প্রাণস্পন্দন পর্ব ৫+৬

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নতুই জামাইয়ের আপ্যয়নে কমতি রাখলেন না ঝুমা বেগম।টেবিল ভর্তি খাবার সাজানো।ইলিশ মাছের দোঁপেয়াজা,আঁচারি গরুর মাংস,মুরগির রোষ্ট,সবজি,ডাল আরো নানারকম খাবার।মিষ্টান্ন হিসেবে দইয়ের সাথে পায়েশও করলেন তিনি।একাই খাচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার পাশেই অনুগত সহচারীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি।কাউচে বসে আছেন আলফাজ সাহেব।নিষ্প্রাণকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আরাজ।আরিশা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।ঝুমা বেগম রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে দেখছেন সব।

তৃপ্তিকর কন্ঠে বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“সত্যি মা,আপনার হাতে জাদু আছে বলতে হয়।এতো ভালো তো ধ্রুবতারাও রান্না করতে পারে না।ওই যে আপনার মনে আছে? প্রথম বার যখন আপনাদের বাসায় এসেছিলাম,ধ্রুবতারা নুডলস রান্না করে খাইয়েছিলো।কী বিশ্রি স্বাদ ছিলো!

ঝুমা বেগম ম্লান হাসলেন।নিষ্প্রাণ পাশে থাকা আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বললো—

“এখন নিশ্চয়ই ভালো রান্না করতে পারিস?বিয়ে বসতে চেয়েছিলি তো।ও তো আর তোকে আমার মতো ভালোবাসে না।যে তোর হাতে ওই অখাদ্য বিনা দ্বিধায় অমৃত মনে করে খেয়ে নিবে।”

আয়ন্দ্রি ঝাপসা চোখে মায়ের দিকে তাকালো।ফ্যাকাশে সে চাহনি।ঝুমা বেগম মুখে কাপড় গুঁজে চৌকাঠ থেকে সরে আসলেন।খাওয়া শেষে আলফাজ সাহেবের সাথে ড্রয়িং রুমেই বসে নিষ্প্রাণ।ঝুমা বেগম সুযোগ বুঝে আয়েন্দ্রিকে কক্ষের ভেতর নিয়ে আসলেন।ব্যস্ত হয়ে বললেন—

“দেখ আয়ু,ভয় পাস না তুই।ওই ছেলেটাকে কোনোমতে ঘুম পাড়িয়ে দে।তোর বাবা আর আমি থানায় যাবো।আরিশা আর আরাজ কে তোর মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।ওকে জেলে পুরে দিলে তোকে নিয়ে আমরাও এই শহর ছেড়ে চলে যাবো।ও আর কখনো তোকে খুঁজে পাবে না।”

হঠাৎ করেই চিনচিনে ব্যথা হয় আয়েন্দ্রির কলিজায়।কার কাছ থেকে পালাবে সে?বিছানায় ধুপ করে বসে আয়েন্দ্রি।নৈঃশব্দের ক্রন্দনে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জল।বিতৃষ্ণা গলায় বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বললো—

“কার থেকে পালাবো বলতে পারো?কোথায় পালাবো মা আমরা?তুমি কী জানো,বাবা যে ছেলেটাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে।ওই যে শিমুল।ও নিষ্প্রাণের লোক।আরাজকে যে লোকটা সিটি কলেজে ভর্তি করাতে সাহায্য করেছে ও নিষ্প্রাণের লোক।আরিশার ডান্স ক্লাবে যে ছেলে ওকে টিজ করেছিলো ওর হাত পা ভেঙেছে নিষ্প্রাণের লোক।এইবার বলো কোথায় পালাবো আমি?সারককে উঠিয়ে নিয়ে গেছে নিষ্প্রাণ।সারারাত ওকে টর্চার করেছে।ওর অপরাধ ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে।বলো মা,কী করবো আমি?

ঝুমা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।ঝরঝর করে কাঁদছে আয়েন্দ্রি।মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখে।ঝুমা বেগম ঝড়ের বেগে বললেন—-

“যত কিছুই করুক ওই অসুস্থ ছেলের সাথে আমি তোকে ছাড়তে পারি না।”

হেঁচকি উঠে যায় আয়েন্দ্রির।বললো—-

“দোষ তো আমারই মা।ওই নিষ্প্রাণকে প্রাণ আমি বানিয়েছি।আমিই ওকে আমার জীবনে জায়গা দিয়েছি।যদি আমি জানতাম ও আমার জীবনের ধ্বংসাত্মক পুরুষ ওকে আমি কখনো আমার জীবনে জায়গা দিতাম না।দিতাম না মা,দিতাম না।”

“ধ্রুবতারা।”

নিষ্প্রাণের ভারী কন্ঠে কান্না গিলে নেয় আয়েন্দ্রি।মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সাথে দুই জনের সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণের চোখের দিকে তাকিয়ে কলিজা কেঁপে উঠলো ঝুমা বেগমের।নিষ্প্রাণ ঝরা হাসলো।বললো—

“মা,কী করছেন বলেন তো!এইভাবে কেউ জামাইয়ের খোঁজ নেয়?

আয়েন্দ্রি কথা বাড়াতে চাইলো না।শক্ত কন্ঠে বললো—

“তুমি যাও মা।”

ঝুমা বেগম আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন।চলে যেতেই প্রশ্বস্ত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—-

“শাশুড়ি মা,দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যান।এন্ড ডোন্ট ডিস্টার্ব আছ।”

আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি চোখ লুকোচ্ছে।কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—-

“কী বলছিলি তুই মাকে?

আয়েন্দ্রি চুপ করে রইলো।অতিষ্ঠ নিষ্প্রাণ জোর হাতে ধাক্কা মারে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি অতর্কিত ধাক্কা সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে যেতেই তার উপর ঝুঁকে যায় নিষ্প্রাণ।রোষানলে জ্বলে বললো—-

“তোকে না বলেছি রাগাবি না আমায়।কেন করিস এমন?

আয়েন্দ্রি শান্ত কন্ঠে বললো—

“প্রাণ,এইটা আমাদের বাড়ি।”

শ্লেষাত্মক হেসে বললো নিষ্প্রাণ—

“কিন্তু তুই তো আমার।”
,
,
,
আয়েন্দ্রির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ।তার মন্ত্রমুগ্ধ চাহনি আয়েন্দ্রির মুখে।নিজের আঙুলে আয়েন্দ্রির ভেজা চুল মুড়িয়ে খেলছে।আয়েন্দ্রি নিরুত্তাপ।দরজায় দাঁড়িয়ে সংকীর্ণ গলায় অনুমতির আহ্বান করে আরিশা–

“ভেতরে আসবো?

আয়েন্দ্রির মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকায় নিষ্প্রাণ।আরিশাকে দেখে প্রফুল্ল হেসে বললো–

“কাম,কাম আরিশা।”

আরিশা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে দাঁড়ায়।অপ্রস্তুত হয় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ এখনো আয়েন্দ্রির ভেজা চুল নিয়ে খেলছে।আরিশা অদ্ভুত দৃষ্টিতে বোনকে দেখে।হাঁটু অবধি ফ্রক পরা আরিশা ঘটনার গম্ভীরতা আঁচ করতে পারলো না।সে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো—

“আপু,সারক ভাইয়ার বাবা এসেছে।তোমাকে ডাকছে।”

নিষ্প্রাণ চুলের ডগা সোজা করে নাকের নিচে খাঁজটাতে ধরে নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

“আরিশা!
বলোতো মোচ রাখলে আমাকে কেমন লাগবে?

আরিশা ভয়ে ভয়ে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।যেদিন নিষ্প্রাণকে জেলে নিয়ে যায় পুলিশ সেদিন কিছু বুঝতে না পারলেও আয়েন্দ্রির পাগলের মতো কর্মকান্ড দেখে এতোটুকু বুঝতে পেরেছে এই ছেলে ভয়ংকর কিছু করেছে তার বোনের সাথে।আরিশা কোনো জবাব দিলো না।নিষ্প্রাণ আরিশার দিকে নজর ক্ষেপণ করে।চোখের ইশারায় আরিশাকে ডাকতেই আরিশা দ্বিধাগ্রস্তের মতো মেপে মেপে পা ফেলে এগিয়ে আসে।
নিষ্প্রাণ উজ্জ্বল হাসে।পকেটে হাত দিয়ে একটা প্যান্ডেন্ট বের করে আরিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—

“এইটা তোমার জন্য।নাও।”

আরিশা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।নিষ্প্রাণ কন্ঠে গভীরতা টেনে বললো–

“নাও।শালি হিসেবে নয়।বোন হিসেবে দিলাম তোমাকে।আমার একটা কাজিন ছিলো।বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার সমানই থাকতো।”

আরিশা টিমটিমে চোখে বোনের দিকে তাকায়।আয়েন্দ্রি অনমনীয় গলায় বললো—

“নিয়ে নে।”

বোনের কথা শুনে দেরি করলো না আয়েন্দ্রি।প্যান্ডেন্টটা নিয়েই পা বাড়ায় দরজার দিকে।নিষ্প্রাণ ভরাট গলায় সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললো—-

“প্যান্ডেটটা ফেলে দিওনা আরিশা।তাহলে কিন্তু ভাইয়া খুব রাগ করবো।”

একটা ভয়ংকর ঢোক গিলে দ্রুত বেরিয়ে যায় আরিশা।নিষ্প্রাণ উঠে বসে।গায়ে দেওয়া কালো শার্টটা ঠিক করতেই আয়েন্দ্রি ভয়াতুর গলায় প্রশ্ন করে—

“কোথায় যাচ্ছিস তুই?

অনুদ্বেগ হাসে নিষ্প্রাণ।হৃষ্ট গলায় বললো–

“তোর না হওয়া হবু শশুরের সাথে দেখা করতে।”

আয়েন্দ্রির কিছু একটা হলো।দ্রুত গিয়ে নিষ্প্রাণের শার্ট খাঁমচে ধরে বললো—

“কোনো পাগলামি করবি না তুই।”

আয়েন্দ্রির দুই হাত আলতো করে ছাড়িয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললো—

“করবো না।প্রমিজ।বললাম না আমি ভালো হয়ে গেছি।কিচ্ছু করবো না আমি।”

তবুও যেনো ভয় কমলো না আয়েন্দ্রির।বসার ঘরে সারকের বাবার একদম সামনেই বসলো নিষ্প্রাণ।ভদ্রলোক চশমার ফাঁক গলিয়ে নিষ্প্রাণকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।দ্বিধান্বিত গলায় বললেন—

“তুমি?

নিষ্প্রাণ ভুবন ভোলানো হাসলো।বললো—

“আয়েন্দ্রির স্বামী।কাল রাতেই আমাদের বিয়ে হয়েছে।আমরা দুই জন দুই জনকে ভালোবাসি।সরি।ওর চেয়ে আমি ওকে বেশি ভালোবাসি।”

ভদ্রলোক ভীষণভাবে চমকালেন।কাল রাতেই যার হবু স্বামীকে কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলো সেই মেয়ে সেদিন বিয়েও করে ফেললো!
কেমন অদ্ভুত লাগলো বিষয়টা ভদ্রলোকের কাছে।নিষ্প্রাণ ব্যপারটা সহজ করার জন্য বললো—

“স্যার এখন কেমন আছেন?
ও আপনি আমাকে হয়তো চেনেন না।স্যার আমর খুব পছন্দের শিক্ষক ছিলেন।আমি স্যারের ভার্সিটিতেই পড়তাম।স্যারের সাথে যা হয়েছে তা একদম ঠিক হয়নি।চিন্তা করবেন না।আর এই বিয়েটা আমি করেছি।আমার শশুড়বাবার এতে কোনো হাত নেই।আপনি স্যারকে আমার নামটা বলবেন।স্যার বুঝে যাবে।আমার নাম নিষ্প্রাণ মুনতাসির।ব্যাচ দুই হাজার পনেরো।কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।”

ভদ্রলোক অবিশ্বাস্য নজরে শ্রবণ করলেন পুরো কথা।কিন্ত হকচকিয়ে বললেন—

“তুমি কী করে জানো সারকের কথা?

নিষ্প্রাণ মোলায়েম হেসে বললো—

“আরিশা বলেছে।”

আরিশা ভড়কে যায়।সে তো ভেতরে গিয়ে কিছু বলেনি।ভদ্রলোক একরাশ প্রশ্ন নিয়ে চলে গেলেন।শুধু নামটা মনে রাখলেন।নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায়।ঝুমা বেগমকে সালাম করে বললো—

“আসি মা।”

ঝুমা বেগম আয়েন্দ্রির চুপসে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে মিইয়ে গলায় বললো—

“আয়ু না হয় আজ রাত এখানেই থাক।তুমি ওকে কাল নিয়ে যেও।”

মুচকি হাসলো নিষ্প্রাণ।আদর ভরা কর্তৃত্বসুরে বললো—-

“পঁচিশ বছর তো আপনাদের সাথেই কাটালো।বাকি জীবনটা না হয় আমার সাথেই কাটাক।কথা দিচ্ছি,আগলে রাখবো আপনার মেয়েকে।এই নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন করে রাখবো।”

নিজের কথা শেষ করে দরজার কাছে গিয়ে দমকে যায় নিষ্প্রাণ।গম্ভীর গলায় বললো–

“তাড়াতাড়ি আয় ধ্রুবতারা।আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি।”
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

আয়েন্দ্রির বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ।সবুজ রঙের ডিম লাইটের ক্ষীণ আলোতে আয়েন্দ্রির ওয়াল পেইন্টিং এ নিরবধি চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।সেদিকেই চোখ রেখে কাতর গলায় বললো—

“জানিস ধ্রুবতারা,এই দুই বছর তোকে কত মিস করেছি আমি।একটা দিনের জন্যও তোকে আমি ভুলে থাকতে পারিনি।”

আয়েন্দ্রি কোনো জবাব দিলো না।সিলিং এর বন্ধ ইলেক্ট্রনিক পাখার দিয়ে তাকিয়ে রইলো।এসির হাওয়ায় শীতলতা বিরাজ করছে বিশাল বেডরুমে।
আয়েন্দ্রির বুক থেকে মাথা তোলে নিষ্প্রাণ।তার মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে অসহিষ্ণু গলায় বললো—

“এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

আয়েন্দ্রি মৃদু গলায় বললো—

“তুই সত্যিই হসপিটালে ছিলি?

আয়েন্দ্রির কপালের উপর কপাল রাখে নিষ্প্রাণ।নাকে নাক ঘঁষে বললো—

“তাহলে চল হসপিটালে।ওদেরকেই জিঙ্গেস করবি আমি সেখানে ছিলাম কিনা।”

আয়েন্দ্রি উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো।ক্লান্ত গলায় বললো —

“তোর কথা বলা শেষ?
আমি ঘুমাবো।”

আয়েন্দ্রিকে ছেড়ে বিছানার এইপাশে এসে শুয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ।পাশে থাকা সাইড টেবিলে দন্ডায়মান ল্যাম্পশেডটা জ্বালিয়ে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে।কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে আসে নিষ্প্রাণের অক্ষিপুট।আয়েন্দ্রির চোখে ঘুম নেই।তার মানসপটে ভেসে উঠছে সেই দিনের ছবি।দুই বছর আগে যেদিন নিষ্প্রাণকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সেদিন নিষ্প্রাণ একটা কথাও বলেনি।শুধু বদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো আয়েন্দ্রির দিকে।সেদিন প্রথমবার নিষ্প্রাণের গায়ে হাত তোলে আয়েন্দ্রি।গুনে গুনে ছয়টা থাপ্পড় মারে নিষ্প্রাণের দুই গালে।নিষ্প্রাণ কোনো প্রতিবাদ করেনি।পালিয়ে যাওয়ার তাগিদও তার ছিলো না।হাঁটু ভাঁজ করে আয়েন্দ্রির সামনে মাথা নিচু করে বসে রইলো।আয়েন্দ্রির বাবা আলফাজ সাহেব পুলিশ ডাকলেন,বাড়িতে হট্টগোল হলো কিন্তু নিষ্প্রাণ!সে নিষ্প্রাণ হয়েই থাকলো।পুলিশ যখন নিষ্প্রাণকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখনও নিষ্প্রাণ অনিমেষ ব্যথাতুর চোখে আয়েন্দ্রির দিকেই চেয়ে রইলো।সে চাহনি নিশ্চল,স্থির।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রির বুক চিরে।

পাশ ফিরতেই দেখে ল্যাম্পশেড জ্বলছে।একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে বসে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই মনে হলো সে তন্দ্রাচ্ছন্ন।আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের কাছে এগিয়ে আসে।সংকোচ নিয়ে তার উপরে ঝুঁকে ল্যাম্পশেড অফ করে।ছেলেটা আসলেই পাগল।ডিম লাইট জ্বলছে সেখানে আবার ল্যাম্পশেড লাগে!

নিষ্প্রাণের একদম কাছেই বসে আছে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের ঘুমন্ত মুখটা কী নিষ্পাপ!যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে হয়তো ততক্ষণই শান্ত।উঠলেই অশান্ত।আয়েন্দ্রি গাঢ় দৃষ্টিতে দেখে নিষ্প্রাণকে।এতোটা কাছে আসলেও রাগে,ক্ষোভে,বিতৃষ্ণায় নিষ্প্রাণের চেহারাটা ভালো করে দেখা হয়নি তার।নিষ্প্রাণ আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে।চাপা চোয়ালটা আগের চেয়ে ভরাট।পাতলা দুই ঠোঁটের রঙও আগের মতো।নিষ্প্রাণ তার চুলের যত্ন করতো অনেক।কারণ তার এই ঝাঁকড়া চুল তার ধ্রুবতারার খুব পছন্দ।প্রায় প্রতিদিনই একবার হলেও নিষ্প্রাণের চুলে আঙুল গলাতো আয়েন্দ্রি।আজও তেমনটা ইচ্ছে হলো আয়েন্দ্রির।ফিকে আলোতেও একটুও উজ্জ্বলতা কমেনি নিষ্প্রাণের।আচমকা বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“এমন করে কী দেখছিস?

হকচকিয়ে যায় আয়েন্দ্রি।চোখের পল্লব মেলে ধরে মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ।উঠে বসে।চট করে বললো–

“ঘুমাস নি যে?

আয়েন্দ্রি অপ্রস্তুত হয়।তার এই অবস্থা দেখে আলতো হাসে নিষ্প্রাণ।টুপ করে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো—

“ঘুম পাচ্ছে না।তাই তো?
আমার কাছে আয়।”

আয়েন্দ্রি দৃঢ় হয়ে রইলো।নিষ্প্রাণ নিজেই আয়েন্দ্রিকে কাছে টেনে নেয়।নিষ্প্রাণে বক্ষস্থলে আয়েন্দ্রির পিঠ ঠেকিয়ে বলয় আকৃতি করে আঁকড়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রির খোলা চুলে নাক ঠেকিয়ে বললো—

“তোর এখনো আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?

আয়েন্দ্রি নির্বিকার।আয়েন্দ্রির কাঁধে চিবুক রাখে নিষ্প্রাণ।মায়ময় গলায় বললো—

“ওরা সবাই কেমন আছে রে?

আয়েন্দ্রি ফ্যাকাশে গলায় বললো–

“কারা?

আয়েন্দ্রির গলার দিকে অধর ছুঁইয়ে নরম গলায় বললো নিষ্প্রাণ—

“তৃণা,কুসুম,সীমান্ত,প্রাবিশ আর শ্রেয়া?

আয়েন্দ্রি সহজ গলায় বললো—-

“ভালো

“কোথায় আছে এখন ওরা?

“তৃণা মাস্টার্স করছে।কুসুম অনার্স শেষ করে গ্রামে চলে গেছে।একবার কথা হয়েছে।বলেছে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জব করে।প্রাবিশ নরওয়ে থাকে।সীমান্ত বাবার ব্যবসায়ে হাত দিয়েছে।আর শ্রেয়ার খবর তোর রাখার কথা।”

শেষের কথায় খলখল করে হেসে উঠে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের বুক থেকে সরে বসে।নিষ্প্রাণ প্রশ্নবিদ্ব চোখে বললো—

“উঠলি কেন?

“ঘুমাবো আমি।”

“ওকে।”

আয়েন্দ্রি শুয়ে পড়ে বিছানার এইপাশটায়।নিষ্প্রাণের স্পর্শে কেমন দূর্বলতা অনুভব করছে আয়েন্দ্রি।ভয়ংকর এই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আয়েন্দ্রির।কিন্তু নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন সত্যিই আয়েন্দ্রিকে বিগলিত করছে।এই যে নিষ্প্রাণের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো।নিষ্প্রাণ তাকে প্রগাঢ় মায়ায় জড়িয়ে ধরলো।অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো আয়েন্দ্রি স্থির শরীরে।যেনো ভেতরে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে নিষ্প্রাণে স্পর্শ,তার তপ্ত নিঃশ্বাস,তার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ।ভাবতে ভাবতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে আয়েন্দ্রি।
,
,
,
কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে টিপিক্যাল বাঙালি গৃহিণীর মতো রান্না করছে আয়েন্দ্রি।অবশ্য আয়েন্দ্রি যা রান্না করবে গোগ্রাসে তা গিলে নিবে নিষ্প্রাণ।তবুও দু’বছরে রান্নার হাত চেঞ্জ হয়েছে আয়েন্দ্রির।বেশ ভালো না হলেও ভালো বলা চলে।দুপুর রোদের তীক্ষ্ম ফলা কিচেন রুমের জানালা ভেদ করে ঢুকেছে।ও বাড়িতে তেমন রান্না করা হতো না আয়েন্দ্রির।ঝুমা বেগম নিজ হাতেই সব করতেন।

আয়েন্দ্রির শুভ্র, নগ্ন কোমরে হাত রাখতেই চমকে উঠে সে।অতর্কিত ছোঁয়ায় কেঁপে উঠে আয়েন্দ্রির মস্তিষ্ককোণ।পরক্ষণেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।ততক্ষণে আয়েন্দ্রি পাখির ছানার মতো গুঁজে গেছে নিষ্প্রাণের বক্ষস্থলে।নিষ্প্রাণ অতলান্তিক মায়ায় তার উষ্ণ ছোঁয়ায় ব্যস্ত করে তোলে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে অপ্রতিভ গলায় বললো—

“রান্না শেষ আমার।তুই খেতে বস।আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।”

নিষ্প্রাণ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে আয়েন্দ্রির দিকে তাকালো।আয়েন্দ্রির নাকের নিচের খাঁজটায় মুক্তোর মতো ঘাম জমেছে।সাথে নাকের ঢগা আর চিবুকের গাঁথুনিতে।আয়েন্দ্রিকে ধরে রাখা বন্ধন আরো দৃঢ় করতে আয়েন্দ্রির নিঃশ্বাসও যেনো মিশে যাচ্ছে নিষ্প্রাণের নিঃশ্বাসের সাথে।আয়েন্দ্রি চোখ তুলে অক্ষিপুট প্রশ্বস্ত করে নিষ্প্রাণের চোরা হাসির মুখটার দিকে তাকায়।ভালো করে তাকাতেই আয়েন্দ্রির মনে হলো কিছু একটি মিসিং নিষ্প্রাণের ফর্সা,টলটলে চেহারাটায়।আয়েন্দ্রির এরূপ চাহনিতেই ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ।কপাল টানটান করে বললো—

“গ্লাস মিসিং।এই যে দেখ চোখে লেন্স লাগিয়েছি।রোমান্সে নো বাঁধা।”

বলেই দীর্ঘ চুমু খায় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।নিষ্প্রাণের বুকে আঁকড়ে ধরা দুই হাতের মুঠ শক্ত করতেই হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ।চটপটে গলায় বললো—

“মেরে ফেলবি নাকি?

আয়েন্দ্রি অদ্ভুত স্বরে বললো—

“তা সম্ভব হলে অনেক আগেই করতাম।”

আয়েন্দ্রির কথায় থমথমে হয়ে যায়য় নিষ্প্রাণের মুখটা।তাকে ঘুরিয়ে পিঠ ঠেকায় নিজের বুকে।নিষ্প্রাণের হাত তখন আয়েন্দ্রির উদরের উপর চেপে রেখেছে।আহ্লাদী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—-

“তোর ঘ্রাণ একদম বেলী ফুলের মতো।ইচ্ছে করে সবটা নিংড়ে নেই।তোর মনে আছে?প্রাবিশের বার্থডের দিন প্রথমবার বিয়ার খেয়ে তোর অবস্থা কী হয়েছিলো!বেহুশ হয়ে সারারাত আমার বুকের উপর পড়ে রইলি।বিশ্বাস কর,জীবনের প্রথমবার সেদিন নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে আমার।সারারাত চোখ বন্ধ করতে পারিনি আমি।তোর শরীরের উষ্ণতা,সৌরভ,তোর হৃদস্পন্দন যেনো আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছিলো।নিজেকে কী করে সামলেছি সেদিন আমি বলতে পারবো না তোকে।”

আয়েন্দ্রি ব্যঙ্গাত্মক গলায় বললো—-

“এখন তো তার প্রয়োজন নেই।তোর যা ইচ্ছে করতে পারিস।”

“রাগ করে আছিস এখনো?

“ছাড় আমায়।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“ওকে।”

আয়েন্দ্রি সিঁড়ি বেয়ে বেডরুমে চলে যায়।খাবার টেবিলে অপেক্ষারত নিষ্প্রাণ।দরজার বাইরে থেকে অ্যালার্ম আসতেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।আধুনিক সকল প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে নিষ্প্রাণ তার প্রাণস্পন্দনকে নিজের করে রাখতে।দরজা পাশেই লাগানো বোর্ডে কতগুলো ডিজিট লেখা।সেখানে থেকে কিছু ডিজিট চাপতেই দরজার মাঝখানের ছোট জানালার মতো খুপরিটা খুলতেই বাইরে থাকা সিকিউরিটি গার্ড একটা খাম ধরিয়ে দেয় নিষ্প্রাণের হাতে।এই দরজাটা নিজে অর্ডার করে বানিয়েছে নিষ্প্রাণ।বেশ পুরু এই দরজার বাইরে কাঠ হলেও ভেতরে ধাতব পদার্থ।আর রয়েছে ইলেকট্রিক তারের সন্নিবেশন।

খামটা নিয়ে আলতো হাতে খুলে নিষ্প্রাণ।শাওয়ার সেরে একটা নীল রঙের জুম শাড়ি পড়েছে আয়েন্দ্রি।সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কীসের কাগজ ওইটা?

নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বললো—

“ইনভাইটেশন কার্ড।”

টেবিলে গিয়ে খাবার বাড়তে থাকে আয়েন্দ্রি।বিছিয়ে থাকা আঁচলটা এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নেয়।হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে এসেছে।নিষ্প্রাণকে কার্ডের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে উৎসুক গলায় বললো—

“কীসের ইনভাইটেশন?

নিষ্প্রাণ কোনো ভনিতা ছাড়াই সহজ গলায় বললো—

“দাদু যে কোম্পানিটা টেক ওভার করেছে তার মালিক নতুন একটা কোম্পানি শুরু কিনেছে।সে উপলক্ষ্যে একটা পার্টি অর্গানাইজ করেছে।তার বিজন্যাস পার্টনার,ইনভেস্টর,ওয়েল উইশার সকলকে আমন্ত্রণ করেছে।একা নয় স্পাউজসহ।”

মুহুর্তেই ঘনকালো মেঘে ছেঁয়ে যায় আয়েন্দ্রির মুখ।নিষ্প্রাণের পাগলামি যদি সত্যিই ভালো না হয় তাহলে ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে সে আবার।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here