প্রেম_প্রাঙ্গণ পর্ব শেষ

‘প্রেম প্রাঙ্গণ’🍂
|অন্তিম পর্ব|
~সুনেহরা শামস
.
.
পিঠে ধুম করে কেউ মারলে চকিত নয়নে সেদিকে তাকায় প্রেম,,দেখে প্রাঙ্গণ কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।প্রেমের ভেতরটা জ্বলে উঠে,,সোফার উপর থেকে উঠে সোজা দাঁড়িয়ে তেজি গলায় বলে উঠে,,

“আপনি আবার আমাকে মারলেন প্রাঙ্গণ?তাও আবার ঐ চার বিচ্ছুর জন্য?”

“মুখ সামলে কথা বলো প্রেম,,ওদের কিন্তু একটা নাম দিয়েছি আমি জন্মের সময়!”

প্রেম মুখ ভেংচি দিয়ে প্রাঙ্গণের ব্যঙ্গ করে বলে উঠে,,”ওদের কিন্তু একটা নাম দিয়েছি আমি জন্মের সময়”

প্রাঙ্গণ চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষন প্রেমের দিকে,,অতঃপর তার মুখ বরাবর নিচু হয়ে বলে উঠে,,

“যাও ওদেরকে সরি বলে আসো”

প্রেম এবার আরো তেজি কন্ঠে বলে উঠে,,

“ওদেরকে সরি বলব তাও আবার আমি??”

“হ্যা কারণ দোষ তুমিই করেছ,,ওরা না।”

প্রেম ঠোট চোকা করে বলে উঠে,,

“আপনার সমস্যা কি বলুন তো?ওরা জানেন আমাকে ইচ্ছা করে ফেলে দিয়েছে,,আমি কতটা ব্যথা পেয়েছি?”

প্রাঙ্গণ কিছুক্ষন চুপ করে প্রেমের দিকে চেয়ে বলে উঠে,,

“প্রিশা কাদছে প্রেম…”

প্রেম এবার একটু গলে যায়,,একটু আগেই চারজন মিলে সাবানের পানিতে পিছলে খাইয়েছে প্রেমকে,,কোমড়ে বেশ ভালো রকমের ব্যথাও পেয়েছে।অতি রাগের চোটে প্রিশা মেরেছেও একটু আগে।তাই তো প্রাঙ্গণের এত রাগ!কিন্তু প্রেমেরই বা কি করার আছে?প্রেমের মতে,,”একেকটা বদের হাড্ডি!” তা না হলে কেউ কারো মা কে এভাবে ফেলে দেয় নাকি…?

~~~
প্রেম উঁকি মারে বাচ্চাদের রুমে।প্রাণ গালে হাত দিয়ে বসে আছে,,প্রায়াণ স্টাডি ডেস্কের উপর উপুত হয়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে,,সিহান নখ কামড়াচ্ছে আর পাশেই প্রিশা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে।প্রেমের ভীষণ মায়া হয়!এই মেয়ের গায়ে ছোট থেকে একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি প্রাঙ্গণ।সেখানে আজ সে মেরেছে,,ব্যপারটা একটু গড়মিলে হয়ে গেল।এখন ভাবছে আদেও ঘরে প্রবেশ করবে কী না?

প্রেম বাইরে তাকায়,,এই গ্লাসগো শহরে এখন ভীষণ ঠান্ডা।প্রিশার দিকে তাকায় প্রেম,,মেয়ে একদম তার মতোই ছিদকাদুনে হয়েছে।যদিও তিনটা ছেলে-মেয়েই একদম প্রাঙ্গণের মতো হয়েছে কিন্তু মেয়েটা তার স্বভাবী হয়েছে।তাই জন্যই তো মেয়েকে অধিক যত্নে রাখে প্রাঙ্গণ,,কিন্তু আজকে হয়তো আসলেই প্রেম বেশী করে ফেলেছে।

“প্রিশাম্মু!”

প্রিশা চোখ তুলে তাকায়,,মাকে একবার দেখে আবার চোখ নামিয়ে ফুপিয়ে উঠে।প্রেম অসহায় চোখে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে,,সেও মুখ ভেংচি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।প্রেম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,,

“প্রিশাম্মু,সরি!!দেখ ভুল কিন্তু তোমরা করেছ,,তবুও আম্মু তোমাকে সরি বলছি কারণ তোমাকে আমি মেরেছি”

প্রিশা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রাণকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে বলে উঠে,,

“আমি কি করেছি?সবতো এই প্রাণ করেছে…”

গাল থেক হাত সরিয়ে তড়িৎ গতিতে প্রিশার দিকে তাকায় প্রাণ।এই মেয়ে কি মিথ্যে বলে!সে তো কিছুই করেনি,,শুধু প্রিশার ইন্ট্রাকশন মতো কাজ করেছে কিন্তু এখন সেই মেয়েই তাকে এভাবে ফাসিয়ে দিল।প্রেমও জানে যে সবকিছুর নাটের গুরু প্রিশাই,,কিন্তু তবুও তাকে স্বান্তনা দিতে বলে উঠে,,

“ওকে তো আমি পরে দেখে নিব,,আগে তুমি একটু হাসো তো আম্মু!”

প্রিশা ঠোঁট প্রসারিত করে এক ভুবনভুলানো হাসি দিয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে প্রেমের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,,

“প্রিশা লাভস ইউ আম্মু!”

~~~
সেদিনের পর প্রাঙ্গণ একদম বদলে যায়,,প্রেমকে দেওয়া কথা রাখতে নিজের সমস্ত রকমের পাওয়ার ছেড়ে দেয়,,নিজের আলাদা বিজনেস শুরু করে,,প্রথমে একটু টানাপোড়ন থাকলেও প্রাঙ্গণের প্রখর মস্তিষ্ক আর পোলাইটের জোড়ে নিজের বিজনেস ৪ মাসে দাড় করিয়ে ফেলে।এদিকে সংসারও জমে উঠে,,,সাহিল সুহার ছেলে হয়”সিহান”।

প্রাঙ্গণ বলেছিল,,সব কিছু ভুলে নতুনভাবে আবার শুরু করবে।তাই ৪ মাসের মাথায় বাংলাদেশ ছেড়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে পাড়ি জমায়।আর কিছু মাস পরই প্রেমের প্রথম ছেলে প্রায়ান হয়,,তার দুইবছর পর প্রিশা আর তার একবছর পর প্রাণের জন্ম হয়।বাংলাদেশে সুহা-সাহিল নিজেদের সংসার জমিয়ে তুলে,,বছরে একবার এখানে এসে দেখা করে যায়।

সবকিছুর মাঝে প্রেমের মাকে তারা ভুলে যায়নি।নিজের স্বইচ্ছায় তিনি দেশেই থেকে যান তবে সাহিলদের সাথে এসে নিজ নাতি-নাতনিদেরও দেখে যান।পূর্বা এখন আর বেচে নেই,,সিহান হওয়ার কিছু মাস পরেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরন করেন।প্রাঙ্গণের মা রুবিনা এখন পুরোপুরি একজন মানসিক রোগী!সেখানেই তাকে সম্পুর্ন দায়ভারে রেখে আসা হয়েছে যদিও প্রাঙ্গণের কথামত সাহিল মাসে একবার গিয়ে খোজ নিয়ে আসেন।আর এহসান সাহেব জেলে থেকে পাঁচ বছরের মাথায় ছাড়া পান,,কিন্তু প্রিয়া বা প্রেম কেউই তাকে আর মেনে নেয়নি,,যার ফলে নিজের ভুলও বুঝতে পেরে তিনি নিজইচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আছেন।

পুরোনো কথাগুলোতে প্রেম এতটাই ডুবে ছিল যে কখন প্রাঙ্গণ এসে পাশে বসেছে সে খেয়ালই করেনি।

“প্রেম!”

প্রাঙ্গণের ডাকে সম্মতি ফিরলে প্রেম ছোট্ট একটা হাসি দেয়,,প্রাঙ্গণের এই অভ্যাস কখনো বদলাবে না।প্রায়ান গর্ভে থাকাকালীন প্রতিদিন বিকেলে বারান্দায় বসে প্রেমকে নিয়ে এককাপ কফি খাবে।প্রায়ান হয়ে যাওয়ার পরই এ অভ্যাস আর বদলায় না প্রাঙ্গণের।

“কিছু কি ভাবছিলে প্রেম?”

“উহুম তেমন কিছুই না!”

“মনে তো হচ্ছে না আমার…”

“আসলে ভাবছিলাম কিভাবে কিভাবে ৬টা বছরের বেশী সময় কেটে গেল তাই না?”

“এসব কথা হঠাৎ?”

“জানেন তো ভেবেছিলাম,,আমাদের সাথে যা যা ঘটে গেল তারপর হয়তো আর কখনো ভালো দিনের দেখাই পাবো না।কিন্তু আল্লাহ হয়তো ভাগ্যে এই সুন্দর দিনগুলো ভাগ্যে লিখেছিল,,তাই না?”

“প্রেম,আমাদের সাথে যাই হয়েছে তাতে কিন্তু আমাদের দুজনের কোনো দোষ ছিল না,,আমরাই ছিলাম পরিস্থিতির শিকার!হ্যা হয়তো তোমার কথা অনুযায়ী আমাদের ভাগ্যে ছিল।কিন্তু জানো তো,এখন তোমাকে,ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখলে নিজেকে এখন পূর্ণ মনে হয়।”

প্রেম প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়,, চোখ তার জ্বলজ্বল করছে।যেদিন প্রথম প্রায়ানকে কোলে নিয়েছিল সেদিন প্রাঙ্গণ ভীষণ খুশি ছিল,,তার মুখে সেদিন ভুবনভুলানো এক হাসি ছিল যা আজও প্রেম ভুলতে পারেনি।আদেও কখনো ভাবেনি জীবনে এতটা উথান-পতনের পর এমন দিনগুলোও আসবে।

প্রেম হাতে থাকা কাপ রেখে প্রাঙ্গণের বুকে মাথা রাখে,,এখনও সেই একই শান্তি সে এই বুকের মাঝে খুজে পায়!প্রাঙ্গণও জড়িয়ে নেয় প্রেমকে নিজের বাহুডোরে,,হালকা স্বরে বলে উঠে,,

“ভালোবাসি আমার চাঁদ”

প্রেম প্রাঙ্গণের বুকেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শান্তির নিশ্বাস ছাড়ে…

“বাবাই বাবাই!দেখ তো এটা কেমন হয়েছে”

“বাবাই এটা কিন্তু আমি রঙ করেছি!”

“হ্যা তাও আবার আমার কালার পেনসিল দিয়ে”

তিনজনের গলার স্বরে পেছনে তাকায় প্রাঙ্গণ আর প্রেম।বড় কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিশা,,তার পাশে রঙ হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রাণ আর তারই পাশে হাসিমুখে প্রায়ান দাড়িয়ে আছে।

“দেখি তো আম্মু তুমি এটা কি এঁকেছ…”

প্রাঙ্গণের আল্হাদী ডাকে নিজের হাতে থাকা পেপারটি এগিয়ে দেয় তার দিকে।প্রাঙ্গণের কাগজটা হাতে নেয়।দুপাশে দুজন ছেলে-মেয়ে,তার মাঝে তিনজন ছোট ছোট বাচ্চা।প্রাঙ্গণ শরীর দুলিয়ে হেসে উঠে,,যদিও কাচা হাতের আকা,,কিন্তু বাচ্চাদের এত সুন্দর তৈরী করা দৃশ্য দেখে প্রাঙ্গণের ভালোই লাগে…

“কেমন হয়েছে বাবাই?”

“খুব সুন্দর হয়েছে আম্মু!”

“ইহহ,,একদম বিচ্ছিরি হয়েছে,,আমার চেহারাটা দেখেছেন?একদম মিস্টার বিনে থাকা বুড়ির মতো দেখাচ্ছে”

প্রাণ আস্তে করে বলে উঠে,,

“তুমি তো এমনই দেখতে!”

প্রেম প্রাণের দিকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,,

“কিছু কি বললি?”

“নাহ নাহ আমি কি বলেছি?”

“তুই কিছু একটা বলেছিস,জোড়ে বল সাহস থাকলে”

“এটার কি এত সাহস আছে না কি?ভীতুটা তো হিসু করতে গেলেও আমাকে নিয়ে যায়!” (প্রায়ান)

“ভাইয়ায়া!”

চারজনের মাঝে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে।প্রাঙ্গণ সেদিকে চেয়ে ছোট একট তৃপ্তির হাসি দেয়।পকেটে থাকা রুমালটা বের করে সে,,আইজা আর নিজের নামের দিকে তাকায়,,

“দেখেছ?তোমার প্রাঙ্গণের কিন্তু এখন একটা পরিবার হয়েছে।হয়তো তুমি নেই,,কিন্তু তোমাকে কিন্তু আমি ভুলিনি আজও,,আবার প্রেমকেও তোমার জায়গা দেই নি।সে নিজের মতো করে নিজের জায়গায় আছে।তোমার জায়গাটাও কখনো চায় নি।তুমি আমার জীবনের প্রথম বসন্ত ছিলে আইজা!সহজে কি তোমাকে ভোলা যায় বলো??আমিও ভুলিনি,হয়তো প্রকাশ্যে কেউ জানেনা,,কিন্তু আড়ালে আজও তোমাকে মনে করি।তোমার জন্য ভালোবাসা এখন আর নেই।কারণ আমি প্রেমের থেক এই অভিযোগ শুনতে চাই না!তোমার জন্য এখন আমার ভালোবাসা একদম সীমিত কিন্তু প্রেমের জন্য তা অসীম!প্রেমের আড়ালে অনেকবার তোমার জন্য চোখের জল ফেলেছি কিন্তু আর কত তোমার জন্য কাদব আমি?চলেই তো গেছ।আচ্ছা কেবল মনের মাঝে থাকলে হয় না?হয় তো,আর তোমার সীমাবদ্ধতাও এখন আমার মনেই!কিন্তু আমি এগিয়ে যেতে চাই ওদেরকে নিয়ে,,যেই সপ্ন তোমাকে ঘিরে দেখেছিলাম তাদেরকে বাস্তবায়ন করতে চাই।ভালো থেকো আইজা!তোমাকে হয়তো আর মনে রাখব না,কিন্তু মনে ঠিকই রেখে দিব”

পিছনে হাত দিয়ে জানালার বাইরে ছুড়ে মারে রুমালটি।কখনো কিছু পিছুটান ভুলে যাওয়াই ভালো!প্রাঙ্গণও তাই করেছে,,হয়তো আর মনে মনে যোগাযোগে হবে না,,কিছু অভিযোগ জানানো হবে না,,কিছু কষ্ট তুলে ধরা হবে না।থাকনা “কিছু”
এই “কিছু” এর বদলে আজ “অনেককিছুই” পেয়েছে সে!আর কি চাই তাহলে?

“বাবা চলো,,সুহাম্মি আজকে নিজ হাতে বিরিয়ানী রান্না করেছে,,খাবে না?”

প্রায়ানের কথায় এক টুকরো মিষ্টি হাসি দিয়ে প্রাঙ্গণ বলে উঠে,,

“আসছি বাবা!”

সমাপ্ত…

[অবশেষে সমাপ্তি টানলাম #প্রেম_প্রাঙ্গণ এর,,সমাপ্তি টানলাম আমার লেখা দ্বিতীয় গল্পের!জানিনা কতটা হৃদয় ছুয়েছে এই কাচা হাতের কাচা লেখা!বরাবরই লম্বা লম্বা গ্যাপে গল্পটা পোস্ট করা হত,যেখানে আমিই নিজেই এই বিষয় নিয়ে অপারগ ছিলাম।প্রেম প্রাঙ্গণের প্রত্যেকটা চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি যদিও আমি পুরোপুরি ভাবে তা করতে পারিনি।কিন্তু অনেকেই এই কাচা হাতের লেখাকে অনেক বেশীই সাপোর্ট করে গেছেন,,ভালো ভালো মন্তব্য উপহার দিয়েছেন,,নাইস/ওয়াও দিয়েও নিজের ভালোলাগাটা প্রকাশ করেছেন।আজকের পর্বতে একটু বড় করে সবার গল্প সম্পর্কে মতামত জানতে চাইছি,,আশা করি কেউ নিরাশ করবেন না।আপনারা ভীষণ ধৈর্যশীল কেননা প্রচুর অপেক্ষার পর গল্প পেতেন আপনারা।কিন্থ ভালোবাসা দিয়ে গেছেন বরাবরই তার জন্য কৃজ্ঞতা।কিন্তু কষ্ট ও আফসোস একটা বিষয় নিয়েই কিছু মানুষকে প্রথম-দ্বিতীয় পর্বের পর আর পাশে পাইনি,,যা সত্যিই ভীষণ কষ্টকর।সবশেষে বলতে চাই ধন্যবাদ!এত ভালোবাসা দেওয়ার জন্য!সবার জন্য অঢেল ভালোবাসা।নতুন গল্প নিয়ে হাজির হব ইনশাআল্লাহ কিছুদিন পর!একটু স্পেস চাইছি!নতুন গল্প #অতঃপর_প্রজাপতিরা -র সাথে আবার দেখা হবে।ততদিনে আল্লাহ হাফেজ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here