প্রহেলিকা পর্ব ১৯+২০

#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–

রাতে ঘুমোতে গিয়ে বাঁধে বিপত্তি। ইনশিতা কিছুতেই জেহেরের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে না। তবে সেটা জেহেরকে বলার সাহস অবধিও করতে পারছে না। সোফায় বসে ছটফট করছে সে। জেহের বিছানায় হেলান দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। বসার স্টাইলটাও চমৎকার। বালিশে সটান ঠেস দিয়ে এক হাঁটু ভাজ করে অপর হাঁটু সোজা রেখে তার উপর ল্যাপটপ রেখেছে। আড়চোখে রোজকেও পর্যবেক্ষণ করছে। ঘড়ি টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। জেহের ল্যাপটপ রেখে ইনশিতার পাশে গিয়ে বসল। একদম গা ঘেঁষে।

-“ঘুমোতে চলো।”

ইনশিতা আমতা আমতা করে বলে,

-“ইয়ে মানে, বিকেলে তো ঘুমিয়েছি। তাই এখন ঘুম আসছে না।”

-“ঘুমানো লাগবে না। আমি ঘুমাবো, তুমি আমার বুকে শুয়ে থাকবে। চলো।”

জেহের ইনশিতার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে নেয়। ইনশিতা ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

-“আমি এখন বই পড়বো।”

পাশে থাকা বুকশেল্ফ থেকে বই নিয়ে উঁচু করে জেহেরকে দেখায়। জেহের নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,

-“আচ্ছা পড়ো। খাটে এসেই পড়ো। আমি ঘুমোই।”

ইনশিতা খাটে আধশোয়া হয়ে বসে বইটাতে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। আসলে দেখে না, দেখার ভান করছে। সে তো জেহেরকে আড়চোখে দেখে তার ঘুমানোর অপেক্ষায় আছে। জেহের পাশে এসে শুয়ে ঝটকা মেরে ইনশিতাকে বুকের উপরে ফেলে। ইনশিতা অবাক হয়ে বলে,

-“এটা কী হলো?”

-“আমার বুকে ঘুমানো হলো।”

-“দেখছেন না আমি বই পড়ছি। এখন ঘুমাবো না। বলেছি না।”

-“হ্যাঁ দেখছি তো, কেমন বই পড়ছো। বই উল্টো করে রেখেও যে পড়া যায় সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না।”

ইনশিতা হাতের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেল। আসলেই সে উল্টো বই ধরে আছে। এখন কী করে আর জেহেরের থেকে ছুটবে? কিছু বলবে তার আগেই জেহের ইনশিতার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। মুহুর্তেই ইনশিতার শরীরে অজানা এক কাঁপন ধরে গেল। জেহের বলল,

-“আর একটাও কথা না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বে।”

কী আর করা? অগত্যা জেহেরের বুকে দ্বিতীয়বারের মতো মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। ইনশিতা ভাবতে লাগল, এখন এই জেহের তার স্বামী। সারাজীবন তার সাথেই কাটাতে হবে। তাহলে এখনও কেন সে মেনে নিতে পারছে না জেহেরকে? একদিন না একদিন তো মেনে নিতেই হবে। সেই একদিন না হয় আজ থেকেই শুরু হোক। ইনশিতার তখন জেহেরের ছোঁয়াগুলো মনে করতে লাগল। তখন সে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে মাথায় কিছুই আসছিল না। আর এখন সেই ছোঁয়া ভাবতেই হুট করে ইনশিতার পিঠ দিয়ে ভালোলাগার শীতল স্রোত বয়ে যায়। কেন জানে না। ইনশিতা একটু মুখটা উঠিয়ে দেখল জেহের এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। জেহেরের দিকে তাকাতেই জেহের চোখ রাঙানি দিলো। ইনশিতা দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর যাই হোক না কেন, এখন থেকে সে জেহেরকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে।

.
হঠাৎ কোনো বিকট শব্দে ইনশিতা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। অ্যালার্ম বেজে চলছে একমনে। জেহের বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে। পাশে তাকিয়ে দেখে রোজ কেমন ভয় পেয়ে আছে। আসলেই ইনশিতা ভয় পেয়েছিল এমন আওয়াজে। এলার্মটা টেবিলের এই কোণায়, একদম কানের কাছে ছিল। ইনশিতার বুকটা এখনো ধুকপুক ধুকপুক করছে। জেহের এক পলক ইনশিতার ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আচমকা অ্যালার্মটা নিয়ে জোড়ে আছড়ে ফেলে। দ্বিগুন বিকট শব্দে অ্যালার্ম ভেঙ্গে চুরমার হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জেহেরের চোখ লাল হয়ে আছে। রাগে তার ইচ্ছে করছে পুরো দুনিয়াটা শেষ করে দিতে। তার রোজের কষ্ট হবে এমন জিনিস সে দুনিয়াতেই রাখবে না। রোজের দিকে তাকাতেই তার মনটা শান্ত হয়ে যায়। ইনশিতা কানে হাত দিয়ে আছে। জেহেরের হঠাৎ এমন আচরণের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। জেহের ইনশিতাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে বলে,

-“তোমাকে কষ্ট দিবে এমন জিনিসের অস্তিত্ব আমি দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেব। তোমাকে যাতে কোনো কষ্ট ছুঁতে না পারে সেই সব ব্যবস্থা আমি করব। ভয় পেয়ো না রোজ।”

ইনশিতার কপালে চুমু এঁকে দিলো জেহের।

-“যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”

ইনশিতা মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ইনশিতা চলে গেলে জেহেরের রাগ যেন আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নিজের রাগটাকে কিছুতেই কমাতে পারছে না সে। ফোঁস ফোঁস করে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। মাথার চুল টেনে ধরে বিড়বিড় করে এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটে। আবারও কী ভেবে দ্রুত রুমে এসে ভাঙা অ্যালার্মের অংশগুলোয় জোরে জোরে লাথি দিতে থাকে। যেন সে এগুলো একদম বালির মতো গুড়ো গুড়ো করে ফেলতে চায়।

ইনশিতা প্রায় অনেকক্ষণ ধরে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কেন দেখছে সে নিজেও জানে না। এমনি, দেখতে ইচ্ছে করছে তাই। একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে ইনশিতা। রুমে ঢুকতেই ভ্রু জোড়া আপনাআপনি কুঞ্চিত হয়ে আসলো। পুরো ফ্লোর পরিষ্কার। অ্যালার্মের ভাঙা অংশের ছিটেফোঁটাও নেই। জেহেরও কোথাও নেই। ইনশিতা বারান্দায় গিয়ে তোয়ালেটা মেলে রুমে আসলে দেখে জেহের সোফার সামনের টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। ইনশিতার জন্য খাবার আলাদা।

ইনশিতাকে আসতে দেখে জেহের ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসল। সেই হাসিটা যেন একদম তীরের মতো বুকে বিঁধল ইনশিতার। জেহের ইনশিতার বাহু জড়িয়ে ধরে এনে সোফায় বসায়। তারপর কী ভেবে যেনে ইনশিতাকে বলে দাঁড়াতে। ইনশিতা দাঁড়ালে জেহের টান মেরে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। ইনশিতা হতভম্ব হয়ে বলে,

-“কী করছেন কী?”

-“শসসহ। কোনো কথা না।”

বলে ইনশিতার মুখে গুঁজে দিলো খাবার। কিছু বলার সুযোগই পেল না সে। দু-গাল ফুলিয়ে খেতে লাগল। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ জেহের একধ্যানে তাকিয়ে থাকে ইনশিতার দিকে। চোখ বন্ধ করে বার কয়েক বড় বড় নিঃশ্বাস নিলো। ইনশিতার ভেজা খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলো হঠাৎ। ইনশিতার যেন শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। জেহেরের গাঢ় নিঃশ্বাস ইনশিতার ঘাড়ে গলায় পড়লেই ইনশিতা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জেহের ক্রমাগত উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ইনশিতাকে চেপে ধরছে। ইনশিতা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। জেহেরের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

-“জেহের।”

জেহের নিরুত্তর।

ইনশিতা এবার বেশ জোরেই বলে,

-“জেহের, আপনি আমায় কথা দিয়েছেন।”

এবার জেহের মুখ তুলে তাকাল। চোখে মুখে অসহায়ত্ব। ইনশিতার মায়া লাগল। তবে কিছু করার নেই। সে সময় নিতে চায়। জেহের অসহায় কন্ঠে বলে,

-“তুমি এমন কেন?”

ইনশিতা ভ্রু কুঁচকে বলে,

-“আমি কেমন?”

-“তুমি অনেক খারাপ রোজ।”

-“কেমন খারাপ?”

-“এই যে আমায় আদর করতে দেও না।”

জেহেরের এমন বাচ্চামিতে বেশ মজা পেল ইনশিতা। মিছে কঠোর গলায় বলল,

-“তাহলে এই খারাপ রোজকে কোলে বসিয়ে রেখেছেন কেন? ছুঁড়ে ফেলে দিন।”

ইনশিতা কথাটি মজার ছলে বললেও জেহের যেন সিরিয়াস ভাবেই নিলো। অস্থির হয়ে গেল সে। ইনশিতাকে নিজের কোলে রেখেই আরেকটু চেপে ধরে কম্পিত কন্ঠে বলে,

-“আমি সরি রোজ। আমি এমনভাবে বলতে চাইনি। আ-আমি শুধু এমনি…আমি সত্যি সরি রোজ।”

ইনশিতা অবাক হয়ে দেখে জেহেরকে। সামান্য মজাও বোঝেনা জেহের?

.
দুপুর গড়িয়ে চলল। ইনশিতা এখন বসে আছে ড্রয়িংরুমের নরম গদিতে। জেসমিন চৌধুরী তার সাথে খোশগল্পে মেতে আছেন। জেসমিন চৌধুরী কথা বলতে প্রচুর পছন্দ করেন। কিন্তু ঘরে কথা শোনার মতো কাউকেই তেমন পান না। ইনশিতার বেশ ভালোই লাগছে। তাকে নিঃসন্দেহে ভালো শ্রোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে। ইনশিতার হাতে কোনো কাজ না থাকায় সে নিচে এসেছে। জেহের চলে গিয়েছিল অফিসে। সে যেতেই চাইছিল না আসলে। তবে ইম্পর্টেন্ট হওয়ায় যেতে হয়েছে।

যাওয়ার আগে ইনশিতাকে কড়া করে বলে গিয়েছে, রুমের বাহির না বেরোতে। বিশেষ করে নিচে না যেতে। ব্যস এটুকুই। ইনশিতা ভেবে পেল না নিচে গেলে কী এমন সমস্যা হবে। রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বিধায় নিচে এসেছে। তার একা থাকতে ভালো লাগে না। কথা বলার কাউকে পেলেই চলে। আগে তো নয়নিকা ছিল, এখন তো আর সে নেই। কিছুক্ষণ আগে বাবা মা আর নয়নিকার সাথে কথা হয়েছিল। নয়নিকার সে কী কান্না। ইনশিতার মনটাও কেঁদে উঠেছিল। নয়নিকাকে বলেছে একবার আসতে এখানে। নয়নিকা প্রথমে জেহেরের ভয়ে না করলেও ইনশিতার জোরাজুরিতে বলে দেয় সময় পেলে চলে আসবে।

জেবা বসে আছে ডাইনিংয়ে। তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। আজ ইনশিতা মুখে হাসি থাকলেও আর কয়েকদিন পর সেই হাসিটা মুখে থাকবে কি না সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। ইনশিতাকে নিয়ে জেসমিন চৌধুরী পুল সাইডে হাঁটছে আর গল্প করছে। আবার রান্নাঘরে গিয়ে এটা সেটা বানিয়ে খাওয়াচ্ছে ইনশিতাকে। ইনশিতার নিজের মনের দুঃখ যেন এক নিমিষেই কোথাও উড়ে গেল। এভাবেই কেটে গেল পুরোটা বিকেল।

রাত আটটায় জেহের ঘরে ফিরে। রোজের জন্যই সে এত তাড়াতাড়ি ফিরেছে। রুমে ঢুকেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আপনাআপনি। রোজ রুমের কোথাও নেই। বারান্দা, বাথরুমেও নেই। জেহের নীচে গিয়ে চেক করেও পেল না। হঠাৎ রোজের হাসি কানে আসলে থমকে দাঁড়ায় সে। ডান দিকের সবচেয়ে কোণার রুমটা থেকে রোজের হাসি ভেসে আসছে। না চাইতেও সে সেদিকে পা বাড়ায়। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। রোজ জেসমিন চৌধুরীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। জেহের জোরে হুংকার ছাড়ল,

-“রোজ!”

আচমকা কারো কন্ঠে পিলে চমকালো ইনশিতা। তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে জেহের দাঁড়ানো। অফিসের পোশাকেই। হাত দুটো শক্ত করে মুঠ করে আছে। চোখে মুখে আগুন ঝরছে যেন। ইনশিতা জেহের সামনে এসে বলল,

-“আপনি এত তাড়াতাড়ি এলেন যে? মায়ের কাছে শুনলাম নয়-দশটার দিকে আসবেন।”

জেহের হালকা ঘাড় কাত করে বলল,

-“মা কে?”

ইনশিতা অবাক হয়ে বলল,

-“মা কে মানে? এই যে মা।”

জেসমিন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে দেখাল। জেহের জেসমিন চৌধুরীর দিকে একবার ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইনশিতার দিকে তাকাল।

-“যাকে তাকে মা বলবে না।”

বলেই ইনশিতার হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেল। পেছন ফিরে ইনশিতা ঠিকই দেখল জেসমিন চৌধুরীর চোখে জল।

ইনশিতাকে রুমে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলল। ইনশিতা হতভম্ব। কী এমন হলো জেহেরের। জেহের ইনশিতার বাহু ধরে ঝাঁকাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-“আমি বলেছিলাম না রুমের বাহিরে না যেতে? কানে শুনোনি?”

-“আরে! সারাক্ষণ রুমে বসে করতামটা কী?”

-“কেন? এই যে বুকশেল্ফ ভর্তি বই, রঙ তুলি, সব তোমার জন্য এনে রাখলাম, এগুলো দিয়ে সময় কাটাতে পারো না?”

-“কী আশ্চর্য! আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই বাহিরে গেছি। রুমের মধ্যে এতক্ষণ থাকলে বন্দী লাগে নিজেকে। আর আপনি মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করলেন কেন?”

-“আমি তোমাকে বলেছি রোজ, যাকে তাকে মা ডাকবে না।”

-“যাকে তাকে কোথায় ডাকলাম? আমার শাশুড়ীকে মা ডাকবো না তো কী আন্টি ডাকবো?”

-“কিচ্ছু ডাকার দরকার নেই। ঐ মহিলার আশেপাশেও ভীড়বে না। মাইন্ড ইট।”

-“কী…”

-“শসসহ, কোনো কথা না। মেইডকে দিয়ে খাবার আনতে বলেছি। এসে পড়বে এখনি। ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি। খাবার টেবিলে রেডি করবে।”

-“সবার সাথে নিচে খাবেন না?”

-“না। এখন থেকে এখানেই খাব সাথে তুমিও।”

-“আজব! পরিবার মিলে একসাথে খেলেই তো মজা।”

-“এত মজা লাগবে না। ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি।”

জেহের ফ্রেশ হতে চলে যায়। মেইড এসে খাবার দিয়ে গেলে ইনশিতা টেবিলে সাজায় আর ভাবে, জেহের তার মাকে এতটা ঘৃণা করে কেন? একদম যেন দেখতেই পারে না। জেহের ফ্রেশ হয়ে এসে রোজকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষে ইনশিতাকে কোলে করে বারান্দায় বসে পড়ে। জেহের ইনশিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

-“রোজ।”

-“হু।”

-“প্রমিস করো, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।”

ইনশিতা জেহেরের চোখের দিকে তাকায়। অসহায় চাহনি।

-“এখন তো আপনি আমার স্বামী। আপনাকে ছাড়া আর কোথায়ই বা যাব?”

কথাটা বেশ তাচ্ছিল্যসুরে বলে ইনশিতা। জেহের ইনশিতাকে নিজের বুকের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বিড়বিড় করে বলে,

-“তুমি চাইলেও কোথায় যেতে পারবে না। তুমি যে নিজ অজান্তে শিকলে পা বেঁধে নিয়েছ।”

.
.#প্রহেলিকা
#পর্ব_২০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

পরপর দু’দিন ইনশিতার বেশ ভালোই কাটল। ইনশিতার প্রতি জেহেরের কেয়ার, ছোটখাটো জিনিস খেয়াল রাখা সবকিছু মিলিয়েই ইনশিতা জেহেরের প্রতি সন্তুষ্ট। আর সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লাগল তা হলো জেহের জোর করেনি কখনো তাকে। এমনকি ভুলেও বাজেভাবে ছোঁয়নি। তবে ইনশিতাকে এপর্যন্ত একবারের জন্যও নিচে যেতে দেয়া হলো না। জেহের নিজেই ইনশিতাকে নিয়ে ছাদে যায়, বাগানে হাত ধরে ঘুরে, মাঝে মাঝে পুল সাইডে বসে গল্প করে। অফিসের কাজগুলো রাতেই সেরে বাকিটা সময় ইনশিতার সাথে কাটায়। মা বাবা, নয়নিকার সাথে কথা বলার জন্য নিউ ফোন কিনে দিয়েছে জেহের।

তবে ইনশিতা দুইদিনে যতবারই কলেজে যাওয়ার কথা বলেছে, জেহের কেমন এড়িয়ে গিয়েছে। বলেছে, কয়েকদিন কলেজ ছাড়া এনজয় করো, আমার সাথে কাটাও; তারপর যেদিন আমি অফিস ফুল্লি যাবো, সেদিন তোমাকে কলেজ দিয়ে আসব। ইনশিতাও সেটাই মাথায় রেখে দিন কাটিয়েছে।

তার একদিন বেশ ভোরে হঠাৎ কিছু একটার শব্দে ইনশিতার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় হাতড়ে জেহেরকে খুঁজে পায় না। শব্দের উৎস খুঁজতে আশেপাশে চোখ বুলায় তবে অন্ধকারের জন্য কিছুই দেখে না সে। বেডের পাশে ল্যাম্প জ্বালাতেই ইনশিতা চিৎকার দেয়। জেহের ওয়ারড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জেহেরের শার্ট রক্তের ছিটে। জেহের নিজেও চমকে যায় হঠাৎ বাতি জ্বালানোয়। কিছু বলার শব্দ খুঁজে পায় না সে। ইনশিতা দ্রুত নেমে আসে জেহেরের সামনে। আঁতকে বলে,

-“আ-আপনার শার্টে রক্ত কেন? কি হয়েছে আপনার? অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?”

বলে দেরি না করে জেহেরের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। তবে কোনো ক্ষত না পেয়ে ইনশিতা অবাক হয়ে তাকায় জেহেরের দিকে।

-“আপনার কোথাও তো লাগেনি। তাহলে এত রক্ত কিসের?”

জেহের ভড়কে যাওয়া গলায় বলে,

-“ম-মানে, আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম তো। একজনকে দেখলাম অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, হসপিটালে নিয়ে গিয়েছি, তাই আমার শার্টেও রক্ত লেগেছে আর কি।”

বলে জোর করে হাসল জেহের। ইনশিতার কাছে কথাটা অযৌক্তিক মনে হলো। এত ভোরে হঠাৎ জেহেরের বাইরে যাওয়া, তার উপর অ্যাক্সিডেন্ট। ঠিক সেই সময়েই জেহেরের ফোন আসে। জেহের রোজের দিকে তাকিয়ে কেটে দেয়। এমন করে আরো দু’বার কল আসলে জেহের ফোন সুইচ অফ করতে নেয়। তখনই আরেকবার কল আসলে ইনশিতা কি মনে করে ছোঁ মেরে ফোনটা রিসিভ করে কানে দেয়। জেহের ঘাবড়ে গিয়ে মোবাইলটা নিতে গেলে ইনশিতা পিছু হটে যায়। ওপাশ থেকে যা শুনলো তাতে ইনশিতার চোখ বড় বড় হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ফোনটা কেটে কাঁপা কাঁপা গলায় ইনশিতা জেহেরকে বলে,

-“কাকে মেরে এসেছেন আপনি? কাকে হসপিটালে ভর্তির কথা বলছে?”

-“কাউকে না রোজ। তুমি হয়ত ভুল শুনেছ। তুমি…”

-“আমি ঠিক শুনেছি জেহের। একজন আপনাকে স্যার বলে বলেছিল কাউকে হসপিটালে নিয়ে যেতে। বলেছিল লোকটার অবস্থা না কি খারাপ। হসপিটালে না নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে না। আ-আর এটাও বলেছিল যে আপনি বললে তারা লোকটাকে মেরে পুতে ফেলবে।”

জেহের নিজের মাথার চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে। ইনশিতা এবার রাগে জেহেরকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে,

-“এই, বলুন, কাউকে তো শিওর মেরে এসেছেন আপনি। কাকে মেরে এসেছেন আপনি? কি হলো? চুপ করে আছেন কেন? হু? বলুন।”

জেহের চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মনে হয় না বেশিক্ষণ থাকতে পারবে। জেহেরকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রায় দেয়ালের কাছেই এনে ফেলল ইনশিতা। এক পর্যায়ে ইনশিতার ধাক্কায় জেহেরের মাথা আর পিঠ খুব জোরে বারি খেল দেয়ালের সাথে। এবার আর নিজের ক্রোধ দমন করতে পারল না জেহের। চোখ মেলে দুহাতে ইনশিতাকে সজোরে ধাক্কা দিলো। টাল সামলাতে না পেরে ইনশিতা পড়ে যায় নিচে। মাথায় কিছুটা আঘাতও পায়। আঘাত ভুলে ইনশিতা অবাক হয়ে যায় জেহেরের এরুপ আচরণের কারণে। জেহের এক হাঁটু ভাজ করে বসে ইনশিতার গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

-“সত্যি আমি মেরে এসেছি রোজ। এমন অবস্থা করেছি না। জীবনেও তোমার দিকে তাকানোর সাহস অব্দি পাবে না।”

-“মানে? ক-কাকে মেরে এসেছেন?”

জবাবে জেহের অদ্ভুত হাসি দিলো। অদ্ভুত এই হাসি দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ইনশিতার। জেহের ইনশিতাকে উঠিয়ে এগিয়ে চলল ঘরের বাহিরে। ভোরের আলো তখন মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। জেহের ইনশিতাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসল। ইনশিতা এখনো অবাকের রেশ থেকে বের হতে পারছে না। পাঁচ মিনিট ড্রাইভিংয়ের পর জেহের একটা ভাঙ্গা ছোটখাটো একটা বাংলোর সামনে নামল। ইনশিতার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভেতরে নিলো। জেহেরের ঠোঁটে এখনো সেই অদ্ভুত হাসি বিরাজমান। বাংলোর ভিতরে শেষ রুমে কয়েকজন গার্ডদের দেখতে পেল ইনশিতা। সেই রুমে নিয়ে ইনশিতাকে দাঁড় করিয়ে সবগুলো গার্ডদের ইশারায় বেরোতে বলল। রুমে ঢুকে ইনশিতার হাত পা বরফের ন্যায় জমে গেল। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। পা থরথর করে কাঁপছে। জেহের ইনশিতার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

-“বললে না কাকে মেরেছি? দেখো, এতক্ষণ ধরে একেই সাইজ করেছিলাম।”

ইনশিতার গা গুলিয়ে আসতে লাগল। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিলো জেহেরের বুকে। জেহের শক্ত করে ধরল ইনশিতাকে। সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রাফিদ। শরীরের একটু অংশও দেখা যাচ্ছে না রক্তের কারণে। নিস্তেজ শরীর পড়ে আছে মেঝেতে। হাত পা মুখের সব জায়গায় ক্ষত। দেখলেই ভিন্ন জগতের প্রাণী মনে হবে। এত রক্ত দেখে ইনশিতার গা গুলানো শুরু করল। একটু পাশে খুব মোটা লাঠির মতো কিছু একটা পড়ে আছে। ইনশিতা অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,

-“রাফিদ।”

-“তোমাকে ছোঁয়ার, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সকল শাস্তি দিলাম রাফিদকে। আমার থেকে নিস্তার পাওয়া এত সোজা না কি? কী বলো রোজ?”

ইনশিতা জেহেরকে ঠেলে সরিয়ে রাফিদের দিকে অগ্রসর হতে চাইল। তবে পা যেন চলতেই চাইছিল না তার।

-“আপনি দয়া করে রাফিদকে হসপিটালে নিয়ে যান। প্লিজ।”

-“নিয়ে যাবো বলছো? কিন্তু ও যদি আবার তোমাকে আমার হাত থেকে নিয়ে যেতে চায়? উহুম। ও কে এক্ষুনি শেষ করে দেব। অলরেডি তো মরেই গিয়েছে। বেঁচে আছে কি না সন্দেহ।”

বলেই জেহের বেশ দুঃখ পাওয়ার ভান ধরল। পরক্ষণেই হা হা করে বিকট অট্টহাসি দিতে দিতে ইনশিতাকে ছেড়ে রাফিদের দিকে চলল। ইনশিতা দেয়াল ধরে নিজেকে সামলাল। জেহের পা দিয়ে রাফিদকে সোজা করে দিল। চোখ মুখ কুঁচকে আছে জেহের। চোখে অজস্র ঘৃণা। যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী জিনিস তার সামনে দেখছে। রাফিদের পেট হালকা উঠানামা করছে। ও? বেঁচে আছে তার মানে?

-“ওয়েল। হসপিটালে নেব। তার আগে এটা বলো, ও যদি তোমার দিকে আবার হাত বাড়ায় তাহলে কী শাস্তি দেওয়া উচিত হবে?”

ইনশিতা দ্রুত বলল,

-“রাফিদ আর কক্ষনো আমার দিকে হাত বাড়াবে না। প্রমিস করছি। অমি নিজেই ও কে দুরে ঠেলে দেব। ওর সামনে যাব না কখনো।”

জেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ঘাড় কাত করে বলল,

-“হাহ! তোমাকে যেতে দিলেই তো!”

পাশে পড়া লাঠিটা হাতে নিয়ে ক্রিকেট স্টাইলে ধরল জেহের। রাফিদের মাথা বরাবর ক্রিকেটারদের মতো ব্যাট ধরে হালকা বারি দিতে লাগলো। তারপর যখন খুব জোরে বারি দিবে তখন ইনশিতা চেঁচিয়ে উঠল।

-“প্লিজ, ও’কে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেব আমি। সত্যি। তবুও প্লিজ ও’কে বাঁচিয়ে রাখুন।”

বলতে বলতে ইনশিতা দেয়াল ধরেই বসে পড়ল। জেহের চোয়াল শক্ত রেখে বলে,

-“বাব্বাহ! এত দরদ? এত দরদ উথলে পড়ে কেন?”

বলে রাফিদের হাঁটুতে খুব জোরে বারি দিলো। রাফিদ আবারো উল্টে গে‌ল। ইনশিতা চিৎকার করতে লাগল। জেহের গার্ডদের ইশারা করলে তারা রাফিদকে নিয়ে চলে যায়। জেহের লাঠিটাকে আঁছড়ে ফেলে। যেন সব রাগ এখন লাঠির ওপর। ইনশিতার কাছে এসে ইনশিতাকে কোলে করে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ইনশিতা সীটে মাথা হেলিয়ে কাঁদতে লাগল। জেহের ইনশিতার গাল চেপে ধরে নিজের কাছে আনল। চোখ লাল করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“অন্য একজনের জন্য তোমার চোখের পানি আমি একদম মেনে নিতে পারব না। রাফিদকে মেরে ফেলব নাকি?”

ইনশিতা জোরে জোরে না সূচক মাথা নাড়াল।

-“তাহলে নিজের মূল্যবান চোখের পানি বিসর্জন দেওয়া বন্ধ করো। আর যদি কোনোদিন দেখেছি আমি ছাড়া কারো জন্য কেঁদেছ তাহলে তাকে দুনিয়া থেকে সরাতে আমার এক মুহূর্ত লাগবে না।”

ইনশিতা চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেলল। জেহের ইনশিতার গাল আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

-“হাসো। হাসো বলছি। আমার সাথে সবসময় হাসি মুখে থাকবে। কী হলো? হাসো হাসো। হু। আরো বড় করে হাসো। আরো…আরো বড়।”

ইনশিতা নিজের সাথে যুদ্ধ করে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। জেহের আঙুল দ্বারা ইনশিতার গাল আরো চেপে ঠোঁট বের করল। বাঁকা হেসে ইনশিতার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,

-“দ্যাটস মাই গার্ল।”

.
.
চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here