প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -৩৮+৩৯

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩৮.
প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আছে হয়তো। দ্রিমদ্রিম শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামেছে। রাস্তাঘাট ভিজিয়ে দিয়েছে৷ প্রকৃতি উচ্ছ্বসিত! জানালার কাঁচে বৃষ্টির রেখা। অরু ধ্যান মেরে তাকিয়ে থাকতে চাইল। বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছে। সে আর তন্ময় একই গাড়িতে। আনোয়ার সাহেব তাদের আলাদা যেতে দিয়েছেন মুলত। অবশ্য মোস্তফা সাহেব অমত করেছেন। তবে কে শোনে কার কথা! অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক আবারো তাকাল। গতকাল রাত থেকে তন্ময়ের বলা কিছু শব্দ তার হৃদয়ে তীরের ন্যায় চুবেছে। এইযে
রাতে তাকে গভীর গম্ভীর স্বরে ‘জান’ বলে ডাকল। তখন সে দুনিয়া ভুলে গেল। ভুলে গেল চারপাশ। এতটুকু জীবনে কখনো এভাবে ডাকতে শোনেনি তন্ময়কে সে। কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তন্ময় এভাবে বলতে পারে! এইযে এখনো তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সেই রাতের ঘটনা ভাবতেই। তারপর আজ যেভাবে মায়ের থেকে তাকে রক্ষ করলো। তারপর স্ত্রী বলে রুখে দাঁড়ালো। অরুর তখন মনে হলো, বাবার পড়ে তন্ময় তার দেয়াল। তাকে রক্ষা করার দেয়াল। তার ভালোমন্দ বুঝে নেবার মানুষ! স্বামী স্ত্রীর এই বন্ধন খুব ভালোভাবে অরুকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হুট করে তন্ময়ের ফোন বেজে উঠল। তন্ময় কল রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়েছে। ওপাশ থেকে হাস্যজ্বল পুরুষালি কন্ঠের স্বর ভেসে এলো, ‘দোস্ত! যা শুনলাম সত্যি নাকি!’
‘কি শুনেছিস!’
‘ভাব কম নে মাম্মা! অবশেষে আমাদের মতো মিঙ্গেল হয়েই গেলি। আচ্ছা হঠাৎ বিয়ের কারণ কী? কীরে ভুল হয়ে গেছে নাকি তোর দ্বারা? আমি নিশ্চিত বিজনেস ট্যুরে গিয়ে ফ্রুটস খেতে হাত বাড়িয়ে ছিলি। বেসামাল হয়ে গেছিলি। তোকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি ব্যাটা! হে হে! দোস্ত… ‘
‘অরু পাশে।লাউডস্পিকার দেওয়া। আম ড্রাইভিং।’

মাহিনের অনর্গল কথা বন্ধ হয়ে গেল। পরপর কল কেটে গেল। অরু লজ্জায় হতভম্ব। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে অন্যপাশে ফিরে গেল। ছি!
_____________
অরু ঠিক জানে, তাদের এই বিয়ে এতো সহজে মেনে নেওয়া হবেনা। তখন রাগের বসে হয়তো মেনে নিয়েছে। নিশ্চিত বড়সড় ঝড় অপেক্ষা করছে বাড়িতে। বাড়িতে পা রাখতেই, আসল রূপ বেরোবে সকলের। হয়তো মা আরেকটি চড় বসাবেন গালে। চাচ্চু গম্ভীরমুখে অরুকে ডাকবেন সামনে। বকাঝকা করে অরুকে বান্দরবন পাঠিয়ে দিবেন। নয়তো বা বড়ো মা অভিমানী স্বরে কথা শোনাবেন। চাচী খুব করে রেগে হয়তো বলবেন, ‘এই কাজ কীভাবে করলি বলত অরু? আমাদের কথা একবার ভাবলি না। তোকে দিয়ে এটা একদম আশা করিনি।’ তখন অরু জবাব দিতে পারবেনা। কেঁদে ভাসিয়ে দিবে শাহজাহান বাড়ি। অবশ্য এখনই তার হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই ভয় নিয়ে তো থাকতে পারছেনা। ভয়ে সাড়া শরীর কেঁপে উঠছে খানিক্ষন পরপর। এই পরিস্থিতি হাওয়া হয়ে গেলে কেমন হয়? ভ্যানিস হয়ে যাক! অরু এই থমথমে সিচুয়েশন আর নিতে পারছেনা। সকলের গম্ভীরমুখ সহ্য করতে পারছেনা। সবাই কেমন করে তাকে শুধু দেখেছে। কথা বলছে না, আদর করে ডাকছে না। কেন! অরু কি এমন করে ফেললো!

পাঁচ ঘন্টার জার্নি করে রাত চারটায় গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছেছে। অরু আসামির ন্যায়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলো। বাড়িতে প্রবেশ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়লো। আঁড়চোখে তন্ময়কেও দেখে নিল। তন্ময় সোফায় বসেছে। তার ভেতর কোনো আতঙ্ক, ভয় কিংবা জড়তার চিহ্ন নেই। অথচ অরু ভয়ে শ্বাস ফেলতে পারছে না। মাথা উঁচু করে বাবামায়ের মুখের দিক তাকাতে পারছেনা। বিশেষ করে বড়ো চাচ্চু আর বড়ো মায়ের পানে।

একটি বিয়ে পুরো পরিবারকে অপ্রস্তুত সিচুয়েশনে ফেলে দিল। সম্পর্কের দ্বিতীয় প্যাঁচ বেরোলো। এতো বছরের সাধারণ মধুর সম্পর্কের মধ্যে, ভিন্ন স্বাদের সম্পর্ক জুড়ে গেল। যার স্বীকারোক্তি দেওয়াটা দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধা জড়িত বিষয়।

আশ্চর্য! চোখের পলকে আনোয়ার সাহেব নিজের ভাইপোর শ্বশুর হয়ে গেলেন। সুমিতা বেগম শ্বাশুড়ি বনে গেলেন। আহাম্মক মোস্তফা সাহেব ভাতিজির শ্বশুর হয়ে গেলেন। জয়া বেগম শ্বাশুড়ি! সাধারণ সম্পর্ক গুলো মুহুর্তে অসাধারণ রূপ নিয়ে ফেলেছে। এই অসাধারণ সম্পর্কের রূপ বুঝে শাহজাহান বাড়ি গুরুজনেরা বড়োই সমস্যায় পড়ে গেলেন। এইযে,
মোস্তফা সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কেশে উঠেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ার সাহেবও কেশে উঠলেন। ওহী সাহেব গলা খাকড়ি দিয়ে, অন্যপাশে তাকালেন। জয়া বেগম এবং সুমিতা বেগম নিঃশব্দে চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। পরিবেশ ভীষণ থমথমে এবং অপ্রস্তুত। মনে সকলের হাজারো কথা। কেউই আগ বাড়িয়ে কথাবার্তার শুরুটা করতে পারছেন না। দ্বিধাবোধ করছেন! অবশেষে মোস্তফা সাহেব ছেলের দিক চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তন্ময়ের মুখ ভোঁতা হয়ে আছে। বাবার চোখ রাঙানো অগ্রাহ্য করে বলল,’এভাবে বসে থাকব? কিছু বললে বলো! আমি রুমে যাবো।’

ছেলের কথায় মোস্তফা সাহেবের দ্বিধাবোধ পুরোদমে কেঁটে গেল। গর্জিয়ে উঠলেন রাগী স্বরে, ‘এতবড় তান্ডব করে আবার গলা বাড়িয়ে কথা বলছ! লজ্জা করছে না তোমার! এই মুখ আমার সামনে এনেছ কীভাবে? ওয়াদা ভঙ্গ করেছ তুমি ! ছিঃ! তুমি আমার ছেলে তা তো আমি ভাবতেই পারছিনা। আমি যে কিনা কখনো কথার খেলাপ করিনি জীবনে, সেই আমার ছেলে তুমি হলে কী করে!’
‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’

ওহী সাহেব এক গ্লাস পানি খেতে নিয়ে বিষম খেলেন। গলায় পানি আটকে লাগাতার কেশে দম আটকে ফেললেন। বুকে এলোপাতাড়ি থাপড়ালেন। মোস্তফা সাহেব স্টোক করে বসবেন! তিনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। বুকে হাত চেপে কম্পিত আঙুল ছেলের পানে তুললেন। ভেঙে ভেঙে কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। অন্যথায়, তন্ময় আসলে কথাটি বলতে চায়নি। মুখে চলে এসেছে হুট করে। বলে অবশ্য বেশ হালকা অনুভব করছে। বাবার অবস্থা দেখে তার রাজ্যের ঘুম ভ্যানিস হয়ে গেল। খুব আরাম করে সোফায় কাতচিৎ হয়ে বসলো। যার যা অভিযোগ শুনবে যেমন।

ওহী সাহেব শান্ত হয়েছেন। খুব মোলায়েম সুরে কথা শুরু করলেন, ‘কিছু হয়েছিল? এভাবে হুট করে…কী কারণ?’

তন্ময় দূরে কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়ানো অরুকে দেখে নিল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কি হবে! কিছু হয়নি। কোনো কারণ নেই! বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো করে নিলাম।’

ওহী সাহেব কথা এগোনোর ভাষা হারিয়ে ফেললেন। অন্য বাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে নাহয় মানা যেতো। নিজের বাড়ির ছেলে নিজের বাড়ির মেয়ে বিষয় করেছে! এখানে কি বলবেন বা করবেন বুঝতেই পারছেন না। মোস্তফা সাহেব কিছুটা শান্ত হয়েছেন। তিনি আঙুল তুলে বললেন, ‘তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। এই বাড়িতে তোমার কোনো স্থান নেই।’
‘ঠিকাছে।’

তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। উচ্চস্বরে বলল,’এই অরু ব্যাগ গুঁছিয়ে নে৷’

মোস্তফা সাহেব চোখ বড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘ও ব্যাগ গোছাবে কেন!’
‘আমার বউ আমার সাথে যাবেনা?’

মোস্তফা সাহেব বুকে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে ওহী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,’আল্লাহ গো! এই অসভ্য ছেলেকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। এক্ষুনি!’

তন্ময় চলে যেতে পা বাড়ালো। মোস্তফা সাহেব দম নেবার অবস্থায় নেই। তবুও ছেলেকে শুনিয়ে আবারো বললেন, ‘এটা কোনো বিয়ে হলো! এই বিয়ে মানা যায়না! অরুর রুমের ট্রান্সফার করা হোক। আজ থেকে অরু নিচের রুমে থাকবে। জয়া ব্যবস্থা করো! আর তুমি..অসভ্য ছেলে! একশো হাত দূরে থাকবে ওর থেকে।’

বাবা ছেলের মধ্যে এই কীসের যুদ্ধ চলছে, কেউই বুঝে পেল না। উপস্থিত সবাই অসহায় চোখে দেখে গেল। তন্ময় তোয়াক্কা করলো না বাবার কথার। সে উপরে চলে গেল। অরুকে এসে শাবিহা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দীপ্ত চুপচাপ পিছু পিছু গেল তাদের। বুকের ভেতর গুরুমগুরুম করছে। আনন্দে চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। চেঁচিয়ে বাড়িঘর মাতিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না ভয়ে। সবাই গম্ভীরমুখে আছে। নিশ্চয়ই দীপ্তর ব্যাক পিঠের মধ্যস্থান থাপড়ে লাল করে দিবে। ভীতু দীপ্ত বাপ-চাচাদের আড়ালে এসে নেচে উঠলো। তার দীর্ঘ লাফানো’তে ঝাকড়া চুলগুলো দুলছে। যেন তারাও খুশিতে নাচছে।

‘বিয়েটা হয়ে গেল?’
‘হু।’
‘সত্যি? আমার কথা শোনার মতো মানুষ তো ভাই নয়। ও বিয়েটা সত্যি করে নিলো! হুয়াই? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছু কী হয়েছে?’

শাবিহার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অরু থমকে গেল। থমথমে গলায় বলল,’কি হবে!’
‘কিছু একটা কারণ আছে! নাহলে আমার ভাই কথা নড়চড় করার মানুষ নয়। বাবাকে কথা দিয়ে সে নিজেই ভাঙবে এমনটা হতেই পারেনা। কুছ তো গারবার হে দীপ্ত, কুছ ত!’

দীপ্তর চোখমুখে রাজ্যের ঘুম। সে হৈ-হুল্লোড় করে শাবিহার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবিহাও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে শুয়ে পড়লো। অরু শুধু বসে রইলো। ফজরের আজান দিচ্ছে। তার ঘুম আসছে না। আনমনে তাকিয়ে ভাবতে বসলো। হঠাৎ করে জীবনের মোড় ঘুরে গেল অদ্ভুত ভাবে। ভাবতেই বড্ড অবাক লাগে সে এখন বিবাহিত। তার পছন্দের মানুষ, তার কাছের মানুষ, যাকে একসময় ভাইয়া বলে পিছু ঘুরে বেড়াতো, সে তার স্বামী। ওই অসাধারণ মানুষটা অরুর! ভাবনায় আসতেই খুব ভালো লাগছে। বুকে একরাশ অনুভূতি ঘুরঘুর করছে। পেট মুচড়ে উঠছে ভেতর থেকে। তবে যতই ভালো লাগা কাজ করুক না কেন! অরু একটু ক্ষিপ্ত তন্ময়ের উপর!
___________
সুমিতা বেগম হাঁসফাঁস করছেন। আনোয়ার সাহেব শুধালেন, ‘কি হয়েছে?’
‘এই বিয়েটা..মানে ভাইয়া খুব করে বলেছিল! এটা কি হয়ে গেল!’

আনোয়ার সাহেব স্মিথ হাসলেন। স্ত্রীকে ইশারা করলেন পাশে আসতে। সুমিতা বেগম আসলেন। আনোয়ার সাহেবের পাশে বসলেন। আনোয়ার সাহেব মোলায়েম সুরে বললেন,’আমাদের একটি মাত্র সন্তান। ধরো, মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিলাম। চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। চোখের সামনে থেকে বহুদূর। মাসে একবার হয়তো বছরে একবার দেখতে পাব। আমাদেরই বা কে দেখবে তখন? এইযে রাতে হুট করে মেয়েটা চলে আসে! কীভাবে যেন বুঝতে পারে আমার মাথা ব্যথা! বলবে, বাবা মাথাটা একটু মালিশ করে দেই? বাবা তোমার বুকে কী আবারো যন্ত্রণা করছে! সেবার তোমার ভীষণ জ্বর হলো! আমি সহ ভাইয়া তুফানের কারণে আটকে। বাড়িতে কেউ নেই! সবাই ফিল্ম দেখতে বেরিয়েছে। মেয়েটা একাই তোমাকে দেখবার জন্য বাড়িতে থেকে গেল। সেবাযত্ন করলো। হঠাৎ করে তোমার অবস্থা খারাপ। দিশেহারা মেয়েটা আমার সেই তুফানের মধ্যে ছুটে বেরিয়েছে পাশের ক্লিনিকের ডাক্তার ডাকতে! কী সাংঘাতিক তোমার অবস্থা হয়ে ছিলো। চিন্তায় মেয়েটা দুদিন তোমার সাথেই ছিল। সেবাযত্ন করলো। একপা নড়ল না তোমার চারিপাশ থেকে। সেই আমাদের আদুরে মেয়েটা চলে যাবার পর আমাদের কী হতো? এভাবে কেই বা দৌড়ে আসত। মাথা ব্যথায় পড়ে থাকলেও কেউ মালিশ করে দিবে বলে দৌড়ে আসত না! কিন্তু দেখ, আল্লাহতালার কী অশেষ রহমত৷ পরের বাড়িতে যাবার জন্য জন্ম নেওয়া মেয়েটা সারাজীবন বাবার বাড়িতেই থাকবে। পাশে। কাছে। দৈনন্দিনের মতো একসাথেই থাকব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়েটা চোখের সামনে থাকবে। এটা কী আনন্দের বিষয় নয় সুমিতা? আবার দেখ, তন্ময়কে ছেলের চোখে দেখে আসলাম। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছেলে। কোনো কমতি বা খারাপ দিক নেই তার মাঝে। সেই ছেলে আমার একমাত্র মেয়ের জামাই হয়ে গেল৷ আমাদের মেয়ে জামাই। সম্পর্ক দুটো। হয়তো এই সম্পর্ক শক্ত করে রাখতে পরিশ্রম করতে হবে৷ আগের থেকে এখন আরও বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। তবে দিনশেষে আপন সম্পর্ক গুলো চারিপাশে রয়ে গেল না?’

সুমিতা বেগম কেঁদে উঠলেন। ভেঙে পড়লেন স্বামীর বুকে। খুব করে কাঁদলেন। কাঁদতে দিলেন তাকে আনোয়ার সাহেব। একসময় শান্ত হলেন সুমিতা বেগম। খুব ধীর স্বরে বললেন, ‘আমাকে একদিন বলেছিলেন, আপনি সেই দিনের অপেক্ষায় যেদিন আমি নিজেকে আপনাকে সবকিছু খুলে বলব। আমি আজ বলতে চাই৷ আপনি শুনবেন?’

আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘শুনব।’
‘ছোট থেকেই অবহেলিত ছিলাম। বাবামা সবসময় ভাইয়াদের এগিয়ে রাখতেন। ভাইয়ারা সর্বদাই আমাকে অপছন্দ করতেন। আমি সবসময় তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য কাতর হয়ে থাকতাম। তারা আমাকে ভালোভাবে দেখতেনই না। আমার বন্ধুবান্ধবদের ভাইয়া গুলোকে দেখতাম। কতো সুন্দর ব্যবহার তাদের। খুনসুটি, আদর তাদের চারিপাশে লেপ্টে। সেগুলো দেখে কেঁদে ভাসাতাম। স্বপ্ন দেখতাম আমার ভাইয়া, আমার বাবাও এভাবে আমার মাথায় আদূরে ভাবে হাত রাখবে। মন খুলে কথা বলবে। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে! কিন্তু স্বপ্নগুলো স্বপ্ন রয়ে গেল। আপনার সাথে বিয়ে হলো। এই পরিবার, পরিবারের মানুষ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেখানে আমি বড়ো হয়েছি সেখান থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন পরিবেশ ভিন্ন ব্যবহার পেলাম। প্রথম এসে ভেবেছিলাম এখানে হয়তো নাটক চলছে। তাই সবাই এমন ভালো ব্যবহার করছে। দিন যেতে থাকলো আমার ভুল ধারণা ভাঙলো। এই পরিবারের মানুষ গুলো আসলেই সত্যিকারের। খেয়াল করলাম বিয়ের পর ভাইয়াদের ব্যবহারের পরিবর্তন এলো। আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলো। আমার যে কি আনন্দ হলো, আপনাকে বোঝাতে পারবো না। অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন গুলো চোখের সামনে পূরণ হতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ভাইয়েরা যা বলত করার চেষ্টা করলাম। টাকা দিতে বলত, দিতাম। অফিসের সম্পর্কে জানতে চাইত জানাতাম। সত্যিটা চোখের সামনে থাকতেও তা অগ্রাহ্য করলাম। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য অন্ধ হয়ে গেলাম। মেয়েটাকেও তাদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য একপায়ে রাজি ছিলাম। আমি ভালো মা নই। ভালো স্ত্রী নই। আমি.. ‘

অঝোরে কাঁদতে থাকা সুমিতা বেগমকে জড়িয়ে বুকে নিলেন আনোয়ার সাহেব। স্বান্তনা সরূপ কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তিনি হেসে বললেন, ‘আমার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।’
‘মাফ করবেন আমাকে?’
‘তুমি অন্যায় করোনি সুমিতা। আমি তোমাকে অন্যায় করতে দেইনি। ঠিক এভাবে আগলে রেখেছি। মরার আগ পর্যন্ত আগলে রাখবো। তুমি শুধু পাশে থেক।’
__________
বিয়ের বিষয়টি যেমন ঘটেই নেই। সকলেই নর্মাল। কোনো রিয়েকশন নেই। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে আগের মতো পেলো অরু। ব্রেকফাস্টে খেতে বসে সে ভয়েভয়ে মায়ের দিক তাকাল। সুমিতা বেগম গম্ভীরমুখে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন নিত্যদিনের মতো। অরু একটানে খেয়ে নিল সেটা। ভয়ে নাকমুখ ও কুঁচকায়নি আজ। পরপর তন্ময় এসে পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তৈরি হয়ে এসেছে জনাব। খেয়ে অফিস যাবে বোধহয়। অরু চোরাচোখে তাকেও দেখে নিল। আশ্চর্য! সবাই নর্মাল শুধু অরু বাদে। কেন! সবাই কী ভুলে গেল তাদের বিয়ের কথা? কালই ত বিয়ে করলো তারা। অরু বিবাহিত! ব্যাচেলর নয় আর। এতবড় সত্য কেউই গ্রাহ্য করছে না আর! সবাই কী এই বিয়েটা ভুলে যেতে চাইছে? তন্ময় ও? ভয়ে অরুর বুক কেঁপে উঠলো!

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’
______________প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩৯.
বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে! রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। প্রতিবেশীদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। মুলত আজ শাবিহাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। বিকেল দিকে। মোস্তফা সাহেব দুপুরের আগ দিয়ে মেয়ের কক্ষে আসলেন গম্ভীরমুখে। শাবিহা তখন জড়সড় হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালো। মোস্তফা সাহেব চেয়ারে বসলেন। মেয়েকে ইশারা করলেন তার সামনে বসতে। শাবিহা বসলো। মোস্তফা সাহেব বললেন, ‘শুনেছ তো তোমার মায়ের থেকে?’
‘জি বাবা।’
‘তোমার কোনো আপত্তি আছে?’

শাবিহা চুপ থাকলো। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। তবুও মুখ ফুটে সত্যটা বলার সাহস পাচ্ছে না। কীভাবে বলবে, কোন মুখে বলবে! এভাবেই তন্ময়ের বিষয়টি নিয়ে তার বাবা প্রচন্ড অস্বস্তিতে। এখন আবার সে যদি এগুলে বলে! শাবিহা বাবার আদুরে মেয়ে হয়ে সত্যটা প্রকাশ করতে পারলো না। আর না পারলো ‘ না ‘ বলতে! মাথা নত করে বসে থাকলো। মোস্তফা সাহেব বললেন, ‘বিয়ে তো করতে হবে! আর কতদিন! আমাকে পিতার দায়িত্বটা পালন করতে দাও মা।’

মোস্তফা সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ মাথা বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা যেতেই কান্না’য় ভেঙে পড়লো শাবিহা। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে নিঃশব্দে ! নিঃশব্দ কান্না কষ্ট হাজার গুন বাড়িয়ে দেয়। যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদতে না পারলে, সেই কান্নার সমাপ্তি পাওয়া যে বড়ো মুশকিল। কান্নার একপর্যায়ে বেশ ক্লন্ত হয়ে পড়লো শাবিহা। ফ্লোরে বসে মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে সেলফোন হাতে নিল। অয়নের অনেক গুলো মেসেজ এসে আছে। লাস্ট মেসেজটা দেখে সে আবারো ফুঁপিয়ে উঠেছে। অয়ন একটা লেহেঙ্গার ছবি পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটি মেসেজ, ‘মামীর সাথে শপিং এসেছি শাবিহা। একটা ব্রাইডাল লেহেঙ্গা দেখলাম। আমার সেটা খুব পছন্দ হয়েছে তোমার জন্য। কিনবো বলে প্রাইস জানতে চাইলাম, শুনবে কতো বলল? পঁয়তল্লিশে হাজার। আমার কার্ডে আটাশ হাজার আছে। বাবার থেকে চাইলে ব্যাপারটা কেমন না! বিজনেসে প্রফিট করে প্রথমেই এই লেহেঙ্গা কিনবো! আমাদের বিয়েতে তুমি এটাই পরবে কেমন?’

কান্নায় শাবিহার শ্বাস আটকে যাবার যোগাড়। এই ছেলেটা কি বুঝতে পারছে কোন সিচুয়েশনে আছে তারা? তাদের সামনে সে তো কোনো রাস্তা দেখছে না! তার বাবা এই প্রেম একদম মেনে নিবেন না। কখনো না।

ঘন্টাখানেক বাদে অয়নের কল এলো। শাবিহা ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখবুঁজে বিছানায় হাতড়ে সেলফোন হাতে নিল। সেভাবেই কল রিসিভ করলো। অয়ন হয়তো বাইরে। যানবাহনের তীব্র শব্দ কানে আসছে। ঘুম পুরোদমে ভেঙে গেল তার। উঠে বসলো। প্রশ্ন করলো, ‘কোথায় তুমি?’

অয়ন যেমন প্রচন্ড বিরক্ত! খুব গম্ভীর স্বরে বলল,’পোলাপান জড়ো করছি।’
‘কী!কেন!’
‘কেন আবার! যে শালা আসছে তোমাকে দেখতে ওর কতবড় কলিজা বুকে, ওটার পোস্টমর্টেম করবো আজ আমি। মাঝরাস্তায় ধোলাই-ওয়াশ করে ফেরত পাঠিয়ে দিব। কার দিকে নজর দিয়েছে হাড়েহাড়ে টের পাবে!’

শাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য নির্বোধে পরিনত হলো। সময় নিয়ে ধমকে উঠলো,
‘তু..তুমি..এক্ষুনি বাড়িতে আসো বেয়াদব!’

অয়ন মুখ ভোঁতা করে ফেললো। অসহায় সুরে ডাকল,
‘শাবিহা.. ‘
‘আর কোনো কথা নেই আমাদের মধ্যে।’

কল কেটে গেল। অয়ন অন্ধকার মুখে ফোনের স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে রইলো। সৌভিক তখন পোলাপানদের হাতের স্টিক, লাঠি গুলো হাতিয়ে দেখছে। ভয় দেখাতে এইসব অ’স্ত্রতেই হবে নাকি আরও লাগবে ভাবছিল। এমতাবস্থায় বন্ধুর নেতিয়ে থাকা মুখশ্রী দেখে নড়েচড়ে উঠলো। আন্দাজ সুরে বলল,’তুই কী ভাবীকে বলে দিলি?’
‘হু। রেগে গেল।’
‘তুই কি পাগল! কেন বলতে গেলি। সে এগুলো পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক।’

অয়ন সেলফোন পকেটে ঢুকিয়ে, হাতের ইশারায় সবাইকে যেতে বলল। ভোঁতা মুখে পোলাপানগুলো বিদায় হতেই, বাইকে চড়ে বসলো। পেছনে সৌভিক উঠে বসলো। ভেবেচিন্তে বলল,’দোস্ত এই দেখাদেখির বিষয়টা কীভাবে থামাবি? আন্টিকে জানাবি?’
‘আর জানাব! সে তো পাত্রপক্ষ আসা নিয়ে বেশ এক্সাইটেড! দেখলাম নিজের সিগনেচার আইটেম গুলো রান্না করে শাবিহাদের বাসায় যাচ্ছে।’
‘আহারে!’
‘ওদের বাসার সামনে আগুন লাগালে কেমন হয়? নাকি শাবিহাকে তুলে নিয়ে আসব? নাকি সোজাসাপটা শ্বশুর আব্বার সামনে যাবো? নাকি… ‘

অয়ন বিষন্ন অনুভব করছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কি ডিরেক্ট কাজি নিয়ে শাহজাহান বাড়ি চলে যাবে?
____________
লতা বেগম চল্লিশ বয়সের স্বাস্থ্যবতী মহিলা। লম্বাচওড়া দেহের গড়নের। অয়নের মুখশ্রীর সঙ্গে বড্ড মিল পাওয়া যায়। টানা ভুরু। উঁচু নাক। পাতলা ঠোঁট। গোলাকৃতি চেহারা। এমনকি ভুরুর উপরের ছোট্ট তিল খানা হুবহু অয়ন ও পেয়েছে। তিনি সবেমাত্র শাহজাহান বাড়ি ঢুকেছেন। দু’হাত ভর্তি খাবার। শাবিহাকে দেখতে আসবে এরথেকে আনন্দের বিষয় যেমন পৃথিবীতে দুটো নেই তার কাছে। তিনি নিজের রান্না করা আইটেমস গুলো সোজা ডাইনিংয়ে রাখলেন। সোফায় বসে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন হলেন। তাদের কানাঘুঁষা গল্পের মাধ্যমে জানতে পারলেন, তন্ময় আর অরুর বিয়ের কথা। বিয়ের বিষয়টি একান্তই গোপন। এখনো শাহজাহান পরিবার সরাসরি কাউকে বলেনি এ-বিষয়ে। প্রতিবেশী যারা জানে সবটাই কানাকানি ভাবে। সাহস করে সোজাসাপটা যে কেউ শুধাবে, তাও পারছে না। তবে লতা বেগম ভিন্ন। তার আবার শাহজাহান বাড়ির গিন্নীদের সঙ্গে বেশ ভাব। সোজা চলে গেলেন জবেদা বেগমের কাছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন। বিয়ের বিষয়টি তার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না! এটা কী বিশ্বাস করার মতো বিষয় নাকি! ভদ্রসমাজের বড়ো বাড়ির দুটো ছেলেমেয়ে কিনা একা-একা বিয়ে করে নিল! জবেদা বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত। তাকে সাহায্য করছে মুফতি বেগম। ধীর স্বরে লতা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘তন্ময় নাকি অরুকে বিয়ে করে নিয়েছে?’

এমন প্রশ্নে জবেদা বেগম মুচকি হাসলেন। তিনি কিছু বলবেন এর পূর্বেই মুফতি বেগম মুখ খুললেন,
‘ আর বলবেন না! এই বিষয়ে ঝড়তুফান হয়ে গেল বাড়িতে। বিয়েটা গতকাল করেছে। কাজি অফিসে গিয়ে। করবেনা কেন বলুন! চারপাশ থেকে ছেলেটার উপর যে হাড়ে নজর পড়ছে! আর এদিকে মেয়েটার ও রক্ষা নেই।’

লতা বেগম কিছুই বুঝলেন না। মুফতি বেগমের কথাবার্তা তার মাথার উপর দিয়ে গেল। জবেদা বেগম আঁচলে হাত মুছলেন। চায়ের কাপ লতা বেগমের হাতে দিলেন। দুজন অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করলেন।এদিকটায় মানুষজন নেই। নিরিবিলি! চায়ে চুমুক দিচ্ছেন লতা বেগম। প্রত্যাশায় আছেন জবেদা বেগম কিছু বলবেন হয়তো! জবেদা বেগম বললেন ও,’আপনাকে যে জানাব তার উপায় ছিলো না। ছেলেমেয়ে দুটো না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। এমন বিষয় তো বলার মতো নয়।’
‘তা তো অবশ্যই।’
‘আমার ছেলেটা অরুর জন্য পাগল। সেই ছোট থেকে! আমরা ভেবে রেখেছিলাম অরু বড়ো হলে এই বিষয়ে কথা বলবো! কিন্তু ছেলে মানতে নারাজ। না জানিয়েই বিয়ে করে নিল হুট করে। অবশ্য তার দ্বারা এমন কান্ড আমরা কেউই প্রত্যাশা করিনি। খুব বুদ্ধিমান ছেলে আমার। সবসময় সবকিছু সামলে নিয়েছে এখনো সামলাচ্ছে! সে কীভাবে এই কাজ করে বসলো জানা নেই। এখন বিয়েটা তো আর অস্বীকার করা যাবেনা! আপনার ভাই এখনো রেগে। তিনি চাচ্ছিলেন না অরু এখনই বিয়ে করে নিক। মেয়েটা এখনো ছোটো। ইন্টার পাশ করলো সবেমাত্র। ভাই-জি’কে বড্ড ভালোবাসেন কিনা। চাচ্ছিলেন আরও সময় নিয়ে ভাববেন।’
‘বিয়েটা হয়ে ভালোই হয়েছে। আমার তো এখন দুটোকে পাশাপাশি দেখতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই খুব মানিয়েছে।’

জবেদা বেগম হাসলেন। আসলেই দুটোকে মানিয়েছে। তিনি তো চোখ ফেরাতে পারেন না। কতটা সুন্দর দেখায় ছেলেমেয়ে দুটোকে একত্রে তা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। এইতো সকালে অরু তন্ময় একসাথে খেতে বসলো। জবেদা বেগম আঁড়চোখে কতবার যে নজর দিলেন, অগুনিত। শুধু সে নয়! মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব খাওয়া বাদ দিয়ে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছেন।
______________
তাদের বিয়ের কথা সকলেই ভুলে বসেছে, এ বিষয়ে আর মন খারাপ করে বসে থাকতে পারলো না অরু। বিবেকবান সে এখন শাবিহার চিন্তায় পাগল প্রায়। এইযে সকালে তন্ময় তাকে ধমক দিয়েছিল। ধমক খেয়ে অরু তন্ময়ের উপর আরও ক্ষিপ্ত। তবুও সে নিজের অভিমানী মন এবং ক্ষিপ্ত অনুভূতি একপাশে রেখে, তন্ময়ের রুমের সামনে হাজির হলো।আজ তন্ময় বাসায়। মোস্তফা সাহেব তাকে অফিস যেতে দেয়নি। শাবিহাকে দেখতে আসবে। বড়ো ভাই হিসেবে তাকে তো থাকতেই হবে। অরু অল্প খানিক দরজা ঠেলে মাথা ঢোকাল। তন্ময় বিছানায় শুয়ে টেলিভিশন দেখছে। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। টেলিভিশন থেকে খবরের শব্দ আসছে। অরু ঢিপঢিপ মন নিয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে যেতে দ্বিধাবোধ করছে মুলত। যাবে নাকি না দ্বিধাজড়িত অরুকে আঁড়চোখে তন্ময় দেখে নিয়েছে। মিনিট পাঁচেক হলো তবুও অরু ভেতরে প্রবেশ করছে না দেখে, এবার তন্ময় বলল, ‘চেয়ার এগিয়ে দিব?’

ভড়কে অরু পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। ওড়নার কোণা দরজায় লেগে আছে। খেয়াল করেনি। কিছুটা যেতেই পেছনে টান খেল। এ অগোছালো অরুকে তন্ময় এক ধ্যানে দেখছে। খবর থেকে তার নজর সরে গিয়েছে খানিকক্ষণ হয়েছে। লজ্জিত অরু টেনেটুনে ছুটিয়ে নিল ওড়না। ছিঁড়ে যাবার শব্দও শোনা গেল। লজ্জা কাটিয়ে ধীরেসুস্থে ভেতরে আসলো। মিনমিনে সুরে বলল, ‘আমিতো মাত্রই এলাম।’
‘দেখলাম তো!’

অরু ভুরু দু’য়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ নিয়ে বলল,’আপনি এমন আরামসে কীভাবে শুয়ে আছেন!’
‘কেন! আমার আরামসে শুয়ে থাকা বারন?’

অরু বিরক্ত সুরে বলল, ‘শাবিহা আপু কাঁদছে।’
‘তুইও যা মিলেমিশে কান্না কর গিয়ে।’
‘আমি কেন কান্না করবো। আশ্চর্য!’

মুহুর্তে তন্ময় শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিছানা থেকে নেমে অরুর সামনে এলো। লম্বা সে কোমর বেঁকিয়ে অরুর সমানতালে এসে, দু’গালে ছোট্ট করে চড় মেরে বসলো। অরুর তুলতুলে গাল দুটো হালকা লাল হয়ে গেল। আকস্মিক চড়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বড়বড় চোখে তন্ময়ের পানে তাকাল। তন্ময় শুধালো, ‘কান্না করার রিজন পেয়েছিস?’

অরু রেগেমেগে একাকার। নাক ফুলিয়ে বলল, ‘আপনি..আপনি…’

রাগান্বিত সে সম্পুর্ন কথা বলতে পারল না। শব্দ করে চলে গেল। নিস্তব্ধতা কক্ষ জুড়ে। তন্ময় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বুকে দু’হাত পেঁচিয়ে দরজার দিক তাকিয়ে। কিছু একটার অপেক্ষায় যেমন৷ মিনিট খানিক পর অরুর ছায়ার দেখা মিললো। ধীরেধীরে সে পুরোটাই পুনরায় তন্ময়ের রুমের সামনে এসেছে। চিৎকার করে বলল,
‘একটা পাষাণ ভাই আপনি! আপনার ভেতর বিন্দুমাত্র দয়ামায়া কিছুই নেই।’

তন্ময় গম্ভীরমুখে বলল,’সামনে এসে বল।’
‘না। এখান থেকেই বলবো। আপনি কিছু কেন করছেন না হ্যাঁ!’
‘ভেতরে আয় বলছি।’

ভেতরে যাবার সাহস অরু করলো না। বরং আরও দূরে সরে দাঁড়ালো। তন্ময় টেলিভিশন ওফ করে দিল। বইয়ের সাইডে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেল্ফ থেকে একটা বই হাতে নিয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরু পুনরায় দরজার সামনে এলো। তন্ময়ের মনোযোগ না পেয়ে দু’পা ভেতরে গেল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘শাবিহা আপু এই বিয়েটা করতে চায়না।’
‘তো?’
‘অয়ন ভাইয়া কতো ভালো। আপুর জন্য পারফেক্ট। চাচ্চুকে তাদের ব্যাপারে বলবেন না?’

তন্ময় বইটা রেখে অরুর সামনে দাঁড়ালো। মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তীক্ষ্ণ নজরে নজর মেলাতে পারছে না অরু। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে তন্ময় বারান্দার দিক চলে গেল। অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে। জিহ্বা কামড়ে তন্ময়ের পিছুপিছু গেল। রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তন্ময়। হিমশীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা আবহাওয়া। তন্ময়ের দেখাদেখি অরুও রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো। এই ঠান্ডা বাতাসে তার চোখবুঁজে আসছে। হঠাৎ পেছনে থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করলো। বিচলিত হয়ে চোখ মেলে তাকাল। তন্ময় পাশে নেই, তার পেছনে। ছুঁইছুঁই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দুপাশে রেলিং ধরেছে। তন্ময়ের বাম গালের চাপদাড়ির খোঁচা লাগছে তার ডান গালে। দুরুদুরু কাঁপছে অরুর হাত। তোলপাড় শুরু হয়েছে ভেতরে। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। তন্ময়ের গলার স্বর নরম এবং নিচুস্তরে, ‘ভাই হিসেবে আমার কর্তব্য আছে। বোনকে সহিসালামত এমন কারো হাতে দেয়া, যে তাকে সুখী রাখবে, ভালো রাখবে। আমি চাই ও এমন কাউকে পাক যে ওকে রাজরানী করে রাখবে। আমার বোনকে রাজরানী করতে হলে, ঐ ব্যাক্তিকে আগে রাজা হতে হবে। শক্তিশালী, ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। তাই অবশ্যই আমার বোনকে পেতে হলে রাজা হয়ে আসতে হবে আমার সামনে। কেঁড়ে নিয়ে যেতে হবে, আমার সাহায্য ছাড়া! আমি দেখতে চাই অয়ন কতদূর যেতে পারে। এখন তোর মাথায় ঢুকেছে আমার কথা?’

অরু মাথাটা পাশে ঘোরাতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে চাপদাড়ির খোঁচা খেল গালে গভীর ভাবে। ‘উহ’ শব্দ করে উঠলো। সরতে চাইল। তবে তন্ময় সরতে দিলো না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো মূর্তির মতো। একসময় অরু শাবিহা-অয়ন সব ভুলে গেল। পেছনে তন্ময় দাঁড়িয়ে শুধু তাই মগজে রয়ে গেল!

চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’
__________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here