বৃষ্টি থামার শেষে পর্ব -০৩

#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-৩
মঙ্গলবার দিন টা তে তিনজনেই একসাথে থাকে। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা,যা কিছুই হোক না কেন তিনজন একসাথে থাকে। এই নিয়ম টা চালু করেছিল তূর্য। কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক চায়ের আড্ডায় বলেছিল, আচ্ছা দোস্ত সপ্তাহের তো সাতটা দিন। এরমধ্যে কোনো একটা দিন কী আমাদের হতে পারে না?
দুজনেই নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, মানে? বুঝিয়ে বল তো!

“যেমন ধর প্রতি সপ্তাহে আমরা আমাদের কাজ করি। কলেজ করি, বাসায় যাই, টিউশনে যাই, সুযোগ পেলে সিনেমা কিংবা খেলা দেখি। আবার শুক্রবার ফ্যামিলির সাথে কাটাই। এরকম একটা দিন হতে পারে না যে আমরা পৃথিবীর সবকিছু ভুলে শুধু নিজেদের নিয়ে থাকব।

ইশা আর অনিক দুজনের ই প্রস্তাব টা ভালো লাগলো। তূর্য ফান লাভিং ছেলে। যার একশ কথার মধ্যে সিরিয়াস কথা থাকে মোটে একটা। অনিক মুগ্ধ গলায় বলল, দারুণ বলেছিস তো। সত্যিই তো! লাইফে একটুখানি চেঞ্জের দরকার আছে। সপ্তাহে ছ’টা দিন তো আমরা রুটিনের মধ্যেই থাকি। একটা দিন তো নিজেদের জন্য দরকার।

তূর্য খুশিতে বাক বাকুম করে বলেছিল, আরে আমি তো সব সময় ভালো ই বলি।

তারপর ঠিক হলো মঙ্গলবার দিনটাই হবে বন্ধুবিলাশের দিন।

কতো যে ক্লাস মিস করে, ফ্যামিলি ফাংশন ছেড়ে নিজেদের মতো ঘুরে ফিরে কাটিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।

ইশা, অনিক আর তূর্যর বন্ধুত্ব হয়েছিল স্কুলে পড়াকালীন সময়ে। অনিক আর তূর্য তখন একই এলাকায় থাকে। অনিকের বাবার অবস্থা ও তখন বেশ স্বচ্ছল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দুজন একই দলে খেলতো। অনিক বর্তমানের মতো ই নরম, ভীতু টাইপের। ক্লাসের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতো। সবাই ডাকতো পুটিমাছ। কেউ দলেও খেলতে নিতে চাইতো না। কোনো এক বিচিত্র কারণে তূর্য ওর দলে অনিক কে খেলতে নিতো। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন। হঠাৎই ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষায় চোখ ধাধানো রেজাল্ট করে সবার নজরে এসে গেল অনিক। সবাই এখন আসে অনিকের সাথে বন্ধুত্ব করতে। চুপচাপ স্বভাবের মুখচোরা অনিক কারও সাথেই খুব একটা মিশে না। কেউ মিশতে এলেও মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অন্যদিকে অনিকের ভালো রেজাল্ট দেখে তূর্য আর ওর সাথে ভাব করতে আসে না, আগে একসাথে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে গুটুর গুটুর গল্প করতো এখন সেটাও করেনা। খেলতে গেলেও এখন আর অনিকের দলের অভাব হয় না। তাই তূর্য আর খেলার জন্যও বলে না। কিন্তু অনিক চায় তূর্যর দলে খেলতে।

একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় অনিক ডেকে বলল, এই শোনো?

তূর্য দাঁড়িয়ে যায়। বলে, কী বলবে?

অনিক কিছুসময় চুপ করে থেকে বলল, আমাকে এখন আর তোমার দলে খেলতে কেন নাও না? আমি তো এখন একটু একটু ভালো খেলি।

তূর্য দাঁত বের করে হেসে বলল, আরে তোকে তো আগে ট্যাবলেট ভাবতাম। কেউ তোকে খেলায় নেয় না তাই খারাপ লাগতো।

অনিক মুখভার করে বলল, আমি কিন্তু তোমার দলেই খেলব।

“আচ্ছা খেলিস। তোকে তো এখন সবাই দলে নিতে চায়”।

তূর্য সেদিন খুব খুশি হয়েছিল। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটি তার দলে থাকলে সবাই ওকে ঈর্ষার চোখে দেখবে। একটু হলেও ওর দাম বাড়বে। এমনিই তো ব্যকবেঞ্চার বলে দাম নেই। যা একটু মান্যিগন্যি সে তো ওই খেলার মাঠেই।

এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা মাস। খেলার মাঠের বন্ধুত্বটা এরপর ক্লাসরুমে এসে ও ঠেকলো। অনিক তূর্যকে ছাড়া বসে না। তূর্য পিছনের বেঞ্চে বসলে অনিক ও সেখানে যায়।

বছর শেষে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে তূর্য গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যায়। ফিরে আসে দিন পনেরো বাদে। ফিরে এসে সাথে দেখা করতে গেলে অনিক দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরে। তূর্য খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলে, আরে কী করছিস! দম বন্ধ হয়ে যদি মরে যাই!

অনিক উচ্ছ্বাস চেপে রেখে বলেছিল, তুমি আমার বন্ধু হবে?

“হ্যাঁ হবো”।

“প্রানের বন্ধু হবি?”

তূর্য মাথা চুলকে বলল, প্রানের বন্ধু কেমন করে হতে হয়?

“কখনো আমায় ছেড়ে যাবি না, মারামারি করবি না, আমি ছাড়া আর কারও সঙ্গে বসবি ও না।

“ওহ এই কথা। আচ্ছা যা আজ থেকে আমি তোর প্রানের বন্ধু”।

“সারাজীবন থাকবি তো?”

“হ্যাঁ থাকব। বড় হয়ে বিয়ে করলেও আমি তোর প্রানের বন্ধু থাকব”।

এভাবেই ছোটবেলার বন্ধুত্ব বড়বেলা পর্যন্ত অটুট থাকলো। এই দুজনের নাম রুপা দিয়েছিল মানিকজোর। একজনের জ্বর হলে অন্যজন ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে একসাথে থাকতো। একটা চকলেট দুইভাগ, একটা হাওয়াই মিঠাই দুজন মিলে ভাগ করে খেত।

এই ভাগাভাগি তে আরেকজন এসে ভাগ বসায়। সে ছিলো ইশা। সিক্সে এসে ইশা ভর্তি হয়েছিল ওদের ক্লাসে। ইশা ই ক্লাসের একমাত্র মেয়ে ছিলো যে সবকিছু পারে। সবার চোখে মুগ্ধতা সৃষ্টি করা ইশা প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই সবার সাথে মিশে গেল। তবে বারবার চেষ্টা করলো তূর্য আর অনিকের সাথে মিশতে। কিন্তু অনিক সেটা পছন্দ করলো না। তূর্য চাইলেও সেটা বেশীদূর এগুলো না।

ইশা হ্যাংলার মতো লেগে থাকলো। বারবার বলতে লাগলো, এই তোদের দলে আমাকেও নে না।

অনিক কঠিন গলায় বলেছিল, না নেয়া যাবে না।

ইশা এরপর আর ঘাটাতে এলো না। দূরে দূরেই থাকলো। স্কুলের এ্যানুয়াল ফাংশনে যখন ইশাকে দেখা গেল না তখন তূর্য অনিক কে বলল, অনি ছোট চুলের ওই মেয়েটা তো সব পারে। তাহলে এলো না কেন?

অনিক চিন্তিত গলায় বলল, জানিনা তো!

“অসুস্থ হলো নাকি?”

“হতে পারে”।

ফাংশনের তিনটে দিন দুজনেই অপেক্ষায় ছিলো ইশা আসবে। কিন্তু আসেনি।
ফাংশন শেষে যথারীতি ক্লাস শুরু হলে ইশা এলো। তূর্য ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এলে না কেন? ড্র‍য়িং, ডিবেট, এগুলো তে নাম ছিলো না?

ইশা বিমর্ষ গলায় বলল, এমনিই।

“ধুর, এমনি এমনি কেউ এ্যানুয়াল ফাংশন মিস করে”? কতো মজা হয়!

“অনেক মজা হয়”?

“হ্যাঁ “।

ইশা মন খারাপ করে নিজের সিটে চলে গেল। অনিক বলল, মেয়েটার মনে হয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে।

তূর্য বিজ্ঞের মতো বলল, আমার মনে হয় ওর বাবাটাও আমার বাবার মতো জল্লাদ।

“এক কাজ করলে কেমন হয়! স্কুল ছুটির পর ওকে ওর সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলাম!

“হ্যাঁ সেটাই ভালো হয়”।

স্কুল ছুটির পর অনিক বলল, তোমার কী কোনো সমস্যা ইশা?

ইশা খেকিয়ে উঠে বলল, সেটা তোকে কেন বলব? তুই কী আমার বন্ধু?

অনিক চুপসে গেল । তূর্য আমতা আমতা করে বলল, না আমরা তো বন্ধুর মতো ই।

“না তোরা আমার বন্ধু না”।

অনিক ভনিতা না করে বলে ফেলল, আসলে তুমি আসোনি দেখে আমাদের খুব খারাপ লেগেছে। আমরা আশায় ছিলাম যে আসবে।

ইশা বিস্মিত হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল, সত্যি? নাকি ঢপ?

তূর্য জোর গলায় বলল, বিশ্বাস না করলে কসম করতে পারি।

ইশা কিছু বলল না। তবে শক্ত মুখ টা উজ্জ্বল হলো। বিড়বিড় করে বলল, তোরা আমায় মিস করেছিস!

তূর্য তুমি থেকে তুই’তে নেমে বলল, এবার বল তোর কী হয়েছে?

“কিছু হয় নি”।

“তাহলে আসলি না কেন”?

“আসলে এসব ফাংশনে সবাই বাবা মায়ের সাথে আসে তো। আমার তো কেউ নেই। খালার সাথে থাকি, খালা এসব পছন্দ করেন না। তাই আসা হয় নি।

দুজনের ই মন খাবার হয়ে গেল। তূর্য বলল, তোর বাবা, মা কই?

“বাবা মরে গেছে। আর মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছে”।

“সে তোর সাথে থাকে না”?

“এতোদিন তার সাথে ই থাকতাম। এখন তার তিনটা বাবু তো তাই আমার দিকে খেয়াল করতে পারে না। তাই খালার কাছে পাঠিয়ে দিলো।

ইশাকে বিদায় দিয়ে দুজনেই বিষন্ন মুখ নিয়ে বাড়িতে ফিরলো। পরদিন স্কুলে এসে অনিক ই ইশাকে ডেকে বলল, তুই আমাদের বন্ধু হবি? প্রানের বন্ধু?

ইশা অবাক হয়ে বলল, প্রানের বন্ধু কী করে হয়?

“আমাদের ছেড়ে কোনোদিন যেতে পারবি না, রাগ করলে কথা বন্ধ করবি না। কোনোদিন ভুলেও যাবি না। ”

“এগুলো করলেই প্রানের বন্ধু হওয়া যাবে?

“হ্যাঁ “।

ইশা যেন এরকম একটা অফারের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। বলল, আরে এসব তো খুব সোজা।

তূর্য বিজ্ঞের মতো বলল, খুব সোজা না। তোর বিয়ে হলে এমন কি বাবু হলেও আমাদের ভুলতে পারবি না। প্রমিস করতে হবে।

“আচ্ছা প্রমিস করবো”।

অনিক বলল, তাহলে আজ থেকে তুই ও আমাদের প্রানের বন্ধু।

কোনো সম্পর্কে দুইজনের জায়গায় তিনজন এলেই মতোবিরোধ, মনোমালিন্য হয় কিন্তু ওদের সেটা হয় নি। একটা চকলেট কে দুই ভাগের জায়গায় তিনভাগ হয়েছে, হাওয়াই মিঠাইয়ের ভাগ ও তিনটে হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কে ফাটল কিংবা বিরোধ হয় নি।

বছর দুয়েক পর রুপা একদিন ডেকে বলল, ভেবেছিলাম তোদের সম্পর্ক থাকবে না। তাই এতোদিন নাম দেই নি। আজ তোদের নাম দিলাম ত্রিরত্ন। সারাজীবন একজন আরেকজনের জীবনে এমন করে রত্ন হয়ে থাকিস।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here