ফিলোফোবিয়া পর্ব -১৮

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

১৮.

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

দুই গ্রামের লোকজন চেয়ারম্যান মেম্বার সহ সালিশ বসলো। সালিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঝামেলা মিটিয়ে, মিলমিশ করে নিতে হবে দুজনকে। কিন্তু, শতাব্দ তা মানল না। তুমুল কথাকাটাকাটি হলো সেখানে। এক সময় ক্ষেপে গেল শতাব্দ। আরেক চোট বেদম পিটানো পিটালো শিহাবকে। শতাব্দের এমন রূপ দেখে হতভম্ব চেয়ারম্যান সাহেব। ছেলের এমন রূপ দেখেনি আগে। পরবর্তীতে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে।
সালিশে প্রিয়’র নাম তোলার কোন সুযোগ দেয়নি শতাব্দ। তার পূর্বেই গন্ডগোল করে থামিয়ে দিয়েছে সব।
সারা গ্রামে চাপা গুঞ্জন। ঝামেলা যে কোন মেয়েকে কেন্দ্র করেই হয়েছে তা সকলে নিশ্চিত। গ্রামের আনাচে-কানাচে সেই মেয়েকে নিয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা কৌতূহল। অজানা সেই রহস্যময়ীকে খোঁজার। চারিদিকে তল্লাশি বার্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

শতাব্দের প্রস্তাবে সরাসরি বিরোধিতা না করলেও, বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে আয়েশা বেগম। যেমন, প্রিয়’র সাথে হুটহাট দেখা না করা, কথা না বলা, যোগাযোগ না করা এমন আরো অনেক শর্ত। সেসব শর্ত না মানলেও। বিরোধী তার বিরোধিতাও করেনি শতাব্দ। ইমান্দিপুরে আসা কমিয়ে দিয়েছে আজকাল। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আসেনা। মাসে বড়জোর দুই-এক দিনের জন্য আসা তার।

স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ ফেলে। টানটান হয়ে বিছানায় হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল প্রিয়। আজ থেকে ছুটি শুরু। আগামী বিশদিন ঈদের বন্ধ থাকবে স্কুল। বাবা তা আগে থেকে জানত। গাড়ি পাঠাতে চাইছে বারবার, আজ ইফতারের পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে বলছে। খালাও তাতে এক মত। তিনি চাইছেন না শতাব্দের সাথে প্রিয়’র দেখা হোক।
অভিমানে মন ভার প্রিয়’র। জলে চিকচিক চোখ। গতরাত থেকে কতবার শতাব্দকে ফোন করছে। কখনো বন্ধ বলছে। কখনো আবার তুলছেনা ফোন। বিরক্ত হলো প্রিয়। শতাব্দ কি পড়াশোনা নিয়ে এতই ব্যস্ত! যে তার ফোন তোলার মত সময় পাচ্ছেনা অন্তত। সে কি আড়ালে এড়াতে চাইছে প্রিয়’কে? কথা না বললেই কি প্রিয়’র আবেগ অনুভূতির উপর কাবু আনতে পারবে সে!
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল প্রিয়। বিছানা ছেড়ে উঠল। ব্যাগ থেকে মোটা ডায়েরিটা বের করল। ডায়েরি কেটে তার ভেতরে ফোন রেখেছে। ডায়েরি কেটে ফোন রাখার বুদ্ধিটা অবশ্য তানহার। নির্বাচনের পর, ঢাকায় যাওয়ার আগে মোবাইলটা দিয়ে গেছে শতাব্দ। প্রিয়’র ফোন চালানোর উপর নিষিদ্ধ জারি করেছে খালা। তাই খালা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, রোজ রাতে শতাব্দের ফোনের আশায় হাতে মোবাইল নিয়ে বসে থাকে প্রিয়। সচরাচর ফোন করেনা শতাব্দ। যখন নিজের আবেগ অনুভূতির উপর খুব বেকাবু হয়ে পড়ে তখনি এলোমেলো হয়ে ফোন করে। আবেগে অনুভূতিতে বেকাবু হয়ে আবোলতাবোল অনেক কিছু বলে। তার অনুভূতি মাখানো বেফাঁস কথাবার্তার সদা হু, হা বলে উত্তর দেয় লজ্জায় জর্জরীত প্রিয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে উথাল-পাতাল ঝড় চলে তার।
ঘড়ির দিক তাকালো প্রিয়। চারটা বাজতে চলছে। সে নিশ্চয়ই ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরেছে। একবার তাকে ফোন করবে কি?
অনেক ভেবে চিন্তে মোবাইল অন করল। শতাব্দের নাম্বারে কল করল। কয়েকবার রিং বাজতেই ফোন তুলল শতাব্দ।

‘ কেমন আছো প্রিয়?’

ফোনের অপর পাশে হতে শতাব্দের গভীর আওয়াজে পেয়ে আবেশে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। দুইদিন পর এই আওয়াজটা আবার শুনলো। সারা শরীর জুড়ে এক মৃদু শীতল হাওয়া বয়ে গেল। শতাব্দের প্রশ্নের উত্তর দিলো না প্রিয়। কাঁপাকাঁপি কন্ঠে তড়িঘড়ি করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কেমন আছেন? শরীর সুস্থ আছে আপনার? গত দুইদিন ফোন করেননি। কোন খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। চিন্তা হচ্ছিলো আমার।’
প্রিয়’র কন্ঠে চিন্তা, অস্থিরতা। অপর পাশ হতে নিশ্বাসের দ্রুত ফোঁসফোঁস আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু চুপ থেকে শতাব্দ বলল,
‘ শান্ত হও। আমি সুস্থ আছি। এই দুইদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই যোগাযোগ করতে পারিনি।’
প্রশান্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। নিশ্চিত হলো। একটু শান্তি লাগছে এখন।
‘ এত আবেগী হলে হয়না প্রিয়। নিজের ইমোশনের উপর কন্ট্রোল আনো।’
শতাব্দের এমন কথায় রাগ হলো প্রিয়’র। একজন মানুষ আচানক দুদিন কোন খোঁজখবর ছাড়া লাপাত্তা হয়ে গেলে তাকে নিয়ে চিন্তা করাটা কি স্বাভাবিক না? কপাল কুঁচকে বলল সে,
‘ আমি কি করে আমার আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসার উপর নিয়ন্ত্রণ আনবো? এগুলোকে কি আদৌ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়? আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার জন্য চিন্তা হয় আমার! এটা কি অস্বাভাবিক?’
‘ হ্যাঁ, অস্বাভাবিক!’
ভীষণ কষ্ট পেল প্রিয়। কান্নাভেজা অভিযোগী কন্ঠে বলল,
‘ জানি আপনি আসবেননা তবুও প্রত্যেক সাপ্তাহ আমি আপনার ফেরার অপেক্ষা করি। জানি ফোন করবেন না। তবুও ভোর অবধি মোবাইল হাতে নিয়ে আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকি। সারাক্ষণ আপনার চিন্তায় বিভোর রই। এসব কি অস্বাভাবিক আবেগ মাত্র! ভালোবাসা না?’
শতাব্দ চুপ। প্রিয় কেঁদে ফেলল এবার। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
‘ আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট। আমি আপনার মত অত পাথর হৃদয়ের মানুষ না। আমার অনুভূতি গুলো বড্ড বেকাবু। সারাক্ষণ শুধু আপনাকে খোঁজে। আপনার মত অত শক্তপোক্ত মনের আমি নই। আমি চেষ্টা করি পারিনা। পারছি না!’
আজ মনের জমানো সব অভিযোগ ঝেড়ে কেঁদে ফেলল প্রিয়। শতাব্দের এই এড়িয়ে চলা, নিতে পারছেনা সে। খালার শর্ত মানতেই কি এমন এড়িয়ে চলছে সে। কারণ যাইহোক না কেন! শতাব্দের এড়িয়ে চলা মানতে পারবেনা সে। একদম মানতে পারবেনা!
অনবরত কেঁদে যাচ্ছে প্রিয়। নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলল শতাব্দ। অস্থির হয়ে বলল,
‘ স্টপ ক্রায়িং প্রিয়!’
শুনল না প্রিয়। অনবরত কেঁদে যাচ্ছে সে। এগ্রেসিভ হয়ে উঠল শতাব্দ বলল,
‘ প্রিয়! আই স্যে স্টপ ক্রায়িং।…….. তুমি কান্না করা বন্ধ করবে? নাকি আমি এসে ঠোঁটে চুমু খেয়ে কান্না বন্ধ করবো?’
শতাব্দের এমন কথা নড়েচড়ে উঠল প্রিয়। থতমত খেয়ে। আচানক কান্না থামলো তার। স্তব্ধ বসে রইল। অশ্রুকণা এখনো চিকচিক করছে গালে। কোন সারাশব্দ না পেয়ে অপর পাশ থেকে শতাব্দ আবার বলল,
‘আমার অনুভূতি গুলো কতটা গাঢ় তুমি আন্দাজোও করতে পারবেনা প্রিয়। তোমার খালাকে কথা দিয়েছি। দূরে থেকে তোমার অনুভূতির পরিক্ষা নিবো। এটা আসলেই ভালোবাসা নাকি তোমার আবেগ! যদিও এতে কিছু আশে যায় না আমার। আবেগ হোক বা ভালোবাসা রাজি না থাকলে তুলে আনবো। দূরে থেকে মূলত নিজেকে কন্ট্রোলে আনতে চাইছি। তোমার কাছে গেলে বারবার কন্ট্রোলেস হয়ে যাই কিনা!
তবে হ্যাঁ, ওনেস্টলি আমি জানতে চাই কি চলছে তোমার মনে।
তখন কি জানো বলছিলে তুমি? রোজ আমার অপেক্ষা করো। তোমার আইডিয়া নেই আমার প্রেম কতটা ভ*য়ঙ্কর হতে পারে! তোমার এই ছোট বয়স তা সহ্য করতে পারবেনা প্রিয়।
ছটফটানি কি জিনিস বুঝো? জানো ক্ষণে ক্ষণে কতটা ছটফট করছি আমি। রোজ সকালে চোখ মেলে আমার তোমাকে চাই। বিকালে চায়ের কাপের সাথে তোমাকে চাই। গভীর রাতে আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন করে তোমাকে নিয়ে ঘুমাতে চাই। তোমার খোলা চুলে মুখ ডুবাতে চাই। এক কথায় আমার বউ চাই……
তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিলো প্রিয়। বুক ধুকপুক করছে এখনো। নিশ্বাসের প্রচন্ড উঠানামা। গাঁ শিরশির করছে এখনো। সাথে সাথে আবারো ফোন এলো। একটু সময় নিয়ে ফোন তুলল প্রিয়। কানে ধরতেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। অপর পাশ থেকে শতাব্দের গভীর নেশাতুর আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ ভদ্র প্রেমিক হতে চেষ্টা করছিলাম। দিলেনা তো! আমার অভদ্রতা ঠেলার জন্য তৈরি হও প্রিয়। আসছি। এক্ষুনি!’
ফোন কেটেছে শতাব্দ। কানে ফোন নিয়ে এখনো বসে আছে প্রিয়। শরীর তিরতির কাঁপছে এখনো। শতাব্দের নেশাতুর ভ*য়ঙ্কর আওয়াজটা কানে বাজছে এখনো।

সন্ধ্যার আজান পড়েছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। টিপটপ তৈরি হয়ে শতাব্দের অপেক্ষায় বসে আছে প্রিয়। ঘড়ি দেখছে বারবার। আচমকা খালা এসে বলল,
‘ ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নে প্রিয়। তোর বাবা আসছে নিতে।’
হতভম্ব প্রিয়। হকচকিয়ে বলল,
‘ বাবা আসছে মানে? আমার তো দুইদিন পরে যাওয়ার কথা ছিল।’
‘ পাশেই কোথায় জানো তোর বাবার দাওয়াত ছিল। তাই এখন ফোন করে বলল, এদিকে এসেছে যখন একেবারে সাথে করে নিয়ে যাবে তোকে।’
‘ কিন্তু খালা…’
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো খালা। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল,
‘ বাড়ি যাওয়ার জন্য আগে বায়না করতি রোজ। এখন বাড়ির কথা শুনলে এভাবে নাক ছিটকাস কেন?’
প্রিয় আমতা আমতা করে বলল,
‘ এখনো কিছু গোছানো হয়নি তাই…’
খালা থামিয়ে বলল,
‘ হাতেহাতে আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। তোর বাবা চলে আসবে এখনি।’
নেতিয়ে পড়ল প্রিয়। বুক ফেটে কান্না আসছে খুব। কতদিন পর আজ শতাব্দকে দেখবে বলে আশা নিয়ে ছিল। কিন্তু….

সারাক্ষণ খালা সাথে ছিল। শতাব্দকে জানানোর সুযোগ হয়নি প্রিয়’র। খানিক বাদেই বাবা চলে এলো। এটা ওটা বলে দেরি করছিল প্রিয়। অবশেষে বাবাকে ঘন্টা খানেক বসিয়ে রেখে মন মরা হয়ে বের হলো। বাড়ি যাওয়া নিয়ে চোখেমুখে কোন উৎসাহ নেই আজ। খালাকে বিদায় জানিয়ে বিষন্ন মন নিয়ে গাড়িতে চড়ল প্রিয়।
ইমান্দিপুর থেকে বেরিয়ে। গাড়ি হাইওয়ের রাস্তায় ইউটার্ন নেওয়ার সময় হ্ঠাৎ প্রিয়’র চোখ পড়লো পাশের গাড়িতে। শতাব্দ ইমান্দিপুরের দিক ইউটার্ন নিচ্ছে। হাস্যোজ্জ্বল হয়ে এলো প্রিয়’র চোখমুখ। আজ পুরো এক মাস পঁচিশ দিন পর শতাব্দকে দেখলো! গলা উঁচিয়ে একবার ডাকতে চাইল। পাশের সিটে বাবাকে দেখে দমে গেল। চোখ ভরে এলো জলে। ইমান্দিপুরে যেয়ে শতাব্দ নিশ্চয়ই প্রিয়’কে খুঁজবে। প্রিয়’য়কে না পেলে কি রেগে যাবে!

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here