#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-২
তূর্যর বাবা এক্সপার্ট ইমপোর্টের বিজনেস করেন। যাত্রাবাড়ী তে তার পাঁচতলা বাড়ি আছে। যার দোতলা ছাড়া বাকী টা ভাড়া দেয়া। তূর্য তিন বোনের আদরের ভাই। তাই আদরে মানুষ হওয়ার চেয়ে বাদর হয়েছে বেশী। পড়াশোনা করছে একটা প্রাইভেট ভার্সিটি তে। তার কাছে জীবন মানে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, আড্ডা দেয়া, জমিয়ে খাওয়া দাওয়া, ইশা, অনিক আর রাতের ঘুম। অনিকের মতো টাকার টেনশন, ইশার মতো নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা কোনোটাই নেই। তিনজনের মধ্যে টেনশন ফ্রী মানুষ শুধু তূর্য ই। অনিকের নিম্নবিত্ত পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা আর বাবার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা ই হলো আর্থিক সমস্যা। ইশার মা থাকেন সৌদি আরব। বাবা এক বছর বয়সে মারা গেলে ইশার মা মেয়েকে অনেক কষ্টে বছর চারেক পর্যন্ত বড় করেন। এরপর পরিবারের চাপে প্রবাসী এক ভদ্রলোক কে বিয়ে করেন। দশ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছে থেকে এরপর খালার সাথে ঢাকা থাকতে শুরু করে। খালা একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন শ্রীমঙ্গল থাকছে তাই ওর এখন হোস্টেলে থাকতে হচ্ছে আজিমপুরে।
ইশা পড়ছে তিতুমীর কলেজে অনার্স থার্ড ইয়ার।
স্বভাবে বদমেজাজী তবে মন ভালো থাকলে জমিয়ে গল্প করতে পারে। মেয়েলি স্বভাব অনেক টা কম। সাজগোজের প্রতি খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও লিপিস্টিক লাগাতে ভুল করে না কখনো।
☆
সকাল থেকে ইশার বুক কাঁপছে সাথে হাত পা ও। পীর সাহেবের কাছ থেকে একদিনে কী করে চালপড়া যোগাড় করলো সেটা ভেবে পেল না। ভেবেছিল যেদিন চাল পড়া খাওয়ার পর্ব হবে সেদিন কারও বাসায় ঘাপটি মেরে থাকবে। ঢাকা শহরে থাকার মতো আত্মীয় স্বজন না থাকলেও ইশার হুটহাট বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। তূর্যদের বিশাল বড় বাড়িতে ওর আদর আপ্যায়নের ত্রুটি করে না কেউ। এছাড়া ক্লাসমেট লুনা, পপি এদের সাথেও গলায় গলায় ভাব আছে।
ইশার রুমমেট ইশাকে এক মুঠ চাল দিয়ে বলল খাও। ও একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল, এখন ই?
“হ্যাঁ। একজন একজন করে খাব।
“আমাকে দিয়েই শুরু করতে হলো”?
“তুমি ভয় কেন পাচ্ছ”? তুমি তো আর একা না! চারতলার সব মেয়েরা খাবে।
ইশার চোখে পানি জমছে একটু একটু করে। এটা খুব ই খারাপ লক্ষন। কেঁদে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ইশা একবার রুমে থাকা বাকী মেয়েদের দিকে তাকালো। সবাই ই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেল নাকি! সবাই কী তবে ওকে সন্দেহ করছে!
কোনো কিছু না ভেবে চাল মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিবুতে শুরু করলো। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে শুরু করলো। বলল, হে আল্লাহ তুমি তো জানো আমি কেন টাকাটা চুরি করেছি। কয়েক মাস ধরে মা টাকা পাঠাচ্ছে না, কঞ্জুস খালা টাও গুনে গুনে টাকা দেয় এমন অবস্থায় আমার হাতে টাকা আসবে কী করে! তাছাড়া এই টাকা তো আর আমি নিজের জন্য নেই নি। নিয়েছি অনির জন্য। অনিটা অনেক দিন ধরে শুধু দুটো শার্ট আর প্যান্ট পরে ক্যাম্পাসে যায়। সামনে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। ওর জন্য তো কিছু ভালো জামাকাপড় এর দরকার। একজোড়া দুল বিক্রির টাকায় যা পাওয়া গেছে তাতে ঠিক ঠাক কিছুই হবে না। তাই তো এই টাকা টা চুরি করা হলো।
ইশা হঠাৎ খেয়াল করলো ভাবনার মাঝেই পুরো চাল খাওয়া শেষ হয়েছে। নিজেই অবাক হয়ে গেল। সত্যিই ওর কিছু হয় নি! অথচ কতকিছু ভেবেছিল।
চওড়া হাসি দিয়ে বলল, আরও চাল খেতে হবে? চাল খেতে ভালো ই লাগে।
উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইশা ঢক ঢক করে বোতলের সবটুকু পানি শেষ করে বলল, এবার তাহলে আসি কেমন!
নিচে নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যার টাকাটা নিয়েছে তার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। ভেবেছিল এখন নিলেও পরে যখন টাকা হবে তখন শোধ করে দিবে। কিন্তু কিভাবে যেন ব্যাপার টা টের পেয়ে গেল।
বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে অফিস রুমের দিকে গেল ইশা। এই রুম পাল্টাতে হবে। মেয়েটার চোখে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলতে পারবে না আর।
ইশা মনে মনে বলল, আল্লাহ এই অপরাধের জন্য আমাকে মাফ করে দিও। হাতে টাকা হলেই আপুটার টাকা দিয়ে দেব। আর তোমার দরবারে নামাজ পড়ে মাফ চাইলে ক্ষমা করে দিও। তুমি তো জানো আমার উদ্দেশ্য খারাপ না। অনি আর তূর্যর জন্য তো আমি জীবন টাও দিতে পারি।
———— ———- ———- —————
রুপা আজ ও সকালে বের হয় নি। এককাপ দুধ চা সুরাইয়া সামনে দিয়ে বলল, দুপুরে কী খাবি মা? কাচকি মাছের ঝোল করবো টমেটো দিয়ে?
রুপা চায়ের কাপে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ টাকা কোথায় পেলে মা?
“অনি কাল এক হাজার টাকা দিলো। সেটা দিয়েই হয়ে যাবে বাকী ক’টা দিন”।
রুপা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, মা আমি মাঝে মাঝে ভাবি আল্লাহ তোমাকে কেন ছেলেমেয়ে দিলো!
সুরাইয়া বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুপা আবারও বলল, আমি না হয় মেয়ে তাই আমার কথা ভাবলে না। কিন্তু তোমার বড় ছেলে সে যে এখান থেকে বিজয় স্মরনী পর্যন্ত হেটে টাকা বাঁচিয়ে দেয় সেটা তো তোমার অজানা নয়। তবুও কেন বেহিসেবী খরচ করো।
সুরাইয়া নতমস্তকে কথাগুলো শুনলো। প্রতিমাসে ভাবে পরের মাস থেকে হিসেব করে চলবে কিন্তু পারে না। আগের খরুচে স্বভাব এখনো রয়ে গেছে। রুপার বাবা যখন দেশের বাইরে থাকতেন তখন দুহাতে টাকা উড়িয়েছেন। সেই স্বভাব এখনো থেকে গেছে। কলোনীতে ফেরিওয়ালা এলে হাতে টাকা থাকলে এটা ওটা হুট করে কিনে ফেলে। আফসোস করে যখন টাকায় টান পড়ে।
সুরাইয়া একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, এরপর থেকে আর হবে না দেখিস।
“এরকম প্রতি মাসেই শুনি মা। বাবার ওষুধ খরচ, খাওয়া সব মিলিয়ে মাসে ন হাজার লাগে। আমার বেতন বারো হাজার। বাকী টা কোথা থেকে আসে? রাতে ওভার টাইম করি বলেই তো আসে নাকি! অনি ও তো যখন যা পারে তা দেয়। তবুও তোমার সংসারে নাই নাই কেন থাকে।
সুরাইয়া কিছু বললেন না। বলার মতো মুখ তার নেই। চুপচাপ শোনা ছাড়া আর কী ই বা করবে। মেয়েটার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে অথচ বিয়ে হয় নি। হবে কী করে! বিয়ে হলে তো বাকী সবাই না খেয়ে মরবে। সুরাইয়ার চোখে পানি এসে গেল। আগের দিন কতো ভালো ছিলো। দোকান থেকে বাজার করার সময় খুচরো পয়সা পর্যন্ত নিতো না আর এখন!
রুপা বলল, আমি তো শেষ হয়েই গেলাম। এবার বাকী আছে অনিটা শেষ হতে। এইরকম পরিবার দেখে কোন মেয়েই বা বিয়ে করবে! কে এসে থাকবে এমন মরা সংসারে।
চলবে……..
সাবিকুন নাহার নিপা
(২০২০ সালের লেখা গল্প। বানান ভুল ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ।)