তোর নামেই এই শহর পর্ব -২৩+২৪

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৩

(৬১)

বছর ঘুরে শীত এলো। হুরায়রা গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো তখন সূর্য আনুমানিক মাথার উপরে অবস্থান করছে। প্রচন্ড কুয়াশা থাকায় সারাদিন সূর্যের দেখা মিলে নি। হুরায়রা উঠোনে নেমে চারপাশটায় এক বার চোখ বুলালো তারপর জোরকদমে হাঁটা ধরলো পুকুর ঘাটের দিকে। ঘাটের সিঁড়িতে একা বসে আছে ইয়াদ। হুরায়রা কিছুটা পথ এগিয়ে এসে থামলো। নিজের নগ্ন পদদ্বয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে মৃদু হাসলো। ইয়াদকে খুঁজতে আসার তাড়ায় জুতা ছাড়াই ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। শিশিরস্নাত নরম কচি ঘাসের ডগায় পা ফেলতে পায়ে শিরশির অনুভূতি হলো আর তখনি জুতার কথা মনে পড়লো। কিন্তু এখন মনে পড়েও বিশেষ কোন লাভ নেই জুতার জন্য আবার বাড়ি পর্যন্ত ফিরে যেতে পারবে না সে। ইয়াদ অন্যমনস্ক হয়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছে হুরায়রা নিশ্চুপে ইয়াদের পাশে এসে বসলো। দীর্ঘ কয়েক মাস পর আজ হুরায়রা ইয়াদের এত কাছাকাছি এসে বসেছে। হুরায়রা উপস্থিতি ইয়াদের মধ্যে এতটুকু বদল ঘটালো না পূর্বের ন্যায় বসে রইলো সে।
“আপনাকে ফুঁপি মা ডাকছেন। একটু পর গাড়ি ছাড়বে তাদের বিদায় দিবেন না?”
ইয়াদ কথা বলল না। চুপচাপ হুরায়রার বলা কথা গুলো শুনে গেলো। অনেক দিন পর হুরায়রাকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে শুনছে সে। তাই নিজে কথা বলল না তাকে বলতে দিলো।
“কই কিছু বলছেন না যে? আপনি কি তাদের সঙ্গে যাবেন না বলে সত্যিই ঠিক করেছেন। তাছাড়া আপনার স্ত্রীও যাচ্ছেন।”
“হঠাৎ তুই ডাকতে এলি?”
“কেন আমি আপনাকে ডাকতে আসতে পারবো না?”
“হঠাৎ করে এত মেহেরবানি উদয় হলো আমার উপর, বুঝতে পারলাম না।”
“আপনি আমাকে আগে কখনো বুঝেছিলেন যে হঠাৎ আজ বুঝবেন।”
“কথার পিঠে কথা বলার অভ্যেস টা বুঝি তোর গেলো না।”
“অবহেলা করার অভ্যেসটা যেমন আপনার যায় নি।”
ফিরে তাকালো ইয়াদ। হুরায়রার মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। একবছরে কতটা পালটে গেছে মেয়েটা। কাদামাটির মতো নরম মেয়েটা চোখের সামনে কেমন পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। যে চোখে একটা সময় নিজের জন্য কাতরতা দেখেছিলো, সেই চোখেই আজ সহস্র ঘৃণা দেখেছে ইয়াদ। অবশ্য তার জন্য সে নিজেই দায়ী।

হুরায়রা উঠে দাঁড়াল। চলে যাবার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি তার মনে পড়লো লিয়ানার বলা কথাটা। “অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারাটা কারো ব্যর্থতা নয় কিছু কিছু মানুষের অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিত থাকে। অপ্রকাশেই যেন তারা নিজেদের গভীরতা জানান দেয়। অনুভূতির গভীরতা পরিমাপ করার মত ক্ষমতা হয় তো সবার থাকে না তবে যে মানুষটির প্রতি অনুভূতি জন্মায় সে ঠিক বুঝে নেয়। তুমি কি কখনো বুঝতে পারো নি কেউ তোমাকে কঠোরতার আড়ালে গভীর ভাবে ভালোবেসেছিলো।”
চলে যেতে নিয়েও থমকে দাঁড়ায় হুরায়রা। ইয়াদকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিছু বুঝার চেষ্টা করে কিন্তু না নি*ষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পেলো না ইয়াদের মাঝে। তবে হ্যাঁ আজ কাল আর ইয়াদের নিষ্ঠুরতা তাকে ব্যথা দেয় না। একরকম গায়ে সয়ে গেছে। তাই তো সব জড়তা ছেড়ে নির্দ্বিধায় তাকে খুঁজতে এসেছে।
“কি ভাবছিস?”
“উঁহু কিছু না। আপনি চলুন।”
হুরায়রা এগিয়ে চলল বাড়ির পথে। ইয়াদ আটকাতে চেয়েও পারলো না। যে যাবার সে তো যাবেই তাকে আটকাবে এমন উপায় কি তার জানা আছে? উঁহু নেই। সে জানতো এমন একটা দিন ঠিক আসবে যেদিন হুরায়রা নামক কিশোরীটি যৌবনে পদার্পণ করবে। কৈশোরের আবেগ অনুভূতি গুলো ধীরেধীরে রঙ বদলাবে। ইয়াদ যেন এই দিনটাই কল্পনায় দেখেছিলো একদিন।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর এগিয়ে এসেছে তিয়াশা, সামির। গ্রামের সুরু রাস্তা ধরে হাঁটছে দুজন। চারপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের ডগায় পা পেলে চলতে দুজনের ই বেশ লাগছে। তিয়াশা গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছে ঠিকই ইতিমধ্যে তার চোখের কিনারায় জল জমে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষের পাশে এইভাবে আর হাঁটা হয় নি কখনো। কি জানি আজ কি মনে সামির তাকে নিয়ে এলো।
প্রহেলিকার সাদা চাদরে মোড়ানো পথে নিশ্চুপে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থামলো সামির। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আজই চলে যাচ্ছেন?”
“হুম।”
“ইয়াদ যাচ্ছে না কেন আপনাদের সঙ্গে?”
” জানি না, তবে থেকে যাবার মত কারণও দেখছি না।”
“হুরায়রা।”
“হুরায়রা,,,!”
“তিনি যার জন্য সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে পড়ে আছেন।”
“তাতে কার কি লাভ হলো বলুন? ইয়াদ কখনো নিজের অনুভূতি কাউকে ব্যক্ত করে নি।”
“সব অনুভূতি সবার কাছে ব্যক্ত করা যায় না তিয়াশা।”
মুচকি হাসলো তিয়াশা। বলল,
“ইয়াদ হুরায়কে কখনো কিছু বুঝতে দেয় নি। তাছাড়া হুরায়রা নিজেকে অনেক টা গুটিয়ে নিয়েছে, কম আঘাত তো পায় নি সে।”
“ভালোবাসা গুটিয়ে নেয়া যায় বলছেন?”
সামিরের কথায় শুকনো চোখে তাকায় তিয়াশা। অন্তঃকরণে কম্পন অনুভব করে। চাপা কষ্টটা অনেক দিন ধরেই বুকে শিকড় গজিয়ে অনেকটা দূর ছড়িয়ে পড়েছে। সামিরের কথায় নতুন করে সেগুলো মাথা তুলার চেষ্টা করলো। তিয়াশা প্রশস্ত শ্বাস নিলো, মনে মনে ভাবল ‘সত্যিই কি ভালোবাসা নামক বস্তুটাকে গুটিয়ে পেলা যায়?’
ভালোবাসার মানুষটা তার কত কাছে তবুও যেন শত যোজন দূরে। ভালোবেসে ভালোবাসা চেপে রাখা যে কতটা বেদনাদায়ক তা শুধু অন্তর্যামী ই জানেন।
“হুরায়রা ইয়াদকে আগের মতই ভালোবাসেন, তবে ইয়াদ যা করেছে তা মোটেই কাম্য নয়।”
“মানুষ পরিস্থিতির স্বীকার।”
“এই কথাটা আমি অন্তত পক্ষে মানছি না। ইয়াদ চাইলেই পারতেন লিয়ানা কে বিয়ে না করতে।”
“আমি ইয়াদকে বুঝতে পারি না, লিয়ানা কিংবা ইয়াদ এদের দুজনকে দেখলে মনে হয় না এরা স্বামী স্ত্রী।”
“বুঝবেন কি করে।”
“কেন?”
“তারা দুজনি ভিন্ন দুজন মানুষকে চেয়েছিলো। যদিও মি.ইয়াদের বিষয়টা আলাদা।”
“আপনি হুরকে ভালোবাসেন?”
তিয়াশার প্রশ্নে মৃদু হাসলো সামির। দুকদম সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তাতে কি কিছু যায় আসে?”
“এক পাক্ষিক ভালোবাসা গুলো বড্ড যন্ত্রণা দায়ক।”
“হবে হয় তো।”
“এই গল্পে আপনি, আমি কিংবা হুরায়রা সকলেই একপাক্ষিক ভালোবাসায় মজে আছি। কেউ একে ভালোবাসে তো সে অন্য কাউকে, যাকে আপনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন তো সে অন্য কারো মাঝে নিজের ভালোবাসা খুঁজে। বড্ড অদ্ভুত লাগে জানেন।”
“আপনিও কাউকে ভালোবেসেছেন?”
সামিরের অকপটে প্রশ্নে হকচকিয়ে উঠলো তিয়াশা। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে বলতে চাইলো ‘না’ অথচ বলতে পারলো না। কথা আটকে গেলো। সামির মৃদু হেসে বলল,
‘আমি আপনাকে চিনি মিস তিয়াশা। আবেগ লুকানোর অসীম ক্ষমতা আপনার ইয়াদের চেয়ে কম নয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় আবেগ লুকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সেটা বেড়িয়ে আসে সকলের সামনে।”
তিয়াশা নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“ও সব কিছু নয়।”
সামীর কিছু বলল না শুধু স্মিত হাসলো। তিয়াশা লজ্জা পেয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো তবে পারলো কিনা কে জানে। সমীর এক নজর থাকাতেই সে হেসে ফেলল।

(৬২)
লিয়ানা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। একটু পর তারা এই বাড়ি থেকে বিদায় নিবে। আজকাল মেহেরিমা মেহের তার সঙ্গে খুব একটা রাগ দেখিয়ে চলেন না। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। এই বাড়ির মানুষ গুলোর সঙ্গে থাকতে থাকতে কেমন একটা সবার প্রতি মায়া পড়ে গেছে, ছেড়ে যেতে বিষণ কষ্ট হচ্ছে তার।
সময়ের সাথে বাড়ির সকলের সাথে সহজ হতে পারলেও হুমায়রা আর ইয়াদের সঙ্গে খুব একটা সহজ হয়ে উঠতে পারে নি সে। এমন নয় যে ইয়াদ তাকে অবহেলা করছে তবু একটা অদৃশ্য বাঁধা তাদের সহজ হতে দেয় নি কখনো।
নিজের একমাত্র ছেলেটা লিয়ানাকে ভালোবেসে প্রতারিত হয়েছে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি হুমায়রা। লিয়ানাকে তিনি ধারেকাছে সহ্য করতে পারেন না এখনো তবু লিয়ানা ছেয়েছে সব কথা বলতে তাকে কিন্তু তিনি শুনতে চান নি। এই বাড়ির মানুষগুলো তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেও কেউ তার কথা শুনতে চান না। সে বার বার চেয়েছে কিছু কথা বলতে কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে চায় নি।
আজকাল ইয়াদ তাকে একটু বেশিই যত্ন করছে। সময়ে অসময়ে এসে সঙ্গ দিচ্ছে। মন খারাপ থাকলে হাসানোর চেষ্টা করছে অথচ তাকে দেখলে বুঝবার উপায় নেই কতটা ব্যথা সে নিজের মাঝে ধারণ করে দিন কাটাচ্ছে।
“আসবো?”
ইয়াদের কথায় ফিরে তাকালো লিয়ানা। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সে। লিয়ানা প্রত্যুত্তরে বলল,
“আপনারি তো ঘর অনুমতি চাইছেন কেন?”
“এই ঘরটা আমার হলেও আপনি থাকছেন তাই অনুমতি নিতে হচ্ছে।”
“এতটা ফর্মালিটির প্রয়োজন বোধ হয় আমাদের দুজনের মধ্যে না এলেও চলে।”
“আপনি রেডি তো? গাড়ি চলে এসেছে।”
“আপনি যাচ্ছেন না আমাদের সঙ্গে?”
“তাকে ছেড়ে যাবার ক্ষমতা আমার নেই।”
“তবে বিয়েটা,,,।”
“বিয়েটা বিয়ের জায়গায় থাক, ভালোবাসাটা না হয় আমার নিজের থাকুক।”
“আপনি হুরায়রাকে বড্ড ভালোবাসেন।”
“সেটা এখন অপ্রাসঙ্গিক। আমি এই বিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করছি না।”
“নিজেকে প্রকাশ করতে কিসের এত দ্বিধা আপনার?”
“যা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ তা আমি কখনো করি না, আমি চাই না হুর আমাকে,,,।”
“কি?”
“মা ডাকছে চলুন। ঢাকায় গিয়ে আপনার বাবার সঙ্গে একবার দেখা করে নিবেন। নাবাদ বিজনেসের ব্যপারটা গুছিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। আমি সময় করে যাবো একদিন।”
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ইয়াদ। লিয়ানা নিশ্চুপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। জীবনের সমীকরণ গুলো কেমন অমিল হয়ে গেছে। কি করে সব ঠিক করবে সে? পবাদকেই বা কি জবাব দিবে?

চলবে,,,,,।
(আপনারা নিশ্চই জানেন ২০২৩ একুশে বই মেলায় আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ #ফাগুনেরা_মিলেছে_যেথায় আসছে। এরি মাঝে বইফেরিতে প্রি অর্ডার শুরু হয়ে গেছে। ইয়াদ হুরায়রাকে ছোট্ট করে পড়তে চাইলে বইটি আপনি আপনার সংগ্রহে রাখতে পারেন। রোম্যান্টিক গল্পগ্রন্থ #ফাগুনেরা_মিলেছে_যেথায় পড়ে কেউ নিরাশ হবেন না কথা দিতে পারি। তাই বই প্রেমিরা যারা সুন্দর কিছু গল্প পড়তে চান তারা অবশ্যই বইটি নিবেন। ধন্যবাদ। পাশে থাকবেন আর বইয়ের প্রচার করে অন্যকে বইটি পড়ার সুযোগ করে দিবেন।)#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২৪

(৬৩)
বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে বিগত দিনগুলোর কথা ভাবছে হুরায়রা। পুরো একটা বছর কেটে গেছে নিজেকে ভেঙেচুড়ে নতুন করে গড়ে নিতে। কথায় আছে সময় কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। কেউ ভালোবাসে নি বলে যত অভিযোগ তা সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়েছে অনেক দিন আগে। তাই বলে কি নিজের ভালোবাসা টুকুও হারিয়ে গেছে? উঁহু। ভালোবাসা হারায় নি, যা হারিয়েছে তা হলো সময়, আবেগ এবং ভালোবাসা প্রকাশের অদম্য ইচ্ছে। আর যদি অনুভূতির কথা বলি তবে? অনুভূতি গুলো ঠিক আগের মতোই আছে তবে তারা ভাষা হারিয়েছে। আচ্ছা! সব যদি হারানোর ই হয় তবে পেয়েছো টা কি? তবে আমি বলবো আমার আমিত্ব কে। নিজেকে নতুন করে চিনেছি, বুঝেছি আত্নসম্মান কি। কাউকে ভালোবেসে সব বিলিয়ে দেয়া যায় তবে আত্নসম্মান বোধকে নয়। যাকে পাওয়ার আশায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম তাকে পাওয়ার আশা এখন আর করি না। সেদিন বয়সের দোষে মোহ বলে ভুল করা মোহটা যে কখনো মোহ ছিলই না বরং তা ভালোবাসাই ছিল যেদিন সে বুঝবে সেদিন টা তার জন্য নরকযন্ত্রণার চাইতে কম কিছু হবে না। তবে আফসোস নরকযন্ত্রণার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে, কেউ যদি নিজের ভুলে নরকের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছায় তবে আর তাতে কার কি করার থাকে?
ভাবতে ভাবতে দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনলো হুরায়রা। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘আসুন।’
ইয়াদ ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। হুরায়রা পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন না করেই বলল,
‘বড্ড ফাঁকা লাগছে তাই না? চাইলে আপনিও তাদের সাথে যেতে পারতেন অযথা এখানে পড়ে থেকে কি লাভ?’

‘লাভ ক্ষতির হিসেব কষতে আসি নি তোর ঘরে। আর তুই এমন কিছুও বড় হয়ে যাস নি যে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস।’
হুরায়রা এবার উঠে বসলো। ইয়াদ একটা চেয়ার টেনে অদূরে বসে পুনরায় বলল,

‘তোকে কিছু কথা বলার ছিল হুর।’

‘আমাকে বলার মত আপনার কোন কথা অবশিষ্ট আছে বলে তো মনে হয় না। তাছাড়া ফুঁপি মা বলেছেন শহরে গিয়ে আপনাদের বিয়েটা আবার দেয়া হবে।’

‘লিয়ানাকে আমি,,,।’

‘দায়ে পড়ে বিয়ে করেছি এটা দয়া করে বলবেন না। আপনি যে দায়ে পড়ে কিছু করেন না সেটা সবাই জানে।’

‘বার বার নিজের কথাগুলো অন্যের উপর ছাপিয়ে দেয়াটা তোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে হুর।’

‘যেমনটা আপনি করেন। অন্যের উপর জোরপূর্বক অধিকার খাটান।’

‘তর্ক করাটা তোর রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে।’

‘যেমনটা অবহেলা করাটা আপনার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।’

‘তুই কি নতুন করে পুরোনো কথা তুলতে চাইছিস?’

‘মোটেই না। বরং আপনি বারবার,,,।’

‘তুই কিন্তু অবাধ্যতা সীমা অতিক্রম করছিস হুরায়রা।”

‘সেটা করতে আপনি বহুদিন আগে বাধ্য করেছেন আমায়’
ইয়াদ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। হুরায়রা অকপটে জবাব কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না তার। মেয়েটা বদলেছে ঠিকি কিন্তু অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করতে ভুলে নি। আজকাল যা সে পছন্দ করে না সেটাই যেন হুরায়রা করতে বেশি পছন্দ করে। বেশ বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো ইয়াদ। হুরায়রা বিছানা ছেড়ে উঠে তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
‘আমি আর আপনার সেই ছোট্ট হুরায়রাটি নেই। বিয়ে করেছেন নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করাটা আপনার ঠিক হচ্ছে না।’
ইয়াদ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। ফিরে হুরায়রার কাছাকাছি এসে বলল,
‘আবহেলা আমি কাউকেই করি নি বরং সময়ের হাতে সবটা ছেড়ে দিয়েছি। আমি যা করেছি তা তোর ভালোর জন্যই করেছি। ভালোবাসা শুধু একটি শব্দ নয়।’
হুরায়রা হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াদের চোখে চোখ রাখলো। বলল,
‘সময়ের হাতে সব ছেড়ে দেয়া উচিৎ নয় আপনি তা ভুলেছেন।’

‘রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়। আসছি,,।’

ইয়াদ চলে গেলে হুরায়রা দরজা আটকে দিলো। কেন যেন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। এই মানুষটাকে কেন ঘৃণা করতে চেয়েও সে পারে না। এতটা হৃদয়হীন মানুষ হয় কি করে। নিজেকে যতটা কঠিন রাখা যায় তাই চেষ্টা করে হুরায়রা অথচ মানুষটার সামনে গেলেই যেন সব কঠিনতা নিমিষে উবে যায়। এভাবে চলতে পারে না আর। নিজেকে আরো কঠিন করে তুলতে হবে কিন্তু তা কি করে হবে? কার জন্য করবে সে যাকে সে নিজের কঠিনতা দেখাতে চায় সে তো নিজেই কঠিন কোন বস্তু দ্বারা নিজেকে বেষ্টিত করে রেখেছে তা বেঁধ করার কোন উপায় তার জানা নেই।

ঘরে এসে কতক্ষণ পায়চারি করলো ইয়াদ। আজ হয় তো সে নিজের মনের কথাটাই বলতে পারতো হুরায়রাকে কিন্তু পারে নি। সে সত্যিই ভালোবেসেছিলো তার ছোট্ট হুরকে আর আজও বাসে, চিরকাল হয় তো তার ঠোঁট ফুলানো অবুঝ হুরায়রাটাকেই ভালোবেসে যাবে অথচ তার ভালোবাসার কথাটা কখনো প্রকাশ করাই হবে না। অবশ্য সেই দরজা সে নিজ হাতেই বন্ধ করে দিয়েছে। হুরায়রা এখন আর আগের মতো গাল ফুলিয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে তার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় না, অকারণে ভয়ে কেঁদে ফেলে না। মেয়েটা সত্যিই বড় হয়ে গেছে। বুঝে গেছে যার ভালোবাসার জন্য সে মরিয়া হয়ে ঘুরছিল সে মানুষটা হয় তো তাকে কখনো, কোনদিন ভালোবাসে নি আর বাসবেও না অথচ সব কিছুর আড়ালে সত্যিটা গোপনই থেকে গেলো। নিজেকে কঠিন করতে করতে নিজের সবচেয়ে মুল্যবান জিনিসটাই হারিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য তাতে তার এতটুকু আফসোস নেই। কারো ভালোবাসা বাঁচাতে গিয়ে না হয় নিজের ভালোবাসাটাই হারালো তাতে কি এমন আর ক্ষতি ই হলো।
ভাবতে ভাবতে জানাল কাছে এসে দাঁড়ায় ইয়াদ। আকাশে আজ বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে। ছাতিমফুলের সুবাস চারপাশ মাতিয়ে তুলেছে। চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস নিলো ইয়াদ। নিজের ভেতর জমানো কষ্টগুলো তারই সাথে যেন বের করে দিতে চাইলো।

(৬৪)

পা টিপে টিপে ইয়াদের ঘরে ঢুকে সোজা আলমারি কাছে চলে গেলো হুরায়রা। ইয়াদ চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হুরায়রা কিছুটা সচেতন হয়ে দেখে নিলো ইয়াদ সত্যিই ঘুমিয়েছে কিনা। ইয়াদ ঘুমিয়েছে বুঝতে পেরে সে নিঃশব্দে আলমারি খুলে লিয়ানার রেখে যাওয়া বক্সটা হাতে তুলে নিলো। বাক্সটাতে একবার চোখ বুলিয়ে তা খুলতে যাবে তখনি ইয়াদ নড়েচড়ে উঠলো। ইয়াদকে নড়ে উঠতে দেখে তাড়াহুড়ো করে বাক্সটা নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো সে।

হুরায়রা চলে যেতে ইয়াদ চোখ খুললো। ঠোঁট কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে লম্বা হাই তুলে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো।

হুরায়রা ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দ্রুত বাক্সটা খুলে ফেললো। বাক্সতে সে একটা ছবি পেলো যেটা লিয়ানা এবং ইয়াদের বিয়ের ছবি। ছবিটা দেখেই হুরায়রার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। ভালোবাসার মানুষটাকে আর যাই হোক অন্য কারো সঙ্গে দেখার মতো কষ্ট বোধ হয় জগতে আর নেই। ছবিটার দিকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে থেকে দু ফোটা চোখের জল ফেললো সে। ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলল,
“হয় তো এই ছবিটায় আমার থাকার কথা ছিলো, কিন্তু আফসোস আপনি আমাকে সেই জায়গাটাই কখনো দেন নি। এতটা অপমান বোধ করি না করলেই পারতেন আমায়, ভালোই তো বেসেছিলাম ভুল তো করি নি কিছু।”
ছবিটা রেখে সেখান থেকে একটা কাগজ বের করে হুরায়রা। সেখানে লেখা,
“আমাকে ভালোবাসার শাস্তিটা খুব বেশিই পেয়েছিস, তবে যেটার আশা করে বাক্সটা চুপিচুপি আমার ঘর থেকে নিতে এসেছিলি সেটা তুই কোন দিনও পাবি না। আমাকে ভুলে যা হুর এটাই তোর জন্য ভালো হবে। উপর থেকে যতই আমাকে ঘৃণা করিস দেখাচ্ছিস তা যে মোটেই সত্যি নয় সেটা আমি অনেক আগেই ধরে ফেলেছি। নিজেকে আড়াল করার শত চেষ্টা করেও তুই ব্যর্থ কারণ তোর বিপরীত প্রান্তে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তোর ভিতর বাহির সবটা স্পষ্ট দেখতে পায়। তাই তার থেকে নিজেকে আড়াল করার মত বোকামি আর করিস না। লিয়ানা যে কথাটা তোকে বলতে চেয়েছিলো সে কথাটা জেনে তোর বিশেষ কোন উপকার হবে না তাই সেটা জানার আগ্রহটা এখানেই দমিয়ে পেল। যাই হোক ছবিটা দেখে যে প্যাচপ্যাচ করে কাঁদছিস এতে তোকে দেখতে খুব বাজে লাগছে। একদম কাঁদবি না সত্যিটা মেনে নিতে শিখ।”
কাগজটা ভাজ করে রাগে ফুলতে থাকে হুরায়রা। তার মানে ইয়াদ আগে থেকেই সব বুঝতে পেরেছিল তাই লিয়ানার রেখে যাওয়া জিনিস গুলো সে সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু লিয়ানা কি এমন রেখে গিয়েছিলো যেটা ইয়াদকে সরিয়ে ফেলতে হলো? হুরায়রা আর ভাবতে পারলো না প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। একটা মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন একটা কাজ করে।

টেবিলের উপর একটা খাম রেখে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো ইয়াদ। ভোর হতে আর কিছু মাত্র সময় বাকি। পুকুর ঘাটে এসে কতক্ষণ বসবে বলে ঠিক করলো সে। শীত কমে গেছে তবুও চারদিকে বেশ কুয়াশা। ইয়াদ ঘাটে নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে। হয় তো আর কখনো এখানে এসে বসা তার বসা হবে না। হুরায়রার জলে ডুবা পা দেখে মুগ্ধ হওয়া হবে না। পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। যা হয়ে গেছে তা বদলানোর ক্ষমতা কারো নেই তাই যা হচ্ছে তা হতে দেয়াই শ্রেয় বলে মনে হলো তার। মেহেরিমা মেহের যাবার আগে বলে গেছেন সামনের মাসেই তার আর লিয়ানার বিয়েটা তিনি আবার দিবেন। এইবার আর চুপিসারে কাউকে না জানিয়ে নয় বরং বড় করে আয়োজন করবেন তিনি। এতে অবশ্য ইয়াদ কোন প্রতিবাদ করে নি। লিয়ানা বলতে চেয়েছিল কিছু কিন্তু ইয়াদ তাকে আটকেছিলো। বলেছিল সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে।
হুরায়রার সাথে কিছু কথা বলবে বলে ইয়াদ তাদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে যায় নি। কিন্তু সেই কথাগুলো সে বলতে পারে নি। হুরায়রার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। না বলা কথা গুলো আর বলা হয়ে উঠে নি।

ধীরেধীরে চার দিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পুকুর পাড়ের শিমুল গাছটার আগায় একটা কোকিল বসে কুহুরব করছে। ইয়াদ সে দিকে তাকিয়ে হাসলো। চোখ বুজে বিগত দিন গুলোর কথা মনে মনে ভাবলো। হুরায়রা ঠোঁট ফুলানো মুখটা চোখে বাসতেই স্মিত হাসে সে। বলল,
“তোকে ছেড়ে থাকার সাধ্য আমার কোন কালে ছিলো না হুর তাই তো সব ছেড়ে ছুড়ে তোর কাছেই পড়েছিলাম। তুই তো আমার প্রহর শেষে আলোয় রাঙ্গা সেই চৈত্রমাস যার চোখে আমি শুধু আমার সর্বনাশ দেখেছিলাম। জানি না কতকাল তোকে না দেখে আমায় কাটাতে হবে। তোকে ভালোবেসে আজ রিক্তহস্তে ফিরতে হচ্ছে আমায় এর জন্য বোধ হয় আমিই দায়ী। তবে তোর ভালোর জন্য যদি আমায় আমার ভালোবাসা বলি দিতে হয় তবে আমি হাসি মুখে তা বলি দিতে প্রস্তুত। তোর আর আমার এক হওয়া সম্ভব নয় কখনো। বিধাতা আমাদের এক করে পাঠান নি হয় তো। তোকে ছেড়ে যেতে বিষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমার যে আর কোন উপায় নেই।”

ঘাট ছেড়ে রাস্তায় নামলো ইয়াদ। ভোরের আলো ফুটেছে সবে। কিছুটা পথ এগোলেই তার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। গন্তব্য এয়ারপোর্ট। সে পারবে না লিয়ানাকে নিজের করে নিতে, মনসম্রাজ্য জুড়ে যে এতকাল একমাত্র সম্রাজ্ঞী হয়ে রাজত্ব করে এসেছে তাকে কি করে রাজ্য হারা করবে সে?

তিন বছর কেঁটে গেছে ইয়াদ চলে গেছে। কোথায় গেছে তা জানে না হুরায়রা। সেদিন তাকে না জানিয়ে নীরবে বিদায় নিয়েছিলো ইয়াদ। এরপর থেকে আর কোন খবর নেই। হুরায়রা চেষ্টা করে নি জানার, কেন যেন ইচ্ছে করে নি জানতে। নীরব অভিমানগুলো নীরবেই যেন অভিমানের পাহাড় গড়ে তুলেছে অন্তঃকরণে। নাবাদ, তিয়াশা অনেক বার কিছু বলতে চেয়েছিলো তাকে কিন্তু সে আর কিছুই শুনতে চায় নি। ইয়াদ নামক বিশাক্ত অনুভূতিটা যেন তাকে পাথর করে তুলেছে।
ইয়াদ যাবার কয়মাস পর লিয়ানা ও ফিরে গেছে বিদেশে। ইয়াদকে লিয়ানা ক্ষমা করতে পেরেছে কিনা জানে না হুরায়রা তবে সে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না তাকে। ভালোবাসা ঠিক যতটা সুন্দর ঘৃণা তার চেয়ে অধিক কুৎসিত। ইয়াদ না পেরেছে তার ভালোবাসার দাম দিতে না পেরেছে স্ত্রীকে মর্জাদা দিতে। সে শুধু একটা কাজই পেরেছিলো তা হলো অবহেলা।

গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে হুরায়রা দু’বছর হলো। ইয়াদে পাশের ঘরটাতেই এখন সে থাকে। তবে কখনো ইয়াদের ঘরে পা রাখে নি। মেহেরিমা ভেবেছিলো ইয়াদের ঘরটায় হুরায়রাকে থাকতে দিবে কিন্তু হুরায়রা তাতে আপত্তি জানায়। সে চায় নি ইয়াদের কিছুতে নিজের অধিকার বসাতে। তাছাড়া একটা সময় সে যাকে ভালোবেসেছিলো আজ তাকে মন থেকে ঘৃণা করে।

এরমাঝে আরো কয়েক মাস কেঁটে গেলো। হুরায়রার কেন যেন হঠাৎ ইচ্ছে হলো ইয়াদের ঘরে যেতে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে একবার যাবে বলে মনোস্থির করলো সে।

চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here