আচ্ছা, আনাফের সাথে দেখা না হলে কি এসব আবার নতুন করে কষ্ট দিতো আমাকে? নাকি যেমন চাপা পড়ে ছিলো তেমন ই চাপা পড়ে থাকতো! আনাফ সত্যি ভুলে গেছে আমাকে? না আর ভাবতে পারব না। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।
সকাল ৭ টা বাজে, আজ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসে যেতে হবে কাজ আছে অনেক। কাল বাসায় এসে কোন কাজ করা হয় নি। রিকশা দিয়ে অফিসে যাওয়ার সময় মোড়ের সেই টং এর দোকানের দিকে বারবার চোখ গেলো অদিতির আজ ও যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় সেই চিরচেনা মুখটা যদি আবার দেখা যায় সেই লোভে। কিন্তু আজ আর হলো না অফিসে এসে কাজের চাপে প্রায় ভুলেই গেলো আনাফের কথা।
লাঞ্চ টাইমে ব্যাগ থেকে ফোন করে দেখলো বাবার কল, কাল রাতেও ফোন দিয়েছিলো কিন্তু কথা হয় নি৷ সকালে তাড়াহুড়োতে খেয়াল ছিলো না। ক্যান্টিনে গিয়ে ফোন দিলো অদিতি,
– বাবা
– কি রে মা, তুই ঠিক আছিস? কাল থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কোন খোঁজ নেই।
-বাবা আমি ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না, কাল ফোন সাইলেন্ট ছিলো হোস্টেল এ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই ফোন ব্যাক করতে পারি নি৷ সকালে তাড়াহুড়ো তে চলে আসছি
-খেয়েছিস?
– না, বাবা। খাবো এখন। তুমি খেয়েছো?
– হ্যাঁ রে। কিন্তু তোর কী মন খারাপ?
এই কথাটা শুনে মনে হলো মন খারাপ আরও বেড়ে গেলো। এই একটা মানুষ যার সাথে অভিনয়ে কখনো পেরে উঠে না।
– উঁহু, কিছুই হয় নি বাবা৷
– কি হয়েছে বল?
– বাবা আসলে কাল আনাফের সাথে দেখা হয়ছিলো ।
-আনাফ কে?
-আমি যে ছেলেকে পছন্দ করতাম সেই আনাফ৷ আজ থেকে দুই বছর আগে যে তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো।
ফোনের দু’প্রান্তে দু’জন একদম চুপচাপ হয়ে গেলো৷ অদিতি ফোন টা কেটে দিলো।
কি হলো! কেন এই কথা বাবাকে বলতে গেলাম। দেখা হয়েছিলো এটা জানানোর ও দরকার ছিলো না। মাঝেমধ্যে এই ভুলগুলো ই বিরক্তিকর লাগে নিজের কাছেই। খাওয়ার ইচ্ছে নেই এক কাপ কফি নিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসলো অদিতি৷ ফোনটা হতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো, কালকের আইডিটা এখনো লগ ইন করা। আনাফের আইডি তে ঢুকে ওর ছবিগুলো দেখতে লাগলো। আগের থেকে সুন্দর হয়েছে নাকি আমার কাছে এমন লাগছে। উফ! কি বিরক্তিকর একটা অবস্থা। হঠাৎ খেয়াল করলো মেসেঞ্জার এ কে জানি মেসেজ দিছে তার নোটিফিকেশন।
মেসেঞ্জার এ লগ ইন করে অনেক বেশী অবাক হয়ে গেলো অদিতি কারণ আর কেউ না আনাফ মেসেজ দিয়েছে।
– কে? অদিতি?
মেসেজটা দেখবে কি না বুঝতে পারছে না কেমন জানি হাত পা কাঁপছে। ডাটা অফ করে ফোন রেখে দিলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। আনাফ কিভাবে জানলো আমি? যদিও জানার ই কথা এই আইডির পাসওয়ার্ড দু’জনের কাছেই আছে শুধু। অনেক কষ্টে সব ভুলে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো অদিতি৷
.
আরিফ সাহেব চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছেন,
আজ একটু বেশীই চুপচাপ ব্যাপারটা হেলাল খেয়াল করলো। হেলাল আরিফ সাহেব এর গ্রামের বাড়ি থাকতো বাসায় কেউ না থাকার জন্য এখন আরিফ সাহেব এর সাথে বাসায় থাকে। আরিফ সাহেব এর দেখাশোনা করে।
হেলালের ডাকে আরিফ সাহেব এর ধ্যান ভাঙলো,
– কি হয়েছে আপনার?
-কিছু না রে
-কিছু তো হয়েছে অদিতি ফোন দেওয়ার পর থেকে দেখছি আপনি অন্যমনস্ক। অদিতি ঠিক আছে তো
– আমার মেয়েটা ঠিক নাই রে। আমার জন্য ই ওর এই অবস্থা
-মানে? কি হয়েছে?
– অদিতি ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে নিজের ভিতরেই একটা অস্থিরতা কাজ করছে। কেমন জানি নিজেকে অপরাধী লাগছে, মনে হচ্ছে অদিতির এই অবস্থার জন্য আমি নিজেই দায়ী। আজ থেকে দু’বছর আগে যদি আমি ওই ছেলের সাথে সব মেনে নিতাম তাহলে বোধহয় মেয়েটা এত কষ্ট পেতো না। দিনগুলোর কথা মনে হয়ে খুব খারাপ লাগছে, আরও খারাপ লাগছে যার জন্য এতকিছু করলাম সেই আমার মেয়েই এখন ভালো নেই।
ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে অনেক আদর যত্নে বড় করেছি জানিস ই তো, অদিতি যখন অর্নাস কমপ্লিট করবে তার কিছুদিন আগে অদিতির মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যায়। আমরা দু’জনেই ওর বিয়ের জন্য ওকে জোর করি, তখন ও আমাদের আনাফের কথা জানায়। আনাফের সাথেও আমরা কথা বলি। আনাফের পড়াশোনা ও তখন কমপ্লিট হয় নি তবুও ও বিয়ে করতে চেয়েছিলো কিন্তু এরকম একটা ছেলের সাথে মা-বাবা হয়ে আমরা বিয়ে দিতে চাই নি যার কোন ভবিষ্যত আছে কি না তা নিয়ে সন্দিহান আমরা। তাই আমরা না করে দেই, অদিতি আমাদের অনেক বুঝায়। আমি একসময় আনাফের সাথে কথা বলি জানি না তারপর কি হলো অদিতি একদম চুপ হয়ে যায়। এরপর আমরা অনেক ভালো একটা পাত্রের সন্ধান পাই, ছেলে ডাক্তার পরিবার ভালো৷ এরপর স্বল্প আয়োজনে বিয়ে ও সম্পন্ন হয়। যেহেতু অদিতির পড়াশোনা চলছিলো তাই ও আমাদের বাসাতেই থাকতো ওর জামাই ও প্রায় সময় ই এখানেই থাকতো৷ ওর নাম ছিলো জামিল। একসময় অদিতির মা বলল জামাই ও এখানে থাকুক আমাদের ও ছেলে নেই খারাপ কি। তারপর জামিল প্রথমে না বললেও পরে রাজি হয়ে যায় আমাদের সাথে থাকতে। এরপর হঠাৎ একদিন জানায় সে আর চাকরি করবে না। কারণ স্বরূপ বলে, অদিতি আমাদের একমাত্র মেয়ে আমরা মারা গেলে সবকিছু ওর৷ যা বাসা ভাড়া আসবে এতেই হয়ে যাবে সে কিছু করবে না৷ একমাত্র মেয়ের জামাই তাই আমাদের কিছু করার ছিলো না বাধ্য হয়ে সবকিছু মেনে নিয়ে ছিলাম। এরপর প্রায়ই দেখতাম অদিতি একদম মনমরা ওর মাকে বললে কিছু বলতে পারতো না। এরকম করে প্রায় এক বছর শেষ হয়ে গেলো। তারপর হঠাৎ করেই অদিতির মা মারা যায়, আমি একপ্রকার হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বাহিরে যেতাম না, বাসায় ই থাকতাম তখন বুঝতে পারলাম একসময় অদিতির মন খারাপ এর কারণ। জামিল প্রায়ই গায়ে হাত তুলতো অদিতির। কিন্তু ও কখনো আমাকে বলে নি, হয়তো আত্মসম্মান এছাড়াও আমাকে কষ্ট দিতে চায় নি। তাই আমিও বলার সাহস পাচ্ছিলাম ওকে কিছু। নিজের ভেতরটা যেন আরও হাহাকার শুরু হয়ে গেছিলো। একদিন আমার সামনেই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলে। ওই দৃশ্যটা আমি ঠিক নিতে পারি নি, যে মেয়েকে এত আদর যত্নে বড় করলাম আজ আমার সামনেই এটা হতে পারে না। তারপরে আমি নিজেই সোজা ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করি। কারণ এই নরকযন্ত্রণায় থাকার থেকে সারাজীবন ও একা থাকুক তাও ভালো। আর তারপর থেকেই অদিতি আমার সামনে যতই হাসিখুশি থাকুক ওর ভেতরটা সবসময় যেন কষ্টের আগুন জ্বলতো।
আজ যখন ফোন দিয়ে আনাফের কথা বলল, তখন সেই পুরাতন অপরাধবোধ, কষ্টটা যেন আবার জেগে উঠলো। আমার এত খারাপ লাগছে না জানি আমার মেয়েটার কি অবস্থা।
গল্পের নাম: প্রিয়তম প্রাক্তন
পর্ব: ০৩
লেখনীতে: ISRAT(Ishu Moni)