#বাসন্তীগন্ধা
|২৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
মেহের হতভম্ভ সারিমের এই ধরণের কথা শুনে। উত্তরে সারিমকে কী বলবে তাও বোধগম্য হলো না। পিটপিট করে চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। সারিমের কপালে তখনো চিন্তার ভাঁজ। মেহের আমতা আমতা করে বললো,
–“সেরকম কিছু না ভা..”
বলতে গিয়ে মেহের দমে গেলো। আবারও ভুল করতে বসেছিলো সে। নিজেকে একবার বকে আবারও বললো,
–“দাদী পরিকল্পনা করে বিয়ে দিয়েছে। আপনি তো বিছানাতে এমনিতেই ঘুমিয়ে ছিলেন। আর আমি.. চেয়ারে বসে!”
মেহেরের গলা নেমে এলো। সারিম অবাক হলো মেহেরের কথা শুনে। এর মানে সবকিছুর পেছনের রোকসানার হাত? কিন্তু কেন? রোকসানার এরকম পরিকল্পনা করার কারণ কী? মেহের সারিমকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই সারিম মেহেরের হাত ধরে থামালো। এতে মেহেরের সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। সারিম খুব শীতল গলায় বললো,
–“এই বিয়েতে তুমি খুশি তো মেরু?”
“তুমি” সম্বোধন! এক জাদুর সম্বোধন লাগলো মেহেরের নিকট। ভেতরে মিশ্র অনুভূতির ভয়ংকর ঝড় চলতে লাগলো। সারিম যেখানে ছুঁয়েছে এই সেই হাতটুকু যেন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
–“মেরু? কিছু বলো?”
মেহের চারপাশে এলোমেলো নজর ফেলে কম্পনরত কন্ঠে বললো,
–“খুশি না হওয়ার কী আছে?”
–“এর মানে আমাকে নিয়ে অভিযোগ নেই?”,
মেহের ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। সারিম সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের হাত ছেড়ে দিলো। সুযোগ পেতেই মেহের ছুটে চলে গেলো রুমের দিকে। সারিম মেহেরের যাওয়ার পানে চেয়ে চাপা হাসি দিলো। মন বড্ড ফুরফুরে লাগছে তার।
মেহের রুমে এসে অসম্ভব কাঁপছে। বিছানার চাদর মুঠ করে চুপচাপ বসে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। ভালো লাগাময় মুহূর্ত। কিন্তু এত লজ্জা কেন লাগছে? কেন মাটির সাথে মিশে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে? আশ্চর্য!
মেহের ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। বালিশে মুখ গুঁজতেই চেনা এক ঘ্রাণ পেলো। এটা সারিমের পারফিউমের ঘ্রাণ। গা শিউরে ওঠে মেহেরের। এপাশেই তো গতকাল সারিম শুয়েছিলো। মেহের সারিমকে নিয়ে চিন্তায় বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। রাতে সেরকম ঘুমোতে পারেনি বোধহয়।
রোজা শুনে হতবাক সারিম এবং মেহেরের বিয়ের কথা শুনে। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়েছিলো অবশ্য। তবে নিচে এসে যা শুনলো, অবাক হবারই কথা। রোজা সাইয়ানের পাশে বসলো। সাইয়ান নাস্তা করতে করতে খুবই নরম গলায় বললো,
–“কিছু বলবে?”
–“আপনার ভাইয়ের বিয়ে মেহেরের সাথে..?”
সাইয়ান হেসে বলে,
–“হওয়ারই ছিলো। মন বলতো একদিন এই দুটো এক হবে। দেখো, মন মিথ্যে বলেনি। মন বলেছিলো তোমাকে একদিন ভালোবেসে ফেলবো। সেটাও মন মিথ্যে বলেনি!”
বলেই অন্যরকম চাহনিতে রোজার দিকে চাইলো। সাইয়ানের ওই নজরে খু’n হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা রোজার। লজ্জায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললো। এতে সাইয়ান স্মিত হাসলো।
সকলে হৈ-হুল্লোড় করছে সারিম এবং মেহেরকে নিয়ে। বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে সেহেতু লাঞ্চে স্পেশাল ডিশ খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। আইঁয়ুব সাহেব মেহের এবং সারিমের জন্য বিয়ের লেহেঙ্গা এবং সেরওয়ানির অর্ডার করলো। মেহেরের বাবা ছুটেছে সেগুলো আনতে। যেহেতু সময় হাতে কম এজন্য প্রি-অর্ডার করে আরও ভালো কিছু কিনতে পারেনি। আইঁয়ুব সাহেব রোজা এবং জ্যুতিকে পাঠালো জুয়েলারি এবং মেহেরের জন্যে আরও কিছু কেনাকাটা করতে৷ সকলে মিলেমিশে কাজ করছে। যেহেতু বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেহেতু আজ হলুদ এবং আগামীকাল রিসিপশন হবে। সকলকে জানালো হবে হয়তো আজ বিকালের মধ্যেই। বাবুর্চি বাগানে রান্না করছে। সেগুলোর তত্ত্বাবধানে আছে সেই তিন চাচা। বাড়ীর মধ্যে এলাহি আয়োজন হচ্ছে তা মেহের জানেই না। সে তো বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে।
দুপুরে সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার কাজ শুরু করে দিলো। হলুদের জন্যে সকাল থেকেই বাগানে ডেকোরেশন হচ্ছে। বিকালের দিকে মেহেরকে হলুদ সবুজে তৈরি করতে শুরু করলো সামিরা সহ আরও দুজন। মেহেরের সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। আচ্ছা, সারিমও কী মেহেরের মতো অনুভব করছে? নাকি বিয়েটা সারিমের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তবে মেহেরের মনে হয় না এই বিয়ে সারিমের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে। সারিম যথেষ্ট ম্যাচিওর৷ দামড়া ছেলেকে ধরে বেঁধে বিয়ে দাওয়া সম্ভব নাকি? এছাড়া সারিম সকালে যেভাবে মেহেরকে খুশি হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলো সেখানে বোঝা যায় সারিম বিয়ে নিয়ে খুশি। তবে.. সারিম কী সেরকম অনুভব করে যেরকমটা মেহের করে? এই একুটা জায়গাতেই মেহের সব গুলিয়ে ফেলছে।
সাজানোর পর্ব শেষ হতেই হন্তদন্ত হয়ে মেহেরের রুমে প্রবেশ করলো সোহা। মেহের চমকালো সোহাকে দেখে। সোহা সাপের ন্যায় হিসহিসিয়ে বললো,
–“লানদ তোদের মতো স্বার্থপর বান্ধুবীর উপর, যারা বিয়ের মতো সেরা মুহূর্তেও বান্ধুবীকে ভুলে যায়। মাহিম না জানালে তো জানতেই পারতাম না তোর বিয়ে হয়ে আবার গায়ে হলুদও হচ্ছে।”
মেহের সত্যি-ই ভুলে গেছিলো সোহার কথা। সকাল থেকে এত চাপে খেয়ালে আসেনি। এজন্য কিছুটা অনুশোচনা বোধ অনুভব করলো। মুখ ভার করে বললো,
–“আমি সত্যি স্যরি সোহা। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হলো যে আমি নিজেই ঘোরের মধ্যে আছি। মাহিম এই প্রথম ভালো কিছু করলো তোকে জানিয়ে!”
সোহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
–“তা তো ভুলবাই। আমি তোমার কে? যাইহোক, এবারের মতো মাফ করে দিলাম। সামনে থেকে যেকোনো ফাংশন হলে আমাকে প্রথমে জানাবি। এখন আমার আম্মু-আব্বুকে রাজি করা তোর বাড়ি থাকতে। আমি সব অনুষ্ঠানে থাকতে চাই!”
মেহের হাসলো। হেসে বললো,
–“আমি এখনই মাকে বলছি তোর আম্মুকে কল দিতে!”
মেহেরের কথা শুনে সোহার মুখ চিকচিক করে উঠলো। খুব খুশি হলো সে।
নির্ধারিত সময়ের থেকে অল্প কিছুটা দেরীতে অনুষ্ঠান শুরু হলো। উচ্চশব্দে গান-বাজনা চলছে। সারিম এবং মেহের পাশাপাশি স্টেজে বসেছে। গুরুজন’রা একে একে এসে দুজনের গালে, হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এসব কিছু মেহের মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করছে। সবকিছু কল্পনা লাগছে তার। সবকিছু সুন্দর লাগছে। আরাম লাগছে। এত কান্না-কাটির ফলস্বরূপ বুঝি এত সুখ পাওয়ার কথা ছিলো তার? অবিশ্বাস্য লাগছে।
মেহেরের ভাবনার মাঝে হঠাৎ সকলের সামনেই সারিম এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। তার গাল থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে মেহেরের গালে লাগালো। যার ফলে সকলে চিৎকার করে উঠলো। মেহের অসম্ভব চমকালো সারিমের এ-কাজে৷ বয়াল বাহুল্য অবাকের চরম পর্যায়ে। শিরশির করে উঠলো সর্বাঙ্গ। আশিফ দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো,
–“জোস বন্ধু জোস। এই নাহলে আমাদের নিরামিষ সারিম! নিরামিষ যে আমিষ হয়ে গেলো। দেখেছো নি সবাই?”
বাচ্চদের হৈ-হুল্লোড় দেখে বড়ো’রা সরে গেলো। আর মেহের লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।