‘ফাগুন চেয়েছে মন’
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১
ফাগুনের বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। উত্তেজনায় হাতের তালু ঘামছে। মাথার ভেতর যযন্ত্রণা হচ্ছে। আসাদ ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলে বিয়েটা কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। পালানোর রাস্তা বন্ধ। দরজায় পাহারা বসিয়ে রেখেছে ফাগুনের বাবা খালেদ তালুকদার। সেই কঠিন পাহারা পেরিয়ে ফাগুনের পক্ষে কিছুতেই বিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানো সম্ভব নয়। এখন একমাত্র ভরসা আসাদ। ও সময়মত পৌঁছালেই আর কোনো ভয় থাকবে না। যেভাবেই হোক বাবাকে ম্যানেজ করে ফেলবে ফাগুন। দরকার পড়লে পায়ে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি দেবে তবুও বিয়েটা হতে দেবে না। ভয়ে ভয়ে ঘড়ির দিকে চাইলো ফাগুন।
ঘড়িতে এখন তিনটা বিশ। আসরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হবে। হাতে সময় আছে মাত্র একঘন্টা। এর মাঝে আসাদ এসে পৌঁছাতে না পারলে কি হবে! বিয়ে হয়ে যাবে? আসাদকে ও হারিয়ে ফেলবে! মস্তিষ্কে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো ফাগুন। দুহাতে মাথা চেপে ধরে দেওয়ালের সঙ্গে এলিয়ে দিলো। ঘরের ভেতর ওর হবু বরের বয়স নিয়ে আত্মীয়স্বজনরা সবাই কানাঘুষা করছে। ফাগুনের সেদিকে মন নেই। ওর চিন্তা কেবল আসাদকে নিয়ে। আসাদ কখন আসবে! মাথার যন্ত্রণা এড়াতে চোখটা বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো।
আসাদ ফাগুনের প্রেমিকের নাম। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া কালীন ওর সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয় ফাগুনের। কোচিং সেন্টারের তরুণ শিক্ষক আসাদ নোট আদান প্রদানের বাহানায় ভালোবাসা আদান প্রদান করে ফেলে সুন্দরী ছাত্রী ফাগুনের সঙ্গে।
মাস তিনেক মিষ্টিমুধর প্রেমের পরই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা অনুভব করতে হয় দুজনকে। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে যায় আসাদ। তবে যাওয়ার আগে ফাগুনকে কথা দিয়ে যায় চাকরী পেলে প্রথম মাসেই ফাগুনকে বউ করে ঘরে তুলবে।
কিন্তু মাঝখানে এই বিয়ের ঝামেলা এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। ফাগুন বুঝতে পারছে না এইমুহূর্তে ওর কি করা উচিৎ। দুশ্চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আসাদের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হতো। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের মুঠোফোনটা হাতে নিলো। ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানায় চুপিচুপি আসাদের নাম্বারে ডায়াল করলো। দুবার রিং হতেই আসাদ ফোন রিসিভ করলো। ফাগুন আকুতিভরা কন্ঠে আর্তনাদ জানিয়ে বললো,
‘কোথায় তুমি? এখনো কেন আসছো না? তুমি না এলে আব্বা সত্যি সত্যি আমার বিয়েটা দিয়ে দেবে।’
ফাগুন কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। ওপাশ থেকে আসাদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ঢাকায় পরিবহণ ধর্মঘট চলছে ফাগুন। আমি গাড়িঘোড়া কিচ্ছু পাচ্ছি না।’
‘কি বলছো তুমি!’
ফাগুনের চাপা কান্না তীব্রতর হলো। আসাদ না এলে ওর পক্ষে বিয়ে আটকানো অসম্ভব। খালেদ তালুকদার জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবেন। কান্না আটকানোর জন্য একহাতে মুখ চেপে ধরলো ফাগুন। আসাদ ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সান্ত্বনার সুরে বললো,
‘কেঁদো না ফাগুন। কেঁদে কোনো লাভ হবে না। তুমি বরং চেষ্টা করে দেখো বিয়েটা আরো তিনচার ঘন্টা আটকে রাখতে পারো কিনা। এর মাঝেই আমি আসবো।’
‘তিনচার ঘন্টা আমি কি করে আটকাবো? বাবা কিছুতেই মানবে না।’
‘মানবে। না মানলে তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে বেহুঁশ হওয়ার ভান করবে। এরমাঝে আমি চলে আসো। এখন রাখি।’
ফাগুন ফোন রেখে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু ভয়ে চিৎকার করতে পারছে না। চিৎকার করলেই খালেদ তালুকদার বুঝে ফেলবেন আসাদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়েছে। বিয়েটা দ্রুত সেরে ফেলবেন। ফাগুন কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চোখ মুছে ধীরেসুস্থে খাটে গিয়ে বসলো।
★
একুশ বছর বয়সী ফাগুনের রূপের তুলনা দুচার গ্রাম খুঁজলেও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে। রূপে গুনে পরমাসুন্দরী এই তরুণীটি পিতার মাতার অত্যাধিক আদরে যত্নে লালিত পালিত হয়েছে। খালেদ তালুকদার কন্যা বলতে দিশেহারা। মেয়েকে তিনি চোখের মণি করে রেখেছেন। কিন্তু সেই কন্যার বেলাতেই কেন তিনি এতটা কঠিন হলেন সেটাই কারো কাছে বোধগম্য হলো না।
আর্থিকভাবে দুর্বল হলেও পাত্র হিসেবে আসাদ ফাগুনের যোগ্য। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। মেধাবী ছাত্র। ধনসম্পদ নিয়ে খালেদ তালুকদারের বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে কেউ কখনো শোনে নি।। তার নিজের যা আছে তাই মেয়ের জন্য ঢের। ফাগুন উনার একমাত্র সন্তান। সারাজীবন রাণীর হালে থেকে খেয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এর পরেও তিনি কেন আসাদের সঙ্গে ফাগুনের বিয়েটা দিতে রাজি হলেন না সেটা একটা বিরাট রহস্য!
গ্রামের লোকও খালেদ তালুকদারের এমন সিদ্ধান্তে রীতিমত হতবাক। গ্রামের চেয়ারম্যান তিনি। বিচক্ষণতা এবং ন্যায় বিচারে সকলের আদর্শ। তার মত বিচক্ষণ লোক নিজের মেয়ের বেলায় কি করে এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো সেটা সবার কাছে ধোঁয়াসা।
একুশ বছর বয়সী কন্যাকে বিয়ে দিলেন ওর চেয়ে একযুগ বেশি বয়স্ক তেত্রিশ বছরের এক যুবকের সঙ্গে। নিজের সমস্ত ভালোবাসা, আশা আকাঙ্ক্ষা বির্সজন দিয়ে বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করে ফাগুন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার ভান করে প্রায় পাঁচ ঘন্টার মতন বিয়েটা আটকে রেখেছিলো ফাগুন। কিন্তু আসাদ আসে নি। পরিবহণ ধর্মঘট নামক এক ভয়াবহ দুর্যোগ ফাগুন এবং তার প্রেমিক পুরুষটিকে সারাজীবনের জন্য আলাদা করে দিলো।
বাবার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা বোধ করলো ফাগুন। আসাদের মতন ছেলেকে বাদ দিয়ে বাবা কি করে এমন বয়স্ক ছেলের সঙ্গে ফাগুনের বিয়ে ঠিক করলো। কি দোষ করেছিলো আসাদ? কেন বাবা ওকে মেনে নিতে পারলো না। মনে মনে পিতার প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করলো ফাগুন। বিদায় বেলা প্রতিজ্ঞা করলো শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আর কোনদিন এই বাড়িতে পা রাখবে না।
ফাগুনের জীবনের আরেকটা বড় উপহাস হলো তেত্রিশ বছর বয়সী সেই পুরুষটিকে দেখতে নাটক সিনেমার হিরোদের মতন আটাশ, উনত্রিশ বছরের কোনো যুবকের মত নয় বরং তেত্রিশ বছরের এক পরিপূর্ণ পুরুষের মতনই লাগে। কানের কাছে একগুচ্ছ চুলে পাক ধরেছে। গলাটা কেমন পুরুষালী, গমগমে। বাবার প্রতি রাগ যেন ক্রমশ ঘনীভূত হলো ফাগুনের। কি করে তিনি এমন অর্ধবয়সী যুবককের সঙ্গে বিয়ে দিলেন ফাগুনের? ফাগুনের কি কোনো মূল্য নেই উনার কাছে?
★
সৃজনের যখন আট বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যায়। পিতৃহীন সৃজন একা মায়ের আদরে বড় হয়। বাবার অঢেল সম্পত্তি আর টাকাপয়সা থাকার কারণে কোনোরকম আর্থিক টানাপোড়নে পড়তে হয় নি যদিও তথাপি মাথার ওপর শক্ত হাতের অভাব থাকলে কাছের মানুষগুলোই রক্তচোষা জোঁকের মতন ধারালো কামড় বসায়। আত্মীয়স্বজনদের লোভ আর তীব্র হিংসার কারণে ধীরে ধীরে মন্দা নেমে সৃজনের পৈত্রিক ব্যবসায়। বেশ কিছুদিন কষ্টে কাটাতে হয় সৃজনদের। কিন্তু পড়াশোনা ব্যবসার হাল ধরতেই ক্রমে ক্রমে আবার সবকিছু পুনরুদ্ধার হয়। বাবার রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে গ্রামে পোশাক কারখানা স্থাপন করে সৃজন। সেই পোশাক কারখানার আয় থেকে ধীরে ধীরে বর্তমানে বিপুল অর্থসম্পদ মালিক সৃজন।
মা ছাড়াও আরো দুজন মানুষ ছিলো সৃজনের পরিবারে। সেই দুজন মানুষ হলো সুধা এবং ওর মা সাবেরা বানু। সাবেরা বানু সৃজনের দূরসম্পর্কের ফুপু। সুধা উনার মেয়ে। সুধার বাবা মারা যাওয়ার পর সৃজনের বাবার ভরসাতেই বেঁচে ছিলেন সাবেরা বানু। তারপর পিতার অবর্তমানে সেই দায়িত্ব কাধে তুলে নেয় সৃজন। সুধার পড়াশোনার খরচ, সাবেরা বানুর ওষুধ খরচসহ যাবতীয় সকল খরচ সৃজন প্রতিমাসে সাবেরা বানুর হাতে তুলে দেয়। সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ করে আবার যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়!
বাবার শাসনের অভাবে বখে যাওয়ার মতন ছেলে সৃজন নয়। ও নিপাট ভদ্রলোক। গ্রামে পরোপকারী নির্ভেজাল মানুষ হিসেবে ওর বেশ সুখ্যাতি আছে। সেই সুযোগ নিয়ে বারে বারে ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে কাছের মানুষজন। কিন্তু তবুও সৃজন কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করে নি। সবার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু এই নির্ভেজাল প্রকৃতির,ভালোমানুষটির জীবনেই সমস্ত দুর্যোগ যেন একের পর এক দলবেধে নেমে আসে।
বছর তিনেক আগে একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সৃজনের। মেয়েটি ছিলো সুন্দরী, শিক্ষিতা। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় সৃজনের মায়ের। তোড়জোড় করে বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে ফেললেন। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে বউ পালিয়ে যাওয়ায় বিয়েটা ভেস্তে যায়। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন হতাশায় ছিলো মা ছেলে। তারপর আবার দ্বিতীয় বিয়ে!
দ্বিতীয় বিয়েটা ভাঙ্গে সুধার কারণে। কে বা কারা যেন শত্রুতাপূর্বক পাত্রী বাবার কাছে খবর পৌঁছায় সুধার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চলছে সৃজনের। সেই খবর কানে যেতেই পাত্রীর বাবা বেকে বসলেন। ব্যস্ত! সেই বিয়েটা ভেস্তে গেলো। সাবেরা বানু লজ্জায় মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলেন।
তারপর হুট করে একদিন সৃজনের মা মারা যায়। সবকিছু মিলিয়ে বয়সটা যে কখন ত্রিশ থেকে তেত্রিশে এসে পৌঁছেছে সেটা সৃজন টেরই পায় নি।
এদিকে ফাগুনের মনের অবস্থা ভয়াবহ। বিয়ের পর ফাগুন বুঝতে পারলো তার বর নামক মানুষটির সত্যিকারের বয়স যা তার চাইতে মনের বয়স অনেক বেশি। বেরসিক, নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির মানুষ। কোনকিছুতেই এর সঙ্গে ফাগুনের মনের মিল হয় না। কেমন যেন জড় পদার্থ! এর সঙ্গে সমঝোতা হয় কিন্তু সংসার হয় না।