বন্ধ দরজা পর্ব ৩০

বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩০
লেখা-মিম
দুপুরে খেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সুহায়লা। গতকাল সন্ধ্যায় তানভীর ওকে বাবার বাড়ি দিয়ে গেছে। রাতে ডিনার সেড়েই চলে গেছে সে। এ বাসার লোকজন থাকতে বলেছিলো ওকে। কিন্তু ও থাকেনি। চলে গেছে। গতকাল সারাদিনে তানভীর তেমন একটা কথা বলেনি ওর সাথে। বেশ এড়িয়ে গেছে সুহায়লাকে। গতকাল এখান থেকে চলে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করেনি তানভীর। ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে সুহায়লাকে। তানভীরের মতিগতি সত্যিই ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। পরশুদিন পর্যন্তও তো তোমাকে ছাড়া থাকা ইমপসিবল বলে বলে মাথা খেয়ে ফেলছিলো। আর এখন? হায়রে ভালোবাসা! এখন আছে তখন নেই। নিজের মনেই হাসলো সুহায়লা। সে শুয়ে শুয়ে সমীকরন মিলাচ্ছে। এতদিন সে যা করেছে এটা কি তানভীরের ভালোবাসা নাকি শুধুমাত্র অভ্যাস? বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে আর হিসেব মেলাচ্ছে। অবশেষে সমীকরন মিলে গেলো সুহায়লার। সে তানভীরের অভ্যাস। ভালোবাসা না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আসরের আযান দিয়েছে কিছুক্ষন হলো। আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বালিশের নিচে থাকা হেডফোন আর মোবাইল টা হাতে নিয়ে ছাদের জন্য বের হয়ে গেলো সুহায়লা। ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারি করচছে আর গান শুনছে সে। বিরহের গান। বিকেলের হালকা আলো পুরো ছাদের ফ্লোর জুড়ে বিছিয়ে আছে। হালকা ঠান্ডা পড়েছে ইদানিং। নভেম্বরের শুরুর দিকে এসময়টাতে একটু একটু ঠান্ডা লাগে। ছাদে থাকা সন্ধ্যামালতিগুলো একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। হাঁটাহাঁটির এক পর্যায়ে ছাদের রেলিং এর উপর বাহিরের দিকে পা ঝুলিয়ে বসলো সুহায়লা। ফোনটা বেজে উঠলো তার। স্ক্রিনে তানভীরের নামটা ভেসে উঠেছে। বুকের ভিতর মোচড় কেটে উঠলো ওর। অদ্ভুদ আনন্দহচ্ছে। কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দ। এইফোনটার অপেক্ষায় ছিলো সে। কেনো ছিলো সেটা তার নিজেরও জানা নেই। তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করলো ও।
-” হ্যালো….”
-” ঠ্যাং বাহিরে ঝুলিয়ে রেখেছো কেনো? দোতলা থেকে নিচে পড়ার শখ জেগেছে?”
-“” তুমি জানো কিভাবে?”
-” আমি কতকিছুই জানি। পা রেলিংয়ের এপাশে এনে বসো।”
সুহায়লা বাসার রেলিং থেকে নেমে নিচে তাকিয়ে দেখছে তানভীর নিচ থেকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে কিনা।
-” আমি তোমার বাসার নিচে না। ওখানে খুঁজে লাভ নেই।”
-” তাহলে কোথায় তুমি?”
-” এতকিছু জেনে কি করবে? আছি তোমার আশেপাশেই।”
-” কোথায় আছো সেটা তো বলো?”
-” বললাম তো আশপাশেই আছি। বাই দ্যা ওয়ে…… তুমি আমার ফোনের জন্য ওয়েট করছিলে? তাই না?”
-” নাহ্। আমি কারো ফোনের ওয়েট করি না।”
-” মিথ্যুক! আমি দেখেছি তো তুমি এতক্ষন কেমন মরা চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে আর আমি ফোনটা দেয়ার পরপরই তোমার চেহারার নকশা কেমন বদলে গেছে।”
-” তুমি অহেতুক সাসপেন্স কেনো বাড়াচ্ছো তানভীর? বলো না তুমি কোথায়?”
-” কেনো? আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?”
-” ধুর ছাই….”
ফোনটা কেটে দিলো সুহায়লা। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। নাহ্, কোথ্থাও তানভীর নেই। তাহলে সুহায়লাকে দেখছে কেমন করে? চিন্তায় ভাটা পড়লো মুখে সূর্যের আলো এসে পড়াতে। আলোটা সেচ্ছ্বায় পড়েনি। কেউ একজন আয়নায় আলোর প্রতিবিম্ব সুহায়লার চোখে মুখে ছড়াচ্ছে। কাজটা সামনের বিল্ডিং এর ছাঁদে্ দাঁড়িয়ে কেউ করছে। আলোর জন্য ঠিকমতো চোখ মেলে দেখতে পারছে না সুহায়লা। আয়নাটা অবশেষে সরলো। চোখ মেলে তাকিয়ে যা দেখলো এতে চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। বাসার সামনের গলিটার উল্টা দিকের বাসাটার ছাদে তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশ থেকে তানভীর ইশারা দিচ্ছে ফোনটা রিসিভ করার জন্য। ফোনটা রিসিভ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তানভীরকে দেখছে সুহায়লা। যা কিছু হচ্ছে সবই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
-” এভাবে কি দেখছেন ম্যাম?”
-” তুমি সিরাজ আংকেলের বাসায় ঢুকলে কেমন করে। এটা তো উনি গত দু মাস ধরে সেল দিতে চাচ্ছেন। বাসা তো পুরাটা তালা মারা ছিলো। চাবি পেলে কোথায়?”
-” তালা ভেঙে ঢুকেছি।
-” কিহ্?”
-” বাসাটা সিরাজ সাহেবের ছিলো। এখন আর নেই। ওটা কিনে নিয়েছি। এটা এখন তানভীরের বাড়ি।”
-” মজা করছো কেনো তানভীর?”
-” আই এ্যাম নট জোকিং।”
-” তোমার ঢাকায় দুটো বাড়ি থাকতে আবার কেনো বাড়ি কিনেছো?”
-” ভদ্রলোক বেশ বিপদে আটকে ছিলো। গতকাল সকালে এক দালালের মাধ্যমে খবর এলো বাড়িটা উনি সেল করবেন। আমি কিনবো কিনা? শুরুতে রাজি হইনি। পরে ভদ্রলোকের সাথে অনেকটা জোর করেই ঐ দালাল আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিলো। উনার টাকার খুবপ্রয়োজন ছিলো। তারপর আবার দেখলাম বাড়িটা তোমাদের পাশেই। ভাবলাম তোমার সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে প্রেম করা যাবে। ঐ যে ১৮-১৯ বছরের পিচ্চিগুলা ছাদে দাঁড়িয়ে প্রেম করে না? ঐরকম আমিও করবো। তুমি ছাদে আসবে কাপড় নিতে আমি তোমাকে দেখবো। ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারি করবে। তোমার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও আমার ছাদে হাঁটবো। পুরো বিকেল জুড়ে কথাহবে। কখনো ফোনে, কখনো বা ইশারায়। হুট করে কেনো যেনো এই বুড়ো বয়সে প্রেম করার নেশা জেগেছে। তাই বাড়িটা কিনে ফেললাম জমিয়ে প্রেম করবো বলে। ভালো করেছি না বলো?”
সুহায়লা হাসছে। তৃপ্তির হাসি ওর ঠোঁটে ফুটে উঠেছে। নিজের অজান্তেই হাসছে সে। এক নজরে তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
– ” আমার বাড়ি কেনার টাকা উসুল হয়ে গেছে। এই হাসিটা দেখার জন্য কি পরিমান ছটফট এই আমি কি করেছি তা তুমি জানো না সুহায়লা।”
-” তুমি কি সেই তানভীর যাকে আমি বিয়ে করেছিলাম?”
-” নাহ্। সেই তানভীর না। আমি তোমার তানভীর।”
সুহায়লার নিজেরকান বা চোখ কোনোটাকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। পিছন থেকে সাবা আলতো করে পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-” কি রে সুহা? দুলাভাই ঐ বাড়ির ছাদে কি করে ?”
-” তুইও কি তানভীরকে দেখতে পাচ্ছিস?”
-” হ্যাঁ পাচ্ছি তো।”
-” তারমানে ও সত্যিই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।”
সাবা ঘটনার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। ক্লিয়ারলি ব্যাপারটা বুঝার জন্য সুহায়লার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিজের কানে লাগালো সাবা।
-” দুলাভাই, আপনি ওখানে কি করেন?
-” প্রেম করি তোমার বোনের সাথে।”
-” তো বাসায় এসে করেন। অন্য মানুষের ছাদে কেনো?”
-” এটা আমার ছাদ।”
-” মানে? বুঝলাম না।”
-” মানে পরে বুঝো। এখন এখান থেকে যাও। ফোনটা তোমার বোনকে দাও। তোমার সাথে পরে কথা হবে। আর হ্যা এখানে দাড়িয়ে আমাদের কথা গিলে খাওয়ার চেষ্টা একদম করবে না। সোজা নিচে চলে যাও।”
তানভীরের মেজাজ সম্পর্কে ধারনা আছে সাবার। তাই ফোনটা ুহায়লাকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
-” তুমি এই পুরান বাড়িতে থাকবে?””
-” হুম থাকবো। বাড়িটা তো বেশ সুন্দর। আমার পছন্দ হয়েছে।”
-” তোমার ঐ বাসার মতো ফ্যাসিলিটিস এখানে নেই।”
-” সেটা ব্যাপার নাহ। এডযাস্ট করে নিবো।”
-” এখানে কতদিন থাকবে?”
-” যতদিন না তুমি আমার ঘরে ফিরে যাচ্ছো।”
-” ঐ বাসায় তাহলে কে থাকবে?”
-” নয়ন তো আছেই।”
-” তোমার এই বাসার কাজ কে করে দিবে?”
-” লোক রেখেছি। কাল সকাল থেকে কাজ করবে। আর আজ সব ফার্নিচার কিনে এনে ঘর সাজালাম। তুমি তো রান্না করে পাঠাবেই। মাঝে মাঝে কাপড় পাঠাবো। ধুয়ে দিও।”
-” কাপড় ধোয়ার লোক রাখোনি?”
-” রেখেছি। তবু তুমি ধুয়ে দিও। তোমার হাতের স্পর্শ লেগে থাকবে কাপড়ে।”
-” এসব পাগলামি করে লাভ কি বলো তো?”
-” ভালোবাসায় কি লাভ লোকসানের হিসেব চলে বলো? আর পাগলামি তো সবে শুরু। সামনে আরো ওয়েট করছে তোমার জন্য। তোমার কি ধারনা পাগলের মতো শুধু তুমিই ভালোবাসতে জানো? আমি জানি না? আমিও জানি। কিন্তু প্রকাশটা ঠিকভাবে করতে পারি না। তবে এবার পুরোপুরি চেষ্টা করবো নিজেকে মেলে ধরার। প্লিজ সুহা, এটাই শেষবার। আর কখনো কোনো সুযোগ চাইবো না। নিজেকে আর গুটিয়ে রেখো না প্লিজ। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসো।সুন্দর কিছু মূহূর্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে একটা সুযোগ দাও তোমার অভিমানের পাহাড় ভাঙার। এরপর যদি তোমার মনে হয় আমি তোমার ক্ষমার অযোগ্য তাহলে ক্ষমা দিও না। আমি নিজে থেকেই সরে দাঁড়াবো। তুমি যাস্ট বন্ধুর মতো করে আমার সাথে মিশো। আর কিচ্ছু চাই না আমি। প্লিজ সুহা রাজি হয়ে যাও।”
বুকের ভেতর বড্ড বেশিই ধুক পাকুর চলছে সুহায়লার। কিন্তু সেটা অন্তরালে রেখে দিয়েছে সে। তানভীরের এই কান্ডে যে কেউ ভাববে সে অসম্ভব ভালোবাসে সুহায়লাকে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে সে। আগে তাকে নিশ্চিত হতে হবে এটা কি তার ভালোবাসা নাকি অভ্যাস? এরপরই সে তার আবেগগুলো তানভীরের সামনে মেলে ধরবে। আবেগ মেলে ধরবে কি ধরবে না সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু এখন যে ও সুহায়লার উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। তাকে কি উত্তর দিবে?
-” সুহায়লা এ্যানসার মি।”
-” চেষ্টা করবো বন্ধুর মতো মিশার। তবে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কতটুকু পেরে উঠতে পারবো তা জানি না।”
-” থ্যাংকস এ লট। তুমি চেষ্টা করবে এটাই অনেক। বেশি না সুহা। তোমার একটু সাপোর্টই আমার জন্য যথেষ্ট।”
সুহায়লা বলে তো দিয়েছে ঠিকই চেষ্টা করবে। কাছাকাছি যাওয়ার পর কি আদৌ চেষ্টা করার ইচ্ছাটা থাকবে নাকি গায়েব হয়ে যাবে? কথাটা বেশ ভাবাচ্ছে ওকে।
(চলবে)

.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here