#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩১.
ইচ্ছের বিয়ে। নওশাদ সাহেব মনের কতো করে সাজিয়েছেন পুরো বাসাটাকে। উজ্জল রোদে বাড়িটার সাজ আরো আকর্ষনীয় লাগছে যেনো। গার্ডেনে স্টেজ করে সেখানে ইচ্ছেকে বসিয়ে হলুদ-মেহেদী লাগানো হচ্ছে। গানবাজনা পর্বও চলছে। হাতে সময় কম থাকায় আলাদা আলাদা দিনে অনুষ্ঠানগুলো না করে বিয়ের দিন সকালেই করা হচ্ছে সবটা। তাছাড়া ইচ্ছে, রাকীন দুজনেরই অমত ছিলো। আলাদা করে একটা দিনে ঝামেলা চায়নি কেউই। বিয়েটা নিয়ে কথা বলে ইচ্ছে প্রেসমিডিয়ার হিসাব মিটিয়ে দিয়েছে আগেই। যাতে ওকে বিয়েরদিন আলাদা করে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়। তবুও সবাই এসেছে। ছবি তুলছে, নিউজ করছে নিজেদের মতো করে। নওশাদ সাহেবের আত্মীয়স্বজন বলতে শুরু দুটো বোন, একটা ভাই আর ইচ্ছের কিছু কাজিন। বাকিসব ইচ্ছের সংঙ্গীতাঙ্গনের পরিচিতরা। বাসার সামনের দিকের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে শক্তমুঠে রেলিং ধরে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলেন নাফিজা বেগম। ওই জায়গায় আজ তার মেয়ের থাকার কথা ছিলো। আর যে যাই বলুক না কেনো, রাকীন তো সবসময় খেয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিতো। আজও ও খেয়াকেই ভালোবাসে। এটাও নিশ্চিত উনি। চোখ ফেটে জল গরিয়ে পরলো নাফিজা বেগমের। চলে আসলেন ওখান থেকে। সবাই হলুদ ছোয়াচ্ছে ইচ্ছেকে। রাকা পাশে দাড়িয়ে আছে শুধু। কিছুই বলছে না। ও মানতেই পারছে না, ইচ্ছে বিয়েটাতে রাজি হয়ে গেছে। মেহেদী দেওয়ার সময় ইচ্ছের পাশে থাকা বাটন মোবাইলটা বেজে উঠলো। তখনই মেহেদী পরাতে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো,
-কি নাম দেবো?
ইচ্ছের দৃষ্টি মোবাইলে। আর মোবাইল স্ক্রিনে সেই আননোন নাম্বার। ইচ্ছে বিস্ময়ে সেদিক তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
-প্রাপ্ত…?
বাজতে বাজতে কেটে গেলো কলটা। প্রাপ্ত নিজের ফোনটাই বিছানায় ছুড়ে মারলো এবার। দু দুবার এই নম্বরে টমির গলা শুনেছে ও। এটা ইচ্ছেরই নম্বর। ও তো ইচ্ছেকে কল করেনি। তবে তো এটাই দাড়ায়, ইচ্ছেই কল করেছিলো ওকে। কিন্তু আজ ওর বিয়ে। ওকেই বা কেনো কল করতে যাবে ইচ্ছে? সন্ধ্যায় খই আর ওর আংটিবদল। আর এখন এই কল। করনীয় বুঝে না উঠে অস্থিরভাবে প্রাপ্ত ফোন নিয়ে আবারো কল লাগালো ইচ্ছের নম্বরে। মোবাইলে আবারো একই নম্বর থেকে কল আসতে দেখে উঠে দাড়ালো ইচ্ছে। বেপরোয়াভাবে অনুষ্ঠানের মাঝ পর্যায়েই স্টেজ থেকে ছুটে নেমে আসলো ও। গায়ের হলুদগুলো যেনো মরিচের প্রলেপ হয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ওর পুরো শরীর। শাওয়ার অন করে সমস্ত শরীর থেকে হলুদ তুলতে শুরু করে দিলো ও। নখের আঁচড়ে কেটেও গেছে কয়েকজায়গায়। এতোক্ষন গায়ে জোর থাকলেও হাতের মেহেদী তুলতে গিয়েই পাথর হয়ে গেলো ইচ্ছে। তালুতে লেখা নামটা দেখে শ্বাস আটকে আসতে লাগলো ওর। মনে পরলো, প্রাপ্তর কলটা যখন আসে মেহেদীর ডিজাইনার কি নাম লিখবে, প্রশ্ন করেছিলো ওকে। ওর মুখ দিয়ে তখন প্রাপ্তর নামই বেরিয়েছে। ফলস্বরুপ হাতের মেহেদীতে ওর হবু বর রাকীনের নামের পরিবর্তে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, “প্রাপ্ত”
•
দিন গরিয়ে সন্ধ্যে নামলো। টকটকে লাল লেহেঙ্গা, ভারীভারি গয়নায় সাজানো হলো ইচ্ছেকে। এই প্রথমবার ওর চুলগুলো খোপা করা হয়েছে হয়তোবা। গলায় আটকানো চোকারটার পরিবর্তে হার, কানের বড়বড় স্টাইলিস্ট এয়াররিংগুলোর পরিবর্তে স্বর্নের ঝুমকো, নাকে বড় নথ, কপাল জুড়ে থাকা টিকলি, হাতভর্তি চুড়ি। সে এক অন্য ইচ্ছে। সবাই বসেবসে প্রশংসা করছে ওর সাজের। ইচ্ছে নিশব্দে বসে আছে বিছানায়। হুট করেই একজন এসে বললো, বর এসেছে। ব্যস! বর দেখতে ছুটলো সবাই। রাকা পুরোটা সময় দুরে থাকলেও একা পেয়ে ইচ্ছের কাছে বসেছিলো কিছুক্ষন। কি ভেবে ওউ চলে গেছে। আপাতত শুধু টমিই রয়ে গেছে রুমটাতে। ইচ্ছের দৃষ্টি ব্যালকনির পর্দার দিকে স্থির। বাইরে থেকে আসা শীতল বাতাসে শুভ্র পর্দাগুলো উড়ছে মৃদ্যুছন্দে। তার ফাঁকফোকড়ে পূর্নচাঁদটাও দেখা যায়।
হাতের তালুটা সামনে তুলে ধরলো ইচ্ছে। সময়ের সাথে মেহেদীর রঙ গাঢ়তর হয়েছে। আরো বেশি রঙ পেয়েছে প্রাপ্তর নামটা। হাত ধোয়ার সময় অনেক ডলেছে। ওঠেনি সে নাম। যেমনভাবে ওই মানুষটার প্রতি ওর অনুভব গাঢ় হতে শুরু করেছে, তেমনভাবেই হাতের মেহেদীতেও ওর নাম গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। চোখ ভরে উঠলো ইচ্ছের। টুপটাপ দু ফোটা চোখের জল গরিয়ে তালুতে পরলো ওর। দম বন্ধ লাগছে ওর এই সাজে। চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে ওর। মায়ের কথা মনে পরছে প্রচন্ড। আজকে ওর মা নেই বলে ওকে সামলানোর জন্য কেউই নেই, করনীয়টা বোঝানোর জন্য কেউই নেই। নিজেকে সামলাতে না পেরে আকস্মাৎ কেদে দিলো ইচ্ছে। অস্ফুটস্বরে কাদতে কাদতে বললো,
-মা!
সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়ে ওঠেনি ইচ্ছের। টমি জানে সেটা। ও শোয়া থেকে উঠে দাড়ালো ইচ্ছেকে কাদতে দেখে। খানিকক্ষন ঘরের মেঝে শুকে টি টেবিলে পানি দেখলো শুধু। গিয়ে টেবিলের কাছে দাড়িয়ে শব্দ করতে লাগলো। ইচ্ছে নাক ডলে বললো,
-খিদে নেই আমার টমি।
টমি আবারো ডাকলো। ইচ্ছে আর কিছুই বললো না। টমি এদিকওদিক দেখে হাটা লাগালো ব্যালকনির দিকে। ইচ্ছে তখনও ঠোট কামড়ে ধরে ফুপাচ্ছে। টমি কামড় লাগালো ব্যালকনির পর্দায়। টেনে ছিড়তে লাগলো পাতলা পর্দাটা। ইচ্ছে তৎক্ষনাৎ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বললো,
-টমি স্টপ।
টমি যেনো শুনলোই না। ইচ্ছে আবারো বললো,
-টমি প্লিজ স্টপ। আজকে না প্লিজ! প্লিজ টমি।
টমি বাধ মানলো না। পর্দার নিচের দিকটা ছিড়ে ফেলেছে ও। ইচ্ছে বিছানা ছেড়ে নামলো এবার। ব্যালকনিতে গিয়ে মেঝেতে দু হাটু ঠেকিয়ে, টমির দিকে হাত বারিয়ে বললো,
-টমি কাম? প্লিজ জেদ করিস না।
ইচ্ছের গলায় অসহায়ত্ব। যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ওকে। আর কোনো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই ওর। টমিকে না থামতে দেখে আরো জোরে বললো,
-টমি প্লিজ! এভাবে প্রাপ্তর মতো পাগলামি কেনো করছিস তুই?
প্রাপ্তর নাম নিয়ে কথা বলেছে এটা মনে পরতেই আবারো কপাল চেপে ধরে কেদে দিলো ইচ্ছে। টমির থামার নামই নেই। এবার লাফিয়ে উঠে দেয়ালে আটকানো ভাঙা গিটারটাকেই মেঝেতে ফেলে দিলো ও। ইচ্ছে থমকে গেছে ওর কাজে। দু দন্ড স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাগলের মতো করে জরিয়ে ধরলো গিটারটা। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে টমির দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো,
-সমস্যা টা কি তোর? কি সমস্যা?আমি ওই ছেলেকে ভুলতে চাইছি। আর তুই বারবার কেনো মনে করিয়ে দিচ্ছিস ওকে? বারবার আমার লাইফে ওর উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে, কি প্রমান করতে চাস কি তুই? কি?
-কোন ছেলেকে ভুলতে চাইছিস তুই ইচ্ছে?
রাকীনের গলা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো ইচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দরজায় তাকালো ও। সাদা-সোনালীর সংমিশ্রনের শেরওয়ানী পরনে রাকীন দাড়িয়ে। ঠিক ওর পেছনেই রাকা। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। চোখমুখ মুছে রাকীনের থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
-তুই এখানে?
-রাকা বলছিলো তুই নাকি সারাদিন কিছু খাসনি?
ইচ্ছে জবাব দিলো না। রাকীন এগোলো। ইচ্ছের হাত থেকে ভাঙা গিটারটা নিয়ে বললো,
-এটা ভাঙলো কি করে?
…
-তোর গিটার কে ভেঙেছে ইচ্ছে?
…
-নামটা বলছিস না কেনো?
ইচ্ছে একপা দুপা করে পেছোতে লাগলো। ওর চারপাশে শুধু একটাই নাম বাজতে শুরু করেছে। প্রাপ্ত। ফুপাতে ফুপাতে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে থাকা ভাঙা গিটারের দিকে তাকালো ইচ্ছে। বুঝলো, ও পাগল হয়ে যাচ্ছে ওই নামের জন্য, এই নামধারী মানুষটার জন্য। তাকে ছাড়া অসহ্য লাগছে ওর সবটা। কয়েকমুহুর্ত সবটা মনে করে নিজের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে অদৃশ্য জোর খাটাতে লাগলো একেরপর এক। কি হলো ইচ্ছের, চোখ তুলে রাকীনের দিকে তাকিয়ে একশ্বাসে বলে দিলো,
-আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি রাকীন।
অবাকচোখে তাকালো রাকীন। ইচ্ছের উত্তর না প্রশ্নের সাথে যায়, না পরিস্থিতির সাথে। তবে এই ভালোবাসি শব্দটা তো চিরন্তন। নিজেকে স্বেচ্ছায় ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করা যে ইনায়াত নিক্কনকে ও চেনে, সেই কঠোর মেয়েটিও ভালোবেসেছে শুনে স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে নিলো রাকীন। তা যাকেই হোক না কেনো। ঠোটের কোনে হাসি ফুটেছে ওর। এইমুহুর্তে আর কোনো প্রশ্ন করলো না ও ইচ্ছেকে। ওর হাসি দেখে ইচ্ছে নিজে কি বলেছে, সেটা অনুভব করলো। আবারো বিস্ময়ে তাকালো ওর ভাঙা গিটারটার দিকে। গিটার কে ভেঙেছে, তার উত্তর কি করে “তাকে ভালোবাসি” হয়? কেউ ওর সবচেয়ে ভালোবাসার জিনিসটাকে আঘাত করে কি করে ওর ভালোবাসার কেউ হয়ে যেতে পারে? ওর ভেতরের অদৃশ্য সত্ত্বা হয়তো জবাব দিলো, ভালোবাসা এমনই। আর যাই হোক, নিজমুখে উচ্চারন করা ভালোবাসিকে এখন আর অস্বীকার করতে পারবে না ও। হ্যাঁ ভালোবাসে ও প্রাপ্তকে। এই স্বীকারোক্তিতে যদি এতো সুখ থাকে, সে সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারবে না ও। রাকীনের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে কাদতে কাদতে বললো,
-আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি। রাস্তায় গুন্ডামো করা ওই গ্যাংস্টারকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি রাকীন। এই বিয়ে আমি করতে পারবো না রে! এই বিয়ে আমি করতে পারবো না!
রাকীন মৃদ্যু হাসিটা ঠোটে রেখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ইচ্ছের কাছে হাসিটা তাচ্ছিল্য বলে মনে হলো। ও কাদতে কাদতেই বললো,
-জানি কথাগুলো তোকে বলতে অনেকটাই দেরি করে ফেললাম। কি করবো বল? আমার নিজেরই বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছি, ওকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আর কাউকে জীবনে মানতে পারবো না আমি। আমাকে তোকে এক করার ভুল ধারনা নিয়ে, খেয়া যেভাবে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিলো, আমি সেভাবে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে পারবো না রাকীন। আমি প্রাপ্তকে ভালোবাসি। তোকে বিয়ে করতে পারবো না। এই বিয়ে হবে না রাকীন। আমি বিয়েটা করছি না। ক্ষমা করে দিস আমাকে। আ’ম, আ’ম সরি!
কথা শেষ করে ইচ্ছে একমুহুর্তও দাড়ালো না। ছুট লাগালো। রাকীন জানতো, ওর মতের জন্য অপেক্ষা করবে না ইচ্ছে। তাই দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কিন্তু ইচ্ছেকে হাত ধরে দরজায় আটকে দিলেন নওশাদ সাহেব। পুরোটা না শুনলেও, ইচ্ছের বলা শেষের তিন লাইন স্পষ্ট শুনেছেন তিনি। ইচ্ছের হাত ধরে রেখে বললেন,
-এসব তুমি কি বলছো ইচ্ছে? আজকে তোমার বিয়ে! রাকীন? তুমি কেনো কিছু বলছো না? কি বলছে ও এসব? কোথায় যাবে তুমি ইচ্ছে?
-ওকে যেতে দাও আঙ্কেল। আজ ওকে আটকিও না।
রাকীনের কথায় অবাকই হলেন নওশাদ সাহেব। এভাবে ইচ্ছে বেরিতে গেলে ওর আর ওর বাবার সম্মানটা কোথায় গিয়ে দাড়াবে ,তার ধারনা আছে তার। কিন্তু রাকীনের সে পরোয়া নেই। ইচ্ছে রাকীনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
-থ্যাংকস্। আমি জানতাম তুই বুঝবি আমাকে।তবে আজ চাইলেও কেউ ইচ্ছেকে আটকাতে পারবে না। আসছি।
গায়ের জোরে বাবার হাতের মুঠো থেকে ঝারা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো ইচ্ছে। রাকীন হেসে দিয়ে নিজের গাড়ির চাবিটা ছুড়ে মারলো ইচ্ছের দিকে। চাবিটা ক্যাচ করে, লেহেঙ্গা খানিকটা উচিয়ে ধরে উচ্ছ্বাসে দৌড় লাগালো ইচ্ছে। থমকে দাড়িয়ে থেকে বিয়ের কনেকে দৌড়াতে দেখলো পুরো বাড়ি। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে, ড্রয়িংয়ের একগাদা মানুষজনের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে, গার্ডেনের আকাশে জ্বলা আতশবাজির আলোতে মরিচবাতিতে সাজানো রাস্তা দিয়ে দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠলো ইচ্ছে। টমিও ওর পেছনপেছন দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠেছে। সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে টমিকে আরেকহাতে আদর করে দিলো ইচ্ছে। অতঃপর স্টার্ট দিলো গাড়িটা। গন্তব্য…প্রাপ্ত!#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩২.
হাতে দুটো ফাইল হাতে বিস্ময়ে থেমে আছে খই। খানিকটা সময় পর ওর আর প্রাপ্তর আংটিবদল। শাড়ি পরে মেঝেতে হাটু জরিয়ে বসে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে ছিলো ও। হুট করে মিষ্টিঘরের কেয়ারটেকারকে সাদিক সাহেবের বাসার দিকে ছুটতে দেখে সন্দেহ হলো খইয়ের। জিজ্ঞাসা করতেই সে ফাইলদুটো দেখালো ওকে। স্কুলের পুনর্নিমান কাজে দ্বিগুন টাকা চেয়ে মিষ্টিঘরে নোটিশ পাঠিয়েছে ইনিশা। সেটাও আজকের মধ্যেই। নইলে স্কুলটাকে ইনিশা নিজেদের করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে তার সবরকমের আইনি কাগজপত্রের প্রমানও পাঠিয়েছে নোটিশের সাথে। খইয়ের বিস্ময় কাটছেই না। যেখানে রাকীন নিজে এই কাজের দায়িত্ব ছিলো, সেখানেও এমন ছলচাতুরি সম্ভব বলে ধারনাতেও ছিলো না ওর। খই কেয়ারটেকারকে বললো,
-এসব কি মামা? এই নোটিশ?
-হ্যাঁ মা। আমিও তাই ভাবছি। এমন কোনো নোটিশ তো আসার কথা না। তাদের টাকা দেওয়ার তারিখও এতো দ্রুত শেষ হবার কথা না। আর টাকার এমাউন্টই বা এতো কেনো? নোটিশ পাঠানোর তারিখ যা দেওয়া আছে, সে তারিখে নোটিশ না পাঠিয়ে আজ লাস্ট ডেট দেখে নোটিশ পাঠানোর কি মানে? সবদিক দিয়ে মিষ্টিঘরকে হয়রানীর চেষ্টা। এসব কেনো করছে ইনিশা? শুধুমাত্র বেশি টাকা আদায়ের জন্য?
জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো খই। আপাতত কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। কেয়ারটেকার বললো,
-ফাইলটা দাও খই। সাদিক সাহেব বা প্রাপ্তকে জানাতে হবে বিষয়টা। আজ রাত বারোটার মধ্যে এর একটা বিহিত না করলে কাল সকালে ইনিশা লোক পাঠাবে বলেছে।
উনি হাত বাড়িয়ে নিতে যাচ্ছিলেন ফাইলটা। খই হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে বললো,
-কাউকে জানাতে হবে না মামা।
-জানাতে হবে না মানে? না জানালে এসব মিটবে কিভাবে?
-ইনিশার আর্কিটেক্ট জানে এসব?
-জানিনা। তবে ওনাকে দেখে যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছিলো আমার। উনি জানলে এমনটা ঘটতে দিতেন বলে আমার মনে হয় না।
খই বুকে আঁকড়ে ধরলো ফাইলটা। আর কয়েকমুহুর্তে ওর জীবন অন্যকারো নামে হয়ে যাবে। শেষবারের মতো রাকীনকে দেখার লোভ কি করে সামলাবে ও? নিজেকে অন্যকারো নামে করে দিয়ে আর নকশাদারকে নিজের বলতে পারবে না যে। খই ধরা গলায় বলে উঠলো,
-আমি ইনিশায় যাবো মামা।
বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। মিষ্টিঘরে আসার পর থেকে খই মিষ্টিঘর আর সাদিক সাহেবের বাসা ছাড়া অন্য কোথাও পা রাখেনি। পড়াশোনা নিয়েই থেকেছে সবসময়। হুট করে এভাবে বেরোতে চাওয়া, তাও আবার আজকে এ সময়ে, ওর কথা শুনে ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন,
-কি বলছো কি তুমি? ইনিশায় যাবে মানে? আজ তোমার আর প্রাপ্ত বাবার এনগেইজমেন্ট!
-আজই নোটিশের লাস্ট ডেইট।
-তাই বলে তুমি এখন ইনিশায় যাবে? কোনো প্রয়োজন নেই তোমার যাওয়ার। ফাইলটা আমাকে দাও। আমি সাদিক সাহেবকে বলে সাফোয়ান বাবাকেদিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবো। আর তুমি…
ধপ করে ভদ্রলোকের পায়ের কাছে বসে পরলো খই। আঁতকে উঠলেন ভদ্রলোক। খইয়ের চোখের জল পায়ের পাতার উপর পরেছে তার। খই মাথা নিচু রেখে মাটিতে দৃষ্টিস্থির রেখে বললো,
-আমার এই একমাত্র চাওয়াকে ফিরিয়ে দেবেন না প্লিজ মামা! আর কোনোদিনও কিছু চাইবো না আপনার কাছে। কোনোদিনও না! আমাকে মিষ্টিঘরের জন্য এটুকো করার সুযোগ দিন প্লিজ! ভরসা রাখুন আমার উপর। কাজ শেষেই ফিরে আসবো আমি। প্লিজ মামা! প্লিজ!
ভদ্রলোক নির্বাক। এভাবেও কেউ আকুতি করতে পারে, জানা ছিলো না তার। তবুও অনেকবার অনেকভাবে মানা করেছে সে খইকে। তাতে খইয়ের কান্না বেড়েছে শুধু। উপায় না দেখে উনি রাজি হলেন খইয়ের কথায়। উঠে দাড়িয়ে হাতের পিঠে চোখমুখ মুছলো খই। ঠোটে হাসি ফুটিয়ে, আসছি বলে, লোকচক্ষু এড়িয়ে বেরিয়ে আসলো মিষ্টিঘর থেকে। ওর যাওয়ার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কেয়ারটেকার। খইয়ের আকুতি কি শুধুই মিষ্টিঘরের জন্য ছিলো? নাকি বড়সর কোনো ভুল করে বসলেন তিনি?
•
ইনিশা’য় কেবিনে বসে নিজের ইচ্ছেমতো এই প্রথমবার ম’দ খেয়ে শান্তি পাচ্ছিলো নিজাম। রাকীন, রাজীব মাহমুদ দুজনেই আজকে বিয়েতে ব্যস্ত। ওকে আটকানোর কেউই নেই আজ। এই এতোবড় বিল্ডার্স কোম্পানির এতো ভালো পজিশনে থেকেও মনে শান্তি নেই ওর। নেশা করতে অভ্যস্ত বলে রাজীব মাহমুদ সবসময়ই কাজের চাপে রাখেন ওকে। আর এটাই ওর পছন্দ না। টাকা পয়সা দিয়ে যদি জীবনে শখ আহ্লাদই পুরন না করতে পারে, কি হবে সে টাকা দিয়ে? অনাথ হওয়ার পর থেকেই কাকার শাষনে বড় হতে হয়েছে ওকে। অন্যায়ের জন্য রাকীনের মারও কম খায়নি। এরা দুই বাবা ছেলে মিলে একদম অসহনীয় করে তুলেছে ওর জীবনটা। এসব ভেবেভেবে গ্লাসের পর গ্লাস ম’দ শেষ করে দিচ্ছিলো নিজাম। পরপর দুবার টেবিলে থাকা টেলিফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো ও। ওরই অধস্তন এক কর্মচারী। পরেরবার বাজতেই সে বিরক্তি রাগে পরিনত হলো নিজামের। রাগে ওটা রিসিভ করে বি’শ্রি এক গা’লি দিয়ে বলে উঠলি,
-শা’লা ***! তোদের জন্য শান্তিতে বসতে পারবো না কোথাও? চাকরিটা খোয়ানোর মন চেয়েছে?
ওপাশ থেকে ভরকে যাওয়া এক কন্ঠে আওয়াজ এলো,
-স্ সরি স্যার। আসলে একটা জরুরি বিষয়েই আপনাকে কল করা। রাকীন স্যারের…
অকথ্য এক গালিতে কল কাটলো নিজাম। লোকটা রাকীনের নাম নিয়েই রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে যেনো। একশ্বাসে সামনে রাখা পুরো গ্লাস শেষ করলো ও। পরপর তিনবার খাওয়ার পর কপাল ঠেকালো সামনের টেবিলে। আজকে শান্তি লাগছে ওর প্রচন্ড। রাকীনের দায়িত্বে ছিলো বলে, মিষ্টিঘরের স্কুলটার কাগজপত্র উনিশবিশ করে দিয়েছে ও। কাজ শেষ হবার পর ইনিশা যতো টাকা পেতো, তার দ্বিগুন বাড়িয়ে লিখে আজকের লাস্ট ডেট বসিয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে। যার ফলে টাকা আসবে বেশি, আত্মসাৎ করবে ও, আর দায় পুরোটা পরবে রাকীনের নামে। এমনিতেও খেয়া হাউজিং আর বিয়েটা নিয়ে বাবা ছেলের মাঝে যা চলছে, তাতে এ ঘটনার পর রাজীব মাহমুদ রাকীনকে ক্ষমা করবেন বলে মনে হয় না। মনেমনে খুশি হওয়ার আগে, নিজামের হঠাৎই হুশ আসলো, কর্মদিবস শেষ। এখন অকারনে নিশ্চয়ই কেউ খুজতে আসবে না রাকীনকে। আর তার উপর সে জানে না আজ রাকীনের বিয়ে। বাকা হাসলো নিজাম। নে’শায় বুদ হলেও উদ্দেশ্যহীন হলো না ও। ফোনটা নিয়ে পুনরায় কল করলো ও জামীলকে। বললো,
-কি বলতে চাইছিলি?
-একজন মেয়ে কল করেছিলো। বারবার রাকীন স্যারের সাথে কথা বলতে চাইছিলো।
-মেয়ে? কোন মেয়ে? আর ওয়ার্কিং আওয়ার শেষে, এখন রাকীনের সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে চায়?
-মেয়েটা মনে হয় ওই অনাথ আশ্রমের। কি বলবে তা তো জানি না। তবে বারবার করে বলছে খুব জরুরি কথা আছে নাকি।
-ওকে আমার কেবিনে পাঠা। বাকিটা দেখছি আমি।
অনুমতি পেয়ে কেবিনে ঢুকলো খই। দেশের সবচেয়ে নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, ইনিশা বিল্ডার্সের অফিস খুজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি ওকে। ট্যাক্সি করে চলে এসেছে সোজা। ততোক্ষনে ইনিশার কর্মদিবস শেষ। হাতেগোনা কিছু স্টাফ রয়ে গেছে শুধু। কেবিনে ঢুকে রাকীনকে আশা করলেও ড্রিংক বানাতে ব্যস্ত নিজামের দেখা মিললো। খই ফাইলটা বুকে আকড়ে রেখে বললো,
-রাকীন শাফায়াত কোথায়?
টলোমলো চোখ তুলে তাকালো নিজাম। শাড়ি পরিহিত মেয়েটার গায়ের রঙটা বেশ চাপা। বিনুনি করা চুল কোমড়ের নিচ অবদি এসেছে একদম। উঠে দাড়িয়ে টলতে টলতে এগোলো নিজাম। রাকীনের নামে এই প্রথমবার কোনো মেয়ে এসেছে ইনিশায়। আর যা রাকীনের নামে হয়, বরাবরই তার প্রতি কেনো যেনো লোভ কাজ করে ওর। নেশালো চাওনিতে আপাদমস্তক দেখে নিলো ও খইকে। খই লক্ষ্য করলো, ঠিকমতো দাড়াতেও পারছে না মানুষটা। এর কাছে স্কুল কেনো, রাকীনকে নিয়ে কথা বলেও লাভ নেই। নিজাম এগিয়ে এসে বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বললো,
-রাকীনকে কি দরকার তোমার?
-দরকারটা না হয় তাকেই বলবো? কোথায় সে?
-ওর তো আজ বিয়ে। ও নিজের দরকারে অন্য কাউকে খুজে নিয়েছে। আসো তোমার দরকারটা আজ আমিই পুষিয়ে দেই না হয়?
পুরোটার বদলে শুধু রাকীনের বিয়ে কথাটা কয়েকবার কানে বাজলো খইয়ের। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। আজ ও অন্যকারো হতে চলেছে। আর আজকেই রাকীন অন্যকাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছে। এর চেয়ে বড় ঘটনাক্রম আর কি হতে পারে? তাচ্ছিল্যের এক হাসি ফুটলো ওর ঠোটের কোনে। নিজাম এবার আরেকপা এগিয়ে বললো,
-কি বলো? আমি পুষিয়ে দেই তোমার দরকার?
খই নিজেকে সামলালো। এখানে থাকার আর কোনো মানে হয়না ওর। যতো দ্রুত সম্ভব মিষ্টিঘর ফিরতে হবে ওকে। আংটিবদলের সময় হওয়ার আগেই। তাছাড়া এখানে রাকীনকে পাওয়ার কোনো উপায়ও নেই। তাই নোটিশটা সাফোয়ানকে দিয়ে দেওয়াই উচিত হবে। খই নিজামকে শান্তভাবে বললো,
-আপনি যে কোনোকিছু বোঝার অবস্থাতে নেই, তা বেশ বুঝতে পারছি। আর আপনাকে বোঝানোর অনুকুল অবস্থাও আমার না। সরি ফর ইনট্রাপশন। আসছি।
খই পা বাড়াচ্ছিলো চলে আসবে বলে। হুট করেই বলে ওর হাত ধরে পেছন থেকে টান লাগালো নিজাম। খই এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। টান অনুভব করেই হাতের কাছে থাকা বড় ফুলের টবটা একহাতে তুলে ঘুরে উঠে বারি লাগিয়ে দিয়েছে ও। কাধে লেগেছে নিজামের। কাধ চেপে ধরে ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিজাম। খই টেবিল থেকে পানির গ্লাসের পুরোটা নিজামের মুখে ছুড়ে মেরে বললো,
-নেশা কেটেছে?
মুহুর্তেই রাকীনের কথা মনে পরে গেলো নিজামের। যতোবার রাকীন ওকে নেশা করতে দেখেছে, ততোবার এভাবেই পানি ছুড়েছে ওর মুখে। খইও এটাই করলো। রাগ সর্বোচ্চসীমায় এবার নাজিমের। তেড়ে এগোলো ও খইয়ের দিকে। ওর ঘাড়ের চুল সর্বশক্তিতে মুঠো করে নিলো। খই ব্যথায় কুকড়ে উঠে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ওর হাত। নিজাম একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,
-না কাটেনি নেশা। রাকীনকে খুজতে ইনিশা্ এসেছিলে না? রাকীনের স্টাইলে কাটাতে চাইছিলে আমার নেশা? তবে আজ তোমাকে দিয়েই নেশা কাটাবো যাও! গেট রেডি।
ওর বিদঘুটে হাসিটা দেখে ঘৃনায় বিষিয়ে উঠলো খই। একহাতে থাকা ফাইলদুটো ছেড়ে দিলো এবার। কোনোমতে হাতড়ে টেবিল থেকে পেপারওয়েট নিয়ে একদম কপাল বরাবর বারি লাগিয়ে দিলো নিজামের। আর্তনাত করে খইয়ের চুল ছেড়ে নিজের কপাল চেপে ধরলো নিজাম। কপাল কেটে রক্ত ঝরছে ওর। খই আর একমুহুর্তও দাড়ায়নি। ফাইলদুটো তুলে ছুটে বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে। কোনোদিক না তাকিয়ে, সিড়ি দিয়ে নেমে ইনিশা থেকে মুল সড়কে এসে দাড়ালো ও। নিজামও ছুটেছে ওর পেছনপেছন। ও ভালোমতোই জানে, এই মেয়েকে এভাবে ছাড়লে রাকীন ওকে স্বাভাবিকভাবে ছাড়বে না। আগেরবার লিখনের সাথে যা ঘটেছিলো, তারপর রাকীনের দেওয়া ধমকিগুলো এখনো ভোলেনি ও। নিচে নেমে নিজাম খইকে দেখলো সিএনজিতে চরে বসতে। টবের বারিতে বেকে যাওয়া কাধ আর ফাটা কপাল, দুটো নিয়ে ওউ গাড়ি নিয়ে বেরোলো খইয়ের পেছনপেছন।
#চলবে…