#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৫ম_পর্ব
ভয়মিশ্রিত চোখে পেছনে ফিরতেই মনে হলো অবয়বটি তার কাছে আসছে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়লো সে। জোড়ানো স্বরে চেঁচালো,
“ভু…..ত, ভু…ত”
সাথে সাথেই অবয়বটি লাইট জ্বালাতো। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে নিদারুণ অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, ভুত না। আমি ধারা”
অনল এখন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ধারার দিকে। ধারা খেয়াল করলো সে প্রচন্ড ঘামছে। তার ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আছে। মুখ ফুলিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত অনলকে দেখে ধারাও খানিকটা বিচলিত হয়ে যায়। টেবিলে রাখা বোতলটি এগিয়ে বলে,
“শান্ত হও, আমি। পানি খাও, ভালো লাগবে”
অনল কাঁপা হাতে পানির বোতলটা নিলো। এক নিঃশ্বাসে পানি খেলো সে। এখন একটু স্বাভাবিক লাগছে। ভয়টা এখনোও পুরোপুরি কাটে নি। বুকটা ঈষৎ কাঁপছে, হৃদস্পন্দন বেসামাল এখনো। হয়তো পালস অক্সিমিটারে মাপলে শ এর উপরে পালস পাওয়া যাবে। অনল কিঞ্চিত স্বাভাবিক হতেই ফট করে ধারা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তুমি কি ভুতে ভয় পাও, অনল ভাই?”
প্রশ্নটা কর্ণপাত হতেই তীব্র লজ্জা ঘিরে ধরলো অনলকে। আঠাশ বছরের তাগড়া যুবক নাকি ভুতে ভয় পায়, ব্যাপারটা শুধু হাস্যকর ই নয়; চরম লজ্জাজনক। উপরন্তু এতোকাল তার ভাবগাম্ভীর্যের জন্য ছোট ছোট ভাই বোনদের মাঝে একটা দাপট আছে। বড় হবার কারণে সবার উপর একটা রাজত্ব খাটানোর অধিকারটি তার জন্মলগ্ন থেকে প্রাপ্ত। সেখানে এতোবড় দূর্বলতাটি যদি প্রকাশ্যে চলে আসে তবে মান ইজ্জতের আর রেহাই হবে না। তার থেকেও বড় কথা একজন গণিতের টিচার কিনা ভূতে ভয় পায়, এ যদি সমাজ জানে তবে আর মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না। অবশ্য এতে তার দোষ নেই। ভয় একটা প্রবৃত্তি, যা মনের অজান্তেই চুপিসারে ঢুকে পরে মনের গহীনে। তারপর ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করে। শাখা প্রশাখা মেলে নিজের রাজত্ব তৈরি করে। মস্তিষ্কের অজান্তেই এই ভয়ের বিস্তার হয়। তারপর কোনো একটা ঘটনায় ঘাপটি মারা ভয় লাফিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। অনলের সাথেও তাই হয়েছে। ছোটবেলার বিশ্রী স্মৃতিটুকু এতোকাল বুকের ভেতরে ঘাপটি মেরে ছিলো। হটাৎ ওই রুপে ধারাকে দেখেই তা বেড়িয়ে এসেছে। এটার যুক্তিও অনল তৈরি করেছে। তার মনে ছিলো না ধারা এখানে থাকে, সারাদিনের ক্লান্তিতে তার মস্তিষ্ক প্রায় বন্ধ হবার পর্যায়ে ছিলো। আলো আঁধারে মিশ্রণে ওভাবে ধারার অবয়বে তার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তাই অজান্তেই “ভুত, ভুত” বলে চেঁচিয়েছে। এটা অবচেতন মনের কারসাজি ব্যাতীত কিছুই নই। যদি হিমুর মতো বেখেয়ালি, আধ্যাত্মিক চরিত্র ভয় পেতে পারে, মিছির আলির মতো শক্ত মস্তিষ্কের, নিপুন চিন্তার বুদ্ধিমান চরিত্র ভয় পেতে পারে; এতো অনল। সার্লোক হোমস ও এক বার ভয় পেয়েছিলো। কবে মনে নেই অনলের। গলা খাকারি দিয়ে ধারার প্রশ্ন এড়াতে সে প্রতিবাদী স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি মো…মোটেই ভুতে ভ..ভয় পাই না”
“তাহলে চেঁচালে কেনো?”
“আর কেনো! সাঁঝবেলায় এমন শা’ক’চু’ন্নি সেজে ঘুরলে যে কেউ ভয় পাবে। আমি ক্লান্ত, তাই হুট করে আয়নায় তোকে দেখে একটু বিচলিত হয়ে গেছিলাম। মোটেই ভয় পাই নি”
অনলের জড়ানো কথাগুলো এতোসময় শুনছিলো ধারা। কিন্তু আর কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। রগচটা, গম্ভীর, দাম্ভিক, আত্নজেদী, কঠিন অনল কিনা ভুতে ভয় পায়। মানা যায়! এটা তো কাজিন মহলে আগুনের মতো ছড়িয়ে যাবে। অনলের এতোকালের রাজত্বকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে এই একটা তথ্য ই যথেষ্ট। ধারা হাসতে হাসতে খাটে শুয়ে পড়লো। শুধু জমজ বি’চ্ছুদের জানালেই এটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে। অপরদিকে নিজের কাজে নিজের উপর ই রাগ হচ্ছে অনলের। এতোকালের সুপ্ত দূর্বলতাকে কিনা ধারার কাছেই ধরা পড়লো। ধমকের স্বরে বললো,
“পা’গ’লে’র ন্যায় হাসছিস কেনো? হাসি থামা”
বলেই ওয়াশরুমে ছুটলো সে। ধারার হাসি থামছেই না। বিশেষ করে, অনলের বিব্রত মুখখানা। কানজোড়া লজ্জায় রক্তিম হয়ে আছে। বিকেলের মন খারাপগুলো কোথায় যেনো উবে গেলো। কালো মেঘগুলো সরে উদিত হলো স্বর্ণালী কুসুম প্রভা। অবশেষে বাগে পাওয়া গেলো প্রিন্স উইলিয়ামকে_______
খাবার টেবিলে অনল চুপ করে থাকলো। বিব্রত, লজ্জা, ক্রোধে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। খাওয়াটাও গলা দিয়ে নামলো না। ছোট মামা তাকে দু বার জিজ্ঞেস করল,
“তোর কি শরীর খারাপ আব্বা?”
“না, চাচু। একটু ক্লান্ত”
অনলের চুপসানো মুখখানা প্রচন্ড প্রশান্তি দিচ্ছে ধারাকে। সে প্রসন্নমুখে খাবার খাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এভারেস্ট জয় করেছে সে। এতো বড় অস্ত্রটিকে গভীর চিন্তার সাথে ব্যাবহার করবে সে। এশা ধারাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“ধারাপু কি হয়েছে? একটু পর পর মৃ’গী রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে হাসছো কেনো?”
“লটারি পেয়েছি”
“কত টাকার?”
“অমূল্য লটারি”
এশা বুঝলো না কিছু। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললো, “এই মহিলার মাথা গেছে”
ধারার প্রসন্নতা নজর এড়ালো না। এই মেয়ের ভরসা নেই। কখন ধুপধাপ কাহিনী ফাস করে দিবে ঠিক নেই। তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো অনল। সিদ্ধান্ত আপোশের।
খাবার পর প্রসন্নচিত্তে রুমে ঢুকতেই অনলের মুখোমুখি হলো ধারা। তীর্যক চাহনী, নির্বিকার মুখশ্রীটাকে উপেক্ষা করেই ধারা ঢুকে পড়লো ঘরে। তখন ই অনল ই তাকে ডেকে উঠলো। ধারা আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবে?”
চরম ইতস্ততা লক্ষ্য করা গেলো অনলের মাঝে। কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু বলতে তো হবেই, কোনো মতে গড়গড় করে বললো,
“আজ সন্ধ্যায় যা হয়েছে সেটা যেনো এই ঘরের বাহিরে না যায়”
“কোন কথাটা? তুমি ভুতে ভয় পাও?”
“ভয় পাই না, একটু ঘাবড়ে গেছিলাম”
খানিকটা প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলো অনল। ধারা ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। তারপর বিস্তর ভাব দিয়ে বললো,
“আমার বয়েই গেছে তোমার আদেশ মানতে! প্রিন্স উইলিয়াম বলি বলে মনে করো না সত্যি সত্যি তুমি প্রিন্স উইলিয়াম। আমি আমার মর্জির মালিক।”
বলেই চলে যেতে নিলে চট করে তার হাতটি টেনে ধরলো অনল। হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আকস্মিক কাজে খানিকটা চমকে উঠলো ধারা। তাদের মধ্যকার দূরত্ব বেশি না, অনলের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে ধারার মুখশ্রীতে। সুগভীর চাহনী ধারার চোখের মাঝে আবদ্ধ আর তার শক্ত বাহুর বেষ্টনীতে ধারা আবদ্ধ। এক মাদক গন্ধ নাকে এলো ধারার। গন্ধটি কি অনলের স্বতন্ত্র! জানা নেই। অনলের এমন কাজে ক্ষণিকের জন্য হলো ঈষৎ কেঁপে উঠলো ধারা। ভীষণ লজ্জা ভর করলো সমস্ত শরীরে। আত্মবিশ্বাসগুলো উবে গেলো। কিছু বলার আগেই অনল বললো,
“এক মাঘে শীত যায় না, প্রথম বার রিকুয়েষ্ট করছি। ভাব দেখাস না। ঘুরে ফিরে এই ঘরেই থাকবি তুই”
তারপর বাঁকা হেসে ছেড়ে দিলো সে ধারাকে। আবারো কুপোকাত হলো ধারা। তীব্র অপমান, লজ্জা, ক্রোধের সংমিশ্রণে গা জ্বলে উঠলো। ঝাঝালো স্বরে বললো,
“ভয় দেখাচ্ছো, আমি ভয় পাই না”
“আচ্ছা যা, যদি তুই ঘটনাটা চেপে যাস আমি তোর যেকোনো তিনটে ইচ্ছে পূরণ করবো। যেকোনো তিনটে। যা বলবি তাই”
ধারা সন্দিহান নজরে চাইলো তার দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না দাম্ভিক প্রিন্স উইলিয়াম তার সাথে আপোশ করতে চাচ্ছে। ধারা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“বেশ, চারটে। এর মধ্যে একটি আজ থেকে আমি ঘুমানোত সময় লাইট অফ থাকবে। আর বাকিগুলো ভেবে দেখবো”
“বেশ রাজী আমি। কিন্তু এশা, আশা যেনো ঘুণাক্ষরেও সন্ধ্যের ঘটনা না জানে”
“বেশ। আর কিছু?”
“না”
আপোশ করে নিলেও ধারা বেশ চিন্তিত, ঠ’কে গেলো না তো! চারটে ইচ্ছের তো একটি ই শেষ। আর তিনটে কি এমন চাওয়া যায় যাতে এই প্রিন্স উইলিয়ামের অ’রা’জ’ক’তা’ থেকে মুক্তি পাবে সে। অন্যদিকে ধারার দিকে সুগভীর নয়নে তাকিয়ে স্মিত হাসে অনল। এতো ছেলেমানুষ কেনো মেয়েটা! হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর কখনো পাবে না সে_________
*****
ধারার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ সকালে, উষ্ণ কোমল প্রভা পর্দা ভেদ করে চুপি চুপি তখন রুমে প্রবেশ করছে। মৃদু নরম সোনালী রোদ। চোখ কচলে উঠে বসলো ধারা। কোলবালিশের দেওয়ালের ওপাশের জায়গাটা শীতল। অনল নেই, খানিকটা অবাক হলো কিন্তু গা মাখালো না। আজকাল তার মনটা ফুরফুরে। অনলের ঘরে থাকলেও খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। এখন আর সে কাজের বাহানায় লাইট জ্বালিয়ে উত্যোক্ত করে না ধারাকে। ফলে নির্বিঘ্নে ঘুমায় ধারা। ক্লাসেও মোটামুটি ভালোই চলছে। মাহিটাও সেদিনের পর চিঠি দেবার জিদ করে নি। গা টানা দিয়ে উঠলো ধারা৷ আজ তাড়াতাড়ি যাবে ভার্সিটিতে। নাস্তাটাও করবে ক্যাফেটেরিয়াতে। আজ একটা বিশেষ দিন। তাই লেট করা যাবে না। ঝটপট তৈরি হলো সে। মুখ ধুয়ে বই খাতা গুছিয়ে নিলো। সাদা একটা জামা পড়ে নিলো, চুল গুলো একপাশে নিয়ে বেনুনী বাধলো। ঠোঁটে দিলো মিস্টি রঙ্গের লিপস্টিক। বেশ ভালো করে সেজেগুজেই বের হচ্ছিলো। তখন ই বাধলো বিপদ। জামাল সাহেব বসার ঘরে চা খাচ্ছিলেন। ধারাকে বের হতে দেখেই উনি নতুন ফরমান জারি করলেন,
“আজ থেকে তোমারে কলেজে অনল দিয়ে আসবে। ওই তোমারে নিয়ে আসবে”
অনল তখন নাস্তা করতে ব্যাস্ত৷ নানাভাই এর এমন অযৌক্তিক ফরমানের কোনো প্রতিবাদ সে করলো না। কিন্তু ধারা বলে উঠলো,
“কেনো? আমি তো একাই যেতে পারি”
“তাতে কি ধারারানী! যাইবা তো একই জায়গায়। তোমার স্বামীও তোমার দায়িত্ব নিক। যাতে তোমার বাপ আমার উপর আঙ্গুল না তুলতে পারে”
নানাভাই এর যুক্তির কাছে কোনো যুক্তি দেখাতে পারলো না ধারা। সুভাসিনী ও হেসে বললো,
“একদম ঠিক বাবা, আমার কি টেনসন হয় বলবেন না। মেয়ে মানুষ একা একা যাতায়াত করে। দিনকাল তো ভালো না। আর ছেলেরা যা পা’জি। আমার ধারাও তো কম সুন্দরী না। যদি উঠিয়ে নিয়ে যায়”
“মানুষের বুদ্ধির এতো আকাল পড়ে নি, যে ধারাকে তুলে নিয়ে যাবে। জানের মায়া সবার থাকে”
মিনমিনিয়ে কথাটা বলেই উঠে গেলো অনল। ধীরে বললেও কথাটা ঠিক কানে গেলো ধারার। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে যদি কাউকে ভস্ম করা যেনো তবে আজ অনলকে করতো সে। নানাভাইকে যুক্তি দেখাতে যেও পারলো না। বৃদ্ধ মানুষটির কাছে যেনো সব কিছুর উত্তর আছে। তাই বাধ্য হয়েই অনলের সাথে যেতে হবে তাকে। বের হতেই দেখলো প্রিন্স উইলিয়াম তার যানে উঠে বসে আসেন। ব্যস্ত গলায় বললো,
“আসুন, মহারাণী। এই দা’সকে কৃতার্থ করুন”
মনে মনে হাজার গালমন্দ করলেও নুখে প্রকাশ করলো না। উঠে বসলো অনলের বাইকে। পিচের রাস্তা চুরে চললো অনলের বাইকটি।
ভার্সিটির গেট থেকে বেশ দূরত্বে আসতেই ধারা ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
“এখানে রাখো, আর যেও না”
“কেনো?”
“আমি চাই না, তোমার সাথে আমাকে কেউ দেখুক। হট টপিক হয়ে যাবো”
অনল বাইক থামাতেই নেমে পড়লো ধারা। অনল কিছু বলার আগেই ছুটলো সে। অনল চেয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। আশপাশ নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো ধারা। তার বন্ধুমহল বা ক্লাসের কাউকেই নিজরে পড়ে নি। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”। দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকেই পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো দিগন্তের। তীর্যক নয়নে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার বন্ধুদের একজন। ধারা কিছু বলার পূর্বেই সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“অনল স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”……….
চলবে#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
কিন্তু কথায় আছে, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”। দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকেই পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো দিগন্তের। তীর্যক নয়নে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার বন্ধুদের একজন। ধারা কিছু বলার পূর্বেই সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“অনল স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”
প্রশ্নটি শুনতেই পিলে চমকে উঠলো ধারার। চুরি করতে যেয়ে অপরিপক্ক চোরেরা ধরা পড়ে গেলে যেমন আমতা আমতা করে ঠিক তেমন আমতা আমতা করতে লাগলো সে। মস্তিষ্কটা হুট করেই যেনো ল্যাপটপ এর উইন্ডোজ শাটডাউনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরটা অতি সরল তবুও যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ধারা। আমতা আমতা করে বললো,
“কিসের সম্পর্ক, কোনো সম্পর্ক নেই! উনাকে তো এর আগে আমি দেখি নি”
“অনল স্যারের বাইক থেকে তোকে থামতে দেখেছি আমি, ঝেড়ে কাশ। লুকিয়ে লাভ নেই”
শীতল অবিচলিত কন্ঠে কথাটা বললো দিগন্ত। ধারা বুঝলো মিথ্যের পাহাড় বানিয়ে লাভ নেই। দিগন্তের শ’কু’নী নজর তাকে দেখে ফেলেছে। দিগন্তের এই পেইজ থ্রি রিপোর্টারদের মতো সকল জায়গায় উপস্থিত হবার ব্যাপারটা বড্ড অপছন্দ ধারার। যখন ই কিছু হয় সবার আগে সেটা তার নজরেই পড়তে হয়। উপরন্তু সেই খবরটা বিবিসি চ্যানেলের মতো সারা ক্লাসে ছড়াবার মতো মহান কাজটিও সে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে। একটা ছেলে যে এতোটা চু’গ’ল’খোর হতে পারে ওকে না দেখিতে ধারা জানতো না। তবুও তার সাথে ধারার সখ্যতা আছে। কারণ ব্রেকিং নিউজ শুনতে কার না ভালো লাগে। ল্যাব স্যাশনের মাঝে হুট হাট কে কাকে প্রপোজ করলো, কোন মেয়ের কোন সিনিয়রের উপর ক্রাস, কোন জোড়া কপোত কপোতী স্যারের নজরে পড়লো, কোন কোন গ্যাং মা’রা’মা’রি করে মাথা ফা’টা’লো ব্যাপারগুলোর মশলাদার গল্প শুনতে খুব একটা মন্দ লাগে না। ছাত্র হিসেবে ডাহা ফেলু হলেও খবর প্রচারে সে একশ তে একশ। এখন তাকে যদি ধারা জানায় সে শ্রদ্ধেয় নতুন স্যারের স্ত্রী, তাহলে পরদিন সকালে সে হয়ে যাবে ভার্সিটির জমজমাট খবর। ধারা চায় না হট টপিক হতে। বন্ধুমহলে আলোচনা, সমালোচনার মধ্যমনি হওয়াটা ততটা খারাপ নয় যতটা তাকে এড়িয়ে চলাটা। স্যারের বউ এর সাথে কে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবে! যা একটু অনলের নামে দু চারটি সমালোচনা শুনে কান জুড়াতো আর হিহি হাহা করতো সেটাও হবে না। গাল ফুলিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। হতাশ গলায় বললো,
“আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই তো”
“ঠিক তাই চাঁদ, বলে ফেলো। কেনো তার বাইকে চড়ে এলি? কে হয় উনি?”
“দেখ তুই তো জানিস আমি মামাবাড়িতে মানুষ”
“হ্যা, তো?”
“অনল ভাই, মানে আমাদের অনল স্যার আমার বড় মামার ছেলে। উনি আমার মামাতো ভাই। সে কারণেই তার বাইকে চড়ে আসা। যদি আমার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু কি করবো বড়দের কথার অমান্য করা আমার স্বভাবে নেই”
ধারার কথা শেষ হবার আগেই তীব্রর স্বরে দিগন্ত বলে উঠলো,
“স্যার তোর মামাতো ভাই আগে বলিস নি কেনো?”
সাথে সাথে ধারা তার মুখ চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এজন্য বলি নি, তোর পেট তো ফাটা ঢোল। একটা কথা চেপে রাখতে পারিস না। শুধু মাহি জানে, কারণ ও আমার স্কুলের বান্ধবী। আর খবরদার দিগন্ত, ক্লাসে কেউ যদি জানে আমি তোর দাঁত ভে’ঙ্গে দিবো”
নিজ মুখ ছাড়াতে ছাড়াতে দিগন্ত বলে উঠলো,
“এতে এতো লুকোচুরির কি আছে! বরং এটা তো আরোও ভালো! ক্লাসের লোক তোকে মাথায় তুলে নাচবে”
“হ্যা, কিন্তু যখন দেখবে ওই অনল স্যার আমাকে দু পয়সার দাম দেয় না সেই মাথা থেকেই আছাড় মেরে ফেলে দেবে। তুই ভাই আমার, একটু চুপ করে থাক। সময় হলে আমি নিজেই বলবো”
“তোর ভাই হতে আমার বয়েই গেছে”
মিনমিনিয়ে কথাটা বললো দিগন্ত। ফলে ধারার কানে গেলো না। সত্যি লুকানোকে কি মিথ্যের কাতারে ফেলা যায়! প্রশ্নটির উত্তর জানে না ধারা। তবে ভার্সিটি জীবনে খানিকটা শান্তির জন্য এই পথটাই বেশি উপযুক্ত লাগলো তার কাছে। হৃদয়ের অন্তস্থলে কিঞ্চিত খচখচানি থাকলো অবশ্য, ঠিক কেনো জানা নেই! হয়তো অব্যক্ত অর্ধেক সত্যিখানাই কারণ। ধারা বেশি ভাবলো না। দিগন্তের সাথে পা বাড়ালো ক্লাসের পানে। এদিকে তাদের দুজনকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে এতোসময় লক্ষ্য করছিলো কেউ। দৃষ্টিটি প্রখর এবং সুচালো, যতসময় তাদের দেখা যায় ঠিক ততসময় তাকিয়ে থাকলো সে। তারপর গমন করলো নিজ গন্তব্যে________
ক্লাসে আজ বেশ রমরমা পরিবেশ। কেক আনা হয়েছে, একটা প্লাস্টিকের ছু’রির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আজ একটা বিশেষ দিন। আজ প্লাবণ স্যারের জন্মদিন। গত সেমিস্টারে মানুষটি তাদের ক্যামিস্ট্রি কোর্স নিয়েছিলো। ধারার মতো পুরো ক্লাস তার ভক্ত। কারণ পয়তাল্লিশ মানুষের একজন ও ফেল করে নি। বরং সবার কোর্সে গ্রেড ছিলো ভালো। তাই সকলের তার প্রতি ভালোবাসাটাও মাত্রাতিরিক্ত। ফেসবুকের জামানায় স্যারে জন্মদিন জানা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, সে তো অনল স্যার নন যার ফেসবুক আসে কি না ব্যাপারটা সন্দিহান। আর পছন্দের স্যারের জন্মদিন পালন করা আজ একটা ফ্যাশন ই বলা যায়। ফলে প্লাবণ স্যারের জন্মদিন পালনের জন্য ই এতো আয়োজন। ধারাও ঠিক সে কারণেই হালকা সেজেগুজে এসেছে। কিশোরী মনের আবেগ ই হোক না, তাকে যত্ন করতে দোষ কোথায়! সে তো আর মনের কথাটা উজার করে বলছে না। শুধু মানুষটার বিশেষদিন পালন করবে। প্লাবণ ভাই এর জন্য সে একটা উপহার ও কিনেছে। কেক কাটার পর দিবে। ক্লাসের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ প্লাবণকে ডেকে আনলো। প্লাবণের ক্লাস না থাকায় সে এলোও। এতো চমৎকার আয়োজন দেখে আবেগে আপ্লুত ও হলো। কিন্তু ধারার উপহার দেওয়াটা হলো না। সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো একটাই মানুষ অনল, কেক কাটার সাথে সাথেই সে তার ক্যালকুলাসের বই নিয়ে হাজির হলো। প্লাবণ কোনো মতে বললো,
“সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, এমন বার্থডে হবে জানতাম না। সত্যি ভালো লেগেছে। কেকটা কেটে তোমরা খেয়ে নাও। অনল স্যার যেহেতু দাঁড়িয়ে আসেন আর আমি সময় নিবো না। আরো একবার বলবো ধন্যবাদ”
প্লাবণ বেড়িয়ে গেলে ছাত্ররা কেক খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাই খেলেও ধারা খেলো না। কারণ তার স্বযত্নে আনা উপহারটি এখন তার হাতেই রয়ে গেলো। প্লাবণকে দেওয়া হলো না। এদিকে চরম বিরক্তি ফুটে উঠলো অনলের মুখে। একেই গরমে শার্টখানা ভিজে গেছে অথচ তার ক্লাসের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ছাত্ররা মনের সুখে কেক খাচ্ছে, এদের কারোর ই হয়তো মনেও নেই আর দু মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘষতে ঘষতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“হয়েছে তোমাদের?”
“জ্বী স্যার”
অনল সময় নষ্ট না করেই ভেতরে প্রবেশ করলো। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিমায় বললো,
“এই যে পেপার। প্রত্যেকে পাস করে দাও। আজ তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট নিবো”
সারপ্রাইজ টেস্টের কথাটা বিশাল এট্যোম বো’ম্ব এর মতো কাজ করলো। ছাত্রছাত্রীদের উল্লাসগুলো মূহুর্তেই উবে গেলো। রিপ্রেজেনটেটিভ আমতা আমতা করে বললো,
“স্যার, সারপ্রাইজ টেস্ট?”
“হ্যা, দশ মার্কের। এটা ক্লাস এস্যাসমেন্টের সাথে যুক্ত হবে। ফাস্ট পেপার পাস করো”
সকলের মুখ থমথমে। পরীক্ষা শুরু হলো, অনল পায়চারি করছে। ধারার বেঞ্চের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে গেল। সূঁচালো চোখে দেখলো ধারার সফেদ খাতা। রোল ব্যাতীত একটা লাইন ও লেখা নেই। সে প্রশ্ন ও তুলে নি। অনল কিছুসময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। যার অর্থ, “তুই ক্লাসে কি একটু মনোযোগী হতে পারিস না! আমার বউ এতো গ’বে’ট কেনো!” কিন্তু তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধারা তার সাদা খাতা কাটাকাটি খেলতে লাগলো। সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর আবার হাটতে লাগলো। ব্যাপারটা দিগন্তের চোখ এড়ালো না।
ক্লাস শেষে বন্ধুমহল বসলো ক্যাফেটেরিয়ায়। আজ ল্যাব নেই। সব ক্লাসের ঝামেলাও শেষ। নীরব ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারের রফিক মামাকে বললো,
“মামা, সবাইকে সামুচা আর তরমুজের শরবত দাও তো”
“দেতাছি, বসো। এই ছোটন, পাঁচ নম্বর টেবিলে পাঁচটা সামুচা আর ৫টা জুস দে”
এর মাঝেই অভীক বলে উঠলো,
“অনল স্যার আজ কি কাজটা করলো? সারপ্রাইজ টেস্ট! আরে জানিয়ে পরীক্ষা নিলেও পাই দশে দুই সেখানে সারপ্রাইজ টেস্ট নেবার কি মানে? আমি সাদা খাতা জমা দিয়েছে। নীরবকে উঠিয়ে দিলো। ধ্যাত”
“ভালো হয়েছে, তোমরা লেকচার তুলবা না আর মার্ক চাবা সেটা তো হবে না। এটা পরশুদিন ই করিয়েছিলো ক্লাসে”
“এজন্য তো তোকে এতো ভালোবাসি। আজ নোট খাতাটা নিয়ে যাবো”
নীরব এবং অভিকের কথার মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“ধারা তো নিশ্চয়ই দশে দশ পাবি!”
“এটা কেনো মনে হলো?”
“অদ্ভুত তোর ভাই তোকে জানায় নি, এটা হতে পারে?”
যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। দিগন্ত কথাটা ফাস ই করে দিলো। অমনি সকলের দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে গেলো। দিগন্তের দিকে কটমট করে চাইলেও সে তা উপেক্ষা করে বললো,
“ক্লাসে কেউ পাস না করলেও ধারা ঠিক ই পাস করবে”
“অনল স্যার তোর ভাই? আগে বলিস নি কেনো?”
“এতো বড় কথাটা তুই চেপে গেলি?”
সকলের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উঠলো ধারা। তাই বাধ্য হয়ে খোলসা করলো তার এবং অনলের সম্পর্কটি। সব শুনে অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক বলেছিস, এই কাজিনগুলো নষ্টের গোড়া। দেখ না আমার কাজিন জিআরই তে ভালো নম্বর পেয়ে জার্মানি তে স্কোলারশিপ পেয়েছে। আমার ফুপু সুন্দর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। ফলে সেই মিষ্টিতে ভ্যাজানো কথাগুলো আমার নসিবে জুটলো। বাবা তো বলেই দিয়েছে এবার যদি আমি রিটেক খাই সোজা বাড়ি ছাড়া করবে”
এতো আলোচনার মাঝেও মাহিকে দেখা গেলো চুপচাপ। সে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। ধারা দু চার বার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। ম্লান হেসে বললো,
“কিছুই হয় নি”
হঠাৎ সে উঠে বললো,
“তোরা খা, আমি একটু আসছি”
“কোথায় যাস”
“কাজ আছে”
আর প্রশ্ন করলো না ধারা। নির্বাক চাহনীতে মাহির যাওয়া দেখলো। তখন ই উপহারের কথা স্মরণ হলো। সেও বললো,
“তোরা খা, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি”
ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়েই একাডেমিক বিল্ডিং এর দিকে হাটা দিলো ধারা। তার ভার্সিটির একাডেমিক এ উলটো দিক থেকে যেতে কোথায় একটা মাঠ পড়ে, সেখানে নরম ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয় ছাত্ররা। দুপুর বেলায় মাঠটা প্রায় থাকে নির্জন। সূর্যের জ্বলন্ত রোদ সরাসরি পড়ে বিধায় এই সময়ে এখানে কেউ আসে না৷ তাই এই পথটাই বেছে নিলো ধারা। প্লাবণ ভাইকে উপহার দেওয়াটা কারোর নজরে না পড়াই ভালো। ধারা বিল্ডিং এর দিকে বাক নিতেই থেমে গেলো সে। মাঠের এক কোনায় দুটো পরিচিত মুখের দর্শন পেতেই তার পা থেমে গেছে। অনল এবং মাহিকে দেখা যাচ্ছে। মাহি মাথা নিচু করে আছে। লাজুক দৃষ্টি তার। ধারা একটু এগিয়ে গেল। লুকিয়ে এক কোনায় দাঁড়ালো সে। তখন ই মাহির মৃদু স্বর কানে এলো,
“অনলভাই, আমি আপনাকে বহুদিন যাবৎ পছন্দ করি………
চলবে
(
মুশফিকা রহমান মৈথি
মুশফিকা রহমান মৈথি