বসন্ত এসে গেছে পর্ব ৭

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ৭

,

,

,
চারপাশে হইচই,চিৎকার, চেচামেচি কোলাহল।
অনেক মানুষের আনাগোনায় মুখরিত চারিদিক।মানুষে গিজগিজ করছে অপুদের বাড়ি।বাচ্চারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।
উৎসব উৎসব আমেজ সবখানে।
সবার মুখে হাসি ফুটে আছে।হাস্যোজ্জল পরিবেশে মধ্যমনি হয়ে বসে থেকেও বিন্দুমাত্র আনন্দ ছুতে পারছেনা অপুকে।ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে সে।মনে বয়ে চলেছে অজানা ভয়ের স্রোতধারা।
কি হতে চলেছে তার জিবনে?জিবন নামক এ নদী কোন দিকে মোড় নেবে এবার?অপু কি সেখানে ভালো থাকবে?

অপু মাথা চেপে ধরে।অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা ব্যথা করছে তার।তারউপর এতো চিৎকার চেচামেচি। কিচ্ছু সহ্য হচ্ছে না অপুর।মনে হচ্ছে একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,

আমি এ বিয়ে করবোনা,করবোনা আমি এমন বিয়ে।

কিন্তু বলতে পারেনা অপু।মায়ের হার্টের অপারেশনটা না করালে মা বাঁচবে না।ভাই কোনদিনও নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মায়ের অপারেশন করাবেনা।অপুরও আয়ের এমন কোন উৎস নেই যা দিয়ে অপারেশনের টাকা জোগাড় করা যায়।
অপুর কাছে মাকে বাঁচানোর জন্য বিয়েটা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এরকম ত্যাগ সে করতেই পারে।

কিছু মেয়েরা দৌড়ে রুমে ঢোকে।খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে,

—অপুরে তুইতো লটারি জিতেছিস রে লটারি।তোর জামাই তো পুরো রাজপুত্র রে।

কথাটা বলেই আবার হাসিতে মেতে ওঠে তারা।
রাজপুত্র কথাটা মাথায় বারবার ঘোরে অপুর।
রাজপুত্র? যে কিনা রাক্ষসদের হাত থেকে যুদ্ধ করে রাজকন্যা কে উদ্ধার করে?রাজকন্যার সকল বিপদে ঢাল হয়ে যে সামনে দাড়ায়?
অপুর বরও কি সেরকম হবে?অপুর বিপদে আপদে তার পাশে ভরসার হাত হবে?নাকি শুধু দেখতেই রাজপুত্রর মতো?

অহেতুক চিন্তাগুলো অপু মাথা থেকে ঝেরে ফেলে।তার কিচ্ছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা এই মুহুর্তে। মাথাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

একটু পরেই কাজি আসে ঘরে।
একটা কাগজ এগিয়ে দেয় সই করার জন্য।
অপুর হাত কাপে।এই মুহুর্তে তার মাকে পাশে দরকার।
কিন্তু মা তার ঘরে ঘুমিয়ে আছে।অপুর এরকম ভাবে বিয়ের কথা শুনে মা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো তাই ভাই ভাবি তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
অপু চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড দম নেয়।জোরে জোরে শ্বাস ফেলে।মায়ের মুখ মনে করে।মায়ের সুস্থ হওয়ার কথা ভাবে।
নিজেই নিজেকে সাহস দেয়।
এদিকে অনিক তাড়া দেয়,

—কিরে সই কর।এতোক্ষণ সময় নিলে হয় নাকি?

অপু চোখ মেলে তাকায়,গটগট করে সই করে দেয়

অপুকে কাবিননামার কাগজ পড়ে শোনায় কাজি।কবুল বলতে বলে।
অপু এবার আর সময় নেয়না।
বলে ওঠে,

—কবুল,কবুল,কবুল।

অনিকের মুখে দেখা যায় লম্বা হাসির রেখা।চোখ চকচক করে লোভে।অন্যদিকে বোনের চোখে যে অশ্রুর ধারা নামে সেদিকে তার কোন হুশ নেই।

,

,

বিদায় বেলাতেও অপু মায়ের সাক্ষাৎ পায়না।গাড়িতে উঠার সময় এদিক ওদিক বারবার তাকায়।কোন আপনজনের অপেক্ষা করে।কিন্তু কেউ আসেনা।অচেনা এতো মানুষের ভিড়ে চেনা মুখগুলো খুজে পায়না।
আশেপাশে গুঞ্জন শোনে,

—জামাই কি বিয়েতে রাজি না নাকি?দেখলি না কেমন গম্ভীর মুখ করে বসে ছিলো পুরোটা সময়।

আরেকজন বলে,

—হ্যা দেখেছিতো,তাছাড়া কবুল বলার পর পরই কেমন বেরিয়ে গেলো।বিয়ে করা বউকে একনজর দেখলো না পর্যন্ত।

—সত্যি তো।

অপুর বিষাদময় হ্রদয় আরো বিষাদে পরিনত হয়।চোখ বেয়ে টপাটপ জল পরে।ভবিষ্যতে কি হবে কথাটা ভাবতেই শিউরে ওঠে।
এমনসময় আরমান খান এগিয়ে আসেন।
অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের জল মুছে দেন।
চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করেন।
সে চোখে অপু ভরসা খুজে পায়।মনে হয় এইতো এখানে একজন আছে আমার আপনজন।
আছে একটা ভরসার হাত।
একটু পাশে তাকিয়ে ভাইকে নজরে পরে। দৌড়ে ভাইয়ের কাছে যায় অপু।
অনিক তখন একজন লোকের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছিলো।
অপুকে আসতে দেখে বিরক্ততে কপাল কুঁচকায়।
বলে,

—এখনো যাসনি?

এমন সময় এমন কথা শুনে অপু থমকে যায়।এতো এতো কথা বলার ছিলো ভাইকে তার।বুকে মাথা রেখে কাঁদা বাকি ছিলো তার।কিন্তু ভাইয়ের রুক্ষ, বিরক্তিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে সবকথা যেনো হারিয়ে গেলো অপুর।
মুখে শুধু বললো,

—মাকে দেখে রাখিস।

কথাটা বলেই একমুহূর্ত দাড়ালো না অপু।ছুটে এসে গাড়িতে উঠে বসলো।
ভাইয়ের বদলে যাওয়া নিষ্ঠুর রুপ আর দেখতে চায়না অপু।আর না।
দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।

,

,

,
——————-

,

,

আলিসান এক রুমে বসে আছে অপু।এতোবড় রুম,এতো দামী আসবাবপত্র জিবনে দেখেনি অপু।
খাটটাও সাজানো হয়েছে পুরো গোলাপ দিয়ে।যেনো দেশের সব গোলাপ এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
অপু এতোক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছিলো এসব,এখন মুলত তার ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।
রিতীমত ঘুমে ঢুলছে সে।বেশ কিছুদিন ধরে টেনশনে ঘুমাতে পারেনা অপু।আজ আবার বিয়ে বাড়িতে প্রচুর ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে।
সেই সব ক্লান্তি যেন একসাথে ভর করেছে আজ তার ওপর।

ঘড়ির কাটা এখন তিনটার ঘরে আটকে আছে।
অপু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে স্মীত হাসলো।
সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছে ছেলে এ বিয়েতে রাজি ছিলোনা।রাজি থাকলেও অপুকে কখনো মেনে নেবেনা।
মেনে নেবেই বা কিভাবে? কোথায় নামীদামী বড়লোক বাবার ছেলে,আর কোথায় অপু।
এভাবে কি মেনে নেওয়া যায়?
তাছাড়া লোকমুখে শুনেছে ছেলে নাকি রাজপুত্রের মতো দেখতে,আর অপু?সে সাধারন একটা মেয়ে।সাভাবিক দেখতে তাকে,সচরাচর যেমনটা দেখা যায় তেমন।আহামরি সুন্দরী তো নয়।
তাহলে?
কেন মেনে নেবে ছেলেটা?
অপুর কান্না পায় আবার পরক্ষনে নিজেই নিজের প্রতি অবাক হয়।
সে কাঁদছে কেনো?
কোনকিছু না পাওয়ার কষ্টে মানুষ কাঁদে? কিন্তু অপুর কান্না পাচ্ছে কেনো?সে কি পায়নি?
সুখ?
সুখের আশা কি করেছিলো সে?অপু তো জানতো এভাবে টাকা দিয়ে কিনে আনা মেয়েকে এতো বড়লোক ছেলে মেনে নেবেনা বা সংসার করবেনা।তাহলে?

নিজের ভাবনা চিন্তাকে জলাঞ্জলী দিয়ে উঠে দাড়ায় সে।মৃদু আলোয় চোখ ছোটছোট করে দেখে সাবধানে পা ফেলে হাটে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়।গলার কানের গহনার ধারগুলো গায়ে লেগে কুটকুট করছে।
অপুর অসস্থি হচ্ছে।
সে একে একে সব গহনা খুলে ড্রয়ারে তুলে রাখে।

তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।
তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে।
এই মুহুর্তে বিয়ের এই ভারী শাড়িটা বদলাতে পারলে ভাল হতো খুব।
খুবই জাঁকজমক এই শাড়িটা।
শাড়ি পরার অভ্যাস থাকলেও এতো ভারী শাড়ি পরার অভ্যাস অপুর নেই।
কিন্তু শাড়িটা বদলালে অপু কি পরবে সেটাই তো জানেনা।
বাড়ি থেকে কেউ তার সাথে জামাকাপড় দিয়ে দেয়নি।অপুও এতো টেনশনের মাঝে এসব নিয়ে ভাবেনি।কিন্তু এখন পরেছে সে মহাযন্ত্রনায়।বিয়ের পরদিন সকালেই কার কাছে বলবে যে আমার জামা এনে দাও?

অপুর এতো ভাবনার মাঝে দরজায় খট করে শব্দ হয়।অপু ফিরে তাকায়।
ঘরে ড্রিম লাইটের হালকা আলো জ্বলছে।
সামনে থাকা মানুষটার চেহারা দেখা সম্ভব হয়না।চোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা চালায় অপু কিন্তু লোকটা সে সুযোগ দেয়না।গটগট করে এসে কাবার্ড খুলে টাউজার টিশার্ট নেয়।ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগায়।
এতো জোরে শব্দে অপু দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে।
মিনিটখানেক যেতে না যেতে নোমান বেরিয়ে পরে।
অপু বিরবির করে,
—কি ফাস্ট রে বাবা।

অপুকে পাশ কাটিয়ে খাটে ধপ করে শুয়ে পরে নোমান।
অপু হা করে দাড়িয়ে থাকে।
নিজের দিকে একবার তাকায়,ভাবে সে কি অদৃশ্য হয়ে গেলো নাকি?
নাহ হয়নি তো?তাহলে?
লোকটা এমন ভাব করলো যেনো অপু এ রুমে নেই।তাকে দেখা যায়নি।
আরে মেনে না নিলি তবুও সৌজন্যমূলক কিছু তো বলতে পারতো।
অপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের কাছে এগোয়,তারও ঘুম পাচ্ছে।
খাটে বসার আগেই নিচে কিছু একটা পরে।অপু সেদিকে তাকায়,দেখে একটা বালিশ।
বালিশ কুড়িয়ে নিয়ে আবার খাটের কাছে আসে অপু।

নোমান বলে ওঠে,

—খাটে আমার সাথে একই বিছানায় শোয়ার স্পর্ধাও করোনা।
বালিশটা নিয়ে বিদেয় হও।

অপু অবাক হয়না।এরকম কিছু সে অনেক আগেই ভেবেছিলো।
বালিশ নিয়ে সোফায় যায়।
গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরে।ঘুমে চোখ লেগে আসে তার।

,

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here