#বাসন্তীগন্ধা
| পর্ব ০৫ |
লাবিবা ওয়াহিদ
–“সামিরা আপু মোটেও পড়াশোনায় এত মনোযোগী না। আমি জানি, আপুকে বিয়ে দিবেন বলেই আপুকে জোর করেন না৷ আপুকে ধমক দেন না। আব্বুকে বলবো আমাকেও যেন বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে আপনিও আমায় আর কথায় কথায় বকবেন না!”
———
সারিম হঠাৎ থেমে যায় মেহেরের এরূপ কথায়। সারিমকে দেখে মেহেরও থেমে মাথা উঁচু করে তাকায়। সারিম ঘাড় বাঁকিয়ে মেহেরের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। মেহেরের মস্তিষ্কে হঠাৎ-ই তরঙ্গিত হলো সোহার বলা কথাগুলো। পিটপিট নজরে চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। খুব খুঁটে খুঁটে পর্যবেক্ষণ করলো সারিমের মুখমন্ডল। আচ্ছা সোহা যা বলছে তা কী আদৌ সম্ভব? পরমুহূর্তে নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে নজর ঘুরিয়ে ফেললো মেহের। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সারিমের দিকে আবার তাকাতেই মেহেরের ভেতরটা কেঁপে উঠলো৷ সারিমের চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়েছে, মেহের তো সেভাবে খেয়াল-ই করেনি। মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“ওভাবে দেখছেন কেন?”
সারিম ভ্রু কুচকে গলার স্বর পালটে বললো,
–“বিয়ের খুব সখ?”
ভয়ে জর্জরিত মেহের এক সিঁড়ি নিচে নেমে গেলো। মেহেরকে ওভাবে পেছাতে দেখে সারিম আবার বললো,
–“নিচে নামছিস কেন? আমার কাছে আয়!”
মেহের ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে,
–“আ..আমার বিয়ের কোনো সখ নেই!”
–“তাই? আচ্ছা যা, বুঝলাম! আয় আমার সাথে।”
বলেই সারিম ধুপধাপ পা ফেলে উপরে চলে গেলো। মেহের প্রথমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পরমুহূর্তে মাথায় এলো, শেষ কথাতেও সারিমের মুখের রঙ একই দেখা গিয়েছিলো। এর মানে কী বিপদ এখনো চৌকাঠে? মেহের ভয়ে ভয়ে পা ফেলে উপরে গেলো। কী হচ্ছে আজ?
মেহেরের ভয় সত্যি হলো। সারিম তাকে পানি*মেন্ট দিলো। পানি*মেন্ট হলো দুইশোবার লিখতে হবে,
“আমি বিয়ে করতে চাই না।”
এরকম পানি*মেন্ট পেয়ে মেহেরের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। পরীক্ষা ব্যতীত মেহের একদমই লিখতে চায় না। সেখানে অযৌক্তিক লেখা তাকে লিখতে হবে? মেহের বাধ্য হয়ে নিজের সব দুঃখ বুকে চেপে লিখছে। সারিম একটা ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বললো,
–“আজ শুনেছি মাহিমের সাথে বাইক রাইড দিতে গিয়ে তোর মাথা ঘুরিয়েছে, বমি-টমি করেছিস, তাই দুইশো লিখতে দিলাম। কিন্তু নেক্সট টাইম এক ভুল করলে কানে ধরিয়ে ছবি তুলবো তোর। খুব বিয়ের সখ না, ফাঁকিবাজির বুদ্ধি। আমি বেঁচে থাকতে তুই বিয়ে কী করে করিস আমিও তা দেখে ছাড়বো!”
–“তাহলে কী আমি কোনোদিনও বিয়ে করবো না?”
মনে মনেই আওড়ালো মেহের। সামান্য বিয়ের কথা বলায় এত রাগ কেন করলো সারিম? কী সমস্যা তাঁর? সবই মাথার উপর দিয়ে গেলো মেহেরের।
মাহিম নিজের রুমে বইয়ের পৃষ্ঠা উলটে – পালটে দেখছে এবং কিছুক্ষণ পরপর মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে৷ মোবাইলটা সুইচড অফ করে রেখেছে সে। আজকে গালে যা চড় পরেছে, কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাগে, ক্ষো* ভে সবই বিষাদ লাগছে মাহিমের। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনে পিছে ফিরে তাকালো মাহিম। মেহের এসেছে। হাতে তোয়ালে জড়ানো কিছু একটা। মেহেরকে দেখে মাহিম রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,
–“এই রাতে আমার রুমে তোর কী?”
মেহের হাই তুলতে তুলতে বললো,
–“তোমার গালটার খোঁজ নিতে এসেছি!”
–“কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া হলে আসতে পারিস!”
–“ফ্যাচফ্যাচ না করে বিছানায় আসো!”
মাহিম শুনলো না। মেহের পেছন থেকে মাহিমের কলার ধরে টেনে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। ওড়না দিয়ে মেহেরের গাল ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
–“ফাউন্ডেশন মা*লে দাগ যাবে কিন্তু ব্যথা সারবে না!”
–“তোর এত দরদের আমার দরকার নেই। বিদায় হ!”
মেহের শুনলো না মাহিমের কথা। তোয়ালে জড়ানো বরফের বোতলটা মাহিমের গালে লাগিয়ে রাখলো। মাহিম নড়াচড়া করলে মেহের উঁচু গলায় বলে,
–“চুপ করে বসে থাকো। নয়তো বরফের জায়গায় আম্মুর ব্যবহৃত গরম খুন্তি এনে গালে লাগিয়ে দিবো!”
–“সাহস বেড়েছে?”
–“খুব। কেন, তুমি জানো না?”
মাহিম আর কিছু বললো না। মেহের মাহিমের গালে হালকা করে ধরে রেখেছে বোতলটা। আহারে বেচারা মাহিম, এখন যদি এই মেয়েবাজি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে পারে।
মাহিম কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
–“হঠাৎ আমার উপর দরদ দেখাতে আসলি যে?”
মেহের ত্যাড়া গলায় বললো,
–“দরদটা লিমিট ক্রস করে গিয়েছে তো!”
মাহিম মেহেরের দিকে ফিরতে নিলে মেহের মাহিমের গলায় চিমটি কেটে দিলো। মাহিম পালটা মেহেরের চুল টেনে দিলো। ভাই-বোনের কার্যকলাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে দেখে গেলো সারিম। কিছু মুহূর্ত পর নৈঃশব্দে হাসলো। ভাই-বোনের ভালোবাসাই আলাদা। কখনো কারো জন্যে মুখে প্রকাশ পায় না।
—————-
–“মেরু~~, কাল ওভাবে পালালি কেন?”
সোহার এরূপ ব্যঙ্গতে মেহের সোহার থেকে দূরে সরে হাঁটতে লাগলো। সোহা হেসে মেহেরের কাছে এসে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–“সত্যি বলছি মেরু, কাজিন লাভ গুলো খুব সুন্দর হয়। সুন্দর না হলে কী আগে পারিবারিক বিয়ে হতো? বেশিরভাগ পরিবারেই পারিবারিক বিয়ে হয়। এক বাসায় বাবা-মায়ের সাথে মিলেমিশে থাকবি। কী মজা।”
–“সোহা প্লিজ। ভালো লাগছে না।”
–“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? ইতিহাস ঘেটে দেখ, উত্তর পেয়ে যাবি!”
মেহের অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতে শুরু করলো। সোহার কথাবার্তা তাঁর এক কান দিয়ে ঢুকছে আর আরেক কান দিয়ে বের হচ্ছে। ক্লাসে এসে মেহের জানতে পারলো তাদের সাথে এক সহপাঠীর এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে। সেই সহপাঠীর হাতের রিং দেখতে তাকে বেশ কিছু মেয়ে ঘিরে রেখেছে৷ তাদের আগ্রহ এঙ্গেজমেন্ট রিং এবং মেয়েটির লাভ স্টোরি শোনার। সোহাও তাদের মাঝে গিয়ে সামিল হলো। মেহের সেই সহপাঠীর পিছের বেঞ্চেই একা বসে আছে। সোহা আগ্রহী হয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এরেঞ্জ ম্যারেজ? আই মিন আগে কখনো দেখা হয়েছে?”
মেয়েটি চোখে-মুখে লজ্জা ফুটিয়ে বললো,
–“আমার মামাতো ভাই আমার উড বি!”
সোহা মারাত্মক খুশি হয়ে শুধায়,
–“ওয়াও! কাজিন লাভ! আমেইজিং ইয়ার!”
মেহের ফোনের মধ্যে ম্নজর স্থির রাখলেও তার কান খাড়া ছিলো। কাজিন লাভ শুনতেই তার ভেতরের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। গতকাল থেকে এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? সোহার কথায় কী ছিলো যা তাকে এত বেশি ভাবাচ্ছে? নাহ, সবকিছুই অযৌক্তিক। সারিম ভাইয়াকে নিয়ে বেশি ভাবাটা উচিত হচ্ছে না। সোহার কোনো কথায় তার কান দিলে চলবে না।
—————–
রোজা একমনে আহত রাতুলের দিকে শীতল নয়নে চেয়ে আছে। রাতুল মাথা নিচু করে বসে আছে। রাতুলের হাতে, মাথায় এবং পায়ে ব্যান্ডেজ। রাতুলের পাশে বসেই রোজার মা তাকে বাতাস করছে। এদিকে লোডশেডিং এর মাত্রা খুব বেশি। এমনিতেই গরম তার উপর ছেলেটার এই অবস্থা। রোজা ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বলে,
–“কী দরকার ছিলো বাজি ধরে খেলার? তোকে মানা করেছিলাম এসব বাজি টাজি না ধরতে। খেলতে যাবি ভালো কথা, তোর চাইতে বড়ো ছেলেগুলোর সাথে লাগতে যাস কেন তুই? কবে বুঝবি এসব করলে পরিণাম খারাপ বৈ ভালো হবে না!”
রাতুল মাথা নিচু করে বলে,
–“ভুল হয়ে গেছে বুবু। আর হবে না!”
–“বিছানায় লটকানোর পর মনে পরে ভুল হয়েছে নাকি ঠিক? আঠারো বছর বয়স হওয়ার পরেও বুদ্ধি নিয়ে চলতে পারিস না? তুই এভাবে বিছানায় পরে থাকলে মাকে আমি কার ভরসায় রেখে যাবো? তোর তো কলেজও আছে রাতুল!”
রোজার রাগা-রাগি থামাতে রোজার মা বলে ওঠে,
–“এত বকিস না তো। ওদের বয়স-ই তো খেলাধুলা এবং চোট পাবার। ছেলেটার ভুল হয়েছে, ক্ষমা করে দে!”
রোজা এবার মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
–“তোমাদের জন্যে তোমাদের ছেড়ে দূরে চাকরি করছি। তোমাদের ভরণপোষণ তুলছি, যাতে রাতুল এবং তোমার কোনো সমস্যা না হয়৷ প্রতি মুহূর্তে চিন্তা করছি রাতুলের এবং ওর ভবিষ্যতের। এমতাবস্থায় যদি ও হাত-পা ভেঙে বিছানায় পরে থাকে তখন আমার কেমন লাগতে পারে মা?”
রোজার এরূপ কথায় রোজার মা চুপসে গেলেন। মেয়েকে সামলানো সহজ না। বেশ রেগে আছে সে। রোজাও বুঝলো সে বেগতিক কথা-বার্তা বলে ফেলছে। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রোজা তাঁর ব্যাগ উঠিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। রোজার মা মেয়ের পিছু ডাকতে ডাকতে গেলো। কিন্তু রোজা ত্রি-সীমানার বাইরে চলে গেছে। রোজার মা তপ্ত-শ্বাস ফেলে ভেতরে আসলেন। রাতুল মায়ের মুখ দেখে বুঝে গেলো তার বোন চলে গেছে। রাতুল ভাঙা গলায় বললো,
–“বুবু খুব রেগে আছে আমার উপর?”
রোজার মা ম্লান হাসলেন। হেসে বললেন,
–“তোর বুবুকে তো চিনিস বাবা। যখন তখন চটে যায় আবার সময় পেরুতে না পেরুতেই স্বাভাবিক। মনে দুঃখ নিস না। একদমই রেগে নেই রোজা!”
রাতুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমি আর এমন কিছুই করবো না যাতে বুবু কষ্ট পায়।”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।