বন্ধ দরজা পর্ব ১

বন্ধ দরজা
মিম

বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে শ্বশুড়বাড়ির সামনে থেকে সি.এন.জি. তে উঠছে সুহায়লা। সে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বাবার বাড়ি যাচ্ছেনা। চিরতরে স্বামীর সংসার ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। সি.এন.জি. তে সুহায়লার লাগেজগুলো তুলে দিচ্ছে এ বাড়ির বহু বছরের পুরোনো ড্রাইভার রফিক। রফিকের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এ বাড়ির কাজের মেয়ে নয়ন।নয়নের চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। রফিকের মনটাও অসম্ভব খারাপ। এ বাড়ির একমাত্র বউ চলে যাচ্ছে। বড় সাহেব বেঁচে থাকলে কখনোই এভাবে বাড়ির বউকে চলে যেতে দিতেন না। অনেক শখ করে বড় সাহেব তার একমাত্র ছেলে তানভীরের সাথে সুহায়লাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। দেড় বছর সংসারের পর আজ সুহায়লা চলে যাচ্ছে। এই সংসারটা বরাবরই সুহায়লার একার ছিলো । সেখানে তানভীরের কোনো পদচারনা ছিলো না। হাজার চেষ্টা করেও সংসারটাকে দুজনের করতে পারেনি সুহায়লা।
তার চোখে আজ কোনো পানি দেখা যাচ্ছেনা। খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। মানুষের স্বভাবটা বোধহয় এমনই। না পাওয়ার পরিমান জীবনে যখন তীব্রভাবে দেখা দেয় তখন হয়তোবা পরম মমতায় গড়া সংসার ত্যাগেও বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়না। কোনো পিছুটান , মায়াজাল তাকে ধরে রাখতে পারেনা। নয়নের কান্না দেখে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সুহায়লা। এভাবে কাঁদার কি আছে?
-” নয়ন আপা আপনি কি চুপ করবেন?”
-” কি করুম ভাবী? চোক্ষের পানি আইটকা রাখতে পারতাছি না। আপনে যাইতাছেনগা। আপনেরে ছাড়া পুরাডা বাড়ি খালি খালি লাগবো। ক্যামনে আপনেরে ছাড়া এই বাড়ি সামাল দিমু?”
-” আমি এসেছি মাত্র দেড় বছর হয়েছে এই বাড়িতে। এর আগে তো আপনি একাই পুরো বাড়িটা সামলে এসেছেন।এতদিন আমি ছিলাম এই সংসারে তাই নিজের মতো করে সব করেছি। আজ থেকে আমার সমস্ত দায়িত্ব শেষ। আর আপনার দায়িত্ব শুরু। আর আমিতো বলেছিই যখনি খারাপ লাগবে আমার বাবার বাসায় চলে আসবেন দেখা করতে। আর ফোন নম্বর তো আছেই।”
-” ভাইয়ের লগে একটাবার যদি একটু কথা কইতেন ভাবী?”
-” মামনি, নয়ন ঠিকই বলছে। তুমি ছোটবাবার সাথে একটাবার কথা বলে দেখো। ছেলেটা ঢাকা আসুক। ওর সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারে একবার কথা বলে দেখো। এমনও তো হতে পারে ও তোমাকে তালাক্ব দেয়ার ইচ্ছা নাও থাকতে পারে। একাই সিদ্ধান্ত নিও না মা। ঠান্ডামাথায়বিবেচনা করো।”
-” কাকা আপনি এসব বলছেন? আপনি কি দেখেননিএই দেড়টা বছরে তানভীর কত অপমান করেছে আমাকে? ও তো আমার বাপ মা তুলে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করেনি। ওর সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছি শুধুমাত্র ওর অতীতের কথা ভেবে। আর সম্ভব না কাকা। আমিও তো একটা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। শখ, আহ্লাদ, মান-অভিমান সমস্ত কিছুএতটাদিন ধরে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আর কত কাকা?”
– মামনি গত দুমাসে যা হয়েছে এরপর তো ছোটবাবা বদলেও যেতে পারে। তুমি ওর মাঝে কি কোনো পরিবর্তনই দেখতে পাওনা?”
-” হুম হতে পারে সে বদলেছে। আবার নাও বদলাতে পারে। মূল কথা হচ্ছে এখন ওর পরিবর্তন আসুক আর না আসুক এতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমার যা সিদ্ধান্ত নেয়ার আমি নিয়েছি। বহু ভেবে চিন্তে যথেষ্ট সময় নিয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। বহু চেষ্টা করেছি ওর সংসার করার। কেউ আমাকে আঙুল তুলে এ কথা বলতে পারবেনা যে সুহায়লা তুমি তোমার সংসার টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করোনি।”
-” ভাবী, ভাই ফিরা আইসা যদি আপনের কথা জিগায় তাইলে কি কমু?”
-” কি বলবেন আবার?? বলবেন যে আমি চলে গেছি আর ফিরবো না। আমার ভাইয়ের বিয়ে দেড়মাস পর। বিয়েটা শেষ হলেই আমি নিজ খরচে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। ওকে একটা পাই পয়সাওঢালতে হবে না। এমনকি আমি ওর কাছে কোনো টাকাও দাবী করবো না।আর আপনাকে যে চিঠিটা দিয়েছি সেটা সযত্নে রেখে দিবেন। তানভীর আসলে তার হাতে চিঠিটা তুলে দিবেন।”
-‘ যদি জিগায় আপনেরে যাইতে দিছি কেন?”
-” ও কখনোই আপনাকে একথা জিজ্ঞেস করবেনা।”
-” তবুও মামনি একটাবার…..”
-” কাকা প্লিজ আর কোনো কথা বাড়াবেন না। আসি, দোয়া করবেন আমার জন্য। মামা, সি.এন.জি. চালু করেন।”
সুহায়লা চলে যাচ্ছে। ছোট বোন আর মা ছাড়া আর কেউ জানে না যে তানভীরেরসংসার ছেড়ে সে চলে আছে বাপের বাড়ি। বড় ভাই সাদমানের বিয়ে দেড়মাস পর। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাদমানের এতদিনের ভালোবাসা পরিনাম পেতে যাচ্ছে। এইমূহূর্তে যদি সাদমানের হবু শ্বশুড়বাড়ির লোকজন জানতে পারে যে সাদমানের বোন স্বামীকে তালাক্ব দিয়ে বাবার ঘরে ফিরেছে তাহলে নিশ্চয়ই তারা ব্যাপারটা সুন্দরভাবে দেখবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা বাবা অথবা সাদমান কারো কানে যদি একথা পৌঁছায় যে সুহায়লা তানভীরকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে তাহলে কোনোভাবেই বিয়েটা এখন তারা হতে দিবে না। সাদমান বোন পাগল মানুষ। বোনের এমন খারাপ সময়ে সে নিজের ঘর সংসার পেতে বসবে এমন ভাই সাদমান না। তাছাড়া তানভীরের সাথে মনোমালিন্যের কথাগুলো সাদমান আর বাবা কেউই জানেনা। এসব তাদের জানানো হলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে সে খবর সুহায়লার জানা নেই।তাই মা বোনেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত তারা এ ব্যাপারগুলো বাবা ভাইয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে। সময়মতো তাদের সমস্তকিছু তারা বুঝিয়ে বলবে। ফোনটা বের করে শেষবারের মতো তানভীরের ছবিটা দেখে নিলো সুহায়লা। বিয়ের পরপর ঘুমন্ত অবস্থায় তানভীরের ছবিটা তুলেছিলো সে। এমন ছবি আরো কয়েকটা আছে সুহায়লার কাছে।সবকয়টাই লুকিয়ে তোলা। ছবিগুলো এক এক করে ডিলিট করে দিচ্ছে সে। যার সাথে সম্পর্কই থাকবে না তার স্মৃতি ধরে রেখে কোনো লাভ নেই।
তানভীরের বাসার ল্যান্ডফোন বাজছে সেই কখন থেকে। নয়নের মন ভীষন রকমের খারাপ। সে ঘরের ফার্নিচার মুছছে আনমনে। মাথায় শুধু সুহায়লার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘুরঘুর করছে। ফোনের শব্দেও তার ঘোর কাটলোনা। শেষমেষ তার মেয়ে নিতুর ধাক্কায় ঘোর কাটলো ।
-” ঐ মা, শুনতাছোনা ফোন বাজতাছে। ধরো না কেন?”
-” ওহ্ দাঁড়া দেখতাছি”
রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে তানভীরের আওয়াজ ভেসে আসলো এপাশে।
-” এতক্ষন লাগে ফোন রিসিভ করতে? ঘরের সবাই কি হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে নাকি?”
-” ভাই খেয়াল করিনাই।”
-” সুহায়লা কোথায়? ওকে ডেকে আনো?”
-” ভাবী তো গেছে গিয়া।”
-” কোথায় গিয়েছে?”
-” বাপের বাড়ি।”
-“, ওহ্ আমি ফোন করেছিলাম ওকে বলার জন্য ঠিকভাবে চিটাগাং এসে পৌঁছেছি। ও তো চলে গেলো। এখন কিভাবে জানাবো? আচ্ছা সুহায়লার ফোন নম্বরটা কি তুমি জানো?”
-” হায় আল্লাহ! কি কন ভাইজান? ভাবীর লগে আপনের বিয়া হইছে দেড় বছর অথচআপনে উনার ফোন নাম্বার জানেন না?”
নয়নের কথায় খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলো তানভীর। ঠিকই তো! নিজের বউয়ের ফোন নম্বরটাই নাকি তার জানা নেই। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে তানভীর বললো,
-” আচ্ছা থাক লাগবে না। কতক্ষন পর সুহায়লা নিজেই ফোন করবে আমার খবর নিতে।”
বলেই ফোনটা কেটে দিলো তানভীর। তানভীরের ভেতরে কেমন যেনো খচখচ করছে। সুহায়লা তো কখনো তার কাছে না বলে বাবার বাড়ি যায়না। আজ ভোরে তানভীর বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময়ও তো ওকেকিছু বললো না এ ব্যাপারে। হতে পারে কোনো জরুরি কাজ আছে।তাই এমন হুট করে চলে গেছে। কাজ সেরেই বোধহয় চলে আসবে।
ওদের দুজনের গল্পটা শুরু হয়েছিলো আজ থেকে এক বছর আটমাস আগে। সুহায়লার বড় ফুপার বন্ধুর ছেলে তানভীর। ফুপাতো ভাইয়ের বিয়েতে বেশ হৈ হুল্লোর করে বেড়াচ্ছে সুহায়লা আর তার ছোট বোন সাবা। ওরা তিন ভাই বোনই একদেখাতেই যেকারো নজরে পড়ে যাওয়ার মতো সুন্দর। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না। দুবোন বিভিন্ন পোজ দিয়ে সেলফি তুলছে। তানভীরের বাবা ফরহাদ সাহেব বসে বসে দুবোনকে দেখছেন। দুটো মেয়েই দেখতে একদম ফুটফুটে পরীর মতো। ছেলের জন্য এমন পাত্রীই খুঁজছেন তিনি। কিন্তু উনার নজরটা সুহায়লার দিকেই বেশি আটকাচ্ছে। সাবা অনেকক্ষন যাবৎ লক্ষ্য করছে একজন বয়স্ক লোক তাদের দুবোনকে দেখছে। সে এতক্ষনকিছুই বলেনি। সেলফি তোলার একপর্যায়ে সাবা দেখলো লোকটাও তাদের ফোনের স্ক্রিনেই তাকিয়ে আছে। সাথে সাথে ঘাড়টা ঘুরিয়ে লোকটাকে বলে উঠলো,
-” আংকেল আপনি কি আমাদের সাথে সেলফি তুলতে চাচ্ছেন?”
সাবার এমন প্রশ্ন সুহায়লা এবং ফরহাদ সাহেবদুজনই হতভম্বহয়ে গেলো। সুহায়লা সাবার পিঠে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
-” এগুলো কোন কথা? মুরুব্বিদের সাথে এভাবেকেউ কথা বলে?”
-” ও মা! আমি কি উনাকে খারাপ কিছু বলেছি নাকি? উনাকে সেই কখন থেকে দেখছি আমাদের সেলফি তোলা দেখছেন। উনার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম উনার সাথে কেউ নেই। ভাবলাম উনার সাথে ছবি তোলার কেউ নেই। তাই আমি অফার করলাম আমাদের সাথে ছবি তুলবে কিনা? আংকেল আপনিই বলেন তো আমি কি আপনাকে খারাপ কিছু বলেছি?”
-” না মামনি। তুমি একদমই কোনো খারাপ কথা বলোনি।”
-” দেখেছিস সুহা, আংকেল কিছু মনে করেনি। তুই অহেতুক আমাকে পাবলিক প্লেসে বকাঝকা করিস।”
-” আংকেল আমার বোনটা এমনি। হুটহাট অদ্ভুদ কথাবার্তা বলে ফেলে। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
-” না আমি কিছু মনে করিনি। মামনি তুমি একটু আমার সাথে বসো। তোমার সাথে কথা বলি।”
সুহায়লা ফরহাদ সাহেবের পাশের চেয়ারে বসলো।সাবাও দৌড়ে গিয়ে ফরহাদ সাহেবের অন্য পাশে বসলো।
– তোমাদের নাম কি?”
-” আমি সুহায়লা আর ও সাবা।”
-” যার বিয়ে হচ্ছে সে তোমাদের কি হয়?”
-” আমার ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে।”
-” তোমরা সাজ্জাদের মেয়ে?”
-” জ্বি। আপনি আব্বাকে চিনেন?”
-” চিনবো না আবার। তোমার ফুপার ছোটবেলার বন্ধু আমি। তোমার বাবাকে ভালো করেই চিনি। তবে অবশ্য প্রায় বিশ বাইশ বছর ধরে তোমার বাবার সাথে দেখাহয়না। এখন সামনে এসে দাঁড়ালে আমি ওকে চিনবো কি না সন্দেহ আছে।”
-” চলুন তাহলে আব্বার সাথে আপনার দেখা করিয়ে দেই।”
-” হুম দেখা তো ওর সাথে করতেই হবে।
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here