মার্ক তো দিতেই পারতো। মার্ক চেয়েছি কিডনী তো না”

তার সাথে সম্পূর্ণ সহমত জানালো অভীক। ক্ষোভ জড়ানো স্বরে বললো,
“ব্যাটা, নিজের পার্সোনাল লাইফের ক্ষোভ আমাদের উপর দিয়ে মিটায়। শান্তি পাবে না দেখিস। চিন্তা কর ধারার মামাতো ভাই অথচ ওকে সবচেয়ে কম দিয়েছে, তিন। এটা কোনো বিচার! দেখিস এই লোক জীবনে সুখী হবে না, ওর গার্লফ্রেন্ড অন্য কারোর সাথে ভেগে যাবে। যা একটু বিয়ে হবে, বউ ও থাকবে না। আমাদের সাথে যা করছে উপরের একজন দেখছে, শান্তি পাবে এই অনল স্যার”
“ওর উপর শোধ তুলতে হবে। মনে আছে আরিফ স্যারের উপর জনগণ কিভাবে শোধ তুলেছিলো। এর উপরও সেই ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। মানা যায়! পয়তাল্লিশ জনের মাঝে মাত্র ৪ জন বিশের উপর পেয়েছে, আর সব দশের নিচে। ক্লাসের সবাই এমনেই ক্ষেপে আছে। একটা মিটিং ডাকলেই হবে”

দিগন্তের কথা শেষ না হতেই ধারা ভেটো দিলো। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
“আচ্ছা, তোদের সমস্যা কি বলতো! নিজের ব্যর্থতার দোষ অনল স্যারের উপর দিচ্ছিস কেনো! উনি তো ক্লাসের লেকচারের বাহিরে ম্যাথ দেন না। তাহলে শুধু শুধু তার উপর এতো চেতছিস কেনো? পড়বি না তাহলে মার্ক কি মুখ দেখে দিবে!”
“তুই চ্যাততেছিস কেনো? অদ্ভুত তো! হুট করে ভাই এর উপর দরদ উতলে উঠলো নাকি! স্টেপের মার্ক সবাই দেয়! সে তো দিতে পারতো?”
“অদ্ভুত স্টেপের মাঝেও যদি ভুল করে রাখিস মার্ক দিবে কিভাবে? যতসব। মাথায় তো শুধু নষ্ট বুদ্ধি জমিয়ে রেখেছিস। এসব ছাড় আর একটু পড়”

বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হনহন করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেড়িয়ে গেলো। ধারার এমন পরিবর্তন যেনো কারোর হজম হলো না। আগে এই মেয়েই সকলের সাথে বসে অনলের পিন্ডি চটকাতো। অথচ আজ হুট করেই চেতে উঠলো, যেখানে সবথেকে কম নম্বর সেই পেয়েছে। দিগন্ত বিস্মিত গলায় বললো,
“যা বাবা! কি হলো! এই ধারা আজ উলটো ধারায় চলছে কেনো? কি এমন বললাম ক্ষেপে লাল হয়ে গেলো! কি রে মাহি! ওর কি হয়েছে জানিস!”

মাহি কিছুসময় মাথা চুলকালো, তারপর হতাশ গলায় বললো,
“বিষয়টা আমিও বুঝলাম না, অনল ভাইকে যে মানুষ দু চোখে দেখতে পারে না সেই মানুষ আজ উনার পক্ষ নিলো। সূর্য কি উলটো দিকে উঠলো”

সবার মুখে চিন্তা, চিন্তার কারণ ধারার এমন পরিবর্তন। এ দিকে মাহির ও ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। সে ভাবলো হয়তো ধারার মন খারাপ। বেশ কিছুদিন যাবৎ ই তাকে অন্যমনস্ক লাগছে৷ হয়তো প্লাবণ ভাইএর বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপার। ঘনিষ্ঠতার জন্য ধারার মনের খবর একটু হলেও সে রাখে। তাই ঠিক করলো এখন তার সাথে কথা বলবে না, বরং বিকেলে সোজা বাসায় যাবে। তখন ই সব রহস্যের উদঘাটন করবে সে। বন্ধুমহল আবার কথায় মজলো। তাদের আড্ডার মুল বিষয় হলো চরম কঠিন এবং খ’চ্চ’র অনল স্যার________

গোধলী লগ্ন, ভেজা চুলে বারান্দার মেঝেতে বসে আছে ধারা। আজ মনটা ভালো নেই, তখন বন্ধুদের উপর না চেঁচালেও পারতো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলো না। কেনো যেনো অনলের নামে অবান্তর কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলো না। লোকটি তার কাজের প্রতি কতোটা নিষ্ঠাবান সেটা ধারা জানে। উপরন্তু আরিফ স্যারের সাথে ঘটিত কাহিনী সে জানে। বেচারা স্যার শেষ অবধি ভার্সিটি ছাড়তে বাধ্য হন। সে চায় না অনল ভাইয়ের সাথে এমন কিছু হোক। এই চাকরীটি তার স্বপ্নের চাকরি। এতোকাল বহু কাঠখড় পুড়িয়েছে এই চাকরিটির জন্য। আগে হলে হয়তো সে উদাসীন থাকতে পারতো। কিন্তু এখন উদাসীন থাকাটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। অনল ভাই মানুষটার কোনো ক্ষতি হোক সে চায় না। হুট করেই নিবৃত্ত মস্তিষ্ক অবুঝ মনটিকে প্রশ্ন করে বসলো,
“কেনো তার এতো পরিবর্তন! কেনো সর্বদা অনল নামক মানুষটাকেই নিয়ে সে চিন্তিত?”

মস্তিষ্কের প্রশ্নে থমকে গেলো হৃদয়। তারপর উত্তর দিলো,
“কারণ মানুষটি ভালো”
“শুধু কি তাই?”

চুল গুলো টেনে ধরলো ধারা। মন এবং মস্তিষ্কের রেষারেষিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। মানুষটির প্রতি তার এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। এ যেনো সম্মহনী কোনো কালো জাদু! চোখজোড়া নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকে, হৃদয়ের অন্তস্থলে তার জন্য এক শুন্যতা কাজ করে! সবকিছুই যেনো প্রহেলিকা। বিশাল অদ্ভুত প্রহেলিকা। এই চিন্তার ঢেউ এ ছেদ ঘটায় বড় মা। তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে বলেন,
“ধারা, মাহি এসেছে”

মাহির নাম শুনতেই সকল চিন্তারা ভো দৌড় দেয়। মাহি এই বাড়িতে খুব এক টা আসে না। কিন্তু আজ বিনা নোটিসে তার আগমণে ধারা খুশিতে গদগদ হবার বদলে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। চটজলদি উঠে দাঁড়ালো সে। ছুটে গেলো বসার ঘরে। মাহি তখন বড়মার সাথেই গল্প করছে। ধারাকে দেখেই সুভাসিনী বললো,
“যা মাহিকে নিয়ে ভেতরে যা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি”

ধারা পড়লো মহা বিপাকে, সে মাহিকে নিজের আগের ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ সেখানে জমজেরা দরজা আটকে কিছু গোপন কাজ করছে। আর অনলের ঘরে নিয়ে যেতে পারছে না। ধারাকে ভুতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুভাসিনী আবার বললো,
“কি রে, নিয়ে যা ওকে”
“এশারা ঘর আটকে রেখেছে”
“এশাদের ঘরে কেনো যাবি! অদ্ভুত তো! তোর আর অনলের ঘরে নিয়ে যা”

ধারা কিছু বলার পূর্বেই মাহি বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
“অনল ভাই এর রুমে ধারা থাকে?”
“ওমা, স্বামীর ঘরে স্ত্রী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক………
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৪তম_পর্ব

ধারা কিছু বলার পূর্বেই মাহি বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
“অনল ভাই এর রুমে ধারা থাকে?”
“ওমা, স্বামীর ঘরে স্ত্রী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। স্বামী স্ত্রী কি আলাদা রুমে থাকে?”

সুভাসিনীর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলা কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো মাহির। সে উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। নিউরণ গুলো রেষারেষি করছে একটা শব্দে “স্বামী-স্ত্রী”। তার বিস্মিত নজর পড়লো ধারার উপর। ধারা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে তার ঘাম জমছে। মুখশ্রীতে ক্ষীন আতঙ্ক হাটে হাড়ি ভাঙ্গার। অস্পষ্ট দলা পাকানো স্বরে বললো,
“স্বামী স্ত্রী! মানে?”

ধারা উত্তর খুজছে কিন্তু পাচ্ছে না। মস্তিষ্কটা হুট করেই উইন্ডোজ কম্পিউটারের মতো শাট ডাউন দিয়েছে। মিথ্যের জটলার মাঝে যেনো নিজেই আটকে গেছে। পরমূহুর্তেই নিজের অপারগতার উপর ধিক্কার জানালো সে। সাথেই মাহির সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার পূর্বাভাস পেলো। কিছু বলার আগেই সুভাসিনী অতি উৎসাহের সাথে বলে উঠলো,
“হ্যা, অনল এবং ধারার তো বিয়ে হয়েছে। কি রে ধারা? মাহিকে জানাস নি?”

ধারার উত্তর এলো না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক এক করে সব মিথ্যে ফাঁস হচ্ছে এবং সে নির্বাক দর্শকের মতো দেখছে। কারণ করার কিছুই নেই। এদিকে মাহির ভেতরটা চুরমার হচ্ছে। সে যেনো বারংবার সপ্তম আসমান থেকে পড়ছে, আবার কেউ তাকে তুলে ধরছে এবং সে আবার পড়ছে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্টে বললো,
“কবে বিয়ে হয়েছে ওদের!”
“আফিয়ার বিয়ের দিন ই”

মাহি মাথা ঘুরে উঠলো। প্রায় এক মাস পূর্বের ঘটনা অথচ তার প্রাণের বান্ধবী নিপুন ভাবে তার থেকে চেপে গেছে। অথচ এই বান্ধবীকেই নিজের প্রেম কবুতর বানাতে বসেছিলো মাহি। স্ত্রীকে দিয়ে স্বামীর কাছে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছিলো অজ্ঞাত মানবী। নিজের বোকামীর উপর নিজেই লজ্জিত হলো সে। মাহি দাঁড়িয়ে রইলো ভুতের মতো। তার মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু স্থির শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের বান্ধবীর দিকে। সুভাসিনী বেগম আজ অতি উৎসাহী। সে প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো না, এটা তো জানতাম না। দাঁড়কো তুমি বসো আমি কালোজাম বানিয়ে আনছি। বিয়ের খবর মিষ্টিমুখ করে খেতে হয়”

প্রচন্ড লজ্জা, ক্রোধ, অপমানে বিব্রত মাহি আজ দাঁড়াতে পারছে না। ভেতরটা যেনো চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কোনো মতে বললো,
“আন্টি লাগবে না, বিয়ের খবরে মিষ্টিমুখ হয়ে গেছে। আর মিষ্টি খাবো না। আর এমনেও আমি মিষ্টি তেমন খাই না। আজ চলি, আমার একটু কাজ আছে। ধারাকে দেখতে এসেছিলাম, দেখা হয়ে গেছে”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো মাহি। সুভাসিনী বুঝলেন না ঠিক, মেয়েটার আচারণ বেশ বিচিত্র ঠেকলো তার কাছে। অবাক কন্ঠে বললেন,
“কি হলো! মেয়েটা চলে গেলো কেনো?”

ধারা উত্তর দিলো না, বরং ক্রুদ্ধ বান্ধবীর পেছনে ছুটলো। আকুল গলায় নাম ধরে বেশ কবার ডাকলো কিন্তু মাহি তা উপেক্ষা করলো। একটা রিক্সায় চেপে নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। ধারা দাঁড়িয়ে রইলো লোহার কেঁচিগেটে। অসহায়ের ন্যায় মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বান্ধবী হারানীর যন্ত্রণা অনুভূত হলো কিশোরীর মনে।

ঘরে ফিরলে সুভাসিনীকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ধারা। তার লম্বাটে মুখখানা দেখে সুভাসিনী চিন্তিত গলায় বললেন,
“কি হলো! তোর মুখটা বাংলার পাঁচের মতো লাগছে কেনো?”

ধারা হতাশ কন্ঠে বললো,
“আসলে কেউ জানতো বিয়ের খবর টা। আমি কাউকে বলি নি”
“ওওওওও”

ধারার কথায় সুভাসিনী ঠিক কি বুঝলেন জানা নেই। তবে তিনি মুখে হাত দিয়ে কিছুসময় ভাবলেন। তারপর ঠোঁটে হাসি একে বললেন,
“আরে, বান্ধবীরা এমন ই হয়। কিছু লুকালেই রেগে যায়। তুই মন খারাপ করিস না। কালকে ভার্সিটি গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরিস। দেখবি ওর মন ভালো হয়ে যাবে, ওর রাগ পড়ে যাবে। তুই বরং রুমে যা আমি কালোজাম বানিয়ে নিয়ে আসছি”

সুভাসিনী রান্নাঘরে চলে গেলেন। ধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। বড়মা তো আর জানে না, মাহির এই রাগ যে সে রাগ নয়। ভঙ্গুর হৃদয়ের সুপ্ত রাগ, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলে যে রাগের উৎপত্তি হয় মাহির রাগটি সেই রাগ। শুধু জড়িয়ে ধরলে যদি কমে তবে তো ভালোই। কিন্তু মাহির সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার সাথে সাথে আরোও একটা সূক্ষ্ম ভয় মনে জন্মালো। বন্ধুমহল যদি জেনে যায় তবে কি হবে! বন্ধুমহল জানা মানে দিগন্ত জানা, দিগন্ত জানা মানে ভার্সিটি জানা। আর ভার্সিটি যদি জেনে যায় তবে কি হবে! নানাবিধ কুচিন্তা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ককে ঘিরে ধরলো। ধারা আর চিন্তা করতে পারলো না। নিজ ঘরে যেয়ে ফোন হাতে নিলো। ডায়াল করলো মাহির নাম্বারে। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরলো না। অবহেলায় বাজতে থাকলো মাহির মোবাইল_______

*****

অনল ফিরলো সন্ধ্যার অনেক পরে। জ্যামের মাঝে বসে থেকে থেকে নাজেহাল অবস্থা তার। ঘামে ভিজে গেছে নীল শার্টটা। কপালের সিল্কি চুলগুলোও লেপ্টে আছে ভেজার কারণে। আজ দেরী হবার কারণ প্লাবণ। বিয়েতে কলেজের তেমন কাউকে দাওয়াত দেয় নি সে। তাই আজ পরিচিত শিক্ষকদের বাহিরে খাওয়িয়েছে। অনলের যাবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু প্লাবণ নাছোড়বান্দা, তাই বাধ্য হয়ে যেতেই হলো। বাসায় এসেই দেখলো ডাইনিং টেবিলে বেশ জটলা। কালোজাম বানানোর জন্য মাছির মতো সবাই আক্রমণ করেছে। জামাল সাহেবের দাঁতের অবস্থা খুব খারাপ। সর্বোচ্চ দশ দাঁত গুনে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ৷ তবুও সে কালোজাম খাচ্ছেন। রাজ্জাক একেবারে ছোট ছোট করে কেটে দিয়েছেন, যেনো বাবা তার খেতে পারে। ইলিয়াস তো হাটছে আর টুপ করে একটা কালোজাম মুখে পুড়ে নিচ্ছে। অনল মাকে দেখে বললো,
“আজ এতো আনন্দের কারণ?”

সুভাসিনী ছেলের মুখখানা ধরে আদর করলেন, তারপর একটা কালোজাম মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন,
“কারণ ছাড়া আনন্দিত হওয়া যায় না নাকি!”

অনল উত্তর দিতে পারলো না কারণ মুখ ভর্তি মিষ্টি। এতো আনন্দের মাঝেও এশা আশাকে দেখা গেলো ফ্রিজের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ কুচকুচে কালো হয়ে আছে। অনল মিষ্টি খেয়ে রুবিকে জিজ্ঞেস করলো,
“এদুটো কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
“শাস্তি দিয়েছি, সাইন্স প্রজেক্টের নামে আকাম করছিলো। দেখো না কালোবাদরের মতো মুখ করে রেখেছে। এজন্য শাস্তি সারাদিন এই ঘরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষ হাটবে, চলবে আর এদুটোকে দেখবে। দেখে দেখে হাসবে। এরপরও যদি না শুধরায় একদম বাহিরের দরজার সামনে দাঁড় করাবো কান ধরিয়ে”

রুবির কথার প্রতিবাদ করলো এশা। বিনয়ী স্বরে বললো,
“সাইন্স প্রজেক্ট ই করছিলাম। ফর্মুলায় হালকা ঝামেলা হয়ে গেছে। সব পরীক্ষা যে সফল হয় তা তো না। কিছু কিছু পরীক্ষা বিফলেও যায়। তবেই তো তাদের বিজ্ঞানী বলে”
“মারবো টেনে এক চ’ড়, বিজ্ঞানী হয়েছেন মহারাণীরা”

রুবির রাম ধমকে দমে গেলো এশা। আশা ও মাথা নামিয়ে নিলো। তারা এখনো কান ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। অনল মাথা ঘামালো না বেশি। এই দুটো কখনোই শুধরাবে না। সে ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমার বউ কোথায়?”
“ঘরেই আছে। কত বললাম, আসলো না। মন খারাপ হয়তো”

সুভাসিনী রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন। অনল কিছু একটা ভাবলো তারপর পা বাড়ালো নিজ ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকে ব্যাগখানা রাখলো অনল। তার জিজ্ঞাসু চোখ পুরো ঘরটি একবার দেখলো। ধারাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। টাওয়ালটা ঘাড়ে নিয়ে সে পা বাড়ালো বারান্দার দিকে। তার আন্দাজ সঠিক। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন মহারাণী। তার চোখ মোবাইলে আটকে আছে। গোল মুখখানা লম্বাটে দেখাচ্ছে। অনল হাত ভাজ করে হেলান দিলো দরজায়। ঠেস মারা কন্ঠে বললো,
“কি রে ফেলুরানী, এখানে পা ছড়িয়ে কি করছিস”

কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ভ্রু কুচকে এলো ধারার। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো অনলের দিকে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“ফেলুরানী বলছো কেনো?”
“৩০ এ ৩ পেয়েছিস, আর কি বলবো? ১০০ মার্কে তো পাবি ১০। ফেল করারো পর্যায় থাকে, তোর সেটাও নেই”

অন্যসময় ধারা তেড়ে আসতো। কিন্তু আজ তা হলো না উলটো ঠোঁট উলটে বললো,
“মহাকান্ড হয়ে গেছে?”
“কি?”

ভ্রু কুচকে অনল শুধালো। ধারা উঠে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“মাহি না জেনে গেছে আমাদের বিয়ের কথা, রেগে ঘর ছেড়ে চলে গেছে”
“আমাদের বিয়ের কথা জেনে ও ওর বাড়ি ছাড়বে কেনো?”
“ধুর, না। আমাদের বাসায় আসছিলো। বড় মা হাটে হাড়ি ভাঙ্গতেই সে রেগে বেড়িয়ে গেলো। আমি ফোন করছি, ধরছে না”

অনল বেশ উদাসীনতার সাথে বললো, “ও”। তারপর সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ধারা অপেক্ষা করছিলো অনল হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু শুধু হতাশাই হাতে পেলো। লোকটা একেবারেই নির্বিকার। মিনিট দশেক বাদে, ওয়াশরুম থেকে বের হল অনল। পরণে একটা ট্রাওজার আর কালো পোলো শার্ট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে তাকালো ধারার দিকে। ধারার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সে এখনো চিন্তিত চিত্তে মাহিকেই ফোন দিচ্ছে৷ অনল মুখ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর টেবিলে বসতে বসতে বললো,
“পড়তে বয়, ফেলুরানী। আর এক মাস আছে। আমি চাই না, মানু্ষ আমাকে ফেলুর বর বলুক”

ধারা তার কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,
“আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় মাহি কি আমার উপরে খুব রাগ করেছে?”
“ওর ইচ্ছে হয়েছে রাগ করেছে। তুই এখন যেটা করতে পারিস, সেটা হলো ক্যালকুলাস বইটা নিয়ে চ্যাপ্টার ১ থেকে শুরু করে ৩ পর্যন্ত ম্যাথ গুলোর সমাধান”

ধারা অনলের মুখোমুখি বসলো, চিন্তিত, ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমার চিন্তা হচ্ছে”
“কেনো বলতো! কিসের এতো চিন্তা?”
“আজিব, ও আমার ফোন ধরছে না। সেই কখন থেকে আমি ওকেই ফোন করছি। সতেরোবার ফোন করেছি, ধরে নি। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও যদি বন্ধুত্ব ভেঙ্গে দেয় তখন!”
“ও”

অনলের উদাসীনতায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। কিছুসময় তীর্যক জ্বালাময়ী দৃষ্টি প্রয়োগ করলো কিন্তু অনলের বিকার হলো না। বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“ও, ও ছাড়া তোমার কি কিছু বলার নেই! না থাকলে থাকো, আমার মাথা খেয়ো না”

বলেই উঠতে গেলে হাতখানা টেনে ধরলো অনল। হ্যাচকা টানে তাকে আগের জায়গায় বসালো। কিছুসময় শান্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের মাঝে। তারপর অনল তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুই একটু বেশি চিন্তা করছিস না?”
“করা উচিত নয়?”
“একেবারেই না। হ্যা, মাহি তোর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এমন তার আমার প্রতি একটা আবেগ ছিলো। কিন্তু আমি তো আমার উত্তর দিয়েছি। আমার মনের উপর কর্তৃত্ব আমার একান্ত নিজস্বের। আমার ওকে প্রত্যাখান করায় তো তোর কোনো দোষ নেই। আমাদের বিয়ের আগেও আমি তার প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে চাপ দিস না। বরং এটা ভাব ফেলুরানী থেকে কিভাবে ধারারানীতে ফেরা যায়! আমি তো ভেবেছি, তুই ৩ পাওয়ার লজ্জায় গা ঢাকা দিয়েছিস। আমাকে হতাশ করলি রে ধারা। শেষমেশ আমার বউ ফেল্টু?”

অনলের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো ধারা। এতোসময় খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। কুচিন্তারা মস্তিষ্ক দখলে নিয়ে ছিলো। কিন্তু এখন যেনো সেই চিন্তার ঘন কালো মেঘগুলো সরে গিয়েছে। মনমন্দিরে কুসুমপ্রভা উঁকি দিয়েছে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
“তাহলে আমার কি করা উচিত?”
“ওই যে বললাম, ক্যালকুলাস”
“যথাআজ্ঞা মাষ্টারমশাই”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। বা হাতটা অজান্তেই চলে গেলো ধারার গালের কাছে। আলতো হাতে হালকা টেনে দিলো সে। সাথে সাথেই জমে গেলো ধারা৷ হৃদপিন্ডের রক্তস্রোত যেনো বাড়লো। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। সামনে থাকা মানুষটির দিকে। এই অনুভূতিটির নাম কি! ভালোলাগা! আবেগ নাকি প্রণয়!

******

ক্লাসরুমে ঢুকতেই মাহির দেখা পেলো ধারা। আজ একটু তাড়াতাড়ি ই এসেছে। অনলের ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও মানুষটিকে ঠেলে উঠিয়ে সকাল সাতটায়। তারপর টেনে হিচড়ে তাকে নিয়ে এসেছে কলেজে। অবশ্য এতে ধারার দোষ নেই, কারণ নানাভাই এর হুকুম ধারা একা কোথাও যাবে না। গেটের থেকে একটু দূরে বাইক থামতেই বিনাবাক্যে ধারা ছুটলো ভার্সিটির দিকে। কারণ এখন মুখ্যম হলো মাহির মুখোমুখি হওয়া। অনল পিছন থেকে ডাকলো,
“আস্তে যা”

কিন্তু ধারা তা কানে তুললো না। সে যা ভেবেছে তাই হয়েছে, মাহি আজ তার জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অপেক্ষা করে নি। সোজা ক্লাসে এসে পড়েছে। মেয়েটা বড্ড অভিমানী, ধারার ভাষায় প্রচুর সেন্টি খায়। তিল থেকে তাল খসলেই তার মুখ ভার হয়ে যায়। তবে ধারার জানা আছে অভিমান কিভাবে ভাঙ্গানো যায়। সে সোজা যেয়ে মাহির পাশে বসে পড়লো। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরির বড় চকলেট বের করলো। চকলেটটি অবশ্য জোর পূর্বক অনলকে দিয়েই কেনানো হয়েছে। কারণ সেটা মাহির পছন্দ। সকাল সকাল এই চকলেটের জন্য বেঁচারাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু বিবাহিত মানুষের গণতন্ত্র একটাই, বউ এর দাবি। বাঁচো, ম’রো মানতেই হবে। অনলের ও সেটাই করতে হয়েছে। সেই কথা না হয় তোলা থাক। চকলেটটি এগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“দোস্তো, সরি। আসলে সব কিছু এমন ভাবে হয়েছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। রাগ করিস না”

ধারা ভেবেছিলো কাজ হবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে মাহি উঠে দাঁড়ালো। বিনাবাক্যে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিলো। গিয়ে বসলো ধারার অতীব অপছন্দের ক্লাসমেট মাধবীর পাশে……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৫তম_পর্ব

চকলেটটি এগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“দোস্তো, সরি। আসলে সব কিছু এমন ভাবে হয়েছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। রাগ করিস না”

ধারা ভেবেছিলো কাজ হবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে মাহি উঠে দাঁড়ালো। বিনাবাক্যে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিলো। গিয়ে বসলো ধারার অতীব অপছন্দের ক্লাসমেট মাধবীর পাশে। ধারা তাকে ডাকতে চাইলো কিন্তু থেমে গেলো। মানুষের একটা বাজে প্রবৃত্তি আছে, যে সকল মানুষদের তারা অপছন্দ করে তারা চায় না তাদের পছন্দের মানুষগুলো সেই অপছন্দের মানুষের আশেপাশে থাকুক কিংবা কথাও বলুক। ধারার মাঝে এই প্রবৃত্তিটি যেনো একটু মাত্রাতিরিক্ত ই। ভার্সিটিতে ভর্তিতে হবার থেকেই মাধবী নামক মেয়েটিকে তার অপছন্দ। সব কিছুতেই তার অতিরিক্ত বোঝা ভাব। ধারার মতে মেয়েটি অতিমাত্রায় স্বার্থপর। ভার্সিটির শুরুর দিকে যখন সিনিয়র ভাই-বোনেরা র‍্যাগিং করতো তখন সেই র‍্যাগিং থেকে বাঁচার জন্য সে নিজ ক্লাসমেটদের নামে কথা লাগাতো। ফলে তার সাথে সিনিয়রদের সখ্যতা হলেও ক্লাসের বাকিদের উপর চলতো র‍্যাগিং। ধারাও সেই র‍্যাগিং এর স্বীকার। এই মাধবী মেয়েটির জন্য অহেতুক কারণে এক আপুর কাছে বকা খেতে হয়েছিলো তার। সেখান থেকেই এই মেয়েটাকে অপছন্দ তার। ধারার অপছন্দ বিধায় মাধবীকে বন্ধুমহলেরও অপছন্দ। অথচ আজ সেই মাধবীর সাথেই গিয়ে বসেছে মাহি। ফলে প্রচন্ড রাগ জমলো মনের কোনে। আগুন জ্বলে উঠলো তার মস্তিষ্কে। নিজের বান্ধবীর উপেক্ষা হয়তো এতোটা কষ্ট দিতো না, যতটা তার শত্রুর সাথে সখ্যতায় দিচ্ছে। ধারা চেয়েছিলো মাহির সাথে সব ঠিকঠাক করে নিবে। কিন্তু মাহির এমন কার্যে সেই ইচ্ছে বর্জন করেছে সে। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে, সে আর নিজ থেকে মাহির রাগ ভাঙ্গাবে না। তার রাগ করার ইচ্ছে থাকলে করুক। তার আর অনলের বিয়ে তো নিজের ইচ্ছেতে হয় নি। তখনের পরিস্থিতিও অনুকূলে ছিলো না। তাই সে মাহিকে কিছুই জানায় নি। অনল ভাইকে মাহি পছন্দ করতো সেখানেও তার কোনো দোষ নেই, অনল ভাই তাকে প্রত্যাখান করেছে সেখানেও তার দোষ নেই। তবুও ধারা তার রাগ ভাঙ্গাবার চেষ্টা করেছিলো। অথচ মাহি কি না তাকে উপেক্ষা করে, তার উপর রাগ দেখিয়ে মাধবীর সাথে বন্ধুত্ব করতে গেছে। যাক, চুলোয় যাক সে। ধারার দায় পড়ে নি তার রাগ ভাঙ্গানোর। চকলেট টা নিক ব্যাগে পুরে ফেললো সে। এদিকে দুজন প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে দুপ্রান্তে বসতে দেখে দিগন্ত, অভীক এবং নীরব প্রচন্ড অবাক। মাহি এবং ধারা ফেবিকলের আঠার মতো। দুজন যেনো দুজন ছাড়া অচল৷ অথচ একজন দক্ষিণে বসেছে তো অন্যজন বসেছে উত্তরে। দিগন্ত অভীককে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“চু’ন্নী দুটোর আবার কি হয়েছে? একটা টেকনাফে আর আরেকটা তেতুলিয়ায় কেনো?”
“কলিযুগ চলছে রে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নয়তো দেখ, মাহি আর ধারার মাঝেও ঝামেলা হলো”
“গুরুতর কিছুই হয়েছে। নয়তো মাধবীর পাশে মাহির বসার কথা না। এদিকে ধারাও দেখ রেগে লাল হয়ে আছে। ওতো কথাও বলছে না। খোঁজ তো নিতেই হবে”

অভীক সহমত জানালো। নীরব চুপ করে রইলো। শুধু চোখ ছোট ছোট করে মাহি এবং ধারাকে দেখলো। দুজনের মাঝে একটা থমথমে আবহাওয়া। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছেও না। কথা তো দূরে থাক। তবে কি ফাটল ধরলো বন্ধুমহলে! স্কুল কলেজের বন্ধুত্ব গুলো অন্যরকম হয়! তখন মানুষের মন টা থাকে ছোট, সেখানে নিজের স্বার্থ ততটা থাকে না। কিন্তু ভার্সিটির বন্ধুত্ব অন্যরকম। এই জীবনে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে মানু্ষ; স্বার্থ, উচ্চাকাঙ্খার মাঝেও কিছু কিছু মানুষের একটা দল তৈরি হয়। যারা সারাদিন ই একসাথে কাটায়। এই সারাদিন একসাথে থাকলেও সিজি, নোট, নম্বর, এসাইনমেন্ট, প্রেম সব মিলে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এমন কত গ্রুপ আছে যা ফার্স্ট ইয়ারে তৈরি হলেও ফোর্থ ইয়ার আসতে আসতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। মনোমালিন্য, ঝগড়া, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ বন্ধুত্বের মিষ্টি সম্পর্কটিকে করে তোলে তিক্ত। তারপর ভার্সিটি শেষ হয়। এক একেক জন এক একেক পথে। নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যাস্ত। ফিরে থাকাবার সময়টিও হয় না। অবহেলায় পড়ে থাকে, ক্যাফেটেরিয়ায় কাটানো সময়, আড্ডা, গান, চায়ের কাপ। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইট, পাথরের এই ঢাকায় সে একা, আত্নীয়রা থাকে সদূর পঞ্চগড়। এই বন্ধুমহলটিই তার পরিবার। সে চায় না এই সুখময় জায়গাটা নষ্ট হোক। সে চায় না এই পাঁচজনের মাঝে কোনো ফাটল ধরুক। রাগ, ক্ষোভ তো থাকবেই, কিন্তু দিনশেষে না হয় এই বন্ধুত্বের মিষ্টতা দিয়ে তার সমাধান হোক________

ক্লাস শেষ হল। একে একে চারটে ক্লাস, মাঝে ব্রেক থাকলেও মাহি এবং ধারার মাঝে কোনো পরিবর্তন হলো না। ক্লাস শেষ হবার পর বন্ধুমহল অপেক্ষা করছিলো ধারা এবং মাহি হয়তো কথা বলবে। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণিত করলো তারা। মাহি হনহন করে বেরিয়ে গেলো। ধারাও ব্যাগ গুছালো। সে পাত্তা দিলো না মাহির উদাসীনতার। যেনো মাহির অভিমানে তার যায় আসে না। দিগন্ত বললো,
“তোরা ধারার সাথে কথা বল, আমি মাহিকে দেখছি”

বলেই পিছু নিলো মাহির। এদিকে অভীক আর নীরব মুখোমুখি হলো ধারার। ভনিতা ছাড়াই অভীক প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি হয়েছে তোর আর মাহির মাঝে?”

আকষ্মিক প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠলো ধারা। উত্তরটা গলায় আটকে থাকলেও বলতে পারলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
“কিছু না, ওর রাগ করতে ইচ্ছে হয়েছে করেছে”

বলেই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো ধারা। অভীক এবং নীরব তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পথে______

****

অনেক কষ্টে দৌড়ে এসে মাহিকে থামালো দিগন্ত। হাপাতে হাপাতে বললো,
“এতো জোরে হাটছিস কেনো? ট্রেন ধরবি নাকি? কখন থেকে ডাকছি, শুনিস না নাকি!”

মাহি সত্যি শুনে নি। নিজ মনেই হাটছিলো সে। কালকের পর থেকে মস্তিষ্ক যেনো অচল হয়ে গেছে। মন এবং মস্তিষ্কের রেষারেষিতে ক্লান্ত হয়ে আছ্র। নিজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর উপর প্রবঅল ক্ষোভ জন্মেছে, সেই সাথে নিজের কাজেও লজ্জা লাগছে। সেদিন যদি ধারা সত্যিটা বলে দিতো তবে নির্লজ্জের মতো অনলের কাছে প্রেম নিবেদন করতো না। এখন সে বেশ বুঝতে পারছে অনল কেনো বলেছিলো “এক হৃদয়ে দুই নারীর স্থান হয় না” —- কারণ সে বিবাহিত।ধারার সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। ফলে আজ মাধবীর অয়াশে বসেছে সে। অবশ্য অন্য জায়গায় জায়গাও ছিলো না। কারণ ধারার পাশে বসবে না। দিগন্তকে এমন পথ আটকাতে দেখে কিছুটা চমকে গেলো সে। অবাক কন্ঠে বললো,
“আমাকে ডাকছিলি কেনো?”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“বাসায়, আর কোথায় যাবো!”
“তুই আর ধারার মধ্যে কি হয়েছে? ফেবিকলের জোর ভাঙ্গলো কেনো?”

দিগন্তের প্রশ্নে খানিকটা বিরক্ত হলো মাহি। এই ছেলের এতো কেনো মাথা ব্যাথা বুঝে না। বিরক্তিভরা স্বরে বললো,
“কেনো? ব্রেকিং নিউজ বানাবি! দশ হাত দূরে যা তুই। আমাদের ব্যাপার আমরা বুঝে নিবো। নিজের বান্ধবীর উপর রাগ ও করতে পারবো না কি? রেগে আছি। ক্ষোভ হয়েছে, কমলে যেয়ে কথা বলবো। তোর মাথা ঘামাতে হবে না”
“বাহ বা! যার জন্য করে চুরি সে বলে চুরি। আমার চিন্তা হচ্ছিলো তাই এসেছি। আর আমার উপর চোটপাট করছিস। কি অদ্ভুত! শোন আমি ব্রেকিং নিউজ করতে পারি ঠিক, কিন্তু বন্ধুদের খবর আমি পাঁচার করি না। আমার ও একটা নৈতিকতা আছে”

দুঃখভরাক্রান্ত কন্ঠে দিগন্ত বললো। মাহি এখনো ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা আস্তো নাটকবাজ। শুধু নাটক করে। বুক বাকিয়ে বললো,
“হইছে, থেমে যা। নাটক যতসব। তোর স্বভাব জানা আছে।”
“বিশ্বাস করলি না তো, মনে থাকবে। আর একটা কথা, চুপ করে থাকলে রাগ বাড়ে। তখন সেটা অভিমানে পরিণত হয় এর বরং রাগ কমিয়ে নেই। দরকার হলে কটা গা”লি দিয়ে নিস। তবুও এতোকালের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাস না”

বলেই হাটা দিলো দিগন্ত। দিগন্তের কথাটা মস্তিষ্কে গেঁথে গেলো মাহির। সত্যি ই তো রাগ মনে পুষে রাখলে অভিমান জন্ম নেয়। রাগ ভাঙ্গা সহজ, অভিমান বড়ই বিচিত্র।

*****

ভার্সিটির গেট পেরিয়ে একটু সামনে আসতেই ধারা থমকে গেলো। পড়ন্ত দুপুর, সূর্য মাথার উপর। জ্বালাময়ী রোদে পিচের রাস্তার উপর থেকেও ধোঁয়া উড়ছে যেনো। অথচ এই রোদের মধ্যেও একটা দোকানের সামনে বাইকের উপর হেলান নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনল। তার হাতে একটা পেপসির আড়াইশো এম.এল এর বোতল। সে একটু পর পর পেপসি খাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। অনল ধারাকে নিতে আসবে এটা কল্পনা করে নি সে। আজ অনলের ছুটিও ছিলো। ক্লাস নেই বিধায় সে আজ ভার্সিটি যায় নি। ধারা কিছুটা এগিয়ে যেতেই অনল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বাইকে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
“তোর আজকে ফাইন হবে, বিশ মিনিট রোদে দাঁড়িয়ে আছি”
“আমি বলেছি আসতে? এসেছো কেনো?”
“তুই তো মানুষ ভালো না, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি জিজ্ঞেস করবি আমি ঠান্ডা কিছু খাব কিনা! আমার কষ্ট হয়েছে কি না! তা নয়, মুখে মুখে তর্ক জুড়ে দিচ্ছিস”
“ধন্য করেছো এসে। এখন প্রিন্স উইলিয়ামের জন্য কি করতে পারি”
“তাড়াতাড়ি বাইকে উঠে আমাকে উদ্ধার করতে পারিস”

ধারা মুখ বেকিয়ে ভেঙ্গালো অনল কে। মনটা ভালো লাগছে না। মাহির উপর চরম রাগ হচ্ছে। অকারণ যদিও, তবুও হচ্ছে রাগ। তার বেস্ট ফ্রেন্ড কেনো ওই কু’ট’নী মাধবীর পাশে বসবে! ধারা বাইকে বসতে বসতে বললো,
“বাড়ি যাবো না”
“তা এই ভরদুপুরে কই যাবি? রোদ দেখেছিস, জ্বলছে যেনো শরীর”
“আমি জানি না, তুমি জানো কই যাবা! আমি বাড়ি যাবো না এখন ব্যস”

অনল মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারে না, ছোট বিধায় দয়া হয়। আর যদি বাসার হিটলার জানে তার ধারারাণীর গায়ে আচড় পড়েছে তাহলে অনলের জীবন দূর্বিষহ। অনেক ভেবে একটা জায়গা পেলো। যদিও পকেট গরম নয় তবুও মনে করে কার্ডটা এনেছিলো অনল। বাইক চলতে লাগলো। পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। গতি বাড়ার কারণে উষ্ণ বাতাসে উড়ছে ধারার অবাধ্য চুল। ধারা মাথা কাত করে ঠেকালো অনলের পিঠে। শক্ত হাতে তার কোমড় চেপে বসলো। ধারার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে অনলের পিঠে। ঠোঁট বেকিয়ে স্মিত হাসলো অনল। এই মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে! যত দূরে থাকতে চায় ততই যেনো মায়ার তরী তাকে টেনে নিয়ে আছে________

বাইক থামলো একটা নদীরে তীরে রিসোর্টে। ঢাকার শহর থেকে প্রায় ষাট কিলো দূরে। রিসোর্টটি ইকোপার্কের মতো বানানো। বেশ কিছু রুম আছে। রিসোর্ট ঘিরে বিশাল জায়গা। পাশ দিয়ে চিকন নদী। ভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার পিকনিক করতে এসেছিলো অনলেরা। নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতে বড় সুন্দর লাগে। ঘরের বাহিরে ধারার তেমন কখনো যাওয়া হয় না। অনলের ছোট ফুপুর বাড়ি কিশোরগঞ্জ। অনুষ্ঠান ব্যাতীত সেখানেও যাওয়া হয় না। যেহেতু জিদ করেছে সে বাড়ি যাবে না সেহেতু জোর করে লাভ নেই। উপরন্তু যদি বাড়িতে বলা হয় ধারা ঘুরতে চেয়েছে আর অনল তাকে নিয়ে যায় নি তবে সেদিন অনলকে ঘরেই ঢোকা বন্ধ করে দিবে জামাল সাহেব। একনায়কতন্ত্র এখনো চলছে কি না! একঅটা রুম ভাড়া করলো অনল। চাবি নিয়েই বললো,
“চল, ফ্রেশ হবি”

ধারা ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। সবুজে আবৃত রিসোর্টে এসে মাহির কথাই ভুলে গেলো সে। অনলের পিছু পিছু রুমে গেলো। বেশ বড় তাদের রুমটি। রুমে ঢুকেই জানালা খুলে দিলো ধারা। জানালা থেকে পেছনের বয়ে যাওয়া নদীঈ স্পষ্ট দেখা যায়। অনল পকেটে হাত গুজে তাকিয়ে রইলো ধারার হাস্যজ্জ্বল মুখখানার দিকে। তারপর নরম গলায় বললো,
“মাহির সাথে বনিবনা হয় নি তাই না?”

অনলের প্রশ্নে নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। তারপর রাগান্বিত গলায় বললো,
“আমি ওর রাগ ভাঙ্গাবো না। আমার উপর চেত দেখিয়ে মাধবীর পাশে গিয়ে বসেছে। ও মাধবীকে নিয়েই থাকুক”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর কাছে এসে তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
“হিংসুটে বউ আমার। ফ্রেশ হয়ে নে। এখানে হোটেল আছে। ভাত খেয়ে নিবো। তারপর রোদ কমলে বের হবো। আমি বাসায় জানিয়ে দিচ্ছি”

ধারা ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়েই ছুটলো বাথরুমে। অনলের মুখে “বউ” টুকু শুনেই তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। হৃদয়টা এই বেড়িয়ে যাবে। বাথরুমে আয়নার সামনে নিজেকে একবার দেখলো। এই প্রথম একাকীত্বে অনলের সাথে কোথাও ঘুরতে এসেছে সে। মনের মাঝে এক অন্য শিহরণ জাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখে বললো,
“এতো লজ্জা পাবার কি আছে? এটা তো অনল ভাই”

পরমূহুর্তে মন উত্তর দিলো, “হ্যা, অনল ভাই। তাই তো লজ্জাটা বেশি লাগছে”

ধারা দুহাত দিয়ে মুখ ডাকলো। পরমূহুর্তেই বললো,
“ধারা তুই পুরাই গেছিস”

********

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য হেলে পড়েছে দিগন্তের সীমানায়। গোলাকার কমলা সূর্যটিকে নদীর পানিতে আরোও বড় লাগছে। সোনালী আলোতে চিকচিক করছে নদীর স্বচ্ছ পানি। মৃদু বাতাস বইছে। ধারা চুল খোলা। হাটু গেড়ে সে এবং অনল বসে আছে নদীর পাড়ে। এক পাশে বন্ধুদের একটা দল গান গাচ্ছে।
“প্রথমত আমি তোমাকে চাই,
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই…

নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই,
রাত ভোর হলে আমি তোমাকে চাই,
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই,
সন্ধ্যের অবকাশে তোমাকে চাই…”

চোখ বুজে গান শুনছিলো অনল। ধারা মুখে হাত দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের কিরণে প্রিন্স উইলিয়ামকে যেনো আরোও সুন্দর লাগছে। হঠাৎ চোখ খুললো অনল। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,
“কি দেখিস?”
“তোমাকে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here