প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৬)
সাক্ষরের স্থানে গিয়ে আঁখির হাত যেন আটকে গেল,সেখানে সাক্ষর করার ক্ষমতা জুটিয়ে উঠতে পারছে না,যার জন্য জীবনের সুন্দর সম্পর্কগুলো ত্যাগ করল আজ তাকেই ত্যাগ করতে হবে ভেবেই বুকের ভিতরে শুন্যতার ছড়াছড়ি হল আঁখির,ভ**য়া**নক এক খাপছাড়া অনুভুতি যা প্রকাশ করার কোনো ভাষা আছে বলে আঁখির জানা নেই,সে অ*লক্ষু**ণে অনুভুতি যার সাথে হয় সেই তার প্রখ**ড়**তার আন্দাজ করতে পারে। আঁখি বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল কাগজখানা,এমনই তো ছিল আদ্রিশের সাথে তার বিয়ের কাবিননামা,সেদিন একটা সাক্ষরের বিনিময়ে সব ত্যা*গের মাধ্যমে আঁখি প্রবেশ করেছিল আদ্রিশের জীবনে।সেদিন বুকে জড়িয়ে আদ্রিশ বলেছিল তাকে।
″আজ নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী বলে মনে হচ্ছে আঁখি,অবশেষে আজ আমি তোমাকে পেয়ে গেলাম।কখনও ছেড়ে যাবে না তো আমায়?″
″তোমাকে পাওয়ার জন্য সবাইকে ছেড়েছি,তোমাকে কিভাবে ছাড়ি বলো!তুমি যে নিশ্বাসে নিহিত,জীবনভর তোমার হয়ে থাকতে চাই।কখনও তৃতীয় কেউ এনো না আমাদের ভালোবাসার কাঁটা হিসেবে, সহ্য করতে পারব না আমি।″
″এ জীবনে তোমার পরে কেউ কখনও আসে নি আর আসবেও না আঁখি,তোমাকে ছাড়া এ হৃদয় যে কিছুই বুঝে না,তুমি ছাড়া যে আমি বদ্ধ উ**ন্মা**দ,সারাজীবন পাশে থাকবে কথা দাও।″
″ভালোবাসা আমাদের দু’জনে সীমাবদ্ধ থাকলে কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না কথা দিলাম।″
″আমাদের ভালোবাসা আমাদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে আমিও কথা দিলাম।″
চোখ টপকে ডিভোর্স পেপারের গায়ে আ*ছ**ড়ে পরল আঁখির চোখের দুফোঁটা জল।আদ্রিশ যে তার কথা রাখে নি,তবে আঁখি তার কথার খেলাফ যাবে না,সে তার কথা রাখবেই,মানিয়ে নিবে সব বি**চ্ছে**দ যন্ত্রণা,হোক না তা পাহাড় পরিমাণ,হোক না তা মৃ**ত্যু যন্ত্রণার সমতুল্য। মুছলো আঁখি আঁখিজল,কলমটা এবার বসিয়ে দিল জায়গা মত করে দিল সাক্ষর।ছাড়ল সস্তির এক নিশ্বাস।
আদ্রিশ কক্ষ থেকে বের হচ্ছিল আঁখির উদ্দেশ্য, আবারও ওকে নিজের কথায় আনার এক প্রচেষ্ঠা করবে বলে ঠিক করল তখন একজন কাজের লোক একটা কাগজ এনে আদ্রিশের হাতে দিয়ে বলল।
স্যার আঁখি ম্যাডাম এটা দিয়েছেন আপনাকে দেওয়ার জন্য।
আদ্রিশ কাগজখানা হাতে নিয়ে যেন আকাশ থেকে পরল,চোখ ছা*না*বা*না হল মুহুর্তে, ডিভোর্স পেপার যেটাতে আঁখির সাইন আদ্রিশের অন্তর অল্পতে পো**ড়ি**য়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথার্থ হল।চোখে জল এসে বাসা বেঁধে গেল এক পলকেই।
আঁখি শাশুড়ি মায়ের পায়ে ধরে সালাম করে নিল,শাশুড়ি মা কান্নারত অবস্থায় তার মাথায় হাত রেখে দোয়া দিলেন তাকে।
″আল্লাহ তোকে তোর প্রাপ্য সুখ যেন দান করেন মা,দোয়া করি,ভালো থাকিস,এই বুড়িকে ভুলিস না।″
″প্রাণ থাকতে তোমাদের ভুলব না মা,দূরে চলে যাচ্ছি বলে ভেবো না সম্পর্কে দূরত্ব চলে আসবে,আমি দূর থেকেও তোমাদের পাশে সর্বক্ষণ থাকব।″
শুভ্রতা আঁখিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলল।
″আমাকে ক্ষমা দাও আঁখি,চেয়েও তোমার জন্য কিছু করতে পারি নি আমি।″
″ধূর, পাগলি বোন আমার,আমি কোনো অবলা না কি যে আমার জন্য কিছু করতে হবে তোমায়,তুমি নিজের,মায়ের আর আমার ভাই, ভাইপো এর খেয়াল রেখো আমার আর কিছু চাই না,কেমন।″
বুকের ব্যা*থা সযতনে বুকে চেঁপে জো*র করে আলতো হাসি মুখে টেনে এনে বলে গেল আঁখি কথাগুলো,বুক ফেঁ*টে কান্না আসছে তার তবে নিজেকে আজ দূর্বল পরতে দিবে না ভেবে নিয়েছে।ছোট্ট রিহানকে কতগুলো চকলেট দিয়ে তার গালে চুমু খেলো,নিজের সন্তানের মতই যে এতদিন ওকে ভালোবেসেছিল আঁখি।রিহানও আঁখিকে অনেক মানে,আঁখির নামে পা**গল বললেই হয়,তার সেই প্রিয় ছোটো মা যে আজ তার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে সে তা এখনও বুঝে উঠতে সক্ষম হয় নি নইলে কেঁদে নেয়ে একাকার করে দিত সব।চকলেটগুলো পেয়ে খুশিতে আত্ন*হা*রা হয়ে লাভ ইউ ছোটো মা বলে ছুটে চলে গেল,আঁখি এগিয়ে গিয়ে আদিলের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে নিল।
″চলি ভাইয়া,ভালো থাকবেন,কোনো প্রয়োজন মনে করলে এ বোনকে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।″
″আমার একটা ছোট বোন নেই,তোমাকে আমি সে বোনের আসনে বসিয়েছিলাম,ভাবিনি আদ্রিশ আমার সে বোনকে এভাবে কেড়ে নিবে,তবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়,দেখো তোমার ভালো হবে,তুমি খুব সুখী থাকো দোয়া করি।″
রিদিকা একপাশে মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে,আঁখি নির্দিদায় হেঁটে গেল তার পাশে,অতঃপর বলল।
চলে যাচ্ছি, তোকে তোর স্বামী দিয়ে গেলাম,আমি তো ধরে রাখতে পারি নি,তবে দোয়া করব তোর আঁচলের বাঁধন যাতে শক্ত হয়,স্বামী হাতছাড়া না হয়ে যায়।
কথাটা যে তী**রের মত বি*ধল রিদিকার বুকে তাও স্বাভাবিক থাকল,কিছু বলল না,তবে মুঠো টা বরাবরের মত শক্ত করে নিল।আঁখি আবার বলল।
আমার অনেক সোনা,গহনা,কাপড় দামী জিনিস সবকিছু রেখে যাচ্ছি, যেখানের বেশিরভাগই আদ্রিশের দেওয়া,কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না আমি,রেখে গেলাম তোর জন্য,যেখানে স্বামী তোর সেখানে মনে নিরাশতা তো আসতেই পারে তোর স্বামীর দেওয়া জিনিস আমি আবার কেন নিলাম।তাই দিয়ে গেলাম,স্বামী নাহলে কেরে নিয়েছিস ওর সংসার সবকিছু না হয় তোকে আমি ভিক্ষে দিয়ে গেলাম।চলি…..।
আঁখি চলে যেতে নিলে রিদিকা মৃদ্যু স্বরেই বলল।
আমি ওকে কেরে নেই নি,ও নিজে থেকেই তোকে ছেড়ে আমার পিছু নিয়েছে।
কথাটা কর্ণপাত হতেই রা**গে শরীর জ্ব**লে উঠল আঁখির,ফিরে গিয়ে সজোরে একটা কঢ়া থা**প্পড় বসালো রিদিকার গালে,থা**প্পড়ে**র তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে আ**ছ*ড়ে পরল রিদিকা।আঁখি তেঁড়ে গিয়ে ওর চুল মুঠো করে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে কটমট করে বলতে লাগল।
তোর মতো বা**জে নারীদের জন্যই আজ সমাজটা এত বিকৃতি পেয়েছে।হ্যাঁ ওসব সকল পুরুষ খা**রাপ এবং নি**কৃ**ষ্ট যারা বউ রেখে অন্য নারীর মোহে পরে,তবে সেই নারীগুলো কী দুধের ধুয়া তুলসীপাতা যারা একজন পুরুষের বউ আছে জেনেও তার দিকে ধাবিত হয়,তার প্রস্তাবে রাজি হয়,সেই নারীগুলো যদি সেসব পুরুষদের ফিরিয়ে দিত,চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত তাদের নিজেদের নিকৃষ্ট অবস্থান, তাদের কাছে নিজেকে বি**লি**য়ে না দিত তবে আজ সমাজে পর**কী**য়া আর ডিভোর্সের হার বাড়ত না,তাই একতরফা আদ্রিশের গলায় দোষ চাপাতে যাস না,নইলে এত মা**র*ব যে পায়ে পরে মাফ চেয়েও প্রা**ণ ভি**ক্ষা পাবি না।
তখনি আদ্রিশ এসে আঁখিকে টান দিয়ে সরালো রিদিকার কাছ থেকে,বেশ তেজি স্বরে বলল।
″এসব কি করছ আঁখি!পা**গল হয়ে গেছ তুমি!তোমার সমস্যা আমাকে নিয়ে তবে আমার সাথে কথা বলো ওকে কেন টানছো?″
″বড্ড দরদ হচ্ছে দেখি উকিল সাহেবের নতুন বউয়ের জন্য..।″
″আঁখি তুমি কিন্তু বড্ড বেশি রিয়াক্ট করছ।রিদিকা এতদিন যখন তোমার বান্ধবী ছিল তখন তো ওর জন্য দরদ তোমার উতলে পরছিল,আর এখন আমি ওকে বিয়ে কী করে নিয়েছি ও তোমার দু**শ**মনে পরিণত হল,ওকে মেনে নিলে কী এমন পরা যাবে তোমার,শুনি?″
″দেখো আদ্রিশ তোমার মত বু**দ্ধিহী**ন, চরি**ত্রহী**ন ল*ম্প*টের সাথে কথা বলার রুচি এই আঁখির নেই।ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি,নিজে সাইন করে দিও,আমি লোক পাঠিয়ে নিয়ে নিব।″
″তোমাকে আমি ডিভোর্স দিব না,দেখি তুমি কি করতে পার।কি ভেবেছ তুমি? আমাকে ছেড়ে যাবে আর আমি যেতে দিব তোমায়! নো ওয়ে,আমিও দেখব তুমি ডিভোর্স কি করে পাও।″
কথাটা বলে আদ্রিশ ডিভোর্স পেপারটা একটানে দু’টুকরো করে ফেলল,সাথে সাথে আঁখি আদ্রিশের গাল বরাবরও একটা ছাপ্পড় বসিয়ে দিল সবার সামনেই,আদ্রিশ রেগে গিয়ে আঁখি বলে গর্জে উঠলে।
″আঁখি….″
″ওই উকিল ভলিওম ডাউন,উকিল হবি তুই কোর্টে আমার সামনে ক্ষমতা ঝাড়তে আসিস না,ভুলে যাস নে আমি আঁখি সবকিছু জ্বা**লি**য়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।স্বামী হিসেবে সম্মান দিয়েছিলাম বলে আমার আসল রুপ ভুলে গেলি!হি*ট**লার আঁখিকে জাগাতে আসিস না বলে দিলাম,যেভাবে এটা ছিঁড়েছিস নতুন করে বানিয়ে সাইন করে নিয়ে আসিস নইলে উকিল এর উ পর্যন্ত রাখব না আমি এই বলে গেলাম,তোদের স্বামী স্ত্রীর সব রোমান্টিকতা মুহুর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিব,কথাটা মনে রাখিস।″
কথাগুলো বলে আঁখি হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল,হাতে শুধু তার ব্যবহার্য ফোন,এই বাড়ি থেকে যতই বেড়িয়ে আসছে বুকটা ততই কাঁ*প*ছে আঁখির,কত স্মৃতি জমে আছে আঁখির এই বাড়িতে,কত সপ্ন কত আশা নিয়ে আদ্রিশের স্ত্রী রূপে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল আঁখি,সবকিছু আজ ধুলোয় মিশে গেল,কাঙাল হয়ে বেড়িয়ে এলো আজ আঁখি,চোখের জলও যেন আজ পর হল,ভিতরটা ধু*ম*ড়ে মু*চ*ড়ে গেলেও চোখ দিয়ে আজ আর নামছে না জল,আচমকা এক আকর্ষণ এই বাড়ির প্রতি টানছে আঁখিকে,যেন শুনতে পাচ্ছে কিছু পিছুডাক,কতগুলো অশ্রুশিক্ত চোখের না বলা বাণী,নির্জীব সেই ইট পাথর সেই অজীব বস্তুদের অজানা ভালোবাসা টানছে বড্ড আজ আঁখিকে,হয়ত স্বামী সংসারের মায়া এমনই হয়, এক একটা বস্তুকেও ছেড়ে যেতে মন চায় না,তবে মন বানিয়ে নিয়েছে যে আঁখি,আজ সে আর পিছু ডাকে সারা দিবে না,খুঁজে নিবে নিজের এক নতুন গন্তব্য।
দূর আমেরিকার বিশাল এক অট্টালিকার আলিশান কক্ষ ঘেষে এক বারান্দা, বারান্দার প্রাচীর এর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বলিষ্ঠ দেহি এক সুদর্শন পুরুষ,বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে,মনে সুখে নাচ করছে যেন তারা,হাতে তার একখানা চিঠি।অপলকে তাকিয়ে আছে সেই চিঠিটার পানে,মনের প্রতি প্রান্তে আ**ঘা*ত করছে চিঠিতে ফুটে উঠা সেই অপ্রিয় সত্য বাণীগুলো।
একদিন তোমার আকাশেও বৃষ্টি নামবে,খুব করে চাইবে তখন পাশে আমায়….
দেখে নিও, তুমিও কাদবে,বিষন্নতায় ভুগবে,খুব করে আমাকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্খা জাগবে,কিন্তুু আফসোস প্রকৃতি আপনার বিপক্ষে চলে যাবে।প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার সাধ্য থাকবে না আর।
আপন মানুষ হা*রা*র শোকে পো*ড়*বে আপনার উতলা হৃদয়, কিন্তু আফসোস ফিরে পাবে না আর সেই বোকা ফুলকে,অতলেই হারিয়ে যাবে সে।
চোখ টপকে আজকেও জল গড়ালো তার, প্রতিনিয়ত আঁখির প্রে**ম*দহ**ণে পো*ড়া*র সাজাটা যে হয়ে গেছে তার কপালের লিখন।আজ নিজেই দো**ষী নিজের এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার জন্য।
চলবে……
আরোহী নুর……।
চিঠির এই অংশটুকু আমার লেখা নয় আমার এক ছোটো বোন লিখেছে,ভালো লেগেছে তাই গল্পে এড করেছি,তার নাম নিশাত জাহান,তার নাম বলতে বারণ করেছে তবে আমি তার ক্রেডিট টা নিতে চাই নি।তার লেখাটা কেমন হয়েছে জানাবেন।আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।