#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
তেইশ পর্ব
চৌত্রিশ.
আবিদ যেহেতু কখনো কোন পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেয়নি তাই অসংখ্য বার ওকে নিয়ে মনগড়া নিউজ হয়েছে। এসবে কখনোই পাত্তা দেয়নি, আমলেই নেয়নি কখনো। নিভৃতচারী মানুষ ও, এসব লাইম লাইটে বরাবরই অনীহা ওর। তাই সেসবের পাল্টা প্রতিবাদও কখনও করা হয়নি, হোক নিউজ, এতে কারও ক্ষতি তো হচ্ছে না, এই ভেবেই নীরব থেকেছে। কিন্তু এবার সব ছাপিয়ে গেছে, সীমা বলে একটা জিনিস আছে, যেটা কিছু ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকরা কখনো বুঝতে পারে না। বাড়তি কাটতির আশায় কোনো সত্যতা যাচাই না করেই দু’কলম লিখেই যেন এদের তৃপ্তি মেটে! অথচ যাদের নিয়ে লেখে তাদের ব্যাক্তি জীবন আছে, আত্মীয় পরিজন আছে তাদের উপরে এর কতটা প্রভাব পড়তে পারে সেসবের বিবেচনাবোধ এদের কস্মিনকালেও ছিল না!
অন্বেষা যেহেতু সাংবাদিক, তাই নিমিষেই আবিদের রাগ ওর উপরেও পড়ল। ওর সাথে ওখানে না গেলেই এসব কিছুই হতো না! এতদিনের লালিত সংযম ঝেড়ে কেন যে ওই মেয়ের সঙ্গী হলো, নিজের উপরেই চরম বিরক্ত হয় আবিদ! এতে ওই বেচারীর কোন দোষ নেই তা এখন ওর মাথায়ই ঢুকছে না। অনেক বছর পর রাগটাও নতুন করে ভর করল ওর মাথায়।
অন্বেষার কল করাতেই মাথার ভেতরে ঘনীভূত হওয়া রাগটা যেন ফেটে বেরোনোর অবকাশ পেল! মুঠোফোনের উল্টো পাশে অন্বেষার কণ্ঠ গনগনে আগুনে যেন ঘি ঢালল।
“একটা তামাশা তৈরি করে ফোন কেন করেছ?” আবিদের গলায় যেন ক্ষোভ ঠিকরে বেরোচ্ছে!
অন্বেষা ভেবে পায় না ওর ভুলটা কোথায়। হ্যাঁ, আবিদকে ওর সাথে যেতে ওই প্রভাবিত করেছে বটে, কিন্তু এসবে তো ওর কোন দায় নেই।
“আমি কী করেছি? আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?”
“কী করনি তাই বলো? সকাল থেকেই এসব ফালতু গসিপে আমার কান পঁচে যাবার জোগাড়! সবটাই তোমার জন্য হয়েছে। তোমার সাথে যাওয়াটা একটা মস্ত বড়ো ভুল ছিল আমার! তোমরা জার্নালিস্টরা সবই পারো।”
অন্বেষা এবার আর নিজেকে সামলে নিতে পারল না,
“গসিপ কী শুধুই আপনাকে নিয়ে হয়েছে? আমি কী এখানে নেই? নাকি ভেবে নিয়েছেন আত্মসম্মান নামের জিনিসটায় আপনার একচ্ছত্র আধিপত্য, আর কারোরই সেটা থাকতে নেই? আর সব জার্নালিস্ট একরকম হয় না, এটা আপনার জানা থাকা উচিত। আপনি যেন নিজেকে দায়ী না করেন এসবের জন্য, তাই ফোন করেছিলাম, কিন্তু আপনি যে পুরোপুরি আমাকেই গিল্টি ভাববেন এটা আমি ভাবতে পারিনি! ভালো থাকবেন, আর বিরক্ত করব না আপনাকে।” ভাঙা গলায় বলল অন্বেষা।
আবিদ যতক্ষণে হুঁশ ফিরে পেল, ততক্ষণে ঝট করে কল কেটে দিয়েছে অন্বেষা। এতক্ষণে ওর মাথায় এলো এতে অন্বেষার কোন দায় নেই। রাগের মাথায় হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে যা তা বলে ফেলেছে ও। নিজের উপরে বিরক্তিটা তাই চরম বিরক্তিতে রূপ নিয়ে নিল। বয়সে যথেষ্ট পরিনত হবার পরেও এরকম বাচ্চা সুলভ ক্ষোভ কেন ওকে গ্রাস করল এটাই বোধগম্য হচ্ছে না! মেয়েটা এরকম গসিপে নিশ্চয়ই ভীষণ ডিপ্রেসড হয়ে আছে, এখন সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল ওর পাশে থাকা, মোটিভেট করা, কিন্তু উল্টো আরও ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দিয়েছে। এতটা অবিবেচক কবে থেকে হয়ে গেছে?
জীবনের অনেক রকম রঙ দেখেছে আবিদ, জীবন পথের পোড়খাওয়া এক পথিক ও, ভীষণ রঙিন থেকে শুরু করে একেবারে ধূসর সবটাই অবলোকন করে এই অব্দি এসেছে ও। কী লাভ হলো জীবনের এত অভিজ্ঞতায়, সেই তো গুলিয়ে টুলিয়ে গুবলেটই পাকালো! কেন ঠিকঠাক করে কিছু করতে পারে না, কেন বারবার সবটা বদলে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়? এসব চিন্তা মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে আসতে থাকে।
অন্বেষার নাম্বারটা কয়েকবার ডায়েল করতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত নিবৃত্ত রাখল নিজেকে। আগে নিজেকেই নাহয় ধাতস্থ করে নেওয়া যাক, নয়তো কী বলতে কী বলবে, আবার ক্ষত বাড়িয়ে তুলবে! ধাতস্থ হয়ে মস্তিষ্ক ঠিকঠাক কাজ শুরু করলে নাহয় সবটা মিটমাট করে নেওয়া যাবে! সেই ভালো, নিজের উপরে আজকাল ভরসা করে উঠতে পারছে না, একেবারেই না!
পঁয়ত্রিশ.
সকাল থেকেই অন্বেষার মনে মেঘ জমছিল। বাবাই প্রথম ওকে ডেকে হাতে পত্রিকা ধরিয়ে দিলেন। সেই থেকেই মনে গুমোট মেঘের আনাগোনা শুরু করেছে। এমন কিছু হবে জানলে কখনোই গোঁ ধরে বসত না আবিদের কাছে। সৎ উদ্দ্যেশ্যে কিছু করতে চাইলে যখন হিতে বিপরীত হয়ে যায়, তখন আক্ষেপের শেষ থাকে না! অন্বেষার অবস্থাও সেরকম, কী এক অচেনা কালো মেঘ ভর করেছে ওর সমস্ত অনুভূতি জুড়ে!
ওর পত্রিকার সম্পাদক সাহেব ফোন করেছিলেন সকালেই, ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে। অফিস থেকে না করার পরেও কেন অন্বেষা গিয়েছে আবিদের কাছে, আর যদি ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েও থাকে, তবে ওর সাক্ষাৎকারই বা কোথায়?
অন্বেষা স্পষ্ট গলায় বলেছে, “স্যার, আমি কী করেছি না করেছি তার ক্ল্যারিটি আমার কাছে আছে, কিন্তু এটা পুরোটাই আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাই এসব নিয়ে আমি কোনরকম এক্সপ্ল্যানেইশন দেব না। এটা জব এথিকসের বাইরে পরে কিনা আমি জানি না।”
ভদ্রলোক নেহায়াতই ওকে ভীষণ স্নেহ করেন বলেই আর কথা বাড়ালেন না।
কিন্তু ওর কলিগদের কাছে এই রটনার চর্চা হতে থাকল। ওদের নিজস্ব চ্যাট গ্রুপ থেকেও লিভ নিয়েছে, এই যন্ত্রণায়। সোস্যাল মিডিয়াগুলো তো রংচঙয়ে করে রসালো ক্যাপশনে ক্যাপশনে শেয়ার হচ্ছে। চল্লিশোর্ধ্ব অবিবাহিত লেখকের লাভ লাইফ বলে কথা! কিন্তু আদৌ এর কোন সত্যতা আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করার বালাই নেই, দায় নেই! ভেতরে ভেতরে ভেঙে পরেছে ও।
নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে আবিদকে কল করল, আর ওর সেই প্রতিক্রিয়ার পর থেকেই মনে জমা মেঘেরা প্রবল বর্ষনে ঝরতে লাগল চোখ থেকে, গাল বেয়ে। ওকে কেন একটু বুঝল না লোকটা? এই যে এত এত চর্চা, জবাবদিহি কোনোটাই এতটা পোড়ায়নি, যতটা পুড়িয়েছে আবিদের বলা কথার বাণ!
হৃদয়ে জমা সাত সমুদ্র আবেগের জল নিংড়ে উথলে উঠছে, সে জল এতই প্রলয়ঙ্কারী যে কয়েকটা সিন্ধু ডুবিয়ে দিতে পারে! অথচ ওর হৃদয়ের আবেগ সমুদ্রের সাথেই হাতে হাত ধরে দাউদাউ করে জ্বলছে বিধ্বংসী আগুন, যে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে ভেতরটা, দহনে দাহ করে দিচ্ছে সমস্তটা! চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া আবেগের জল পুরো পৃথিবী ডুবিয়ে দিতে পারে, সব ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিতে পারে, অথচ ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠা হৃদয় পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলা আগুনটাই নেভাতে পারে না! কীসের এত বড়াই তবে এই আবেগের!
ওর মনের সাথে তাল মেলাতেই যেন কালো মেঘের ঘনঘটা বাইরে, পুরো আকাশ জুড়ে কালবৈশাখীর আয়োজন। ক্ষণে ক্ষণে কালো আকাশটা গর্জে উঠছে প্রবল হুংকারে! অন্বেষার মন খারাপটা যেন ছুঁয়ে গেছে ওর চারপাশে, আকাশে, বাতাসে, পুরো প্রকৃতিতে! আজ চারদিকে মন খারাপের রং, বড্ড বেরঙ!
রাতে শুরু হলো কালবৈশাখীর তান্ডব, সেই ঝড়ের মুহূর্তে অন্বেষা নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, উগ্র বাতাসের তোড়ে ওকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি, সেদিকে ওর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কেবলই নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে বৃষ্টিমাখা মেঘের আলো আঁধারীতে।
বাবা ওর রুমে এসে ওকে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিতেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনার বুকটা হুহু করে উঠল! অভিমানী মেয়েটার অভিমান তাকেও স্পর্শ করল ভীষণভাবে! বাবার বুকে মাথা রেখে নিজের ভেতরকার প্রলয় থামাবার চেষ্টা করতে লাগল অন্বেষা।
পরেরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতেই ফোনের রিংটোন কানে গেল ওর। বাইরে তখন ঝকঝকে সূর্যালোক, রাতের তাণ্ডবের রেশ মাত্র নেই এখন। ফোন হাতে নিতেই মুচকি হাসি খেলে গেল ওর মুখে, ওর হৃদয়ের মেঘও কেটে গেল সহসাই! এক চিলতে রোদ্দুর খেলে গেল হৃদয়ে। কিন্তু কল রিসিভ করল না। দু’বারেও যখন ধরল না, এরপরে মেসেজ টোন বাজতেই সাথে সাথে পড়ে ফেলার লোভটা সামলাতে পারল না।
“স্যরি, অন্বেষা। আমিও রাগের মাথায় তোমার মতোই সব গুলিয়ে ফেলছি ইদানীং। তোমার বন্ধুত্ব আমার কাছে নতুন সূর্যালোকের মতো, এটা হারাতে চাই না।
আবিদ”
ছোট্ট একটা টেক্সট যে কারও মনে ভালো লাগার তুফান বইয়ে দেয় এটা অন্বেষার জানা ছিল না। ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ল পুরো হৃদয়, মননে, মস্তিষ্কে। কিন্তু এত সহজেই কল রিসিভ করবে না ও। ওরও তো কিছু আত্মসম্মানবোধ অবশিষ্ট আছে নাকি? পুরো একটা দিন বিষাদে নিমজ্জিত থাকার পর এই আনন্দ আলোক, এই আলোতেই যদি পুরো জীবন কেটে যেত!
অন্বেষার হঠাৎ করে ভীষণ লিখতে ইচ্ছে করল, আর বসে বসে লিখেও ফেলল। এটা আদৌ কবিতা হলো কিনা জানে না অন্বেষা আর জানতেও চায় না! সব কবিতাতেই কী ছন্দ খুঁজতে হবে নাকি, এটা নাহয় ওর হৃদয়েরই আয়না হোক! যার প্রতিটি শব্দ ওর একেবারে হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসারিত! আবিদের মনের রুদ্ধদ্বারের ওপারে কী আছে তা জানতে ও তীর্থের কাকের মতোই তৃষিত!
“তোমায় ঘিরে দহন যত আমার হৃদয় মাঝে
সব বৃষ্টি হয়ে তুমুল ঝরুক,
আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা
তোমাকেও একটুখানি স্পর্শ করুক।
হৃদয়ের গহীন কোনে জমে থাকা অনুভূতিটুকু
যতটা রয়েছে অব্যক্ত, আর গোপন ভীষণ,
সেই পাথরচাপা অভিমান আরও কতশত পংক্তিমালা
উন্মোচিত হোক তোমার কাছে,
ঘটুক প্রবেশ তোমার মনের রূদ্ধ দরজার ওপাশে।
হয়ত সবই অলিক স্বপ্ন, কিংবা ক্যানভাসে আঁকা রঙিন আল্পনা,
তবুও চাই, খুব করে চাই
দুই হৃদয়ের মাখামাখিতে বাজুক প্রবল সুরের মূর্ছনা।”
(