বেদনার রং নীল পর্ব -৫২ ও শেষ

#বেদনার_রঙ_নীল
শেষ পর্বের প্রথম ভাগ
লিখা- Sidratul Muntaz

তুলি যে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছিল সেই হাসপাতালের ঠিকানা, তুলির ডেথ সার্টিফিকেট এবং কবরের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেল। মৃত্যুটা হয়েছিল খুব মর্মান্তিক। ধ*র্ষিতা হওয়ার পর তুলি আত্মহ*ননের পথ বেছে নেয়। তৈমুরের থেকে এইসব ঘটনা শুনে প্রণয় স্তব্ধ হয়ে গেল। টানা একমাস সে যেন মৃত্যুর পূর্বে তুলির আর্তনাদগুলো নিজ কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। রাতগুলো তার নির্ঘুমই কেটে যাচ্ছিল।রাইফা, শান, রিসব, মিষ্টি, অজান্তা, সবাই প্রতি শুক্রবারে একবার করে তুলির কবরে যায়। তবে প্রণয় এই পর্যন্ত একবারও সেই কবরের কাছাকাছি যায়নি। অসহনীয় একটা কষ্টে প্রায়শই তার বুকের ভেতর বিদ্ধ হয়ে ওঠে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত সে কখনোই তুলির সামনে যাবে না।

তুলির মায়ের নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরী করা হয়েছে। আজমীরের হদিশ এখনও পাওয়া যায়নি। সে বিদেশ গেছে কিন্তু কোন দেশ, ঠিকানা, এসব কিছুই বের করা যাচ্ছে না। কেউ তার ঠিকানা জানে না। একদম যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রণয় আজমীরকে খুঁজে না বের করতে পারলে মরেও শান্তি পাবে না। সে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে আজমীরকে খুঁজে বের করতে।

একদিন প্রণয় রাইফাকে নিজের ঘরে ডাকল। রাইফা তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু সে খুশি নয়৷ সারাক্ষণ মনমরা হয়েই থাকে। তার রিসবের সঙ্গে ঝগড়া চলছে। আগে বেস্টফ্রেন্ডের মতো রাইফা প্রণয়ের সাথে সবকিছু শেয়ার করতো। কিন্তু ইদানিং প্রণয় এতো ব্যস্ত আর গম্ভীর হয়ে গেছে যে তার সঙ্গে কথা বলারই ফুরসত পাওয়া যায় না। আজ প্রণয় নিজে থেকে কথা বলার জন্য ডাকায় রাইফা বেশ খুশি হলো। জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার? আজ হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ল?”

প্রণয় হাস্য মুখে বলল,” তোমাকে মিস করছিলাম। অনেক দিন কথা বলা হয় না। মনে আছে আগে আমরা সব বিষয় শেয়ার করতাম!”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাইফা। আক্ষেপ নিয়ে বলল,” হ্যাঁ। আগের মতো আর কথা বলা হয় না। তুমিই তো সারাদিন ব্যস্ত থাকো। আমার সাথে কথা বলার সময় কই তোমার? এদিকে তোমার ভাইও ধানাই-পানাই শুরু করেছে। সে নাকি এভারেস্ট জয় করতে যাবে। আমাকে মায়ের বাড়ি চলে যেতে বলছে। আমি চাই এই সময়টা ও আমার পাশে থাকুক। তা না করে সে চলল পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে। এগুলো কোনো কথা বলো?”

প্রণয় একটু হাসল। কৃত্রিম হাসি। তার চেহারা সবসময় পাংশুটে বর্ণ হয়ে থাকে। হাসি দেখলেই বোঝা যায়, জোর করে হাসছে। রাইফার খুব কষ্ট হয় প্রণয়ের সামনে এলে।

” রিসবকে আমার সাথে কথা বলতে বোলো।”

” এভারেস্টের ব্যাপারে কথা বলবে নাকি? লাভ নেই। ও সিদ্ধান্ত বদলাবে বলে মনে হয় না। তবুও একটু চেষ্টা করে দেখতে পারো। যদি তোমার কথা শোনে!”

প্রণয় একটু অভিযোগের সুরে বলল,” তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াও কেন রাইফা?”

রাইফা হকচকাল। স্থবির কণ্ঠে বলল,” মানে?”

প্রণয় মন্থর কণ্ঠে বলল,” তুমি কি ভেবেছো? আমি কিছুই বুঝি না? আমাকে দেখলে তোমার তুলির কথা মনে পড়ে। মনখারাপ হয়৷ এজন্যই আমার থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাও। ঠিক বললাম?”

রাইফা তার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুটা মুছে নিয়েই জড়ানো গলায় বলল,” সেরকম কিছু না প্রণয়। তুমি ভুল ভাবছো।”

প্রণয় এই বিষয়ে আর কিছু বলল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিল,” যে কারণে তোমাকে ডেকেছিলাম সেটা বলি। আচ্ছা তুমি কি তুলির বাবার নাম জানো?”

রাইফা একটু মনে করার চেষ্টা করে বলল,” তুলি একবার বলেছিল… হ্যাঁ মনে পড়েছে। মিজানুর খন্দকার।”

প্রণয় নামটা কয়েকবার আওড়ালো,” মিজানুর খন্দকার, মিজানুর খন্দকার।”

তারপর ঝটপট বলল,” উনার ব্যাপারে আর কিছু জানো? কোথায় থাকেন বা ছেলে-মেয়ের নাম?”

রাইফা হেসে উঠে বলল,” আমি নামটাই জেনেছিলাম শুধু তুলির থেকে। মেয়ের নাম তমালিকা। আর ছেলের নামটা যেন কি? সাজ্জাদ না আজাদ হবে কিছু একটা। এছাড়া আমি বাড়তি কিছুই জানি না৷ যদি জানতাম তাহলে এতোদিনে খুঁজে বের করে ফেলতাম। তুলি নিজেই তার বাবাকে খুঁজছিল!

প্রণয় হতাশ হয়ে বলল,” ও হ্যাঁ, তাইতো।”

” তোমার হঠাৎ এসব জানতে ইচ্ছে করল কেন?”

প্রণয় এড়িয়ে যাওয়ার মতো বলল,” এমনি। জাস্ট কিউরিওসিটি। তুমি রিসবকে পাঠিয়ে দিও।”

” আচ্ছা।”

রাইফা বের হওয়ার সময় দেখল প্রণয়ের বিছানার ঠিক পাশেই টেবিলে তুলির একটি ফটোফ্রেম রাখা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রণয় কি রোজ ফটোফ্রেমটির সাথে কথা বলে? সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য কল্পনা করেই কান্না পেল রাইফার। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল।”

রাইফা চলে যাওয়ার পর প্রণয় চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে খুঁজে বের করা যায় মিজানুর খন্দকারকে? তুলির ডায়েরীতে অবশ্য তার বাবার যুবক বয়সের একটা ছবি আছে। মানুষ যুবক থেকে বৃদ্ধ হলে চেহারার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। সুতরাং প্রণয় মিজানুর খন্দকারকে খুঁজে পেলে ঠিক চিনবে। রিসব দরজায় কড়া নাড়ল। প্রণয় শ্রান্ত গলায় বলল,” ভেতরে আয়।”

রিসব ভেতরে এসে প্রণয়ের পাশে বসল। জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার? আজ হঠাৎ আমাকে এতো জরুরী তলব?”

প্রণয় নিরস গলায় বলল,” এভারেস্টে যাচ্ছিস?”

প্রশ্ন শুনে অধৈর্য্য হলো রিসব৷ সামান্য বিরক্ত হয়ে বলল,” প্লিজ, এখন তুইও রাইফার সাইড নিয়ে আমাকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করিস না৷ আমি জানি এই সময়টা যাওয়ার জন্য ঠিক না। কিন্তু এখন না গেলে আমার হয়তো আর কখনোই যেতে ইচ্ছে করবে না। ”

” কেন?”

” কেন আবার? বাচ্চাটা হয়ে গেলে তার মুখ দেখার পর যদি মায়ায় পড়ে যাই? প্রথমেই রাইফা একটা দূর্বলতা। তার উপর আসছে আরও একজন। পুরোপুরি সংসারে বাঁধা পড়ার আগে আমি আমার স্বপ্নপূরণ করতে চাই।”

” সব স্বপ্ন যে পূরণ হতেই হবে এমন কিন্তু কোনো কথা নেই। আমি তোকে শুধু এটাই বলবো রিসব, জীবনটা খুব অনিশ্চিত। কখন কি হয়ে যায় আমরা তা ধারণাও করতে পারি না। জীবনের অর্ধেক সময় আমরা অযথা রাগ, ঝগড়া, অভিমান করে কাটিয়ে দেই। কিন্তু সময় খুব নিষ্ঠুর আর সংকীর্ণ। যে সময়টা একবার চলে যায় তা আর কখনও ফিরে আসবে না। বাকিটা তোর সিদ্ধান্ত।”

রিসব বুঝতে পারল প্রণয় এসব কথা কেন বলছে! সে আসলে এভাবে চিন্তা করেনি। নিজের উপর তার বিশ্বাস আছে। সে ঠিকই এভারেস্ট জয় করে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু ততদিন রাইফা তার অপেক্ষায় থাকতে পারবে কি-না সেটাও একটা ভাবার বিষয়। যদি ডেলিভারির আগে বা পরে তার কিছু হয় যায় তাহলে রিসবকে সারাজীবন আফসোস করতে হবে। সজ্ঞানে করা ভুলের জন্য আফসোস করার চেয়ে তিক্ত অনুভূতি আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই সে নিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করল।

আজমীরকে খুঁজে না পাওয়া গেলেও মিজানুর খন্দকারের বৃত্তান্ত যোগাড় করতে প্রণয়ের বেশি সময় লাগল না। প্রণয় তৈমুরকে নিজের বিশ্বস্ত বানিয়ে ফেলেছে। সে মিজানুর খন্দকারের সমস্ত সমাচার প্রণয়কে জানাল,” স্যার, তিনি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি। স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমানে দেশেই থাকেন। তার সন্তান-সন্ততিরা সব বিদেশে সেটেলড। তাদের সঙ্গে তেমন ভালো যোগাযোগ নেই বলা চলে। তার বিষয়-আশয় দেখে রাখার জন্য বিশ্বস্ত একজন কর্মচারী আছেন। নাম মোখলেস হায়দার। তিনি কোম্পানীর ম্যানেজার। ধরতে গেলে তিনিই সবকিছুর দেখা-শুনা করেন।”

প্রণয় ভ্রু প্রসারিত করে বলল,” বাহ, খুবই ভালো। আমি যেমন ধারণা করেছিলাম তেমনটাই পেয়েছি। এবার তাহলে মিস্টার মোখলেসের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া শুরু করো।”

” ঠিকাছে স্যার। সন্ধ্যার মধ্যে মিস্টার মোখলেসের ব্যাপারে আপনাকে সবকিছু জানাবো।”

তন্বি শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। তাকে প্রায় মাসখানেকের মতো বন্দ্বি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। সামির প্রতি রাতে তার সাথে খাবারসহ দেখা করতে আসতো। কিন্তু তন্বি এতোদিন বোকার মতো সামিরের সঙ্গে রাগ দেখিয়েছে৷ একটা কথাও বলেনি। না খেয়ে রোগ বাঁধিয়েছে। তারপর তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সামিরকে হাত করে সে ওই বাড়ি থেকে পালানোর ব্যবস্থা করল। সামিরও তার ফাঁদে পা দিয়ে তাকে পালাতে সাহায্য করে। সে ভেবেছিল তন্বি তাকে ক্ষমা করেছে। কিন্তু তন্বি বাপের বাড়ি আসার পর মা-বাবাকে জানিয়েছে, সে সামিরের থেকে ডিভোর্স নিবে। হেলাল সাহেব সবকিছু শুনে ডিভোর্সের জন্য সম্মতি দিলেও আশা বেঁকে বসল। সে কিছুতেই মেয়েকে ডিভোর্স নিতে দিবে না। তার ধারণা ডিভোর্স নেওয়ার চেয়ে মেয়েদের ম-রে যাওয়া ভালো। এদিকে ইকবাল সাহেব তন্বিদের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। যদি আজমীরের ব্যাপারে তন্বি মুখ খোলে তাহলে তার পরিবারের কেউ জীবিত থাকবে না। তন্বি কোনো হুমকির পরোয়া করে না। কিন্তু মায়ের ঘ্যানঘ্যানানির জন্য কাউকে কিছু বলতেও পারে না। আজমীর যে ডেনমার্কে আছে এই খবর সে প্রণয়কে দিতে চায়। কিন্তু মায়ের জন্য পারে না। সামির প্রতিদিন আসে তন্বির কাছে। ক্ষমা চায়। কিন্তু তন্বি বলে দিয়েছে, সে আর কোনোদিন সামিরের সাথে সংসার করতে পারবে না। পরোক্ষভাবে হলেও তুলির মৃত্যুর সাথে সামির জড়িত ছিল। এই কথা কি কখনও ভোলা যায়? তাকে কি আদৌ কখনও ক্ষমা করা যায়?

মোখলেস হায়দারের একমাত্র মেয়ের নাম চৈতালি। পড়ে ক্লাস থ্রিতে৷ প্রতিদিন সে কোন রাস্তা দিয়ে স্কুলে যায় সেই বিষয়েও খবরা-খবর নেওয়া হয়ে গেছে। একদিন সুযোগ বুঝে তৈমুর তাকে কিডন্যাপ করে প্রণয়ের নির্দেশিত একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। মেয়েটিকে দেখে-শুনে রাখার জন্য একজন আয়া ভাড়া করা হয়েছে। সে চৈতালির ভালো-মতো খেয়াল রাখবে। চৈতালি যেভাবে থাকতে চায় তাকে সেভাবেই রাখা হবে৷ শুধু মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে কান্নার অভিনয় করে কথা বলতে হবে। ছোট্ট চৈতালি এমন খেলায় বেশ মজা পেয়ে গেল। তাকে প্রণয় যা বলে সে তাই করে। দুইদিনের মধ্যে মোখলেস হায়দার বশে এসে যান। একমাত্র মেয়েকে উদ্ধার করতে তিনি জীবন দিতেও প্রস্তুত। প্রণয় বলল,” জীবন লাগবে না। শুধু ঈমান বিসর্জন দিতে হবে।”

প্রণয়ের ধাঁধাময় কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না মোখলেস। প্রশ্ন করলেন ত্বরিতে,” কি বলতে চান? বুঝিয়ে বলুন।”

” আপনার সাথে আমার শত্রুতা নেই। কিন্তু আপনার মালিক মিজানুর খন্দকার সাহেবের সাথে বহু পুরনো একটি হিসাব আছে।”

” তাহলে আপনি আমার কাছে কি চান? আমার মেয়েকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন? ও বাচ্চা মানুষ। ওকে ছেড়ে দিন। দয়া করুন।”

” ছাড়বো। যদি আপনি আমাকে সাহায্য করেন।”

” কি ধরণের সাহায্য?”

প্রণয় মুখে হাসি এঁটে বলল,” মিজানুর খন্দকারকে দেউলিয়া বানাতে হবে।”

মোখলেস হায়দারের দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো৷ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,” এ কিভাবে সম্ভব?”

” আপনি চাইলেই সম্ভব। আমি জানি, তাদের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন আপনার হাতে। আপনি তাদের খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী। খুঁটিনাটি সবকিছুই জানেন। তাই এই পদ্ধতিও আপনার জানার কথা। ভেবে দেখুন, আপনার কাছে কোনটা বেশি জরুরী? মালিকের কাছে বিশ্বস্ত থাকা নাকি নিজের মেয়ের জীবন? ভাবার জন্য একদিন সময় দিচ্ছি।”

মোখলেস বিপাকে পড়ে যায়। অবশেষে প্রণয় যেমন চেয়েছিল, তেমনটাই হলো। মোখলেস প্রণয়কে সাহায্য করতে রাজি হয়ে গেল। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই মিজানুর খন্দকারের সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা হয়ে গেল। ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে উঠল, ব্যাংক-ব্যালেন্স লুটপাট হলো, শেষ সম্বল হিসেবে বাড়িটাও নিলামে উঠে গেল। প্রথম দিকে ছেলে-মেয়েরা বড়লোক বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর নিতে হামলে পড়তো। আর এখন বিপদগ্রস্ত বাবা-মায়ের প্রতি তাদের তেমন মনোযোগ নেই বললেই চলে। দায়িত্ব নিতে রাজি না কেউই। বাড়িটি নিলামে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর মিজানুর খন্দকার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। জমানো যা টাকা-পয়সা হাতে ছিল তাও যেন ঝড়ের গতিতে ফুঁড়িয়ে গেল। অবশেষে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে ছেলে-মেয়েদের দ্বারস্থ হলে তারাই বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থাই করল। প্রণয় মোখলেসের মাধ্যমে তাদের কাছে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা পাঠায়। মিজানুর খন্দকার একদিন ভোর সকালে স্ত্রী পারভিন বেগমকে নিয়ে তুলির মায়ের নামে তৈরী করা সেই বৃদ্ধাশ্রমেই উঠলেন। সদর দরজার বাইরে বড় করে একটি পোস্টারে তুলির মায়ের নামসহ হাসি মাখা একটি ছবি জ্বলজ্বল করছে। সেই ছবি দেখে মিজানুর থমকে যান। অপরাধবোধে হৃদয়ে দহন শুরু হয়। অশ্রুসিক্ত হয় দৃষ্টি। মনে পড়ে যায় বিগত পনেরো বছর আগের স্মৃতি। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন করে মিজানুর জানতে পারেন এই আশ্রমের মালিক তার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে তুলনা সরকার।

ইকবাল সাহেব রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়েছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি এই বিছানায় একাই ঘুমান। তবে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শেফালী তার হাত-পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। এটা অনেকে খারাপ চোখে দেখলেও ইকবাল পরোয়া করেন না। আজকে অবশ্য শেফালী আসতে দেরি করছে। তিনি বিছানা থেকে নেমে দেখতে গেলেন। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে আটকানো। তার সঙ্গে কি কেউ মশকরা করছে? তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। চারদিক থমথমে অন্ধকার। ব্যালকনি থেকে একটা কালো ছায়া ভেসে আসছে। ইকবাল সাহেব রুদ্ধ কণ্ঠে কয়েকবার ডাকলেন,” শেফালী, এই শেফালী!”

কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ হলো। তিনি দুই কদম এগিয়ে যেতেই শেফালীর মৃতদেহ খুঁজে পেলেন। এমন বীভৎস পরিস্থিতির অবলোকন হতেই সশব্দে চিৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে বদ্ধ ঘরে ইকবাল সাহেব ও শেফালীর লা*শ খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু কে খু*ন করেছে, কেন করেছে, তার কিছুই জানা গেল না।

বাবার মৃত্যুর চারদিন শেষ হওয়ার পর সামির তন্বির সঙ্গে দেখা করতে যায়। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” আব্বা মারা গেছেন। তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছিলেন। পারলে মাফ করে দিও।”

তন্বি বাঁকা হেসে বলল,” জীবনেও তোমার বাবাকে আমি মাফ করতে পারবো না। আর তোমাকেও না!”

” এমন কথা বোলো না। মৃত মানুষ! তুমি মাফ না করলে বাবার কবরে আজাব হবে।”

” উনি যে পাপ করেছে, কবরে আজাব এমনিতেও হবে। কিন্তু তাও মাফ করতে পারি একটা শর্তে।”

” কি শর্ত?”

তন্বি জিজ্ঞেস করল,” তোমার ভাই কোথায় আছে? সত্যি করে বলোতো?”

” বললে তুমি ফিরে আসবে?”

” আসবো?”

” কথা দিচ্ছো?”

” দিলাম।”

সামির তন্বিকে আজমীরের ঠিকানা দিল। এরপরদিনই তন্বি সামিরকে ডিভোর্স দিয়ে দিল।

প্রণয় তম্বির থেকে আজমীরের ঠিকানা পাওয়ার পর ডেনমার্কে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। তুলির ডায়েরীর শেষ ইচ্ছে ছিল, আজমীরকে সে একদিন খু*ন করবে। আর প্রণয়ের জীবনের শেষ লক্ষ্য ছিল আজমীরের থেকে প্রতিশোধ নিবে। এই শেষ লক্ষ্য পূরণ হলেই তার ছুটি। এরপর সে নির্দ্বিধায় তুলির কবরে যেতে পারবে।

রাইফার একটি ছেলে বাচ্চা হয়েছে। যথাসময়ে হাসপাতালে সমবেত হয় সবাই। তন্বিও এসেছে। বাচ্চাকে যখন অটি থেকে বের করা হলো তখন ভোর রাত্রি। রিসব তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাইফার সঙ্গে দেখা করতে গেল। কিছুক্ষণ পর সেখানে প্রণয়ও আসে। মিষ্টি বলল,” দ্যাখ ভাই, কত ফুটফুটে একটা রাজপুত্র হয়েছে।”

প্রণয় হাঁফ ছাড়ে। বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে তার বুক হু হু করে উঠল। এমন একটি বাচ্চা সেও চেয়েছিল। কিন্তু সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। হঠাৎ আবদার করে বসল প্রণয়,” আমি কি ওর নাম রাখতে পারি?”

রাইফা আর রিসব একবার চোখাচোখি করল। তারপর দু’জনেই হাসল৷ রাইফা বলল,” নিশ্চয়ই পারো। বলো, কি নাম দিতে চাও?”

প্রণয় বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলালো। নরম কণ্ঠে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,” ওর নাম স্বপ্ন। পছন্দ হয়েছে নামটি?”

রাইফা তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” অনেক সুন্দর নাম…” তারপর কথা শেষ করার আগেই কেঁদে উঠল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে তার। তুলির ইচ্ছে ছিল ছেলে হোক বা মেয়ে, নাম রাখবে স্বপ্ন। প্রণয় তুলির দেওয়া সেই নামটাই তার ছেলেকে দিয়ে দিল! এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? রাইফা নিজেকে সামলাতে পারছে না। রিসব বাবুকে প্রণয়ের কোলে দিয়ে রাইফার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রণয় স্বপ্নকে কোলে নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইল। বার কয়েক ডাকল,” স্বপ্ন, কেমন আছো স্বপ্ন?”

স্বপ্ন কোনো জবাব দিল না। নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
#বেদনার_রঙ_নীল
শেষ ভাগ
লিখা- Sidratul Muntaz

পরিশিষ্ট – মাঝরাত্রে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ছুটে গেল আজমীরের। লামিকে পাশে না পেয়ে কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো। তাদের বিবাহিত জীবনের একবছর হতে চলেছে। এখনও লামিকে সে চোখে হারায়। এক মুহূর্তের জন্যেও লামি চোখের আড়াল হলে তার হাঁসফাঁস লাগে। মনে হয়, এই বুঝি কেউ এসে লামিকে তুলে নিয়ে যাবে। লামি হারিয়ে গেলে আজমীরের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠবে। আতঙ্ক নিয়ে আজমীর প্রথমে বাথরুমে দেখল কিন্তু লামি সেখানে নেই। তারপর বারান্দায় খুঁজতেই পাওয়া গেল লামিকে। আজমীর হাঁফ ছাড়ল। পেছন থেকে লামিকে জড়িয়ে ধরেই কাঁধে মুখ গুঁজে বলল,” এখানে কি করছ হানি?”

লামি উদাস মুখে বলল,” তেমন কিছু না। ঘুম আসছিল না তাই এসেছিলাম।”

” আগে বললে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিতাম তোমাকে!”

লামি লাজুক হেসে বলল,” তুমি উঠে এলে কেন?”

” তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম হয় না যে!”

আজমীর এই কথা বলেই লামিকে কোলে নিয়ে বিছানায় এলো। লামির খুব অস্থির লাগছে আজ। মাঝেই মাঝেই তার এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আজমীরকে খুব অচেনা লাগে। তখন মনে হয়, এই জীবনটা আসলে তার জন্য নয়। সে বুঝি কোনো ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তার হয়তো অন্যকোথাও থাকার কথা ছিল। অন্যকিছু করার কথা ছিল।

তৈমুর সব খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছে। সকালে আজমীরের স্ত্রী ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। সেই সময়টা আজমীর বাড়িতে একাই থাকে। প্রণয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলল। একবার তৈমুর বলল,” স্যার, আপনি চাইলে কিন্তু আমরা মিসেস লামিকেও কিডন্যাপ করতে পারি। আজমীর যেমন আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছিল তেমনিও আপনিও তার স্ত্রীকে হত্যা করবেন। এটাই হবে আসল প্রতিশোধ।”

প্রণয় একটু হেসে বলল,” আমি নির্দোষকে শাস্তি দিতে চাই না তৈমুর। অন্যায় আজমীর করেছিল, তাই সে-ই শাস্তি পাবে। তাকে আমি সবচেয়ে নিষ্ঠুর মৃত্যু দেবো!”

প্রণয়ের হিংস্র দৃষ্টি দেখে তৈমুরের শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। পরদিন তারা পরিকল্পনা মতো আজমীরের বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নিল। আজমীর লামিকে ইউনিভার্সিটিতে ছেড়ে কিছুক্ষণ বাইরে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরল। গোসল করতে বাথরুমে ঢুকল। সেই সময় শাওয়ার থেকে পানি আসা বন্ধ হয়ে যায়। মুখভর্তি সাবান ফেনা নিয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই আজমীর দেখতে পেল প্রণয়কে। হাতে ইয়া বড় একটি পিস্তল নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সে। আজমীরের প্রথমে মনে হলো সে বিভ্রমে আছে। নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তেই বুঝতে পারল, এটা ভুল নয়।

লামি তার জরুরী জিনিস নিতে ভুলে গেছিল। তাই ট্যাক্সি করে আবার বাড়ি ফিরল। অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেল চাপছে। কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। আজমীরের র/ক্তা*ক্ত নিথর দেহ মেঝেতে কাতরাচ্ছে। প্রণয় তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ব্লেড দিয়ে তার শরীরের শিরা কেটে নিচ্ছে। প্রত্যেকবারই আজমীর গগনবিদারী চিৎকারে বাড়ি কাঁপাচ্ছে। যেই হাত দিয়ে সে তুলিকে স্পর্শ করেছিল সেই হাতে পেরেক গেঁথে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে প্রণয়। ঠিক সেই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। আজমীর যাতে চিৎকার করতে না পারে সেজন্য তার মুখ বাঁধা হয়। তৈমুর গিয়ে দরজা খুলল এবং প্রণয় লামির মাথায় আঘাত করল। লামি তৎক্ষণাৎ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে লামির মুখ দেখে প্রণয়ের দুনিয়া ঘুরে উঠেছে। আজমীর কাতরাচ্ছে অসহায়ের মতো। জ্যান্ত ছাগলের চামড়া টেনে ছিঁড়লে যত যন্ত্রণা হয় তার চেয়েও দ্বিগুণ যন্ত্রণা হচ্ছে আজমীরের। প্রণয় হতবিহ্বল হয়ে গেল। একবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তারপর আবার দাঁড়াল। লামিই তুলি। তুলিই লামি। সে স্বপ্ন দেখছে না তো? বিধ্বস্ত আজমীর যন্ত্রণা সইতে না পেরে তার চেতনা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হলো। প্রণয় দ্রুত তার কাছে গিয়ে গাল চাপড়ে প্রশ্ন করতে লাগল,” এই, এই, আজমীর, কথা বল। কে এটা? কে এটা? বল?”

আজমীর ফ্যাঁসফ্যাঁসে কণ্ঠে আওড়ালো,” তুলি।”

প্রণয়ের মাথায় বজ্রপাত হলো৷ অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তুলির দিকে চেয়ে আবারও প্রশ্ন করল,” ও এখানে কিভাবে? কি করে? বল, সবকিছু বল নয়তো মেরে ফেলবো। যেভাবে তোর বাবাকে মেরেছি, তার চেয়েও ভয়ংকরভাবে তোকে মারবো।”

প্রণয় গর্জন করে উঠল। আজমীর দূর্বল কণ্ঠে বলল,” এক্সিডেন্টের পর স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল ও। তারপর আমি এখানে নিয়ে এসেছি। পরিচয় বদলে ওকে বিয়ে করেছি। ও এখন আর তুলি না। ও লামি। আমার লামি।”

প্রণয় আজমীরের শেষ কথা সহ্য করতে না পেরে তীব্র আক্রোশে তার বুকে ছুরি গেঁথে দিল। এতো জোরে হঠাৎ আক্রমণ করায় আজমীরের চোখ বেরিয়ে আসে। মুখ থেকে র-ক্ত ছলকে বের হয়। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানের তার মৃত্যু ঘটে। রক্তাক্ত হাত নিয়ে নির্লিপ্ত বসে রইল প্রণয়। মাথা ফাঁকা লাগছে তার। আজমীরের শেষ কথা বার-বার কানে বাজতে লাগল,” ও এখন আর তুলি না। ও লামি। আমার লামি।”

কিছুক্ষণ পর তুলির জ্ঞান ফিরে আসে। আজমীরকে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সে গুমরে উঠল। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। প্রণয় তার কাছে গিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,” কেঁদো না তুলি, প্লিজ।”

তুলি বড় বড় চোখে তাকাল,” আপনি কে? আমার স্বামী আপনার কি ক্ষতি করেছিল? কেন তাকে মা-রলেন এভাবে বলুন?”

তুলির আর্তনাদ প্রণয়ের হৃদয় ভেঙে দেয়। তার অপরিচিত সম্বোন্ধনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় প্রণয়। সত্যিই কি তুলি চিনতে পারছে না তাকে? প্রণয় দুই হাতে তুলির মুখ আঁজলায় নিয়ে বলল,” আমাকে দেখো তুলি, আমি প্রণয়। আমাকে চিনতে পারছো না তুমি?”

তীব্র ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে প্রণয়কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল তুলি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দূরে চলে গেল। বলতে লাগল,” আমি আপনাকে চিনি না। আপনি খু*নী। আমার স্বামীকে আপনি খু*ন করেছেন। আমি আপনাকে ছাড়বো না। হে আল্লাহ!”

তুলি আজমীরের নাম নিয়ে কাঁদতে লাগল ফুপিয়ে। প্রণয় চিৎকার করে বলল,” ও তোমার স্বামী না। ও তোমার কেউ না। আমাকে দেখো, আমি তোমার স্বামী।”

তুলি এমন কথা শুনে আরও ভয় পেল। ভীত-সন্ত্রস্তভাবে জড়োসড়ো হয়ে বলল,” কি অদ্ভুত কথা বলছেন! আপনি পাগল। সাইকো আপনি।”

প্রণয় কাছে এসে তাকে বোঝাতে নিলেই তুলি এক দৌড়ে অন্যঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। প্রণয় চিৎকার করে ডাকতে লাগল,” তুলি, আমার কথা শোনো প্লিজ। বিশ্বাস করো আমিই তোমার স্বামী। প্লিজ তুলি।”

প্রণয় মেঝেতে বসে পড়ল ধপ করে। তুলির এমন আচরণ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড কষ্টে বুক ভেঙে আসছে। তুলি কেন তাকে চিনতে পারছে না? কেন? কেন? কেন? প্রণয় আর্তনাদ করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর তুলি দরজা খুলে বের হলো। চারদিক তখন থমথমে নীরব। আজমীরের দেহটাও নেই। সবকিছু পরিষ্কার করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে তৈমুর। প্রণয় তখনও তুলির জন্য অপেক্ষা করছে। তার বিশ্বাস, তুলি দরজা খুলবে। প্রণয়কে সে চিনতে পারবে। তুলি বের হতেই প্রণয় হাসি মুখে বলল,” তুলি।”

ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল তুলি। প্রণয় ধৈর্য্য ধরে নিজেকে শান্ত করল। ধাতস্থ হয়ে বলল,” ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আচ্ছা, তোমার কি কিছুই মনে নেই? আমাকে দেখেও কি কিছুই মনে পড়ছে না?”

প্রণয় কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। কিন্তু তুলি কোনো উত্তর দিল না। ঢোক গিলে এপাশ-ওপাশ তাকাল। প্রণয় কাছে আসতে নিলেই তুলি বলল,” খবরদার, একদম আমার কাছে আসবেন না।”

প্রণয় তাকে শান্ত করতে বলল,” আচ্ছা, আসব না। আমি প্রমিস করছি আসব না। এইতো, আমি দূরে চলে যাচ্ছি।”

তুলি আস্তে আস্তে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতে লাগল। প্রণয় তাকে দেখছে দু’চোখ ভরে। কতদিন পর দেখা! এভাবে তুলিকে সামনে পেয়েও সে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। কপালে চুমু দিতে পারছে না। তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? প্রণয়ের বাম চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তুলি আচমকা একটি ধারালো ছুরি উঠিয়ে বলল,” নিন। যেভাবে আমার স্বামীকে মেরেছেন, সেভাবে আমাকেও মেরে ফেলুন।”

প্রণয় হতভম্ব হলো। তুলি ভাঙা কণ্ঠে বলল,” প্লিজ মেরে ফেলুন আমাকে। ও ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। আমি অনাথ। খুব নিঃসঙ্গ। এভাবে আমি বাঁচতে চাই না। প্লিজ আমাকেও মেরে ফেলুন আপনি।”

তুলি জড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করেই তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ল। প্রণয় বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,” আমি তোমাকে মেরে ফেলবো? এটা অসম্ভব তুলি। কে বলেছে তোমার কেউ নেই? এইতো, তোমার আমি আছি!”

প্রণয় এগোতে নিলেই তুলি ছ্যাঁত করে উঠল,” খবরদার। একদম আসবেন না। আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে ফেলব।”

তুলি এবার নিজের গলাতেই ছুরি চেপে ধরল। প্রণয়ের বুক ধড়াস করে উঠল। সে পুনরায় তুলিকে হারাতে চায় না। দ্রুত বলল,” একদম না। তুমি নিজেকে কিছু করবে না প্লিজ। তুমি যা বলবে তাই হবে। কিন্তু ছুরিটা রাখো।”

তুলি কঠিন গলায় বলল,” তাহলে আপনি মরে যান।”

প্রণয় চমকে উঠল,” কি?”

” যেভাবে আমার স্বামীকে মেরেছেন সেভাবে আপনিও মরে যান। নয়তো আমিই আপনাকে মেরে ফেলবো।”

প্রণয় এই কথা শুনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। হাসিমুখেই বলল,” আমাকে মেরে যদি তুমি খুশি থাকো, তাহলে মেরেই ফেলো প্লিজ!”

প্রণয়কে অবাক করে দিয়ে তুলি তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে ছুরিটা গেঁথে দিল তার বুকে। প্রণয় কুকিয়ে উঠল। ছুরিটা এসে ঠেঁকেছে ঠিক প্রণয়ের বুকের বামপাশে। গলগল করে র*ক্ত বের হচ্ছে। প্রণয়ের মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। তুলি প্রণয়ের উপর ঝুঁকে এসে আরও গাঢ়ভাবে ছুরিটা গাঁথল। প্রণয় তীব্র আর্তনাদে চেঁচিয়ে উঠল। তুলি ভেজা গলায় প্রশ্ন করল,” আমার স্বামী কি অপরাধ করেছিল? কেন মা-রলেন তাকে আপনি?”

প্রণয় তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” তোমার জন্য!”

তুলি এই কথার অর্থ বুঝতে পারল না। প্রণয় তার জ্যাকেটের পকেট থেকে ডায়েরীটা বের করেই ছুঁড়ে মারল। তুলি কৌতুহলী হয়ে ডায়েরীটির কাছে গেল। ডায়েরী খুলতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তার নিজের ছবি। তারই লেখা কিছু কথা। কিছু ইচ্ছা। তুলি আঁড়চোখে আবার তাকাল প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের দেহ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তুলি ব্যস্ত হয়ে লেখাগুলো পড়তে লাগল। খুব পরিচিত, খুব চেনা একটা অনুভূতি তাকে গ্রাস করে নিল। তার মাথার শিরা দপদপ করছে। কিছু মনে পড়তে নিয়েও পড়ছে না। তবে একটু আগেই যে মানুষটিকে খুব হিংস্র মনে হচ্ছিল এখন তাকে খুব আপন, খুব নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। তুলি লেখাগুলো পড়তে পড়তে কিছু পাতায় এসে থামল। একজায়গায় সে আজমীরকে খু*ন করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। প্রণয়কে ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি ব্যক্ত করেছিল। তাদের প্রথম বাচ্চার নাম,’স্বপ্ন’ হওয়ার কথা ছিল। তাদের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। তুলির গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শরীর শিউরে উঠছে। সে ডায়েরী হাতে নিয়েই প্রণয়ের কাছে গেল। তার গাল ধরে এলোপাতাড়ি চাপড় মারতে লাগল,” উঠুন, প্লিজ উঠুন। কে আপনি?”

প্রণয় কোনো কথা বলছে না। তুলি চিৎকার করে ডাকল। মানুষটা কেন কথা বলছে না? অস্থির লাগছে খুব। সে প্রণয়ের দেহ ঝাঁকাতে লাগল,” উঠুন, উঠুন, প্লিজ উঠুন না!”

তুলির তীব্র ঝাঁকুনিতে আচমকা প্রণয়ের সম্বিৎ ফিরে এলো। খুব বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। তুলি আশার আলো খুঁজে পেয়েই হেসে উঠল। প্রণয় আবছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল তুলির হাসিমাখা মুখটি। ক্ষত-বিক্ষত হওয়া বুকটা যেন শীতল পরশ পেল। সে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,” তুলি।”

তুলি ব্যাকুল হয়ে বলল,” কিছুই মনে পড়ছে না আমার। কিন্তু আপনার কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। বলুন না, আপনি কে?”

প্রণয় মৃদু হাসল। তার র*ক্ত/ক্ত হাতটা তুলির গালে রাখল। তুলির মনে হলো, এতো ভালো তার আগে কখনও লাগেনি। পৃথিবীটা এতো রঙিন তার আগে কখনও মনে হয়নি। এই ছোয়া এতো আপন! তুলি দূর্বল কণ্ঠে আওড়াল,” আমার কিছু মনে পড়ছে না। বিশ্বাস করুন, কিছুই মনে পড়ছে না।”

প্রণয় তুলিকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে আনল।তুলি চোখ বন্ধ করে প্রণয়ের শরীরের ঘ্রাণ নিল। মনে হলো এই সুগন্ধটা তার চিরচেনা! প্রণয় কিছু বলল না, তাও তুলি শুনতে পেল, ” ভালোবাসি, বড় ভালোবাসি। এর বেশি ভালোবাসা যায় না…”

_____

শেষ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here