#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৩)
( বর্তমান….)
শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর স্বামীর মুখদর্শন পায়নি অনড়া। সুগন্ধি ফুলে সাজানো খাটটি শূন্য থেকে যায় সারারাত। বাসি ফুলের দিকে একভাবে চেয়ে থাকায় অনড়ার চোখ টলমল হয়। বুকের ভেতর ক্ষীণ ব্যথাটা প্রকট হতেই একটি কাগজ আর কলম তুলে নেয়। কাঁপা হাতে দুই-তিন লাইন লিখে ক্ষান্ত হয়। কলম পাশে ফেলে কাগজটি ভাঁজ করে উদাসভঙ্গিতে। সেসময় দরজায় কড়া পড়ার মৃদু শব্দ হয়। অনড়া উঠে দাঁড়ায়। পুরো দরজা না মেলে একটু ফাঁক করে। সেই ফাঁকে হাত গলিয়ে দিয়ে বলল,
” বুবু, এই কাগজটা তাকে দিও। ”
কোমল কাগজটা নিয়ে কিছু সুধানোর সুযোগ পেল না। অনড়া ভেতর থেকে দরজা আটকে দিল সশব্দে। আরও দুইরাত একা এক রুমে কাটানোর পর স্বামীর পদধ্বনি পেল অনড়া। ব্যাকুলচিত্তে দরজা মেলে সমুখে তাকাল। স্বামীর মুখদর্শনের সৌভাগ্য হলেও সুনজর পেল না। নিবিড়ের চোখ-মুখে রাজ্যের বিরক্ত, অনিচ্ছা, বিরাগ। এই অনাগ্রহ মুখটাতেও ভীষণ মায়া অনুভব করল অনড়া। নরমসুরে বলল,
” অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার সুতো কাটল! ”
অনড়ার আহ্লাদ ভাঙা কথা কর্ণপাত করল না নিবিড়। খনখনে গলায় বলল,
” কোমল জানাল, তুমি নাকি কারও সাথে দেখা করছ না, কথা বলছ না, সারাক্ষণ দরজা আটকে রাখছ? ”
অনড়া মান স্বরে যোগ করে দিল,
” খাচ্ছি না, গোসল করছি না, কাপড়ও বদলাচ্ছি না। ”
নিবিড় এক পলক চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মেয়েটা এখনও বধূসাজে আছে!
” কেন করছ এসব? ”
” কাগজে লিখে দিয়েছি। ”
নিবিড় একটু চুপ থেকে বলল,
” বাচ্চাদের মতো জেদ করো না। তুমি অবুঝ নও। বুঝার চেষ্টা করো। অন্য সবার মতো আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক না। এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে আমাকে যন্ত্রণা দিও না! ”
নিবিড়ের কণ্ঠে মিনতি। চোখের চাহনিতে অসহায়ত্ব। অনড়া বলল,
” তুমি স্বাভাবিক আচরণ করো। তাহলে আমিও করব। ”
অনড়ার ‘ তুমি ‘ সম্বোধনে নিবিড়ের চোখে রাগ তেজে উঠে নিভে গেল। দরজা থেকে ফিরে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” আপাতত সম্ভব না। ”
এক কদম এগিয়ে গেলে অনড়া উঁচু স্বরে বলল,
” আমি জানি, বুবু কখনও গোপনতা ভাঙে না। কাগজের লেখা বুবু পড়েনি। তুমি পড়েছ। বুবুকে শুনিয়েছ। হয়তো তার জোরাজুরিতে আমার মুখোমুখি হয়েছ। ”
নিবিড় থামল। পেছন না ঘুরেই মুক্তস্বরে বলল,
” তোমার বুবু আমার স্ত্রী। প্রাণপ্রিয় বিবি। তার সামনে আমার কোনো গোপনীয়তা নেই। আকাশের মতো স্বচ্ছ, নির্মল। ”
অনড়া চুপ হয়ে গেল। পরমুহূর্তে বলল,
” শুধু কাগজে না মুখেও বলছি, যতদিন না তুমি আমায় স্পর্শ করবে ততদিন আমি এভাবেই থাকব। অনাহারে, অযত্নে মৃত্যু গ্রহণ করব। ”
নিবিড়ের পায়ের গতি বেড়ে গেল। মূল দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মায়ের ডাক পেল। থামল নিবিড়। কুলসুম নাহার ছুটে এসে বললেন,
” না খাইয়া কই যাস? ”
নিবিড় জবাব দেয় না। কুলসুম নাহার শঙ্কিত গলায় আবার বললেন,
” খাউন-দাউন একবারেই ছাইড়া দিছস দেহি! রোগ বাঁধাইবি নাকি? ”
” রোগ বাঁধলেই কী, মা। আমার জন্য কারও চিন্তা হয়? হয় না। ”
” খামখেয়ালি কথাবার্তা! ”
” খামখেয়ালি না, মা। সত্যি কথা। ”
” বউ খাবার বাড়ছে, খাইয়া যা। ”
নিবিড় দূর থেকে কোমলকে পর্যবেক্ষণ করছিল। তার দিকে চেয়ে গাঢ়স্বরে বলল,
” খাবার শরীর সুস্থ রাখতে পারে, মন না। ”
নিবিড় আবারও সদর দরজার দিকে এগুলে কোমল দূর থেকে বলল,
” ঘরে দুজন থাকতে একজন সকল দায়িত্ব পালন করবে কেন? দায়িত্ব ভাগ করা হোক। আমি শরীরের দায়িত্ব নিচ্ছি, অনুকে মনের দায়িত্ব দেওয়া হোক। ”
কোমলের এমন কথায় বিস্ময়াপন্ন হলেন কুলসুম নাহার। স্তব্ধ থাকলেন এক মুহূর্ত। স্তব্ধ দৃষ্টি ছেলের দিকে ফেলেই ঘাবড়ে গেলেন। ছেলেকে শান্ত রাখতে কোমলকে ধমক দিতে চাইলেন। সুযোগ পেলেন না। নিবিড় ঝড়েরগতিতে কোমলকে নিয়ে ডানদিকের রুমটায় ঢুকে পড়ে। তীব্র শব্দে দরজা আটকালে কুলসুম নাহার ভয়ে শিউরে ওঠেন। ছুটে যান বন্ধ দরজার দিকে। ঘনঘন আঘাত করে বলেন,
” নিবিড়, শান্ত হ। বউ ভুল কইরা কইছে। ”
নিবিড় কোনোরূপ উত্তর করল না। দরজার দিক থেকে মন সরিয়ে কোমলের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ। মাথা নিচু করে আছে। হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। নিবিড় মৃদু হাসল। সহাস্যে জড়িয়ে নিল স্ত্রীর নরম শরীরখানা। ফিসফিসে বলল,
” শুভ বিবাহ বার্ষিকী। ”
বিস্ময়ে কোমলের বন্ধ চোখের পাতা আলগা হয়ে গেল। নিবিড় স্ত্রীকে বাঁধনে রেখেই বলল,
” আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের সাত বছর পূর্ণ হলো আজ। প্রতিবছর এই দিনটিতে আমরা ভালোবাসা বিনিময়ে ব্যস্ত থাকি, কিন্তু এবার? ভালোবাসা তো দূর, তুমি দিনটিকেই ভুলে গেছ। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”
স্বামীর দুঃখ প্রকাশে কোমলের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
” অনড়া নামক এই ঝড়টা কেন টেনে আনলেন, কোমলমতি? কিভাবে সামলাব আমি? নিজেকে দিশাহারা মনে হচ্ছে, দিগভ্রান্ত! ”
কোমল জানে নিবিড় মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হলে তাকে আপনি সম্বোধন করে। মুহূর্তেই স্বামীর মনের অবস্থা বুঝে গেল। তাকে সাহস দিতে বলল,
” আপনি সামলাতে পারবেন। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি আছি তো আপনার পাশে। ”
নিবিড় একটু দূরে গিয়ে বলল,
” কোনো প্রয়োজন নেই সামলানোর। আমি শুধু আপনার থাকতে চাই। শরীর, মন সবকিছুর দায়িত্ব একমাত্র আপনার। কোনো ভাগ হবে না। ”
” তাহলে যে অনড়া ঠকে যাবে! ”
কোমলের ন্যায়পরতাকে গ্রাহ্য করল না নিবিড়। কাছে এগিয়ে এসে সোনার ঝুমকো জোড়া সযত্নে পরিয়ে দিল কানে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
” চিনতে পারছ? ”
দুলজোড়ার দিকে একস্থির চেয়ে থেকে খানিক ভাবল। সহসা বলল,
” এটা তো বাবার গড়িয়ে দেওয়া সেই দুল। যেটা তোমার মা…”
বেফাঁসে বলে ফেলা কথাটার মাঝপথে থেমে গেল সে। জিভ কামড়ে ধরে চোখ বুঝে ফেলল। নিবিড় সেই চোখে চুমু খেল উষ্ণ আদরে। তারপর বলল,
” হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। কিন্তু এখানে একটা আমার গড়ানো। ”
কোমল চোখ মেললে সে আবার বলল,
” সেদিন দুটো ফেরত দিতে আসলেও আমি একটা সঙ্গে করে নিয়েছিলাম। মাঝপথে গিয়ে মনে পড়ল, মা বুঝে যাবে দুলজোড়া আমি-ই নিয়েছি। অনেক সমস্যা হবে, ঝামেলা হবে। ঐ সময়টাতে নতুন কোনো ঝামেলা চাচ্ছিলাম না। তাই তোমার কাছে রেখে যাওয়া ঐ একটাও নিয়ে আমার কাছে রাখলাম, অন্যটা মাকে দিলাম। সে ভেবেছে, একটা হারিয়ে ফেলেছে। ”
” সেজন্যই চিঠিতে উল্লেখ থাকলেও আমি বাস্তবে খুঁজে পাইনি। ”
নিবিড় হালকা হাসল। কোমলের গাল ছুঁয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আপনমনে আওড়াল, ‘ এভাবে একটু একটু করে আপনার সব ঋণ শোধ করব। ‘
” অনেক টাকা লেগেছে, তাই না? কী প্রয়োজন ছিল এখন গড়ানোর? পরেও…”
কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই স্বামীর আঙুল এসে পড়ল ঠোঁটে। বলতে শুনল,
” আমার সংসারকে দুই ভাগ করে একভাগ হতে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন না? মুক্ত করলাম। আজ থেকে, আমার ভেতরের সংসারের দায়িত্ব আপনার আর বাহিরের সংসারের দায়িত্ব আমার। শুধু-ই আমার। বুঝেছেন? ”
কোমল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকল শুধু। নিবিড় ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে আরও কাছে টেনে নিতে চাইলে বাঁধা পেল। জিজ্ঞেসা দৃষ্টি রাখতে কোমল বলল,
” অনড়া তোমার অপেক্ষায় আছে। ”
” আপনি নেই? ”
কোমল দৃষ্টি নামিয়ে নিল। স্বামীর স্পর্শের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল। নিবিড় বাঁধন শক্ত করে বলল,
” আমাকে বাঁধা দেওয়ার সাহস নেই আপনার, আমার স্পর্শকে উপেক্ষা করার শক্তিও নেই। তবু মিছে চেষ্টা করছেন কেন? ”
” ওর সাথে অবিচার হবে। আমি কথা দিয়েছি, ওর অধিকারে বাঁধা হব না। ”
” হচ্ছেনও না। ”
কোমল জোর দিয়ে বলল,
” হচ্ছি। ”
” না, হচ্ছেন না। আপনার পাওনা বুঝে নিচ্ছেন। ”
” কিসের পাওনা? ”
পরে বুঝাব। এখন ধৈর্য্য ধরতে পারছি না৷ বলতে বলতে কোমলকে কোলে নিল নিবিড়। উষ্ণ চুম্বনের নেশায় ডুবে বলল,
” দুই মিনিট, মাত্র দুই মিনিট এমন শক্ত হয়ে পড়ে থাকুন। আমি হার স্বীকার করে দূরে সরে যাব। ”
কোমল সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। পাথরের মতো শক্ত হতে গিয়ে বরফের মতো গলে গেল। হার স্বীকার করে অস্ফুটে বলল,
” নিষ্ঠুর! ”
” শুধু অন্যের বেলায়। ”
_______________
প্রথমবারের মতো মিলনের পরপর-ই ঘুমিয়ে পড়েছে কোমল। তার নিশ্বাসের গতি বলে দিচ্ছে, এই ঘুম কতটা গভীর, নিরুদ্রবিগ্ন। নিবিড় ফিসফিসে বলল, ‘ এতগুলো বছর আমাকে ঘুম পাড়ালেন। আমিও আপনাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি। আজ থেকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্বটাও আমি নিলাম। ‘
কোমলের একটা হাত তার পিঠের নিচে পড়েছিল। সেটা বের করার জন্য একটু নড়তে কোমল ঘুমের মধ্যে পিঠ খামচে ধরল। নিবিড় হেসে ফেলল। আপনমনে বলল, ‘ আপনার মন কুঠুরির খুব গোপন কক্ষে ভয়ের বীজ রোপন হচ্ছে। আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়! অথচ এই ভয় এতদিন আমাকে তাড়া করেছে। যার বহিঃপ্রকাশকে আপনি পাগলামি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। বিবি, আপনিও কি এমন পাগলামি করবেন কখনও? ‘ কোমলের দিক থেকে কোনো উত্তর এলো না। অপেক্ষা করতে করতে তন্দ্রা লেগে এলো নিবিড়ের চোখে। সে তন্দ্রায় নিমগ্ন না হয়ে কোমলকে সরাল খুব সাবধানে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
” আপনাকে পাগলামি করতে হবে না, ভয় পেতেও হবে না।পৃথিবীতে আমাদের আলাদা হওয়ার একমাত্র কারণ হবে মৃত্যু, আর কিছু নয়। ”
মাঝরাতে অনড়ার রুমে হাজির হলো নিবিড়। মৃদু আঘাত করতেই অনড়া দোর খুলে দাঁড়ালে সে জিজ্ঞেস করল,
” কাপড় বদলাওনি এখনও? ”
অনড়া দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” জেদের মূল্য না পেয়ে ছাড়ি কী করে? ”
নিবিড় সহজভঙ্গিতে রুমের ভেতর ঢুকল। বিছানার এককোণে বসে বলল,
” তোমাকে একটা লাঠি দিয়ে বলেছিলাম, সবসময় সঙ্গে রাখতে। রেখেছ? ”
অনড়া পড়ার টেবিলের দিকে হেঁটে গেল। তার পেছন থেকে লাঠি এনে বলল,
” মারবে? ”
” অনেকটা তেমনই। ”
” মাঝরাতে সোহাগ না করে মারতে এসেছ? ”
নিবিড় সেই প্রশ্নের উত্তর দিল না। লাঠি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
” তুমি তাহলে জেদ ছাড়বে না? ”
অনড়া নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলল,
” না। ”
নিবিড় লাঠি দিয়ে অনড়ার হাতের চুড়ির উপর আঘাত করল। গলার গয়না টেনে ছিঁড়ে ফেলল। সামিয়ানা প্যাঁচিয়ে খুলে ফেলল। শাড়ির আঁচল ফেলে দিল কাঁধ থেকে। খাবারের পানির জগ এনে পানি ঢেলে দিল মাথায়। চাপা শাসানির সুরে বলল,
” ভদ্র মেয়ের মতো শাড়ি বদলে সালোয়ার কামিজ পরো। আমার কাছে তোমার একমাত্র পরিচয়, তুমি কোমলের বোন। আর সেই পরিচয়েই থাকবে। অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করবে না একদম। ”
নিবিড় বেরিয়ে যেতে গিয়েও থামল। পেছন ঘুরল না। সেভাবেই বলল,
” তোমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি, বুঝনি। সেজন্যই এই ব্যবহারটা পেলে। আশা করছি, ভবিষ্যতে এটা মনে রাখবে। ”
” ভুলে যাব। ”
” কষ্ট ছাড়া কিছু পাবে না। ”
_____________
প্রতিটি ভোরের মতো আজও প্রথম ঘুম ভাঙল নিবিড়ের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল অনেক বেলা হয়ে গেছে। ফযরের নামাজ কাযা হয়েছে দেখে একটু দুঃখ পেল। কোমলকে জাগানোর উৎসাহ পেল না। তাই চুপচাপ নিজে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরুল। দেখা হলো মায়ের সাথে। তিনি কিছু বলার আগেই নিবিড় বলল,
” কোমল ঘুমাচ্ছে। কেউ যেন ডাক না দেয়। ”
নিবিড় চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর ঘুম ভাঙল কোমলের। পাশে স্বামীকে না পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ওঠল। ঘড়িতে সময় দেখে কপালে হাত চলে গেছে। গর্হিত অন্যায় করেছে এমন মুখ করে রুম থেকে বেরুল। রান্নাঘরে শাশুড়িকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে বলল,
” ছি, ছি! আপনি চুলা ধরিয়েছেন কেন? ছাড়ুন, আমি করছি। ”
” তোমার আর করতে হইব না, সব করা শেষ। ”
কোমল মুখ কালো করে বলল,
” আমায় একটু ডেকে দিতেন! ”
” নিবিড় মানা করছিল। ”
কুলসুম নাহার ছেলের বউয়ের দিকে ঘুরে বললেন,
” মনখারাপ করতে হইব না। আমি বুঝছি, সারারাত জাগ্না ছিলা। প্রথম প্রথম তো! মাইনা নিতে কষ্ট হইব। ”
শাশুড়ির কথা বুঝতে পারল না কোমল। সপ্রশ্নে চেয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” আবার ভাইব না, আমি আড়ি পাইতা তোমাগো কথা হুনছি! এমন অভ্যাস আমার নাই। আমি স্বচক্ষে নিবিড়রে ছোট বউয়ের রুমে যাইতে দেইখা বুঝতে পারছি, তুমি ওরে বুঝাইছ। মানাইছ। তোমার মন যত নরম তত শক্তও। নাহলে নিজের জামাইরে সাইধা সতীনের কাছে পাঠাতে পার? ”
‘ নিবিড় অনড়ার রুমে গিয়েছিল ‘ কথাটা শোনামাত্র তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নিশ্বাস এলোমেলো হলো। চোখদুটোতে অন্ধকার নেমে এলো যেন! অনুভব করল, তার মন, শরীর, মস্তিষ্ক সব অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অথচ এমনটাই চাওয়া ছিল। চাওয়া পূরণেও বুঝি এমন কষ্ট হয়?
” আজ দুইবোনে একলগে নাস্তা করো, যাও। ”
কুলসুম নাহার একটি প্লেটে রুটি আর ডিম ভাজা সাজিয়ে কোমলের হাতে দিতে গিয়ে দেখল, তার হাত কাঁপছে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে সুধালেন,
” শরীর খারাপ লাগতাছে নাকি? রুমে যাও। আমি নাস্তা দিয়া আসুমনি। ”
কোমল দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। অবশ শরীরটাকে টেনে রুমে নিয়ে আসল। বিছানায় ধপ করে বসে আনমনা হয়ে গেল।
____________
নিবিড় সকালে খেয়ে যায়নি, দুপুরেও আসবে না। কাজের চাপ বেড়েছে। ব্যস্ততা কাটিয়ে খাওয়ার সময়টুকু বের করা কঠিন। কোমল জানতে পেরেই হাসপাতালে খাবার পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল। সাথে একটি চিরকুট পাঠাল। তাতে লেখা, ‘ যখন আমি জানতাম না, দুলজোড়া তোমার কাছে তখন একজনকে উপহার দেওয়ার মন বানিয়ে ছিলাম। এখন আমার কী করা উচিত? ‘
খাবারের বাটি ফেরত এলো একঘণ্টার মধ্যেই। কোমল মুখ খুলে দেখল, অর্ধেক ভাত ও তরকারি পড়ে আছে। চিরকুটের উত্তরে লিখেছে, ‘ তোমার বাবার অংশ দিতে পার। আমার অংশ দেওয়ার অনুমতি নেই। ‘
কোমল সেই অর্ধেক ভাগকে পুনরায় দ্বিভাগ করল। একভাগ নিজের জন্য রেখে অন্যভাগ নিয়ে গেল অনড়ার জন্য। সে খাবার দেখে মুখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। কঠিন হয়ে বলল,
” বলেছি তো খাব না। তবুও বার বার আনছ কেন? ”
” খাবি না কেন? তোর চাওয়া তো পূরণ হয়েছে। ”
” কে বলল? ”
” নিবিড় আসেনি রাতে? ”
” এসেছে, কিন্তু চাওয়া পূরণ করতে নয়। ”
” তাহলে? ”
অনড়া চুপ হয়ে গেল। রাতের ঐ ঘটনা বুবুকে বলতে আগ্রহী নয় সে। কোমল উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে কাপড় বদলেছিস কেন? ”
” ভিজে গেছিল। ”
কোমল অনেক চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারল না। রাতে নিবিড় বাড়ি ফিরলে অনড়ার কথা তুলল। খাবারের প্রসঙ্গ উঠতে সে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি খেয়েছ? ”
কোমল মাথা নত করে ফেলল। নিবিড় বুঝে গেল সেও খায়নি। মুহূর্তে মেজাজ চটে গেল। চোখদুটো সূর্যের মতো জ্বলে উঠল। দ্রুতপদে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে কোমল জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় যাচ্ছ? ”
” তোমার বোনের সাথে বোঝা-পড়া করতে। ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৪)
অনড়ার রুমের দরজা ভেজানো। নিবিড় বেশ শক্ত চাপড়ে আঘাত করল। একটু থেমে আবার। বারবার। অপেক্ষার সময় সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটে স্পর্শ করতে অধৈর্য হয়ে পড়ল মন ও শরীর। বলপ্রয়োগে ধাক্কা দিতে পাল্লা সরে গেল আপনাআপনি। ভেতরটা দৃষ্টি সীমা আসতেই সে ত্রস্তপদে এগিয়ে গেল। মেঝেতে এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা অনড়ার শিথীল শরীরটা তার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিল যেন! এক মুহূর্তের জন্য চিন্তাবোধ হারাল। সহসা চাপা চিৎকারে ডাকল,
” কোমল? ”
কোমল দৌড়ে এলো। সে তার ডাকের অপেক্ষায় ছিল এমন ভাব! ভেতরে ঢুকতে চোখ দুটো মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। মুখ হলো রক্তশূণ্য! এক চিৎকারে পুরো কক্ষ কাঁপিয়ে তুলল। অনড়ার পাশে বসে অনর্গল ডেকে চলল,
” অনু? এই অনু? ”
চেতনাশূন্য শরীরটা একবারের জন্যও কাঁপছে না। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে কিছু বলছে না। পলক মেলে তাকাচ্ছে না। কোমল নিবিড়ের দিকে চেয়ে সুধাল,
” ওর কী হয়েছে? সাড়া দিচ্ছে না কেন? ”
এমন অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে নিবিড়। বাকশক্তি হারিয়ে একদম নিশ্চুপ, বোধশক্তিহীন। কোমল তাগিদ দিয়ে বলল,
” চেয়ে চেয়ে কী দেখছ? ও কে বিছানায় তুলো। হাত-পা বরফের মতো ঠাণ্ডা! ”
নিবিড় রোবটের মতো আদেশ পালন করে পূর্বের মতো কাঠ হয়ে রইল। কোমল তার শরীরে কাঁথা দিল। ছুটাছুটি করে সরষে তেল যোগাড় করল। হাত-পায়ের তলায় মালিশ করতে করতে বলল,
” আবার দাঁড়িয়ে আছ যে! নাড়ি পরীক্ষা করে দেখ। শ্বাস চলছে তো ঠিকমতো? হৃদস্পন্দনটা মাপ। ”
কোমল নিজেই দৌড়ে গিয়ে স্টেথোস্কোপটা আনল। নিবিড়ের হাতে দিয়ে বলল,
” আমার বোনকে সুস্থ করে দাও। ”
নিবিড় মূর্তি রূপ থেকে বেরিয়ে এলো। নিজস্ব কায়দায় প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করল। স্যালাইন পুশ করে বলল,
” একটু পর জ্ঞান ফিরে আসবে। চিন্তা করো না। ”
মিনিট তিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে এলো অনড়ার। পিটপিটে তাকাল। হাত-পা নাড়ল হালকা। নিবিড় তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমার বোনের শরীর খুব দুর্বল। তার খাবারের ব্যবস্থা করো। ”
কোমল তখনই বেরিয়ে গেল। নিবিড়ও বেরিয়ে যেতে চাইলে অনড়া দুর্বল স্বরে বলল,
” আমি খাব না। ”
সে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলো। কপাল কুঁচকে একভাবে চেয়ে থাকল অল্পক্ষণ। সহসা হেঁটে গেল তার শিয়রের কাছে। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে বলল,
” চুপচাপ খেয়ে সুস্থ হও। তারপর জরুরি আলাপ করব আমরা। ”
অনড়া কী একটা বলল ঠোঁট কাঁপিয়ে। নিবিড় তার স্পষ্ট মানে ধরতে পারল না। তাই এড়িয়ে গেল। স্যালাইন ঠিকমতো চলছে নাকি দেখার জন্য অন্যপাশে হেঁটে গেল। ততক্ষণে খাবার নিয়ে হাজির হয়েছে কোমল। অনড়াকে খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হলে নিবিড় বলল,
” এত অস্থির হচ্ছ কেন? শান্ত হও। তোমার বোনের তেমন কিছু হয়নি। ”
স্ত্রীর কাছে হেঁটে এসে জিজ্ঞেস করল,
” পানি কোথায়? আগে একটু পানি খায়িয়ে গলা ভিজিয়ে নেও। ”
কোমল মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভুল করায় লজ্জিত হলো। নত মাথায় পানি আনতে ছুটতে নিলে নিবিড় বলল,
” একজন তো অনশন করে বিছানায় পড়েছে। তুমি কি হাত-পা ভেঙে বিছানায় পড়তে চাও? সাবধানে হাঁটো। দৌড়াদৌড়ি করার মতো কিছু হয়নি। ”
কোমল ধীরে হাঁটতে চেয়েও দ্রুতপদ ফেলে বেরিয়ে গেল। অনড়া শ্বাস টেনে স্পষ্ট করে বলল,
” যদি তুমি খায়িয়ে দেও, তবেই খাব। ”
নিবিড় চমকে তাকাল। অনড়ার ক্লান্ত, শুকনো মুখটা মায়া জাগাতে পারল না একবিন্দুও। ভীষণ নিষ্ঠুরতায় বলল,
” এমন ইচ্ছে স্বপ্নেও পূরণ হবে না। ”
” তাহলে অভুক্ত থেকে মৃত্যুকে বরণ করব। ”
নিবিড়ের হারিয়ে যাওয়া ভয়াবহ রাগটা ফিরে এলো। অনড়ার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে চিৎকার করল,
” বিবি? ”
স্বামীর ডাক কানে পৌঁছাতে কেঁপে উঠল কোমল। হাতের পানি ছলকে পড়ে গেল। গ্লাসটাকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখল। দুয়ারে পা রেখে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? ”
নিবিড় কঠোর স্বরে বলল,
” তোমার বোনের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দেও। আজকে, এই মুহূর্তে গ্রামে ফিরে যাবে ও। ”
কোমলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! ভীত দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল অনড়ার দিকে। ঘটে যাওয়া ঘটনা আঁচ করতে পারল কিছুটা। স্বামীকে মানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে সে দৃঢ় স্বরে বলল,
” আমার বাসায় থাকতে হলে, আমার কথা মানতে হবে। ”
কোমল দ্রুত বলল,
” মানবে। ”
” আমি যা বলব তা শুনতে হবে। ”
” শুনবে। ”
নিবিড় অগ্নিঝরা দৃষ্টি রাখল অনড়ার উপর। কঠিন হয়ে বলল ,
” বিশ মিনিট সময় দিলাম। এই খাবার শেষ করো। নাহলে ব্যাগপত্র গুছাও। ”
কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। প্রায় আধঘণ্টা পর কোমল এসে জানাল, অনড়া খাবার খেয়েছে। ওষুধও। এখন ঘুমাচ্ছে। এসব তথ্য শুনে একটুও খুশি হলো না নিবিড়। উল্টো বিরক্তে কপাল, ভ্রূ কুঁচকে মন্তব্য করল,
” তোমার বোনের মাথায় সমস্যা আছে। ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ নিতে হবে। ”
কোমল অসম্মতিতে বলল,
” ওর মাথা একদম ঠিক আছে। ”
নিবিড় মজার ছলে বলল,
” খোঁজ পেলে প্রথমে তোমাকে দেখাব। ”
কোমল চোখ বড় বড় করে তাকালে সে চাপা হাসল। বলল,
” বোনের সাথে থেকে থেকে তোমার মাথায়ও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ”
কোমল একটু এগিয়ে বলল,
” এত ‘ তোমার বোন, তোমার বোন ‘ বলো কেন? ”
” তাহলে কি আমার বোন বলব? ”
কোমল মুখ বিকৃত করে বলল,
” ছি! বিয়ে করা বউকে কেউ নিজের বোন বলে? ”
নিবিড় নিরুত্তর থাকলে সে প্রশ্রয় পেয়ে বলল,
” বিবি বলবে। ”
নিবিড়ের দৃষ্টি বদলে গেল। রাগ ভাব ফুটে উঠার আগেই কোমল সংশোধন করে দিল,
” ছোট বিবি বলবে। ”
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সে। সর্বশক্তি দিয়ে ঠোঁটদুটো চেপে রেখে রাগ সংবরণ করছে। হাত মুঠো করে, চোখ বন্ধ করে কোমলের সামনে থেকে সরে যেতে গিয়েও ফিরে এলো। কোমলের হাতদুটো এক করে মোনাজাতের রূপ দিয়ে বলল,
” আজ থেকে মোনাজাত ধরলেই প্রথমে বলবে, ‘ হে আল্লাহ, আমার স্বামীকে ধৈর্য্য দিন। ‘ ঠিক আছে? ”
কোমল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি রেখে বলল,
” আচ্ছা। ”
_____________
পরের দিন হাসপাতাল থেকে ফিরে অনড়ার সাথে দেখা করতে গেল নিবিড়। সে উদাসভাবে বিছানায় আধশোয়া ছিল। নিবিড় খোলা দরজার পাল্লায় মৃদু আঘাত করে সুধাল,
” আসব? ”
অনড়া হালকা কেঁপে উঠল। দরজার দিকে এক পলক চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মান স্বরে বলল,
” তোমার ইচ্ছে। ”
নিবিড় ভেতরে ঢুকল। একটা চেয়ার টেনে বসল একটু দূরে। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” তোমার উদ্দেশ্য কী বলো তো। ”
অনড়া চকিতে তাকাল। সবিস্ময়ে বলল,
” কোন উদ্দেশ্যের কথা বলছেন? ”
” পাগলামির। জেদের। কাল সারারাত ভেবেও তোমার উদ্দেশ্য ধরতে পারলাম না।
নিবিড় একটু ঝুকে এলো অনড়ার দিকে। বলতে লাগল,
” আমি যখন জানলাম বিয়ের পাত্রী তুমি তখন একটু খুশি হয়েছিলাম। কারণ, ঐ মুহূর্তে কোমলকে শান্ত ও সুস্থ করার জন্য বিয়েটা করা জরুরি হলেও পরবর্তীতে মিটমাট করার একটা ভালো সুযোগ আছে। আমার ধারণা ছিল, তুমিও হয়তো এ কারণেই বিয়েতে রাজি হয়েছ। কিন্তু তোমার আচরণ বার বার প্রমাণ করছে, আমার ধারণা ভুল। তোমার বিয়ের উদ্দেশ্য কোমলকে খুশি করা নয়। অন্যকিছু। সেটা কী? ”
নিবিড় একটু থামল। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
” আমি তো খুব সম্পদশালীও না যে স্ত্রী সেজে আত্মসাৎ করবে। বিয়ে করার মতো তেমন কোনো প্রণয়ঘটিত ব্যাপারও নেই। তাহলে কি বিয়ের পর স্বামীর প্রতি উতলে উঠা ভালোবাসা? ”
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে একটু বিরতি নিল নিবিড়। অনড়ার দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে পুনরায় বলল,
” এটাও তো অসম্ভব। কারণ, ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার জন্য একটিবার দেখা হওয়া বা কথা বলা জরুরি ছিল। সেটার সুযোগ-ই হয়নি। তার আগেই তোমার জেদের সূচনা হয়ে গেছে। ”
অনড়ার সচকিত দৃষ্টি আনমনা হয়ে এলো। মনে পড়ল তার সেই কিশোরী বয়সের মুগ্ধতা, অদ্ভুত অনুভূতির দোলা, প্রথম লেখা প্রেমপত্র।
চলবে
চলবে
[