বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৫৭

#বর্ষণের সেই রাতে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৭
.
আদ্রিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। সকলেই হতভম্ব হয়ে গেছে। এইরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবে কেউ কল্পণাও করতে পারেনি। রিক ও ধপ করে বসে পরল অনিমার সামনে। স্নিগ্ধা ওরা সবাই দৌড়ে এলো। কবির শেখ বেশি ডেসপারেট হয়ে গেছে তার জন্যে পুলিশ আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওনাদের নিয়ে চলে গেলো। জার্নালিস্টরা কিছু পুলিশের পেছনে গেলো আর কিছু এইখানে অনিমাদের দিকে ক্যামেরা টার্ন করলো। স্নিগ্ধা চেচিয়ে বলল,

— ” তোমারা এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? ওকে হসপিটালে নিতে হবে, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে।”

স্নিগ্ধার আওয়াজে আদ্রিয়ান আর রিক দুজনেরই হুশ এলো। তীব্র দৌড়ে গাড়ি বার করতে চলে গেলো। আদ্রিয়ান অনিমার গালে হাত রেখে হালকা ঝাকিয়ে বলল,

— ” জানপাখি? এই জানপাখি? কেনো করলে এরকম? কে বলেছিলো সামনে আসতে ? হোয়াই ড্যাম ইট?”

রিক নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছে কিন্তু নিজেকে সামলে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে হালকা কাঁপা গলায় বলল,

— “আদ্রিয়ান প্লিজ শান্ত হও। ওকে হসপিটালে নিতে হবে। ওঠাও ওকে।”

অভ্র ইতস্তত গলায় বলল,

— ” হ্যাঁ স্যার বেশি লেট হয়ে যাওয়ার আগে..”

আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,

— ” ঐ? লেট হয়ে গেলে মানে কী? কিচ্ছু হবেনা ওর কিচ্ছু হবেনা।”

বলে আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পদে বেরিয়ে গেলো ওর পেছন পেছন বাকিরাও গেলো। সাথে জার্নালিস্টরাও।

_______________________

ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনিমাকে। বাকি সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা ডক্টর তাই ওও ভেতরে আছে। বাইরে সাংবাদিকরা ভীর করে আছে কিন্তু পুলিশ ওনাদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সকলের মুখেই টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। আদিব ,আশিস, অভ্র, তীব্র গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অরু আর স্নেহা বেঞ্চে বসে বসে কাঁদছে। আদ্রিয়ান হাটু গুটিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। ওর শার্টে অনিমার শরীরের রক্ত লেগে আছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। রিক দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে ওর মানসিক অবস্হাও ভালো নেই। ওও তো খুব ভালোবাসে মেয়েটাকে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজেরই চোখের সামনে অলমোস্ট মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে দেখাটা যে কতোটা যন্ত্রণার সেটা আদ্রিয়ান আর রিক দুজনেই খুব ভালোকরে বুঝতে পারছে। কিছু একটা ভেবে রিক গিয়ে আদ্রিয়ানের পাশে ফ্লোরে বসে ওর কাধে হাত রেখে বলল,

— ” নিজেকে সামলাও কিচ্ছু হবেনা ওর। তোমার জন্যে হলেও ফিরে আসতে হবে ওকে।”

আদ্রিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রিকের দিকে। চোখ লাল হয়ে আছে আদ্রিয়ানের। রিক একহাতে জরিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” ওঠো। বেঞ্চে এসে বসো।”

আদ্রিয়ান কোনো রেসপন্স করলোনা তাই রিক নিজেই ওকে ধরে উঠিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দিলো। নিজেও ওর পাশে বসে মুখ চেপে ধরে বসে আছে। একটা দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরী হয়েছে চারপাশে। অনিমার ওদের সকলের কলিজার টুকরো আর সেই মেয়েটার এরকম অবস্হা দেখে প্রত্যেকেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছে।

এরমধ্যেই মিস্টার আর মিসেস আবরার দৌড়ে ভেতরে এলেন। ওনারা পুরোটা নিউসই দেখেছেন টিভিতে আর অনিমার গুলি লাগার নিউস শুনেই ওনারা ছুটে এসেছেন হসপিটালে। মিসেস আবরার আদ্রিয়ানের পাশে বসে বলল,

— ” কেমন আছে অনিমা? ডক্টর কী বলেছে?”

মানিক আবরারও বললেন,

— ” কোথায় আছে মামনী এখন?”

আদ্রিয়ান কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে। রিক নিজেই বলল,

— ” একটু আগে ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়েছে। এখনো ডক্টর বের হয়নি।”

মিস্টার আর মিসেস আবরার দুজনেই বেঞ্চে বসল। একটু পরেই স্নিগ্ধা আর একজন ডক্টর বেড়িয়ে এলেন। ওদের দেখে সবাই নড়েচড়ে দাঁড়ালো। আদ্রিয়ান আর রিক দুজনেই দ্রুতপদে গেলো ওদের সামনে। আদ্রিয়ান কাঁপা গলায় বলল,

— ” কী অবস্হা ওর?”

রিকও ওনাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” বুলেট এর পজিশনটা কী? মানে রিস্ক নেই তো?”

স্নিগ্ধা আর মেল ডক্টর একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। আদ্রিয়ান অধৈর্য হয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলল,

— ” তোমরা কিছু বলবে?”

রিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ” স্নিগ্ধু তুই বলবি নাকি আমি ভেতরে ঢুকবো?”

স্নিগ্ধা একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” কেসটা খুব ক্রিটিকাল হয়ে গেছে রিক দা। সব ঠিকি ছিলো বুলেটের পজিশনটাই অবস্হাটা জটিল করে দিয়েছে।”

মেইল ডক্টর ও বললেন,

— ” হ্যাঁ বুলেটের পজিশনটার জন্যেই আমরা কোনো স্টেপের কথা ভাবতে পারছিনা। সার্জারিটা করার সাহসটাই পারছিনা। জীবণে গুলি লাগার কেস অনেক সামলেছি। কিন্তু এইরকম কেস পাইনি। যদি অপারেশন করাও হয় তাহলে অপারেশন টেবিলেই…আইমিন অপারেশন সাকসেসফুল হবার চান্স মাত্র টু পার্সেন্ট।”

আদ্রিয়ান রেগে ডক্টরের দিকে তেড়ে গিয়ে চেচিয়ে বলল,

— ” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই টু পার্সেন্ট হ্যাঁ? কেমন ডক্টর আপনারা? ওর যদি কিছু হয়না এই হসপিটালটাই গুড়িয়ে দেবো আমি।”

রিক আর স্নিগ্ধা মিলে আদ্রিয়ানকে ধরে ওকে শান্ত করলো। রিক আদিব আশিসের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই ওরা এসে আদ্রিয়ানকে ধরে বসিয়ে দিলো। রিক ডক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আপনারা অপারেশন করবেন কী না?”

ডক্টর ইতোস্তত করে বলল,

— ” অপারেশন তো করতেই পারি বাট আমিতো বললামই যে চান্স মাত্র টু পার্সেন্ট। তাই একটা বন্ড সাইন করতে হবে।”

আদ্রিয়ান চেঁচিয়ে বলল,

— ” নাহ কোনো বন্ড সাইন হবেনা। ইউ হ্যাভ টু এসিউর যে ও ঠিক হয়ে যাবে।”

মানিক আবরার আদ্রিয়ানের পাশে বসে বলল,

— ” এতো হাইপার হওয়ো না ও ঠিক হয়ে যাবে।”

রিক নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু একটা ভাবল। তারপর একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” সার্জারি হবে বন্ড সাইন ছাড়াই হবে আর সেটা আমি করবো। ”

সকলেই অবাক হয়ে তাকালো রিকের দিকে । ডক্টর অবাক হয়ে বললেন,

— ” আপনি করবেন মানে?”

রিক শক্ত চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আমি বাংলাতেই বলছি। ”

ডক্টর ইতোস্তত গলায় বলল,

— ” নাহ স্যার আমরা জানি আপনার লাইসেন্স আছে কিন্তু প্রাকটিস ছাড়া..”

রিক ছোট্ট একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

— ” মেডিকেল লাইফে আমার বিশেষত্ব কী ছিলো জানেন? আমি একবার যেটা শিখতাম সেটা আর দ্বিতীয়বার শেখাতে হতো না আমায়। টপার ছিলাম আর টপ বয় ও। রিক চৌধুরীর কোনো প্রাকটিসিং এর প্রয়োজন পরে না।”

স্নিগ্ধা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। এরমধ্যে এই খবর শুনে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট এর লোকও এসে গেছে। তাদের মধ্যে একজন বললেন,

— ” কিন্তু স্যার..”

রিক এতক্ষণ ঠান্ডা গলায় কথা বললেও এবার রেগে বলল,

— ” আমাকে যদি কেউ থামানোর চেষ্টাও করে তাহলে এই হসপিটাল টা কালকে আর থাকবেনা আই সোয়ার।”

রিকের এই কথা শুনে কেউ আর কোনো কথা বলার সাহস পেলোনা ওটি রেডি করতে চলে গেলো। স্নিগ্ধা তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছে। ও ভাবতেই পারেনি রিক আবার হোয়াইট এপ্রোন পরবে। ও দ্রুত একটা হোয়াইট এপ্রোন এনে রিকের হাতে দিলো। রিক এপ্রোনটা হাতে নিয়ে একবার হাত বুলালো ওটার ওপর কতোবছর পর হাতে নিলো এই এপ্রোন, এটা একসময় ওর প্যাশন ছিলো আর আজ এটা ওর প্রয়োজন। রিক এপ্রোনটা পরল সাথে সাথে ওর ভেতরে অদ্ভূত এক অনুভূতি কাজ করলো। তবে সেদিকে পাত্তা পা দিয়ে রিক আদ্রিয়ানের সামনে গিয়ে বসে বলল,

— ” আমার কাছে আমার মতামতই সবার আগে। কারো ধার ধারিনা আমি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমার তোমার অনুমতি লাগবে। কারণ অনিমা তোমার। একটু ভরসা করো আমার ওপর। তোমার জানপাখিকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো আমি, আর সেটা না পারলে নিজেও চিরকালের মতো হারিয়ে যাবো। আই প্রমিস।”

আদ্রিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। ও রিককে অবিশ্বাস করতে পারছেনা। ইনফ্যাক্ট রিকের চেয়ে বেশি ভরসা এইমুহূর্তে কাউকে করতে পারছেনা ও। ও শুধু রিকের হাত ধরে চোখের ইশারায় ওকে অনুমতি দিলো। রিক কথা না বাড়িয়ে ইমারজেন্সি তে ঢুকে গেলো বুলেটের পজিশনটা নিজে ভালোভাবে দেখে নিতে। সবাই এতোক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো অনেকেই জানতো না রিক একজন ডক্টর। রিক সব দেখে বাইরে বেরিয়ে এলো।

ওটি রেডি হয়ে গেছে। স্নিগ্ধা রিককে এসিস্ট করবে । রিক ওটির জন্যে রেডি হয়ে, মিস্টার আর মিসেস আবরারের কাছে গিয়ে বললেন,

— ” মা এখানে নেই। আর বাবা তো দুনিয়াতে থেকেও নেই। আপাদত আপনারা আছেন। প্রফেশনালভাবে প্রথম সার্জারি এটা আমার। দোয়া করবেন যাতে নিজেকে প্রমাণ করতে পারি।”

মানিক আবরার ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,

— ” আমি জানি তুমি পারবে।”

রিক মনে মনে বলল পারতেতো হবেই। নিজের প্রাণ কে না বাঁচাতে চায়? ও তো আমারও প্রাণ। ওনাদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে রিক আর স্নিগ্ধা ওটিতে ঢুকে গেলো। অটির লাইট জ্বলতেই আদ্রিয়ানের বুকের মধ্যে ঝড় শুরু হয়ে গেলো। মাত্র টু পার্সেন্ট এর ভরসাতেই আছে ওরা সবাই।

ওটিতে অনিমার ক্ষতের দিকে তাকাতেই রিক চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো। এই মেয়েটার শরীরে নিজ দ্বায়িত্যেই কত আঘাতের চিন্হ তৈরী করেছিলো ও অথচ আজ ওর নিজেরই এসব সহ্য হচ্ছেনা। ছুড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চালানোর সাহস করে উঠতে পারছেনা, অন্যকেউ হলে এতো ভাবতো না কিন্তু অনিমা বলেই এতো ভয়। রিকের কাঁধে হাত রেখে স্নিগ্ধা ওকে আশ্বস্ত করতেই রিক নিজেকে শক্ত করে নিলো। চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে অপারেশন শুরু করলো।

সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। হঠাৎ করেই ওখানে রিকের মা মিসেস লিমা বেগম ছুটে এলেন। এসে বললেন,

— ” রিক কোথায়? ও ঠিক আছেতো?”

মিস্টার আর মিসেস আবরার দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন মিসেস লিমাকে দেখে। মিসেস আবরার উঠে ওনার সামনে গিয়ে বললেন,

— ” লিমা তুই ঠিক আছিস তো?”

মিসেস লিমাও অবাক হয়ে বললেন,

— ” রিমা তুই..”

দুজনেই দুজনকে জরিয়ে ধরলো। মিসেস লিমা মিসেস আবরার এর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” তুই এখানে কী করছিস? তুই তো..”

মিসেস আবরার একটা শ্বাস নিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে ইশারা করে বললেন,

— ” আদ্রিয়ান আমার ছেলে। আর ভেতরে ওটি তে মানে ভাইয়া আজ যাকে গুলি করেছে সে আমার হবু বউমা।”

মিসেস লিমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

— ” ভাই বলিসনা ওনাকে। লজ্জা করে আমার যে ওইরকম একটা লোক আমার ভাই। আদ্রিয়ান তোর ছেলে? তবুও ওরা ছিঃ।আমার তো কপালটাই খারাপ যে আমার স্বামী আর ভাই দুজনেই খুনি।”

ওনাদের কথপোকথন শুনে আদ্রিয়ান আর মানিক আবরার বাদে বাকি সবাই অবাক। কে কার ভাই আর কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছেনা কেউ। মিসেস আবরার বললেন,

— ” ভাইয়া জানতো যে আদ্রিয়ান ওনার নিজের ভাগ্নে তবুও কীকরে পারলো ওর দিকে গুলি ছুড়তে?”

মিসেস লিমা ভাঙ্গা গলায় বললেন,

— ” ওনাদের দ্বারা সব সম্ভব।”

আদ্রিয়ান এসবে কানও দিচ্ছেনা ওর দৃষ্টিতে শুধু ওটির দরজার দিকে। মানিক আবরার এবার বললেন,

— ” আচ্ছা অনেক হয়েছে তোমারা একটু বসো।”

ওনারা দুজনে বসতেই মানিক আবরার সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” তোমরা কিছুই বুঝতে পারছোনা তাইতো? আসলে রিমা আর লিমা ওরা জমজ বোন। চেহারা হুবহু না মিললেও নাইটি পার্সেন্ট এক। আর কবির শেখ হলেন ওনাদের একমাত্র বড় ভাই। আসলে আদ্রিয়ানের মা আর আমার লাভ ম্যারেজ ছিলো। কিন্তু ওদের পরিবারের কেউ আমাদের সম্পর্কটা মানে নি আর ওর বাবা ওর সাথে সব সম্পর্কই শেষ করে দিয়েছে। তাই আমি ওকে নিয়ে চলে আসি। এরপর শুরুর দিকে চেষ্টা করলেও ওনারা মানেননি। মুল কারণ ছিলো কবির শেখ। উনিই বিভিন্নভাবে ওর বাবাকে উস্কে রাখতো। একপর্যায়ে আমরাও যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। এরমধ্যে ওর বাবা মারা যায় আর প্রপার্টি সব কবির শেখ নিজের নামে করে নেয়। আর এই দুই পরিবারের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি। সেতো কিছুদিন আগে আদ্রিয়ান এসে আমাদের বলল যে মিনিস্টার রঞ্জিত চৌধুরীর ওয়াইফ তুমি আর ছেলেও আছে রিক। এইকারণেই রিক আমাদের বাড়িতে আসলে আমরা ওকে এতো আদর করতাম।”

সকলেই অবাক হলো এতো কাহিনীতো ওরা জানতোই না। মিসেস লিমা ভাঙ্গা গলায় বললেন,

— ” রিক কোথায় এখন।”

মিসেস আবরার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

— ” ওটিতে আছে। অনিমার সার্জারি ওই করছে।”

মিসেস লিমা অবাক তো হলেনই সাথে প্রচন্ডরকমের খুশিও হলেন। খুশিতে ওনার চোখেও পানি চলে এলো, উনি কাঁপা গলায় বললেন,

— ” আমার রিক ওটি তে ঢুকেছে? ওপারেশন করছে? ”

মিসেস আবরার বললেন,

— ” প্রার্থনা কর যাতে ও সফল হতে পারে।”

মিসেস লিমা মনে মনে আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন তার ছেলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে এটা ভেবে আর অনিমা যাতে সুস্হ হয়ে যায় সেই প্রার্থনাও করলেন।

এদিকে অনিমার অবস্হা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। স্নিগ্ধা বারবার মনিটর চেক করছে। বাকিরাও ভয় পাচ্ছে। রিকের তো ঘাম বেড়োচ্ছে কিন্তু তবুও নিজেকে শক্ত রেখে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে অনিমার অবস্হা এতোটাই খারাপ হলো যে বাকিরা ধরেই নিলো পেশেন্ট বাঁচবে না। রিক একটু দূরে সরে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। স্নিগ্ধা রিকের কাছে গিয়ে বলল,

— ” শক্ত হও রিক দা। তোমাকে পারতে হবে। আর তুমি পারবেও। এটা অনিমার জীবণ এতো সহজে যেতে দিতে পারোনা তুমি। প্লিজ।”

সময় যতো বারছে সবার মধ্যকার অস্হিরতা ততো বারছে। একপর্যায়ে আদ্রিয়ানতো কেঁদেই দিলো। ওর ফোপানোর আওয়াজে মিসেস আবরার ওর কাছে গিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলেন। সকলেই চমকে গেলো। মিসেস আবরার আদ্রিয়ানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

— ” এমন কেনো করছিস তুই সব ঠিক হয়ে যাবে। ও একদম সুস্হ হয়ে যাবে দেখিস।”

আদ্রিয়ান মিসেস আবরার কে জরিয়ে ধরে ভাঙ্গা গলায় বলল,

— ” কেনো এরকম করলো ও? কেনো? ও কী করে ভাবলো হ্যাঁ নিজে মরে আমায় বাঁচিয়ে নেবে? আমার শরীরের আঘাত নিজের গায়ে নিয়ে নেবে? ও এটা কেনো বোঝেনা বলোতো ওর শরীরের একেকা আঘাত আমার কাছে দশগুন হয়ে ফেরত আসে? আমি পারবোনা ওকে ছাড়া থাকতে মা জাস্ট পারবোনা।”

মানিক আবরারও এবার আদ্রিয়ানের কাছে এসে বলল,

— ” আরে কিচ্ছু হবেনা ওর। দেখবি ও একদম সুস্হ হয়েছে বেরোবে রিক আর স্নিগ্ধা আছেতো ওখানে ওরা ঠিক পারবে।”

এরমধ্যেই ওটির লাইট অফ হয়ে গেলো আর তারপর রিক আর স্নিগ্ধা দুজনেই বেড়িয়ে এলো। দুজনের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই খবর ভালো না খারাপ। আদ্রিয়ান ওদের কাছে গিয়ে বলল,

— ” অনিমা কেমন আছে? কী হলো বলো? কেমন আছে অনিমা।”

মিসেস আবরার বললেন,

— ” ও ঠিক আছে তো বিপদ কেটে গেছে তো?”

রিক ওনাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” আদ্রিয়ানকে কথা দিয়েছিলাম ওর জানপাখিকে ওর কাছে ফিরিয়ে দেবো। আমি পেরেছি আমার কথা রাখতে।”

স্নিগ্ধা মুচকি হেসে বলল,

— ” হ্যাঁ ও এখন একদম ঠিক আছে আর একটু পরে কেবিনে দেওয়া হবে। কালকে সকালের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।”

সবাই স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলল, আদ্রিয়ান গিয়ে রিককে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” থ্যাংক ইউ থ‍্যাংক ইউ সো..মাচ।”

রিক কিছু না বলে একটু হাসলো। ওর দৃষ্টি মিসেস লিমার দিকে যেতেই ও অবাক হয়ে বলল,

— ” আরে মা তুমি এখানে? তুমি এখানে? মানে তুমি ঠিক আছোতো? দেখো টিভির নিউজগুলো দেখে ভেঙ্গে পরোনা। আমিতো আছি তোমার কাছে।”

মিসেস লিমা হেসে রিকের দুই গালে হাত রেখে বললেন,

— ” একদিন বলেছিলাম না আমার লজ্জা হয় তোকে নিজের ছেলে বলতে? আজ আমি বলছি আমি গর্বিত যে তুই আমার ছেলে। আই এম প্রাউড অফ ইউ।”

বলে রিকের কপালে একটা চুমু খেলেন। এরপর রিক আর স্নিগ্ধা দুজনেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ওরা ফ্রেশ হয়ে আসতেই আদ্রিয়ান রিককে বললো,

— ” অনির সাথে দেখা করা যাবে এখন।”

রিক আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” টেনশন করোনা একদম ও ঠিক আছে। দুই ঘন্টা যাক এরপর দেখা করে এসো।”

রিক ওনাদের কাছে গিয়ে বসতেই মিসেস লিমা বললেন,

— ” রিক তোমার রিমা আন্টি কিন্তু তোমার নিজের খালামনি আর আদ্রিয়ান তোমার আপন খালাতো ভাই।”

রিক অবাক হয়ে তাকালো ওনার দিকে। এরপর উনি রিককে সককথা খুলে বললেন শুরু থেকে। সব শুনে রিক খুশি হওয়ার সাথে সাথে লজ্জিত হলো। নিজের ভাইকে মারতে চেয়েছিল ও একসময়? রিক উঠে আদ্রিয়ানের কাছে গিয়ে বলল,

— ” আই এম সরি ভাই। আমি আসলে..”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” গাঁধা আমি তোর মাত্র তিন মাসের বড় তাই এসব ভাই টাই বলার দরকার নেই। নাম ধরে ডাকবি আর তুই করে বলবি।”

দুজনেই দুজনকে জরিয়ে ধরলো। সবার মুখেই প্রশান্তির এক হাসি। অনেকদিন পর সমস্ত কালো আধার কেটে গিয়ে সুখের আলো এসেছে ওদের জীবণে।

_______________________

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অনিমাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। রিক হসপিটাল জয়েন করেছে। শুধু তাইনা মিসেস লিমা, রিক আর স্নিগ্ধা এখন আদ্রিয়ানকে বাড়িতেই থাকে। আসলে মিস্টার রঞ্জিত এর বাড়ি ঘর সরকার থেকে সিল করা হয়েছে কারণ সবই অবৈধ আর কালো টাকায় তৈরী যেটুকু পরে আছে সেগুলো রিক ছোবেও না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। রিক চেয়েছিলো আপাদত একটা ফ্লাট ভারা নিয়ে থাকবে পরে একটু গুছিয়ে বাড়ি কিনবে কিন্তু আদ্রিয়ান মানেনি জোর করেই এই বাড়িতে নিয়ে এসছে ওদের। স্নিগ্ধার যেহেতু হসপিটালের জন্যে এখানে থাকতে হয় তাই ওকেও এই বাড়িতেই রেখে দিয়েছে ওরা।

তবে বিপত্তি হলো এই এক সপ্তাহ ধরে অনিমার সাথে আদ্রিয়ান কোনো কথা বলেনি। তবে ওকে সময়মত খাইয়ে দেওয়া, মেডিসিন দেওয়া, যত্ন নেওয়া সব করে আদ্রিয়ান কিন্তু শুধু কথাটাই বলেনা। ওর অপরাধ ও কেনো বন্দুকের সামনে এসছিলো। অনিমা অনেকবার সরি বলার পরেও কাজ হয়নি। অনিমা ভাবছে এবার একটা প্লান করতে হবে যাতে বাবুসাহেবের রাগ ভাঙ্গে।

স্নিগ্ধা হসপিটাল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে রিক ওর বেডে বসে বসে ফোন দেখছে। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বলল,

— ” তুমি এখানে? কী করছো?”

রিক ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বলল,

— ” ব্রেকটাইমে তোর কেবিনে বসে যেই ছেলেটার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলি। ছেলেটা কে ছিলো?”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুচকে বলল,

— ” সেটা জেনে তুমি কী করবে? তুমি এসব কেনো জিজ্ঞেস করছো?”

রিক এবার রেগে আছাড় মারলো। স্নিগ্ধা ভয়ে কেঁপে উঠলো। রিক স্নিগ্ধার বাহু ধরে চেঁচিয়ে বলল,

— ” আমার কী সেটা তোর না জানলেও চলবে কিন্তু নেক্সট টাইম যদি কোনো ছেলের সাথে এতো ঢলাঢলি করতে দেখি তো। ঠ্যাং ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখব।”

বলে স্নিগ্ধাকে ধাক্কা দিতেই ওর পা গিয়ে সোজা কাঁচের একটা টুকরোর ওপর পরল। স্নিগ্ধা আহ করে পা ধরে বসে পরল। রিক চলৈ যেতে নিচ্ছিলো স্নিগ্ধার আওয়াজে পেছনে তাকিয়ে এই অবস্থা দেখে দৌড়ে স্নিগ্ধার কাছে বসে ওর পা ধরে এগিয়ে এনে দেখলো কাঁচ ঢুকে গেছে। রিক করুণ চোখে একবার স্নিগ্ধার দিকে তাকালো স্নিগ্ধা রিকের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। রিক কাঁচটা ধরে একটানে বের করলো কারণ ধীরে ধীরে করলে ব্যাথা বেশি পাবে। স্নিগ্ধা জোরে চেঁচিয়ে উঠে রিকের শার্ট খামচে ধরলো। রিক কাঁপা গলায় বলল,

— ” সরি। আসলে বুঝতে পারিনি আমি। খুব বেশি ব্যাথা করছে?”

স্নিগ্ধা কিছু বললনা শুধু মাথা নাড়ল। রিক ওকে কোলে নিয়ে বেডে বসিয়ে দিলো তারপর ফার্স্ট এইড বক্স এনে ওর পায়ে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা শুরু করলো। স্নিগ্ধা শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। ওর চোখ দিয়ে খুশির একফোটা জল গড়িয়ে পরল কারণ আজ ও রিকের চোখে সেই অনুভূতি দেখেছে যা আগে কখোনো দেখেনি।

#চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here