তোর নামেই এই শহর পর্ব -০১

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০১

(১)

গুটিগুটি পায়ে পুকুর পাড়ের ছোট্ট আম গাছটার আড়ালে এসে দাঁড়াল হুরায়রা। এখান থেকে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে থাকা যুবকটিকে বেশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। পৌষের শীত। চারদিক ঘণ কুয়াশায় ঢেকে আছে তবুও পুকুরের পশ্চিম পাড়টা বেশ স্পষ্ট ভাবেই দেখা গেলো। খালি পায়ে শিশিরস্নাত ঘাসের বুকে দাঁড়িয়ে বার বার সেদিকেই উঁকি মেরে দেখছিল হুরায়রা। এই শীতে খালি পায়ে বেশিক্ষণ মাটিতে পা ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ভুল করে জুতা ছাড়াই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছিল সে। কিছুটা পথ হেঁটে এসে বুঝতে পেরেছিল জুতা ছাড়াই সে বেড়িয়ে পড়েছে। একবার ভেবেছিল ফিরে যাবে কিন্তু পরোক্ষণেই আবার কি যেন ভেবে আর গেলো না, গুটিগুটি পায়ে আম গাছটার আড়ালে এসে দাঁড়ায়। ফোনে কথা বলতে বলতে যখন যুবকটি এই দিকেই ফিরছিলো তখনি হুরায়রা আরেকটু সরে এসে নিজেকে আরো আড়াল করার চেষ্টা করলো যাতে সে যুবকটির চোখে ধরা না পড়ে যায়। খানিকটা সময় অতিবাহিত হলে হুরায়রা আবারো আম পাতার ফাঁকে উঁকি মারলো, দেখার চেষ্টা করলো এখনো যুবকটি সেখানেই আছে কিনা।
“এই হুরমতি লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখছিস ওই দিকে?”
পেছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠস্বর কর্ণকুহর হতেই জিভে কামড় দিয়ে চোখ বুজে হুরায়রা। শেষ রক্ষা আর হলো না সেই তো ধরা পড়ে গেলো ভেবে মনে মনে একটা ফাঁকা ঢোক গিলল সে। ধুরু ধুরু বুকে প্রচণ্ড ভয় আর সংশয় নিয়ে পেছন ফিরতেই দেখলো ইয়াদ প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে কিছুটা অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো সে। খানিকটা অভিমানী সুরে গাল ফুলিয়ে বলল,
“আপনি আমায় আবার হুরমতি ডাকলেন?”
হুরায়রার গাল ফুলানো দেখে একগাল হাসলো ইয়াদ। বলল,
“কেনো রে তোর বুঝি পছন্দ হয় নি নামটা?”
“একেবারেই না।”
“তুই জানিস এই নামটার পেছনে কত গভীর ইতিহাস লুকিয়ে আছে? ”
হুরায়রা মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়াল। ইয়াদ প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
“তা জানবি কি করে মাথায় তো সব গোবরভরা। ”
“আপনি সব সময় এই কথাটাই কেন বলেন।”
“না বলার মধ্যে তো কোনো মহত্ব খুঁজে পাই না।”
“আপনি আমাকে আর হুরমতি বলে ডাকবেন না। হুরমতি নামটা আমার একেবারেই ভালো লাগে না।শুনলেই কেমন যেন মনে হয়।”
“তুই জানিস হুরমতি কে?
বরাবরের মতো এইবারো মাথা নাড়াল হুরায়রা। প্রচন্ড বিরক্তিতে তার মুখখানা একেবারেই কালছে বর্ণ ধারণ করেছে। আর যাই হোক ইয়াদের মুখে হুরমতি ডাকটা শুনতে তার একটুও ভালো লাগে না। সেটা ইয়াদ ভালো করেই জানে তবুও যে কেন তাকে এই নামটা ধরেই ডাকতে হবে কে জানে।
ইয়াদ হুরায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো। মনে মনে যে হুরায়রা বিষণ চটেছে সেটা তার মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছে সে। তবুও সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল,

“হুরমতি হলেন শহীদুল্লাহ কায়সারের বিখ্যাত উপন্যাস “সংশপ্তক” এর প্রতিবাদী এক নারী চরিত্র। যিনি সমাজের বৃত্তবান দের লালসার স্বীকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছিলেন কিন্তু তারপরও তিনি দমে জাননি প্রতিবাদ করেছিলেন এইসব বৃত্তবান নরপশুদের বিরুদ্ধে,যারা তার সম্মান লুটে নিয়েছিলো। ওই উপন্যাসের আরেকটি কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো যাকে সবাই কানকাঁটা রমজান নামে চেনে। সেই কান কাঁটা রমজানের লালসার স্বীকার হতে হয়েছিলো হুরমতিকে পরে হুরমতি রমজানের একটা কান কেঁটে দিয়েছিলো। বুঝলি তো মাঝে মাঝে নারীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠা খুব জরুরি না হয় তারা তাদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে।”

হুরায়রা মাথা দোলাল। তারপর কিছু একটা ভেবে চিন্তে ইয়াদের চোখে চোখ রেখে বলল,

“কিন্তু তার সাথে আমার কি সম্পর্ক আপনি আমায় কেনো হুরমতি বলে ডাকেন?”

“তোকে এত কিছু বুঝতে হবে না যা বাড়ি যা,আর শুন ফের যদি দেখেছি আমার পিছন পিছন ঘুরঘুর করেছিস তাহলে তোর ফর্সা ঠ্যাঙ দুটো ভেঙ্গে আমি খোড়া করে দিবো।
হুরায়রা ঠোঁট ফুলিয়ে নাক উঁচু করে তাঁকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদ সেদিকে একবার তাঁকিয়ে ভ্রুবিলাস করতে করতে বলল,
“ঠোঁট দুটোতে কি বোলতা হুল ফুটিয়েছিল যে এভাবে ফুলিয়ে রেখেছিস? যা বাড়ি যা। আর এমন ঠান্ডায় জুতো ছাড়া ঘর থেকে বেড়িয়েছিস কেনো?”
ইয়াদের শেষের কথায় সে কোনো জবাব না করলেও ভেতর ভেতর প্রচণ্ড আহত হল। যাকে একটিবার দেখার আশায় সে কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে হাঁড় কাঁপানো শীত গায়ে মাখিয়ে এমন কুয়াশা ঝড়া ভোর বেলায় খালি পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে নাকি তাকে বলছে তার পেছনে ঘুর ঘুর করলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। প্রচন্ড অভিমানে হুরায়রার আঁখি পল্লব দুটি সিক্ত হয়ে উঠে। ইয়াদ সেটা লক্ষ্য করলেও না দেখার ভান করল। হুরায়রা একবার চোখ তুলে তাঁকাতেই ইয়াদ তাকে বাড়ি যাবার জন্য ইশারা করে। ইয়াদের ইশারায় কিছু একটা ছিলো যেটা বুঝতে বেশি দেরি করল না হুরায়রা। তাই আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না সোজা গটগট করে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলো। সে জানে ইয়াদের কথা অমান্য করে আর কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠিক কি হতে পারে। হুরায়রা প্রস্থান করলে ইয়াদ আরো কিছুটা সময় নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে হুরায়রার যাওয়া পানে তাঁকিয়ে থাকে। মেয়েটা বড্ড ছেলে মানুষ। ভালোবাসা নামক মোহ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে বিচরণ করছে। এই মোহ বড্ড ভয়ংকর, সে চায় না এই ভয়ংকর মোহে জড়িয়ে হুরায়রা তার কৈশোরের দুরন্ত সময়টা অকারণেই নষ্ট করুক।

(২)

নামীদামী একটা ফাইভস্টার হোটেলে মুখোমুখি বসে আছে অরা এবং নাবাদ। বিজনেস প্রোজেক্ট নিয়ে একটা ডিল ফাইনাল করতে কয়েকজন ক্লাইন্ট এর সাথে মিটিং করতে মুলত তাদের এখানে আসা। নাবাদ পূর্ণ মনোযোগ সহকারে সামনে থাকা লেফটপ স্ক্রিনে তাঁকিয়ে প্রোজেক্টের ডকুমেন্ট গুলোতে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। অরা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরে নাবাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আচ্ছা মি.ইয়াদ কেন এলেন না এমন একটা প্রোজেক্ট ডিল করতে? আজ অন্ততপক্ষে উনার এখানে থাকা উচিৎ ছিলো।”

” মিস অরা আপনি মনে হয় এত দিনেও এটা বুঝতে পারেন নি যে কোনো ডিল ফাইনাল করতে মি. ইয়াদকে সশরীরে কোথাও উপস্থিত থাকতে হয় না তিনি সব আগে থেকেই হ্যান্ডেল করে রাখেন।”
“কি করে বুঝবো বলো। কাউকে বুঝতে হলে তার কাছাকাছি যেতে হয় কিন্তু মি.ইয়াদ তো তার কাছে কাউকেই ঘেঁষতে দেন না।”
“মিস. অরা আপনি মনে হয় এখনো মি.ইয়াদের ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নন।”
কারো এমন কড়া জবাবে পেছন ফিরে তাঁকায় অরা। ধূসর খয়েরী রঙের শাড়ি পরিহিতা চব্বিশ কি পঁচিশ বছর বয়সী রমনীটির দিকে তাঁকিয়ে মুখ বাঁকায় সে। যেটা একেবারেই রমনীটির নজর এড়াল না। অরার মুখ বাঁকানো দেখেও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া করলো না তিয়াশা। নাবাদের পাশে একটা চেয়ার টেনে সেখানেই দাঁড়ায় সে।
“আরে তিয়াশা তুমি এলে থ্যাংক গড।”
“আসতে একটু লেইট হয়ে গেলো নাবাদ। আসলে ডিলটা নিয়ে ইয়াদের সাথে ফোনে কিছু কথা বলছিলাম তাই আসতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে।”
“ইট’স ওকে তিয়াশা বসো না তুমি। এই একটু পরই ক্লাইন্টরা এসে পড়বে।”
“সেই যাই বলুন না কেনো মিস তিয়াশা মি.ইয়াদ এইভাবে গ্রামে গিয়ে বসে থাকাটা একদম বেমানান। ”

অরার কথায় বেশ বিরক্ত হলো তিয়াশা। মেয়েটা বড্ড গায়ে পড়া স্বভাবের। সব সময় ইয়াদ ইয়াদ করে দুই ঢোক জল বেশি খায় কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারে নি।
কারন ইয়াদ নামক কড়া ব্যাক্তিত্বের অধীকারী সুপুরুষটির কাছে এমন হাজারো অরা হার মেনেছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ তার ব্যাক্তিত্বের ধারে কাছে ঘেঁষার সাহস টুকুও পায় নি কেউ।

ক্লাইন্টদের সাথে ডিল ফাইনাল করে হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো নাবাদ, তিয়াশা এবং অরা। ক্লাইন্টরা বেশ বড় অংকের টাকা ইনভেস্ট করে তাদের প্রজেক্টের সাথে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। এতে করে নাবাদ তিয়াশা দুজনই বিষণ খুশি। এই ডিলটা তাদের কোম্পানির জন্য বিরাট একটা পাওয়া। যেটা তাদের আরো একধাপ সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নাবাদ ফোন বের করে শিল্পপতি ইশরাক ইহতেসাম এর নাম্বারে কল করলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ হতে ভদ্র লোক ফোন ধরেই বলে উঠলেন,
“হ্যালো মাই সন,কি খবর ওই দিকে? সব ঠিকঠাক তো?”
“বাবা ক্লাইন্টদের সাথে আমাদের ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেছে।”
“যাক ভালো হলো। তাছাড়া আমি ধারণা করেছিলাম প্রোজেক্টটা এইবার আমরাই পাবো। ইয়াদকে জানিয়েছো এই ব্যাপারে?
“তার আর দরকার পড়বে না মনে হচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে তুমি কোথায় আছো?”
“অফিসেই আছি এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়বো। তোমরাও আর দেরি করোনা চলে এসো।”
” আমরা একটু পর আসছি বাবা তুমি তাহলে বাসায় চলে যাও।”
“ওকে তাহলে আমি রাখছি। তুমি তিয়াশাকে নিয়ে চলে এসো।”
“ওকে বাবা রাখছি।”
নাবাদ ফোন রেখে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবে তখনি অরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“খবর টা মি.ইফাদকে এক্ষুনি দেয়া দরকার তাই না নাবাদ?”
“মিস অরা আপনি সব সময় এমন বোকা বোকা কথা কেন যে বলেন বুঝতে পারি না। আপনার মনে হয় যে ভাইয়া নিউজটা এখনো না জেনে বসে আছেন? ক্লাইন্টরা অনেক আগেই সেটা জানিয়ে দিয়েছেন।”

নাবাদের কথায় প্রচণ্ড বিরক্ত হলো অরা। সে চাইছিলো সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কিভাবে ইয়াদের কাছাকাছি যাওয়া যায়। তাই ফোন করে খবরটা সে নিজেই দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু নাবাদ তার আশাকে নিরাশায় পরিণত করে দিলো।

অরা ইয়াদের পার্সনাল সেক্রেটারি। ইয়াদের সাথে তার খুব বেশি একটা কথা কখনো হয় নি। দুএকটা অফিসিয়াল কাজের কথা ছাড়া সচরাচর তাদের মধ্যে খুব তেমন কোন আলাপ জমেনি আজ পর্যন্ত। অরা প্রায় কথা বলার কিংবা আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে তবে তাতে খুব একটা উৎসাহ দেয় নি ইয়াদ। সে অনেক করে চেয়েছে ইয়াদের ধারেকাছে ঘেঁষার কিন্তু কোনো সুবিধা আজ অবধি করে উঠতে পারে নি। অরা অনেক চেষ্টা করেছিল ইয়াদের মনোযোগ আকর্ষণ করার কিন্তু প্রতিবারই ব্যার্থ হয়েছে। অরার এমন কাজ কর্মে নাবাদ মজা পেলেও তিয়াশা প্রচণ্ড বিরক্ত। কারন ছেলেদের গায়ে পড়া মেয়ে গুলোকে তার একেবারেই পছন্দ নয়।

(৩)
শিকদার বাড়ির বড় উঠান পেরিয়ে থাকার ঘর। বাড়িতে ডুকে একটু এগিয়ে গেলেই রসুইঘর। সেখানে বসেই রাহেলা বেগম পানের বাটা থেকে একখিল পান সাজিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন। হুরায়রা এতক্ষণ বাড়ি ছিলো না এই মাত্রই ফিরেছে। বাড়িতে ডুকে কোন দিকে না তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে উঠান পেড়িয়ে ঘরের দিকে এগোতেই রাহেলা বেগম রুসুই ঘর থেকে চিল্লিয়ে হুরায়রাকে ডাকপাড়লেন। দাদী ডাক কানে পৌঁছাতেই কলিজায় পানি শুকিয়ে গেলো তার। এক্ষুনি বৃদ্ধা চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলবেন। নিজের পায়ের দিকে লক্ষ্য করে একটা শুকনো ঢোক গিলে সে। পায়ের গোড়ালি বেয়ে র/ক্ত ঝড়ছে। খানিকক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকায় কয়েক ফোঁটা র/ক্ত গোড়ালি বেয়ে নেমে উঠানের শুকনো মাটিতে গিয়ে জমাট হয়েছে। রাহেলা বেগম রসুইঘরের রোয়াকে বসে ছিলেন, সেখান থেকেই তিনি হুরায়রার পায়ের দিকে লক্ষ্য করে চোখের চশমাটা হাল্কা নেড়েচেড়ে নিলেন। গতিক সুবিধার না বুঝতে পেরে হুরায়রা পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করার পূর্বেই বৃদ্ধা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললেন,

“বড় বউ কই গেলা? দৌড়াইয়া আসো, দেইখা যাও দেইখা যাও তোমার মাইয়া কি কাম কইরা আইছে। ইয়া মাবুদ, কই গেছিলি তুই হ্যাঁ এইভাবে পা খান কাঁ/ইটা আইলি কেমনে? কেমনে গড়গড় কইরা র/ক্ত পড়তাছে।”
হুরায়রা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে বলল,
“দাদী কিছু হয় নাই আমার। শুধু শুধু চিল্লাচিল্লি করো ক্যান। এই একটু কাঁ/টছে ওষূধ লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে।”
হুরায়রার কথায় খেঁকিয়ে উঠলেন রাহেলা বেগম। বললেন,
“কিছু হয় নাই তো রক্ত পড়ে ক্যান? ও বড় বউ ছোট বউ কই তোমরা? এত ডাকি কথা কি কারো কানে পৌঁছায় না।”

শ্বাশুড়ির ডাক শুনে হুমায়রা এবং মালিহা দুজনি ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। মাঝ উঠানে মেয়েকে পাংশুবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসতেই লক্ষ্য করলেন হুরায়রার পায়ের গোড়ালি বেয়ে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। হুরায়রা মাকে কিছু বলে পরিস্থিতি সামলে নেয়ার চেষ্টা করতে চাইলো কিন্তু মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর মুখ খুলতে পারলো না মাথানত করেই দাঁড়িয়ে রইলো। হুমায়রা এতক্ষণ একটি বাক্যও ব্যায় করেন নি হুরায়রার পায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মায়ের সন্দিহান চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিল সে। এই নিয়ে না জানি মা আবার কি কাণ্ড করে বসে।
হুমায়রাকে চুপচাপ থাকতে দেখে রাহেলা বেগম পুনরায় বললেন,
“তুমি এমনি খাড়ায়া আছো ক্যান। মাইয়া যে পা কা/টছে দেখবার পারতাছো না। ও ছোট বউ তাড়াতাড়ি ঘরে যাও ওষুদ লইয়া আসো। বড় বউ তুমি ওরে লইয়া এখানে আইসা বসো। কতখানি কা/টছে দেখতে দাও আমারে।”

“তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি কখনো হবে না হুর। তোরে না বললাম সকাল সকাল বাড়ি থেইকা বের হইবি না তাইলে বাহিরে গেলি ক্যান? এমনি কইরা কেউ পা কাইটা আসে? আর এই ঠান্ডার মধ্যে জুতা ছাড়া বাহির হইলি ক্যান তুই।” ইতিমধ্যে রাহেলা বেগম সহ বাড়ির ঝি চাকরের চেঁচামেচিতে একেবারে ঘাবড়ে গেলো হুরায়রা। একদিকে কাঁ/টা পায়ে যন্ত্রনা অন্য দিকে দাদী আর বাকি সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে সব কিছুই অসহনীয় লাগছে তার। কাউকে যে মুখ ফুটে বলবে তার উপায় নেই। এমনিতেই হুমায়রা বেশ রেগে ছিলেন। মেয়েকে বেশ করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে বললেন,
“কতো বার বলেছি তোকে যখন তখন যেখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করবি না তাও যদি তুই আমার কথা শুনতিস।”
“কতখানি পা কাঁটছে সেই খেয়াল কি তোমার মাইয়ার আছে গো বড় বউ?”

“আমাকে পাগল করে ছাড়বে এই মেয়ে আম্মা। কোনো কথাই এই মেয়ের কানের পাশ দিয়ে যায় না।”
মালিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হুমায়রাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
” বুবু তুমি একটু চুপ করো না, আর আম্মা আপনিও একটু চুপ করেন। দেখছেন মেয়েটা এমনিতে ভয়ে চুপসে আছে তার উপর সবাই এমন চেঁচামেচি করে মেয়েটাকে আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।”
“শুনো ছোড বউ চেঁচামেচি কেউ স্বাদে করে না বুঝছো? এতবড় মাইয়া কই না কই ঘুইরা আইসা পা খান কাঁ/টলো সেই খবর কি আর তোমরা রাখো।”
“মালিহা আর কথা বাড়াস না দেখ কি ভাবে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে তুই তাড়াতাড়ি যা ব্যান্ডেজ নিয়ে আয়।”
হুরায়রার আদেশ পেয়ে মালিহা আর কোনো কথা বাড়ালো না দৌড়ে ঘরে গিয়ে ওষুধ, ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে এলো।

বাড়ির দিক থেকে চেঁচামেচির শব্দ কানে আসতেই ইয়াদ বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসে বাড়িতে ডুকতেই রসুইঘরের সামনে একটা ছোটখাটো ভিড় দেখতে পেলো সে। হুরায়রাকে ঘিরে ধরে বসে আছে হুমায়রা, মালিহা, রাহেলা বেগম সহ বাড়ির আরো দুজন পরিচারিকা। হুরায়রার পা থেকে র/ক্ত পড়ছে দেখে ইয়াদ দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলো। ইয়াদকে দেখে রাহেলা বেগম এইবার বিলাপ জুড়ে দিলেন। নানীর এহেন কাণ্ডে বেশ বিরক্ত হলো সে। হুরায়রার পাশে বসতে বসতে বলল,

“উফ নানী এত চিৎকার করছো কেনো? আর সবাই হুরকে ঘিরে বসে না থেকে ফাস্টএইড করে দিলেই তো পারো? আর এই যে তুই পা কাঁ/টলি কি করে?”

হুরায়রা ভয়ে চুপসে আছে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। সে জানে এখন মুখ খুল্লেই ইয়াদ তাকে শাস্তি দিবে তাই সে চুপচাপ নতমস্তকে বসে রইলো। ইয়াদ মালিহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ছোট মামি ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে তুমি আমার ঘরে এসো। আমি হুরকে নিয়ে যাচ্ছি এখানে বসে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করে তো আর পায়ের ক্ষ’ত সেরে যাবে না।
বলেই হুরায়রাকে পাঁজাকোলে তুলে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ইয়াদকে অনুসরণ করে মালিহাও পেছন পেছন ঘরের দিকে ছুটলো। রাহেলা বেগম ধীরেধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন অতঃপর হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“মাইয়া বড় হইছে বউ এখন তারে চোখে চোখে রাখন লাগবো। বয়স ভালা না দেইখা শুইনা রাইখো।”
রাহেলা বেগম চলে গেলে হুমায়রা আরো কিছুক্ষণ সেখানেই বসে রইলো। হুরায়রাকে নিয়ে আজকাল তার বড্ড বেশি চিন্তা হয়। মেয়েটার মাথায় কখন যে কি ভুত চাপে তা বলা দুষ্কর। ইয়াদ আছে বলেই তিনি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। হুরায়রা আর যাই হোক ইয়াদের কথা কখনো অমান্য করে না। বড় ভাই হিসেবে তাকে যতটুকু শাসন করা যায় সে পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে আজকাল তার মনে অন্য কথা উঁকি দিচ্ছে। আর সেটা যদি সত্যি হয় তবে তা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারবেন না। শ্বাশুড়ির বলা কথাগুলোও তিনি একেবারেও ফেলে দিতে পারছেন না। বয়সটা সত্যিই খারাপ আবেগের বশে মেয়ে যদি কোন ভুল করে বসে তবে তিনি তা কি দিয়ে শুধরাবে। যদিও ইয়াদকে তিনি ভরসা করেন কিন্তু নিজের মেয়ে?
চলবে,,,,।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here