প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ৩৫+৩৬

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩৫.

-যতোদুর মনে পরে, সেদিন পার্ক থেকে ইচ্ছে রাকীন চলে যাওয়ার পর আমি নিজেনিজেই উল্টোদিকে হাটা শুরু করেছিলাম। আমার গায়ের রঙ নিয়ে বলা ইচ্ছের কথায় অভিমান হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু বাসায় ফিরতাম আমি। অভিমান নিয়ে হাটতে হাটতেই পার্ক থেকে বেশ অনেকটা দুরে চলে আসি। কোনো এক মুলসড়কে। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার সময় প্রাইভেট কার ধাক্কা দিয়ে চলে‌ গেলে, জ্ঞান হারাই। সাথে স্মৃতিও। হসপিটালে সাহেরা মা আমাকে মেয়ের পরিচয় দেয় আর ওখান থেকেই ভাদুলগায়ে নিয়ে আসে। কখনো বলেনি আমি তার মেয়ে নই। বরং শুরুর দিক থেকেই আমাকে গ্রামের ভাষায় কথা বলতে জোর করতো, স্কুলে যেতে দিতো না ঠিকমতো, জামাকাপড়েও কখনো আধুনিকতা দেয়নি আমাকে। এমনকি শহর থেকে কেউ গ্রামে গেলেও তাদের ছায়াটা অবদি দেখতে পেতাম না আমি। সর্বোস্ব দিয়ে ভালোবাসলেও, সাহেরা মা সবসময় আড়াল করে রাখতো আমাকে। সবসময়!

নাফিজা বেগমের বুকে মুখ গুজে সবটা বললো খেয়া। ইচ্ছে কল করে জানানোর পরেই হসপিটালে চলে এসেছেন নওশাদ সাহেব আর নাফিজা বেগম। মেয়েকে দেখে অঝোরে কেদেছেন দুজনে। কেদেছে খেয়াও। তবে তাদের আগে আরো একজনের আগমন ঘটেছে কেবিনে। রাকীনের। এককোনে দাড়িয়ে দাতে দাত চেপে এতোগুলো বছরের সমস্ত কষ্ট, রাগ, অভিমান সহ্য করার চেষ্টা করে চলেছে সে এতোক্ষন হলো। যাকে এতোগুলো বছর খুজে চলেছে ও, এতোটা কাছে পেয়েও চিনতে পারে নি তাকে। নিজের ওপর, খেয়ার উপর শুধু রাগই হচ্ছে ওর। খেয়া মায়ের বুকে মুখ গুজে রাকীনের ওই চাওনি পরখ করে চলেছে। নাফিজা বেগম মেয়েকে আদর করে দিয়ে কাতরভাবে বললেন,

-খুব কষ্ট হয়েছে তোর মা? খুব কষ্ট হয়েছে?

-না মা। সাহেরা মা এতোটুকোও কষ্ট পেতে দেয়নি আমাকে। সবসময় আগলে রাখতো।

-কেনো রাখবে না খেয়া? তুমিই তো তার বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিলে। তোমাকে আগলে না রাখলে, কি নিয়ে বাচতো সাহেরা?

রাকীন বাদে দরজায় তাকালো সবাই। ওর দৃষ্টি খেয়ার দিকেই স্থির। সাদিক সাহেব এসেছেন। উনি ভেতরে ঢুকতেই খেয়া বললো,

-সাদিক কাকা, আমি…

-শান্ত হও‌ খেয়া। আজ আমি বলি?

খেয়া থামলো। সাদিক সাহেব বললেন,

-অনেক আগেই এগুলো বলা উচিত ছিলো আমার। কথাগুলো আমার আগে তোমারই‌ জানা উচিত ছিলো। কিন্তু সাহেরা চায়নি বলে হয়নি। মারা যাওয়ার আগে সাহেরা বলেছিলো, মরনরোগে আক্রান্ত ছিলো বলে স্বামীরঘর ছাড়তে হয়েছিলো ওকে। বাচার জন্য কোনো অবলম্বন অবশিষ্ট নেই‌ দেখে যখন ঠিক করলো আত্মহত্যা করবে, ঠিক তখনই তোমাকে স্মৃতিহারা মেয়ে হিসেবে পেয়ে যায় সাহেরা। মাতৃত্বের লোভ সামলাতে পারেনি ও। তেমনি না কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো তোমাকে হারানোর ভয়। তাইই তোমাকে ঘিরে ওর এতো আড়াল ছিলো খেয়া। সাহেরার ইচ্ছে ছিলো, ওর মৃত্যুর পর যেনো আমি তোমাকে তোমার আসল ফ্যামিলি খুজে দেই। নিজের মতো করে চেষ্টা চালাবো বলেছিলাম। কিন্তু ছেলের কথা ভেবে স্বার্থপর হয়ে পরি একসময়। না তোমার স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা করেছি, না তোমার পরিবারকে খোজার। আমার‌ সেই স্বার্থপরতার জন্যই আজ তোমাদের এই পরিস্থিতি ফেইস করতে হচ্ছে। চার চারটে সাজানো জীবনে তান্ডব শুরু হয়েছে। সবটার জন্য আমিই দায়ী।

এতোক্ষন হলো এককোনে দাড়িয়ে খেয়া, নাফিজা বেগম আর নওশাদ সাহেবের খুশি দেখছিলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেবের কথা এবার এগিয়ে আসলো ও। বললো,

-দায় কেনো নিচ্ছেন? আপনাকে তো আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আঙ্কেল।

-ধন্যবাদ মানে?

-ধন্যবাদই বটে। আজ আপনি যদি ভাদুলগায়ে না যেতেন, খেয়াকে কি করে শহরে ফিরে পেতাম আমরা বলুন তো? এইযে ওকে‌ আমরা ফিরে পেলাম, এর সব ক্রেডিট তো আপনারই! তাই গিল্টিফিল করে আমাদের ছোট করে‌ দেবেন না প্লিজ! রিকুয়েস্ট করছি!

মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে, ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সাদিক সাহেব। নাফিজা বেগম খেয়াকে ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ইচ্ছের সামনে দাড়িয়ে বললেন,

-তোর সাহেরা মাকে হারিয়ে যে যন্ত্রনা তুই এই ক দিনে পেয়েছিস, একই যন্ত্রনা সয়ে, তোর বড়মাকে হারানোর পর, ইচ্ছে কিভাবে বেচে আছে খেয়া?

টলোমলো চোখ তুলে নাফিজা বেগমের দিকে তাকালো ইচ্ছে। বুঝেই উঠতে পারলো না কি বলবে। নাফিজা বেগম একহাত ইচ্ছের গালে রেখে বললেন,

-যে মেয়ে আমার কথার অগ্নিবর্ষনের প্রতিত্তর যুক্তির জালে দমন করে, আজ তার চোখে জল? এ বর্ষনে আমায় শুচি করতে পারবি মা?

-আমি সত্যিই তোর মা হওয়ার যোগ্য নই ইচ্ছে। কোনোদিনও, এতোটুকোও বুঝতে চাইনি তোকে। তোর মতো মেয়ের মা হওয়ার সৌভাগ্য, যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। সে সৌভাগ্য শুধু বড় আপাকেই মানাতো। তাইতো সে তোর মা। আর আমি তোর এস এম। সৎ মা।

-কেনো যেনো আজ খেয়াকে ছেড়ে তোকে আদর করতে ইচ্ছে করছে মা। তোকে একটু আদর করতে দিবি আমাকে? অল্প একটু?

টুপটাপ জল গরালো ইচ্ছের চোখ থেকে। যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর সবটা। আস্তেধীরে ও কপাল এগিয়ে দিলো নিজের। নাফিজা বেগম ওর দুগাল ধরে কপালে চুমো দিলেন। বাস্তবতা টের পেতেই নাফিজা বেগমকে শক্তকরে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছে। উপরওয়ালা আজ যেনো দুহাত ভরে ভরিয়ে দিচ্ছে ওকে। নাফিজা বেগম আজ প্রানভরে আদর করলেন ইচ্ছেকে। এতে সবচেয়ে বেশি খুশির হাসি খেয়ার ঠোটে। ওকে হাসতে দেখে এতোটা সময় পর রাকীন বলে উঠলো,

-আজ তোর এনগেইজমেন্ট হওয়ার কথা ছিলো খেয়া?

রাকীনের মুখে নিজের নাম শুনে, চমকে উঠলো খেয়া। ছোটবেলার খেলার সাথী হলেও, বরাবর রাকীনকে ভয় পেতো ও। আজ যদি খই পরিচয়ে ও এখানে থাকতো, হয়তো এই ভয়টা একবিন্দুও কাজ করতো না ওর। হয়তো খই বলতো, তুমিও তো বিয়ে করে নিচ্ছো নকশাদার। এমনটা ভেবে, রাকীনের দিকে একপলক তাকিয়ে, তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিলো খেয়া। বলতে পারলো না কিছুই। রাকীন এগোলো ওর দিকে। নাফিজা বেগম তখনও ইচ্ছেকে জরিয়ে। ইচ্ছে বুঝলো, দুজনের মধ্যে জমা অভিমানগুলো বেরিয়ে আসবে এবার। বললো,

-এখান থেকে চলো মা। ওরা কথা বলুক।

চলে আসবে বলে পা বাড়াচ্ছিলো সবাই। রাকীন ততোক্ষনে খেয়ার বেডে গিয়ে বসেছে। কেবিন থেকে একজনও বেরোনোর আগে, আঙুলে থাকা আংটিটা খুলে খেয়ার আঙুলে পরিয়ে দিলো রাকীন। ওর কাজে বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো সবাই। খেয়ার বিস্মিত চাওনি দেখে রাকীন স্বাভাবিক গলায় বললো,

-নে! হয়ে গেছে তোর এনগেইজমেন্ট!

-রাকীন!

-আমি ছাড়া তুই অন্যকারো না খেয়া। তুই শুধুই আমার। খেয়া, রাকীনের! মাথায় বসিয়ে নে! এমনভাবে বসিয়ে নে, যেনো অভিমানের আগে রাকীনের পাগলামোর কথা মনে পরে তোর। এই বারোবছরের শাস্তির কথা মনে পরে তোর! আমার কষ্টগুলোর কথা মনে পরে তোর!

চোখ ফেটে আবারো জল গরালো খইয়ের। আস্তে করে মাথা ঠেকালো ও রাকীনের বুকে। দুহাতে জরিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো রাকীন। কতোদিন হলো এই বুকে হাহাকার, শুন্যতা। আজ তা সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষেই স্বস্তিতে ভরে উঠেছে। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে মুচকি হেসে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো সবাই। খেয়াকে নিয়ে রাকীনের পাগলামোর সীমা জানে তারা। ইচ্ছে করিডরে আসতেই দেখে প্রাপ্ত দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে। উপস্থিতি জানান পেতেই, ইচ্ছের দিকে চেয়ে চেয়ে নিরবে অশ্রুবিসর্জন দিতে শুরু করেছে প্রাপ্ত। অপরাধবোধে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে ওর। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সবাই। শুধু ইচ্ছে দাড়ালো। এগিয়ে এসে, একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-আমি জানতাম, পুরো পৃথিবী একদিকে থাকলেও, যে আমার ঠোটে হাসির কারন, যাকে আমি ভালোবেসেছি, যার কাছে আমার প্রেমনোঙর ঠায়, শুধুমাত্র সেই আমাকে, আমার ভালোবাসাকে ডেফাইন করতে পারবে। অন্য কেউ না। ভুল ছিলাম আমি প্রাপ্ত। আমার বোঝা উচিত‌ ছিলো, আমি ভালোবেসেছি তো কি? তুমি তো না আমায় ভালোবেসেছো, না আমার ভালোবাসাকে বুঝেছো। তোমার প্রেমনোঙর তো অন্য তরীর মালিকানাধীন। না বুঝেই বিয়ের আসর ছেড়েছিলাম, আমার একপাক্ষিক ভালোবাসার পাগলামো দেখাবো বলে। সত্যিই অনেকবড় ভুল করে ফেলেছি। তাইনা প্রাপ্ত?

প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধলো প্রাপ্তর কাছে। এবার আর ও সামলাতে পারলো না নিজেকে। জাপটে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছেকে। ওর চুলে মুখ গুজে দিয়ে কাদতে কাদতে বললো,

-ভুল তো আমি করেছি ইচ্ছে! ভুল তো আমার! যার দায়িত্ব নেবো বলে তোমার প্রতি ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছিলাম, তাকেই মৃত্যুমুখে দেখে মাথা ঠিক ছিলো না আমার। সাফোয়ানের কাছে যখন শুনলাম খেয়া তোমার গাড়িতেই এক্সিডেন্ট করেছে, আমি নিজেকে বুঝাতে পারিনি, ইচ্ছে এমনটা করতে পারে না। ভুল আমার ইচ্ছে! সব ভুল আমার! সীমাহীন ভালোবেসেও বলিনি ভালোবাসি। তাইতো আজ এই দিনটা দেখতে হলো তোমাকে। কথা দিচ্ছি এমন ভুল আর কোনোদিনও হবে না। আর কখনো তোমার কান্নার কারন হবো না মিস রকস্টার। ভালোবাসি তোমাকে। খুব ভালোবাসি!

প্রাপ্তর কাছে এইবার ভালোবাসি শুনে বুকভরে শ্বাস নিলো ইচ্ছে। ও জানতো, প্রাপ্ত ঠিক বুঝবে সবটা। প্রাপ্ত বলে চলেছে নিজের মতো করে। আর ইচ্ছের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। প্রাপ্তর বলা কথাগুলো মাথায় ঢুকছে না আর কিছুই। ইচ্ছে টলোমলো শরীরটা কিঞ্চিত সামনে এনে একহাত প্রাপ্তর গালে রাখলো। তারপর মিহিস্বরে বললো,

-আমিও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। বয়ে চলা স্রোতস্বীনীর মতো হয়েও, বরাবর, আমি শুধু তোমাতেই আটকেছি মিস্টার গ্যাংস্টার। প্রেমনোঙর ফেলে।

কথা শেষ করেই মুখে হাসি ফোটালো ইচ্ছে। প্রাপ্তও হাসিমুখ করে ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিলো। ইচ্ছে কি বুঝলো, প্রাপ্তর দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

-আমার হাজারো প্রাপ্তি আর পুর্নতার খাতায়, তুমি সর্বোচ্চ অপুর্নতা প্রাপ্ত। এতো বেশি ভালোবেসেছি যে, সেখানেই বোধহয় আমার ইতি আঁকা। তবুও! তোমাকে ভালোবাসি মিস্টার গ্যাংস্টার। ভালোবাসি।

প্রাপ্তর হাত থেমে গেলো। কথাদুটো বলে হঠাৎই দুবার জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে‌ ওর হাতে ঢলে পরলো ইচ্ছে। বড়বড় চোখে স্তব্ধতা নিয়ে হাতে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেছে। কাপাকাপা হাতে ইচ্ছের গলায় আলতোভাবে স্পর্শ করলো প্রাপ্ত। ফিসফিসিয়ে ডাকলো বারদুয়েক। ইচ্ছে সাড়া দিলো না। হাতে তরলের উপস্থিতি টের পেয়ে ইচ্ছের গলা থেকে কাপতে থাকা হাত উপরে তুলে ধরলো প্রাপ্ত। কান দিয়ে রক্তক্ষরন হয়েছে ইচ্ছের। কানের পাশ বেয়ে গলার দিকটা র’ক্তে ভিজে উঠেছে। অবিশ্বাসে সেকেন্ডদুই তাকিয়ে থেকে, দুহাতে শক্ত করে ইচ্ছেকে জরিয়ে ধরলো প্রাপ্ত। গগনবিদারক চিৎকার করে বলে উঠলো,

-এটা কি করলে তুমি? কি করলে এটা? যেটুকো বলে তোমার ভালোবাসাকে অপমান করেছি, তার জন্য শাস্তি প্রাপ্য আমার! কিন্তু তাই বলে এমন শাস্তি দিও না আমাকে ইচ্ছে! এমন শাস্তি দিও‌ না! এখনো তো ইচ্ছেনদীর ভালোবাসার স্রোতে গা ভাসানো বাকি! এখনো তো তোমার নামের প্রেমযমুনায় প্রেমনোঙর ফেলা বাকি! চোখ খোলো ইচ্ছে! প্লিজ চোখ খোলো! ভালোবাসার উত্তল ঢেউ হয়ে এসে, এভাবে‌ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে, নিজেকে দুরে সরিয়ে নিতে পারো না তুমি ইচ্ছে! পারো না!
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩৬.

-মিস ইনায়াতের এক্সিডেন্টের প্রায় ছ ঘন্টা পার হয়ে গেছে মিস্টার রাকীন। আর তার মাথায় আঘাতটাও ঠিক তখনই লেগেছে। ব্রেইনে ব্লিডিং শুরু হয়েছে তখন থেকেই। শুরুর দিকে বলে তিনি হয়তো তৎক্ষনাৎ টের পাননি। কান দিয়ে আসা অল্পবিস্তর র’ক্তকে ইগ্নোর করেছেন। এখন এতোটা সময় পর ব্লিডিং বেড়েছে। পুরো দিন না খাওয়া উনি। ফিজিক্যালি উইক হয়ে ব্লাডও ডোনেট করেছেন দু ব্যাগ।

এটুকো বলে ডক্টর থামলেন। সামনের মানুষগুলোর বিদ্ধস্ত রুপ দেখে আরও বলার পুর্বে তার সাহস সঞ্চার করা প্রয়োজন। জ্ঞান হারানোর পর ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রক্তক্ষরন থেমেছে। তবে জ্ঞান ফেরেনি ইচ্ছের। ডক্টরের সামনের চেয়ারে রাকীন, নওশাদ সাহেব অসহায়ের চাওনি নিয়ে বসে। আর এককোনে দুহাত মুঠো করে, মেঝেতে দৃষ্টিস্থির করে প্রাপ্ত দাড়িয়ে। হাতের তালুর উপরপিঠ থেকে র’ক্ত ঝরছে ওর। ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর করা পাগলামিতে, করিডরের দেয়ালেও লেগেছে সে র’ক্ত। কথাগুলো শোনার পর আরো প্রাপ্ত আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পরবে, তা বেশ বুঝছেন উনি। ডক্টর উঠে দাড়ালেন। উঠে দাড়ালো রাকীন আর নওশাদ সাহেবও। নওশাদ সাহেবের সামনে গিয়ে ডক্টর বললেন,

-ব্লিডিং আপাতত না থাকলেও, মিস ইনায়াতের এখনো সেন্স ফেরেনি। রেসপন্স করছেন না উনি। আমাদের আর কিছুই করার নেই মিষ্টার নওশাদ।

-আমার মেয়েটা আর বাচবে না। তাইনা ডক্টর?

নওশাদ সাহেবের ফাকা দৃষ্টি। খেয়াকে তো আগেই হারিয়েছিলেন। ওর অভাবে ভালোবাসা নামক অনুভূতিও যেনো হারিয়ে ফেলেছিলো ইচ্ছে। কোনোদিনও ভালোবাসা বোঝে নি তার। আজ যখন খেয়া ফিরেছে, দুই মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে, তখন দুজনকেই এই হসপিটালে দেখে কোন বাবা ঠিক থাকবে? নাফিজা বেগমকে ইচ্ছের ইমারজেন্সির দরজা থেকে সরানোই যায় নি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় পিতা বলে মনে হচ্ছিলো নওশাদ সাহেবের। রাকীন বললো,

-শান্ত হও আঙ্কেল। ইচ্ছের কিছু হবে না। ডক্টরের সাথে আমি কথা বলছি।

রাকীন সরিয়ে নিয়ে আসলো ডক্টরকে। যন্ত্রের মতো বসে রইলেন নওশাদ সাহেব। রাকীন বললো,

-ইচ্ছে কেমন আছে ডক্টর?

-উনি ভালো নেই মিস্টার রাকীন। মিস্টার নওশাদ ভুল আন্দাজ করেন নি। এভাবে সেন্সলেস থাকলে হয়তো ইনায়াতকে আমরা ব্…

কথা শেষ করার আগেই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ডক্টরের এপ্রোন দুহাতে চেপে ধরলো প্রাপ্ত। তবে ওর রক্তবর্ন চোখ আর শক্ত চোয়াল দেখে নমনীয়তা হারালেন না ডক্টর। ইচ্ছেকে ওর বাহুডোর থেকে সরানোর পর থেকেই এএন পাগলামো করে চলেছে এই ছেলেটা। প্রাপ্ত ডক্টরের এপ্রোন ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বললো,

-এই ডক্টর! আমার ইচ্ছের কিছু হবে না! ওর কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে বাচতে দেবো না! শেষ করে দেবো সব! প্রাপ্ত ওয়াদা করছে এটা! আমি…

রাকীন ঝারা মেরে ডক্টরকে ছাড়িয়ে নিলো প্রাপ্তর হাত থেকে। অবাকচোখে তাকালো প্রাপ্ত। রাকীন শক্ত গলায় বললো,

-এটা তোমার গুন্ডামো দেখানোর জায়গা না প্রাপ্ত! এট হসপিটাল। আর উনি একজন ডক্টর!

-ওকে বলো আমার ইচ্ছেকে সুস্থ্য…

-কিসের তোমার ইচ্ছে? তোমার না ইচ্ছে! বরং এসবের জন্য তুমিই দায়ী! এতোই যদি ভালোবাসো, কেনো বলোনি ভালোবাসো? যে মেয়ে এতোবড় সেলিব্রিটি হয়েও তোমাকে সময় দিতো, তোমার কাজগুলোতে তোমাকে বাধা দিতো না, তোমার একটাবারের জন্যও মনে হয়নি, সে মেয়ে তোমাকে নিয়ে কিছু তো ফিল অবশ্যই করে? একবারো ভাবনায় আসেনি সে কথা? হোক তা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, তবুও বারবার কাছে এসেছিলো ও তোমার। কেনো বলোনি ভালোবাসো ওকে? তাহলে আজ আমাদের কাউকেই এইদিন দেখতে হতো না। না ইচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো, না তুমি জেদ ধরে খেয়াকে আংটিবদল করতে রাজি হতে। কোনোটাই ঘটতো না!

চোখ নামিয়ে নিলো প্রাপ্ত। একবর্নও ভুল বলেনি রাকীন। তবে রাকীন নিজেও এভাবে বলতে চায়নি। যেটুকো ভাগ্যে লেখা, তা তো হওয়ারই ছিলো। এভাবেই ওদের চারজনের জীবন বহমান হওয়ার ছিলো। একা প্রাপ্তর তো দোষ না এতে। তবে প্রাপ্তকে থামাতে এসব বলতেই হতো ওকে। সত্যিই থেমে গেছে প্রাপ্ত। রাকীন এগোচ্ছিলো ওকে সামলাবে বলে। ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো প্রাপ্ত। দুহাত জোর করে জলভরা চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-ইচ্ছেকে প্লিজ সুস্থ্য করে দিন ডক্টর। ওকে প্লিজ ঠিক করে দিন। বাচবো না ওকে ছাড়া আমি। বাচতে পারবো না। প্লিজ ওকে বাচান ডক্টর। প্লিজ!

চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো রাকীন। ইচ্ছে যখন বলেছিলো, গ্যাংস্টারকে ভালোবাসি, কৌতুহল থেকে রাকার কাছে শুনেছে ও প্রাপ্তর বিষয়ে সবটা। রাকার ভাষ্যমতে যে ছেলে মারপিটের ভাষা ছাড়া অন্যকোনো ভাষায় বুঝাতে জানে না, আজ সে হাতজোর করে কাদতে কাদতে কথা বলছে। নত হচ্ছে। হবেই বা না কেনো? ভালোবাসার কেউ যখন মৃত্যুমুখে, তখন নিজেকে সামলানো কতোটা কষ্টের, ও নিজেও সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইচ্ছের অসুস্থ্যতার কথা খেয়া জানার পর ওর অবস্থায় গুরুতর হয়ে গিয়েছিলো। দুজনকে নিয়ে সমান ভয়ে ছিলো সবাই। আপাতত ঘুমের ঔষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে খেয়াকে। ডক্টর প্রাপ্তকে তুলে দাড় করালেন। ওর কাধে হাত রেখে বললেন,

-আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা মিস্টার প্রাপ্ত। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করছি মিস ইনায়াতকে ঠিক করার। বর্তমানে মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নত। এক্সিডেন্টাল স্ট্রোকের ক্ষেত্রে উন্নতদেশে ব্রেইন অপারেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখানে আমাদের নিউরো হসপিটালেও কিছু স্পেশালিস্ট এমন অপারেশন করেছেন। আপনারা চাইলে আমরা মিস ইনায়াতের অপারেশনের ব্যবস্থা করবো।

একটুখানি স্বস্তির শ্বাস ফেলে, ঠোট কামড়ে নিশব্দে কাদছিলো প্রাপ্ত। ডক্টর একপলক রাকীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-বাট ব্রেইন অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পসিবিলিটি খুব কম মিস্টার প্রাপ্ত। এ পর্যন্ত হওয়া সবগুলো অপারেশনে, প্রতি দশজনে একজনকে বাচাতে পেরেছে ডক্টরেরা। বাকি নয়জন ওটিতেই…

-কি বলছেন আপনি ডক্টর? সবেই তো আশার আলো দেখালেন। এখন বলছেন অপারেশন সাকসেসফুল না হলে ওটিতেই…

বিস্ময়ে বললো রাকীন। ডক্টর মাথা নিচু করে নিলো। রাকীন চুলগুলো উল্টে ধরলো নিজের। এবার ওরও ভয় করছে। ডক্টর বললেন,

-জ্বী। বিষয়টা এমনই। অপারেশন না হলে মিস ইনায়াত অসুস্থ্যতা নিয়ে হাতেগোনা কিছুদিন সার্ভাইভ করবেন। অপারেশন সাকসেসফুল হলে সুস্থ্য হয়ে যাবেন। আর না হলে ওটিতেই… এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা মিস্টার রাকীন। তবে যদি আপনারা অপারেশন করাতে চান, যা করার দ্রুত করতে হবে। নইলে মিস ইনায়াত আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পরবেন। তখন আমাদেরও করার কিছু থাকবে না।

রাকীন বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। এই অপারেশনের কথা কিভাবে বলবে নওশাদ সাহেবকে? উনি কোনোদিনও রাজী হবেন না এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশনের জন্য। বরং অপারেশন ব্যতিরেকেই ইচ্ছেকে আরো কিছুদিন ভালোবাসার সুযোগ নেবেন সে। অপারেশন করাবে না এটা বলবে বলে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো রাকীন। প্রাপ্ত হঠাৎই শান্তস্বরে বললো,

-আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন ডক্টর। ইচ্ছের কিছুই হবে না।

অবাকচোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। প্রাপ্তর দৃষ্টি মেঝের দিকে স্থির। প্রাপ্ত চোখ তুলে বললো,

-দেরি করবেন না প্লিজ ডক্টর। যা ব্যবস্থা করার, করুন। ইচ্ছের অপারেশন হবে।

ডক্টর বললেন,

-আপনার অনুমতিতে অপারেশন হবে না মিস্টার প্রাপ্ত। পেশেন্টের বাবা অথবা পরিবারের কারো অফিসিয়াল অনুমতি চাইবে হসপিটাল অথোরিটি। বোনসাইন ছাড়া এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশন কোথাও কেউই করাবে না।

-নওশাদ আঙ্কেল কখনোই এই অপারেশনে অনুমতি দেবে না প্রাপ্ত। তাকে চিনি আমি। খেয়াকে সবে খুজে পেয়ে ইচ্ছেকে হারানোর এতোটুকো ঝুকি নেবেন না তিনি এই মুহুর্তে।

রাকীনের কথায় দু দন্ড চুপ করে রইলো প্রাপ্ত। অপারেশন হবে না এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো রাকীন। আচমকাই প্রাপ্ত বলে উঠলো,

-বাবার পরিবর্তে পেশেন্টের বর অনুমতি দিলে হবে?

বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও আকাশসম বিস্ময়। প্রাপ্ত একদম স্বাভাবিক গলায় বললো,

-বলুন না ডক্টর? বিয়ের পর মেয়েদের বড় অভিভাবক তো স্বামীই হয়। নওশাদ স্যারের পরিবর্তে ইচ্ছের বর যদি বোনসাইন করে, অপারেশন করাবেন না আপনারা?

রাকীন খানিকটা জড়ানো গলায় বললো,

-কি করতে চাইছো তুমি প্রাপ্ত?

-আজ তো ইচ্ছের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ইচ্ছের বিয়ে হবে আজ। তারপর ওর বর ওর অপারেশনের জন্য বোনসাইন দেবে। অপারেশন হবে ইচ্ছের। কেউ আটকাতে পারবে না।

স্পষ্টভাষায় জবাব দিলো প্রাপ্ত। রাকীন কপাল চেপে ধরলো নিজের। একবার ভাবলো, প্রাপ্তকে থামাবে। বলবে এমন পাগলামি না করতে। পরপরই নিজেকে এর জায়গায় বসিয়ে ভাবলো, আজ ইচ্ছের জায়গায় খেয়া থাকলে, এমনটা করতে দুবার ভাবতো না ও। এমনকি বন্ধু হিসেবে এখনো ও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু সে সম্পর্কটা না ও চায়, নাইবা ইচ্ছে, খেয়া, প্রাপ্ত বা ওদের পরিবারের কেউ। রাকীন এগিয়ে প্রাপ্তর কাধে হাত রেখে করুনভাবে বললো,

-জেনেশুনে এতোবড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, পরে যদি ইচ্ছের কিছু…

-ইচ্ছের কিছুই হবে না মিস্টার রাকীন। ও তো প্রাপ্তর প্রাপ্য! কেড়ে নেওয়ার অধিকারবোধ খাটাবে না সৃষ্টিকর্তা।

এটুকো বলেই প্রাপ্ত নওশাদ সাহেবের দিকে এগোলো। সে পাথর হয়ে চেয়ারে বসে। প্রাপ্ত তার সামনে গিয়ে হাটু গেরে মেঝেতে বসে বললো,

-আমি,ইচ্ছে, দুজন দুজনকে ভালোবাসি স্যার। আপনি অনুমতি দিলে, আমি ইচ্ছেকে এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই।

নওশাদ সাহেব অবুঝের মতো তাকালেন প্রাপ্তর দিকে। নিজের সুদীর্ঘ জীবনে অনেক প্রেমের কাহিনী দেখেছেন। নিজেও প্রেমে পরেছেন। একবার নয়, দু দুবার। প্রথমজনকে হারানোর পর আবারো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু জীবনমরনের সন্ধিক্ষনে কেউ কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, আজ প্রথমবার দেখছেন। প্রাপ্তর দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে রইলো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও রাজ্যের বিস্ময়। মৃত্যুমুখী জেনেও যে প্রিয় মানুষটাকে বিয়ের কথা বলতে পারে, তারচেয়ে বড় ভালোবাসার প্রমান আর কি হতে পারে? যেখানে কোনো কামনা-বাসনার সুযোগ নেই, কোনো নতুন শুরুর নিশ্চয়তা নেই, সেখানেই কি করে বিয়ে নামক বাধনে বদ্ধ হবার উন্মাদনা? সেখানেই কি করে শুভ প্রেমপরিনয়ের অস্থিরতা? হয়তো ভালোবাসা আছে বলেই! হয়তো প্রেম আছে বলেই! আর এজন্যই, ভালোবাসা পবিত্র, ভালোবাসা সুন্দর…

#চলবে…
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here