#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৭|
অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। নোটিশ বোর্ডে সফেদ রঙের কাগজে লেখা রুটিন দেখে মাহতিমের ভ্রূ কুচকে গেছে। সে ব্যাগ কাধে তুলে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল। পেছন পেছন ওয়াহিদ হেঁটে এল। মাহতিম ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেল। অলস হাতে ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে দু কাপ কফি অর্ডার দিল। মাথা ধরেছে ভীষন। রুটিন দিয়েছে পরীক্ষার। অথচ সে সেরকম কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। মাহতিম তো আর প্রিয়ন্তি নয় যে সারাক্ষণ বই খাতা নিয়ে পরে থাকবে। বই খাতা তার অবসরের সঙ্গী। পরীক্ষার দুদিন আগে তুমুল পড়াশোনা করে যেন-তেন প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে সর্বদা। প্রিয়ন্তি আর মাহতিম একই বর্ষে পড়াশোনা করলেও প্রিয়ন্তির সিজিপিএ দুর্দান্ত। চাকরির পথ সবদিকে খোলা থাকবে প্রিয়ন্তির জন্যে। মাহতিম চায়, সে প্রিয়ন্তির সঙ্গে একই অফিসে চাকরি করবে। একসঙ্গে যাবে, আসবে। একসঙ্গে কাজের ফাঁকে দারুন কিছু সময় কাটাবে। কিন্তু তারজন্যে তো পড়তে হবে। প্রিয়ন্তির ন্যায় সিজিপিএ আনতে হবে। মাহতিম মনেমনে ভেবে ফেলল, সে এই পরীক্ষা ভালো করে দেবে। তুমুল পড়াশোনা করে ক্র্যাক করবে।
কফি এসে রেখে গেছে ক্যান্টিন বয়। ধোঁয়া উড়ছে কাপ থেকে। ঘোলাটে ধোঁয়া কাপ থেকে উড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মাহতিম কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক বসাল। ওয়াহিদ ভীষন অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ মামা, পরীক্ষা আসতাছে। কিছু পারস? এইবার নিশ্চিত ফেইল করমু। ‘
মাহতিম চিন্তিত গলায় বলল,
‘ এইবার পরীক্ষা সিজিপিএ ভালো আনতে হবে। নাহলে আমার কপাল ফাটবে। ‘
ওয়াহিদ মাহতিমের কথা শুনে বিস্মিত হল। কফির কাপ ঠোঁটের ডগা থেকে সরিয়ে বলল,
‘ মামার দেখছি সিজিপিএ নিয়ে অনেক চিন্তা। আগে এসব চিন্তা কই ছিল? হঠাৎ করে এত পরিবর্তন? কাহিনী কি? ‘
মাহতিম মৃদু হাসল। কপালে পরে থাকা অগোছালো চুল বিবশ ভঙ্গিতে পেছনে ঠেলে চোখ টিপে বলল,
‘ প্রিয়ন্তিকার সঙ্গে একই অফিসে চাকরি করব, তাই। ‘
ওয়াহিদ কিয়ৎক্ষণ মাহতিমের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ তোর মাথায় কি ওই মেয়ে ছাড়া আর কিছু ঘুরে না? শালা, তুই মরবি একদিন ওই মেয়ের চক্করে। পাঁচ পয়সার দাম দেয় না তোরে। আর ওর পিছু পিছু ঘুরে কি পাস? ‘
মাহতিম মৃদু হাসল, তথা উত্তর দিল না। নিশ্চিন্তে কফি শেষ করল। কিছুক্ষণ খালি কফির কাপে চামচ নাড়িয়ে ঝনঝন শব্দ তুলে ওয়াহিদের কানকে বিরক্ত করল। ওয়াহিদ বলল,
‘ অযথা শব্দ করছিস কেন? কি চিন্তা করস? ‘
মাহতিম চামচ নাড়ানো বন্ধ করে টেবিলে শক্ত করে হাত রাখল। ওয়াহিদ অনুভব করেছে, টেবিলে কেপে উঠছে। ওয়াহিদ টেবিল চেপে ধরে মাহতিমের দিকে চাইল। মাহতিম ভীষন রেগে গিয়ে বলল,
‘ ওই শালা লিমনের বাচ্চা শুধরে নাই। আমার প্রিয়ন্তিকাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। ওর হাত আমি ভেঙে ফেলব। পরীক্ষা একবার শেষ হোক। তারপর দেখছি একে। ‘
ওয়াহিদ মাহতিমের রাগ দেখে দমে গেল। প্রিয়ন্তিকে ছোঁয়ায় চেষ্টা? এবার মাহতিমের হাত থেকে লিমনকে আল্লাহ ছাড়া কেউ বাঁচাতে পারবে না। মেরে ফেলবে ও লিমনকে। প্রিয়ন্তিকে সামান্য টিজ করলে ওর সহ্য হয়না। সেখানে এতবড় কান্ড করে অবশ্যই লিমন বেচে যেতে পারবে না। মাহতিম এবার আর দল, দলের লোক, শক্তির দাপট এসব আর কিছুই মানবে না মাহতিম। খুন করে ফেলবে। ওয়াহিদ প্রশ্ন করল,
‘ তোকে এসব কে বলেছে? প্রিয়ন্তি? ‘
মাহতিম মাথার ঘন চুল খামচে ধরে মাথা নত করে বলল,
‘ হ্যাহ! প্রিয়ন্তি বলবে? ওর মুখ থেকে কিছু বের করা যায়? সারাক্ষণ মুখ ফুলিয়ে পরিকল্পনা করে কিভাবে আমাকে হ্যানস্থা করে যায়। ও বলে নি। ওর বন্ধু নিপা বলেছে। ‘
ওয়াহিদ কিছু একটা ভেবে হঠাৎ হেসে উঠল। জরুরি আলোচনায় হঠাৎ করে ওয়াহিদের হেসে উঠায় মাহতিম চরম বিরক্ত হল। মাথা তুলে রাগান্বিত চোখে চাইল ওয়াহিদের দিকে। ওয়াহিদ দমে গেল। হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ক্ষুদ্র চেষ্টা করে বলল,
‘ মামা,আমার মনে হয় তোর প্রিয়ন্তিকে নয় প্রিয়ন্তির যেকোনো এক বন্ধুকে ভালোবাসা উচিত ছিল। এটলিস্ট তারা তোকে মূল্যায়ন করে। তোর ভালোবাসা বুঝে। ‘
ওয়াহিদের কথা শুনে মাহতিম চোখ উল্টে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। বলে,
‘ মজা করিস না। ভালো লাগছে না এসব। শুধু মাথায় রাখ, ওই লিমনরে আমি খাইছি। পরীক্ষা শেষ হোক একবার। ‘
_________________________________
প্রিয়ন্তি মেসেজ পরল। মাহতিম পাঠিয়েছে। পরীক্ষার রুটিনের ছবি তারসঙ্গে নিচে একটা ছোট বার্তা।
‘ পরীক্ষা এসেছে বলে আমাকে ভুলে যেও না আবার। এবারের পরীক্ষার সিট তোমার আর আমার একইসঙ্গে পরবে। পরীক্ষায় দেখাবে। ঠিকাছে? গুড লাক। ‘
পরীক্ষায় দেখাবে? মগের মুল্লুক পেয়েছে? প্রিয়ন্তি খাতা প্রশ্ন দিয়ে ঢেকে লিখবে, চুল ছড়িয়ে দেবে খাতার উপর, ঝুঁকে লিখবে যেন মাহতিম পেছনে থেকে কিছুই দেখতে না পারে। ফেইল করুক সে। তাতেও যদি পেছন ছাড়ে। প্রিয়ন্তি মেসেজ ডিলেট করে দিল। মাহতিমের নাম পাল্টে, ‘প্যারা’ লিখে সেইভ করল। ফোন বিছানার উপর ফেলে আবার পড়ায় মন দিল। পড়ার সময় প্রিয়ন্তি কখনো ফোন কাছে রাখে না। তাহলে পড়ায় বিঘ্ন ঘটে। ফোন ব্যবহার করতে ইচ্ছে করে। প্রিয়ন্তির মা এক গ্লাস দুধ রেখে গেছেন টেবিলে। প্রিয়ন্তি গ্লাসের দুধ খেয়ে আবার পড়ায় মন দিল।
________________
সকালের রোদ গায়ে মেখে প্রিয়ন্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। আজকে থেকে নিপা নিয়ে আসে প্রিয়ন্তিকে। সেদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে নিপা প্রিয়ন্তিকে একা আসতে দেয়না। দুজন একসঙ্গে আসে, যায়। প্রিয়ন্তিও আগের ঘটনা প্রায় ভুলে বসেছে। প্রিয়ন্তি নিপার সঙ্গে গল্প করে করে পরীক্ষার হলে এসে দেখে মাহতিম প্রিয়ন্তির পেছনের সিটে বসে আছে। প্রিয়ন্তির বড্ড রাগ হল। এতদিনের পিছু ঘুরে বেড়ানো কি কম ছিল? এখন আবার পরীক্ষায় একসঙ্গে বসতে হল! প্রিয়ন্তি নিপাকে তার হলে রেখে এসে নিজের সিটে এসে বসল। মাহতিমের দিকে একবারও তাকালো না অব্দি। মাহতিমও কথা বলল না। চুপচাপ খাতা ঠিক করছে। প্রিয়ন্তি অবাক হল। আজ মাহতিম প্রিয়ন্তিকে বিরক্ত কেন করছে না? এত ভদ্র সেজে আছে কেন? প্রিয়ন্তি মনেমনে হাফ ছাড়ল। অথচ প্রিয়ন্তি ভুল ছিল। প্রশ্ন পাবার এক মিনিট আগে মাহতিম প্রিয়ন্তির একগোছা চুল টেনে ধরে। ব্যথায় প্রিয়ন্তি চুলে হাত রেখে রাগান্বিত চোখে তাকায় মাহতিমের দিকে। মাহতিম বলে,
‘ কিছু না পারলে বলবে। আমি দেখাব। ঠিকাছে? ‘
প্রিয়ন্তি মাহতিমের হাত থেকে চুলের গোছা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘ আমি মরে গেলেও তোমার দেখে লিখব না। বুঝেছ? ‘
মাহতিম অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
‘ সামান্য দেখে লেখার জন্যে তোমার মরে যেতে হবে কেন? আমাকে ইশারা দিলেই আমি খাতা তোমার চোখের সামনে তুলে ধরব। আমি আবার ভীষন সুহৃদয় তো।কাউকে মুখ ফুটে মানা করতে পারি না। ‘
#চলবে