প্রাণস্পন্দন পর্ব ৭+৮

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

একটা জাম রঙা শাড়ি পরেছে আয়েন্দ্রি ফুলস্লিভ কালো ব্লাউজের সাথে।আয়েন্দ্রির চুল ততটা লম্বা নয়।পিঠের দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দীর্ঘ চুল বেশ ঘন আর সিল্কি।এক পাশে একটা সিঁথি করে ছেড়ে রেখেছে চুল।দেশী-বিদেশী প্রসাধনীর ব্যবহারও তার চোখে,মুখে।ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি রঙের লিপস্টিক।আইলেস লাগানো চোখগুলো ভাসা ভাসা।পার্টিতে সমাবেশিত শ’খানেক মানুষের মধ্যে কেমন অস্বস্তি লাগছে আয়েন্দ্রির।যদিও তার আসতে একদম ইচ্ছে করেনি কিন্তু নিষ্প্রাণের না শোনার ধৈর্য্য এখন শূন্যের কোঠায়।

নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে বটবৃক্ষের মতো আয়েন্দ্রির পাশে।সাদা শার্টের সাথে কালো ব্লেজার।বরাবরই কালো রঙ পছন্দ নিষ্প্রাণের।নিজেকে লুকানোর সবচেয়ে যুতসই রঙ।

একটা রিসোর্টে আয়োজিত এই পার্টিতে অনেক নামিদামী ব্যবসায়ীর আগমন।পায়ের নিচে দুমড়ে চলছে সবুজ ঘাস।নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর অন্তর রয়েছে ঝাউগাছ যাতে করা হয়েছে সাদা রঙের লাইটিং।এছাড়াও রয়েছে ঝাউগাছের প্রান্ত ঘেঁষে অতিথিদের জন্য গোল টেবিল।বুফের ব্যবস্থা করাও হয়েছে।নির্দিষ্ট পোশাকে রয়েছে সার্ভিস বয়।তারা সার্ভ করছে স্কচ,ওয়াইন আর সফট ড্রিংকস।

নিষ্প্রাণ তার কিছু পরিচিত লোকের সাথে আয়েন্দ্রিকে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং হঠাৎ বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা মশকরাও করে।অত্যন্ত চতুরতার সাথেই সবটা সামলে নেয় নিষ্প্রাণ।

আয়েন্দ্রিকে দাঁড় করিয়ে ওয়াশরুমে যায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি গুটিসুটি মেরে স্থির হয়ে আছে।চকিতেই তার পেছন থেকে কেউ একজন আসতেই ধাক্কা লাগে আয়েন্দ্রির গায়ে।আয়েন্দ্রির হাতে থাকা সফট ড্রিংক তার শাড়িতে পড়ে যায়।অপরিচিত লোকটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঝাড়া মেরে আয়েন্দ্রির শাড়ি থেকে কোল্ড ড্রিংকসের ভেজা আবরণ সরাতে চায়।দূর থেকে তা দাঁড়িয়ে দেখছে নিষ্প্রাণ।ক্রমশ তার শিড়দাঁড়া শক্ত হতে থাকে।চোয়ালে দেখা দেয় অশিথিলতা।দাঁতে দাঁত চেপে হাতের মুষ্ঠি করতেই হাতের শিরা ফুলে উঠে।
অপরিচিত লোকটি সাহায্য করার আড়ালে আয়েন্দ্রির কোমর ছুঁইয়ে দিচ্ছে।অপ্রস্তত আয়েন্দ্রি ব্যক্তিটির নোংরা অভিপ্রায় ধরতে পারলো না।তবুও নিষ্প্রাণের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে বারবার বলছে সে ঠিক করে নিবে।ব্যক্তিটি তবুও অপরাধবোধ এড়াতে এই কাজ করতে লাগলো।হঠাৎ নিষ্প্রাণের দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় আয়েন্দ্রি।ব্যক্তিটিকে একরকম ঝাঁড়া মেরেই ওঠে।সটকে পড়ে ব্যক্তিটি।আয়েন্দ্রির কাছে এসে মুখভর্তি হাসে নিষ্প্রাণ।মিষ্টি গলায় বললো—

“কী হয়েছে?

আয়েন্দ্রি ভীষণ অবাক হলো নিষ্প্রাণের গলার স্বরে।সাবলীল উত্তর দিলো—

“কিছু না।ড্রিংস পড়ে গিয়েছিলো আমার গায়ে।”

নিষ্প্রাণ একটা লোককে ডাক দেয়।কয়েকটা টিস্যু পেপার নিয়ে শাড়ির এপাশ ওপাশ চেপে ধরে বললো—

“খেয়াল করে হাঁটবি তো।এখানে তো আর আমরা একা না।অনেক মানুষ।”

নিষ্প্রাণের ব্যবহারে যারপরনাই বিস্মিত হলো আয়েন্দ্রি।কতটা সহজ ব্যবহার।আয়েন্দ্রির বিশ্বাস হতে লাগলো নিষ্প্রাণ সত্যিই ঠিক হয়ে গেছে।অদ্ভুত ভালোলাগা শুরু হলো আয়েন্দ্রির।আয়েন্দ্রিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো—

“চিন্তা করিস না।এই শাড়ি আর পরতে হবে না তোকে।এই রঙের নতুন শাড়ি কিনে দিবো।”

আয়েন্দ্রি নীরস হাসলো।নিষ্প্রাণ মুচকি হেসে বললো—

“মাই হার্টবিট।”

যে লোকটার আয়েন্দ্রির সাথে ধাক্কা লেগেছিলো চল্লিশ বছর হওয়ার পরও এখনো ব্যাচেলর সে।তাই এইধরণের গর্হিত কাজ সে প্রায়ই করে।স্কচে চুমুক দিয়ে বিশ্রিভাবে হেসে বললো–

“নতুন বিয়ে তো তাই অনেক শাই।”

পাশে দাঁড়ানো অন্য একজন রেড ওয়াইনে তৃপ্তিকর চুমুক দিয়ে বললো—

“ভাই,বয়স তো কম হলো না।বিয়েটা করে নিলেও তো পারেন।তাহলে আর এদিক ওদিক হাত নাড়তে হয় না।”

জাফর বিশ্রি হাসলো।বললো—

“না,না।ওসব বিয়ে টিয়ে তে আমার পোষবে না।নিত্য নতুন ডিশ পছন্দ আমার।বিয়ের পর ভালো না লাগলেও রোজ সেই ডাল,ভাত।জমে না আমার।”

কথা শেষ করেই চুমুক স্কচের প্রশ্বস্ত গ্লাসে।তার পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলো নিষ্প্রাণ।চকিতে একটা লোকের সাথে ধাক্কা লাগে জাফরের।লোকটা ছিলো সার্ভিস বয়।শহরের উঁচু তলার মানুষ আবার গরীব লোকদের মানুষ মনে করে না।হাতাপায়ির এক পর্যায়ে জাফরের মোবাইল পড়ে যায় হাত থেকে।জটলার মধ্যে থেকে তা তুলে নেয় নিষ্প্রাণ।দ্রুতহাতে একটা নম্বরে ডায়াল করে যা নিষ্প্রাণের আরেক হাতে।রিসিভ করে সেই মোবাইলটা একটা ঝাউগাছের তলায় রেখে দেয়।আর অতি সন্তর্পনে ঝগড়া মিটে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।আয়েন্দ্রিকে বুফের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।হাত ভর্তি খাবারের থালা দেখে বিহ্বল আয়েন্দ্রি।অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু একটু করে খেয়ে চলছে আর নিষ্প্রাণকে খুঁজে চলছে।বুফের সামনেই একটা পর্দা টানানো।তাই এইপাশের কিছুই দেখতে পারছে না আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের আদেশ অমান্য করে সেখান থেকে নড়তেও পারছে না।

জাফর ছেলেটাকে এমনভাবে মারলো যে সে নিজেই ঘেমে নেয়ে একাকার।তার হাজার টাকার জুতো নষ্ট করে ফেলেছে ছেলেটি খাবার ফেলে।ততক্ষণে নিষ্প্রাণ তার কাজ করে ফেলেছে।জাফরের মোবাইল থেকে ডায়ালকৃত কল কেটে মোবাইলটা তার পকেটে ঢুকিয়ে দেয়।নিজেকে একটু পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে ঢুকে জাফর।তলপেটে চাপ দিতেই কাজ শেষ করে
হাত ধুয়ে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকাতেই চোখ পিটপিট করে জাফর।তার পেছনে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ।উৎসুকতা নিয়ে পেছন ফিরতেই জাফরের মুখে একটা চার ইঞ্চির তীক্ষ্ম চাকু ঢুকিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।চাকুটা বিনা বাঁধায় জাফরের মুখের ভেতরের কন্ঠনালীর একটু সামনের দিকের উপরে গেঁথে যায়।জাফর হতবিহ্বল হয়ে দুই হাতে নিষ্প্রাণের হাত চেপে ধরে।চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে পানি জাফরের।মরণ যন্ত্রণায়ও অস্ফুট আওয়াজ তার।নিষ্প্রাণের চোখ দিয়ে আগুনের কুন্ডলী বের হচ্ছে যেনো।দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে নাকের পাটা ফুলিয়ে ডান হাত দিয়ে জাফরের এক হাত ছাড়িয়ে নেয়।জাফর অনবরত থরথরিয়ে কাঁপছে।প্রাণসঞ্জিবনী ফুরিয়ে আসছে তার।মুখ দিয়ে গলগলিয়ে লহুর শ্লথ ধারা বের হচ্ছে।নিষ্প্রাণ জাফরের ডানহাতের আঙুল একটা একটা করে ভেঙে দেয়।তরপাতে থাকে জাফর।গলার নিচ থেকে বুক পর্যন্ত রক্তে জবজবে।গলা কাটা মাছের মতো কিছুক্ষণ শনশনিয়ে বেরিয়ে যায় জাফরের আত্মারাম।হাত সরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।গড়িয়ে পড়ে জাফরের নিথর দেহ মেঝেতে।নিষ্প্রাণ হাতে থাকা ওয়ান টাইম গ্লাভস খুলে ফ্ল্যাশ করে।জাফরের ভাঙা হাতের উপর পা মাড়িয়ে ধরে নিষ্প্রাণ।ক্রোশ মিটিয়ে পুরো থেতলে দেয় সেই হাতের পাঞ্জা।রাগে ফুঁসে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ।

নিজেকে ধাতস্থ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে সে।সিসিটিভি ফুটেজে নিষ্প্রাণের অস্তিত্ব নেই।কারণ সিসিটিভির ডাইরেকশন আগেই চেঞ্জ করেছে নিষ্প্রাণ।সহজ ভঙিতে বাইরে বেরিয়ে আসে সে।অনেকটা দূরে এসে জুতোতে লাগানো এক্সট্রা প্লাষ্টিকের পেপারটা খুলে নেয় নিষ্প্রাণ।ফেললো না তা।একটা কাগজে মুড়ে প্যান্টের পকেটে পুরে নিলো। গাড়ির ভেতরে বসতেই কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—

“কোথায় গিয়েছিলি?

নিষ্প্রাণ সরল গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“একজন ইনভেস্টরের সাথে কথা বলতে।জানিস তো আমাদের কোম্পানি ডাউন।সেখানে নিজ থেকে ওই লোক ইনভেস্ট করেছে।আমি তো আর অফিস যাবো না।দেখা হয়ে গেলো তাই কথা বলে নিলাম।তোর কিছু লাগবে?

“উঁহু।”

নিষ্প্রাণের মুখটা প্রাণোচ্ছল,স্বাভাবিক,হাস্যোজ্জ্বল।আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে খুশির হাসি।যেনো সবকিছু সুস্থ হতে চললো।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

দুপুরের ভাতঘুমের পর আলস্য শরীর যেনো চলছিলো না।বিশাল বাড়ির চার দেয়ালই এখন আয়েন্দ্রির আবাসস্থল।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় দেখতে পেলো না নিষ্প্রাণকে।বারান্দার থাইও টানা।এদিক ওদিক তাকিয়েও যখন নিষ্প্রাণের হদিস মিললো না তখন বেডরুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসে আয়েন্দ্রি।আয়েন্দ্রিদের পুরো বাড়িটাই যেনো নিষ্প্রাণের ড্রয়িং রুমের সমান।শুষ্ক হাসে আয়েন্দ্রি।সে এক ঘুমন্ত রাজ্যের রাণী।

ড্রয়িং রুমেও নেই নিষ্প্রাণ।ঢিবঢিব করছে আয়েন্দ্রির কলিজা।নিষ্প্রাণ তাকে ছেড়ে বাইরে যাওয়ার মানুষ নয়।ড্রয়িং রুমের কর্ণারে কাউচের পাশে একটা জানালা যার পুরোটাই কাঁচের।এপাশ থেকে স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে আয়েন্দ্রি দেখতে পেলো কেউ আছে সেখানে।আয়েন্দ্রি সফেদ পর্দাটা টান মেরে সরিয়ে দেয়।সেখান থেকে দেখতে পায় নিষ্প্রাণ কিছু একটা করছে।হুম করছে সে।কাঁচি,ঝাঁঝরি নিয়ে তার কাজ।আয়েন্দ্রি কাঁচের গায়ে হাত দিয়ে আঘাত করে।শুনতে পেলো না নিষ্প্রাণ।কাঁচ গলিয়ে সেই আওয়াজ বাইরে যাওয়া দুর্বোধ্য।আয়েন্দ্রি নৈঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো।নিষ্প্রাণকে দেখছে সে।কী গভীর মনোযোগে বেলি ফুলের চারা লাগাচ্ছে।সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। দেখে আয়েন্দ্রি দাঁড়িয়ে আছে।সমুচ্ছলিত হাসে নিষ্প্রাণ।হাতের মাটি ঝাঁড়া মেরে কাঁচের জানালাটার সামনে এসে দাঁড়ায়।পাসকোর্ড দিয়েই তা খুলতে হয়।দুপুরে গোসলের পর চোখে কাজল দিয়েছিলো আয়েন্দ্রি।ঘুমের মধ্যে তা ছড়িয়ে গেছে।কাঁচের জানালায় হাত রেখে তাতে কপাল ঠেকায় আয়েন্দ্রি।ঠিক তার হাতের উপর ওপর প্রান্তে হাত রাখে নিষ্প্রাণ।দুর্ভেদ্য কাঁচের গ্লাস বেশ পুরু।আয়েন্দ্রির কপালের সমান্তরালে কপাল রাখে নিষ্প্রাণ।চোখে হাসে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের প্রাণবন্ত চেহারাটা অনেকদিন পর দেখছে আয়েন্দ্রি।আয়েন্দ্রির ঠোঁট যেইনা কাঁচের জানালা স্পর্শ করেছে ওমনেই সেইখানে চুমু খেয়ে বসে নিষ্প্রাণ।হতভম্ব হয়ে যায় আয়েন্দ্রি।তার মনে হলো সত্যিই যেনো নিষ্প্রাণ তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছে।খলখল করে হেসে উঠে নিষ্প্রাণ।এপাশ থেকে তার হাসির আওয়াজ শুনতে না পেলেও মায়াময় ওই হাসি মুখটা যেনো আয়েন্দ্রির জমাট রাগ তরলে পরিণত করলো।
,
,
,
টি টেবিলের উপর পা ছড়িয়ে ডিভানে বসে আছে নিষ্প্রাণ।পায়ের উপর রাখা ল্যাপটপে আঙুল চলছে খটাখট আওয়াজে।তার সামনেই ধোঁয়া উড়ানো কফি ধরে মুচকি হাসে আয়েন্দ্রি।মিষ্টি গলায় বললো—

“তোর কফি।”

ঠোঁট চিপে কৃতজ্ঞ হাসে নিষ্প্রাণ।ঝলমলে গলায় বললো—-

“থ্যাংক ইউ।”

“একটা কথা বলবো?

“অবশ্যই।

আয়েন্দ্রি কৌতূহলী গলায় বললো—

“তোর দাদু কোথায়?

বিগলিত হাসে নিষ্প্রাণ।নরম গলায় বললো–

“গ্রামে।তোকে নিয়ে যাবো দাদুর কাছে।তোকে দেখলে দাদু খুব খুশি হবে।”

নীরস হাসে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ চুমুক দেয় কফিতে।ভ্রু নাচিয়ে সন্ধিৎসু গলায় বললো—-

“শ্রেয়া নাকি বিয়ে করেছে!ওর হ্যাজবেন্ড কেমন রে?

আয়েন্দ্রি তীর্যক গলায় বললো—

“তোর থেকে ভালো।”

বিদ্রুপপূর্ণ হাসলো নিষ্প্রাণ।বক্রোক্তি করে বললো—

“অবশ্যই ভালো।সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হ্যাজবেন্ডের সাথেও এক বছর সংসার করতে পারলো না।কথায় আছে না,দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তাহলে দাগই ভালো।”

চোখে হাসে আয়েন্দ্রি।টিভি চলছিলো তখন।ব্রেকিং নিউজের হেডলাইন শুনতেই থমকে যায় আয়েন্দ্রি।সমুৎকর্ণ হয়ে রইলো।তড়াক করে উঠে আয়েন্দ্রির মস্তিষ্ক সেই রিসোর্টের নাম শুনতেই।টিভির দিকে উদ্ভাসিত চোখে তাকাতেই জাফরের রক্তাক্ত লাশটা এক পলক দেখে গা গুলিয়ে উঠে আয়েন্দ্রির।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ভয়চকিত সজলনেত্রে নিষ্প্রাণের দিকে তাকায়।নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে সিটি বাজাতে থাকে।পায়ের উপর থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে তা পাশে রেখে পা নামায় মেঝেতে। দৃঢ় হয়ে বসে নিষ্প্রাণ।কম্পন শুরু হয় আয়েন্দ্রির শরীরে।ভয়ে গলা শুকিয়ে তার জিহ্বা লেগে আসে গালে।তবুও দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো—-

“তুতুতুতুই!

নিষ্প্রাণ সরল দৃষ্টিতে তাকায়।কেমন অদ্ভুতভাবে ঘাড় কাত কর ভয়ংকরভাবে হাসে।আত্মা শুকিয়ে আসে আয়েন্দ্রির।সন্ত্রস্ত গলায় বললো—

“তাহলে তুই ই ছিলি যে রোজ আমাকে কল করে শুধু বিরক্ত করতি?

নিষ্প্রাণ আলতো হাসে।উঠে কাছে আসে আয়েন্দ্রির।কোমল গলায় বললো—

“আমি না তো কে?কার এতবড় সাহস আমার ধ্রুবতারার দিকে হাত বাড়ায়?

আয়েন্দ্রি সশব্দে বলে উঠে—-

“এতোটা মানসিক যন্ত্রণা কেন দিলি তুই আমায়?

নিষ্প্রাণ পুনরায় সিটি বাজাতে থাকে।আয়েন্দ্রির নরম গালে হাত দিতেই ঝটকা মেরে তা সরিয়ে দেয় আয়েন্দ্রি।অস্থির গলায় বললো—

“কেন করলি তুই?

নিষ্প্রাণ মুক্ত শ্বাস ফেলে।নমনীয় গলায় বললো—

“দুই বছর!দুই বছর তোর থেকে দূরে থেকেছি আমি।কেন জানিস?শুধু তোকে পাওয়ার জন্য।এই যে আমার এই সাম্রাজ্য দেখছিস এইসব তোর জন্য।দাদু আমাকে বলেছে সে সব দিবে আমায় তার বদলে আমাকে চিকিৎসা করাতে হবে।আরে আমি কী পাগল!যে চিকিৎসা করাবো?আমি তো তোর প্রেমে পাগল।”

থামে নিষ্প্রাণ।বিবশ শরীরে দেয়ালে হাত দিয়ে ঢলে পড়ে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ আবারও শীষ বাজায়।কানে স্তব্ধতা লেগে আসে আয়েন্দ্রির।গত একবছর রোজ রাতে কেউ কল করে শুধু সিটি বাজাতো।কোনো মতেই তাকে ট্রেস করতে পারছিলো না আয়েন্দ্রি।বিধ্বস্ত,বিপর্যস্ত আয়েন্দ্রির অবস্থা দেখে তার বাবা আলফাজ সাহেব পুলিশের শরণাপন্ন হোন।তাদের সহযোগিতা করে সারক।যতবার আয়েন্দ্রি সিম বদলেছে ততবারই ওই অজ্ঞাত লোক নাম্বার কালেক্ট করে ফেলেছে।আজ আয়েন্দ্রি বুঝতে পারছে এইসব নিষ্প্রাণের কাজ।নিঃশ্বাস আটকে আসে আয়েন্দ্রির।নিষ্প্রাণ নির্লিপ্ত হাসে।গুমোট গলায় আয়েন্দ্রির পেইন্টিং এর দিকে তাকিয়ে বললো—

“তোকে ছেড়ে কী করে থাকি আমি বল।রোজ তোর গলার স্বর না শুনলে আমার ঘুম আসতো না।একবছর কোনো মতে কাটালেও আর সম্ভব হচ্ছিলো না আমার পক্ষে।তাই বাধ্য হয়েছি।কিন্তু আমি ভাবিনি মাঝখানে ওই সারক এসে যাবে।”

টিভিটা বন্ধ করে নিষ্প্রাণ।জাফরের খুনের দায়ে তার প্রতিপক্ষ শোয়াইব কে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।ফোন কল অনুসারে জাফর লাস্ট টাইম শোয়াইবের সাথে কথা বলেছে যে নিজেও সেই পার্টিতে উপস্থিত ছিলো।চেঁচিয়ে উঠে আয়েন্দ্রি—

“কেন খুন করলি তুই?কেন ওই লোকটাকে খুন করলি?

নিষ্প্রাণের সহজ উত্তর—

“আমার ধ্রুবতারার শরীর স্পর্শ করেছে যে হাত তাকে কী করে বাঁচতে দেই।”

“তাই বলে তুই খুন করবি?

“তো?তাতে কী?ওর মতো লোক বেঁচে থেকে কী করবে।তিন বছর বিয়ের কথা বলে একটা মেয়ের সাথে লিভ ইন করে ছেড়ে দিয়েছে ।এছাড়াও কোনো পার্টিতে নিজের চোখ আর মস্তিষ্ক কোনোটাই সামলাতে পারে না।”

আয়েন্দ্রি রাগাম্বিত গলায় বললো—

“তার মানে তুই সুস্থ নস।তুই মিথ্যে বলেছিস আমাকে।তুই এখনো মেন্টালি সিক।কাউকে ছোঁয়ার মানে এই নয় যে তার প্রাণ কেড়ে নিতে হবে।”

ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে নিষ্প্রাণ।সরোষে বললো—

“অন্যায় করিনি আমি।পুলিশরাও তো খুন করে।এদের মতো লোককেই করে।ডক্টরের হাতেও মানুষ খুন হয়।তো?

ক্রোধে ফেটে পড়ে আয়েন্দ্রি।খলবলিয়ে বললো—

“তুই এখনো অসুস্থ।তোর চিকিৎসার প্রয়োজন।”

আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“আমি সুস্থ।আমি সুস্থ বলেই ওই বাস্টার্ডের হাত আর চোখ ওর সাথেই আছে।যদি আমি আগের নিষ্প্রাণ হতাম তাহলে যে হাত দিয়ে ও তোকে স্পর্শ করেছে ওই হাত আর ওই চোখ ওর থেকে আলাদা করে ফেলতাম আমি।”

আয়েন্দ্রি ভরাট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার হৃদপিন্ড লাফিয়ে চলছে।শরীর জুড়ে অসহনীয় কম্পন।কী বলছে নিষ্প্রাণ!আয়েন্দ্রি খেমটি মেরে বললো—

“ইউ সিক!ভাবিস কী তুই নিজেকে?জানোয়ার!গত এক বছর আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি তোর জন্য।তুই আবারও খুন খারাবি শুরু করেছিস।ইউ সাইকো।তোর চিকিৎসার প্রয়োজন।নিজের চিকিৎসা করা তুই।”

নিষ্প্রাণ ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির গালে।ছিটকে পড়ে আয়েন্দ্রি মেঝের উপর।নিষ্প্রাণ রোষানলে তেড়ে গিয়ে আয়েন্দ্রির চুল মুঠ করে ধরে।নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে অন্য হাতে গাল চেপে ধরে বললো—

“সাইকো!তোর জন্য হয়েছি আমি।কেন এই নিষ্প্রাণকে প্রাণ বানিয়েছিস তুই?কে বলেছিলো তোকে?

আয়েন্দ্রির চোখে টলটল করছে অশ্রু।
,
,
,
শান্ত হয়ে বিছানায় বসে আছে আয়েন্দ্রি।কাতর গলায় বললো–

“প্লিজ প্রাণ,যেতে দে আমাকে।মুক্তি দে বন্দি দশা থেকে।”

নিষ্প্রাণ দুর্বোধ্য হাসল।সেই হাসিতে কেঁপে উঠলো আয়েন্দ্রির সারা অঙ্গ।ভয়াতুর চোখের আর্তনাদ বুঝেও বুঝলো না নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি আবারও আর্ত গলায় বললো—

“কেনো এমন করছিস আমার সাথে?প্লিজ আমাকে যেতে দে।তুই যা চেয়েছিস তাতো পেয়েছিস।”

নিষ্প্রাণ গুমোট হাসলো।শীতল গলায় বললো–

“আমার তো তোকে চাই।তোর ভালোবাসা চাই।আমৃত্যু তোর ভালোবাসার নহরে অবগাহনে মত্ত হতে চাই।”

আয়েন্দ্রি জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠে–

“না।আমি তোকে ভালোবাসি না।কখনো বাসবোও না।”

নিষ্প্রাণ ম্লাণ হাসে।অনুরক্তির গলায় বললো–

“কেন ভালোবাসবি না তুই আমাকে?বল।বল না?কেন পারবি না তুই আমাকে ভালোবাসতে?

আয়েন্দ্রি যেনো তেঁতে উঠলো।সুপ্ত সকল রাগ ফুঁসলে উঠলো।ঝাঁঝালো গলায় বললো—

“কারণ,তুই একটা জানোয়ার।মানুষরুপী একটা অসুস্থ জীব।”

বিদ্রুপাত্মক হাসে নিষ্প্রাণ।শ্লেষ নিয়ে বললো—

“জানোয়ার!আমি সত্যিই জানোয়ার।তোর জন্য জানোয়ার হয়েছি আমি।তোকে ভালোবেসে পশু হয়েছি।একদিন তুই এই নিষ্প্রাণকে প্রাণ বানিয়েছিস।তাহলে আজ কেন সেই প্রাণকে আবার নিষ্প্রাণ করতে চাইছিস বলতো?

আয়েন্দ্রির সারা মুখ জুড়ে স্বচ্ছ,শীতল,নোনতা জলের আঁকিবুকি।তার ক্রন্দনে হৃদযন্ত্র পিষ্টিত হচ্ছে নিষ্প্রাণের।ঝকঝকে,শুভ্র মেঝেতে বসে থাকা নিষ্প্রাণ আবেগী গলায় বললো—

“এই তুই আমাকে তুই কেন বলিস?স্বামীকে কেউ তুই বলে?তুমি বল।বল না?

মেয়েটি দাঁত,মুখ খিঁচে বললো–

“বলবো না।বলবো না।”

নিষ্প্রাণ গভীর মায়ায় তাকিয়ে থাকে তার সামনে বসা তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মনের অধিকারীণিকে।কোনো এককালে এই প্রাণেশ্বরী তার নিষ্প্রাণ জীবনে প্রাণের ফোয়ারা বইছে।তার থমকে যাওয়া হৃদস্পন্দন জাগ্রত করেছে।তাই তো এতো ভালোবাসে তাকে নিষ্প্রাণ।তার নিস্পন্দন জীবনের প্রাণপ্রদীপ সে।নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায়।বিছানায় গিয়ে আয়েন্দির পাশে বসে।নিষ্প্রাণের দুই তীক্ষ্ম চোখে ভয়চকিত দৃষ্টি আয়েন্দ্রির।কালো শাড়ির আচ্ছাদন ভেদ করে উথলে আসা তার মোমের মতো ধবধবে মেদহীন উদরে হাত রাখে নিষ্প্রাণ।ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেয় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ছোঁয়া বিলাতে থাকে আয়েন্দ্রির গালের থেকে চুঁইয়ে নিয়ে গলদেশ পর্যন্ত।থামে নিষ্প্রাণ।একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে নেয় ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে।আয়েন্দ্রির সমস্ত সৌরভ যেনো এক নিমিষে গিলে নিলো নিষ্প্রাণ।গলার একপাশে গভীর চুম্বন করে ছোট্ট কামড় বসিয়ে দেয় সেখানে।আয়েন্দ্রির বুকের উঠানামায় বুঝতে পারছে তার ভেতরে মুর্ছনা নিষ্প্রাণ।রাগে,ক্ষোভ,অভিমানে আয়েন্দ্রি ফিরে তাকালো না তার স্বামী নামের সুদর্শন পুরুষের খোলসে আবৃত হিংস্র হায়েনার দিকে।নিষ্প্রাণ তার আঙুলের বেপরোয়া স্পর্শে অস্থির করে তুললো তার শান্ত দেহপিঞ্জর।উত্তাপিত দেহেও নিষ্প্রাণের প্রতি কোনো অভীপ্সা অনুভব করলো না আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণ তার এই নিগ্রহ একদমই নিতে পারলো না।আলগোছে আয়েন্দ্রির গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে অতি মাত্রায় স্বাভাবিক গলায় বললো—

“এমন করছিস কেন তুই?একটু ভালোবাস না আমায়।তোর পায়ের নিচে স্বর্গ এনে দিবো আমি।ভালো বাসনা আমায়।”

আয়েন্দ্রির চাপা রাগে তার ব্যাকবোনের সন্ধিস্থল অনবরত হাঁপরের মতো উঠানামা করতে লাগলো।মুখে টু শব্দও করলো না।চোখের চাহনিতে ছুঁড়ে দিলো ঘৃণার তীক্ষ্ম বাণ।নিষ্প্রাণ আর নিতে পারলো না।প্রকুপিত গলায় বললো—

“তোকে আমায় ভালোবাসতেই হবে রে।ভালোবাসতেই হবে।”

আয়েন্দ্রির পাতলা ওষ্ঠাধর লুফে নেয় নিজের অধরে নিষ্প্রাণ।গভীর আশ্লেষে শুষে নিতে থাকে তার অধরসুধা।আয়েন্দ্রি বাঁধা দিতে গিয়েও যেনো ক্ষান্ত,পরিশ্রান্ত।তাকে বিছানায় শুইয়ে নিজের সমস্ত ভর ঢেলে দেয় তার উপর নিষ্প্রাণ।এক হ্যাঁচকা টানে শাড়ির কুঁচি খুলে নেয়।আয়েন্দ্রিকে অনাবৃত করতে কয়েক সেকেন্ডই সময়ে নেয় নিষ্প্রাণ।ভুলে যায় পার্থিব জীবনেন টান।প্রাণেশ্বরীর প্রাণসুধাতেই নিজেকে হারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ।
আদৌ কী সে তার প্রাণস্পন্দন খুঁজে পাবে?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here