প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|১৬|
আবিরের সাথে রিকশা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই চমড়া পোড়া উত্তাপ ছড়াল গায়ে। ছাতার উপর ঝমঝমে আষাঢ়িয়া নৃত্য আর শীতল হাওয়ার ঝাপটায় এক অলীক মায়া তৈরি হলো চারপাশে। রাত বাতির নিয়ন আলোয় চকচক করা পিচ ঢালা ভেজা রাস্তা। আকাশ ভরা স্তব্ধ আষাঢ়। সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে হানা দিলো পাগল করা জ্বর। শরীরের প্রতিটি রোমে রোমে তীব্র ব্যথায় ‘আহ্’ করে উঠল মন। ঠিক তখনই উপলব্ধি করলাম, ধ্রুবর প্রতি আমার ব্যথা ব্যথা প্রেম। পাশে বসে থাকা আবিরের নিরন্তর ছুটা বাক্যগুলোকে ছাপিয়ে গিয়ে উপলব্ধ হলো জীবনের আরও একটা দুর্নিবার ভুল। ধ্রুবর প্রেমে পড়াটা আমার ভুলের খাতায় লেখা হয়ে গেল সর্বপ্রথম। কিন্তু প্রেম বড় বেয়ারা, ছটফটে। কথা শুনে না একদম। যুক্তি মানে না। তর্ক শুনে না। কোমল মনটাকে দুঃসহ কষ্টে ছুঁড়ে দিয়ে, নির্ভেজাল ভালো মানুষটির মতো উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কী নির্দোষ তার চাহনি। বাচ্চা বাচ্চা তার অভিমান। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। জ্বর মাখা তপ্ত শ্বাসখানি শীতল বাতাসে ভাসতে দিয়ে আবিরের দিকে চাইলাম। পথের ধারে নির্বিকার আলো ছড়ানো রাত বাতির আলোয় অল্প অল্প দৃষ্টিবহ হচ্ছে তার মুখ। শ্যামলা মুখে ছড়িয়ে আছে হলদেটে নিয়ন আভা। কাটা কাটা নাক। সর্বদা বিস্মিত দুটো চোখ। ঠোঁট ভর্তি সরল হাসি। বৃষ্টির জলে মাথা ভর্তি অর্ধসিক্ত ঝাঁকড়া চুল। একদম ধ্রুবর মতোই শক্ত চোয়াল, প্রশস্ত কাঁধ। অথচ ধ্রুব নয়। চিবুকে তিল নেই। ধ্রুবর মতো গাম্ভীর্য নেই। নিষ্ঠুরতা নেই। নির্ভেজাল ভালো মানুষ। আহত হতে হতে ক্লান্ত মনটা এইবারে ফিক করে হেসে উঠল। কৌতুক করে বলল,
‘ এই নির্ভেজাল ভালো মানুষটার প্রেমে কেন পড়লি না নিশু? চেহারা তো একই। বরং ধ্রুবর থেকে ঢের ভালো। ও ব্যাটা তো হাসতে না পারা আশ্চর্য বেয়াদব।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনটা নেহাৎ কৌতুক করলেও কথাটা খুব মিথ্যে না। বেয়াদব ধ্রুবর প্রেমে পড়াটা খুব বড় ভুল হয়ে গেল। আমাকে একভাবে চেয়ে থাকতে দেখেই বুঝি ভ্রু কুঁচকে চাইল আবির। মুখ ভরা হাসি নিয়ে ভ্রু নাচালো। বলল,
‘ কী ব্যাপার বলো তো? এভাবে কী দেখছ? আমার জায়গায় ভাইয়া হলে ভালো হতো ভাবছ?’
আমি প্রথমটায় চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। খুব রাগ করতে চেয়েও পারলাম না। এই ছেলেটার উপর রেগে থাকা যায় না। হেসে ফেলে বললাম,
‘ উঁহু। তোমার ভাইয়ার জায়গায় তোমাকে বিয়ে করে ফেললে কত রকম লাভ পাওয়া যেতে পারে তাই ভাবছি।’
আবির চোখ বড় বড় করে চাইল। বিস্মিত চোখদুটো কপালে তুলে টি-শার্টটা উঁচু করে বুকে থুতু ছিটাল। কৃত্রিম আতঙ্ক নিয়ে বলল,
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! তুমি কী সাংঘাতিক মেয়ে ভাবি। এরপর তো লজ্জায় আমি তোমার সামনেই আসতে পারব না।’
আবিরের মুখভঙ্গি আর কথার ভাঁজে আজ সারাদিনে এই প্রথম প্রাণখোলা হাসি হাসলাম আমি। চারপাশের সকল নিস্তব্ধতাকে চিঁড়ে দিয়ে বেজে উঠল আমার উচ্ছল হাসির স্লোগান। আবির কিছুক্ষণ মুখ ভার করে বসে থেকে নিজেও হেসে ফেলল। সরল কন্ঠে বলল,
‘ হাসলে তোমায় একদম তুমি তুমি লাগে। সবসময় হাসবে।’
আমি ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখেই বললাম,
‘ তুমি কী মেডিক্যাল স্টুডেন্ট? ডাক্তার দেবর হলে সুবিধা আছে, বিনাখরচে চিকিৎসা।’
আবির হাসল। অর্ধসিক্ত চুলগুলো গোছাতে গোছাতে বলল,
‘ হুম। ফাইনাল প্রুফটা শেষ হলেই ইন্টার্ন করব।’
এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। আমি বিস্মিত হলাম। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেললাম। চমকে যাওয়া কন্ঠে বললাম,
‘ ইন্টার্ন! তারমানে তুমি…. তুমি আমার বড়! কত বড়?’
আমার চমকে উঠায় শব্দ করে হেসে ফেলল আবির। উচ্ছল হাসিটা দুই ঠোঁটের মাঝে চেপে নিয়ে তিন আঙুল নাচিয়ে বলল,
‘ খুব সম্ভবত তিন বছর।’
আমি বাক্যহারা, নির্বাক প্রাণীটির মতো মূক হয়ে চেয়ে রইলাম। প্রায় কেঁদে ফেলার মতো নির্দোষ মুখ নিয়ে বললাম,
‘ তিন বছর! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। দেখে একদম বুঝা যায় না। আমি তোমাকে… আপনাকে… মানে…তোমাকে.. ‘
হাসতে হাসতে আবিরের চোখে জল এলো এবার। বৃষ্টির ঝপটা মুখের উপর এসে পড়তেই হাসি থামাল সে। আমার অবিশ্বাস্য, বিস্মিত দৃষ্টিজোড়ার দিকে চেয়ে বলল,
‘ রিল্যাক্স ভাবি। সম্পর্কে তুমি আমার থেকে বড়। ভাইয়া আমার থেকে বড় হওয়া মানে তুমিও বড়। এতো অস্থির হচ্ছ কেন?’
এবার আমি আরও মর্মাহত চোখে চাইলাম। মুখ কালো করে বললাম,
‘ তোমার ভাইয়া তো তাহলে রীতিমতো বুড়ো আবির। তুমি কোনো বুড়ো লোকের দোহাই দিয়ে আমায় ভাবী ডাকতে পারো না। আই এ্যাম অনলি টোয়েন্টি। প্লিজ ভাবী ডাকবে না। তোমার ভাই রিজেক্টেড।’
আবিরের হাসি এবার আরও ভারী হলো। বৃষ্টি স্নাত রাতের সকল নিস্তব্ধতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে প্রাণখোলা হাসিতে প্রতিধ্বনিত করে উঠল চারপাশ। আমি মুখ গুঁজ করে বললাম,
‘ তোমরা সবাই এমন কেন? কারোরই বয়স বুঝার উপায় নেই। তোমার মা, ভাইয়া, তুমি সবাইকে দেখেই সমবয়সী মনে হয় আমার। বড়জোর দুই-তিন বছরের ছোটবড়?’
আমার কথায় বেশ মজা পেলো আবির। বাকিটা রাস্তা সে থেকে থেকেই হেসে উঠল। পেটে খিল দেওয়া হাসি হাসতে হাসতেই বার কয়েক অনুরোধ করল,
‘ ভাবি? আমাকে জোরে একটা থাপ্পড় মারো না প্লীজ। আমি কিছুতেই হাসি থামাতে পরছি না।’
আমি উদাসমুখে চেয়ে রইলাম, উত্তর দিলাম না। এরা দুই ভাই চমকের উপর চমক দিয়ে চলেছে আমায়। এসবও মেনে নেওয়া যায়?
এই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন বাসায় এসে পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন আটটা বিশ। আমার ফ্ল্যাটের ঝুলন্ত তালাটা উধাও। সুতরাং ভেতরে কেউ আছে। আমি কলিংবেল চাপলাম। দরজা খোলার আগপর্যন্ত সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল আবির। প্রিয়তা দরজাটা হালকা ফাঁক করে মাথা বের করল। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে একরকম চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ কোথায় ছিলি নিশু! আমার ফোন ধরছিলি না কেন?’
আমি রাগ চোখে চাইলাম। আবিরকে চোখের ইশারায় বিদায় দিয়ে চুপচাপ ভেতরে ঢুকলাম। এতোক্ষণ থিতিয়ে থাকা জ্বরটা ঝেঁকে উঠল মাথায়। চোখদুটোতে আগুনের হল্কা। প্রিয়তা আমার পিছু পিছু ঘ্যানঘ্যান করছে। আমি নিজের ঘরে গিয়ে দোর টানলাম। শান্ত চোখে চেয়ে বললাম,
‘ ক্লান্ত লাগছে। বিরক্ত করিস না।’
প্রিয়তা বিরক্ত করল না বরং মহাবিরক্ত করার প্রস্তুতি নিল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু এই ধ্রুব ব্যাটা জুটলো কী করে তোর সাথে?’
‘ ওটা ধ্রুব না আবির ছিল।’
দরজাটা বন্ধ করেই উত্তর দিলাম আমি। প্রিয়তা ওপাশ থেকে হাজারও ছক কষতে বসলো৷ উত্তেজনায় ছটফট করে কাকুতি মিনতি করল। আমি দরজা খুললাম না। ভেজা জামাটা গায়ে রেখেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। জ্বরটা হুহু করে বাড়তে লাগল। বৃষ্টি আর হাওয়ার মিশেল ঝাপটায় চঞ্চল হয়ে উঠল চুল। চারতলার উপর থেকে বৃষ্টিস্নাত ঝাপসা এই ময়মনসিংহ শহরটিকে দেখেই চট করে মনে পড়ে গেল অতৃপ্ত এক তৃপ্তির কথা। যাকে আমি কক্ষনো দেখিনি সেই মায়ের কথা। বাবা বলেন মা ছিলেন বৃষ্টিবিলাসী ছটফটে রমনী। বড় ভাইয়ার যখন পাঁচ বছর বয়স ছোট ভাইয়া তখন মাস কয়েকের ছেলে। ময়মনসিংহ শহরে তুমুল বৃষ্টি। রাস্তাঘাট জলে জলে একাকার। মায়ের ঘরটা ছিল ছাদের ঘরের পাশে। আমার নানুর শেষ বয়সের ছেলে ছিলেন ছোট মামা। ছোট মামার বয়স তখন কেবল আট বছর। সারাদিন তিরা আপা, তিরা আপা করে মায়ের পেছন ছুটতো। মা ছোট ভাইয়াকে ছোট মামার কোলে বসিয়ে নেমে গেলেন সেই ঝমঝমে আষাঢ়ে বর্ষায়। এই ঝমঝমে বৃষ্টিতে প্রিয় আপাকে নাইতে দেখে মামারও আর তর সইলো না। কিছুক্ষণ পরই ময়মনসিংহের বিস্মিত আকাশ চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে দেখলো বছর ছাব্বিশের এক যুবতি মাস ছয়েকের এক বাচ্চা কোলে রেলিঙহীন ছাদে বৃষ্টিবিলাস করছে। ভয়হীন, নির্বিক আঁচলখানি বাতাসে উড়ছে। জবজবে শাড়িটা ল্যাপ্টে আছে তার লতানো গায়ে। আহ, কী দৃশ্য! সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরে, ভয়ঙ্কর নারীটির কথা চিন্তা করেই কেঁপে উঠলাম আমি। এই ভারী বাতাসের দিকে চেয়ে হুহু করে উঠল বুক। সেই ভয়ঙ্কর নারীটি আর নেই। শুধুমাত্র আমাকে আলো দেখাতে গিয়ে চিরতরে বিলীন হয়ে গিয়েছে দুঃসাহসিক সেই প্রাণ। এই আকাশে, এই বাতাসে কোথাও নেই তার অস্তিত্ব। অথচ আজ থেকে বিশ বছর আগেও এমনই এক আকাশের নিচে নির্বিক ছুটে চলেছে সেই নারী। কী চপল তার পদচিহ্ন! সেই চিন্হগুলো আর নেই। কোথাও নেই। এই ময়মনসিংহে সে আর আসে না। এই বৃষ্টিকে সে আর ভালোবাসে না। বুকের ভেতর থেকে ছুটে এলো একমুঠো তপ্ত শ্বাস। আচ্ছা, বাবা-ভাইয়ার কী রাগ হয় না আমার উপর? অভিমান হয় না আমার মতো? হওয়া উচিত। সেই দুঃসাহসিক প্রাণের বিনিময়ে নিরবিচ্ছিন্ন শ্বাস নেওয়ার অপরাধে অভিমান হওয়া উচিত। বেশ কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে ফোনের শব্দে ঘাঁড় ফিরিয়ে চাইলাম। ঘরে ফিরে অনেক খুঁজে পেতে ফোনটা বের করেই দেখলাম বড় ভাইয়ার নাম। ফোনের স্ক্রিনজুড়ে বড় ভাইয়ার নির্মল হাসি হাসি মুখ। বাবা বলে, ভাইয়া একদম মায়ের মতো দেখতে। তেমনই টিকল নাক। বড় বড় পাপড়িতে ঢাকা চোখ। হলদে ফর্সা গায়ের রঙ। সুন্দর, একহারা গড়ন। আমি ফোন রিসিভ করতেই খুব আদুরে কন্ঠে ডাকল ভাইয়া,
‘ বাচ্চা? কী করা হয়? ভাইয়াকে মনে পড়ে?’
ভাইয়ার আদুরে আওয়াজটা যেন মস্তিষ্কে ঝনঝনে শব্দ তুললো অনেকক্ষণ। মনটা নিজের অজান্তেই ঝুপ করে আহ্লাদী হয়ে উঠল। তারপর আবারও ভার হয়ে উঠল হঠাৎ। মন খারাপ করে বললাম,
‘ তোমার আমার উপর রাগ হয় না ভাইয়া?’
ভাইয়া অবাক হলো,
‘ রাগ! রাগ কেন হবে?’
‘ বাবা বলে মা তোমায় সব থেকে বেশি ভালোবাসতো। তুমি মাকে ছাড়া ঘুমোতে না। খেতে না। আমার জন্য মা নেই। তোমার রাগ হয় না? আমার খুব রাগ হয়।’
ভাইয়া থমকে গেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। চুপচাপ কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। প্রশ্নটা খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘ আমি তোকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। মাকে যতটুকু ভালোবাসতাম হয়তো তার থেকেও বেশি।’
তারপর আর কথা এগুলো না৷ কেউ ফোন কাটলো না। ফোনের দুপাশে বসে থেকেই বুঝতে পারলাম দুটো মনেই চলছে একই রমণীকে হারিয়ে ফেলার দহন। নারীটি আমাদের মা। আমাদের এক অতৃপ্ত তৃপ্তির নাম। আমার বুকটা হুহু করে উঠল। ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
‘ আমি মায়ের কাছে যাব, ভাইয়া। সবার মা আছে। শুধু আমাদের নেই কেন?’
ভাইয়া এবার অসহায়বোধ করল। নিরুপায় কন্ঠে বলল,
‘ আমাদের যে একটা পরি আছে, সোনা।’
আমার মন মানলো না। নিজের মতো অভিযোগ তুলে বললাম,
‘ উপরতলার ছেলেটার মা আছে। মাকে নিয়ে কত ভাব দেখায় জানো? ভয়ও পায়। আমার মা থাকলে বুঝিয়ে দিতাম। সব ভাব ছুটে যেতো। বেয়াদব ছেলে।’
ভাইয়া হেসে ফেলল। শব্দ করে হেসে উঠে বলল,
‘ তুই কখনো বড় হোস না পরি৷ তোকে ছোট্টই থাকতে হবে। তোর বয়সটা এখানেই আটকে যাক, পাগলী।’
সারাটা রাত মায়ের কথা, ধ্রুবর কথা মনে করতে করতেই কাটিয়ে দিলাম। রাতের শেষে, ঘুমে ভারী হয়ে আসা চোখ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সিদ্ধান্ত নিলাম, অনেক হয়েছে। আর নয়। এই বাসাটা যত তাড়াতাড়ি ছাড়া যায়, ছেড়ে দেব। ধ্রুবকে নিয়ে আর ভাববো না। কদাপি নহে! কিন্তু ভাগ্য বিধাতা আমার সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি বোধহয় হলেন না। পুবাকাশে সূর্য উঠতেই ধুপ ধুপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে দরজাটা খুলে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রিয়তা ঘরে ঢুকেই জানালার পর্দা সরালো। ভোরের নরম আলোয় ঘরটা ভরে যেতেই চোখের উপর হাত তুলে দিলাম আমি। বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘ আহ! সকাল সকাল জ্বালাচ্ছিস কেন বলতো? লেট মি স্লিপ। নিজের ঘরে যা।’
প্রিয়তা আমার কথায় কান দিলো না। আমার পাশ ধপ করে শুয়ে পড়ে বলল,
‘ কিছু পড়েছিস? পরীক্ষা দিবি না, জান?’
আমার ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গিয়ে চোখ মেলে তাকালাম। অবাক হয়ে বললাম,
‘ পরীক্ষা? কীসের পরীক্ষা?’
প্রিয়তা হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ আজকে আমাদের কোর্স ফাইনাল জান। ভুলে গিয়েছিস?’
প্রিয়তার কথায় গোটা আকাশটা টুপ করে ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে আসন্ন পরীক্ষার চিন্তায় বেদুইন হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। কী করে না পড়েই পরীক্ষায় চট করে ভালো রেজাল্ট করে ফেলা যায়, চিন্তা করলাম। চিন্তা বেশিদূর এগুলো না। পরীক্ষায় পাশ করে ফেলার মতো কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেল না। আমার মান্ধাতার আমলের অলস মস্তিষ্কটা খুব একটা খোঁজাখুঁজিও করল না। বহুদিন পর নোটিফিকেশন পাঠিয়ে নিজের বিরক্তি জানাল, ‘ একটা পরীক্ষায় তো? পরের পরীক্ষাটা ঝাক্কাস দিবি। পড়াশোনা করবি। এমনিতেও ফালতু লোকের প্রেমে পড়ে বিরাট জ্বালিয়েছিস। এখন আর চিন্তা-ভাবনা করতে ইচ্ছে করছে না। প্লীজ, গো টু স্লিপ।’ আমি বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিলাম। ফোনে পরীক্ষা শুরু হওয়ার বিশ মিনিট আগের এলার্ম সেট করে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
টানা তিন ঘন্টা ঘুমিয়ে যখন পরীক্ষার হলে গেলাম তখন নয়টা বিশ। প্রফেসর চলে এসেছেন। পরীক্ষার খাতা-টাতা দিয়ে বিদিগিস্তা অবস্থা। আমি আর প্রিয়তা খুব ধীরস্থিরে ভেতরে ঢুকলাম। খাতা আর প্রশ্নপত্রটা হাতে তুলে নিতেই মস্তিষ্ক দ্বিতীয় সিগন্যাল পাঠাল, ‘ আনকমন কনটেমপ্লেশন! আনকমন কনটেমপ্লেশন! উই কান্ট হেল্প।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বেয়াদব মস্তিষ্ককে ছুটি দিয়ে মনের দুয়ারে দাস্তানা দিলাম। মন বেচারা আমায় খুব একটা হতাশ করলো না। মনের মাধুরি মিশিয়ে মনের সব সাহিত্য সফেদ খাতায় উগরে দিয়ে কাতর প্রার্থনা করলাম, ‘ হে আল্লাহ! এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও বিধাতা। নেক্সট টাইম জব্বর পড়াশোনা করব। মসজিদে গুণে গুণে একশো টাকা দিব। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো, প্রমিজ!’ বিধাতা আমার কথা বিশ্বাস করলেন কী-না বুঝা গেল না। তবে জীবনের সব থেকে জঘন্য পরীক্ষাটা শেষ করে বেরিয়ে আসার ঠিক আগমুহূর্তে প্রফেসর আমায় ডেকে পাঠালেন। এতোগুলো ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়ে আমার উপর প্রফেসরের এই সদয় দৃষ্টিতে বিস্মিত হলাম। ঘাড় ফিরিয়ে অবাক চোখে চাইতেই বললেন,
‘ এইযে, আপনাকেই বলছি। পরীক্ষা কেমন দিলেন, মিস?’
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে মাথা দোলালাম। বললাম,
‘ জি, ভালো।’
প্রফেসর আমার থেকে চোখ সরিয়ে পাশে থাকা কৌতূহলী ভদ্রমহিলাকে বললেন,
‘ ধ্রুবর কথা মনে আছে না? দ্য এক্সিলেন্ট বয়। ইনি ধ্রুবর বান্ধবী। স্পেশাল ফ্রেন্ড।’
এত্তো সিনিয়র একটি ছেলের এই অল্প বয়স্কা মেয়েটি কী ধরনের বান্ধবী হতে পারে তা চট করেই বুঝে গেলেন ভদ্রমহিলা। খাতা গোছাতে গোছাতেই চশমার উপর দিয়েই তীক্ষ্ণ চোখে চাইলেন। নিজের ছেলের জন্য মেয়ে দেখছেন এমন তীব্র তার মাপ ঝোক। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম। স্যারকে কী ধ্রুব আর আমার কমপ্লিকেশনটা বলে দেওয়া উচিত? বুঝে উঠতে পারলাম না। ভদ্রমহিলা আমাকে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করে বললেন,
‘ ধ্রুব তো দূর্দান্ত স্টুডেন্ট ছিল। তার বান্ধবীর পরীক্ষাও তো তাহলে ভালো হওয়ার কথা। ফোর আউট অব ফোর হবে?’
শেষ প্রশ্নটা শুনেই মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। পাশ করাই যেখানে দুষ্কর সেখানে ফোর আউট অব ফোরের প্রশ্ন তুলছেন মিষ্টার ব্রিলিয়ান্টের ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষকরা। আমি শুকনো হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আশা আছে। দেখা যাক।’
বুকের ভেতর বসে থাকা মনটা কটমট করে চাইল। মস্তিষ্কও সচল হয়ে উঠল চট করে। কৌতুক করে বলল,
‘ ঘোর কলি যুগ। পাপিষ্ঠ! পাপিষ্ঠ! এতোবড় মিথ্যাটা বলতে তোর মুখ কাঁপলো না নিশু?’
আমি উত্তর দিলাম না। প্রফেসরের সাথে কথা বলে উদাস মুখে বেরিয়ে এলাম। জীবনের প্রথম উপলব্ধি করলাম, ‘ভাই-বোন মেধাবী হওয়ার থেকে প্রেমিক মেধাবী হওয়া মারাত্মক। মেধাবী ছাত্রের ছোটদের ছাড় দেওয়া গেলেও মেধাবী ছাত্রের প্রেমিকাকে ছাড় দেওয়া একেবারে অসম্ভব!’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। স্যার-ম্যাম আমার খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখলে মনে মনে কেমন জঘন্য গালি দিতে পারে চিন্তা করলাম। চিন্তা বেশিদূর এগুলো না। দগদগে মেজাজটা আরও একটু দগদগে হয়ে উঠতেই ফুঁসে উঠলাম আমি। গজগজ করে বললাম,
‘ এই ধ্রুবকে তো আমি দেখে নিব, প্রিয়। বেয়াদব পুরুষ মানুষ। মেধাবী হয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে আমার। ব্যাটাকে কে বলেছিল এতো মেধাবী হতে? ক্যাম্পাসে এতো পপুলার হতে? তাও আবার আমার মতো নিষ্পাপ বাচ্চার প্রেমিক হয়ে ঝুলে পড়ার পর! আশ্চর্য!’
#চলবে….
[