#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
৭০.
একটা মানুষের জীবনের অন্যতম সুখের মুহূর্ত আসে যখন সে জানতে পারে যে তার সন্তান, তার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসতে চলেছে। আদ্রিয়ানের ক্ষেত্রেও এটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনিমা মা হতে চলেছে কথাটা শোনার পর ওর মনে হয়েছিল ঐ মুহুর্তে ও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। এতোটাই আনন্দ হচ্ছিলো যেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আনন্দের এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ওর চোখ দিয়ে।নাহিদের সামনেই ঘুমন্ত অনিমার কপালে চুমু দিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নাহিদ যেটা বলেছিল সেটা ছিল ভয়ংকর। অনিমার মানসিক অবস্থার যে অবনতি হচ্ছে সেটার মূল চিকিৎসা শুরু করা এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ ওর এখন যেই মেডিসিনগুলো প্রয়োজন সেগুলো খেলে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। আর অন্যদিকে খুব শীঘ্রই চিকিৎসা শুরু না হলে ও মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। যতো দিন যাবে ততই অনিমার আচরণ অস্বাভাবিক হতে থাকবে। এমনও হতে পারে যে পরে ওকে আর সুস্থ স্বাভাবিক করা সম্ভব হবেনা। আর সেরকমটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আদ্রিয়ান তখন নাহিদের কাছে জিজ্ঞেস করে,
” এখন কী করব তাহলে?”
নাহিদের কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে আদ্রিয়ানের সামনে নিষ্ঠুর দুটো পথ খুলে দিয়ে বলে,
” যদি তুই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চাস তাসলে তোকে অনিমাকে নিয়ে রিস্ক নিতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে যে ও সুস্থ হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। আর অনিমাকে এখন সুস্থ করতে চাস তাহলে তাহলে বাচ্চাটাকে…”
আদ্রিয়ান স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নাহিদের দিকে। ওর বুঝতে বাকি নেই যে ঠিক কী বলতে চাইছে নাহিদ। কিন্ত এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত কীকরে নেবে ও? নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবে? যে এখনো পৃথিবীর আলোও দেখেনি? কিন্তু সেটা না করলে তো অনিমার ক্ষতি হয়ে যাবে। আদ্রিয়ান নাহিদকে জিজ্ঞেস করেছিল আর কোন উপায় আছে কি-না। কিন্তু আর কোন উপায়ই নেই বাচ্চাটা অনিমার গর্ভে থাকাকালীন ও এতো পাওয়ারফুল ঔষধ খেতে পারবেনা। আর যদি খায় তো বাচ্চাটা ঠিক থাকবেনা। ব্যর্থ আর অসহায় কন্ঠেই সেটা আদ্রিয়ানকে জানিয়েছে নাহিদ। জীবনে প্রথমবার আদ্রিয়ানের মাথা কাজ করছে না, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ‘ আমার একটা বাচ্চা চাই আদ্রিয়ান। আমিও মা হতে চাই।’ বারবার অনির এই কথাটা মাথায় ঘুরছে। এতোটা অসহায় নিজেকে এর আগে কোনদিন মনে হয়নি ওর। কী করবে? কী করা উচিত এখন ওর?
_________
আবরার মেনশনে আজ খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কয়েকমাস আগেই রিক আর স্নিগ্ধার কোল আলো করে স্নিগ্ধ এসেছে। আর আজ সকলেই জানতে পেরেছে যে অনিমাও মা হতে চলেছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। মিসেস রিমা আর লিমা মিলে আজ সারাদিন রান্নাঘরে থেকে রান্না করেছে। সবটাই অনিমা আর আদ্রিয়ানের পছন্দের খাবার। সকলেই আনন্দে মেতে আছে। আর অনিমার খুশিতো সবচেয়ে বেশি। যদিও সবার সামনে সেটা প্রকাশ করতে পারছেনা। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। সবার এতো আনন্দ দেখে লজ্জাও লাগছে অনেকটা। আদ্রিয়ান সোফায় বসে তাকিয়ে শুধু দেখছে সবার আনন্দ। এই আনন্দ কীকরে নষ্ট করবে ও। মাঝে আরও দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে। প্রেগনেন্সির খবরটা আদ্রিয়ান বা নাহিদ কাউকে জানায়নি। কারণ আদ্রিয়ান তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অনিমা নিজেই জানতে পেরেছে। পিরিয়ড মিস হওয়া, আর শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখেই অনুমান করতে পেরেছিল ও। এরপর টেষ্ট করানোর পর জানতে পারে মা হতে চলেছে। সেদিন অনিমার খুশি আর উচ্ছ্বাস দেখে স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আদ্রিয়ান। অনিমা যখন আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে দিয়েছিল। তখন আদ্রিয়ান প্রচন্ড অসহায় বোধ করছিল।
রাতে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে গম্ভীরভাবে ভেবে চলেছে আদ্রিয়ান ওর হাতে সময় খুব কম। নাহিদ তাড়া দিচ্ছে বারবার। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাড়াতাড়ি নিতে হবে। দরজা লাগানোর আওয়াজে চোখ তুলে তাকাল ও। অনিমা এসেছে। অনিমা বিছানায় উঠে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে। আদ্রিয়ানও দুহাতে আগলে নিলো। অনিমা বলল,
” আজ আমি খুব খুশি। আপনি জানেন এতোদিন একটা বাচ্চার জন্যে মনটা কেমন ছটফট করতো আমার? খুব কষ্ট হতো। তাই হয়তো মাঝেমাঝে এমন রুড বিহেভ করে ফেলতাম তাইনা? কিন্তু আর করবোনা দেখবেন। আজ আমি ভীষণ খুশি। আমাদেরও ছোট্ট একটা বাবু আসবে। ছোট ছোট হাত-পা নাড়িয়ে খেলবে। আদো গলায় আমাদের ডাকবে। খিলখিল করে হাসবে। তাইনা?”
আদ্রিয়ান এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে অনিমার কথাগুলো শুনছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে মেয়েটার কতো স্বপ্ন। আর এই কথাগুলো ওর স্বপ্নের পরিধিকেও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আদ্রিয়ানকে চুপ থাকতে দেখে অনিমা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি খুশি হন নি?”
আদ্রিয়ান মুচকি হাসলো। এরপর অনিমাকে নিজের বুকের সাথে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” খুশি হবোনা কেন? খুব খুশি হয়েছি। অনেক রাত হয়ে গেছে এবার ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে কথা বলব আবার।”
অনিমা আর কিছু না বলে পরম শান্তিতে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। আদ্রিয়ান অনিমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। এই কয়েকদিন অনেক ভেবেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু এখন ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ও ওর বাচ্চাকে মারতে পারবেনা, কোনভাবেই না। অনিমা যদি ওর হৃদয় হয় তো ওদের এই বাচ্চা সেই হৃদয়ের স্পন্দন। কাউকেই ছাড়তে পারবেনা ও, সম্ভবই না। তাই ওকেও একটা রিস্ক নিতে হবে। হ্যাঁ যদি অনিমা পরে কখনও সুস্থ নাও হয়। তাতে কী? অনিমা যেমন থাকবে সেরকমভাবেই আগলে রাখবে ও অনিমাকে। হয়তো অনেক কষ্ট হবে কিন্তু ও ঠিক সামলে নেবে। তবুও নিজের সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা ও। অনিমাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথায় গভীরভাবে একটা চুমু দিল আদ্রিয়ান। এরপর ওর পেটের দিকে তাকাল। পেটের ওপর হালকা করে হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু দিল। এখানে ওর সন্তান ওর অংশ একটু একটু করে বড় হচ্ছে। যে ওকে ‘বাবা’ বলে ডাকবে। ভাবতেই বুকের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।
________
জাবিন নিজের রুমের বিছানায় হেলান দিয়ে কারো সাথে একটা কথা বলছে। ওর দৃষ্টি হাতের নখের দিকে আর মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলে রয়েছে। সশব্দে দরজা লাগানোর শব্দে জাবিন হালকা চমকে তাকালো দরজার দিকে। অভ্র ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্রর চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। জাবিন অভ্রর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আমি পরে কল করছি বেবি। এখন বাই।”
জাবিনের মুখে বেবী ডাক শুনে অভ্রর রাগ আরও বেড়ে গেল। জাবিন উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ? আপনাকে না বলেছিলাম আমার থেকে দূরে থাকবেন। এখানে এসেছেন কেন?”
জাবিনের প্রশ্নকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে অভ্র বলল,
” কার সাথে কথা বলছিলে ফোনে?”
জাবিন একটু অবাক হয়ে তাকাল অভ্রর দিকে। তারপর একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” দ্যাটস..”
কথাটা শেষ করার আগেই অভ্র জাবিনের দুই হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” দ্যাটস ডেফিনেটলি মাই বিজনেস। কজ__”
জাবিন এবার অভ্রর চোখে চোখ রেখে বলল,
” কজ?”
অভ্র আজ কোনরকম সংকোচ ছাড়াই বলে ফেলল,
” আই লাভ ইউ। কেনো বুঝছো না সেটা? আর তুমিওতো আমাকে ভালোবাসো তাইনা?”
জাবিন অভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
” বাসতাম। কিন্তু এখন আর বাসিনা। আপনাকে ভালোবাসার কোন কারণও নেই এখন আর।”
কথাটা বলে জাবিন চলে যেতে নিলেই অভ্র হাত ধরে টেনে আবার নিজের কাছে এনে বলল,
” মজা করছো আমার সাথে? দু’দিনেই সব ভালোবাসা উবে গেলো। আমি তোমাকে রিজেক্ট করেছি বলে?”
জাবিন এবার একটু রেগে গেল। রাগে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” তো আপনি কী ভেবেছিলেন আপনি আমাকে রিজেক্ট করার পর আমি দেবদাসী হয়ে থাকব? মুভ অন করব না?”
অভ্র এবার নিভল। সত্যিই তো বলেছে। কিন্তু ওতো জাবিনকে ছাড়তে পারবে না। এই কয়েকমাসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে জাবিনকে ছেড়ে বেঁচে থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব। ও এবার ঠান্ডা মাথায় জাবিনের দু-কাঁধে হাত রেখে বলল,
” আমিতো মানছি ভুল করেছিলাম। ক্ষমাও চেয়েছি কতোবার। কেন ওরকম করেছি সেটাও বলেছি।এবার অন্তত ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আর কতো কষ্ট দেবে? এদিকে তোমার ভাইও আমার মাথার ওপর খাড়া ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোন মুহূর্তে বলি দিয়ে দেবে টাইপ। তুমি সেটা চাও বলো? লঘু পাপে গুরুদন্ড হচ্ছেনা?”
জাবিন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা ফিক করে হেসে দিলো। অভ্র অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাবিনের দিকে। জাবিন অভ্রর দু কাঁধে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” কী মিষ্টার? কেমন দিলাম? এবার বুঝেছো ভালোবাসার মানুষ ফিরিয়ে দিলে কতো কষ্ট হয়?”
অভ্র চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ জাবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
” তারমানে এতদিন সব নাটক চলছিল?”
জাবিন দাঁত কেলিয়ে বলল,
” জি স্যার।”
অভ্র এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
” আর তোমার ক্রাশবয়?”
জাবিন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” সেটা আবার কে?”
” তোমাকে তো…”
জাবিনকে আর কে পায়। অভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। অভ্রর ছুটলো ওর পেছনে।
________
আদ্রিয়ানের আজও ফিরতে বেশ রাত হলো। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে খুব গোপনে মাদারের কাছে গিয়েছিল সবার চোখে ধুলো দিয়ে। এরপর গোপন মিটিং চলছিল। যেখানে রিক আর হাসান কোতয়ালও ছিল। কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরীর বর্তমান অবস্থা আর পরিকল্পনা নিয়েই কথা বলেছিল ওনারা। রুনা নামের মেয়েটাও একেবারে নিখোঁজ। সব ঝামেলা শেষ করে অনিমার জন্যে আইসক্রিম আর বার্গার কিনে নিল। সকালে বের হওয়ার সময় আনতে বলেছে মেয়েটা। বেশ ক্লান্ত শরীরেই রুমে ঢুকলো। কিন্তু রুমটা অন্ধকার। আদ্রিয়ান ভেতরে এসে দু-পা দিতেই পায়ে কাঁচের টুকরো ঢুকে গেল। ব্যথা পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিল আদ্রিয়ান। বুঝতে বাকি রইল না এই মেয়ে আজ আবার ক্ষেপেছে। সারাদিন পর বাড়ি ফিরে এসে কারোরই এসব ভালো লাগবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আদ্রিয়ান রাগ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু কতদিন পারবে নিজের ধৈর্য্য রাখতে?
#চলবে..