বসন্ত এসে গেছে পর্ব ৬

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ৬
,

,

শুক্রবারের দিনটা অপুর জন্য ব্যস্ততম একটা দিন।অন্যসব দিনে বাড়ির কাজ,ভার্সিটি, টিউশনি করতে করতে অন্যসব কাজ করার সময় পায়না।কিন্তু শুক্রবার আসলেই একসপ্তাহের পুরো কাজ একসাথে করে অপু।
মায়ের ঘরদোর পরিষ্কার করে,জামা কাপড়,বিছানার চাদর সব একসাথে ধুয়ে দেয়।মাকে শ্যাম্পু করিয়ে গোছলও করায় অপু।

,
সকাল সকাল উঠে কাজে লেগে পরে অপু।
মাকে তুলে বারান্দায় নিয়ে হাতল ওয়ালা একটা চেয়ারে বসায়।গায়ে মিষ্টি বাতাসের ছোয়া লাগে।শরীর মন দু’টোই ফুরফুরে হয়।
মাকে রেখে ঘরে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে।
মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কোলে মাথা রাখে।
আলেয়া বেগম চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিলেন।
কোলে কারও স্পর্শ পেয়ে সেদিকে তাকান।মুচকি হেসে অপুর মাথায় হাত বোলান।
বলেন,

—কিরে অপু?কি হয়েছে আমার মা টার?

—কিছুনা মা।

—কিছুই না?

—উঁহু। একটা কথা ভাবছি জানো মা।

—কি কথা?

—আমাদের সাথে যদি অলৌকিক কিছু ঘটতো,মানে যদি অলৌকিক ভাবে অনেক টাকা পেতাম তাহলে আমাদের সব দুঃখ ঘুচে যেতো তাইনা মা?তোমার চিকিৎসা করাতাম,আমরা দুজন আলাদা একটা বাড়ি বানাতাম।
খুব বেশি না,একটা টিনের ছোট্ট বাড়ি হলেই চলতো।
আর দুবেলা দুমুঠো ভাত।এই হলেই আমাদের দুজনের দিন চলে যেতো বলো মা?

আলেয়া বেগম মেয়ের মুখে এমন বাচ্চামো কথা শুনে হাসেন।বলেন,

—তুই বলছিস টাকা হলেই আমাদের সব দুঃখ ঘুচে যেতো? টাকা থাকলেই সুখ আসে?

অপু বললো,

—হ্যা তো।টাকা থাকলে তো আমাদের এতো কষ্ট করা লাগতো না।

—আমি মানছি জিবনে টাকার দরকার আছে কিন্তু টাকা থাকলেই সুখ পাওয়া যায়না।

অপু মাথা তুলে তাকালো।আলেয়া বেগম বললেন,

—যেমন ধর কারো কারো প্রচুর টাকা আছে, তারা বড় বড় উচু অট্টালিকায় থাকে,দুহাতে অজস্র টাকা উড়ায় কিন্তু তার মনে কোন কারনে শান্তি নেই,সে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা,খেতে পারেনা।এতো এতো টাকা তার কোন কাজে আসলোনা।
তাহলে কি সে সুখি?
আবার ধর কেউ রিকশা চালায়।দিন আনে দিন খায়,তার ভেতরে কোন চিন্তা নেই,ভাবনা নেই।মনে তার শান্তি।
বাড়িতে বউ বাচ্চা নিয়ে খুশিতে থাকে।যেটুকু আয় করে সেটুকুতেই সন্তুষ্ট।
তাহলে বল তো সে কি সুখি না?

অপু ঘার নাড়ে।বলে,
—তাহলে মনে শান্তি থাকলেই সে সুখি মা?

—অবশ্যই।
প্রত্যেকেই
নিজের নিজের অবস্থানে সুখি আছে।

—সেটা কেমন?

—মনে কর যে রাস্তায় ভিক্ষা করে,অনাথ ছেলে,বাবা মা নেই,ঘর বাড়ি নেই,ঠিকমতো একবেলাও খাবার পায়না।
তার থেকে কি তুই সুখি না?

—হ্যা।

—তাহলে?

অপু উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।বলে

—তুমি কতো কিছু জানো মা।

অপু আরও কিছু বলতে যায় তার আগেই অপুর ভাবি হাসি হাসি মুখ করে বলে,

—এখানে কি করছো অপু?তোমার ভাইয়া তোমায় কখন থেকে ডাকছে?যাও দেখা করে এসো।

,

,

অপু অবাক হয়।জিবনে কোনদিন ভাবি তার সাথে এতো ভালোভাবে কথা বলেছে কিনা অপুর মনে পরেনা।
চোখ পিটপিট করে তাকায় ভাবির দিকে।আবার মায়ের দিকে তাকায়।
আলেয়া বেগম চোখে ইশারা করে যাওয়ার জন্য।অপু সেদিকে দেখে হেটে ভাইয়ের রুমে এগোয়।
,

,

,

,

অনিকের রুমে ঢুকে একপাশে দাড়ায়,অপু।কতোদিন হলো এ ঘরে আসা হয়না তার।আগেতো প্রায়ই ভাইয়ের জন্য এটাওটা নিয়ে আসতো,রুম গুছিয়ে দিতো।সকালে চা হাতে ভাইয়ের ঘুম ভাঙাতো।
সকালে অপুর হাতের চা আর তার মিষ্টি মুখ না দেখলে নাকি অনিকের দিন ভালো যেতো না।কতো খুনশুটি করতো দু’জনে।
কিন্তু এখন?
সময় বদলেছে,সেই সাথে বদলেছে আপন মানুষগুলোও।

অনিক অপুকে দেখে বলে,

—কি অপু,ওতো দুরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?আয়,আমার পাশে এসে বস।

অপু এগিয়ে আসে।অনিক বিছানার পাশে বসার জন্য জায়গা করে দেয়।মুখে মিষ্টি হাসি তার।
অপু অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে।আজ ভাইকে আগের মতো লাগছে,আগের মতো কথা বলছে ভাই তার সাথে।
ইদানীং তো ভাইয়ের সাথে কথাই হয়না।

অনিক বলে,

—ওভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখিস বোন?

অপু অবাক কন্ঠে বলে,

—এটা কি তুই ভাই?সত্যি তুই?

অনিক হাসে।অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

—সত্যি আমি রে বোন।
আসলে আমি অনেক ভাবলাম বুঝলি,অনেক ভাবলাম।
দেখলাম আমি তোদের সাথে অন্যায় করে ফেলছি।মায়ের এতো বড় অসুখ আর আমি কিনা নিষ্ঠুরের মতো টাকার জন্য মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছি না?মায়ের থেকে কি আমার টাকা বড় বল?টাকা তো অনেক কামাই করতে পারবো,কিন্তু মা গেলে আর মা কোথায় পাবো?
তাছাড়া তোর পড়াশোনার ব্যাপারেও আমি তোকে সাহায্য করিনি।খুব খারাপ কাজ করেছি আমি,খুবই খারাপ কাজ করেছি।

—তুই তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস?

অনিক এবার কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,

—হ্যা রে।আমি বুঝতে পেরেছি আমি কতো বড় ভুল করেছি।তাইতো ভুলগুলো শুধরাতে চাই।মায়ের এ মাসের ভেতর আমি হার্টের অপারেশন করাবো দেখিস তুই।

অপুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
তার ভাই ভুল বুঝতে পেরেছে?আবার আগের মতো হয়ে যাবে সে?মায়ের অপারেশন করাবে?মা ও সুস্থ হয়ে যাবে।অপুর জিবনে আবার শান্তি আসবে?

দুহাত দিয়ে অনিকের হাত আকড়ে ধরে অপু।বলে,

—সত্যি মায়ের অপারেশন করাবি ভাই?সত্যি?

খুশিতে কথাগুলো জড়িয়ে আসে অপুর।

অনিক বলে,

—হুমমম করাবো তো।মায়ের অপারেশন করাবো,তোর বিয়ে দেবো।
খুব ভালো ঘরে তোর বিয়ে দেবো।

—আমার বিয়ের কথা পরে ভাবিস।তাছাড়া এখন আমি পড়াশোনা করছিতো।আগে মায়ের অপারেশন করা।

অনিক অপুর হাত ছাড়িয়ে নেয়।বলে,
—তোর বিয়ে না দিলে মায়ের অপারেশন হবে কি করে?

অপু অবাক হয়।
—আমার বিয়ের সাথে মায়ের অপারেশনের কি সম্পর্ক ভাই?

—আরে তোর বিয়ে দিলেই তো তোর শশুড় আমাদের অনেক টাকা দেবে।সেই টাকা দিয়েই তো মায়ের অপারেশন হবে।সাথে আমরাও কিছু পাবো আর কি?

—মানে?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।

অনিক এবার ধৈর্যহারা হয়।এতো মানে মানে করে মেয়েটা,মেজাজ ঠিক করে আবার বলে,

—এতোকিছু তোকে বুঝতে হবেনা।শুধু জেনে রাখ সামনের শুক্রবার তোর বিয়ে।

—বিয়ের তারিখও ঠিক করে ফেলেছিস?

—তো কি করবো?যতো তাড়াতাড়ি বিয়েটা হবে ততো তাড়াতাড়ি টাকাগুলো পাবো,না মানে ততো তাড়াতাড়ি মায়ের অপারেশন হবে।
তুই কি চাস না মায়ের অপারেশন হোক?

অপু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে।
এতোক্ষণে ভাই ভাবির এতো ভালো ব্যবহারের কারন বোঝে।
মাথাটা ভনভন করে।তার ভাই,আপন ভাই টাকার জন্য বোনকে খোজখবর না নিয়ে যারতার সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে?
এটা কি সত্যি অপুর ভাই?
তারমানে ভাইয়ের এতোক্ষণের ব্যবহার,কথা সব নাটক ছিলো?
অপুর মাথা কাজ করেনা।ভাবে সে কি বিয়েটা করবে?এভাবে কি বিয়ে হয়?কিন্তু মা?মায়ের অপারেশনটা যে হবে তাহলে।
মাকে বাঁচানোর জন্য এটুকু কি অপু করতে পারেনা?

অনিক ধাক্কায়।বলে,

—কিরে কি এতো ভাবছিস?এতো তো মা মা করিস আর এখন আসল জায়গায় এসে চুপ মেরে গেলি?মায়ের অপারেশন হোক তুই চাস না?

অপু ঘোর লাগা গলায় বলে,

—-চাই।

—তাহলে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দেই?

—হুম।

,

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here