প্রেয়সী পর্ব ২৩+২৪

প্রেয়সী – ২৩

হোটেল ছেড়েছি নয়টায়। হোটেলের আশেপাশে তেমন মানুষজন
দেখা না গেলেও, হোটেল ছেড়ে কিছুটা দূরে পৌঁছাতেই মানুষের আনাগোনা বেশ দেখা যাচ্ছে। বাচ্চা, বুড়ো , যুবতী-যুবক সব
ধরনের মানুষের যাতায়াত। কিছুটা দূরে দুজনের প্রতি নজর
আমার অনেকক্ষণ যাবত। একটি যুবক লোক সাথে তার
মাঝবয়েসী এক মহিলা। স্পষ্ট কন্ঠে সেই ভদ্রলোক মহিলাকে
বলছেন,
– মা, কষ্ট হচ্ছে? গাড়ি আনার ব্যবস্থা করব?
মহিলা আদুরে কন্ঠে জবাব দিচ্ছেন,
-‘ ঠিকাছিরে বাবা। তোর মা এখনও বৃদ্ধ হয়নি। এতটুকু রাস্তা চুটকি দিয়ে শেষ হয়ে যাবে।
ভদ্রলোক তার মায়ের হাত শক্ত করে চেপে। বারবার এপাশে
হাঁটতে বলার নির্দেশ দিচ্ছেন। হাসলাম আমি। মা-ছেলে ঘুরতে
বেরোয় ব্যাপারটা সচরাচর দেখা যায়না। অবশ্য তন্ময় ভাই প্রায় বেরোয়, বড় মা’কে নিয়ে ঘুরতে। সেবার ঢাকায় চারদিন থেকে
এসেছে দুজন। নানান যায়গা বড় মা’কে দেখিয়েছেন। সাধারণত এই ব্যাপার গুলো সাংঘাতিক হৃদয় স্পর্শ করে আমার।
তন্ময় ভাই আর দীপ্ত সামনে। দীপ্তর হাত ধরে রেখেছে তন্ময় ভাই।
দুজন হাঁটছে। স্বাস্থ্যবান দীপ্তর ঝাকড়া চুলগুলো সোনালী রোদের আলোয় ঝিলমিল করছে। চোখে ছোট একজোড়া চশমা।
হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি, স্নিকার্স পড়ে সে দিব্বি তন্ময় ভাইয়ের পায়ে
পা মেলাচ্ছে। দুজনের মাথায় একই রঙের ক্যাপ। তাদের দিক
একবার চোখ গেলে দ্বিতীয় বার তাকাতে বাধ্য। আর সেটা হচ্ছেও। আশেপাশে অনেকেই তাকাচ্ছে। কিউট। পেছনে আপু আর ইব্রাহিম ভাই। তারা ঝগড়া করছে না কথা বলছে বোঝা দায়। আমি
আশপাশে মনোযোগ দিলাম। তখনই পাকনা দীপ্তর কন্ঠ,
– তৃষ্ণা পেয়েছে। ‘
ভাগ্যিস মনে করে ছোট ব্যাগে দুবোতল পানি এনেছিলাম। নাহলে কী হতো? ব্যাগ থেকে বোতল একটা বের করে দিলাম। দীপ্ত পানি খেয়ে হাঁপাচ্ছে,
– বাব্বাহ। আর কতদূর?
তন্ময় ভাই বললেন,
– এসেছি।
হ্যাঁ, ওইতো দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে ছোট দেখাচ্ছিলো। সামনে এসে বোঝা যাচ্ছে কতটা বিশাল বড়। এতটা উঁচু’তে উঠতে হবে আমাদের। ভয়ে জান না গেলেই হচ্ছে।

পাহাড়ের অর্ধেক উঠে দীপ্ত আরও হাঁপাচ্ছে। ফরসা মুখ লাল হয়ে এসেছে। ইব্রাহিম ভাই কোলে নিতে চাচ্ছিলেন। দীপ্ত উঠবে না।
– আমি একজন ম্যানলি ছেলে। কোলে উঠার বয়স নেই।
বেশ বড় গলায় ভাষন দিল। অথচ যখন তন্ময় ভাই কোলে তুললেন, পিচ্চি একদম শান্ত। চুপচাপ ভাইয়ের কোলে উঠে যাচ্ছে আমাদের আগে। দীপ্ত’কে কোলে নিয়েও কী দ্রুত চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ। এক পর্যায়ে দেখা গেল, দীপ্ত’কে উপরে রেখে তিনি আবারও এসেছেন। শক্তি দেখাচ্ছে যে? হু। আমি পাত্তা না দিয়ে দ্রুত উঠার প্রচেষ্টায়। তিনি এসে আমার বাহু জড়িয়ে
ধরলেন।
– কোলে নিব?
আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে, দ্রুত মাথা নাড়ালাম,
– উঁহু। না।
তিনি হাসলেন। বাহু শক্ত করে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমারও আর সরতে ইচ্ছে হলো না। গরম গালের আভাস নিয়ে তার সাথে স্পর্শে রয়ে গেলাম।

কথায় আছে, অতি কষ্টে সুখ মেলে। কথাটা আসলেই সত্য। এইযে এতক্ষণের কষ্টের ফল, এই চমৎকার দৃষ্য। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো পৃথীবি যেন একদম ছোট । পৃথীবির সৌন্দর্য যেমন ফুটে উঠেছে। দীপ্ত শব্দ করে চেঁচাচ্ছে। রুবি আপু ভিডিও করছে। ছবিও তুলছে। হঠাৎ বলল,
– এই তন্ময় দাঁড়া।
তন্ময় ভাই না করে দিলেন,
– উঁহু। তুলবো না। ‘
– আররে অরুর সাথে।
এবার তিনি আমার দিক তাকালেন। বললেন,
– তাহলে তোলা যায়।
অমত করলাম না। এই সৌন্দর্যের মাঝে থাক না তার আমার একটি স্মৃতি। যা দেখে আনমনে হাসবো, লজ্জা পাব। তিনি ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালেন। আদুরে ভাবে কোমর ছুঁয়ে দিলেন। এখনও আমি তার স্পর্শের ছোঁয়া নিতে পারছিনা। শরীর কাঁপা হতে থামাতে পারছিনা।
আমার শক্ত হয়ে থাকা দেখে তিনি মিষ্টি হাসলেন। তার ঠোঁট মাথায় ছোঁয়ালেন। শক্ত করে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ধুকপুকের তীব্রতা আজ অপরিসীম, অপরিচিত।

যখন আমরা ফিরবার পথে চলছিলাম। সামনে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। হাতে বড় এক চায়ের ফ্ল্যাক্স। সাথে ঝুলানো কিছু ওয়ান টাইম কাপ গুলো। বিস্কুট আর সিগারেটও রেখেছেন। আমাদের দেখে
বললেন,
– চা খাইয়া যাও গরম গরম।
দীপ্ত লাফিয়ে উঠলো,
– চল খাই।
মানলাম সবাই। চা দিতে দিতে বৃদ্ধের নানান প্রশ্ন,
– তা আফনারা বিবাহিত?
প্রশ্ন’টা ক্লিংগি পেছনের কাপল’কে করা হলো। মানে রুবি আপু আর ইব্রাহিম ভাইয়া’কে। আমি হাসলাম। জবাব দিলাম,
– বিবাহিত না। খুব শীগ্রই হবে। এইতো মাস শেষে তাদের বিয়ে।
– মাশাল্লাহ। আল্লাহ ঠিক এভাবেই মিলিয়ে রাখুক সারাজীবন।
রুবি আপু লজ্জা পেল। ততক্ষণত ধন্যবাদ ও জানাল। তন্ময় ভাই চা খাবেন না। তিনি অন্যপাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে। চা হাতে চুমুক দিয়েছি তখন বৃদ্ধার আরেক প্রশ্ন,
– আফনারা দুইজন?
এটার জবাব কীভাবে দিব? আমি অন্যদিকে তাকালাম। আপু হাসছেন। দীপ্ত আগে আগে তন্ময় ভাইকে দেখিয়ে বলল,
– এই হচ্ছে আমাদের ভাই। কিন্তু অরু আপুর ভাই, প্রেমিক আর ভবিষ্যৎ হাসবেন্ড। একের ভেতর সব যাকে বলে।
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম। সকলে হাসছে। রুবি আপু খুলে বললেন,
– চাচাতো ভাই-বোন। ওদের দুজনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
ইশ। কবে ঠিক হলো? এই ব্যাপারে কথা হয়েছে, তার সম্পর্কে না জানা আমি। অথচ বাড়ির সকলের মুখে মুখে রয়েছে,
‘ বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ‘ কবে, কই, কখন? আমি শুনিনি কেন?’
বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। সেখানে অনেকক্ষণ ঘুরে, আবারও হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

আমাদের সকলের অবস্থা আধমরা। শুধু তন্ময় ভাই এখনও শক্ত ভাবে হেঁটে চলছেন। তাকে দেখলে বোঝা যাবে না যে, আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পাহাড় বেয়ে এসেছি। পা খুবই ব্যাথা করছে। রুমে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে বিছানায় যাব আগে। ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন। করলাম ও সেটা। হোটেল পৌঁছাতেই আমি আগে ফ্রেস হতে গিয়েছি। এসে খাওয়া ছেড়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। ঘুমে চোখ বুঝে আসছে। অথচ আপু চেঁচাচ্ছে,
– অরু, এখন খাবি। ঘুমাস না।
এটা কোনো কথা? অথচ ঘুম কথা শুনছে না৷ ঝেকে ধরেছে আমায়। তখনই তন্ময় ভাই হাজির। হাতে প্যাকেট। খাবার নিয়ে এসেছেন। বললেন,
– উঠ।
পরপর ইব্রাহিম ভাইও হাজির। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুম ধরেছে প্রচন্ড। ঘুমঘুম চোখে তার দিক তাকালাম। বললাম,
– উঠে খাব। আপনারা খান।
তন্ময় ভাই দিলেন এক ধমক।
– থাপ্পড় খাবি?
দ্রুত উঠলাম। প্যাঁচা মুখ করে এক কোণায় বসলাম। লোকটার আমাকে ধমকানো থামবে না? ভালবেসে বললেই তো হতো ।
পাষাণ। আধমরা মুখ নিয়ে খাচ্ছি, দেখে সকলেই হাসছে। দীপ্ত
হাসছে আর খোঁচাচ্ছে আমাকে। খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় তন্ময় ভাই আমার গাল টেনে ধরলেন,
– এতো ঘুম কই থেকে আসে?
এহ। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ঘুম তো আসবেই। আমি তো আর তার মতো রোবট নই। রক্তে মাংসে তৈরি মানুষ।

চলবে
রুবি আপু জোরসে চেঁচাচ্ছে,
– যাব না, যাব না।
নিশ্চয়ই ইব্রাহিম ভাই ডাকছে তাকে। কতটা ভালবাসেন। একদম চোখ ছাড়া করেন না। কতটা লাকি আপু। আর তন্ময় ভাই। ইশ, নাম ও নেই। লোকটা সেই যে গিয়েছে। হাওয়া। যাক, যাক, যাক।
মাত্র ছয়টা। যাও ঘুম ধরেছিল, তন্ময় ভাইয়ের ধমক খেয়ে চলে গেলো। এখন তাকে জ্বালাবো। কেন আমার ঘুম ভাঙিয়েছে।
এবার আর তাকে মেসেজেস করলাম না। বরং সাহস নিয়ে রুমের দরজা খুলে বাহিরে গেলাম। তার রুম পরেরটি। রুমের দরজা খোলা। ধীরে গিয়ে উঁকি দিলাম। তিনি শার্টল্যাস। শরীর কেঁপে উঠলো। শার্টল্যাস তিনি, অথচ শ্বাসকষ্টে আমি। মাত্র গোসল সেরেছেন হয়তো। এখনও চুলে পানি। তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ ঘুরে আমাকে দেখে ফেললেন। আমার দৌঁড় আর কে দেখে। তার শব্দ করে ডাকা শুনতে পেয়েছিলাম। তাও থামিনি। বুক ধুকপুক করছে। রুমে ঢুকে দরজা লক করে ফেললাম। রুবি আপু নেই। ওহ। তিনি তো ভাইয়ার সাথে বাহিরে বসে। বিছানায় শক্ত করে বসে আছি। যখনই ভাবলাম তিনি আসবেন না। তখনই দরজায় নক। নিশ্চয়ই তন্ময় ভাই। খুলে রিস্ক নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
বিছানায় উঠে কম্বলের ভেতর ঢুকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ হচ্ছে।
এখন আর কোনো নক নেই। আহ, চলে গিয়েছে। ধীরে এগিয়ে গেলাম। আস্তে করে দরজা হালকা খুলে, মাথাটা বের করেছিলাম।
তন্ময় ভাই সোজা সামনে দাঁড়িয়ে। এই লোক যায়নি? দরজা লাগাতে গিয়েও পারলাম না। আমার থেকেও দ্রুত গতিতে
তিনি রুমে ঢুকলেন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার চুল টেনে ধরলেন,
– ডেকেছিলাম, শুনেছিলি?
ধীরে জবাব দিলাম,
– শুনিনি।
মারাত্মক ধীরে বললেন,
– মিথ্যে কথা। ব্যাড গার্ল।
ঢোক গিললাম। এভাবে কথা বলছে কেন? আঁড়চোখে তাকালাম।
আমার দিক তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,
– রেস্ট নে। ইউ নিড ইট।
চলে গেলেন। বড় বড় শ্বাস ফেললাম। এটা কোনো কথা?

রাত গভীর। বিছানায় শুয়ে মনে পড়লো, সকালে পরিবার থেকে কল এসেছিল। মা-বাবা, বড় চাচ্চু, বড় মা সকলে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কথাই বলতে পারলাম না। পাহাড়ে চড়ার জন্য এতটা এক্সাইটেড ছিলাম যে, ব্যাপারটা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। এখন তো অনেক রাত। হয়তো সকলে ঘুম বিভোর। কাল কথা বলে নেব।
চোখ লেগে এসেছিলো, তখনই তন্ময় ভাই হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসেছেন। তার এমতাবস্থা দেখে আমি দ্রুত বিছানা ছাড়লাম।
তিনি ভাঙা কন্ঠে আদেশ দিলেন,
– দ্রুত তৈরি হ।
তার অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ কেউ প্রশ্ন করেনি। বরং জামাকাপড় পরিবির্তন করে, কাপড়চোপড় ব্যাগে নিতে নিতে
আপু প্রশ্ন করলো,
– কী হয়েছে তন্ময়?
তন্ময় ভাইয়ের জবাব নেই। ইব্রাহিম ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে
জবাব দিলেন,
– অরুর আম্মু হার্টএট্যাক করেছেন।
আমার সামনের পৃথিবী থমকে দাঁড়ালো। কেমন সব অন্ধকারে মিশ্রিত হলো। সে তো ভালো ছিলেন, তাহলে? আসার পূর্বে সম্পুর্ন সুস্থ দেখে এসেছি। হঠাৎ কি হলো? মায়ের চেহারা চোখে ভাসতেই শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে৷ এটা তার দ্বিতীয় তম হার্টএট্যাক। ভয়ে বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু হবেনা তো? ঠিক হয়ে যাবে তো?
তন্ময় ভাই টেনে তার বুকে চেপে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। কতক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে যেয়েও, পারলাম না। চোখের জল অকারণে বেয়ে যাচ্ছে দিশেহারা হয়ে । কাঁদছি কেন আমি? মা ঠিক হয়ে যাবে। তন্ময় ভাই আমাকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন। গাড়িতে বসিয়ে তিনি ড্রাইভিং গেলেন। পেছনে রুবি আপু আমাকে ধরে বসলো। আজ বাহিরের প্রকৃতিও আমাকে মোহিত করতে পারছে না। ধ্যান মেরে নিচে তাকিয়ে। এইত সেদিন বিকেলে কী সুন্দর কফি বানাতে শেখাল। বোকাঝোকা করলো।
কী হয়ে গেলো একদিনের মাঝে?

হসপিটাল পৌঁছে বাবার শুঁকনো চেহারা। চোখ নাক লালচে হয়ে আছে। পুরুষ মানুষ বিদায় কেমন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। অথচ আমি কত সহজে কেঁদে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, বাবার কেমন লাগছে?
তিনি তো কাঁদতে পারছেন না। তার কী যন্ত্রণা’টা অতিরিক্ত ভাবে জমা হচ্ছে? সোজাসাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে এক অস্থির চাহনি দিলেন। যেখানে তিনি বোঝালেন, তোর মা ভালো নেই।
কেন যেন, বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আমি নড়তে পারছি না। পা শক্ত ভাবে ফ্লোর ছুঁয়ে। অদ্ভুত ভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে।
তাও, পাথরে পরিনত পা দুটো’কে নিয়ে বাবার দিক পৌঁছালাম।
আমার কাঁদা দেখে বাবাও ভেঙে পড়লেন। লাল চোখ গুলো নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলেন। পেছন থেকে স্পষ্ট ভাসছে তার পিঠ কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অপরিসীম চেষ্টা করছে।
নানুর বাড়ির সকলে এসেছে। অথচ কোথাও আমার নজর যাচ্ছেনা। বন্ধ হয়ে যাওয়া কাঁচের দরজার দিক তাকিয়ে।
বড় মা কাঁদছে। নানু বাড়ির সকলে এসেছে। ছোট মামা পাশে এসে, আস্থা দিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মন শান্ত হলো না।
ভয়ে মন, শরীর কাঁপছে। বড় মা তার বুকে জড়িয়ে নিলেন। আদুরে কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,
– কাঁদিস না। আল্লাহ’কে ডাক। তিনি সব ঠিক করে দিবেন।
সত্যি কী সব ঠিক হয়ে যাবে? এবার তো রিস্ক বেশি। এটা তার দ্বিতীয় তম হার্টএট্যাক। কতটা রিস্ক রয়েছে তা বোঝার মতো অবস্থা হয়েছে আমার।

মায়ের জ্ঞান নেই। ডাক্তার এসে খুব সিরিয়াস ভাবে বড়দের সাথে কথা বলে গেলেন। বাবার চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভালো কোন সংবাদ দেননি । ভোর থেকে সকলে হসপিটাল বসে। বড় মা কতবার করে খাওয়াতে চেষ্টা করলেন। আমি খেতে পারলাম না।
বসে রইলাম। সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে৷ মায়ের জ্ঞ্যান না আসা পর্যন্ত, আমার দ্বারা কিছু হবেনা। কিচ্ছু না। সারাদিন না খাওয়া আমার শরীর নেতিয়ে, ভয়, ক্লান্তি সব ঝেঁকে বসে। রাত দুটো’র দিক খবর, এলো মা নেই৷ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তিনি হেঁড়ে গেছেন। এতক্ষণের
জমানো ভয় নিমিষেই ঘূর্নিঝড়ে রুপান্তরিত হলো। বাবা কেমন বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেছে। সকাল থেকে নিজেকে শক্ত করে রাখা, আমার বাবা ভেঙে পড়লেন। বাচ্চাদে মতো কেঁদে উঠলেন।
আমাকে শক্ত করে ধরে রাখা বড় মা, কেমন হাউমাউ করে কাঁদছেন। সকলের কান্নার শব্দে মাঝে, আমি নিঃশব্দে বসে। চোখ জল নেই। নেই কোনো হাউমাউ কান্নার শব্দ। শরীরের সব কিছু অবসে পরিনত হয়ে আছে। জ্ঞ্যান চিন্তাশক্তি কাজ করছে না।
অবস্থা তখন বেগতিক হলো, যখন মায়ের লাশ বেরোলো। তাকে ধরে আমার হাউমাউ কান্নায় বাবা কাঁদছে। রুহ যেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে । চোখ বুঝে শুয়ে থাকা আমার মায়ের দৃশ্য কেমন আমাকে মেরে ফেলছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যাচ্ছে, অথচ মায়ের শরীর আমার থেকে কেউ নিতে পারছেনা। তার মুখের দিক তাকালে মনে পরে, আমাদের স্মৃতি। বাড়িতে ফিরে মা কাকে ডাকব। আর কোনো মা থাকবে না পৃথীবিতে। সারা জীবন থেকে মা চলে যাবে।
এই অঝোর কান্নার বিরতি নেই। মায়ের সাথে থাকার শক্ত লড়াইয়ে তন্ময় ভাই আমাকে চেপে ধরে দাঁড় করালেন। কিন্তু আমাকে থামাতে পারছেন না। পাগলের মতো আমার কান্না দেখে তিনি অস্থির চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের সামনে মা’কে এম্বুল্যান্সে নেওয়া হচ্ছে। পাগলের মতো ছুটে আমিও উঠলাম এম্বুল্যান্সে। বাবাও বসে ভেতরে। একধ্যানে মায়ের হাত ধরে বসে। কান্নার বেগ আমার বেড়ে চলেছে। ক্রমাগত কান্নার ফলে শ্বাস নিতে পারছিনা৷

মসজিদে নেওয়া হয়েছে মা’কে। গোসল করাবে৷ বড় মা, রুবি আপু আমাকে চেপে ধরে। নাহলে আমি আমার মায়ের কাছে থাকতাম। তার পাশে। মসজিদের গেইট থেকে কেউ আমাকে নিতে পারল না। মাথায় কাপড়ে আমি শক্ত হয়ে বসে। বড় মা ও আমাকে জড়িয়ে বসে। বাচ্চা দীপ্তর দিক আমার চোখ মাত্র গেলে। স্বাস্থ্যবান ছেলেটা কাঁদছে। চশমার নিচে চোখের পানি গুলো বেয়ে যাচ্ছে। ওর দিক তাকাতেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কমে যাওয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। অস্থির ভাবে চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে৷
শেষ বারের মতো তাকে দেখাল। মা’কে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি নিস্তেজ হয়ে এলাম। নিমিষেই চোখের সামনের সব ঝাপসা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here