#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৭)
” আপনি শাস্তির ব্যবস্থা করুন, আমি বিয়ের ব্যবস্থা করছি। ”
নিবিড় বেরিয়ে যেতে অনড়া ভীরুপায়ে এগিয়ে এলো। কোমলের পাশে বসে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” নিকাব পরতে ভুলে গিয়েছ, বুবু? ”
কোমল লজ্জা পেল। আরও একদফা নিকাব খোঁজারভঙ্গিতে বিছানার সবকিছু উল্টে-পাল্টে বলল,
” না, পরেছিলাম। ভুল করে খুলে গেছে। এখন খুঁজে পাচ্ছি না। ”
অনড়ার বুক ধক করো উঠল। সেই ধকধকানি বাড়িয়ে দিতেই বুঝি নিবিড় ফিরে এলো। অকুণ্ঠে ডাকল,
” বিবি? ”
কোমল চকিতে তাকাল। অনড়াও। বিব্রত হয়ে কোমল চোখ নামিয়ে নিলেও অনড়া একভাবে চেয়ে আছে। সেদিকে না তাকিয়ে নিবিড় নিঃসংকোচে বলল,
” আপনার নিকাব দিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম। ”
অনড়ার পলকহীন চোখদুটো দেখল, নিবিড় কেমন যতন করে প্যান্টের ভেতর থেকে নিকাবের কাপড়টা বের করে কোমলের হাতে দিল। কোমলের মুখটায় চেয়ে কী মিষ্টি হাসল! চোখভর্তি মুগ্ধতা নিয়ে আলস্য চালে হেঁটে গেল দরজার পানে।
নিবিড় দরজার আড়ালে হারিয়ে যেতেই অনড়ার পলক পড়ল। চোখ বন্ধ করল তখনই। দুই হাতের আঙুল এক করে চেপে ধরে, রুদ্ধশ্বাসে সুধাল,
” উনি কার বিয়ের কথা বলছিল, বুবু? ”
কোমলের শ্যামবর্ণের গালদুটো রাঙা হলো। সেই রঙ ঢাকতেই বোধহয় দ্রুত নিকাব বেঁধে বলল,
” তুই শুনে ফেলেছিস? ”
অনড়া শব্দ করে উত্তর দিতে পারল না। মাথা উপরনিচ করলে কোমল বলল,
” মানুষটার দেখি হুঁশ-জ্ঞান কিছু নেই। দরজা খোলা রেখে এমন জোরে জোরে বলে কেউ? পাগল একটা! ”
কোমলের কণ্ঠে পাগল শব্দটা এত মধুর শোনাল যে অনড়া নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। চোখদুটো রক্তিম হলো নিমিষেই। বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটুকু সহ্য করা কষ্ট হয়ে দাঁড়াল। চোখের পানি লুকিয়ে পালিয়ে আসতে নিলে কোমল বলল,
” যাচ্ছিস যে? আমায় খুঁজছিলি কেন, সেটাই তো বললি না। ”
অনড়া থমকে দাঁড়ালেও পেছন ফিরতে পারল না। পাছে বুবু তার কান্না ধরে ফেলে সে ভয়ে খুব সাবধানে বলল,
” তোমাকে দেখতে এসেছিলাম, অনেকদিন দেখা হচ্ছিল না যে! ”
কোমল মধুর হাসল। বিছানা ছেড়ে এসে দাঁড়াল অনড়ার নিকট। মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলল,
” আমাকে খুব মনে পড়ছিল বুঝি? ”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না অনড়া। বুবুর মমতাময় স্পর্শে দুর্বল হয়ে গেল আরও। চোখের পানিতে ভেসে গেল দুই গাল। ইচ্ছে হলো, বুবুকে ঝাপটে ধরতে। শব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে, ‘ উনার তো আমাকে বিয়ে করার কথা। তা না করে, অন্য কাউকে বিয়ে করছে, মুগ্ধ হয়ে দেখছে, আদর করে বিবি ডাকছে। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, বুবু। উনাকে বলো, আমায় বিয়ে করতে, আমাকে ভালোবাসতে, আমাকে আদর করে বিবি বলে ডাকতে! ‘ অনড়ার ইচ্ছে মনেই আটকা পড়ল। বুবুর স্নেহময় পরশ থেকে ছিটকে দূরে সরে পড়ে বলল,
” আমি যাই, নানিকে না বলে এসেছি। রাগ করবে। ”
_______________
নিবিড় দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের প্রস্তাব দিলে আনিস মোল্লা সাদরে গ্রহণ করলেন। আয়োজনের এত দ্রুততা ও গোছানো দেখে মনে হবে, সবটা আগে থেকেই জানতেন তিনি। শুধু অপেক্ষায় ছিলেন প্রস্তাবের। আগেরবারের মতো এবারও ঘরোয়া আসরেই বিয়ে হবে কোমল ও নিবিড়ের। কাজী কাবিননামা তৈরি করতে করতে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেল মোল্লাবাড়ির বিয়ের খবর।
পূর্বেই গড়িয়ে রাখা গয়না ও নতুন কিনে আনা বেনারশী পরে কোমল বাবাকে ডাক পাঠাল জরুরি আলাপের জন্য। তিনি কাজীর সাথে বিশেষ আলাপে ব্যস্ত ছিলেন। সেখান থেকে উঠে আসতে বিরক্ত বোধ হলেও পরমুহূর্তে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই সময় কী এমন বলবে কোমল? বিয়ে ভেঙে দেওয়ার মতলব নয়তো আবার? আনিস মোল্লা মনে মনে ক্ষেপে রইলেন। ঠিক করে নিলেন, এমন কিছু হলে তিনি মেয়ের কথা শুনবেন না। প্রয়োজনে ধমক দিবেন, জোর করে হলেও এই বিয়ে সম্পন্ন করবেন। এই মুহূর্তে নিবিড়কে তার সোনার টুকরো মনে হচ্ছে। কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
বাবা রুমে ঢুকতেই কোমল তড়িঘড়িতে দরজা আটকে দিল ভেতর থেকে। তার এমন কাণ্ডে আনিস মোল্লার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। যতই কঠিন সাজার চেষ্টা করেন না কেন, মেয়ের মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তার কোনোকালেই ছিল না। আজও হয়তো তেমনি হবে। সত্যিই কি তাহলে কোমল বিয়েটা ভেঙে দিবে?
কোমল বাবার হাত ধরে নিজের বিছানায় বসাল। অনুরোধের সুরে বলল,
” কাকার বাড়িটা তুমি কিনে নেও, বাবা। ”
এমন ভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসায় খানিক অবাক হলেন আনিস মোল্লা। সময় নিয়ে মেয়ের কথাটার অর্থ ধরতে চাইলেন, পারলেন না। নির্বোধের মতো প্রশ্ন করলেন,
” হঠাৎ বাড়ি কিনতে যাব কেন? ”
কোমল সরাসরি উত্তর না দিয়ে সংক্ষেপে মতিন মিয়ার বাড়ি বিক্রি করার ঘটনাটা তুলে ধরল। সাথে এই আসঙ্কাও করল, বাড়ি যেহেতু বিক্রি হয়ে গেছে, সেহেতু তারা চাইবে দখল করতে। এমতাবস্থায় নিবিড়রা কোথায় যাবে? মান-সম্মানেরও একটা ব্যাপার আছে। কুলসুম নাহারও যদি সহ্য করতে না পেরে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন? সবটা বুঝে নিয়ে আনিস মোল্লা থমথমে গলায় বললেন,
” নিবিড় জানে? ”
কোমল চুপ হয়ে গেল। আবেগে গলে গিয়ে সবটা জানিয়েছিল সে। পরে যখন দেখল, নিবিড় ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেনি, তখন সে ধরে নিল, নিবিড় একথাগুলো শুনেনি। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে কোমল। আপাতত, বাড়িটা রক্ষা করুক তারা। পরে সময় ও পরিস্থিতি বুঝে নিবিড়কে জানানো যাবে। কোমল নিজের পরিকল্পনাটাও বাবাকে জানালে তিনি সম্মতি দিয়ে বললেন,
” ঠিক আছে, আমি কাল সকালেই পাশের গ্রামে যাব। চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে আসব। ”
কোমল কৃতজ্ঞতায় বাবাকে জড়িয়ে ধরল আলতো করে। আনিস মোল্লা পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” আমার সব তো তোর-ই মা। যখন যা লাগবে নিবি, খরচ করবি। আমার কাছে অনুমতি চাইতে হবে না। আমরা শুধু চাই, তুই সুখে থাক। ”
_______________
কোমলের পাশে বসে নিবিড় যখন কাবিননামায় সাইন করছিল তখন দূর থেকে খুঁটে খুঁটে নিবিড়কে দেখছিল রাবেয়া খাতুন। প্রশস্ত কাঁধ, টানটান বুকের জন্য রোগাটে শরীরখানা স্থূলকায় দেখা যাচ্ছে। মুখ থেকে সেই কিশোর ভাবটা কেটে তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। উচ্চতায় কোমলের চেয়ে বেশ উঁচু হওয়ায় মনেই হচ্ছে না এই ছেলে তার মেয়ের চেয়ে ছয় বছরের ছোট। কেউ না জানলে ধরতে পারবে না একদম। রাবেয়া খাতুনের মনের খচখচ ভাবটা একটু কমল। কয়েকদিন পর যে নিবিড় ডিগ্রি পাস ডাক্তার হবে এটা মনে করতেও ভুললেন না। প্রসন্ন মুখে আপনমনে বিড়বিড় করলেন, ‘ ডাক্তার হতে পারেনি কিন্তু ডাক্তারের বউ তো হয়েছে! এই ঢের। ‘ রাবেয়া খাতুন দৃষ্টি হালকা করতে করতে ভাবলেন, এ গ্রামে এর চেয়ে ভালো ছেলে আর একটিও নেই। কোমলের সুভাগ্য বলেই এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে। নাহলে কার হাতে গিয়ে পড়ত কে জানে!
_____________
কোমলকে নিজের বাড়িতে উঠিয়েই নিবিড় মায়ের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে গেল। বুঝাতে চাইল, এখানে থেকে তার পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে। সামনে পরীক্ষা। শীঘ্রই ঢাকায় ফিরে না গেলে সমস্যা হবে। সে যেন গোছগাছ করে রাখে। ভোরেই সপরিবারে ঢাকা রওনা দিবে।
কুলসুম নাহারকে ঢাকা নিয়ে যাবে এ কথা শুনে রেগে গেলেন। মারার জন্য তেড়ে এলেন প্রায়। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না, তার ছেলে এমন কথা বলার দুঃসাহস করল কিভাবে। তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন,
” স্বামীর ভিটা ছাইড়া একপাও নড়মু না আমি, তোর বউরে নিয়া যা ঢাকা। ”
নিবিড় আরেকটু বুঝিয়ে বলতে চাইলে তিনি হাত উঁচিয়ে বললেন,
” চোখের সামনে থেইকা যাবি নাকি বিয়ার রাইতে মাইর খাবি? আমি কিন্তু ভুইলা যামু, বাড়িতে নতুন বউ আইছে। ”
মাকে বুঝাতে না পেরে কোমলের শরণাপন্ন হলো নিবিড়। বধুবেশে থাকা কোমলের লজ্জাটুকু দর্শন না করে সরাসরি অনুরোধ করল, মাকে বুঝাতে। বাবা নেই বাড়িতে, এমতাবস্থায় মাকে একা রেখে ঢাকায় যায় কিভাবে? তার যে ওখানে মন টিকবে না। চিন্তায় চিন্তায় পড়ালেখা অসহ্য হয়ে উঠবে। কোমলও লজ্জা ভেঙে স্বাভাবিকভাবে বলল,
” কাকিমা, বুঝার মতো অবস্থায় নেই। আমি বললেও কোনো কাজ হবে না। তাছাড়া এত বছরের গুছানো সংসার। সবকিছুতে কাকার স্মৃতি। এমন হুট করে বললেই কি এভাবে সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাওয়া যায়? ”
” তাহলে আপনি চলুন। ”
কোমল বিস্ময়ের অতিকে উঠে বলল,
” পাগল হলে নাকি? তাকে একা রেখে আমি কিভাবে যাব? বিবেকে বাঁধবে না? মানুষ কী বলবে? ”
উত্তরে নিবিড় চুপ থাকল। কয়েক সেকেন্ড নীরব বসে থেকে ব্যাগপত্র গুছাতে শুরু করল। কোমলের আর কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিল না। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
” একজনের কাছে স্বামীই সব, আরেকজনের কাছে শাশুড়িই সব। আমার কোনো মূল্যই নেই এদের কাছে। তাহলে আমি এখানে থেকে কী করব? এই চললাম আমি, থাকো তোমরা বউ-শাশুড়ি মিলে ভিটা আর সমাজ পাহারা দেও। ”
কোমল হতবাক হয়ে দেখল, নিবিড় সত্যি সত্যি রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কুলসুম নাহার ছেলেকে আটকানোর জন্য পিছু পিছু দৌড়াচ্ছেন।
ছেলের পেছন পেছন বাড়ি থেকে অনেকটা দূর ছুটে এসেও আটকাতে পারলেন না। গতি এতই বাড়িয়ে দিল যে, চোখের পলকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। ব্যর্থ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলেন। উঠোনে কোমলকে দেখেই ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন,
” বউ হইয়া আইতে না আইতেই জামাইর লগে ঝগড়া শুরু করছ? অবাধ্য হইছ? তোমারে কইছি আমি, আমারে দেহাশুনা করো? কইনাই তো? তাইলে যাইতে রাজি হইলা না ক্যান? বিয়ার প্রথম রাইতে পোলাডারে বাড়ি ছাড়া করছ! এগুলা কি কল্যাণের কাজ? ”
কোমল মাথা নত করে শাশুড়ির ঝাড়ি শুনছিল। তিনি একটু দম নিয়া আবার বললেন,
” জামাই-বউ হইল সুঁই-সুতার মতো। সুঁইয়ের পেছন পেছন যেমন সুতা ছুটে তেমন জামাইয়ের পেছন পেছনও বউয়ের ছুটা লাগে। বুঝছ? যাও, কাপড়চোপড় গুছাও। সকাল হইলেই তুমি ঢাকার পথে রওনা দিবা। ”
” আপনাকে একা রেখে….”
” আবার মুখে মুখে তর্ক করতাছ? আমার হাত নাই নাকি পা নাই যে দেখাশুনা করার জন্য অন্য মানুষ লাগবো? তোমাগো মতো টাকা-পয়সা খরচ কইরা বান্দি রাইখা চলছি কোনোদিন? ”
বলতে বলতে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন তিনি। নিজে সামনে থেকে কোমলকে দিয়ে ব্যাগ গুছালেন। শক্ত করে জানিয়ে দিলেন, নিবিড়ের রাগ না ভাঙানো পর্যন্ত তার সাথে যেন যোগাযোগ না করে। ‘#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৮)
রাতে খুব রাগারাগি করলেও ভোরের আলোতে মন নরম হয়ে আসে কুলসুম নাহারের। কোমলের পা টেনে টেনে হাঁটারভঙ্গিতে স্নেহ চলে আসে। সহানুভূতি ফুটে উঠে প্রবীণ চোখদুটোতে। ছেলে রাগ না করলে হয়তো কোমলের ঢাকা যাওয়া আটকে দিতেন। সম্ভব হচ্ছে না দেখে কোমলের হাতের ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিজের হাতে নিলেন। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মোহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” বউমা রে আমার পোলার কাছে পৌঁছাইয়া দিয়া তারপর আইবা, বুঝছ? আবার একলা ছাইড়া দিও না। ঢাকা শহর কিন্তু আমাগো গেরামের মতো না। খালি মানুষ আর গাড়িতে ভরা! এত মানুষ যে কইত্তে আইছে আল্লাহ জানে। আমার জীবনে তো এত মানুষ একলগে দেহি নাই! ”
কুলসুম নাহারের কণ্ঠে একই সাথে যত্নাভাব, বিস্ময়, বিরক্ত। মোহনের বদলে আনিস মোল্লা প্রত্যুত্তর করলেন,
” চিন্তা করো না, কুলসুম। আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি মোহনকে। ”
মেয়ে ঢাকা যাবে শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছিলেন আনিস মোল্লা। নিজে দিয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়লে কোমল বুঝায়, তার গ্রামে থাকা দরকার বেশি। চেয়ারম্যানের সাথে যত দ্রুত সম্ভব আলাপে বসে বাড়িটা নিজেদের দখলে নিতে হবে। এই মুহূর্তে নিবিড়দের উপর কোনোরূপ বিপদের ছায়া পড়তে দিতে চাই না সে। মেয়ের অর্পণ করা এই গুরুতর দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্যই সঙ্গে যেতে পারছেন না। তাই তার বিশ্বস্ত কর্মচারী মোহনকে সাথে করে দিচ্ছেন। মেয়েকে একা ছাড়বেন না কিছুতেই।
কুলসুম নাহার হাত ধরে কোমলকে বাসে উঠালেন। সিটে বসিয়ে ব্যাগটা কোলের উপর সুবিধামতো রেখে বললেন,
” সাবধানে যাইও। নিবিড়রে কইও একটা কল দিত। আমি তোমাগো বাড়িতে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করমু। ”
কোমল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালেও একটু চিন্তায় পড়ল। সে জানে, নিবিড়ের কাছে মোবাইল নেই। কল দিবে কোথা থেকে? ঢাকার ঐদিকে মোবাইল ব্যবহার একটু সহজ হয়ে আসলেও সকলে করতে পারছে না। দাম এখনও নাগালের বাইরে। নিবিড়ের মতো অবস্থাপন্ন মানুষগুলোর কাছে মোবাইল ক্রয় এক রকম স্বপ্নই বলা যায়।
কুলসুম নাহার সরে পড়লে আনিস মোল্লা দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন। গাড়িচালক প্রস্তুত। যেকোনো সময় গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই দ্রুত মেয়ের হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন,
” বিয়ের রাতে নিবিড়কে এই মোবাইলটা উপহার হিসেবে দিছিলাম। মনে হয়, সঙ্গে করে নিতে ভুলে গেছিল। সকালে আমার রুমে পেয়েছি। দিয়ে দিস। ”
ইঞ্চিন চালু হয়েছে। বাস কাঁপতে থাকলে আনিস মোল্লা তড়িঘড়িতে নিচে নেমে আসলেন। বাইরে থেকে জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে বললেন,
” ওর সাথে থাকে যে ছেলেটা? ওর নাম্বার সেইভ করা আছে। কল দিয়ে ঠিকানা বুঝে নিস ভালো করে। ”
বাবার দিকে চেয়ে থেকে মাথা একপাশে কাত করে কোমল। নিকাবের আড়ালে হালকা হেসে আপনমনে বলল, ‘ ভুল করে রেখে যায়নি, বাবা। ফিরিয়ে দিতে পারছিল না বলে, চুপচুপ করে রেখে আসছে। শ্বশুরবাড়ির উপহার নিলে তার সম্মানে লাগবে যে! ‘
নিজেদের গ্রাম পেছনে রেখে ছুটে চলতে চলতে ভাবনায় ডুবে গেল কোমল। মনে পড়ল সেই সকাল, নিবিড়ের চোখের তৃষ্ণা, সুমধুর কণ্ঠে বিবি সম্বোধন, শাস্তি গ্রহণের সহজ স্বীকারোক্তি, বিবাহ করার জেদ। বেখেয়ালে আবারও হেসে উঠল কোমলের ঠোঁটদুটো। মানতে বাধ্য হলো, যখন ভিন্ন কিছু ঘটার থাকে তখন প্রকৃতিও ভিন্ন আচরণ করে। নাহলে সেরাতে কোমল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো কেন? ফজরের নামাজ কাযা হলো কেন? তার এত বছরের জীবনে কখনও তো ফজরের নামাজ কাযা হয়নি। মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসার আগেই তার ঘুম ভেঙেছে সবসময়। শুধু সেই সকালে আযানের বদলে নিবিড়ের কণ্ঠ শুনে ঘুম ভেঙেছে তার। তারপরই এক পলকে সব বদলে গেল! কোমলের মনে অদ্ভুত এক সম্মোহনী সুর ছড়িয়ে পড়ল। বাইরের মাতাল হাওয়া মিশে সেই সুর পাগলাটে হয়ে পড়েছে যেন। তাকে হারিয়ে নিতে চাইছে অন্য এক সময়ে, অন্য এক ভুবনে।
____________
দুলাল বিয়ে করার পরপরই মেস ছেড়ে বাসা ভাড়া নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল নিবিড়কে। খোলামনেই জানিয়েছিল, সেই বাসায় তুলি আসবে মাঝেমধ্যে। রান্না-বান্না করে দিয়ে চলে যাবে। যেসময়টা সে রান্না করবে সেইসময় নিবিড়কে একটু বাইরে থাকতে হবে। শুধু এই শর্ত মানলে খাওয়া-দাওয়ার খরচ মাফ নিয়ে বাসা ভাড়াটা ভাগাভাগি করবে। নিবিড় ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল, মেসের মধ্যে তারা দুজন এক রুমে থাকলেও পাশের রুমগুলোতে আরও অনেক ছেলেপিলে থাকে। সেখানে তুলির আসা-যাওয়া করা সম্ভব না। আবার তাদের বিয়ে সম্পর্কে তুলির বাবা-মা জানে না বিধায় একেবারে চলে এসে আলাদা রুম নিয়ে থাকাও সম্ভব না। তাই এই বাসা ভাড়ার পরিকল্পনা করেছে দুলাল। এতে নিবিড়েরও সুবিধা হয়েছে। সেখানকার বাবুর্চির রান্না সে খেতে পারত না। অন্য রুমের ছেলেপিলেগুলোর চিল্লাচিল্লি, আড্ডা-মাস্তি। হুটহাট রুমে এসে বিরক্ত করা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তাই সহজে শর্ত মেনে নিলেও খাবার খরচটা মাফ নিল না। দুলাল ভাই এমনিতে অনেক ভালো মানুষ। তাকে নানানভাবে সাহায্য করে, সেহিসেবে এইটুকু সুবিধা দেওয়াই যায়। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একান্ত সময় না কাটালে সম্পর্ক গাঢ় হবে কিভাবে? দুলাল অফিস থেকে ফেরার পথে তুলিকে সঙ্গে নিয়ে আসত প্রায় প্রতিদিন। তার কিছু সময় পূর্বেই নিবিড় একটা বই সঙ্গে নিয়ে বাসা তালা দিয়ে বেরিয়ে যেত। অনেকটা সময় বাইরে থেকে ফিরে আসার পর তুলিকে পেত না। দুলাল ভাই হেসে বলতেন, ‘ তোর অপেক্ষায় ছিলাম। চল, একসাথে খেয়ে নিই। ‘
এখন তুলি রান্না করতে আসবে না। কালও হয়তো আসেনি, তাই রান্নাঘরে রাঁধা কোনো খাবার নেই, শুকনো খাবারও নেই। বাসায় ফিরে একটু ঘুমিয়েছিল নিবিড়। ঘুম ভাঙার পর প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। বাইরে বেরুনোর মতো মনমানসিকতা নেই। দুপুরও হয়ে এসেছে। চা-বিস্কুটে কাজ হবে না। ভারী খাবার খেতে হবে। নিবিড় রান্নাঘরে চাল খুঁজে পেল। ধুয়ে চুলায় বসিয়ে ভাবতে বসল, ভাত হলে কী দিয়ে খাবে। রান্না-বান্নার কিছুই জানে না। ভাত বসিয়েছে অনুমানের ভিত্তিতে। ঠিকঠাকভাবে হবে নাকি সেই সন্দেহে আছে। ভাবতে ভাবতে পুরো রান্নাঘর তোলপাড় করে দুটো ডিম, কয়েকটা আলু আর পেয়াজ পেল। সবগুলো নিয়ে বটি হাতে গিয়ে বসল রুমে। রান্নাঘর ছোট হওয়ায় সেখানে বসার সুবিধা করতে পারছিল না। আলুর খোসা না ফেলেই মনমতো কুটিকুটি করে রাখল একটা বাটিতে। এবার পেয়াজ নিয়ে গবেষণা চালানোর মধ্যেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। এই বাসা থেকে অফিস কাছে হওয়ায় মাঝেমধ্যেই দুলাল ভাই দুপুরে খেতে বাসায় আসেন। নিবিড় ভাবল সেই হয়তো। পেয়াজ হাতেই দরজা খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। দরজার সামনে দুলাল ভাই নয় বোরকা পরিহিত এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিস্ময় কাটল মোহনের কণ্ঠে,
” মালিকের কথামতো তোমার বউরে তোমার কাছে পৌঁছাই দিছি, এবার আমি যাই। ”
মোহন তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে প্রস্থান করল। কোমল অপরাধী চোখে তাকিয়ে আরও কুণ্ঠিত হলো। নিবিড়ের চোখদুটো ভীষণ লাল ও অশ্রুতে ভেজা। সে ধরে নিল নিবিড় কান্না করছিল। তার মুখ ভয়ে পাংশুটে হয়ে আসল। মাফ চাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই নিবিড় দরজা ছেড়ে চুপচাপ ভেতরে চলে গেল। কোমল দূর থেকে দেখল নিবিড় পেয়াজ কাটার চেষ্টা করতে গিয়ে আরও একদফা কেঁদে ফেলছে। না চাইতেও হেসে ফেলল। মুখে নেকাব পরা থাকায় সেই হাসি কেউ দেখল না। হাসতে হাসতে লজ্জাও পেল এই ভেবে যে, পেয়াজের ঝাঁজে বেরিয়ে আসা পানিকে অন্য কিছু ভেবেছিল।
নিবিড় পেয়াজের খোসাসহ গোটা কয়েক পেয়াজ কুটি কুটি করে আলুর সাথে রাখল। কাটার পর্ব শেষ হয়েছে এই স্বস্থি নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল, কোমল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও। তার কি ভেতরে ঢোকার জন্য অনুমতি লাগবে? তাহলে চাচ্ছে না কেন? নিবিড় নাহয় রাগ করে আছে, তাই কথা বলছে না। কোমলের তো উচিত নিজ থেকে কথা বলে রাগ ভাঙানো। এইটুকু বুঝ কোমলের নেই দেখে ভারী আফসোস হলো নিবিড়ের। আপনমনে বলল, ‘ শুধু বয়স হলে যে বুদ্ধি হয় না, এটা প্রমাণ করে দিলে, কোমলমতি। ‘
নিবিড় উঠে গেল কোমলের কাছে। হাত ধরে ভেতরে এনে দরজায় সিটকানি টেনে দিল। একটানে নিকাব খুলে ফ্যান ছাড়ল। নিজের পড়ার টেবিলের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে এনে কোমলকে বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল ভারিক্কি চালে। এতগুলো কাজের মধ্যে থেকে ভাতের কথা ভুলে গিয়েছে নিবিড়। পানি গরম হয়ে উপচে পড়ছে চুলার পাশে। তাড়াহুড়ায় চুলার আঁচ কমাতে গিয়ে বন্ধ করে ফেলল। নতুন করে যে চুলা ধরাবে সেই উপায় নেই। চুলার নিচে থাকা ম্যাচ ভিজে চপচপে হয়ে আসে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পারল না রেগে গেল। ম্যাচের শলা ঢিল মারতে গিয়ে দেখে কোমল দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। তার কৌতূহলী চোখে চোখ পড়তে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল দরজার দিকে। সিটকানি খুলে বাইরে বেরুতে গিয়ে আবার ভেতরে এলো। টেবিলের উপর থেকে তালা-চাবি নিয়ে ফিরে এলো দরজায়। কোমলকে ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দোকানে এলো। ম্যাচ কিনে একটু বাজারের দিকে এগিয়ে একটা মুরগিসহ টুকটাক আরও কিছু কিনে যখন রুমের ভেতর ঢুকল তখন কোমল রুম ঝাড়ু দিচ্ছে। কোমলের থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে রান্নাঘরে ফেলল। বাজার-সদাই রাখতে গিয়ে দেখল, ভাতের হাড়ি মার ফেলার জন্য উপুত করেছে। ডিম ভাজাও শেষ। নিবিড় বিস্ময়াভিভূত হয়ে ভাবছে, এত অল্প সময়ে রান্না হলো কী করে? তার তো আলু আর পেয়াজ কাটতে গিয়েই দুপুর শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নিবিড় ভাবনা থেকেই গোসল করতে চলে গেল। বের হতেই মশলা কষার ঘ্রাণ নাকে পৌঁছাল। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিতে গিয়ে ধরা পড়ল কোমলের দৃষ্টিতে। সে মৃদু হেসে বলল,
” কাকিমা, আমাদের বাসায় অপেক্ষা করছে। বাবার নাম্বারে একটা কল দেও। ”
নিবিড় বিব্রত হয়ে সরে পড়ছিল। কোমলের কণ্ঠ পেয়ে বলল,
” দুলাল ভাই আসুক, তারপর কল দিব। আমার কাছে মোবাইল নেই। ”
” আমার কাছে আছে তো। দেখ, তোমার বইয়ের উপর রেখেছি। ”
নিবিড় মোবাইল দেখে চিনে ফেলল। ধরতে গিয়েও ধরল না। একটা বই তুলে নিয়ে বিছানায় বসল। বইয়ের পাতা মেলতে মেলতে বলল,
” আমি কারও সাথে কথা বলতে পারব না। ”
কোমল ধরে নিল, মায়ের সাথে রাগ হয়েছে তাই এভাবে বলছে। চুলা থেকে তরকারিটা নামিয়ে নিজেই কল দিল বাসায়। বাবার সাথে একটু কথা বলেই কুলসুম নাহারকে দিতে বলল। তিনি মোবাইল নিলে নিবিড়ের হাতে মোবাইল দিয়ে বলল,
” কথা বলো, নাহলে খুব দুঃখ পাবে। ”
মায়ের কণ্ঠ পেয়ে আত্মসম্ভ্রম ভুলে গেল নিবিড়। কানে ফোন লাগিয়ে কথা চলতে থাকল অবিরত। তাদের কথার মধ্যেই কোমল প্লেটে ভাত বেড়ে আনল। নিবিড় কথায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে উঠে গিয়ে আরেক প্লেট ভাত বেড়ে আনল। নিজের পাতে তরকারি নিয়ে কোমলের পাতে দিয়ে ইশারায় খেতে বলল। সেই ইশারা উপেক্ষা করল না কোমল। নিবিড়ের সাথে সাথে সেও খাওয়ায় মন দিয়েছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, পানি আনতে ভুলে গেছে। নিজের অর্ধেক খাবার ফেলে পানি এনে দেখল, তার প্লেটের একটাও মাংসের টুকরো নেই। নিবিড় মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে তার প্লেট থেকে খেয়ে ফেলেছে সব। কোমলের ভারি মায়া হলো, বাবার শোকে ঠিকমতো খায়নি ছেলেটি! এতদিন পর মুখে রুচি এসেছে। কোমল দৌড়ে এসে বাটির অবশিষ্ট মাংসের টুকরোগুলো নিবিড়ের পাতে দিতে চাইল। ততক্ষণে তার কথা শেষ। লাইন কেটে মোবাইল রেখেই কোমলকে বাঁধা দিল। চামচ ঘুরিয়ে নিয়ে কোমলের পাতে দিয়ে বলল,
” আমি তো আপনারটা খেয়েছি, আমাকে দিচ্ছেন কেন? আপনি খান। ”
কোমল বিস্ময় চোখে তাকাল। আরও একবার সে ভুল ভেবেছে। নিবিড় ক্ষিধে থেকে খায়নি, মনের ভুলেও না। ইচ্ছে করে স্বজ্ঞানে খেয়েছে।
_____________
রাত হয়ে এলেও দুলাল ভাই বাসায় ফিরেনি। এদিকে কোমলের সাথে মান-অভিমানটাও ঠিকমতো কাটেনি দেখে নিবিড়ের মেজাজ খুবই খারাপ। বইয়েও মন বসাতে পারছে না। তবুও জোর করে বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। কোমল আরও একবার বিছানার চাদর টেনেটুনে ঝাড় দিতে গিয়ে একটা কাগজ কুড়িয়ে পেল। সেটা নিয়ে নিবিড়কে দিয়ে বলল,
” এটা মনে হয়, বইয়ের ভেতর থেকে পড়েছে। ”
নিবিড় কাগজটা মেলে দেখল, দুলাল ভাইয়ের লেখা। চিঠির মতো লিখেছে,
প্রিয় নিবিড়,
তুলির মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়েও মানাতে পারলাম না। বিয়ে ভেঙে দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই ও কে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। আশা করছি, আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। তুমি ভালো থেকো। আমাদের জন্য দোয়া করো।
ইতি,
দুলাল ভাই।
পুনশ্চঃ বাড়িওয়ালাকে একমাসের ভাড়া দেওয়া আছে। রুমে কিছু খাবার মজুদও আছে। তোমার পক্ষে যদি একা এই রুমের ভাড়া বহন করা সম্ভব না হয় তাহলে এই মাসের মধ্যে নতুন মেসে উঠে যেও।
চলবে
চলবে