প্রহরের শেষাংশ পর্ব -০৫

প্রহরের শেষাংশে |৫|
লেখা : মান্নাত মিম
______________

কুশাল বিদেশে পৌঁছে শুধু ফোন করে জানায় যে, সে পৌঁছে গেছে। ব্যস এতটুকুই! আমাকে না জানিয়ে যাওয়াটাকে সে সহজ চোখে দেখল! আমার হৃদয়ে তখনকার বিষাক্ত অনুভূতিটা বোঝানোর মতো নয়। একসপ্তাহ-ও তখন পুরোপুরি হয়নি, এরইমধ্যে ডিভোর্স লেটার হাতে পাই। নির্বাক, বিহ্বলিত আমি উন্মীলিত চোখে বিষাদের ছায়া নিয়ে কেবল খামটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখি খোলার জন্য আর সাহস পাই না। জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয়ে আমি তখন পাগলপ্রায়। আগে থেকেই যে, ডিভোর্সের পরিকল্পনা করা ছিল সেটা সেদিনই জানতে পারলাম। উপরন্তু কুশাল-রা সেটাকে মিউচুয়ালভাবেই সারতে চাচ্ছেন তা-ও বোঝা হয়ে গেল। কিন্তু আমার যে জানার ইচ্ছা কুশাল কীভাবে এটাতে স্বাক্ষর দিয়ে গেল? আমাকে জানাল না পর্যন্ত। এত বড়ো পদক্ষেপ কোন কারণবসত নিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু কুশাল দিতে পারবে। সেদিন রাতেই কুশাল নিজে আগ বাড়িয়ে ফোন দেয়। কথার কথা বলে,

“নিশ্চয়ই ডিভোর্স পেপার পৌঁছে গেছে। স্বাক্ষর করে দিও। আমি-ও করে দিয়েছি।”

অসাড়ে গলায় কোনোরকমে শুধু জিজ্ঞেস করি,

“ক..কেন এ..এমন করলে?”

ওপাশের জবাব ক্ষীণ শ্বাস ফেলার ধ্বনিত হয়ে উত্তর আসে,

“লিসেন, তোমাকে শুধু ভালো লাগত। অথচ তোমার দেমাক আমাকে যারপরনাই অবাক করে। কালো মেয়ের এতো অহংকার! উপরন্তু তোমাকে পাওয়ার নেশা আরো বেশি চেপে বসে, যখন তোমার নরম হাতের গরম থাপ্পড় আমার গালে পড়ে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি; যেভাবেই হোক তোমাকে হাসিল করব। কিন্তু সমস্যা হয় পরিবার নিয়ে। দু’দিনের খেলার মাঝে ফ্যামিলি আমার ভোগান্তি পোহাবে। তাই পালিয়ে যাওয়ার কথা তোমার মুখ থেকেই বের করি। সেক্ষেত্রে আমি যেন দোষী না হই। সাথে ভাইদের পাঠাই তোমাদের বাড়িতে অভিনয়টা আরো নিখুঁত করতে। বিয়ের প্রথম প্রথম যাও নতুন শরীরের স্বাদে নোনতা জিনিসেও মিষ্টতা খোঁজে পেতাম। তোমাকে বিয়ে করতে কতো বড়ো রিস্ক নিলাম, অথচ সব উসুল করব না তা কি করে হয়। কিন্তু তিক্ততা আসে যখন-তখন তোমাকে বাইরে থেকে দেরি আসার কৈফিয়ত দিতে। অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগে বিষয়টা। তোমার একঘেয়েমি শুরু হয় আমার চাকরি করার জন্য চাপ প্রয়োগে। মেজাজ যায় বিগড়ে, এদিকে ভাইয়ার কাজে বিষয়গুলো সত্যিই ঝামেলাযুক্ত ছিল। সুযোগ পেলাম তখন, যখন বিরোধিতা দলের লোক খুন করে তোমার থেকে সাথে পুলিশের কাছ থেকেও পগারপার হওয়ার। তাছাড়া আমার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য আগে থেকেই বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। তা যাইহোক এখন ভালোয় ভালোয় ডিভোর্সে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে দিও, নাহলে তোমার ভাইয়েরা তোমাকে অস্বীকার করলে কী হবে, তুমি তো আর তাঁদের ফেলে দাওনি।”

স্তম্ভিত, হতবাক আমি মুখে কোনো রা নেই। বিস্ময় যেন কাটতে চাইছে না। মন শুধু বলছে,

“সব মিথ্যে হয়ে যাক। ভালোবাসার মানুষটা শুধু আমার থাক।”

প্রলয়ঙ্কারী এ কোন ঝড় এলো আমার জীবনে? ভালোবাসার মানুষটা এভাবে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাল। আর আমি, আমি-ও নির্বোধের মতো সবকিছু বিশ্বাস করে নিলাম। না না, এখানে অবিশ্বাসের মতো কোনো কারণ তো কুশাল রাখেনি। তার করা প্রতি পাগলামি, ভালোবাসার অনুভূতি করা স্পর্শ, কথা-আচরণ সবকিছুই যে আমি অনুভব করেছি। এগুলো কি তাহলে মিথ্যে ছিল? জীবনের সুতো কেন ছিঁড়ল এভাবে? কার কাছে উত্তরগুলো পাব? শূন্য দৃষ্টি ফেলেও একনাগাড়ে তাকিয়ে নিজেকে বড্ড একা অনুভব করলাম। একে একে কুশালের সাথে থাকা স্মৃতিগুলো অন্তঃকরণের হানা দিতে লাগল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলচিত্তে মাথায় শুধু মিতুর আর বড়ো ভাইয়ের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। মিতু বারবার সাবধান করেছিল, পরে পস্তানোর রাস্তা পাব না। ঠিকই আজ পস্তানোর জন্যও আমার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভাইয়া-রা তো পরই করে দিয়ে জানিয়েছিল, তাঁদের কাছে যেন ফিরে না যাই।

“যে পথে ছিল তোমার আনাগোনা,
সে পথের দ্বার বদ্ধ করো না।
কণ্টকাকীর্ণ পথে তুমিহীনা;
আমি যে একা চলতে পারি না।”

_______

মিউচুয়াল হিসেবেই ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর দিয়ে কুুশালের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে গেলাম। আমি-ই পৌঁছে দিতে গেলাম বিশেষ কারণবসত। নিজ হাতের গড়া স্বপ্নের সংসার তাসের ঘরের মতো ভেঙে শেষ করে দিয়ে আসব নিজ হাতেই। শক্ত না, বেশ পাষাণে তৈরি করে নিয়েছি মন’কে! মাঝে মাঝে নিজের ভেতরে পিশাচী ভর করে। হয় নিজেকে নয় কুশাল’কে মৃত্যু ভয়াবহ মৃত্যু দিতে চায়। কিন্তু হায়! অভাগী আমি-র সাহসে কুলায় না। কুশালের বাড়ির ঠিকানা আমার জানা আছে। সেখানেই গেলাম বড়ো লোকদের বিরাট বড়ো গেটের সামনে দারোয়ান থাকার কথা সাধারণ বিষয়। কিন্তু আমার নাম জেনে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করানো ব্যাপকভাবে আমায় চমকিত করল। আমি তো ভেবেছিলাম নাম বললে; আমাকে গেট থেকেই ফেরত পাঠাবে। কিন্তু হলো উলটো। যাইহোক ভেতরে প্রবেশ করে ড্রইংরুমের সোফায় বসতে বলে কাজের লোক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। দৃশ্যটা দারুণ সিনেমা-ও হার মানাবে। ভালোবাসার মানুষের সাথে মিউচুয়াল ডিভোর্স উইথআউট রিজন তা-ও আবার বাড়ি বয়ে ডিভোর্স পেপারে দিতে আসি। আমি নিজেকে নিজেই দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। কিছুদিন আগেও কুশালের সাথে কথা বলার পর পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। কুশাল’কে তখন ফোন করেও লাইনে পাওয়া যায়নি এমনকি সকল ধরনের অনলাইন থেকেও আমাকে ব্লক করে রাখা হয়েছিল। আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে আমার সামনে মাঝবয়সের মহিলা এলেন। এখনো মুখের চামড়া টানটান। অন্যপাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন,

“অরুমিতা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তখন তিনি নিজের পরিচয়ে বললেন,

“কুশালের মা।”

কুশাল কখনো তার পরিবারের বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেনি। এমনকি পরিবারের সদস্যদের ছবি পর্যন্ত দেখায়নি। অতি ভালোবাসায় অন্ধত্ব বরণ করার ফল এখন পাচ্ছি সাথে কারণ-ও বোঝা হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলি যার শব্দ পেয়ে কুশালের মা বললেন,

“পরিবারের বিপক্ষে কথা বলার ধাতে নেই। প্রথমদিকে মনে করেছিলাম, তুমি বুঝি সম্পত্তির লোভে পড়ে কুশাল’কে বিয়ে করেছ। তুমি করেই বলি কেমন।”

এটুকু থেমে আমার অবাক নয়ন জোড়ায় তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলেন,

“তুমি ভাবছ, তোমাকে আমরা লােভী মনে করেছিলাম। কিন্তু তোমাদের বিয়ের পরে কুশাল সবকিছু খোলে বলে আমাদের। যদিওবা তোমাকে আমরা কেউ মেনে নেইনি। তবুও নারী মনে একটু খারাপ লাগার রেশ ছিল কুশাল তোমাকে এভাবে ব্যবহার করবে বলে।”

ফের থামলেন। এদিকে মনে মনে শুধু একটাই কথা ঘুরঘুর করছে, কুশাল তোকে ব্যবহার করেছে অরু; তুই যাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসলি সে তোকে আর তোর শরীরটাকে ব্যবহার করেছে। ডিভোর্সে সহাস্যবদনে দৃঢ়চিত্তে স্বাক্ষর করার সময়ও এতটা খারাপ লাগার মতো কাজ করেনি। একমনে সাহস করে নিজেকে ভালো থাকাট প্রবোধ দিয়ে সাইন করেছিলাম। সাথে সাহস জুগিয়ে বিপদে পাশে থেকে ছিলেন খালু-খালামনি। এখন সম্মুখে বসা মহিলার কথাতে তীরের ফলা এসে মনাঙ্গনে বিদ্ধ করে সকল প্রতিজ্ঞাবাক্য ভেঙে দিচ্ছে। যার ফলস্বরূপ ব্যথিত ও ভঙ্গ হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অশ্রু হয়ে চোখ থেকে ক্ষরিত হচ্ছে। এরমধ্যে আবার কর্ণকুহরে শব্দ এলো,

“কুশালের বিয়ে ঠিক করা আছে। মেয়েটি আমাদেরই পরিচিত। মন্ত্রণালয়ের সচিবের পরিবারের। কুশাল যেখানে বর্তমানে অবস্থান করছে সেখানেই মেয়েটির পরিবার থাকে। কুশাল তাঁদের কাছেই গিয়েছে। সেই মন্ত্রীর কাজ করতে গিয়েই আমার ছেলেটা বাংলাদেশ ছাড়া হলো। যাইহোক তুমি ডিভোর্স পেপার দিয়ে যাও। একটা কথা উপদেশ বা আদেশ যেভাবে নেও; নিজের পথ নিজে দেখ, এই পথ আর মাড়িয়ো না। শোনলাম বাবা-মা কেউ নেই, তাদের শিষ্টাচার আসবে কোথা থেকে।”

শেষ কথাটা বসা থেকে ওঠে আমার হাত থেকে ডিভোর্স পেপারটা ছিনিয়ে নিয়ে বলে চলে গেলেন। ফেলে গেলেন জীবন্মৃত, নির্জীব আমাকে।
______

রাস্তা ধরে হাঁটছি আর ভাবছি। আসলে ভাবার মতোও কিছু নেই। শূন্যতে দৃষ্টি মেলে চলেছি। বৃষ্টি নামল, ভিজিয়ে দিলো শরীরের শুষ্ক হওয়া জমিন; কিন্তু মন পিঞ্জিরার খরাতে বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও পড়ছে না। শারিরীক ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ হওয়া শরীর ধীরে ধীরে রাস্তাতেই ছেড়ে দিলো, তারউপর সামনের পাথরের আঘাত আরো বাড়িয়ে দিলো গড়িয়ে পড়া। শুধু ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম; সন্নিকটের মৃত্যুকে।

সরকারি হাসপাতালের গন্ধ কোনোকালেই আমার পছন্দ ছিল না। বেশ আদুরে ছিলাম কি না তাই ক্লিনিকের পরিষ্কার ফ্রেশ এয়ারে অসুস্থতায় যাতায়াত হতো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমাকে সেই গন্ধযুক্ত স্থানেই টেনে আনল। জ্ঞান ফেরা মাত্রই অনুধাবন করতে হলো তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। মা হওয়ার মতো সুখকর অনুভূতি বিষাক্ততায় ছড়িয়ে গেলো। তবে আমি ছিলাম, নির্বিকার, নির্নিমেষ শূন্য দৃষ্টিতে।

“আনন্দ-অশ্রু ঘেরা এ-জীবন,
মিলয়ে নাও তোমার প্রিয়জন।
সব তো এক হয় না প্রিয়,
আপনজনে-ও ভীত হইও।”

চলবে…..

এডিট ছাড়া পর্ব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here