#বর্ষণের সেই রাতে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব: ৩২
.
অনিমা শাওয়ার নিয়ে একটা নীল ফুল হাতা গেঞ্জি আর কালো টাউজার পরে চুপচাপ খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। এই টাউজার আর গেঞ্জিটা খাটের কোণায় প্যাকেটে পেয়েছে ওহ। তবে ওর মন খুব অস্হির আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আদ্রিয়ান ফিরে আসবে এই অস্হিরতা মোটেও কমবে না। এই ছেলেটা কী বোঝেনা যে ওর টেনশন হয়। আর রুমটাও লক করে দিয়ে গেছে, ব্যালকনির দরজাটাও লক করা। ভাগ্যিস ওয়াসরুমের দরজাটা লক করেনি। এসব ভাবতে ভাবতে রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেলো অনিমা। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান এসছে। অনিমা মুখ ঘুরিয়ে হাত ভাজ করে বসে রইলো। সেটা দেখে আদ্রিয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর অনিমার কাছে গিয়ে বসলো, অনিমা একবার আড়চোখে তাকিয়ে আবারো মুখ ফিরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান হেসে অনিমাকে একহাতে জরিয়ে ধরে বলল,
— ” রেগে আছো আমার ওপর?”
অনিমা অন্যদিকে মুখ করেই বসে আছে। আদ্রিয়ান চারপাশে তাকিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা রুমটা কেমন হয়েছে বলোতো? আমি তো ঠিক করেই নিয়েছি বিয়ের পর আমরা এখানেই থাকবো।”
অনিমা অবাক আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” বিয়ে? কীসের বিয়ে? কার বিয়ে? ”
আদ্রিয়ান অনিমার গাল টেনে দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ বিয়ে, আমাদের বিয়ে, মানে তোমার আর আমার বিয়ে।”
অনিমা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার হাত ভাজ করে বলল,
— ” বয়েই গেছে আপনাকে বিয়ে করতে আমার।”
আদ্রিয়ান খাটে হেলান দিয়ে বসে বলল,
— ” যাই বলোনা কেনো বিয়েতো তুমি আমাকেই করছো।”
অনিমা ভ্রু কুচকে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান হেসে উঠে ওয়াসরুমে চলে যেতে নিলেই অনিমা বলল,
— ” শুনুন?”
আদ্রিয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো অনিমার দিকে। অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলল,
— ” আপনার ওপর কী কোনো অ্যাটাক হয়েছিলো? মানে..”
আদ্রিয়ান এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
— ” কেনো কারো অ্যাটাক করার কথা ছিলো?”
অনিমা কিছু না বলে চুপ করে আছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে ওয়াসরুমে চলে গেলো। অনিমা একটু অবাক হলো। অনিমার কোনো কথা বা রিঅ্যাকশনেই আদ্রিয়ান পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনা, এরকম মনে হয় যেনো ও সবই জানে। কিন্তু রিক এখনো আদ্রিয়ানের কোনো ক্ষতি কেনো করলোনা? ও কী অনিমাকে খুজে পাওয়ার অপেক্ষায় করছে? ওকে খুজে পেয়ে গেলেই কী আদ্রিয়ানের ক্ষতি করে দেবে? এসব চিন্তা করেই অস্হির হয়ে উঠছে ও।
রাতে খাওয়াদাওয়া করে সবে বসেছে অনিমা এর মধ্যেই আদ্রিয়ান এসে আবার ওর হাত পা বেঁধে দিতে শুরু করলো। অনিমা অবাক হয়ে বলল,
— ” আরে কী করছেন?”
আদ্রিয়ান হাত পা বাধতে বাঁধতে বাঁধতে বলল,
— ” তোমাকে কোনো বিশ্বাস নেই। এটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। তাই তোমার ঐ চাদর পেচানো টেকনকটা খুব কাজে লাগবে। সো আই কান্ট টেক এনি রিস্ক।”
অনিমা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,
— ” তাই বলে এভাবে বেঁধে রাখবেন আমাকে?”
আদ্রিয়ান বাধা কম্প্লিট করে অনিমার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,
— ” আ’ম সরি সোনা। বাট তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত পালানোর ভুত মাথা থেকে না নামাচ্ছো ততোক্ষণ আমাকে এটা করতেই হবে।”
বলেই অনিমাকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— ” ব্রেনে এতো চাপ দিয়ো না। চিল এন্ড টেইক ইউর টাইম।”
এটুকু বলে আদ্রিয়ান সোফায় শুতে চলে গেলো। অনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এই বাড়িতে আর কোনো বেডরুম নেই?”
আদ্রিয়ান সোজা হয়ে শুয়ে ছিলো, অনিমার প্রশ্ন শুনে ওর দিকে ঘুরে শুয়ে বলল,
— ” কটা লাগবে তোমার?”
অনিমা একটু ইতোস্তত করে বলল,
— ” তাহলেতো আমাকে অন্য কোনো রুমেও রাখতে পারেন। আপনার এভাবে সোফায় শুতে কষ্ট হয়না? ”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,
— ” হয় একটু কিন্তু তোমাকে কাছে থাকতে তার চেয়েও বেশি ভালোলাগে।”
বলেই আদ্রিয়ান ওর সেই হাসি দিলো। অনিমা সাথেসাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঐ হাসির দিকে তাকিয়ে থাকার শক্তি নেই ওর মধ্যে। এই হাসি একটু বেশিই ভয়ংকর। এই হাসির দিকে তাকালেই ওর শ্বাস আটকে আসে, হৃদপিন্ড বিট করতে করতে বেড়িয়ে আসতে চায়। অনিমাকে এভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে আদ্রিয়ানও মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
_____________________
খাটে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে আদ্রিয়ানের সব বায়োগ্রাফি, উইকপিডিয়া সার্চ করছে রিক। কিন্ত তেমন কিছুই পাচ্ছেনা যেটা দিয়ে ও আদ্রিয়ানের ব্যাপারে বিশেষ কোনো তথ্য পায়। এইখানের ইনফরমেশন অনুযায়ী আদ্রিয়ানের দুটো এপার্টমেন্ট আর একটা বাংলো আছে। কিন্তু ও ওসব জায়গায় খোজ চালিয়ে নিয়েছে কিন্তু আদ্রিয়ান ওকে রাখেনি ওখানে। তারমানে অন্যকোথাও রেখেছে। একটা রকস্টার? তার এতো ক্ষমতা যে একটা জলজ্যান্ত মেয়েকে এভাবে আড়াল করে রাখতে পারে। রিক এসব চিন্তা করতে করতেই কবির শেখ রিকের সামনে এসে বসে বলল,
— ” কী এতো ভাবছো বাবাই?”
রিক কপালে হাত রেখে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” কোথায় এমন রেখেছে বলোতো? এমন কোন জায়গা হতে পারে?”
কবির শেইখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বললেন,
— ” কথা বলোনি আদ্রিয়ান এর সাথে?”
রিক সোজা হয়ে বসে গলা শক্ত করে বলল,
— ” বলেছিলাম। এটিটিউট দেখালো আমাকে, ইচ্ছে করছিলো ওখানেই শুট করে দেই কিন্তু যতক্ষণ অনিকে না পাওয়া যাচ্ছে ততোক্ষণ ওকে মারতে পারবোনা আমি।”
কবির শেখ কপাল ভাজ করে আবার কিছু ভাবতে শুরু করলেন। এরমধ্যেই রিক বলল,
— ” তবে একটা প্লাস পয়েন্ট আছে মামা।”
কবির শেখ কৌতুহলি হয়ে বললেন,
— ” সেটা কী?”
রিক বাঁকা হেসে বলল,
— ” এটিটিউট থাকলেও, গান বন্দুক এসবে অভ্যস্ত নয় ও।”
কবির শেখ হেসে দিয়ে বলল,
— ” তাহলে তো ভালোই, একটা কাজ করতে পারো?”
রিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কবির শেখ এর দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” কী কাজ?”
কবির শেখ শয়তানী হেসে বললেন,
— ” ওকে তোমার লোক দিয়ে তুলে এনে ভয় দেখিয়ে কথা বেড় করতে পারো।”
রিক কিছু না বলে চুপ করে ভাবতে লাগলো। এটা করাই যায়। যেভাবে তখন বন্দুক দেখে পিছিয়ে গেলো তাতে কাজ হলেও হতে পারে।
____________________
আদ্রিয়ান একজন মিউসিক ডিরেক্টরের সাথে মিটিং সেরে একটা চেয়ারে বসে রেস্ট করছে, এরমধ্যেই ওর ফোনে ভিডিও কল এলো যাতে অরু আর তীব্র কানেক্টেড আছে। আদ্রিয়ান কলটা রিসিভ করার পরেই স্ক্রিণে তীব্র আর অরুমিতার মুখ ভেসে উঠল। অরুমিতা চিন্তিত গলায় বলল,
— ” ভাইয়া অনি কোথায়? কেমন আছে ও?”
আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেলে বলল,
— ” কোথায় আছে বলতে পারব না কারণ তোমাদের ফোন ট্রাক করা হচ্ছে।”
অরুমিতা আর তীব্র পাল্টা কোনো প্রশ্ন করলোনা কারণ ওরা বেশ ভালো করে বুঝতে পারলো যে কে ফোন ট্রাক করছে আর কেনো? তাই দুজনেই মাথা নাড়লো। তীব্র নিচু গলায় বলল,
— ” এমনিতে ভালো আছেতো ও?”
আদ্রিয়ান মুচকি হাসলো তারপর বলল,
— ” চিন্তা করোনা আমি থাকতে ও কোনোদিন খারাপ থাকবে না। কিন্তু হাত পা বেধে রেখে এসছি কারণ ছাড়া রাখলেই পালাতে চাইছে।”
অরুমিতা বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” এমন কেনো করছে ও? ওর সমস্যা কোথায়? ”
আদ্রিয়ান ওদের দিকে দেখে বলল,
— ” কিন্তু আমি জানি।”
তীব্র আর অরুমিতা দুজনেই অবাক হয়ে একসাথে বলল,
— ” কেনো?”
আদ্রিয়ান একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” বলবো পরে। আর টেনশন করোনা সি ইজ অলরাইট, আপাদত রাখছি হ্যাঁ?”
ওরা দুজনেই মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান কলটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও এখন অন্যকিছু ভাবছে। নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টায় আছে ও। ও জানে এরপর ও যেটা করবে সেটা ওর জন্যে সহজ হবেনা কিন্তু ওকে করতেই হবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই ওর ফোন বেজে উঠল, আর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই ওর ঠোঁটে বাকা হাসি ফুটে উঠল। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপর পাশ থেকে বলে উঠল,
— ” মিস্টার জুহায়ের খুব বড় ভুল করছো তুমি, আমার জিনিসে কেউ হাত দিলে আমি তাকে ছেড়ে দেই না। ”
আদ্রিয়ান একটু শক্ত গলায় বলল,
— ” মিস্টার রিক চৌধুরী। ফাস্ট অফ অল ও কোনো জিনিস নয়। আর সেকেন্ড অফ অল ও কার সেটা ডিসাইড করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ওর অন্য কারো সেই অধিকার নেই।”
রিক রাগী কন্ঠে বলল,
— ” তো তুমি বলবেনা যে ও কোথায়?”
আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,
— ” আপনি এতো ডুল হেডেট নাকি? আমি তো বলেই দিয়েছি ও আমার কাছেই আছে।”
রিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ” আমি জায়গাটা জানতে চেয়েছি।”
আদ্রিয়ান এবারেও মুচকি হেসে বলল,
— ” আদ্রিয়ানের বাড়ি।”
রিকের রাগ এবার সাত আসমানে উঠে গেলো, ও রাগে গজগজ করে বলল,
— ” আদ্রিয়ান তুমি কিন্তু আমার ট্রাক রেকর্ড জানো না। আমি কিন্তু গান নিয়ে খেলতে খুব ভালোবাসি।”
আদ্রিয়ান এবার সিরিয়াস মুখ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে এরপর ঠান্ডা গলায় বলল,
— ” আমার ট্রাক রেকর্ড ও আপনি জানেন না। আমি গান খেলতে আর খেলাতে দুটোই খুব ভালোবাসি।”
রিক ভ্রু কুচকে বলল,
— ” মানে?”
আদ্রিয়ান সাথেসাথেই হেসে দিয়ে বলল,
— ” আরে গানের কথা বলছি। সিঙ্গিং ইউ নো। রকস্টার তো..।”
রিক এবার রেগে সামনের টি-টেবিলে লাথি মেরে বলল।”
— ” আদ্রিয়ান?”
আদ্রিয়ান ঠোঁট চেপে একটু হাসলো। তারপর গলা ঝেড়ে বলল,
— ” রিক চৌধুরীকে একটা মেয়েকে খুজে পেতে আমার কাছে এতো আকুতি মিনতি করতে হচ্ছে? আমার বাড়িগুলো চেক করলেন, লোক দিয়ে ফলো করালেন, ফোন ট্রাক করলেন তবুও রেজাল্ট ইজ জিরো? সো স্যাড এন্ড সেইমফুল। ”
রিক চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে রাগ কন্ট্রোলের চেষ্টা করলো। আদ্রিয়ান আবার বলল,
— ” আপনাকে একটা ফ্রি এডভাইস দেই। আমাকে ফোন করে এসব ফালতু প্রশ্ন না করে তার চেয়ে বরং খোজায় কনসেনট্রেট করুন, পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। বাই।”
এটুকু বলে রিকের উত্তরের আশা না করেই ফোন কেটে দিলো আদ্রিয়ান। আর তারপর নিজের মনেই হেসে বেড়িয়ে গেলো। ওখান থেকে নিজের একটা ফ্লাটে গিয়ে নিজের ফোনের সিম চেঞ্জ করলো, যেটা সম্পর্কে কয়েকজন ছাড়া তেমন কেউ জানেনা। এরপর ওখান থেকে বেড়িয়ে গাড়ি টা এমনভাবে ড্রাইভ করলো যাতে কেউ ওকে ফলো করলেও ওকে হারিয়ে ফেলবে। বাড়িতে পৌছে নিজের রুমে ঢুকে দরজা খুলে তাকিয়ে আদ্রিয়ান দেখলো যে অনিমা শব্দ করে কাঁদছে। আদ্রিয়ানের এবার অনিমার কান্না দেখে কষ্টের চেয়ে বেশি রাগ লাগল, এভাবে কাঁদার কী আছে? ও কী টর্চার করছে ওকে? ও কী এটা বোঝেনা যে ওর চোখের একেকটা ফোটা আদ্রিয়ানের হৃদয় থেকে কতোটা রক্ত ঝড়ায়? আদ্রিয়ান রেগে গিয়ে একটানে উঠিয়ে বসালো অনিমাকে। অনিমা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার হাত পায়ের বাধন খুলতে খুলতে বলল,
— ” মুক্তি চাও আমার কাছ থেকে? হ্যাঁ? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার কাছে থাকতে? ঠিকাছে চলো, ছেড়ে দিলাম তোমাকে, যাও যেখানে ইচ্ছে। যাও!”
অনিমা কিছু না বলে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে হিচকি দিয়ে কাঁদতে লাগল। আদ্রিয়ান ওকে সরিয়ে দিতে চাইলে ও আরো জোরে জরিয়ে ধরল আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানের রাগটা ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। নিজেকে শান্ত করে ও অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই অনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ আপনি আর বাইরে যাবেন না। খুব ভয় লাগে, শ্বাস আটকে আসে আমার। খালি মনে হয় যে রিক..”
এটুকু বলে অনিমা আর কিছু বলতে পারলোনা আবারও কাঁদতে লাগলো। অনিমার কথাকে সম্পূর্ণ করে আদ্রিয়ান বলল,
— ” যে রিক আমাকে মেরে ফেলবে রাইট?”
অনিমা অবাক হয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ জানি, সবটা জানি। তোমার বাবার মার্ডার হওয়া থেকে শুরু করে মাদারের আশ্রমে তোমার আশ্রয় নেওয়া অবধি সব জানি আমি। আর এটাও জানি কেনো তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছো।”
অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
— ” কীভাবে?”
আদ্রিয়ান শক্ত গলায় বলল,
— ” সেটা ইমপর্টেন্ট নয়। ইমপর্টেন্ট হলো এটাই যে তুমি যেই কারণে ভয় পাচ্ছো সেই ভয়ের কোনো কারণই নেই।”
অনিমা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
— ” আদ্রিয়ান আপনি জানেনা আপনি কতোটা হিংস্র কতোটা ভয়ংকর ওরা। ওরা যা খুশি তাই করতে পারে। কাউকে মারতে ওদের হাত কাঁপেনা।”
আদ্রিয়ান অনিমার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,
— ” ভালোবাসা জগতের সবচেয়ে বড় শক্তি অনি। একবার ভালোবেসে দেখো তোমার ভালোবাসা আমার কবজ হয়ে যাবে। একবার কাছে টেনে দেখো তোমার স্পর্শে আমার চারপাশে সুরক্ষা বলয় তৈরী হয়ে যাবে। তুমিই তো আমার শক্তি। আর তুমি আমার সাথে থাকলে আল্লাহ ছাড়া জগতের কোনো শক্তি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। একবার সেই ভালোবাসায় বিশ্বাস করে দেখো সব সহজ হয়ে যাবে, সব।”
অনিমা চোখ খিচে বন্ধ করে আদ্রিয়ানের কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখের জল ফেলছে আর ওর বলা প্রতিটা শব্দকে শুনছে। ওর মনে হচ্ছে এই কথাগুলোর একটা শব্দও সত্যি না বরং চিরন্তন সত্যি।
আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে খাবার আনিয়ে অনিমাকে খাইয়ে দিয়ে স্টুডিওতে যাওয়ার আগে অনিমার কাছে এসে বলল,
— ” তোমাকে আর বেধে রাখবোনা আমি। আমার ভালোবাসার প্রতি যদি তোমার এতোটুকু বিশ্বাস থাকে তাহলে তুমি কোথাও যাবেনা।”
এটুকু বলেই আদ্রিয়ান চলে গেলো ওখান থেকে আর অনিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে।
_____________________
রাতে স্টুডিও থেকে ফিরে রুমে আদ্রিয়ান পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে কারণ অনিমা গায়ে একটা চাদর পেচিয়ে বসে আছে। আদ্রিয়ানকে দেখেই অনিমা বিরক্ত হয়ে তাকালো ওর দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে বলল,
— ” জ্বর ও তো আসেনি এভাবে চাদর পেচিয়ে রেখেছো কেনো?”
অনিমা বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” তো কী করবো? আপনি আমাকে এখানে তুলে নিয়ে এসছেন। অথচ আমার জন্যে যেসব পোশাক কিনেছেন সব ওই ফ্লাটেই রেখে এসছেন?”
আদ্রিয়ান আফসোস এর একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” শিট। ভুলেই গেছিলাম। কিছুই পরোনি?”
অনিমা ইতস্তত করে বলল,
— ” পরেছি।”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বললো,
— ” কী?”
অনিমা কিছু না বলে মাথা নিচু করে আছে। সেটা দেখে আদ্রিয়ান নিজেই বলল,
— “এই রাতে শাওয়ার নিয়েছো কেনো?”
অনিমা মুখ ফুলিয়ে বলল,
— ” খুব অস্হির লাগছিলো তাই।”
আদ্রিয়ান এবার একটু রেগে গিয়ে বলল,
— ” তাই বলে এই রাতের বেলা শাওয়ার নেবে? চলো চুল শুকিয়ে দিচ্ছি।”
এটুকু বলে অনিমার হাত ধরতে গেলেই অনিমা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
— ” নাহ।”
আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে বলল,
— ” কী? চেচাচ্ছো কেনো?”
অনিমা চাদর টা ভালোভাবে গায়ে জরিয়ে বলল,
— ” আমি উঠতে পারবোনা।”
আদ্রিয়ান ধমকের সুরে বলল,
— ” মানে কী? এভাবে ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লাগবে ওঠো!”
বলে একটানে অনিমাকে দাড় করিয়ে দিলো যার ফলে চাদরটা গা থেকে পরে গেলো। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে পুরো শকড হয়ে গেলো, এবার বুঝলো অনিমার রিঅ্যাক্ট করার কারণ। অনিমা আদ্রিয়ানের নেভি ব্লু রং এর একটা শার্ট পরে আছে। যেটা অনিমার হাটুর খানিকটা ওপরে পরছে। অনিমা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান এবার হেসেই দিলো, ধীরে ধীরে সেই হাসি বৃদ্ধি পেতে লাগল, হাসতে হাসতে লুটোপটি খাওয়ার মতো অবস্হা। অনিমা মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
— ” এইজন্যেই ওভাবে প্যাকেট হয়ে ছিলে?”
অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত কচলে যাচ্ছে আর মাঝেমাঝে শার্ট টা টানছে। আদ্রিয়ান হেসে বলল,
— ” ওভাবে টানলে ওটা বড় হবেনা। বাই দা ওয়ে, শার্ট টা তে কিন্তু তোমাকে অনেক হট লাগছে।”
অনিমা চোখ বড়বড় করে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে আর আদ্রিয়ান চোখ টিপ মারলো একটা। অনিমা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
— ” অসভ্য একটা।”
আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে অনিমাকে টুলে বসিয়ে চুল শুকিয়ে দিলো। এরপর খাবার এনে দুজনেই একসাথে ডিনার করলো। অনিমার বেশ অসস্হি হচ্ছে আদ্রিয়ানের সামনে এভাবে থাকতে বাট কিছুই করার নেই। তাই পুরোটা সময় ও একবারো আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকায় নি লজ্জায়। আদ্রিয়ানও অনিমার এই লজ্জামাখা মুখটা বেশ ইনজয় করেছে আর বারবার ওকে লজ্জা দিতে নানা রকমের পিঞ্চ মারা কথা বলেছে। অনিমা বেচারী তো লজ্জায় পুরো কুকড়ে যাওয়ার অবস্হা।
গভীর রাতে বাইরে তীব্র বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে, আসলে বর্ষা প্রায় শেষের পথে তাই হয়তো প্রকৃতি ঢাকঢোল পিটিয়ে বর্ষাকে এইবছরের মতো বিদায় দেবার আয়জন করছে। বাজ পরার আওয়াজে চিৎকার করে উঠে বসল অনিমা প্রতিবারের মতো এবারেও হাইপার হয়ে গেছে ও। কান চেপে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। আদ্রিয়ান জেগেই ছিলো অনিমা এভাবে চিৎকার করতে দেখে প্রতিদিনের মতো উত্তেজিত হলোনা ও শান্তভাবেই অনিমার সামনে গিয়ে দাড়ালো। অনিমা আদ্রিয়ানকে দেখেই বসা অবস্হাতেই ওর পেট জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ওর সেইসব বকতে লাগল কিন্তু আদ্রিয়ান ওকে ধরলো পর্যন্ত না। অনিমা হিচকি দিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
— ” আই নিড সিলিপিং পিলস। প্লিজ দিন ওটা আমি পারছিনা এসব নিতে। আমি মরে যাবো প্লিজ।”
এটা বলার সাথেসাথেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে ওকে দাড় করালো এরপর টেনে রুম থেকে বার করে সিড়ি দিয়ে ছাদের ওখানে নিয়ে গেলো। এই বাড়ির ছাদে ঢোকার দরজার আগে কাঁচের ওয়াল আর দরজাটাও কাঁচের। বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর ঝলকানি সাথে বাজের আওয়াজ বেড়েই চলেছে,অনিমা আদ্রিয়ানকে আকড়ে ধরে বলল,
— ” প্লিজ এখান থেকে চলুন ভয় লাগছে আমার।”
আদ্রিয়ান দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে অনিমাকে ছাদে ঢেলে দিয়ে দরজা আবার বন্ধ করে দিলো। অনিমা দৌড়ে এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলো, ভয়ের জন্য কথাও বলতে পারছেনা বেচারী। আদ্রিয়ান কাচের দরজা দিয়েই অনিমাকে দেখছে। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ” প্লিজ দরজাটা খুলুন প্লিজ। আমি মরে যাবো এখানে প্লিজ! আমার খুব ভয় করছে। আমি হাত জোর করছি প্লিজ ভেতরে নিয়ে যান আমাকে। আদ্রিয়ান প্লিজ!”
এটুকু বলে গ্লাস ধরেই ওখানে বসে পরলো অনিমা। আর আদ্রিয়ান গ্লাসের সাথে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে চোখ মুখ ভীষণ শক্ত করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে, আর অনিমা পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে।
.
#চলবে…
.
(