প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -১১+১২

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১১তম_পর্ব

ধারা কার কথা ছেড়ে কার কথার উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। তখন ই অনল বলে উঠলো,
“বিয়ে তে এসেছো, বিয়ে খাও না। এখানে মজলিস বসানোর কি মানে!”

সুভাসিনী বেগম উত্তর দিতেই যাবেন তখন শোনা গেলো, বিয়ে হবে না। বউ নাকি পালিয়েছে। কথাটা কর্ণপাত হতেই বিস্মিত হলো অনল এবং ধারা। বউ পালিয়েছে মানে কি! স্মৃতি এবং প্লাবণের সম্পর্কটি সেই কলেজ থেকে। একটু রগচটা, দাম্ভিক, আত্মজেদী হলেও মেয়েটি প্লাবণকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কত পাগলামী করেছে সে সেটার সাক্ষী প্লাবণের এই বন্ধুমহল। অনল কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর সুভাসিনীকে বললো,
“তোমরা দাঁড়াও, আমি প্লাবণের কাছে যাচ্ছি”

বলেই সে ছুটলো বরের স্টেজের দিকে। ধারাও পিছু নিলো তার। বহুকৌতুহল তাকে ঘিরে ধরেছে। যদি প্রেমের বিয়েই হয় তবে বউ পালাবে কেনো!

স্টেজের কাছে আসতেই দেখা গেলো প্লাবণ একটি চিরকুট হাতে বসে রয়েছে। তার মুখ কঠিন হয়ে আছে। সর্বদা হাসিখুশি মানুষটিকে এমনভাবে দেখবে কল্পনা করে নি ধারা। তবে একটা জিনিস তীব্র ভাবে অনুভব করলো সে। তার প্লাবণের জন্য সমবেদনা হচ্ছে ঠিক ই কিন্তু তার প্রেমিকা পালিয়ে যাওয়ায় অত্যন্ত খুশি কিংবা তার হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ায় অত্যন্ত কষ্ট তার হচ্ছে না। হয়তো প্লাবণের প্রতি অনুভূতিটা কেবল ই কিশোরী আবেগ ছিলো যা এখন সম্পূর্ণরুপে বাস্পায়িত হয়ে গিয়েছে। অনল প্লাবণের হাত থেকে কাগজ খানা নিলো। সেখানে লেখা
“পারলে আমায় ক্ষমা করো। কিন্তু এই মূহুর্তে তোমায় বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”

কথাখানা পড়ামাত্র অনলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। প্রচন্ড ক্রোধ মস্তিষ্কে চড়ে বসলো। তীব্র স্বরে বললো,
“এসব ফাজলামির মানে কি? এতো বছরের প্রণয় আজ পরিণয়ে পরিণত হচ্ছে। তাহলে সে কিভাবে বলে সম্ভব নয়। অনুভূতির কি দাম নেই নাকি?”

প্রাবণ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“বিয়ে হবে, তোরা টেনশন নিস না। আমি জানি ও কোথায়!”

প্লাবণের কথায় রবিন ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“তুই জানিস মানে? কোথায় স্মৃতি?”

প্লাবণ উত্তর দিলো না বরং হনহন করে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। অনল বন্ধুদের বললো,
“তোরা থাক, আমি যাচ্ছি ওর সাথে”

অনল যেতে ধরলে তার পাঞ্জাবী টেনে ধরলো ধারা। বিনয়ী, নরম স্বরে বললো,
“আমি যাবো তোমার সাথে?”

অনল কিছু একটা ভেবে বললো,
“চল”

*********

কমিউনিটি সেন্টারের ছাঁদের ট্যাংকির পাশে লাল বেনারসী পরিহিত নারী বসে রয়েছে। ট্যাংকিতে হেলান দিয়ে, হাটুজোড়ায় মাথা নুইয়ে সে বসে রয়েছে। তার বেনারসি শাড়ির আঁচলটি বাতাসে উড়ছে। খোঁপা করা সুন্দর পরিপাটি চুলগুলোয় ট্যাংকির খসে পড়া চুনের গুড়া দেখা গেলো। কিন্তু মেয়েটির সেদিকে খেয়াল নেই।প্লাবণ তার মাথার পাগড়িটি খুলে অনলের হাতে দিলো। তারপর সেই মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“এখানে কি করছিস? নিচে সবাই তোকে খুঁজছে। আন্টির তো মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। সবাই ভাবছে তুই আমাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছিস। আমার মায়ের কান্না যদি দেখতি”

প্লাবণের কন্ঠ শুনেই মেয়েটি তড়াক করে উঠে বসলো। তার চোখে বিস্ময়। ভেজা কন্ঠে বলল,
“তুই এখানে?”
“আমার হবু বউ যদি চিরকুট নিয়ে ছাঁদের ট্যাংকির পাশে লুকিয়ে থাকে আমার কি করার আছে? কি ভেবেছিলি, স্মৃতি? একটা চিরকুট দিয়ে আমার থেকে পালিয়ে যাবি! এতো সোজা?”

স্মৃতি কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো কিছু সময়। তার মুখশ্রীতে বিষন্নতার ছাপ। চোখগুলো ভেজা। সে তাকিয়ে রইলো উন্মুক্ত আকাশের দিকে। এদিকে ধারা তাকিয়ে রইলো স্মৃতির দিকে। কি সুন্দর মেয়েটি। শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী, টানা টানা চোখ। বউ সাজে কি মায়াবী লাগছে তাকে। অথচ বিয়ের দিন সে ছাঁদে লুকিয়ে আছে। অনল ও ধারাও নিশ্চুপ। ছাঁদটি যেনো নিস্তব্ধতায় ডুবে গিয়েছে। কিছুসময় বাদে সেই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো স্মৃতি,
“মিলি আপুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। ইমরান ভাইয়া প্রচন্ড তার উপর। ভাবা যায়! সাত বছরের প্রেম, তারপর আটবছরের সংসার। সম্পর্কগুলো বুঝি এমন ই হয়! একটা সময় ভালোবাসার মানুষটির প্রতি বুঝি অনীহা চলে আছে? ইমরান ভাই অকপটে বলে দিলো, তার একঘেয়েমি লাইফ ভালো লাগছে না। সে নাকি এই সম্পর্কে নতুনত্ব পাচ্ছে না। তাই সে মিলি আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো।”
“একারণে তুই ভয় পেয়েছিস?”
“ভয় পাবো না কেনো? আমাদের এই দশ বছরের রিলেশনে ক বার ব্রেকআপ হয়েছে বলতো? কতবার আমি তোর উপরে রেগে ফোন অফ করে রেখেছি, সপ্তাহ এর পর সপ্তাহ কথাও হয় নি। তুই ও একই কাজ করেছিস!”
“তখন আমরা বাচ্চা ছিলাম স্মৃতি”
“বিয়ের পর যে এমন হবে না তার কি গ্যারেন্টি! এটা বিয়ে এখানে ব্রেকাপ হয় না হয় ডিভোর্স। যেখানে প্যাচাপ এর ওয়ে থাকে না। কি গ্যারেন্টি! তুই আমার ফেডাপ হয়ে যাবি না! আমার বদঅভ্যাস, আমার রাগ, জেদ এগুলোর উপর তুই বিরক্ত হবি না। এই তো চারদিন আগে, মেজাজ খারাপ করে ফণ রেখে দিলি, কত ফোন করলাম এই চারদিন একটি বারো ফোন ধরেছিস তুই! না, ধরিস নি। সমাজের জন্য আমি বিয়ে করতে চাই না প্লাবণ। আমি বিয়ে করতে চাই কারণ তোর সাথে সারাটাজীবন কাটাতে চাই। কিন্তু মিলি আপুর ঘটনা শোনার পর থেকে আমার আর সাহস হচ্ছে না। একসাথে থাকবো চব্বিশটা ঘন্টা, আমাদের পছন্দ অপছন্দ গুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে হবে আমাদের সংসার। যদি সেটা না মিলে! যদি আমাদের ঝগড়ার মিটমাট না হয়! যদি আমাদের সুখময় স্মৃতিগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। কি করবো তখন! তোর সাথে কাটানো সময় গুলো অনেক স্পেশাল প্লাবণ। ছোট ছোট মূহুর্ত, ছোট ছোট কাজ। আমি চাই না সেগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠুক। হয়তো আমি কাউকেই বিয়ে করতে পারবো না। সারাজীবন কুমারী থাকবো। কিন্তু আমি চাই না, আমাদের সম্পর্কটাও ইমরান ভাই এবং মিলি আপুর মতো হোক”

প্লাবণ এতো সময় চুপ করে স্মৃতির কথাগুলো শুনছিলো। স্মৃতি কন্ঠ দলা পাকাচ্ছে, চোখ টলমল করছে। সে টিস্যু দিয়ে চোখ মুচছে। ফলে মেকাপ হালকা উঠে উঠে যাচ্ছে। প্লাবণ মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। জ্বালাময়ী রোদের কারণে তার শরীর ঘামে সিক্ত হয়ে আছে। রুমাল বের করে ঘামটা মুছে নিলো সে। তারপর বললো,
“বুঝলাম, চল এবার নিচে সবাই অপেক্ষা করছে”
“আমি যাবো না”

দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বললো স্মৃতি। এবার প্লাবণের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, কড়া স্বরে বলল,
“আংকেল আন্টি তোরে কখনো মা/রে নি তাই না? এইজন্য তোর এই অবস্থা! তোর কি মনে হয় এটা ফাজলামি হচ্ছে! আমি আমার পরিবারকে নিজে ফাজলামি করছি! এতোকাল তোর সব জিদ মেনে আসছি বলে মাথায় উঠে নাচবি এটা তো মানতে পারবো না। দেখ স্মৃতি আমি এক থেকে দশ গুনবো। এর মধ্যে যদি না উঠিস, তুলে নিয়ে যাবো আমি!”

স্মৃতি বিস্মিত নজরে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দিকে। শান্ত মানুষেরা রেগে গেলে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে; আজ স্বচক্ষে দেখলো সে। প্লাবণের মতো শান্ত মানুষটির রাগান্বিত রুপে খানিকটা ভয়ও পেলো সে। মাথা নুইয়ে বসে রইলো সে। প্লাবণ আবারো গরম নিঃশ্বাস ফেললো। এবার কিছুটা নরম গলায় বললো,
“স্মৃতি, ভয় যেমন তোর হচ্ছে আমারো হচ্ছে। এতোকাল আমরা প্রেমিক প্রেমিকা ছিলাম, এখন হবো স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা অনেক আলাদা, বিচিত্র কিন্তু এই সম্পর্কটা পবিত্র। এখানে কোনো লুকোচুরির জায়গা নেই, এখানে কোনো অবিশ্বাসের জায়গা নেই। হ্যা, ঝগড়া হবে, ঝামেলা হবে, কখনো জীবনে কড়া রোদের দেখা মিলবে তো কখনো বৃষ্টির মতো শীতলতা ছেয়ে যাবে। তবে বটবৃক্ষের ন্যায় একে অপরকে আগলে রাখবো। এটাই তো বিবাহিত জীবন। আর মিলি আপু আর ইমরান ভাইয়ার মতোই যে আমাদের বিয়ে হবে এমনটা তো নয়। তারা ভিন্ন মানুষ আমরা ভিন্ন মানুষ। হ্যা, তোর উপর আমার রাগ হয়, ক্ষোভ হয় কিন্তু বিরক্তি আছে না। কারণ এই স্মৃতিটাকে আমি ভালোবাসি। সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোবাসাটা গাঢ় হচ্ছে। নয়তো ভাব, আমি কেনো ছুটে আসবো এই ছাদে। যদি তোর উপর বিরক্ত হতাম তাহলে চিরকুট পেয়ে দেবদাসের মতো ফিরে যেতাম তাই না! কিন্তু আমি জানি তুই ভয় পেয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে আছিস। আর বাকি রইলো ফোন না ধরা, আমার ফোন আমার কাছেই নেই। বিয়ের আগে কনের সাথে কথা বলতে হয় না। তাই আমার ফুপি ফোন নিজ আয়ত্তে নিয়ে রেখেছেন। সরি, আমার বোঝা উচিত ছিলো, আমার রাগ করে ফোন কেটে দেওয়ায় তুই চিন্তা করবি, উদ্বিগ্ন হবি। কে জানতো! এই উদ্বিগ্নতায় তুই বিয়ের দিন এমন কিছু করবি! এবার কি যাবি! নাকি তুলে নিয়ে যেতে হবে! কারণ বিয়ে না করে আমি যাচ্ছি না”

স্মৃতি নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ফট করে উঠে প্লাবণকে জড়িয়ে ধরলো। জড়ানো স্বরে বললো,
“সরি, ভয় পেয়ে গেছিলাম”
“ইটস ওকে, এই বিয়ে সারাজীবন মনে থাকবে। এতো এপিক বিয়ে কারোর হয় নি, সেখানে হলুদের দিন বরের পেট খারাপ। বিয়ের দিন বউ বিয়ে করবে না বলে ট্যাংকির নিচে লুকিয়ে আছে। স্মরণীয় বিয়ে। আমার বিয়ে গ্রিনিস বুকে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে”

বলেই নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো স্মৃতিকে। এদিকে ধারার মুখেও হাসি, অবশেষে প্লাবণ ভাইয়ের বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু অনলের মুখ দেখা গেলো কঠিন। কিছু নিয়ে সে বড্ড চিন্তিত। ধারা যখন তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, “কি ভাবছো?” অনল উত্তর দিলো না। বরং কঠিন মুখে বললো,
“কিছু না”

ধারা আর ঘাটালো না। অবশেষে প্লাবণ এবং স্মৃতির বিয়েটা হলো। অবশ্য প্লাবণকে নিয়ে রবিন বেশ হাসিঠাট্টা ও করলো। বন্ধুমহলে এমন বিচিত্র বিয়ে কজনের হয়েছে! কিন্তু অনলকে দেখা গেলো শান্ত। অনল বরাবর ই চুপচাপ বিধায় কেউ ঘাটালো না, তবে তার কঠিন, চিন্তিত মুখখানা ধারার নজর এড়ালো না। কি নিয়ে এতো ভাবছে অনল ভাই!

*******

জৈষ্ঠ্যমাসের প্রথম দিন, সূর্য্যিমামার আলাদা দাপট। কড়া রোদে উত্তপ্ত পৃথিবী। ক্ষীন বাতাস বইছে সেটাও বেশ উত্তপ্ত। রোদের প্রভাবে গা ঘেমে একসার। এদিকে পশ্চিম আকাশে সফেদ মেঘেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবার কোনো মতলব নেই। এই গরমে বি’চ্ছুজোড়ার সাথে মার্কেটে এসেছে ধারা। তাদের নাকি নতুন জুতো লাগবে। এখানের নতুন স্কুলে নাইনে ভর্তি হচ্ছে তারা। আগে ছোট মামারা থাকতেন ময়মনসিংহে। ওখানেই ছিলো মামার ব্যাবসা ছিলো। কিন্তু এই বছর তার পার্টনার তাকে বিশাল ধো’কা দিয়েছে। প্রতারণা করে সকল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে ময়মনসিংহে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠেছে ইলয়াসের জন্য। নানাভাই কথাটা জানতেন ফলে তিনি ছেলেকে নিজ বাড়তে ডেকে নেন। এতোকাল সবাই জানতো বেড়াতে এসেছে ইলিয়াস ও পরিবার। কিন্তু গতরাতে যখন ইলিয়াস বললো,
“এশা এবং আশাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আগামী সপ্তাহ থেকে ওদের ক্লাস”

তখন সবার বোধগম্য হলো ব্যাপারটা কি! জামাল সাহেব ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ছা’গ’লটাকে বলছিলাম আমার ব্যাবসা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাস না। কিন্তু শুনে নি। অতি শিক্ষিত ছা’গ’ল কি না! যাক এখন যখন সে আমার কাছে ফেরত এসেছেই তাই আমার বাজারে দোকানটা ইলিয়াস ই সামলাবে। আর এই বাড়িতেই ভাড়া থাকবে”

রাজ্জাক বাবার কথায় বলে উঠলেন,
“ভাড়া কেনো থাকবে বাবা! এটা তো ওর বাসা ই”
“কে বলছে? এটা আমার বাসা! তুমি আমার ছেলে, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবো নি তাই তোমার ভাড়া মওকুফ। কিন্তু এই ছাগলটা সেটা করে নি। তাই ওকে ভাড়া দিতে হবে”

ইলিয়াস কিছু বললেন না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। রুবি অবশ্য সুভাসিনীকে আফসোস করে বললো,
“বাবা, এমন কেনো আপা?”
“বয়স্ক মানুষ তো, ছেড়ে দাও”

সেজন্য ধারা এবং জমজ বি’চ্ছুরা মার্কেটে এসেছে। নতুন স্কুলের ইউনিফর্ম, জুতো এবং যাবতীয় জিনিস কেনবার জন্য। তারা শপিং ই করছিলো, অমনি মানুষের ছোটাছুটি শুরু হলো। ধারা দুজনের হাত শক্ত করে ধরলো। একজন পুরুষকে ডেকে বললো,
“আংকেল সবাই দৌড়াচ্ছে কেনো?”
“দা/ঙ্গা লাগছে, মা/র/পি/ট হচ্ছে। এখন সব বন্ধ, বাড়ি যান তাড়াতাড়ি”

কথাটা শোনামাত্র ধারার বুক কেঁপে উঠলো। মার্কেট বাসা থেকে বেশি দূরে নয় সেকারণেই বোনদের দিয়ে সে এসেছে। কিন্তু ঝামেলায় পড়বে কল্পনাও করে নি। এশা এবং আশার হাত শক্ত করে ধরে সেই মার্কেট থেকে বের হতে যাবে অমনি দেখলো দা/ঙ্গা দলেরা মার্কেটের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম জমজেরাও ভয় পেলো। ধারা উপায় না পেয়ে একটা দোকানের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিলো। দোকানী ক্ষতির ভয়ে শাটার দিয়ে দিলো। ধারা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে! বাসায় ফোন দিবে! কিন্তু বাসায় তো শুধু বড় মা এবং ছোট মামী। মামারা তো কাজে গেছেন। তখন ই স্মরণ হলো অনলের কথা। ফোনটা বের করে ডায়াল করলো অনলের নাম্বার। ফোন বাজছে কিন্তু ধরছে না। ধারা আবারোও ফোন করলো, একটা সময় ফোনটা রিসিভ হলো। ধারা আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমি ধারা। আমরা মার্কেটে আটকা পড়েছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। বাসা থেকে দু রোড সামনে সে কাপড়ের মার্কেট সেটা”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই ফোন কেটে গেলো। ধারা আবারো ফোন দিলো কিন্তু ফোন ধরলো না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা, অনল কি আসবে না………..
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১২তম_পর্ব

একটা সময় ফোনটা রিসিভ হলো। ধারা আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমি ধারা। আমরা মার্কেটে আটকা পড়েছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। বাসা থেকে দু রোড সামনে সে কাপড়ের মার্কেট সেটা”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই ফোন কেটে গেলো। ধারা আবারো ফোন দিলো কিন্তু ফোন ধরলো না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা, অনল কি আসবে না। বাহিরে তীব্র শব্দ শোনা যাচ্ছে, ভাঙ্গচুর হচ্ছে, লাঠালাঠি হচ্ছে। শব্দগুলো কর্ণকুহরে আসতেই বুকে জমা ত্রাশ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারা জমজদ্বয়ের হাত শক্ত করে ধরে বয়ে রইলো। এশা এবং আশার মুখ থমথমে, সারাক্ষণ দুষ্টবুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘোরা মানুষও যখন শান্ত হয়ে যায় বুঝতে হবে পরিস্থিতি কত ভয়ানক। দোকানী পুলিশকে ফোন দিলো। আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“স্যার, আমি সমবায় মার্কেটের একজন দোকানদার। এখানে কিছু ছেলেপেলে মারপিট করছে, দোকান ভাঙ্গচুর করছে। আমি শাটার দিয়ে দোকানেই বসে রয়েছি। স্যার, একটু জলদি আসুন। আমার এবং কাস্টোমারের জীবন ঝুকিপূর্ণ”

ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর কি বললো বোঝা গেলো না। ধারা চুপ করে বসে আসে। মনে মনে সকল দোয়া দুরুদ পড়ছে। সে নিজের জন্য আতঙ্কিত সেটা কিন্তু নয়। সে আতঙ্কিত ছোট বোনগুলোর জন্য। নিজ দায়িত্বে বেশ চড়াও হয়ে তাদের মার্কেটে নিয়ে এসেছে। বড় মা কে বলেছে,
“আরে আমি ওদের খেয়াল রাখতে পারবো। আমার বয়সে তুমি তো মা হয়ে গিয়েছিলে আর আমি এই দুটো সামলাতে পারবো না। আর মার্কেট তো কাছেই। যাবো আর আসবো”

সেই বড়াই সব ধুলোয় মিশে গেছে। এই বিপদে পড়বে জানলে কখনোই এমন বড়াই করে আসতো না। ভয়, আতঙ্ক, ত্রাশে তার কপালে ঘাম জমছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিনয়ী স্বরে দোকানীকে বললো,
“আংকেল, একটু পানি হবে?”

দোকানী স্মিত হেসে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। কিন্তু পানিটা খাওয়া হলো। শাটারের উপর তীব্র আঘাতের শব্দ এলো। দা”ঙ্গা”কারীরা দোকান অবধি চলে এসেছে। হয়তো শাটার ভেঙ্গে দোকানে হামলা করার ধান্দা। ধারা কেঁপে উঠলো। দোকানী বললো,
“ভয় পেও না, আমার শাটার মজবুত আছে। ঢুকতে পারবে না। আর আমি ভেতর থেকে তিনটা তালা দিছি”

ধারা দোকানীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না। বুকে জমা ভয়টা তীব্র আকার নিলো। তারা কি সত্যি ঢুকে পড়বে! তারপর কি হবে! আচ্ছা অনল কি সত্যি আসবে না! অনলের কথা মনে পড়তেই পুনরায় ফোন করলো তাকে। কিন্তু এবারো হতাশাই জুটলো। এই আতঙ্কের মধ্যেও আশা এশাকে খোঁচালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভয় পাইছিস?”
“না! নিরস্ত্র বিধায় চুপ করে আছি। সাহসী আমি বটেই তবে নির্বুদ্ধি নই। খালি হাতে বাঘের ডেরায় যাই না”
“কত গোপ মারবি, ফেকুচন্দ্র! স্বীকার কর ভয় পাইছিস”
“আমি কি তোর মতো ভীতু?”

দুজনের মধ্যে বেশ রেষারেষি লাগলো। একেই বিপদ, কিভাবে বাসায় যাবে মাথায় আসছে না। উপরন্তু জমজদ্বয়ের কিচিরমিচির শুনে ক্রোধ সামলাতে পারলো না ধারা। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“চুপ, একদম প্যাপু করবি না। ঝিম ধরে বসে থাক। আরেকবার যদি টু শব্দ করেছিস তো শাটার খুলে দুটোকে বাহিরে দিয়ে আসবো”

ধারার রামধমক কাজে দিলো। দুজনে সাময়িক কালের জন্য চুপ করে গেলো ঠিকই কিন্তু এশা ফাকতালে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভয়ে মহিলার মাথা আওলায়ে গেছে। চুপ থাকাই শ্রেয়”

সময় অতিবাহিত হলো। শাটারের উপর আঘাতের মাত্রা কমলো। ধারা পা এলিয়ে বসে আছে। তার কোলে জমজদ্বয় মাথা দিয়ে অর্ধশোয়া। দোকানী তার কাজ করছে। যেনো কিছুই হয় নি। হঠাৎ সাইলেনের আওয়াজ কানে এলো। মানুষের ছোটাছুটির শব্দ ও কানে এলো। কিছুমানুষের আর্তনাদ ও শোনা গেলো। ধারার সোজা হয়ে বসলো। বেশ কৌতুহল তার মুখে। দোকানী বললো,
“পুলিশ চলে এসেছে, এখন ভয় নেই। এগুলোকে পি’টা’য়ে সোজা করে দিবে। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে যাও”

ধারা মৃদু হাসলো। কিন্তু বুকে একটা চাপা কষ্ট জমা হলো। অভিমান হলো অনলের উপর, সে ধারার বিপদ জেনেও এলো না। চোর ধরার ঐ দিন লোকটার বেশ ভয়ার্ত চেহারা দেখেছিলো ধারা। ভেবেছিলো হয়তো কঠিন মানুষটির হৃদয়ে তার প্রতি টান রয়েছে। তাই তো তাকে হারাবার ভয় ছিলো। কিন্তু সবকিছু মিথ্যে লাগছে। এই অভিমানের কারণটি জানা নেই ধারার। তবে চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা হৃদয়ের অন্তস্থল ছেয়ে গেলো। এশা বলল,
“ধারাপু, এবার বাড়ি যেতে পারবো মনে হয়”

ধারা উত্তর দেবার আগেই শাটারে তীব্র আঘাত কর্ণপাত হলো। আঘাতটি লাঠির নয়, হাতের। দোকানী চিন্তিত হয়ে পড়লো। গ্যাঞ্জাম থেমে গেলে শাটারে কে আঘাত করবে। তখন ই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শোনা গেলো,
“ধারা, এশা, আশা। তোরা কি এখানে? ধারা? এখানে থাকলে উত্তর দে”

কন্ঠটি চিনতে সময় লাগলো না। মূহুর্তেই বুকের মধ্যস্থলে জমা মেঘমেদুর কেটে গেলো ধারার। অভিমান জল রুপে নয়নে জমলো। ভেজা কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমরা এই দোকানে”

দোকানী কিছু বোঝার আগে তাকে বললো,
“আংকেল প্লিজ শাটার খুলে দেন, আমার বর বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে”

দোকানী সময় নষ্ট করলো না। তাড়াতাড়ি খুলে দিলেন দোকানের শাটার। শাটার খুলতেই অনলকে দেখা গেলো। ভয়ার্ত, আতঙ্কিত মুখশ্রী, সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো, উশকোখুশকো, ঘর্মাক্ত শার্টটি গায়ে লেপ্টে আছে। হাতের তালু লাল হয়ে আছে। হয়তো প্রতিটি বদ্ধ দোকানের শাটারে আঘাত করেছে সে। ডানহাত দিয়ে ঠোঁটের উপর জমা ঘাম মুছে নিলো। রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। ধারা তার মুখের দিকে টলমলে চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তারপর কি যেনো হলো তার। ছুটে গেলো অনলের কাছে। জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো তার বলিষ্ঠ বুকে। ধারার এমন কার্যে কিছুটা অবাক হলো অনল। অপ্রস্তুত হলো বটে, তবে ধারাকে বুক থেকে সরালো না। বরং নিবিড় ভাবে দু হাতের বেষ্টিনীবদ্ধ করলো। এশা আশাও ছুটে অনলের কাছে এলো। অনলকে দেখে তারা ভয় পায় ঠিক ই তবে ভয়টি স্বস্তির। তাদের বিশ্বাস অনল ভাই থাকলে কিছু হবার জো নেই। অনল খেয়াল করলো ধারা ঈষৎ কাঁপছে। তার বুকে উষ্ণ জলধারা বইছে। ধারা কি কাঁদছে! আসলে তখন ধারার আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। মূহুর্তে বুকটা ধক করে উঠেছিলো। তাই ফোন কেটে, হাতের কাজ ছেড়ে ছুটে চলে এসেছে সে। বাইকের গতি কতটা ছিলো নিজেও জানে না। ধারা এরপর ফোন করেছিলো ঠিক কিন্তু ধরতে পারে নি। মার্কেটের কাছে আসতেই দেখলো দা’ঙ্গা আগুনের ফুলকির ন্যায় উত্তপ্ত। এই দা”ঙ্গার মধ্যে প্রবেশ করলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। বিপদ আরোও বাড়বে ধারার। যতই হোক অনল তো সুপার হিরো নয়। পচিশ ত্রিশ জনকে মেরে মাটিয়ে লুটিয়ে দিবে। তাই বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে অনল ছুটলো নিকটবর্তী থানায়। সেখানে ইন্সপেক্টর একটু ব্যাস্ত থাকায় তাদের আসতে এতো দেরি হয়েছে। যতই হোক দল বল নিয়ে আসতে হবে বলে কথা! অবশেষে পুলিশের সাথেই এসেছে অনল। একের পর এক প্রতিটি দোকানের শাটারে কড়া নেড়েছে। কিন্তু ধারার শব্দ পায় নি। ধারার মোবাইলেও ফোন করেছিলো ফোন বন্ধ পেয়েছে। অবশেষে বাধা পেড়িয়ে ধারাকে পেয়েছে সে। ধারাকে পাওয়া মাত্র হৃদয়ের কোঠরের ঝড় থেমে গেছে। এক মৃদু শীতল হাওয়া বয়ে গেছে হৃদয় জুড়ে৷ তাই লোকের সামনে জড়িয়ে ধরাতে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও বাধা দেয় নি অনল।

ধারা কান্না থামিয়েছে কিন্তু এখনো কিছুক্ষণ বাদে বাদে ডুকরে উঠছে। কাঁপছে ঈষৎ। অনল তার মুখটা আলতো হাতে তুললো। ভেজা চোখজোড়া মুছে নরম গলায় বললো,
“ভয় পেয়েছিলি?”

ধারা কেবল মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে ভয় পেয়েছে। অনল ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। তারপর ধারাকে দাঁড় করিয়ে দোকানীকে ধন্যবাদ জানালো। তিনটে মেয়েকে সে আশ্রয় দিয়েছে, বিপদ থেকে রক্ষা করেছে এটা কম কিসের। আজকালের ব্যাস্ত ইট পাথরের শহরে আপন মানুষের বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না। সেখানে একজন অচেনা মানুষ তাদের এই দা’ঙ্গা তে সহায়তা করবে ব্যাপারটা অকল্পনীয়। দা’ঙ্গাকারীরা অনেকেই পালিয়েছে। দশ বারো জনকে পুলিশ ধরেছে, মা’র’তে মা’র’তে তাদের জিপে পুরেছেন। অনল জমজদ্বয়কে রিক্সশায় তুলে দিলো। ধারাকে বললো,
“বাইকে উঠ”

ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অবশেষে মিনিট দশেক বাদে বাড়িতে পৌছালো তারা। বাড়িতে ঢোকার পূর্বে জমজদ্বয় ধারার ওড়না টেনে ধরলো৷ গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“আমরা যে ভয় পেয়েছি এটা কাউকে বলো না, প্রেস্টিজের বারোটা বেজে যাবে”

ধারা নিঃশব্দে হাসলো শুধু। বাসায় আসতেই অনলকে দেখে বড়মা হাজারো প্রশ্ন করলেন। অনল বললো,
“পানি দাও, গলা টা ভিজাই। তোমার ভাগ্নি যা দৌড় করালো। গলা কাঠ হয়ে গেছে”

রুবি পানি এগিয়ে দিলো। এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে সকল ঘটনা খুলে বললো অনল। সুভাসিনী এবং রুবির আতঙ্ক দেখে কে! জারি করা হলো আজ থেকে এই তিনজন একা কোথাও যাবে না। অনল, অথবা রাজ্জাক অথবা ইলিয়াস থাকবে তাদের সাথে। এরা ব্যস্ত থাকলে এরা বের হবে না। এশা আশা কিছু বললো না, কারণ ধারা কোনো প্রতিবাদ করে নি। বেচারি বেশ ভয় পেয়েছে। যে কান্ড ঘটেছে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সুভাসিনী তার কপালে চুমো খেয়ে বললো,
“যদি তোর কিছু হয়ে যেতো, কি করতাম বলতো! এর চেয়ে তুই আমার সামনে থাক, ভালো থাক। আমাকে না বলে একা একা বের হবি না”
“যাহা আজ্ঞা বড় মা”

সুভাসিনী বেগম স্মিত হাসলেন। অনল ভেতরে চলে গেলো। এখানে দাঁড়িয়ে কাজ নেই। মা, মেয়ে বুঝুক নিজেদেরটা। ভার্সিটিতে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ ল্যাব স্যাশন নিতে পারবে না সে। অন্য কেউ যেনো নিয়ে নেয়। অন্যদের সাথে কথা বললেও ধারার চোখ অনলকেই দেখে যাচ্ছে। এক স্বস্তি কাজ করে মানুষটা থাকলে। এই অনুভূতিটা বেশ বিচিত্র। এতোকাল অনল ভাই ছিলো কেবলই দাম্ভিক প্রিন্স উইলিয়াম, এখনও সে প্রিন্স উইলিয়ামই আছে। তবে এই প্রিন্স উইলিয়ামটিকে চোখ বুঝে বিশ্বাস করা যায়_________

******

রাতের খাবার পর ধারা ঘরে প্রবেশ করলো। বিছানা করে যেই ঘুমাতে যাবে তখনই গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
“এই ফাকিবাজ, এদিক শোন”

শখের নরম বালিশটা রেখে পেছনে তাকালো ধারা। অনল তখন ল্যাপটপে কাজ করছে। হয়তো আগামীদিনের লেকচার গোছাচ্ছে। সে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুললো না। ওখানে বসেই কথাটা বললো৷ ধারা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। যা একটু ঘুমোবে সেটার জোগাড় নেই। মুখ বিকৃত করে বললো,
“কি হয়েছে?”
“অ’ভ’দ্র মেয়েছেলে, এখানে আসতে বললাম তো। বড়দের সম্মান করতে শেখ”
“বাহ বা, তা আজ সূর্য্যি কোন দিকে উঠলো। আমি তো ভাবলাম আমার সাথে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছো”
“এটা মনে হবার কারণ?”
“প্লাবণ ভাই এর বিয়ের পর থেকে তো এড়িয়েই চলছো। আজ নিজ থেকে কথা বলছো তো হজম হচ্ছে না”

ধারা এগিয়ে আসতে আসতে ঠেস মেরে কথাটা বললো। অনল উত্তর দিলো না। হ্যা, প্লাবণের বিয়ের পর সে ধারার সাথে দরকার ব্যাতীত কথা বলে নি। স্মৃতির কথাগুলো তাকে প্রচন্ড ভাবাচ্ছিলো। নানাবিধ চিন্তা মস্তিষ্ক ঘিরে রেখেছিলো। সত্যি বলতে তাদের বিয়ে একমাস হতে চলেছে অথচ সম্পর্কটা কোনদিক যাচ্ছে নিজেও জানে। ধারাকে বিয়ের রাতেই বলেছে কোনো প্রকার জোর সে করবে না, কিন্তু ধারা যদি তার থেকে মুক্তি চায় তখন কি করবে সে! প্রহেলিকার পেছনে ছুটছে না তো সে! উপরন্তু ফুপা অর্থাৎ সেলিম সাহেব আসলে কি ঘাপলা বাধায় কে জানে! সব কিছু মিলায়ে প্রচন্ড ঘেটে ছিলো অনল। কিন্তু আজকের ঘটনা তাকে সম্পূর্ণ নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই গভীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করবে না।
“কি হলো, ডাকলে কেনো”

ধারার প্রশ্নে চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো অনলের। ধারার দিকে মোটা ক্যালকুলাসের বইটা এগিয়ে বললো,
“পড়তে বয়”
“অনল ভাই! এখন কে পড়ে?”
“আমার বউ, বেশি বকিস না। সিটি, টেস্ট এ যা পেয়েছো তাতে তোমার অবস্থা বোঝা যাচ্ছে, ইহজীবনে আমার কোর্সে পাস করে লাগবে না। তাই পড়তে বয়। এখন থেকে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা আমার কাছে পড়বি। প্যা পু করিস না। পড়তে বয়”

ধারা আর তর্ক করলো না। গোমড়া মুখে পড়তে বসলো। কড়া বর তার না পড়ে উপায় নেই। অনল বই এর গোটা গোটা অংক দাগিয়ে বললো,
“কর”

বাধ্য হয়ে গণিতের সূত্রের মাঝে মন ডুবাতে হলো ধারার। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছিলো কঠিন মুখশ্রীকে। আচ্ছা একটা মানুষ এতো সিরিয়াস হয়! একটু তো স্বাভাবিক কথাও বলা যায়। না শুধু পড়, পড়, পড়।

বহুদিন বাদে গণিতের চাপে ঘুম জড়ো হলো ধারার নেত্রে। বই এর উপর ই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ধারা। ল্যাপটপের কাজ শেষে পাশে তাকাতেই দেখলো মহারাণী ঘুমে কাঁদা। গণিতের খাতা কাটাকুটিতে ভরপুর। এর মাঝে ছোট্ট করে লেখা,
“নিরস, কঠিন, খ’চ্চ’র মানব”

অনল লেখাটি দেখে হাসলো। তারপর সব বন্ধ করে ধারাকে তুলে নিলো কোলে। তখনই চোখ মেলে তাকালো ধারা……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথিপ্রণয় প্রহেলিকা পর্ব -৯+১০
চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here