#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ১
একটি পচে যাওয়া লা° শের তীব্র দুর্গন্ধে থিতিয়ে আসে প্রাণ। তার চেয়ে বেশি শোকে ঝিমিয়ে আসে অনুভূতি। হৈচৈ পড়ে এলাকা জুড়ে। কী যেন একটা হাহাকার গ্রাস করে পুরো চা বাগানকে। বাগানের সবচেয়ে গুণী ছেলেটার এমন দেহ, এমন পরিণতি আশা করে নি কেউ। তবুও কতটা নির্মমতা আকাশ পাতাল জুড়ে!
এক সন্ধ্যা বেলা অভ্রদা’র দেহ উদ্ধার করা হয়, এরপরের দিন সন্ধ্যা বেলা সেই দেহ সৎকার করা হয়। আফসোসের আকাশে তখন বিষাদ ঘন হয়ে আসে, চা বাগানে নেমে আসে বোধহয় গা ছমছমে অমাবস্যা। এর পর থেকেই চা বাগানে ঘটতে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যা ঘটে নি কখনো। প্রথম ঘটনা ঘটে পত্রের সাথে। অভ্রদা’র সৎকারের পরের দিনের ঘটনা- পত্র দুপুরের দিকে এঁটো থালাবাসন ধুঁতে পুকুরে যায় এবং তারপরই মিনিট পনেরো পেরুতেই চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে বাড়িতে। পত্রের মা ছায়া সবে তখন মাথা রেখেছিল বালিশে। মেয়ের চিৎকার শুনে সে এক লাফে উঠে বসে বিছানায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে উঠোনে। পত্রের চিৎকার তাদের প্রতিবেশীদের বাড়ি অব্দিও ঠিক চলে গেছে। গোসাইদের বাড়ি, দাসেদের বাড়ির জেঠিমা,কাকীমা’রাও ছুটে আসে পত্রদের বাড়ির উঠোনে।
পত্রলেখার শরীরে তখন চুপচুপে ঘামের আবির্ভাব। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিল তার শরীর। ছায়া ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে পত্র? এমন ভর দুপুরে চিৎকার করছিস কেন? পুরো চা বাগানে তোর গলা বোধহয় শোনা যাচ্ছে। কী সমস্যা?”
পত্রের কণ্ঠে তখন শব্দদের নিস্তব্ধতা। চেয়েও পত্র বলতে পারছে না কিছু। কেবল তার দেহের তাপ বাড়ছে সাথে কম্পন বাড়ছে। গোসাইদের বাড়ির জেঠিমা পত্রের মাথায়-পিঠে চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর কী যেন বলে বার বার ফু দিলো পত্রের মাথায়। অতঃপর আচমকা বলে উঠলো,
“তুই ভর দুপুরে কই গিয়েছিলি?”
“ও তো প্রতিদিন দুপুরের থালাবাসন ধুতে পুকুরে যায়, আজও সেখানে গিয়ে ছিলো।”
পত্রের মায়ের কথায় আৎকে উঠে গোসাই বাড়ির জেঠিমা। পত্রের দিকে তাকিয়ে ভীত কণ্ঠে বলে,
“কিরে? পত্র? তুই কী দেখেছিস পুকুরে? কিছু দেখেছিস নাকি?”
পত্র কাঁপা কণ্ঠেই এবার উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ জেঠি। আমি, আমি সেখানে পিসিকে দেখেছি সাথে অভ্রদাকেও।”
পত্রের কথায় উপস্থিত সবাই আৎকে উঠে। ভয়ে দু’কদম পিছিয়েও যায় তারা। গোসাই জেঠিমাই কেবল দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়, শক্ত কণ্ঠে বলে,
“সত্যি সত্যিই তাদের দেখেছিস?”
“হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। আমি দেখেছি অভ্রদা কী সুন্দর ঘাটে বসে আছে আর পিসি বসে ছিলো বট গাছের নিচে।”
পত্রের কথায় কলরব শুরু হলো তাদের উঠোনে। কিছু ক্ষণের মাঝেই পুরো খবর ছড়িয়ে গেলো চা বাগানে। ঘোষণা করা হলো যেন ভর দুপুরে আর রাত দশটার পরে কেউ চা বাগানের পুকুর পাড়ের রাস্তায় না যায়। বদলে গেলো চা বাগানের পরিস্থিতি।
_
সময়টা আষাঢ়ের শুরুর দিকে। সারাদিন মেঘ গুলো গুরু-গম্ভীর ভাব নিয়ে বিচরণ করছে গগণ বক্ষে। অভ্রদা আর পিসি বিহীন প্রায় কিছুটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। চা বাগানের পরিবেশে দেখা দিয়েছে ক্ষাণিকটা বদল। কেমন একটা গুমোট ভাবে যেন স্তব্ধ এই নব্য কিশোরীর ন্যায় চা বাগান। পত্র সারাদিন স্কুলে ছিল। স্কুল থেকে মাত্র রওনা দিয়েছে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। রাস্তার আশপাশের দোকান-পাট প্রায় বন্ধ। বিন্নীও বেশ কিছুদিন স্কুল যাচ্ছে না। ভাইয়ের মৃত্যুর শোক বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না মেয়েটা। তাই একাই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে পত্রকে। পথিমধ্যে বিশাল বিশাল ঝোপ পেরুতে হচ্ছে। বাড়িটা কিছুটা ভেতরের দিকে যে। নিজ মনে দ্রুত পায়ে যখন পত্র গন্তব্যে যেতে ব্যস্ত তখন প্রায় শুনশান রাস্তার মাঝে গমগমে শব্দ তুলে পরিচিত জিপ গাড়িটা এসে পত্রের সামনে দাঁড়ালো। জিপ গাড়ির শব্দ থামতেই পথচারীর সেই নিস্তব্ধ পথ আবার নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। পত্র কিছুটা ভয় পেয়েছে সাথে খানিক চমকেও উঠেছিল কিন্তু গাড়ির মাঝে পরিচিত মুখটা দেখতেই থিতিয়ে গেলো ভয়। জিপ গাড়ি থেকে নেমে এলো শহুরে সুদর্শন পুরুষটি। পত্র আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আতস গাড়ি থেকে নেমে পত্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। আকাশে তখন বর্ষার বিকেলের টিমটিমে আলো। যার বিদায় ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে ভাব। আতস ডানে-বামে রাস্তার দিকে একটু তাকিয়ে ছোট্টো শ্বাস ফেলে বললো,
“বাড়ি ফিরছো?”
“হ্যাঁ।”
পত্রের কণ্ঠে আড়ষ্টতা। আতস কিছুক্ষণ মৌন থেকে পর্যবেক্ষণ করলো পত্রকে। কি যেন দেখলো মনযোগ সহকার, অতঃপর হুট করেই বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“চুল গুলো কেটে ফেলেছো!”
“হ্যাঁ।”
আতসের চোখে-মুখে তখন কেবল উপচে পড়া বিস্ময়। পত্রকে সে অনেকদিন পর দেখলো, তাই সে পত্রের চুল কাটার ঘটনাটা জানতো না। কিন্তু ঘটনাটা তার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্যকর লাগলো। তার কথাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবুও কৌতুহলী কণ্ঠে বললো,
“কীভাবে! কীভাবে পারলে এমন ভয়ঙ্কর কাজটা করতে?”
পত্র উত্তর দেয় না। মাথাটা আগের চেয়ে আরও একটু নিচে নামিয়ে ফেলে। দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পিচঢালা সরু রাস্তাটায়। আতস হয়তো পত্রের পরিস্থিতি বুঝতে পারে তাই হতাশার একটা শ্বাস ফেলে বলে,
“চলো, আমি এগিয়ে দেই তোমায়। বৃষ্টি আসবে বোধহয়, সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো। গাড়ি করে গেলে তাড়াতাড়ি যেতে পারবে।”
“না, আমি হেঁটেই পারবে।”
“হ্যাঁ, তা আমি জানি। কিন্তু গাড়িতে গেলেও তো সমস্যা নেই তাই না?”
পত্র দ্বিমত করতে চেয়েও করলো না। নিবিড় পায়ে সে উঠে গেলো গাড়িতে। আতসও মুচকি হেসে গাড়িতে উঠলো। আকাশে তখন আঁধার ঘনিয়ে গেছে গভীর ভাবে। জিপ ছুটেছে নতুন উদ্যমে, সশব্দে, নিজ বেগে। আতস গাড়ি চালানোতে মনযোগ দিয়েই বললো,
“একটু কাজে তোমাদের মেইন সদরে গিয়েছিলাম, এসে দেখি তোমাদের চা বাগান নিস্তব্ধ হয়ে আছে। যা ঘটেছে তা সত্যিই খারাপ হয়েছে।”
“হুট করেই সবটা হয়েছে।”
“চুল গুলো না কাটলে কী হতো!”
আতসের প্রশ্নের জবাব দেয় না পত্র। কেবল নিঃশব্দে বেরিয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস। আতস আবার বললো,
“তোমার অভ্রদা মারা গেলো কীভাবে?”
“জানা যায় নি।”
“কোনো ব্যবস্থা নেও নি জানার?”
“কী ব্যবস্থা নিতাম? লা/শ পচে বাজে অবস্থা ছিল।”
“তোমরা কী আন্দাজ করছো? হুট করে তো আর সে মারা যায় নি তাই না? আর মারা গেলেও সে ঐখানে কেন যাবে? তাও নাকি নিজের হোস্টেলে যাবে বলে বেরিয়ে ছিলো।”
“জানিনা। মানুষটার কোনো শত্রু থাকার তো কথা না কিন্তু কে করলো এটা! এমন কাজটা!”
“এখানে এসে আরও একটা কথাও তো শুনতে পাচ্ছি। যদিও আমি এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করি না, কিন্তু এটা নাকি তুমিই প্রথম বলেছো?”
“কোনটা?”
“এই যে, তোমার মৃত পিসি, অভ্রদাকে নাকি দেখতে পেয়েছো?”
পত্র কেবল উপর-নীচ মাথা দুলায়। যার অর্থ সে দেখেছে। তার মাঝেই গাড়ি এসে থামে পত্রদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে৷ পত্র নিজের ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নামার প্রস্তুতি নিতেই আতস থামিয়ে দেয় তাকে। পত্রের বা’কাঁধের বাহুতে শীতল স্পর্শ করে বলে,
“পত্রলেখা, তোমার অভ্রদা কী কখনো বলে নি যে, তোমার লম্বা চুল গুলোতে দীঘির কালো জলের ঢেউ ছিলো? যা দেখে মুগ্ধ হতো নয়ন যুগল?”
আতসের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে পত্র। অপরিচিত পুরুষের ছোঁয়া বোধহয় নতুন নতুন পাচ্ছে সে! এর আগে এত গভীর ভাবে তো কেউ স্পর্শ করে নি তাকে। আবার মিঠে প্রশংসায় খানিকটা মিইয়েও যায় সে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভুলে যায় মুহূর্তেই। তা দেখে আতস মুচকি হাসে। পত্রের আরেকটু কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলে,
“আগামীকাল সিনেমা দেখতে যাবে? চা বাগানের পশ্চিমের দিকে যে সিনেমা হলটা আছে, সেখানে? নতুন সিনেমা?”
পত্রের কণ্ঠ দিয়ে শব্দ আসে না, তবুও মিনমিন করে সে বলে,
“আমার স্কুল আছে। আর মাকে বললে তো যেতেও দিবে না।”
“মাকে বলবে কেন? স্কুলের নাম করে বেরুবে। আমরা তারপর সিনেমা দেখতে যাবো।”
“কেউ দেখে ফেললে!”
পত্রের কণ্ঠে ক্ষীণ আশংকা। সেই আশংকাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বেশ গা ছাড়া ভাবে আতস বললো,
“কেউ দেখবে না। তুমি যাবো তো?”
“দেখি।”
আর কোনো বাক্যব্যয় না করেই পত্র নেমে গেলো গাড়ি থেকে। হৃদপিণ্ড তার তখনও লাফাচ্ছে। কোনো পুরুষের এত সান্নিধ্যে সে কখনো যায় নি। কেন যেন এই আতস নামের মানুষটাকে কিশোরী হৃদয় অনেক বেশিই পছন্দ করে ফেলেছে। মানুষটাকে দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।
পত্র বাড়ির ভেতর না যাওয়া অব্দি আতস দাঁড়িয়ে থাকে। পত্র যেতে যেতেও আরেকবার ফিরে তাকায়। মনের মাঝে অপরিচিত অনুভূতিদের তোলপাড়। কিশোরী বয়সের আকর্ষণ যে ভয়াবহ হয়, পত্র বোধহয় সেই আকর্ষণেই কাবু হয়ে গেলো।
–
অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের সকাল টা বেশ ভীত। চা বাগানের বেশির ভাগ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অভ্রদা’র বাড়িতে। ঠাকুর জেঠিমা শুয়ে আছে বিছানায়। চোখে মুখে তার অস্বাভাবিকতা। জ্ঞান নেই। কবিরাজ ডাকা হলো। জেঠিমা কেমন চুপ হয়ে আছেন। বিন্নীর আর জেঠা মশাই এর মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে তা এমন ছিলো যে, গত কাল রাতে জেঠিমা জল খেতে কলপাড়ে এসে বিকট এক চিৎকার দেয়। তার চিৎকার শুনে জেঠা মশাই এবং বিন্নী সেখানে পৌঁছাতেই দেখে জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পড়ে আছে জেঠিমা। রাতে রাতেই সে খবর ছড়িয়ে গেছে পুরো বাগান জুড়ে। পত্র ঘুম থেকে উঠে সে ঘটনা শুনেই ছুটে এসেছে জেঠিমার কাছে।
কবিরাজ অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। তার বিজ্ঞ চোখে তখনও অস্বচ্ছতা। পত্র বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে জেঠিমা’র মাথায়। তার মাঝেই সারা রাত পর জ্ঞান ফিরলো জেঠিমা’র। জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিলেন, অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
“স সরলা এসেছে, আলতা রাঙা পায়ে সরলা এসেছিল। আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। সরলা ছিলো।”
উপস্থিত উত্তেজনা আরও তুমুল হলো। সকলে কেবল ভীত চোখে দেখতে লাগলো চারপাশ। সকলের মনে কেবল একটা প্রশ্ন, মৃত মানুষ ফিরেই বা কীভাবে?
#চলবে