প্রাণস্পন্দন পর্ব ৯+১০

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৯
লেখনীতে তাজরিয়ান খান তানভি

ক্লাস জুড়ে চলছে শিক্ষার্থীদের হৈ চৈ।গতকাল সন্ধ্যায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে।সেই নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে।স্টেরিওকেমেস্ট্রির শিক্ষক কমলক্রান্তির আগমনেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ক্লাস।শিক্ষার্থীরা যার যার জায়গায় বসে পড়লো।কমলক্রান্তি সাহেব ডেক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।শিক্ষার্থীদের মাঝে বহমান চাপা উত্তেজনা বুঝতে পেয়ে চমৎকার হাসলেন।হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললেন—

“কংগ্রেজুলেশন এভরিওয়ান।এইবারের রেজাল্ট আমাদের ডিপার্টমেন্টের রেকড গড়েছে।”

ক্লাস জুড়ে আবারও কিচিরমিচির শুরু হলো।কমলক্রান্তি সবাইকে শান্ত হতে বললেন।অতি গর্বের সাথে বললেন—

“এইবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের হাইজেস্ট পয়েন্ট থ্রি পয়েন্ট নাইন এইট।আর তা অর্জন করেছে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত আর ভদ্র ছেলে নিষ্প্রাণ মুনতাসির।”

ক্লাসে সবাই একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে।অনেকের কাছেই নামটা নতুন।কমলক্রান্তি নিষ্প্রাণকে উঠে দাঁড়ানো আদেশ করলেন।ক্লাসভর্তি উৎসুক চোখ নিবদ্ধ হলো মাঝের সারির একদম পেছনের বেঞ্চে।তিন সারিতে বিভক্ত ক্লাসের কর্ণারের সারিতে প্রথম বেঞ্চে বসা আয়েন্দ্রি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো ফর্সা,গোলগাল মুখের একটা ছেলেকে।মাথায় ঝাঁকড়া চুল,চোখে মৃদু পাওয়ারের চশমা।হলুদ,কালো মিশেলের চেক শার্টের হাতা গুটানো কনুই পর্যন্ত।হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্র গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আজকের আগে ছেলেটাকে দেখাই হয়নি।কমলক্রান্তি সবার সাথে নিষ্প্রাণকে পরিচয় করিয়ে দিলো।নিষ্প্রাণ প্রথম বর্ষ থেকে নয়,দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝিতে এসেছে এই ভার্সিটিতে।

নিষ্প্রাণের ধরা বাঁধা জায়গা সেই পেছনের বেঞ্চ।চুপচাপ সেখানেই বসে থাকে।টিচারদের প্রতিটা লেকচার শোনে গভীর অভিনিবেশে।তার পাশেই আছে বন্ধু সীমান্ত।খালি মাঠে ছক্কা হাঁকাবে নিষ্প্রাণ তা বুঝতে পারেনি সীমান্ত।নিষ্প্রাণ বসতেই তাকে খোঁচা মারতে লাগলো বিভিন্ন উদ্ভট কথা বলে।নিষ্প্রাণ লাজুক হাসে।তার সেই হাসিতে আটকে যায় আয়েন্দ্রির চোখ।
,
,
,
ব্রেক টাইমে ভার্সিটির মাঝে অবস্থিত শহীদ মিনারের প্রাঙ্গনে বসে আছে সীমান্ত।বিশ মিনিটের ব্রেকে দাপিয়ে উঠে সে।হাসি-ঠাট্টা সবকিছুতে যেনো একটু বেশিই এগিয়ে সীমান্ত।খোশমেজাজে বললো—

‘দুর শালা!সেকেন্ড ইয়ার পাস কইরা ফালাইলাম আর এখনো একটা মাইয়া জুগাইতে পারলাম না।জীবনটা পুরাই কচুপাতা।”

হো হো করে হেসে উঠে প্রাবিশ।মৃদু গলায় বললো–

“কেন মামা?ধরে রাখছে কে তোমারে?যাইয়া ঝুইলা পরো কারো গলায়।”

সীমান্ত আপত্তি করে বললো—

“আরে সবার গলায় কী ঝুইলা যাওয়া যাইবো নাকি?দেইখা,শুইনা ঝুলতে হইবো।”

প্রাবিশ অট্টহাসি দিয়ে বললো–

“হ মামা।যেই বডি বানাইছো!মাশাআল্লাহ্।ক্লাসের মুক্তা যদি তোমার বউ হয় তাইলে তো বিয়ের রাতেই হসপিটালে দৌঁড়াইতে হইবো।”

“চুপ!যতসব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা।”

হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে প্রাবিশ শহিদ মিনারের সিঁড়িতে।তখনই একটি মিহি কন্ঠ শুনতে পায় প্রাবিশ।

“প্রাবিশ!

প্রাবিশ চোখে তুলে তাকাতেই দেখে আয়েন্দ্রি দাঁড়িয়ে আছে।মাথাভর্তি ঘন চুলে পনি টেইল করা।গাঢ় খয়েরি রঙের সেলোয়ার কামিজ।চোখে,মুখে অকৃত্রিম লাবন্যতার ছোঁয়া।প্রাবিশ মিষ্টি হেসে বললো–

“কী হয়েছে?কিছু বলবি?

প্রাবিশ আয়েন্দ্রির খুব ভালো বন্ধু।এক ডিপার্টমেন্ট আর পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় সম্পর্কটাও বেশ পোক্ত।আয়েন্দ্রি মুচকি হাসলো।মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিলো।প্রাবিশ বসে থাকা বাকি ফ্রেন্ডদের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।একরকম অগ্রাহ্য করেই চলে যায় আয়েন্দ্রির কাছে।বিরক্তি ঝুলে সীমান্তের চোখে,মুখে।

আয়েন্দ্রির কাছে দাঁড়িয়ে ফিকে কন্ঠে প্রশ্ন করে প্রাবিশ—

“কিছু বলবি?

আয়েন্দ্রির নরম চোখ জোড়া তাদের বন্ধু মহলে একবার ঘুরিয়ে এনে মিইয়ে গলায় বললো—

“নিষ্প্রাণ কোথায়?

প্রাবিশ পেছন ফিরে সীমান্তের দিকে তাকায়।সীমান্ত কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।প্রাবিশ চোখ ফিরিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো—

“আযান হয়েছে তো।নিষ্প্রাণ নামায পড়তে গেছে।”

“ও।আচ্ছা।ক্লাসে যাবি না?ক্লাস শুরু হবে তো।”

“হুম।চল।”

প্রাবিশ সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বাকিদেরও আসার নিমন্ত্রণ দিলো।সীমান্ত কিড়মিড়িয়ে উঠে।মেয়ে মানুষের ন্যাওটা!
,
,
,
ক্লাশ শেষে নিষ্প্রাণকে খুঁজতে থাকে আয়েন্দ্রি।কিন্তু কোথাও নেই।ছেলেটা হুট করেই কোথায় যে যায়!

তিনতলার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আয়েন্দ্রি খেয়াল করে প্রাবিশ,সীমান্ত,নিষ্প্রাণ সবাই মাঠে ক্রিকেট খেলছে।খেলায় তেমন আগ্রহ নেই আয়েন্দ্রির।কিন্তু আজ ইচ্ছে হলো।
নিচ তলার করিডোরে পৌঁছাতেই এক হ্যাঁচকা টান তৃণার।হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বললো–

“কোথায় যাচ্ছিস?ডাকছি শুনতে পারছিস না?

হতবুদ্ধি হয়ে যায় আয়েন্দ্রি।তার দৃঢ়চিত্ত ওই মাঠে।তাই অন্য কিছু তার কর্ণগোচর হচ্ছে না।তৃণা আয়েন্দ্রির বেস্ট ফ্রেন্ড কুসুমের কাজিন।তৃণা ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট।কোনোরকম টেনেটুনে আয়েন্দ্রিকে নিজের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যায় তৃণা।তাদের ডিপার্টমেন্টে একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করা হচ্ছে।আর তাতে গান গাওয়ার জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে আয়েন্দ্রিকে।আয়েন্দ্রি কোনোভাবেই রাজী হচ্ছিলো না।তাই তৃণা সেইসবে স্যারদেরকেও ইনভলব করে।বাধ্য হয়েই রাজী হতে হয় আয়েন্দ্রিকে।

গুটগুট পায়ে মাঠে এসে দেখে ঘাসের উপর শুয়ে আছে ক্লান্ত,শ্রান্ত প্রাবিশ আর সীমান্ত।সাথে তাদের অন্য ফ্রেন্ডরাও।নিষ্প্রাণকে কোথাও দেখলো না আয়েন্দ্রি।আয়েন্দ্রিকে দেখে উঠে বসে প্রাবিশ।পাশে থাকা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সীমান্ত থেকে বিদায় নেয়।ঘামে ভিজে থাকা টিশার্ট হালকা বাতাস আসতেই আলগা হয় শরীর থেকে।

ভার্সিটির গেইট থেকে বের হতেই আয়েন্দ্রিয় রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে—

“নিষ্প্রাণ কোথায়?

প্রাবিশ একগাল হেসে বললো—

“যুবতীর মন আজ করে আনচান
দেখবার চায় তোমার ওই চাঁদ মুখখান।”

ধুম করেই এক কিল বসিয়ে দেয় প্রাবিশের পিঠে আয়েন্দ্রি।হো হো করে হেসে উঠে প্রাবিশ।মৃদু গলায় বললো—

“আছে।মসজিদে।”

ভার্সিটির সাথেই লাগোয়া এলাকার মসজিদ।মসজিদ দুই ভাগে বিভক্ত মসজিদের একপাশে এতিমখানা।এতিমখানার ভবন থেকে ভার্সিটি সম্পূর্ণ অবলোকন করা যায়।মসজিদের সদর দরজা বড় রাস্তার দিকে।কিন্তু এর ছোট একটা দরজা আজে পাশের রাস্তার দিকে যেখান থেকে সহজেই ভার্সিটি,কলেজ আর স্কুলের শিক্ষার্থীরা মসজিদে যেতে পারবে।এই ছোট্ট দরজাটার বামপাশে একটা মিষ্টির দোকান আর ডানপাশে লাইব্রেরি।আর উপরে ফটোকপির দোকান।প্রাবিশ আর আয়েন্দ্রি মিষ্টির দোকানের সামনে আসতেই বেরিয়ে আসে নিষ্প্রাণ।আসরের নামায শেষ করে বেরিয়েছে সে।নিষ্প্রাণকে দেখে থমকে যায় আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রাণের সরল দৃষ্টি প্রাবিশের দিকে।স্মিত হেসে মোলায়েম গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“চলে যাচ্ছিস?

“হুম।”

চট করেই বলে ফেলে আয়েন্দ্রি—

“হাই!

মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাতেই নিষ্প্রাণের চোখ দুটো আবদ্ধ হয় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।আয়েন্দ্রির নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর একটা লাল তিল।

কেঁপে উঠে নিষ্প্রাণের ভেতর মানব।অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে শুরু করে নিষ্প্রাণ।অস্থির হয়ে উঠে সে।শ্বাস আটকে আসে।চোখ জ্বলতে শুরু করে।বড় বড় শ্বাস টানতে থাকে নিষ্প্রাণ।নিষ্প্রাণের এমন অদ্ভুত আচরণে ঘাবড়ে যায় প্রাবিশ।ভীত চোখে চেয়ে রয় আয়েন্দ্রি।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মুখে অনবরত শীতল জলের ঝাঁপটা দিচ্ছে নিষ্প্রাণ।তার চোখের দৃষ্টিকোণ থেকে মুছে যাক আয়েন্দ্রির ওই ঠোঁট,ওই তিল।পানির ঝাঁপটা দিতে দিতে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে নিষ্প্রাণের অক্ষিযুগল।মেসের কমন বাথরুমে এতোসময় থাকা যায় না।সমানতালে করাঘাত চলছে দরজার কপাটে।লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে বালতির উপর থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।বাথরুম থেকে বের হতেই দেখে মেসের একগাদা ছেলে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নিষ্প্রাণ সোজা নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে ধপাস করে বিছানায় বসে।

প্রখর যন্ত্রণায় কাতর মস্তিষ্ক নিয়ে নিষ্প্রাণ বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।দুমড়ে মুছড়ে যাওয়া খিদের পেট এখন শান্ত।নিষ্প্রাণের চোখে ভেসে উঠে আয়েন্দ্রির সেই ঠোঁট।অস্থিরতা জেকে ধরে নিষ্প্রাণকে।হট করেই চক্ষু মুদন করে নিষ্প্রাণ।সেই নিমীলিত চোখেই নিষ্প্রাণকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই লাল তিল।সেই হাসি।সেই কম্পিত ঠোঁট।

নিষ্প্রাণকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে পাশের এক ফুচকার দোকানের বেঞ্চিতে বসায় তাকে প্রাবিশ।আয়েন্দ্রি সন্ত্রস্ত চোখে নিষ্প্রাণকে দেখে।সুস্থ ছেলেটা আচমকা অসুস্থ হয়ে গেলো কেন?আয়েন্দ্রি আলতো হাত রাখে নিষ্প্রাণের কাঁধে।আয়েন্দ্রির ঠোঁটের দিকেই ঘোলা চোখে তাকাতেই লাফিয়ে উঠে নিষ্প্রাণ।দ্রুত পালিয়ে আসে সেখান থেকে।প্রাবিশ আর আয়েন্দ্রির বোধগম্য হলো না ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

দরজার খটখটানিতে ঘুম ভাঙে নিষ্প্রাণের।ভার্সিটিতে থেকে ফিরে কিছুই খাওয়া হয়নি তার।তন্দ্রচ্ছন্নতা কাটতেই পেটের ভেতর মুছড়ে উঠে খিদে।উঠে বসে নিষ্প্রাণ।অচঞ্চল পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলতে ঝাড়া মেরে উঠে সীমান্ত—

“হালার পো,কহন তে কল করতাছি ধরোস না ক্যান?মরছোস?

নিষ্প্রাণ ম্লান হাসলো।ঘুমো ঘুমো চোখ দুটো টানটান করে বললো–

“ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“হ।আমি তো ভাবছি তুমি উগান্ডায় গেছো।চল।”

নিষ্প্রাণ বিরসমুখে বললো—

“কোথায়?

ভ্রু দুটো কুঁচকে নেয় সীমান্ত।ফরফর করে বললো–

“দুর শালা!কিছু মনে থাকে না তোর?গাঞ্জা খাস?না বাবা টানোস?কইলাম না বটতলায় যামু।কাম আছে।”

নিষ্প্রাণ বাম হাতের তর্জনী দিয়ে কপাল চুলকে বললো—

“এখন না।খিদে পেয়েছে আমার।পরে আসছি।”

হাত টেনে ধরে সীমান্ত।চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে বললো—

“থাবড়া খাইছোস?চল,আমি খাওয়ামু।তাড়াতাড়ি কর।হারামি কল করতে করতে আমার মোবাইলের চার্জ খতম অয় শান্তিতে ঘুমাই।”

নিষ্প্রাণ গম্ভীর মুখে বললো—

“আচ্ছা।তুই দাঁড়া আমি চেঞ্জ করে আসছি।”

“যা।আবার ঘুমাইয়া পড়িস না।ঘুম আর পড়া ছাড়া তো জীবনে আর কিছু করলি না।হালার ঘরে হালা!খাড়াইয়া আছোস ক্যান?যা।”

কোমল হাসে নিষ্প্রাণ।
,
,
,
বটতলা।এই এলাকার নামকরা জায়গা।যদিও বটগাছের অস্তিত্ব নেই এখন।কেটে ফেলা হয়েছে তা। বহুবছরের বটগাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠে একটা তিনতলা দালানবিশিষ্ট মার্কেট।কালের পরিবর্তনে তা ভগ্নপ্রায়।কিন্তু জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।নড়বড়ে এই মার্কেট ভেঙে ফেলার ধমকি দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশন।মার্কেট এড়িয়া জুড়ে রয়েছে নির্দিষ্ট সীমানার গেইট।বারো ফিট উঁচু লোহার গ্রীলের বেড় দেওয়া মার্কেটের দুইপাশে।সেই গ্রীল ঘেঁষে সন্ধ্যা নামলেই বসে ছোট ছোট হকারদের বেচাকেনা।নিম্নবিত্ত মানুষদের হৈ হৈ চলে এখানে।এখানেই একটা ছোট কাঠের তৈরি ভ্রাম্যমান গাড়ি করে মুরগির মাংসের পুর দেওয়া পুরি,কাবাব,ভাজা চিংড়ি মাছ বিক্রি করে রাতুল।তিন বন্ধু প্রায়ই আসে এখানে।পেট পুরে এই ভাজা পোড়া খেয়ে ছোট্ট মৃদুলের কাছ থেকে পান করে গরম গরম ঘন দুধের চা।

বেঞ্চের উপর পাশাপাশি বসে আছে তিন বন্ধু।সেখানেই একটা ছোট্ট কাঁঠাল গাছ।চিংড়ি ভাজায় কামড় বসিয়ে ভজভজ করে বললো সীমান্ত–

“বুঝি না তোর সমস্যা কী?ওই প্রবেশপত্র কইলো তুই নাকি এই আন্দিরে দেইখা নাকি অসুস্থ হইয়া গেছোস?ক্যান মামা,ক্রাশ ট্রাশ খাইছোস নাকি?

প্রাবিশ রাগ দেখিয়ে বললো—

“মাইন্ড ইউর ভাষা শালা!

সীমান্ত হা হা করে হেসে বললো—

“হয়।আজ আমার বোন নাই দেইখা বাঁইচা গেলি তুই।আগে ক এই নিষ্প্রাইন্না ওই আন্দিরে দেইখা হার্ট অ্যাটার্ক করছে কেন?

নিষ্প্রাণ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো—

“এমন কিছু নয়।সকালে কিছু খাইনি তাই হয়তো মাথা ধরেছিলো।”

“আমি তো ভাবলাল আন্দি তোর অন্য কিছু ধরছে।”

নিষ্প্রাণ আর প্রাবিশ বিভ্রান্ত চোখে তাকায়।

সীমান্ত একগাল হেসে বললো—

“বুঝি,বুঝি মামা।আন্দিরে দেইখা আর সহ্য হয় নাই তোমার।”

নিষ্প্রাণ গম্ভীর হয়ে যায়।প্রাবিশ চায়ের কাপে চুমুক দিতেই তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—

“মেয়েটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের?

আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সীমান্ত।মুখে দেওয়া পুরি ছিটকে পড়লো বাইরে।তার এই অবস্থায় হতভম্ব হয়ে যায় নিষ্প্রাণ আর প্রাবিশ।ছোট্ট মৃদুল খলখল করে হাসে।সীমান্ত পাহাড় সমান বিস্ময় নিয়ে বললো—

“আন্দিরে তুই দেখোস নাই এর আগে?

নিষ্প্রাণ চাপা স্বরে বললো–

“দেখেছি হয়তো।ঠিক মনে পড়ছে না।”

“কী কছ মামা?তুই ঠিক আছোস তো?

প্রাবিশ জোর দিয়ে বললো—

“তুই চুপ কর।
তোকে সেদিন বললাম না আয়েন্দ্রির কথা।আমার পাশের বাসায় থাকে।ও ই তো আয়েন্দ্রি।”

নরম গলায় বললো নিষ্প্রাণ–

“ও,আচ্ছা।”

সীমান্ত একটা চাপড় মারে নিষ্প্রাণের কাঁধে।তারপর অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে।নিষ্প্রাণে প্যান্টের মাঝখানে হাত দিতেই ক্ষেপে উঠে নিষ্প্রাণ—

“আরে হাত সরা।কী শুরু করলি তুই?

সীমান্ত দম্ভের সাথে বললো—

“দেখতাছি তুই পোলা তো।ভেতরে আবার সমস্যা টমস্যা নাই তো।
ভাইরে ভাই কেমনে পারোস তুই?হারাদিন বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁইজা থাকোস।চোখে মধ্যে খালি অনু-পরমানু আর বিক্রিয়া দেখোস।আর বিস্ফোরণ হয় এই জায়গায়।”

নিজের বুকে হাত দিয়ে ঘঁষতে থাকে সীমান্ত।আফসোসের সুরে বললো—

“কবে যে বিয়া করমু আর কবে বাপ হমু!

প্রাবিশ নির্মল হাসে।সীমান্ত চিল মুডের ছেলে।হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখে বন্ধুদের।কিন্তু স্বভাব একদম ব্যতিক্রম।মুখের ব্যালেন্স না থাকলেও হাত,পায়ের ব্যালেন্স অনেক।
,
,
,
নিজের গলিতে ঢুকে নিষ্প্রাণ।মূল রাস্তা থেকে একটা সরু গলির ভেতরে ঢুকেছে নিষ্প্রাণ।একাই একটা রুমে থাকে সে।তাই বাড়তি চিন্তা নেই।আজ আর খাবেও না।সোজা গিয়ে ঘুম।সকালে উঠে পড়া কমপ্লিট করবে।আপাতত আয়েন্দ্রির সেই লাল তিল ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে নিষ্প্রাণকে।ভুলে যাওয়া স্মৃতি তরতর করে ভেসে উঠছে চোখের সামনে।নিষ্প্রাণের থিতিয়ে থাকা সেই ভয়ংকর অতীত সামনে আসতে পারে না।এখন সে শুধু নিষ্প্রাণ মুনতাসির।একজন স্টুডেন্ট।

সোডিয়াম বাতির আলোয় রাস্তার দুই পাশ উজ্জল।রাস্তায় জ্বলজ্বলে চাঁদের আলোও।পাশের একটা বিল্ডিং এর সামনে আসতেই থমকে যায় নিষ্প্রাণ।বেলি ফুলের তীব্র ঘ্রাণ।একটা লম্বা শ্বাস টেনে আবার হাঁটতে শুরু করে নিষ্প্রাণ।নিস্তব্ধ সড়ক পথে আলোই নিষ্প্রাণের সঙ্গী।কলেজ আর চাকরিজীবি ছেলেদের জন্য উপযুক্ত এলাকা।নিষ্প্রাণ যেই মেসে থাকে তা বিশাল।দুই তলা বিল্ডিংটিতে প্রায় দুইশত ঘর।তিন শতাধিক মানুষ।

নিষ্প্রাণের পাশ দিয়ে চলছে তার ছায়া।ঠোঁট দুটো গোল করে সেই পরিচিত সুর।সিটি বাজাতে থাকে নিষ্প্রাণ।সেই সিটির আওয়াজে কিছুক্ষণের মধ্যে তার সাথী হয় একটা কালো কুকুর।লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিষ্প্রাণের পাশাপাশি চলছে।নিষ্প্রাণ এখনো সিটি বাজিয়ে যাচ্ছে।নৈঃশব্দে ভয়ানক সুর তুলে সেই সিটি যেনো রাতের আঁধার ফুঁড়ে দিবো সেই আওয়াজ।নিষ্প্রাণ পকেট থেকে একটা বনরুটি বের করে থেমে যায়।হাঁটু ভাঁজ করে বসে।কুকুরটা নিষ্প্রাণের সামনে এসে সশব্দে ডেকে উঠে।নিষ্প্রাণ মলিন হাসে।রুটিটি কুকুরের সামনে ধরতেই খুশিতে আপ্লুত কুকুর টেনে হিঁচড়ে তা খাওয়া শুরু করে।যতক্ষণ কুকুরটি খাচ্ছিলো নিষ্প্রাণ পরম মমতায় তা দেখছিলো।খাওয়া শেষে নিষ্প্রাণের গা ঘঁষতে থাকে কুকুরটি।প্রফুল্লচিত্তে কুকুরটি গায়ে হাত বুলায় নিষ্প্রাণ।মৃদু গলায় বললো—

“মানুষের চেয়ে পশু উত্তম।তোদের জবান নেই তবুও ওই চোখ সব বলে।আর মানুষ!জবান থাকতে বোবা তারা।”

ঘেউ ঘেউ করে উঠে কুকুরটি।কেমন কাতর শোনায় সেই ডাক।চকিতে নিষ্প্রাণের মনে পড়ে আয়েন্দ্রির সেই ঠোঁট।সেই লাল তিল,সেই হাসি,সেই স্ফুরণ।ঝট করেই উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।দম বন্ধ হয়ে আসে তার।ঘামতে শুরু করে নিষ্প্রাণ।যেনো এখনই সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।নিষ্প্রাণের মনে পড়ে সেই আগুন।জ্বলন্ত আগুন।ভয়ংকর চিৎকার।মৃত্যু আর্তনাদ।বাঁচার আহাজারি।বীভৎস সেই রাত।

চলবে,,,

(বিঃদ্রঃ
আমার পাঠকরা অতি দ্রুত আগ্রহ হারায় আর নাহলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।)
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here