#বেদনার_রঙ_নীল
সাইত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
বসার ঘরে জড়ো হয়ে বসল সবাই। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু প্রণয়-তুলি। রাইফা এতোরাতে বাইরে কেন গিয়েছিল সেই ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করল না। সবার কৌতুহল প্রণয় আর তুলি একই ঘরে কি করছিল সেটা নিয়েই। তুলি মাথা নিচু করে বসে আছে। একহাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখল লজ্জায়। প্রণয় ইতস্তত ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করল,” আমি কি বিষয়টা কি ক্লিয়ার…”
হেলাল সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাতের ইশারায় থামতে নির্দেশ দিলেন। প্রণয় থেমে গেল। তুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেলাল সাহেব বললেন,” প্রথমে যখন তুই ওর সাথে বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছিলি তখনি আমি জানতাম তোদের মধ্যে কিছু আছে। কিন্তু পরে তুই সব অস্বীকার করলি। আমি যেই না তোর কথা বিশ্বাস করলাম তখনই তুই এমন একটা কান্ড ঘটালি। এখন আমি কি বুঝবো? কোনটা বিশ্বাস করবো?”
তুলির লজ্জিত চেহারা চুপসে গেল। প্রণয় তাকে জবাবদিহির হাত থেকে বাঁচাতে আবার কিছু বলতে নিল, তখন হেলাল সাহেব তাকে পুনরায় নিষেধ করলেন। থমথমে কণ্ঠে বললেন,” তুমি চুপ থাকো। আমি শুধু তুলির কথা শুনতে চাই।”
অগত্যা প্রণয়কে চুপ থাকতেই হলো। হেলাল সাহেব বললেন,” এদিকে আয় তুলি।”
তুলি উঠে এলো। তাকে নিয়ে অন্য একটি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলেন হেলাল সাহেব। বাইরে সবাই আতঙ্কিত। না জানি কি হয়!
তুলি মাথা নত রেখেই বলল,” আমাদের মধ্যে সত্যিই কিছু নেই মামা। তুমি অযথাই ভুল বুঝছো।”
” তাহলে ঠিকটা তুই বুঝিয়ে দে! ভুল ধারণা নিয়ে আমাকে কেন থাকতে দিবি? এতোরাতে প্রণয় তোর ঘরে কি করছিল বল?”
তুলি আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,” ও আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল। আর তখন তুমিও ঘর থেকে বের হচ্ছিলে। তাই আমি দরজা আটকে দিলাম।”
” সেটাই তো। তুই দরজা আটকাবি কেন?”
” ভুল হয়ে গেছে।”
” এইটা আবার কেমন ভুল? প্রতিদিনই কি এই ভুল হয়? ”
” ছিঃ, একদম না। প্রতিদিন কেন হবে?”
” তার মানে শুধু আজকেই হয়েছিল আর আজই আমি দেখে ফেললাম?”
” মামা তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছো। আমাকে এই চিনলে?”
হেলাল সাহেব আঙুল উঠিয়ে বললেন,” ইমোশনাল ব্লেকমেইল করবি না। যেদিন তোরা এলি সেদিন রাতে কিন্তু প্রণয়কে আমি আমাদের ঘরে থাকার কথা বলেছিলাম। ও রাজি হয়নি। ও ব্যালকনিতে থাকতে চেয়েছিল। তুইও ওকে সাপোর্ট করেছিলি। এই তাহলে আসল কারণ?”
তুলি চোখ বড় করে বলল,”এসব তুমি কি বলছো?”
” ঠিকই বলছি। আমরা বাইরের ঘরে ঘুমালে প্রণয়ের মাঝরাতে তোর ঘরে আসতে অসুবিধা হয়ে যেতো এজন্য সে ইচ্ছে করে বাইরের ঘরে ঘুমাতো। যাতে..”
তুলি করুণ গলায় আওড়ালো,” প্লিজ মামা, এইসব বলা বন্ধ করো। আমি আর শুনতে পারছি না। এতো বাজে চিন্তা তুমি আমাদের নিয়ে কিভাবে করলে?”
হেলাল সাহেব হাত ভাঁজ করে বললেন,” ঠিকাছে। আলোচনা বন্ধ করলাম। কিন্তু..”
বিরক্তি নিয়ে তাকাল তুলি। হেলাল সাহেব শক্ত গলায় বললেন,” কাল চেয়ারম্যান বাড়িতে সামির-তন্বির বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে। আর এই বাড়িতে হবে বিয়ের অনুষ্ঠান। তোদের দু’জনের।”
তুলি মাথা দুলিয়ে ‘আচ্ছা’ বলতে নিয়েও থেমে গেল। ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই আৎকে ওঠা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কি?”
হেলাল সাহেব অটল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। তুলি কাঁচুমাচু মুখে বলল,” এসব তুমি কি বলছো মামা? আমাদের বিয়ে হবে মানে? আগামী পাঁচ বছর অন্তত আমার বিয়ের কোনো প্ল্যান নেই। অসম্ভব!”
” এখন এই কথা বলা সাজে না। তোরা যে কান্ড করেছিস তাতে বিয়ে ছাড়া আমি আর কোনো গতি দেখি না।
” মামা প্লিজ, এইরকম কোরো না।”
” যদি মন থেকে আমাকে মামা ভেবে থাকিস তাহলে আমার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব তুই দিবি। নয়তো আবার পালিয়ে যা। আর কখনও এই বাড়িতে আসার দরকার নেই।”
হেলাল সাহেব কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তুলি বিছানায় বসে পড়ল ধপ করে। খানিক বাদেই রাইফা, আশা আর তন্বি ঘরে ঢুকল। তুলি কাঁদছে।
হেলাল সাহেব গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলেন,” আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকালের অনুষ্ঠানে প্রণয় আর তুলির বিয়ে সেড়ে ফেলবো।”
সবাই হতবাক হয়ে গেল এই কথা শুনে। হেলাল সাহেব আঁড়চোখে প্রণয়ের দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন,” তুমি কি বলো?”
প্রণয় হকচকিয়ে গেল। একবার তুলির দিকে চাইল সে। তার কি বলা উচিৎ? ঠিক করতে পারল না। প্রণয়ের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে হেলাল সাহেব বললেন,” আমি আশা করছি তোমার দ্বিমত নেই।”
প্রণয় বিনীত কণ্ঠে বলল,” আপনি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবেই নিয়েছেন! আমার কোনো সমস্যা নেই।”
তুলি অগ্নিদৃষ্টিতে প্রণয়ের দিকে ঘুরে চাইল। কটমট করে বলল,” এইখানে ভালোর কি দেখলেন আপনি? কোনদিক থেকে এটা ভালো সিদ্ধান্ত হলো?”
রাইফা আর তন্বি একে-অন্যের দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগল। সামির এবং আশা কেবল পরিস্থিতি দেখছে। তারা মতামত প্রকাশ করবে কি-না এই নিয়ে খুব বিভ্রান্তিতে আছে। হেলাল সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,” প্রণয় তাহলে সিদ্ধান্তে অমত করছো না। তাইতো?”
তুলি ফটাফট বলল,” আমি অমত করছি। তুমি এমন হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।”
” তাহলে কি করবো? আমার বাড়িতে থেকে তোরা যা ইচ্ছা করবি আর আমি সহ্য করবো? তুই সামিরকে বিয়ে করতে চাসনি বলে প্রণয়ের সাথে পালিয়েছিলি। এখন আমি ওর সাথেই তোকে বিয়ে দিতে চাইছি। তবুও তোর সমস্যা কেন?”
তুলি আমতা-আমতা করে বলল,” প্রণয়ের ফ্যামিলি আছে। সে কি সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করতে পারবে? এটা কিভাবে হয়?”
প্রণয় তৎক্ষণাৎ বলল,” আমি বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিবো। ”
তুলি কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। নরম হেসে প্রণয় আবার বলল,” ফ্যামিলি ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”
হেলাল সাহেব সন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,” তাহলে ব্যবস্থা হয়ে গেল। আগামীকাল বিয়ে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিশ্চিত।”
আশা বিব্রত কণ্ঠে বলল,” এতো তাড়াহুড়ো করা কি ঠিক হবে?”
হেলাল সাহেব বললেন,” তাড়াহুড়ো কোথায় হচ্ছে? বরং আমার তো মনে হয় দেরি হয়ে গেছে। এই কাজ আরও আগে করলে এইদিন দেখতে হতো না।”
হেলাল সাহেব নিজের ঘরে ঢুকলেন। আশা স্বামীর পিছু নিল।
প্রণয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? তুলির মামাকে সে বেহুদা মানুষ ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলোক যথেষ্ট বুদ্ধিমান। নাহলে এতো দারুণ সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারে?
প্রণয় একবার তুলির দিকে চাইল। তুলি রা গা ন্বিত ভঙ্গিতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। খিটমিট করে বলল,” এটা আপনি কেন করলেন? কেন রাজি হলেন?”
প্রণয় সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,” রাজি না হওয়ার তো কিছু নেই। এতো ভালো একটা কাজ করতে আমি রাজি হবো না?”
” আপনার গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।”
রাইফা তুলির কাঁধে হাত রেখে বলল,” আচ্ছা, কাম ডাউন।”
তুলি চিৎকার করে বলল,” কেউ আমাকে কিছু বোঝাতে পারবে না৷ আমি বিয়ে করবো না মানে করবো না৷ ইম্পসিবল!”
প্রণয় নির্জীব গলায় বলল,” ঠিকাছে, তাহলে আমি মামার সঙ্গে কথা বলে দেখছি ক্যান্সেল করা যায় কি-না। ”
তুলি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,” কোনো প্রয়োজন নেই।এখন গেলে মামা ভাববে আমি আপনাকে পাঠিয়েছি।”
রাগ করে তুলি দরজা আটকে দিল। প্রণয় কয়েক পা পিছিয়ে মুচকি হাসল। দুশ্চিন্তার কারণে মাথায় ব্যথা হচ্ছে তুলির। রাইফা অপরাধী কণ্ঠে বলল,” স্যরি। আমার জন্যই এতোসব ঝামেলা হয়ে গেল। ”
তুলি মাথায় মালিশ করতে করতে বলল,” উহুম। তোর দোষ নেই। দোষ আমার ভাগ্যের।”
” এখনও কি তুই আমার উপর রেগে থাকবি?”
” জানি না।”
তুলি বাতি নিভিয়ে দিল। রাইফাও চুপ হয়ে গেল। একটু পর তুলি নিজে থেকেই জানতে চাইল,” তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? ”
রাইফার ঠোঁটে হাসি ফুটল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,” রিসব এসেছিল জানিস?”
তুলি অবিশ্বাস্য গলায় উচ্চারণ করল,” কি? সত্যি?”
” হুম। কফিশপের ওই ইন্সিডেন্টটা নাকি ও ভুলতে পারছে না৷ তাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এতোদূর এসে গেছে। ”
” তুই উনাকে বাড়িতে আনলি না কেন? কি আশ্চর্য!”
” আমি আর তন্বি মিলে এতো অনুরোধ করলাম তাও সে এলো না। তার নাকি ট্রেনিং-এ যেতে হবে। আমার থেকে বিদায় নিতে এসেছিল।”
তুলি আগ্রহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” বিদায় নিতে এসে কি কি করল?”
তুলির ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই রাইফা নাক সিঁটকে বলল,” ছিঃ, কিছুই করেনি। শুধু একটু গল্প আর ঘুরাঘুরি করেছি। ”
” আর কিছু না? প্রেমের বিষয়েও কিছু বলেনি?”
” শুধু বলেছে তার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তুই তো জানিস, তার এইটুকু কথাই আমার জন্য অনেক!”
তুলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পরদিন সকালে জিলা হাসপাতাল থেকে রাইফার কাছে ফোন এলো। রিসব হাসপাতালে ভর্তি। রাইফা, প্রণয়, তুলি হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল। সাত-আটজন মিলে রিসবকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। সকালে একজন ভ্যানগাড়ি চালক তাকে ঝোঁপঝাড়ে পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে তুলে এনেছে। রাইফা তাকে আহত অবস্থায় দেখে কান্না শুরু করে দিল। প্রণয় সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে নিশ্চিত হয়ে গেল যে এই সবকিছুতে আজমীরের হাত আছে। হয় সে প্রণয়কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এইটা করেছে নয়তো রিসবকে অন্ধকারে প্রণয় ভেবেছিল! এই ধারণা সে কারো কাছে প্রকাশ করল না। তবে মনে মনে ঠিকই সিদ্ধান্ত নিল আজমীরকে শায়েস্তা করবে।
দুপুরে রিসবকে নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো। কিন্তু প্রণয় তাদের সঙ্গে ফিরল না। সে চেয়ারম্যান বাড়িতে গেল। আজ তন্বি-সামিরের বৌভাতের অনুষ্ঠান। হেলাল সাহেব আর আশা আগেই সেখানে চলে গেছেন। তুলিরা রিসবকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দেখল বাড়ি ফাঁকা। রাইফা রিসবকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকল। আশেপাশে দেখে রিসব বলল,” মানুষ-জন কোথায়?”
” তন্বি-সামিরের বৌভাতের অনুষ্ঠানে গেছে মামা আর মামী। সন্ধ্যায় ফিরে আসবে। আপনাকে কিছু দিবো? এখানে কিন্তু কফি পাওয়া যায় না। চা চলবে?”
” আপাতত তুমি পাশে বসো। তাহলেই চলবে।”
রাইফার আনন্দে লাফানোর জন্য আজকে এই ছোট্ট কথাটাই যথেষ্ট। সে বাক-বাকুম হয়ে রিসবের পাশে বসল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও তার চোখ-মুখ থেকে খুশি ঠিকরে বের হচ্ছে। রিসব কি বুঝে ফেলছে?
” প্রণয় কোথায় গেল রাইফা? বলেছে কিছু?”
” জানি না তো। ফেরার সময় বলল আপনার খাওয়ার জন্য কিছু কিনে আনবে। তারপর এখনও আসেনি।”
” এতোক্ষণ তো লাগার কথা না৷ এই এলাকা এমনিতেও সেইফ না। আমার টেনশন হচ্ছে। বাইরে গিয়ে দেখবো একবার?”
” আরে থামুন, প্রণয় এসে পড়বে। ও তো এখানকার সবকিছুই চেনে। বন্ধুর গ্রাম বলে কথা। আর এখন তো এটা ওর শ্বশুরবাড়িও হতে যাচ্ছে।”
” শ্বশুরবাড়ি মানে?” রিসব একটু অবাক হলো। রাইফা হাসতে হাসতে বলল,” ওহ, আপনাকে বলা হয়নি। গতরাতে কি হলো জানেন? আমি যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে বের হলাম তখন মামা আমার খোঁজ করছিলেন। তুলি প্রণয়কে আমি সাজিয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে বিছানায় শুয়িয়ে রাখল। আর তখনি আমি বাড়িতে ঢুকলাম। ব্যস, ধরা খেয়ে গেল ওরা। তারপর মামা অন্যকিছু ভেবে নিলেন। তিনি রেগে প্রণয়- তুলির বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তাই আজ সন্ধ্যায় তাদের বিয়ে হচ্ছে।”
রিসব চোখমুখ বিকৃত করে বলল,” কি? সত্যি এসব হয়েছে?”
” হুম।”
” খুবই লেইম ব্যাপার। ওদের এমন করার প্রয়োজনই ছিল না। তুমি বাইরে আছো এটা বলে দিলেই হতো।”
” হ্যাঁ তা বলা যেতো। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে, প্রণয় তো ইচ্ছে করেই তুলির ঘরে ঢুকেছিল। এই ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যেই এতো নাটক। মামা খুব রাতে প্রণয়কে তুলির ঘরে দেখলে কি ভাবতো বলেন?”
রিসব মৃদু হেসে বলল,” তাহলে তো মামা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।”
রাইফা খিলখিল করে হাসতে লাগল। এমন সময় প্রণয় বাড়িতে ঢুকল৷ তাকে দেখে তুলি আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,” আরে, কি সর্বনাশ! আপনার এই অবস্থা কি করে হলো?”
প্রণয় আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলল,” শশশ, শান্ত থাকো। তেমন কিছু হয়নি।”
” গাল, ঠোঁট, কপাল সব জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। তাও আপনি বলছেন কিছু হয়নি? মানে কি আজব! আমি বরফ আনছি এখনি।”
তুলি ছুটে যেতে নিলেই প্রণয় তার হাতটা চেপে ধরল। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,” রাইফা কোথায়? ওকে ডাকো।”
” তার আগে আপনি বলুন যে আপনার কি হয়েছে? এই অবস্থা কেন? আজমীরের সাথে আবার লাগতে গিয়েছিলেন আপনি? সে এতোবড় ক্ষতি করতে যাচ্ছিল আপনার। তবুও কেন শুধু শুধু তার সঙ্গে ঝামেলা করে বিপদ ডেকে আনছেন? রিসব ভাইয়াও বিপদে পড়ল। আর এখন আপনি…”
প্রণয় সামান্য রেগে আগের মতো আবার বলল,” রাইফাকে ডাকো তুলি।”
তার ভারী কণ্ঠ শুনে তুলি একটু ভড়কে গেল৷ তারপর আছড়ে আছড়ে পা ফেলে চলে গেল রাইফাকে ডাকতে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রথমে কাশি দিল সে। রিসব প্রশ্ন করল,” প্রণয় এসেছে নাকি তুলি?”
তুলি গম্ভীর গলায় বলল,” এসেছে। না জানি কার সাথে লেগে এসেছে! আহত অবস্থা।”
রিসব অস্থির কণ্ঠে আওড়ালো,” বলো কি?”
সে বের হলো। তুলি রাইফার দিকে চেয়ে বলল,” তোকেও ডাকছে আয়।”
রিসব ছুটে এসে বলল,” প্রণয়, কি হয়েছে তোর?”
” কিছুই হয়নি। জাস্ট ব্যথা পেয়েছি।”
তুলি প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,” ব্যথা পেলে এই অবস্থা হয়? নির্ঘাত কারো সাথে লাগতে গিয়েছিলেন।”
প্রণয় থমথমে গলায় বলল,” সেরকম কিছুই না।”
” সত্যি কথা বল প্রণয়! ” রিসব ধমকালো। প্রণয় রাইফার দিকে চেয়ে বলল,” সত্যি কথা তো রাইফা আমাদের বলবে। কালরাতে তুমি কোথায় ছিলে রাইফা?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে রাইফা থতমত খেল। বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” মানে?”
” ঠিকঠাকভাবে মনে করো। কালরাতে তোমার সাথে কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি?”
রাইফা কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে অপরাধী স্বরে বলল,” হ্যাঁ। কয়েকটা ছেলে আমাকে ফলো করছিল। তারপর আমি ধমক দিতেই তারা চলে গেল। আমি ভাবলাম হয়তো গ্রামের বখাটে।”
প্রণয় কোমরে হাত রেখে অবজ্ঞাসূচক হাসল। তারপর গরম কণ্ঠে বলল,” তুমি কি ভেবেছো? তারা তোমার ধমকে ভয় পেয়ে সরে গেছে? আর এই কথা তুমি কাউকে জানালেও না? আরে কিডন্যাপার ছিল ওরা!”
সবাই আৎকে উঠল এবার। রাইফা প্রশ্ন করল ত্বরিতে, ” তুমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছো? তারা তো আমার কোনো ক্ষতি করেনি।”
” ক্ষতি করেনি কারণ তারা তুমি তাদের টার্গেট না। তাদের টার্গেট ছিল তুলি। হয়তো তোমার মুখ দেখেই ওরা চলে গেছে। কিন্তু পেছন থেকে তোমাকে তুলি ভেবেছিল। ওইসময় যদি তুমি মুখ না দেখাতে তাহলে আজকে তুলির জায়গায় তুমিই কিডন্যাপ হয়ে যেতে পারতে।”
তুলির হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল৷ ভয়ে চোখ প্রসারিত। রাইফা মুখে হাত দিয়ে বলল,” ও মাই গড!”
” ডেঞ্জারাস! তুলিকে কারা কিডন্যাপ করতে চায়?” রিসব জিজ্ঞেস করল।
” আজমীর।” প্রণয়ের জবাব।
তুলি এই কথা শুনে একদৌড়ে ঘরে ছুটে গেল। রাইফাও তার পেছনে গেল। তুলি ভয়ে কাঁপতে লাগল। কারণ এই মুহূর্তে তার মনে পড়ছে গতরাতে দিঘীর কাছে ওই ঝোঁপের আড়াল থেকে টর্চ মারার ঘটনা। প্রণয় যদি সময়মতো না আসতো তাহলে আজকে ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারতো। তুলি চাপ অনুভব করছে বুকে। অসম্ভব আতঙ্ক লাগছে তার। আজমীর এতো নিকৃষ্ট কেন? রাইফারও গলা শুকিয়ে এলো। সে পানি খাচ্ছে। একটু পর বলল,” আমি চিন্তাও করতে পারছি না তুলি। ওই আজমীর বদমাইশ এতো খারাপ!”
তুলি কথা বলছে না। প্রণয় দরজায় কড়া নাড়ল। রাইফা তাকিয়ে বলল,” এসো।”
প্রণয় তুলিকে দেখতে দেখতে বলল,” তুমি যাও রাইফা। আমি একটু তুলির সাথে কথা বলবো।”
” ওকে।”
রাইফা বের হওয়ার পর প্রণয় তুলির কাছে এসে বলল,” ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই একদম। কাল সকালেই আমরা এখান থেকে চলে যাবো। গট ইট?”
তুলি ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” আপনি আজমীরের সাথে কি করেছেন?”
” সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?”
তুলি জেদী গলায় বলল,” অবশ্যই দরকার আছে। যদি সে আপনাকে কিছু করে ফেলতো?”
প্রণয় পাল্টা প্রশ্ন করল,” আর যদি সে তোমাকে কিছু করে ফেলতো?”
এই কথায় থেমে গেল তুলি। একটু নীরব থেকে আবার বলল,” তবুও আপনার এসব করা উচিৎ হয়নি। আমার জন্য আপনি বিপদে পড়তেন…”
তুলির কথার মাঝেই প্রণয় জড়িয়ে ধরল তাকে। চুপসে গেল তুলি। জড়পদার্থের মতো জমে গেল তার শরীর। প্রণয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” যতক্ষণ আমি আছি, ততক্ষণ তোমার ছায়াও নিরাপদ। কেউ ত্রিসীমানাতেও আসতে পারবে না।”
তুলি মাথা নিচু করে বলল,” আর যদি আমিই আপনার কাছে না থাকি?”
” আমি সবসময় তোমার পেছনেই থাকবো।”
” পেছনে থাকার অনুমতি না দিলে?”
” লাগবে না অনুমতি। এটা আমার অধিকার।”
” কিরকম অধিকার?”
” আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমাকে প্রটেক্ট করার অধিকার আমার সবসময় থাকবে। তুমি না দিলেও থাকবে।”
তুলি হালকা রাগার ভাণ ধরে বলল, ” ও আচ্ছা তাই? আর কি কি অধিকার থাকবে আমার উপর?”
প্রণয় কথা না বলে তুলির ঠোঁটে চুমু দিল। হতভম্ব হয়ে তুলি বেশ কয়েক মুহূর্ত স্থির বসে রইল। তারপর ছটফটিয়ে উঠল। প্রণয়কে ধাক্কাতে লাগল। প্রণয় তাকে দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরল। তুলি অসহ্য কণ্ঠে গর্জে উঠল,” এসব কি? এটাও কি আপনার অধিকার?”
প্রণয় হেসে জবাব দিল,” না। এটা আমার ভালোবাসা।”
” লাগবে না এমন ভালোবাসা আমার। ছিঃ!”
চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
আটত্রিশতম পর্ব(৩৮)
লিখা- Sidratul Muntaz
রিসব ক্লান্ত ছিল। তাই বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মাথাটা হালকা কাত হয়ে আছে। রাইফা খুব সাবধানে তাকে শুইয়ে দিল। যেন তার ঘুম না ভাঙে। রিসবের ঘুম ভাঙল না। বরং সে যেন আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কপালে এবড়োখেবড়ো সাদা ব্যান্ডেজ। মুখে ক্ষতচিহ্ন। মলিন চেহারা। তবুও রাইফার মনে হচ্ছে এই মুখ পৃথিবীর সেরা সুন্দর মুখ। এতো মুগ্ধতা আর কোনো মুখে নেই। সে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইল। আহা, আর কত অপেক্ষা? এই মানুষটা কি কোনোদিনও তার ব্যক্তিগত হবে না? সে আর কত দূরে দূরে থাকবে? ঘুমানোর আগেও রিসব ট্রেনিং এ যাওয়ার ব্যাপারে বলছিল। তার পাহাড় ভ্রমণ কবে শেষ হবে? রাইফা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার স্বপ্নগুলো বেশিরভাগ সময় রিসবকে ঘিরেই হয়। সে দেখে, রিসব তার দুনিয়া তুচ্ছ করে শুধু রাইফার একান্ত হয়ে ফিরে এসেছে। এই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবুও রাইফা স্বপ্ন দেখে। কেন যে দেখে!
দরজায় টোকা পড়ল। পেছনে ঘুরতেই রাইফা দেখল তুলি দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ভর্তি জলে।রাইফা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটে এলো। উদগ্রীব কণ্ঠে জানতে চাইল,” কি হয়েছে তুলি?”
মাথা নিচু করে তুলি সামান্য লজ্জা এবং সামান্য ক্রোধ মেশানো কণ্ঠে বলল,”প্রণয় আমাকে চুমু দিয়েছে।”
রাইফার প্রথমে মনে হলো সে ভুল শুনেছে। তারপর কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলল,” তুই কি এজন্যই কাঁদছিস?”
তুলি মাথা নাড়ল। রাইফা নিশ্চিত হতে আবার বলল,” মানে প্রণয় তোকে চুমু দিয়েছে এজন্য কাঁদছিস?”
তুলি একটা রেগে জবাব দিল,” হ্যাঁ। ”
রাইফা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হেসে উঠল। তুলির মেজাজ আরও উত্তপ্ত হয়ে গেল। সে তাকালো প্রসারিত দৃষ্টিতে। রাইফা হাসতে হাসতে বলল,” আমি হলে খুশিতে নাচতাম। আর তুই কাঁদছিস! এতো বোকা কেন?”
তুলির চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এমনভাবে সে প্রশ্ন করল,” তুই হলে খুশিতে নাচতি? মানে প্রণয় তোকে চুমু দিলে খুশিতে নাচতি?”
রাইফা থতমত খেল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,” উফ প্রণয়ের কথা কেন বলবো? আমি রিসবের ব্যাপারে বলছিলাম। সে যদি আমাকে কখনও চুমু দেয় তাহলে তো আমি পার্টি করবো।”
তুলি চোখমুখ বিকৃত করে বলল,” ছিঃ, নির্লজ্জ। তুই আর প্রণয় একদম এক।”
রাইফা হাসতে হাসতে বলল,” তোর মতো সব বিষয়ে ওভার সেন্সিটিভ হতে চাই না আমি। চুমু খেয়ে কাঁদার কি হলো? এতো খারাপ লাগলে তুই নিজেও একটা দিয়ে দে।”
তুলির খুব বিরক্ত লাগছে৷ সে ক্ষীপ্ত হয়ে চলে যেতে লাগল। দরজা পর্যন্ত যেতেই প্রণয় ছুটে এসে বলল,” কোথায় যাচ্ছো তুলি?”
” জাহান্নামে!” তুলির কণ্ঠে তেজ, উত্তাপ। প্রণয় নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,” ওকে চলো। আমিও তোমার সাথে জাহান্নামে যাবো।”
” খবরদার, আপনি আমার পেছনে আসবেন না।” তুলি আঙুল তাঁক করে এমনভাবে তাকাল যেন চোখের আগুনে ভস্ম করে দিবে প্রণয়কে। প্রণয় ঠান্ডা স্বরে বলল,” তোমার বাইরে একা যাওয়া নিষেধ তুলি। একটু আগে আমি কি বলেছি মনে নেই?”
তুলি প্রায় চেঁচিয়ে বলল,” একটু আগে আপনি কি করেছেন সেটা মনে আছে?”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকালো। সে বুঝতে পেরেছে যে তুলি কি বিষয়ে বলছে। তবুও না বোঝার ভাণ করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” কই? কি এমন করলাম?”
তুলি বড় করে নিশ্বাস ছাড়ল। তাকিয়ে থাকল ক্রোধসিক্ত দৃষ্টিতে। প্রণয় বলল,” কিছু মনে পড়ছে না। তুমি একটু মনে করিয়ে দাও তো!”
” আপনার মাথায় বাঁশ দিয়ে একটা বারি দিলে তারপর আপনার মনে পড়বে। শুনেছি যারা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে তাদের মাথায় বারি দিয়ে স্মৃতি ফেরাতে হয়।”
প্রণয় হালকা এগিয়ে এসে বলল,” ধূর, সিনেমা নাকি? মাথা খুবই সেন্সিটিভ জায়গা। বারি-টারি দেওয়া যায় না। স্মৃতি ফেরানোর আরেকটা কৌশল আছে কিন্তু। সেটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যালি দেখানো। যেটা আমি ভুলে গেছি সেটা তুমি আমাকে করে দেখাতে পারো। তাহলে হয়তো মনে পড়বে।”
তুলি আছড়ে আছড়ে পা ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। প্রণয় মৃদু হেসে তুলির পেছন পেছন এলো। ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে তুলি থামল। রাইফাও রুম থেকে বের হয়েছে। হাত ভাঁজ করে বলল,” কি হয়েছে তোমাদের? ঝগড়া চলছে?”
তুলি কোনো কথা বলল না। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে লাগল। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে গ্লাসের বাকি পানিটুকু সম্পূর্ণ ছুঁড়ে মারল প্রণয়ের মুখে। আচমকা ঠান্ডা পানি গায়ে লাগায় সামান্য ভড়কে গেল প্রণয়। তার টি-শার্ট আর মাথার চুল ভিজে চুপচুপে অবস্থা হলো। রাইফা মুখে হাত দিয়ে স্বগতোক্তি করল,” হোয়াট ননসেন্স!”
তারপর তুলির দিকে চেয়ে গর্জন করে বলল,” এটা কি করলি তুলি? এই শীতের মধ্যে এমন করতে পারলি?”
তুলি জবাব দিল না কোনো। আঁড়চোখে রাইফাকে একবার দেখে নিয়েই ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। ধড়াম শব্দ হলো। রাইফা তেড়ে যেতে নিলেই প্রণয় তার হাত ধরে বলল,” থাক, থাক, ভুলটা আমারই ছিল। আমিই রাগিয়েছি ওকে।”
রাইফা কোমল দৃষ্টিতে প্রণয়কে অবলোকন করল। চুল আর টি-শার্ট ঝেড়ে অমায়িক হাসি দিয়েছে প্রণয়। রাইফা চেয়ারে বসতে বসতে মনখারাপ করে বলল,” তোমার আর আমার অবস্থা প্রায় একই।”
প্রণয় হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল,” হঠাৎ এই কথা বলছো কেন?”
” তোমার ভাই একটু আগে ট্রেনিং-এ যাওয়ার কথা বলছিল। এবার গেলে নাকি ছয়মাসেও আর ফিরবে না।”
এই কথা বলে মাথা নিচু করল রাইফা। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। যেন কেঁদেই ফেলবে। প্রণয় কৌতুহলী গলায় বলল,” তোমাদের মাঝে কি হয়েছিল রাইফা? স্পষ্ট করে কিছুই জানা হয়নি। কালরাতে রিসব তোমার কাছে কেন এসেছিল?”
রাইফা কফিশপের ঘটনা বলল। তারপর কালরাতের ঘটনাও বলল। একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কিত।
” সে কফিশপের ঘটনার জন্য রিগ্রেট ফীল করছিল, প্রণয়। তার মনে হয়েছে, সে আমাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিল৷ দ্যাটস ইট।”
প্রণয় মাথা নেড়ে বলল,”ইম্প্রেসিভ! এটা তো খুবই পজিটিভ সাইন। শুধু ক্ষমা চাইতে কেউ এতোদূর চলে আসবে না। হি কেয়ারস ফোর ইউ।”
” হ্যাঁ সেটা জানি। কিন্তু এক্সপ্রেস করে না কেন?”
প্রণয় একটু চিন্তা করে বলল,” সে বিখ্যাত পর্বত আরোহী হতে চায়। এটা তার স্বপ্ন। সে জানে তার লাইফ রিস্ক আছে। সে হয়তো নিজের কমপ্লিকেটেড লাইফের সাথে তোমাকে জড়াতে চায় না৷ এজন্যই ইগনোর করে। কিন্তু তুমি আপসেট হয়ে যেও না। ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ তোমাকে শতবার ট্রাই করতে হবে রাইফা।”
রাইফা স্মিত হেসে বলল,” দেখলে, তোমার আর আমার একই কপাল। তুলি যতদিন বড়লোক না হচ্ছে ততদিন তোমাকেও ধৈর্য্য ধরে শতবার ট্রাই করতে হবে।”
” হ্যাঁ জানি। সেজন্য আমি অলরেডি ডিটারমাইন্ড। সে আমাকে যত ইচ্ছা ভুল বুঝুক, যত ইচ্ছা রাগ দেখাক আর যত ইচ্ছা তাড়িয়ে দিক, আমি তার পিছু কখনও ছাড়ছি না।”
রাইফা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণয়কে স্যালুট দিয়ে বলল,” ইন্সপ্যায়ার্ড হলাম, বস।”
প্রণয় হো হো করে হাসল। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাঁচি পেল। একসাথে সে দুইবার হাঁচি দিয়ে ফেলল। রাইফা এই অবস্থা দেখে দ্রুত তোয়ালে আনতে ছুটে গেল। প্রণয়ের সর্দি লেগে যাচ্ছে। আবার জ্বর আসবে নাতো! মাথা মুছে দিতে হবে। টি-শার্টও তো ভেজা!
সন্ধ্যাবেলা হেলাল সাহেব এবং আশা বাড়ি ফিরেই খোশমেজাজে গল্প শুরু করল। বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে নানান গল্প। তারা খাবারও নিয়ে এসেছে। সেই খাবার রাতের জন্য গরম করছেন আশা। প্রণয় একটু কৌতুহলে ছিল। সকালে আজমীরের সাথে তার একটা ঝামেলা হয়েছে। রিসবকে হাসপাতালে পেয়ে প্রণয়ের একদম মাথা ঠিক ছিল না। আজমীরকে সে আচ্ছামতো মেরেছে আবার নিজেও মার খেয়েছে। এই নিয়ে বৌভাতের অনুষ্ঠানে অবশ্যই কোনো ঝামেলা হবে। এমন কিছুই ভেবেছিল প্রণয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত কোনো ঝামেলা হয়নি। বরং হেলাল সাহেব এই ব্যাপারে কিছু জানতেই পারেননি। তিনি বাড়ি ফিরে প্রথমে কুশল বিনিময় করেছেন। তাকে কিছুদিন থেকে যেতে বলেছেন। কিন্তু রিসব জানাল তার ট্রেনিং আছে। সে সকালের মধ্যেই চলে যাবে। এমন আহত শরীর নিয়ে সে ট্রেনিং-এ যাবে শুনে হেলাল সাহেব অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু রিসব নাছোড়বান্দা। কারো অনুরোধই কাজে এলো না। সে সকালে চলে যাবে মানে তাকে যেতেই হবে। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল রাইফা, তুলি আর প্রণয়ও রিসবের সাথে চলে যাবে। তুলিদের কোচিং আছে। এইখানে তাদের থেকেও কাজ নেই। তন্বির বিয়ে উপলক্ষ্যে তারা এসেছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠান তো শেষ। তাই আর কোনো উপলক্ষ্য নেই। হেলাল সাহেব সবাইকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে তুলি এখন মনে মনে খুবই স্বস্তিবোধ করছে। মামার মাথা থেকে বিয়ের ভূত নেমে গেছে। তিনি কালরাতে বিয়ের জন্য একদম উঠে-পরে লেগেছিলেন। আর আজ সে কথা বেমালুম ভুল বসে আছেন। যা তুলির জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। আরাম করে সে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছিল এমন সময় আশা তার ঘরে ঢুকে বলল,” তোর মামা ডাকে। এদিকে আয়।”
তুলি বলল,” কেন ডাকে?”
আশা জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। তুলি বিড়বিড় করে বলল,” আজব!”
ওরনা গলায় জড়িয়ে চুলে খোপা বেঁধে সে মামার ঘরে গেল। হেলাল সাহেব বসে আছেন বিছানায়। চেয়ারে একজন বৃদ্ধ। দু’জনকেই সালাম দিল তুলি।
বৃদ্ধ সালামের উত্তর নিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে হাসলেন! হেলাল সাহেব বললেন,” এনাকে চিনতে পেরেছিস?”
তুলি চিনতে পারল না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই লোককে সে কোথাও না কোথাও দেখেছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। হেলাল সাহেব সামান্য বিরক্ত গলায় বললেন,” আরে, তোর বিয়েতে এসেছিল যে!”
তুলি অবাক হয়ে বলল,” আমার বিয়ে মানে?”
” তোর আর সামিরের বিয়ে। যেটা হতে নিয়েও হয়নি।”
তুলি নিঃসাড় কণ্ঠে উচ্চারণ করল,”ও।”
হেলাল সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন,” উনি হলেন মোকাররম সাহেব। সামিরের সাথে তোর বিয়ে হলে উনি হতেন কাজী। কিন্তু সেই বিয়ে তো আর হয়নি। তাই আজ তোর আর প্রণয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি উনাকে দাওয়াত করেছি।”
তুলি নরম কণ্ঠে ‘ হুঁ’ উচ্চারণ করতে নিয়েও থেমে গেল। খুব আঁৎকে উঠল। ভ্যাবাচেকা খাওয়া কণ্ঠে আওড়ালো,” মানে? আমাদের বিয়ে? মানে এখন?”
হেলাল সাহেব অকপটে উত্তর দিলেন,” কালরাতে তো এমনটাই কথা হয়েছিল। তুই কি ভেবেছিস আমি ভুলে যাবো? যা, সবাইকে ডাক। রাইফা, প্রণয় আর তার ভাই রিসবকেও ডাক। ভালোই হলো রিসব এসেছে। প্রণয়ের পরিবারের একজন হলেও বিয়েতে থাকবে।”
তুলি অনবরত ঢোক গিলতে লাগল। শেষমেষ কি তাহলে বিয়ে নামক অঘটনটা ঘটবেই? কাজী মোকাররম সাহেব মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে তুলিকে বললেন,” যাও মা, যাও, সবাইকে ডেকে আনো। আমি কাগজপত্র ঠিক করছি।”
তুলি মুখ গোঁজ করে বেরিয়ে এলো। রাগে নিজেকেই তুলে আছাড় মারতে মন চাইল তার।
রিসব আর রাইফা পাশাপাশি বসল। তাদের ঠিক বরাবর বসলেন হেলাল সাহেব। বিছানার উপর তুলি আর কাজী সাহেব। প্রণয় এলেই বিয়ের কাজ শুরু হবে। এই ফাঁকে আশা তুলিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। রাইফা তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। খুবই হালকা সাজ। কিন্তু তুলিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। হালকা গয়না আর হালকা মেকাপে তুলিকে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে পার্লার থেকে আয়োজন করে বউ সেজে এলেও কাউকে এতোটা সুন্দর দেখায় না।
আশা আলমারি থেকে তুলির মায়ের কানের দুল বের করেছে। আর একটা চিকন চেইন। নাকফুলও ছিল। কিন্তু তুলির নাকে ফুঁটো নেই বলে পরানো গেল না। আশা বললেন,” এই সুযোগে নাকটা ফুঁড়িয়ে দেই তোর?”
তুলি ধমক দিয়ে বলল,” যথেষ্ট হয়েছে মামী। আর টর্চার করলে কিন্তু আমি এখনি ঘর থেকে বের হয়ে যাবো।”
প্রণয় ঘরে ঢুকে তুলিকে বউ সাজে দেখে বিস্মিত হলো। তার বুকের বামপাশটা চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। হেলাল সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন,” এইতো প্রণয়, দ্রুত আসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। কোথায় ছিলে?”
প্রণয় ইতস্তত করে বলল,” বাড়ির পেছন সাইডে গেছিলাম। ওইখানে নেটওয়ার্ক ভালো আসে। আমার বড় আপুর সাথে কথা বলছিলাম।”
” বড় আপুকে বিয়ের কথা জানিয়েছো?”
প্রণয় অপ্রস্তুত হলো। বিয়ের ব্যাপারে সে নিজেই নিশ্চিত ছিল না। সে ভেবেছিল মামা হয়তো এমনিই বলেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তিনি সিরিয়াস! কি হবে? জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তুলির দিকে তাকালো প্রণয়। মাথা নিচু করে বসে আছে তুলি। মুখটা তার রাশভারী। সে আঁড়চোখে প্রণয়ের দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। হেলাল সাহেব তাগাদা দিতে বললেন,” দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? বসো। বিয়ের কথা পরে জানিয়ে দিলেই হবে। আর তোমার ভাই রিসবও এখানে আছে। তাহলে আর অসুবিধা কি? শুভকাজ সেড়ে ফেলি, কি বলো?”
প্রণয় দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” না।”
তুলি অবাক হয়ে তাকাল। হেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। প্রণয় বলল,” এভাবে বিয়ে হয় না, মামা।”
” মানে?”
” আমি এভাবে তুলিকে বিয়ে করতে চাই না। স্যরি, আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
” তাহলে কিভাবে বিয়ে করতে চাও?”
প্রণয় মাথা নিচু করে বলল,” বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে।”
চোয়াল শক্ত করলেন হেলাল সাহেব। মুখের পেশী টান-টান করে জানতে চাইলেন,” কালরাতে যেটা হয়েছে এরপরেও তুমি এই কথা কিভাবে বলছো? আমি তোমাকে ভালো ছেলে ভেবেছিলাম। ভালো ছেলে হলে এই বিয়ে তুমি অবশ্যই করতে।”
প্রণয় উত্তর দিল না। মাথা নত করে রাখল। হেলাল সাহেব একবার তুলির দিকে তাকালেন। তারপর প্রণয়কে বললেন,” তুমি কি শিউর? ভেবে বলছো যে বিয়ে করবে না?”
” হ্যাঁ। আমি একদম শিউর। আমি তুলিকে বিয়ে করবো না।”
প্রণয় তার কথা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। সাথে সাথে সকলের চেহারা একটি মেদুর ছায়ায় ঢেকে গেল। পরিবেশ হলো নিশ্চুপ, দমবন্ধকর। তুলি মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। এটা ঠিক যে সে চেয়েছিল বিয়ে না হোক। কিন্তু এখন সত্যিই বিয়ে হচ্ছে না বলে তার খারাপ লাগছে। প্রণয় তাকে প্রত্যাখ্যান করল ভেবে তার কান্না পাচ্ছে। মন এতো অদ্ভুত কেন? কিছুক্ষণ পর হেলাল সাহেব রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,” ফাজলামি করছিস নাকি তোরা আমার সাথে?”
মামার গর্জনে কেঁপে উঠল তুলি। হেলাল সাহেব প্রশ্ন করলেন,” তোরা কি শুরু করেছিস? কি চাইছিস?”
উত্তর দিল না তুলি। চোখ মুছল একহাত দিয়ে। হেলাল সাহেব গজগজ করে বললেন,” প্রথমে সামিরের সাথে তোর বিয়ে দিতে চাইলাম। তারপর তুই ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি। গ্রামে আমার মান-সম্মান ধূলোয় গড়াগড়ি খাওয়ালি। মানুষের কত অপমান আর কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছে তা তোর মামীকে জিজ্ঞেস কর। তারপর তন্বির সাথে সামিরের বিয়ে হলো। এই নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। মানুষের অনেক আজে-বাজে কথা শুনেও সামির-তন্বি ভালো আছে দেখে আমি সব এড়িয়ে গেছি। কিন্তু তোদের নিয়ে যে বদনাম রটে গেছে, সেটা কিভাবে মুছবো? ভেবেছিলাম তোদের বিয়েটা দিয়ে সবার মুখ একবারে বন্ধ করে দিবো। কিন্তু তোরা এমন শুরু করেছিস যেন বিয়ে একটা অপরাধমূলক কাজ। তোদের বিয়ে করার সাহস নেই তাহলে প্রেম করতে গেলি কেন? আমাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে বিয়ের আসর থেকে পালালি কেন? উত্তর দে আগে। উত্তর না দিয়ে খবরদার নড়বি না।”
তুলির কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেল। প্রণয় কেন এমন করছে? কেন? তুলি এবার মনে-প্রাণে চাইল যাতে প্রণয় ফিরে আসে। এসে যেন তুলিকে বিয়ে করে এই বিপদ থেকে বাঁচায়। এই বিয়ে না হলে তুলি মুখ তুলে তাকাতেও পারবে না মামার সামনে।
চলবে