#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ৫
,
,
অপু মেজাজ সপ্তমে উঠিয়ে হাসপাতালের করিডোরের চেয়ারে বসে আছে।
এই মুহুর্তে অপুর মনে হচ্ছে নিজের চুল টেনেটেনে ছিড়তে।নয়তো পাশের কাউকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে,আমার গালে জোরে জোরে থাপ্পড় মারুন তো।ততক্ষণ ধরে মারুন যতক্ষণ না গাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।
পারলে মারতে মারতে আমায় মেরে ফেলুন।পেছনে বড় সাইনবোর্ড টানাতে ইচ্ছে হচ্ছে। সাইনবোর্ডে লিখে রাখবে আমি হলাম গাধা,বিশ্ব গাধা।আমাকে সবাই গাধা বলে ডাকুন।
কিন্তু এটা সম্ভব নয় বিধায় অপু রাগে কিড়মিড় করছে।নিজেকে নিজে বকতে বকতে গালির রেকোর্ড তৈরী করে ফেলেছে।
এখন বাজে রাত নয়টা।এতো রাতে বাড়ির বাইরে বসে মশা মারতে মোটেও ভাল লাগেছেনা।কিন্তু কি করবে?সে তো দয়ার রানী হতে গেছিলো?নয়তো এমনভাবে কেউ ঝামেলায় ফাঁসে?
এত্তো এতো লোক ছিলো রাস্তায়, কই কেউ তো নিজে যেচে ঝামেলা ঘারে নেয়নি,তাহলে অপুই কেনো নিলো?কেনো?ওই ওই লোকটার জন্য?যে রাস্তায় অপুকে রাগিয়ে দিয়েছিলো তার জন্য?
,
তাছাড়া শুধু বসে থাকলেও অপু রাগতো না।রাগার কারন অন্য।
মায়ের ঔষধ ফুরিয়ে গেছে,অপুর ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষার ফিস জমা দিতে হবে।অনেক বলে কয়ে ছাত্রীর মার কাছ থেকে অগ্রীম টাকা এনেছিলো আজ,আর সেই টাকাটা কিনা হাসপাতালে জমা দিতে হলো?
যতো যাই হোক অসুস্থ লোকের কাছে তো আর চিকিৎসার টাকা চাইতে পারেনা অপু।
এখন নিজের কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই তার কাছে।কি করবে এখন?টাকা ম্যানেজ করবে কোথা থেকে?পরিক্ষার ব্যাপারটাও চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ মায়ের ঔষধ।সেটাই বা কোথায় পাবে?ভাই তো আর দেবেনা।
,
ভাবনার মাঝে নার্স এসে বলে উঠলো,
,
—রোগী আপনার সাথে দেখা করতে চায়।
অপু উঠে দাড়ালো।রাত অনেক হয়েছে।বাড়ি ফিরতে হবে তাকে,যাওয়ার আগে লোকটার সাথে একবার দেখা করে নেওয়াটাই ভালো।
তাছাড়া এক্সিডেন্টটা বেশী গুরুতর ছিলো না।মাথায় আঘাত লাগার কারনে লোকটা অজ্ঞান হয়ে পরেছিলো,আর হাতে পায়ে একটু আধটু ছুলে গেছে এই যা।
,
,
কেবিনের সামনে এসে দরজার কাছে দাড়ালো অপু।
আরমান খান বেডে আধশোয়া হয়ে আছেন।
অপুকে দেখে হাত দিয়ে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলেন।
ইশারা পেয়ে অপু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।বেডের পাশে দাড়াতেই আরমান খান বললেন,
—দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা,বসে পর।
এতক্ষণ যতোটুকু খারাপ লাগা বা রাগ অপুর মাঝে ছিলো তা হুট করে যেনো গায়েব হয়ে গেলো।ভেতরে ভর করলো একরাশ ভাললাগা।মা ছাড়া কেউ কোনদিন অপুকে এতো ভালবেসে সম্মোধন করেছে কিনা অপুর মনে নেই।অচেনা অজানা লোকের কাছে এমন আদরমাখা সম্মোধন শুনে অপুর চোখ ভরে এলো।
আরমান খান বললেন,
—তুই করে বললাম বলে রাগ করেছিস?
অপু নিজেকে সামলালো।হুট করে এতোটা আবেগী হয়ে ওঠা মানায় না তাকে।তাছাড়া লোকটা অপুর চোখে পানি দেখলে কি ভাববে?
নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
—না না।
আরমান খান হাসলেন।অপুর মাথায় মমতামাখা হাত বুলিয়ে দিলেন।বললেন,
—তোকে দেখেই আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো,আর যাকে মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো তাকে তুমি বা আপনি বলতে ইচ্ছে করলো না।
অপু উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো।
আরমান খান আবার বললেন,
—তোর হাসিটাও আমার মায়ের মতো জানিস?আচ্ছা দুটো মানুষের এতো মিল হয় কোনদিন?
—জানিনা তো।
—তোর নাম কি রে মা?
—অপরুপা।
—অপরুপা?বাহ ভারি মিষ্টি নাম।
রাত তো অনেক হলো তুই বাড়ি যাবিনা।আমার জন্য তোকে এতোরাত হাসপাতালে থাকতে হলো।
অপু হাত ঘরির দিকে তাকিয়ে বললো,
—হ্যা এখনি যাবো।
—একা একা যেতে পারবি?
—হ্যা পারবো।আমার কোন সমস্যা হবেনা।
আরমান খান কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন।
ব্যাপারটা চোখে পরলো অপুর।
বললো,
—আপনি কি কিছু বলবেন?
আরমান খান মৃদু হাসলেন।মেয়েটার স্বভাব ও দেখি তার মায়েরই মতোন।মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছে যে সে কিছু বলতে চায়।
—তোর ঠিকানাটা দিবি মা?না মানে একটু যোগাযোগ করতাম আরকি।
অপু কথা বাড়ালো না ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিলো।
হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরলো।
,
,
,
,
হাসপাতালে পৌছেই নাক মুখ কুঁচকে তাকালো নোমান।এটা কি হাসপাতাল?নোমান আসেপাশে তাকিয়ে আরও একদফা ভ্রু কুঁচকালো। পকেটে হাত দিয়ে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরলো সে।
দু আঙুল নিয়ে কপালে ম্যাসেজ করলো কিছুক্ষণ।
এই মুহুর্তে তার মেজাজ ঠান্ডা রাখতে হবে।হাসপাতালে কোনরকম সিনক্রেট করতে চাচ্ছে না সে।
নোমান ভেবে পায় না তার বাবা,নোমান খানের বাবা এমন একটা লো ক্লাস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে?এটাকে কি হাসপাতাল বলে?চারদিকে নোংরা, গন্ধ।
এখানে রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে তো আরও অসুস্থ হয়ে পরবে।
নোমানের সমস্ত রাগ গিয়ে পরলো তার ওপর,যে তার বাবাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে।
কর্মচারী ছেলেটার কাছে শুনেছে তার বাবাকে একটা মেয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।
সেই মেয়েটার কি কমনসেন্স বলতে কোন জিনিস নেই?
বিখ্যাত বিজনেস ম্যান নোমান খানের বাবা আরমান খানকে এই রকম একটা হাসপাতালে কি মনে করে ভর্তি করিয়েছে সে?
ভাল কোন হাসপাতাল কি ছিলো না?
,
নোমান রিসিপশনে গিয়ে আরমান খানের কেবিন নাম্বার শোনে।
মুখে রুমাল চেপে বাবার কেবিনে এগোয়।
আশেপাশের সুস্থ-অসুস্থ,নার্স,ডাক্তার সব লোক হা করে দেখে।নোমান খানকে কে না চেনে।এতো অল্প বয়সে নিজেই নিজের বিজনেসকে দেশের প্রথম কাতারে নিয়ে যাওয়া চাট্টি খানিক কথা তো নয়।
কিন্তু সেই নোমান খান এখানে?এই হাসপাতালে?কেনো?
,
,
কেবিলের দরজার সামনে দাড়িয়ে নোমান তার বাবাকে দেখে।মাথায়,হাতে পায়ে ব্যন্ডেজের চিহ্ন দেখে বুকটা মুচড়ে ওঠে তার।ভেতরের কষ্টগুলো চিনচিন করে ওঠে।যতই বাবা তার মাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে অন্য মহিলাকে বিয়ে করুক,মায়ের মৃত্যুতে তাকে দেখতে না যাক।যতই তার রাগ থাকুক বাবার ওপর।
তবুও বাবা তো!
বাবার এই অবস্থা দেখে ছেলে হয়ে কষ্ট পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
,
,
নোমান ধীর পায়ে এগোয় আরমান খানের দিকে।
বেডের পাশের চেয়ার টেনে বসতে যায়,আবারও কপাল কুঁচকে আসে তার।এটা কি চেয়ার?কি নোংরা।
ইতস্তত করে আবার বসে।বাবার জন্য এটুকু করতেই হবে তাকে।
চেয়ার টানার শব্দে আরমান খান চোখের ওপর থেকে হাত সরান।নোমানের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।
,
নোমান হতভম্ব হয়ে যায়,এতোটা বছরে জিবনে সে তার বাবাকে কাঁদতে দেখেনি,উহু কখনোই দেখেনি।
আরমান খান নোমানের দুহাত নিজের মুঠোয় বন্দি করেন।
বলেন,
—আমার পাপের জন্য আমায় ক্ষমা করা যায়না নোমান?আমি আর এ বোঝা বয়ে বেড়াতে পারছিনা।নিজের ছেলের চোখে দোষী হয়ে থাকতে পারছিনা আমি।
নোমান কি বলবে খুজে পায়না।বললেই কি ক্ষমা করা যায়?এতোটাই কি সহজ?
আরমান খান আবার বলেন,
—এক্সিডেন্ট এর মুহুর্তে আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। তখন মাথায় একটা কথাই ঘুরছিলো আমি আমার ছেলেটার মনের একরাশ ঘৃনা নিয়েই পৃথিবী ছারবো?
,
নোমান কথা ঘোরানোর জন্য বললো,
—বাদ দাও এসব বাবা,আগে বলো তোমার শরীর এখন কেমন?
আরমান খান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
—কথা ঘুরাচ্ছো নোমান?
ক্ষমা করা যায়না না?সত্যিই তো আমি হলে কি ক্ষমা করতে পারতাম?
তবে একটা কথা কি জানো নোমান,প্রত্যেকটা কাজের পেছনে একটা কারন থাকে সেটা ভাল হোক বা খারাপ।
নোমান কথা বলে না।ফোন বের করে কাউকে কল করে।অন্য হাসপাতালে বাবার এডমিডের ব্যবস্থা করে।
বলে,
—এসব পুরোনো কথা থাক বাবা।তুমি চলো আমার সাথে।অন্য হাসপাতালে তোমার চিকিৎসা হবে।
—কেনো এখানে খারাপ কি?
—এখানে খারাপ কি বলছো বাবা?এখানে?এখানে ভালো কি সেটা তো দেখাও।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে যেতেই আরমান খান আবার নোমানের হাত ধরে।নোমান বলে,
—কিছু বলবে?
—আমার একটা কথা রাখবে নোমান?
—বলো।
—না না বলো রাখবে কথাটা।আমি বাবা হিসেবে তোমার কাছে এইটুকু চাইছি।আর কোনদিনও তোমার কাছে কিছু চাইবো না,কোন বিষয়ে জোর করবো না।
শুধু এই কথাটা তোমায় রাখতে হবে।
রাখবে?
নোমানের খারাপ লাগে।
বাবাদের এমনভাবে আকুতি মিনতি করা মানায় না।বাবাদের করতে হয় আদেশ।
সে বলে,
—আচ্ছা রাখবো।
আরমান খান উচ্ছাসিত গলায় বলেন,
—সত্যি?
—হুমমম।এবার বলো কথাটা।
আরমান খান পাশের সেন্টার টেবিল থেকে গ্লাস তুলে পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেন।
বলেন,
—বিয়ে করে সংসারি হও নোমান।
নোমান বোঝার ভঙ্গিতে মাথা দুলায়।বাবা যে এরকম কিছু বলবে সে বুঝেছিলো।
—তোমার কথা রাখতে বিয়ে করতে পারি বাবা,তবে সংসারি হতে পারবো কিনা বলতে পারছিনা।
আরমান খান বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে ওঠেন।
নোমান তাকে সামলায়।বাবার ব্যবহার তার কাছে অদ্ভুত লাগে।
বৃদ্ধ হলে যে মানুষ বাচ্চা হয়ে যায় সেটা সে বোঝে।
,
,
,
চলবে……