‘প্রেম প্রাঙ্গণ’🍂
|পর্ব-২২|
~সুনেহরা শামস
.
.
ব্রিজের কিনারা ঘেঁষে হাত ধরে একে অপরের হেটে চলেছে প্রেম আর প্রাঙ্গণ।মৃদু বাতাস ঘেঁষে দেহ এপার-ওপার হয়ে যাচ্ছে।চাঁদ মাথার উপর আলো ছড়াচ্ছে,,নিচে নদীর ঢেউয়ের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।তার মধ্যে কিছু গাড়ী গুলির বেগে ছুটে চলেছে।গাড়ির হেডলাইট গুলো কি সুন্দর রঙ ফালিয়ে যাচ্ছে,,উপরের নিয়ন লাইটগুলো রাস্তায় আবছা আলোর মতো দেখাচ্ছে।মোটামুটি সুন্দর একটা পরিবেশ!একদম চমৎকার!
প্রাঙ্গণের গায়ে টি-শার্ট এর উপর কালো রঙা শার্ট!প্রেমের গায়ে ঢিলাঢালা কুর্তি আর পায়ে কনভার্স!
প্রেমের হাত এখন প্রাঙ্গণের ঠান্ডা হাতের মুঠোয়!এতদিন পর এরকম একটা পরিবেশে দারুণ লাগছে প্রেমের!পাশে প্রাঙ্গণ!যেন নিজের রকটা নিরাপদ জায়গা খুজে পেয়েছে সে…প্রাঙ্গণ সামনের দিকে চেয়েই হাটতে হাটতে বলে উঠে,,
“প্রেম!”
“হুম”
“কেমন লাগছে?”
“অনেক ভালো!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ!”
কিছুক্ষন পর প্রেম নিজ থেকে বলে উঠে,,
“আপনার কেমন লাগছে?”
প্রাঙ্গণ কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠে,,
“উমমম,,ভালো!”
“শুধু ভালো?”
“হুম,,কেন বলো তো?”
“এমনেই”
“ওহ আচ্ছা”
তারপর আবার দুজনই চুপ,,কিছুক্ষন এভাবে হাটার পর প্রাঙ্গণ বলে উঠে,,
“চলো ঐপাশটায় গিয়ে দাঁড়াই,,”
.
প্রেম কিছু বলে না,,কেবল প্রাঙ্গণকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু যায়।
একসাথে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে,,ঠান্ডা বাতাসে প্রেমের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে,,সেদিকে প্রাঙ্গণের দৃষ্টি নিবদ্ধ।প্রেম অনেক্ষন প্রাঙ্গণের সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে ঘুরলে দুজনের চোখাচোখি হয়।প্রেম চোখ নামিয়ে নেয়,,দূরের জ্বলজ্বল করা পানিগুলোর দিকে চ্র্যে বলে উঠে,,
“আইজাকে ভীষণ ভালোবাসেন তাই না?”
তড়িৎ দৃষ্টিতে প্রাঙ্গণ প্রেমের দিকে তাকায়,,বলার ধরণ বিষন্ন ছিল।প্রাঙ্গণ বুঝে!আগে থেকেই সে জানে যে প্রেম তাকে ভালোবাসে ভীষণ,,হয়তো আইজার মতো করেই।কিন্তু প্রাঙ্গণ?একবার ভালোবাসাকে হারিয়েছে,,শুদ্ধ ভালোবাসার উপর বিশ্বাস তো সেদিনই হারিয়েছিল যেদিন মা-বাবার তার প্রতি কৃত্রিম ভালোবাসার দেখা পেয়েছিল।আর কথা রইল আইজার?তার প্রতি প্রাঙ্গণের আলাদা একটা সম্মান কাজ করত,,এই মেয়েই তাকে নিজের মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল যখন জীবনে ভালোবাসার মানুষের ভীষণ অভাব ছিল।প্রাঙ্গণের পাই টু পাই খেয়াল রেখেছিল সে,,কখনো বুঝতেই দেই নি যে তার বাবা-মা তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।কেননা তখন একটা আস্থার জায়গা ছিল।কিন্তু এখন??প্রশ্নগুলো এখন অনেক ভাবায় প্রাঙ্গণকে।প্রেমের তো কোনোই দোষ ছিল না,,কিন্তু সে তাকে নিজের কাজে ব্যবহার করে গেছে কেবল,,কিন্তু এখনতো আর তার হাতে কিছুই নেই……
“বলুন না!”
প্রেমের কথায় প্রাঙ্গণ হালকা হেসে বলে উঠে,,
“আমাদের জীবনটা অনেক আলাদা সবার থেকে প্রেম!তোমারও,আমারও আবার সাহিলেরও!আমাদের জীবন কিন্তু সুহার জীবনের মতো সহজ-সরল ছিল না।তুমি তোমার বাবার এই নির্মমতা দেখেছ,,আমি আমার বাবা-মায়ের বিশ্বাসঘাতকতা পেয়েছি,,নিজের জীবনের অনেক বড় একটা অংশ হারিয়েছি।সাহিল নিজের বাবার আশে-পাশে থেকেও বাবার ভালোবাসা পায়নি,,মা নিজের পাপ ঢাকতে তাকে ফেলে এসেছিল।কতটা কঠিন ছিল আমাদের জীবন তোমার থেকে,,একবার অনুভব করতে পারো?”
“আমার প্রশ্ন এটা ছিল না প্রাঙ্গণ!”
“জানি,,কিন্তু কিছু কথা সংযোজন না করলে সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পূর্ণ হয় না।জানো যখন বাবা প্রথম আমার হাতে ধারালো চাকু ধরিয়েছিল একজন মানুষকে মারার জন্য,,কতটা ভীত ছিলাম আমি?কিন্থ বাবা আমাকে এখানে উৎসাহ দিয়েছিলেন।কারণ এখানে তার কোটি কোটি টাকা লাভ হতো।সেদিন প্রথম আমি কেদেছিলাম,,ভীষণ রকমের কেদেছিলাম!তারপর কিন্তু আর কাদিনি এমনকি আর কখনো খুন করতেও আমার হাত কাপেনি।চাইলেই পারতাম তোমাকেও ব্যবহার করে নিজ হাতে তোমার জান নিতে,,কিন্তু কেন করেনি জানো??কারণ তুমিই একজন,যে আমাকে আইজা,সাহিলের মতো করে ভালোবেসেছ।তোমাকে ব্যবহার করেছি জানার পরেও তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে প্রেম!
আর কি দরকার কাউকে ভালোবাসার জন্য? কারো মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার জন্য?”
প্রেম কাপা গলায় বলে উঠে,,
“মা-মানে?”
প্রাঙ্গণ আস্তে করে প্রেমের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়,,ব্রিজের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে প্রেমকে দাড় করিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।প্রেম চোখ বুঝে নেয়!তার এলোমেলো চুলগুলো বাতাসের সাথে প্রাঙ্গণের মুখে বাড়ি খাচ্ছে। প্রাঙ্গণের প্রেমের একহাত নিয়ে আকাশে দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে,,
“ঐযে দেখতে পারছ না চাঁদটাকে?ঐ চাঁদ কিন্তু আকাশকে ছেড়ে কখনো যায় না,,নিজের আলো দিয়ে আগলে রাখে!কথা দিলাম আমার চাঁদ,,কখনো ছেড়ে যাবো না তোমাকে।জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি আমার চাঁদকে ভালোবেসে যাবো।আমার চাঁদের সাথে ঝগড়া হবে,,খুনশুটি হবে কিন্তু আমার চাঁদ আমারই থাকবে।পুরোনো সবকিছু ভুলে আমরা আমাদের নতুন জগতে পা বাড়াবো,,যেখানে না আইজা নামের তৃতীয় কোনো প্রসঙ্গ থাকবে,,না রেহেনেওয়াজ,এহসান আর রুবিনার মতো মানুষ থাকবে।কেবল আমাদের শহরে আমাদের ভালোবাসা থাকবে,,কথা দাও চাঁদ,,পাশে থাকবে সারাজীবন??”
প্রেম নিশব্দে ঠোঁট চেপে কেদে উঠে,,অবশেষে পেরেছে সে!হ্যাঁ,অনেককিছু আজকে সে পেয়েছে।প্রাঙ্গণকে নিজের করতে পেরেছে।আজকে নিজের সার্থক মনে হচ্ছে প্রেমের!ভীষণ রকমের!
“কথা দাও আমার চাঁদ!!”
প্রেম এবার তড়িৎ গতিতে প্রাঙ্গণের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে হু হু করে কেদে উঠে।প্রাঙ্গণের ঠোটে হাসি!একদম বিজয়ের হাসি!প্রেমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে,,
“কথা দিবে না চাঁদ??”
প্রেম নাক টানতে টানতে বলে উঠে,,
“আসল কথাই বলেননি আপনি প্রাঙ্গণ!আগে বলুন তারপর ভেবে দেখব।”
প্রাঙ্গণ এবার শরীর কাপিয়ে হেসে উঠে,,প্রেমের কানের কাছে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে হালকা স্বরে বলে উঠে,,
“ভালোবাসি আমার চাঁদ!ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে!”
প্রেম আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে প্রাঙ্গণকে,,নিরাপদ আশ্রয় বলতে এ পৃথিবীতে এখন প্রাঙ্গণের এই বুক!যেখানে এসে সে সারাদিনের ক্লান্তিমাখা দেহ হেলিয়ে দিয়েও বলতে পারবে “এই তো!বেশ শান্তি লাগছে তার!”
প্রেম প্রাঙ্গণের দিকে চেয়ে বলে উঠে,,
“একটা কথা রাখবেন প্রাঙ্গণ??”
“বলে ফেলুন চাঁদ!”
“এই সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবেন?”
“মানে?”
“এই কালোজগত থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন না প্রাঙ্গণ?আমার জন্য?আমাদের ভবিষ্যতের জন্য? ”
প্রাঙ্গণ কিছুক্ষন চেয়ে থাকে প্রেমের দিকে!সাহিলও সুহার অন্তসত্তা হওয়ার পর এখান থেকে একদমের জন্য বের হয়ে এসেছে!তাহলে প্রাঙ্গণ কেন পারবে না?প্রাঙ্গণ দুষ্টুমির স্বরে বলে উঠে,,
“আগে আমার এই চাঁদ থেকে কিছু তারার দরকার,,তারাদের আসার পর ভাবতে পারি এ বিষয়ে!”
প্রেম নাক-মুখ কুচকে বলে উঠে,,
“তারা!?”
“হুম তো,,একটা মেয়ে তারা আর একটা ছেলে তারা!”
প্রাঙ্গনের কথার মানে বুঝতে পেরে প্রেমের গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে,,আরেকটু গভীরে মাথা রাখে সে!
“আগে প্রমিস করুন যে এসব থেকে বের হয়ে আসবেন তাহলে তারাদের দেখা পাবেন,,তার আগে না!”
প্রাঙ্গণ কিছু বলে না,,প্রেমের থুতনিতে হাত রেখে মাথা উচু করে,,প্রেম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় প্রাঙ্গণের দিকে।প্রাঙ্গণ আর বিলম্ব না করে প্রেমের ঠোটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়……
ফাকা রাস্তা,,উপরে ল্যাম্পপোস্টের আলো,,নিচে পানির কলকল শব্দ,,চারিপাশে ঠান্ডা বাতাস,,উপরে চাঁদের শুদ্ধ আলো আর তারই নিচে একজোড়া দম্পতি চুম্বনরত অবস্থায়!!চারপাশে যেন বাতাসের সাথে মিশে কেউ বলে উঠছে,,
“লাগিল প্রেম
বহিছে বাতাসে,
আড়ালে
চাঁদ হাসে আকাশে!!”
~সুনেহরা শামস…
চলবে…
[আর এক পর্বে গল্পের সমাপ্তি টানব,,শেষ হয়ে যাবে আমার লেখা দ্বিতীয় গল্প।শেষ পর্বে সবার পুরো গল্প সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাই,,আশা করি নিরাশ করবেন না।আজকের পর্ব সম্পর্কে একলাইনের মন্তব্য ছেড়ে যাবেন।ধন্যবাদ]