তোর নামেই এই শহর পর্ব -২১+২২

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২১

(৫৭)

ইয়াদের সঙ্গে করে লিয়ানাও বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। বড় উঠোন পেড়িয়ে থাকার ঘর। উঠোনের একপাশে রসুইঘর। রুসুই ঘরের অদূরে রাহেলা বেগমের অতি যত্নে বেড়ে উঠা শাকসবজির বাগান। লিয়ানা বাড়িতে পা রেখেই সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। এর আগে কখনো গ্রাম দেখে নি সে। ইয়াদের হাত ধরেই প্রথম গ্রামে এসেছে। লিয়ানা খেয়াল করলো রসুইঘরের দুয়ারে বসে একজন বৃদ্ধা আচার রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। বৃদ্ধাকে দেখে চিনতে পারলো সে ইনিই ইয়াদের নানী। রাহেলা বেগমকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো লিয়ানা। এই বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ তার খুব চেনা। বিশেষ করে এই বাড়ির মেঝো মেয়ে হুরায়রা। হুরায়রার ছবি সে অনেক বার দেখেছিলো। অনেক গল্পও শুনেছে তাকে নিয়ে। অবশেষে আজকে তাকে দেখার সুযোগ হলো তার। অবশ্য এই বাড়ির মানুষগুলোর সাথে এইভাবে পরিচিত হতে হবে কোন দিন কল্পনা করতে পারে নি সে। অথচ ভাগ্য তাকে আজ এখানে টেনে নিয়ে এসেছে অপরিকল্পিত ভাবে অন্য একজনের সঙ্গে করে।

মাঝ উঠোনে এসে বাঁধা প্রাপ্ত হলো ইয়াদ লিয়ানা। রাহেলা বেগমের ডাকে তাকে মাঝ উঠোনেই দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাদের। বৃদ্ধা চেঁচিয়ে বললেন,
“তোর লগে এইডা কেডা ইয়াদ? তুই সারা রাইত কই ছিলি? কাউরে না কইয়া কই গেছিলি।”

ইয়াদের ইচ্ছা হলো না এসব কিছু নিয়ে এখন কথা তুলতে কিন্তু রাহেলা বেগম দমে যাবার পাত্রী নন। তিনি এগিয়ে এসে লিয়ানাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
“এই মাইয়া বউ সাইজা আছে ক্যান। কার বউ বাড়িত আইনা তুলছোস। তুই কি বিয়া করছোস কাউরে না জানাই?”

নানীর পর পর প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিতে পারছে না ইয়াদ। নানীকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাহেলা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির সকলে উঠোনে এসে জড়ো হয়েছে। ইয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে তর্জনী আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে বলল,

“কি করছো কি নানী একটু থামো আমাকে বলতে দাও?”

বৃদ্ধা ইয়াদের কথা তোয়াক্কা করলেন না বিলাপ জুড়ে দিলেন। বাড়ির সকলে পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে রইলো। মেহেরিমা হুমায়রা রসুই ঘরে ছিলো। তাদের বেড়িয়ে আসতে একটু দেরি হচ্ছিলো। শ্বাশুড়ির মরাকান্না শুনে হাতের কাজ ফেলে বেড়িয়ে এলেন দুজন। নাবাদ তিয়াশা দ্রুত এগিয়ে এসে ইয়াদের পাশে দাঁড়াল। ইয়াদ তখন নিশ্চুপ। বাড়ির সকলের চোখে প্রশ্ন। তিয়াশা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ইয়াদ মিস লিয়ানা এখানে কেনো। আর ও এইভাবে বউ সেজেছে কেনো?”

ইয়াদ জবাব দিতে গিয়েও পারলো না। গলা ধরে এলো। তিয়াশা তৎক্ষণাৎ আবার জিজ্ঞেস করে বলল,
“কি হলো কিছু বলছো না কেন উত্তর দাও। আপনি এখানে কেনো লিয়ানা আপনার তো এখানে আসার কথা নয়।”

“তিয়াশা উনাকে আমিই নিয়ে এসেছি।”
এইবার তিয়াশা ভ্রু কুচকে ফেললো। বলল,

“মানে?”

“মানে উনি আমার সঙ্গে এই বাড়িতে এসেছেন।”
ইশরাক ইহতেসাম এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এইবার মুখ খুললেন। বললেন,

“কাল তুমি কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলে। আর লিয়ানা তুমি এখানে কেন? তোমার বাবা ইয়াদের সঙ্গে এখানে আসতে দিলোই বা কেন?”

সকলের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উঠেছে ইয়াদ। এমনিতেই সারা রাত তার মনের উপর দিয়ে কম ঝড় বয়ে যায় নি। বাড়ি এসে একের পর এক সকলের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। যত সময় যাচ্ছে সকলের মধ্যে উৎকন্ঠার পরিমান বাড়ছে কিন্তু ইয়াদ সে কি জবাব দিবে সকলকে?
বিতৃষ্ণায় তার চারদিক্র আধার ঘনিয়ে এলো। নিজেকে যত শান্ত রাখা যায় তার চেষ্টাই করলো সে।
মেহেরিমা মেহের পুরো ঘটনায় থ হয়ে রইলেন। তিনি ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছেন এক দৃষ্টিতে। অপেক্ষায় আছেন ইয়াদ কি জবাব দেয় তার আশায়।
মুনতাসির আহসান বাড়ি ছিলেন না। তুরিনের শ্বশুর বাড়ি থেকে এই মাত্র ফিরলেন। বাড়িতে ঢোকার আগেই তিনি বাড়ির পরিবেশ বুঝতে পেরেছিলেন। অবশ্য এতক্ষণে যে বাড়ির পরিবেশ ঠিক থাকার কথা নয় এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।

নাবাদ ইয়াদের কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে ইয়াদ। নাবাদ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ইয়াদকে কিছু বুঝাতে চাইলো কিন্তু ইয়াদ তাতে কোন সায় দিলো না পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ রইলো। ইয়াদকে নিশ্চুপ দেখে ইশরাক ইহতেসাম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ঘটনার কিছুটা তিনি এখন আঁচ করতে পারছেন। মি.মেহেবুব শেষ পর্যন্ত ইয়াদকে ফাঁসিয়ে ছাড়লেন এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
মুনতাসির বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পরিবেশ বদলে গেলো। এইবার আর কারো জানতে বাকি রইলো না লিয়ানা ইয়াদের সঙ্গে কেনো এসেছে। গত রাতে ইয়াদ লিয়ানাকে কাজী অফিসে বিয়ে করেছে আর সকালেই মুনতাসির তুরিনের শ্বশুরের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলো কথাটা।

পুরো বাড়ি জুড়ে থমথমে পরিবেশ। মেহেরিমা মেহের কেঁদে কেটে একাকার করে দিচ্ছেন। মালিহা তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয় নি কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছিত হয়ে পড়লেন দুইএকবার। পুরো ঘটনায় বাড়ির একজন সদস্য এখনো পর্যন্ত মুখে রা শব্দটি করেন নি। আর তিনি হলেন হুমায়রা। ভদ্র মহিলা লিয়ানাকে দেখার পর থেকে একেবারে চুপ মেরে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইয়াদকে নিয়ে যেই ভয়টা করেছিলেন তাই হয়েছে। ইয়াদ শুধু নিজের সর্বনাশই করে নি সাথে করে হুমায়রার সর্বনাশও করেছে। লিয়ানাকে তিনি ইয়াদের সাথে দেখবেন সেটা কল্পনায় ভাবতে পারেন নি। মেয়েটাকে উঠোনে এক নজর দেখেই হুমায়রার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। তিনি জানেন না পরবর্তী পরিস্থিতি তিনি কি করে সামাল দিবেন।

(৫৮)

বাড়ির উঠোনে ছোটখাটো ভিড় জমেছে। জাফর আহমেদ হুরায়রাকে নিয়ে পরিক্ষা কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। এই মাত্র মেয়ে আর ইনানকে নিয়ে ফিরলেন। বাড়ির কাছাকাছি এসে বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে বাড়িতে। হুরায়রা জোর কদমে এগিয়ে গেলো বাড়ির পথে গেইটের কাছে এসে উঠানে ভির দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।
“বাড়িতে এত ভিড় জমেছে কেনো বাবা কারো কিছু হয় নি তো।”
জাফর আহমেদ সহসা জবাব দিতে পারলেন না কারণ ঘটনার কোন কিছুই তার অবগত নয়। তিনি সকালে হুরায়রাকে নিয়ে বেড়িয়েছেন। আজকে হুরায়রার পরীক্ষা ছিলো। আসার পথে কলেজ থেকে ইনানকে সাথে করে ফিরেছেন।

হুরায়রাকে গেইটের কাছে দেখতে পেয়ে হুমাশা এক ছুটে বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে এলো গেইটের কাছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
“জ্যাঠু তাড়াতাড়ি ঘরে আসো ইয়াদ ভাই কারে জানি নিয়া আইছে বাড়িতে। ফুঁপি আম্মা কান্না কাটি কইরা দুইবার মুর্ছা গেছেন।”
হুমাশার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না হুরায়রা। জাফর আহমেদ কথা না বাড়িয়ে ঘটনা বুঝতে দ্রুত গতিতে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। হুরায়রা ইনান মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। কি এমন ঘটনা ঘটে গেছে এর মধ্যে যার জন্য ফুঁপি আম্মা মুর্ছা গেছেন দুবার? না হুরায়রা আর ভাবতে পারলো না। পরিস্থিতি যে খুব একটা সুবিধার না সেটা কিছুটা আঁচ করতে পারছে সে।
ইনান পিছনে ছিলো দুকদম এগিয়ে এসে হুরায়রার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তুই দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস। চল যাই কি ঘটেছে দেখি।”

“হু। তুই যা আমি আসছি।”

“দাঁড়ায় থাকিস না তাড়াতাড়ি আয়।”

“হু।”
হুরায়রা বাড়িতে পা রাখতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। উঠোনে জড়ো হওয়া মানুষদের মধ্যে কয়েকজন কি সব কানাঘুষা করছে। হুরায়রার কানে দুইয়েকটা শব্দ এলেও পুরোপুরি সেদিকে মনোযোগ দিতে পারলো না। অচিরেই মনটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠেছে তার। হুমাশা এই একটু কথা বলেই আবার চলে গেছে। পুরো কথাটাও শেষ করে নি। মনে সংশয় নিয়ে এক পা দুপা করে এগিয়ে গেলো সে। মাঝ উঠোনে এসে হঠাৎ মেহেরিমার চিৎকারের শব্দ কানে এলো হুরায়রার। ভদ্রমহিলা চিৎকার করে চেঁচিয়ে বলছেন,
“এই মেয়েকে আমি কিছুতেই বউ বলে মেনে নিবো না ইয়াদ। এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে কখনো আমি মানবো না, একে যেখান থেকে এনেছিস সেখানেই রেখে আয়।”
হুরায়রার কানে আর কোন শব্দ গেলো না। ভেতরটা তৎক্ষণাৎ মুচড়ে উঠলো। চোখের সামনে যা দেখছে সব অন্ধকার লাগছে। তবে কি ইয়াদ বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছে? হুমাশা এই কথাটাই বুঝাতে চেয়েছিলো? না আর ভাবতে পারছে না সে পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাপছে। গলাটাও কেমন শুকিয়ে উঠছে তার।

একপা দুপা করে সদর দরজা পেড়িয়ে বসার ঘরের দিকে এগুতে লাগলো হুরায়রা। উঠোনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা এখনো কানাঘুষা করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজনকে বলতে শুনা গেলো,
“শহর থেইকা বিয়া কইরা আনছে ইয়াদ। কাউরে একবার জানাইলো না। এই পোলা তো এমন কাম করার মানুষ না কেমনে করলো এইকাম। আহারে মেহেরিমা মাইয়াডা থাইকা থাইকা মুর্ছা যাইতাছে। কথাগুলো শ্রবণ হতেই থমকে দাঁড়ায় হুরায়রা। তার পা আর সামনে এগুতে চাইছে না। বুকের ভেতর ডিব ডিব করছে। হাত পা ইতিমধ্যে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। মাথাটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে। মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে উঠেছে। সামনে এক পা এগোবে তার শক্তি পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে টলতে টলতে বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল হুরায়রা। রাহেলা বেগম দরজার কাছে বসে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। হুরায়রা দাদীর পাশ কাটিয়ে ঠেলে ঘরে ডুকতেই ইয়াদের মুখটা নজরে এলো। পরিবারের সকলে নিশ্চুপ। মেহেরিমা মেহের নাক টেনে টেনে কাঁদছেন আর আঁচলে চোখ মুছছেন। তিয়াশা অরা নাবাদ তিনজনেই এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হুরায়রা একবার করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো।

ইয়াদের পাশে লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে লম্বা গোমটা টেনে একটা মেয়ে জড়সড়ভাবে বসে আছে। ইয়াদ তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। হুরায়রা এই দৃশ্য আর চোখে ধারণ করতে পারলো না অচিরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

চলবে,,,।#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_২১(আংশিক)

(৫৯)

মুর্ছিত হুরায়রার শিয়রের কাছে বসে আছে ইয়াদ। মেয়েটার জ্ঞান নেই প্রায় ঘন্টা খানেক হলো। হুমায়রা মেয়ের পায়ের কাছে বসে তেল মালিশ করছে। হাত পা শীতল হয়ে আছে হুরায়রার। মালিহা কাঁচা রসুন সরিষা তেলে গরম করে এনে ইয়াদের হাতের কাছে রাখলেন। ইয়াদ একটু তেল নিজের হাতে নিয়ে হুরায়রার হাতে ঘঁষতে আরম্ভ করলো। মালিহা হুরায়রার চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ইয়াদকে বললেন,
“নতুন বউ ঘরে একা একা বইসা আছে ইয়াদ। বুবু কেঁদেকেটে একাকার কইরা দিতেছে মেয়েটা নিশ্চই সব শুনতেছে। তুমি বরং বউর কাছে যাও আমরা আছি হুরারার কাছে।”

ইয়াদ নড়লো না। ঠাঁয় বসে রইলো হুরারার পাশে। হুরায়রার মুর্ছিত মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতর টা হুহু করে উঠলো। সে জানতো এমন কিছুই ঘটবে এই ভয়টাই সে কাল থেকে পাচ্ছিলো। কিন্তু কি করার তার সমুখে তো কোন পথ খোলা ছিলো না। বিয়েটা তাকে করতেই হতো।
ইয়াদের অন্তঃকরণে সাংঘাতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কঠিন করে রাখতে চেয়েও পারছে না। হুরায়রার মুর্ছিত মুখের দিকে তাকিয়ে তার পাষাণ হৃদয় খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যেতে লাগলো। মেয়েটা বড্ড বেশি ভালোবাসে তাকে। প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে তাইতো পুরো ঘটনা সামলে নিতে পারে নি মুর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলো মাটিতে।

হুমায়রা মেয়ের পায়ে গরম তেল মালিশ করে গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাত বেড়েছে। মেয়েটা একবারের জন্যও চোখ মেলে তাকায় নি। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন কিন্তু লাভ হয় নি। মুর্ছিত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। জাফর আহমেদ একবার এসে মেয়েকে দেখে গেছেন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করলেন অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দুলাতে দুলাতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। হুমায়রা মেয়ের শিয়রের কাছে এসে কপালে স্নেহভরে চুম্বন করলেন। তার সাত রাজার ধন মেয়েটা কেমন ধুপ করেই নিভে গেলো। কাল সন্ধ্যে বেলায়ও হাসিখুসিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে রেখেছিলো অথচ আজ? টপ করে এক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রুবিন্দু চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ইয়াদ হুরায়রার এক হাতে নিজের মুঠোয় ভরে রেখেছিলো। হুমায়রাকে কাঁদতে দেখে সে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। হুমায়রা আঁচলের কোণে চোখ মুছে বলল,

“রাত বাড়ছে। এইবার যাও বাবা। বাড়ির সকলে খেতে বসবে তুমিও যাও। নতুন বউ তুমি না গেলে তার খাওয়া হবে না।”

“মামী মা! আপনিও আমাকে ভুল বুঝছেন সবার মতো?”

“এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় নয় ইয়াদ। দেখছো না মেয়েটা কিভাবে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে।”
ইয়াদ এবার হুরায়রার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। হুরায়রার চোখের নিচে ঘাঢ় করে কালি পড়েছে দেখেই বুঝা গেলো অনেক রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। ইয়াদ এতদিন খেয়াল করে দেখেনি আজ নজরে পড়তেই বুকের বা পাশটায় চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব হলো। নিজেকে হুরায়রার কাছ থেকে দূরে করে রেখেছিলো এতদিন। হুরায়রাও কম কিসের সেও ইচ্ছে করে ইয়াদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে। ইয়াদ চেয়েছিলো হুরায়রা আগের মতো তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করুক। ভালোবাসি বলে বলে জ্বালিয়ে মা/রুক কিন্তু না হুরায়রা তেমন কিছুই করে নি দিনের পর দিন তাকে এড়িয়ে চলেছে। সামিরের সঙ্গে অবসর সময় কাঁটাতে শুরু করছে। ইচ্ছে করেই তাকে কষ্ট দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলো হুরায়রা। কথার অবাধ্য হওয়া, যখন যা খুশি তাই কি করেনি মেয়েটা অথচ এইসব কিছুর পেছনে যে গোপন অভিমানটা মাথাচাড়া দিয়ে বসেছিলো কে জানতো। প্রথম প্রথম মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিলো ইয়াদের, ভেবেছিলো শাস্তি দিবে মেয়েটাকে কড়া শাসনে রাখলে অবাধ্য হবে না অথচ সে সবের কিছুই পারে নি ইয়াদ। অদৃশ্য কোন শক্তি তাকে বাঁধা দিয়েছে বার বার। বিবেক বলেছিলো চলতে দাও তাকে তার মতো কেন অধিকারবোধ খাটাবে তুমি, তারই বা কি দায় তোমার কথা মেনে চলবে। অভিমানিনী হুরায়রা ভালোবাসার নামক নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছে রাতের পর রাত। কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে অশ্রুবর্ষণ করে কিন্তু ওইযে পাষণ্ড মন তার এক তিল ও নড়লো না অবিচল থাকলো নিজের কঠিনতায়।

হুরায়রা মাথায় আলতো হাত ছোঁয়াল ইয়াদ। আজ ইচ্ছে করছে সমস্তটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিতে তার অবুঝ হুরমতিটাকে। অথচ আজ সে নিরুপায়। বুকে পাথর চাপা দিয়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ছাতিমফুলের গন্ধ পুরো ঘর জুরে। এই ছাতিমফুলের গন্ধটা একটা সময় হুরায়রা পছন্দ করতো না। নাক মুখ কুঁচকে বলতো “কি বিচ্ছিরী গন্ধরে বাবা। এ আবার ফুলের গন্ধ হতে পারে নাকি।” অথচ সেই হুরায়রা যেদিন জানলো ছাতিমের ঘ্রান ইয়াদের বেশ পছন্দের সেদিন থেকে এই বিচ্ছিরী গন্ধটাকেও সে আপন করে নিয়েছে। সন্ধ্যের পর ছাতিমফুলের মাধকা গন্ধে সারা বাড়ি ভোরে উঠতো। সন্ধ্যের আগে নিজের ঘরের দরজা জানালা লাগিয়ে বসে থাকতো হুরায়রা পাছে তার ঘরে চলে যা গন্ধটা। অথচ সেদিনের পর থেকে রোজ রাতে ঘরের জানালা খুলে ঘুমোতে শিখে গেছে। কাউকে ভালোবাসলে বুঝি এমনটাও করা যায়। অপছন্দের জিনিসটাও কত সহজে পছন্দের হয়ে উঠে।

পুবের হাওয়া বইছে। ইয়াদ জানালার কবাট কিঞ্চিৎ মেলে দিয়ে আবার জায়গায় গিয়ে বসলো। হুরায়রা হাতটা মুঠোভরে আলতো চুমুতে সিক্ত করে তুললো। বিড়বিড় করে বলল,

“মহানায়ক কাকে বলে জানিস তো হুর। যে নিজের আবেগ, ভালোবাসা অনুভূতি আড়াল করে দিব্যি সকলের সঙ্গে ভালো থাকার অভিনয় করে যায়। জীবনের রঙ্গমঞ্চে আমার চেয়ে বড় অবিনেতা মহানায়ক বুঝি আর দ্বিতীয়টি হয় না। যে পুরুষ কোন কিশোরী প্রেমিকার প্রেমাবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারে তার চেয়ে হৃদয়হীন এই ভুখন্ডে বোধকরি আর একটিও নেই। আমার পাষাণহৃদয় তোকে বারবার আঘাত করেছে। ক্ষতবিক্ষত করেছি কারণে অকারণে তবুও তোর মনের গভীরে প্রেবেশ করে ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারি নি। আমি এক ব্যার্থ প্রেমিক পুরুষ যে হৃদয় নিঙ্গড়ে ভালোবেসেও ষোড়শী প্রেমিকার কাছে ভালোবাসার কথাটি ব্যক্ত করতে পারি নি। আমায় ক্ষমা করিস হুর। এই ইহজম্মে হয়তো তোর সাথে আমার মিলনের পথ বন্ধ হয়েছে। তবে তুই জেনে রাখিস এই ইয়াদ তোর ছিলো তোর আছে আর তোরই থাকবে।”

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ইয়াদের অনর্গল বলে যাওয়া কথাগুলো শ্রাবণ করছে লিয়ানা। বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। সে তো চায় নি এমনটা হোক তবে বিধাতা কেন তাকে এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। সে শুধু চেয়েছিলো বউ হয়ে এবাড়িতে আসার। স্বপ্নেও দেখেছিলো অনেক অথচ কে জানতো তার স্বপ্নটা যে এইভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে ভুল মানুষের হাত ধরে।

হুরায়রার ঘরে সামনে এসে লিয়ানাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন হুমায়রা। এতরাতে তাকে হুরায়রার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুও চমকালেন না তিনি বরং স্বাভাবিক ভাবে বললেন,

“আমার মেয়েটাকে দেখছো বুঝি? ভেবো না এখন ওকে দেখছো আজ নাহয় কাল আমার ছেলেটারো এই দশা হবে। ভাগ্যিস এখনো সে কিছু শুনতে পায় নি।”

লিয়ানা চমকে পেছন ফিরে তাকালো। অন্ধকারে হুমায়রা মুখ লক্ষ্য করে বলল,
“পবাদকে কিছু জানাবেন মা। ও সহ্য করতে পারবে না।”

“আমি মা হয়ে কি করে সব সহ্য করি বলো। ছেলেটা আমার কত আশা করে তোমার ছবি দেখিয়ে বলেছিলো মা দেশে আসি এইবার দেখবে তোমার সাথে এইবার ঠিক দেখা করিয়ে দিবো।”

“আমাকে ক্ষমা করুন মা। আমি চাই নি বিয়েটা করতে বাবা আমাকে,,,।”

“আমি জানি না আমার ছেলেটা কি করে এসব সহ্য করবে। বড্ড ভালোবেসেছিলো তোমায়। কেন এক মাস আগে দেশে ফিরে এলে আর কয়টা দিন অপেক্ষা করে এলে তো এই দিন আমাকে দেখতে হতো না।”

“পবাদ চেয়েছিলো ওর আগে আমি ফিরি দেশে। ও সেমিস্টার চলছিলো। আমি শেষ না করেই তাড়াহুড়ো করেছি দেশে ফেরার জন্য। অবশ্য বাবা আমাকে চাপ দিয়েছিলেন তাই আগেই ফিরে এসেছি। এসেই,,,।”
আর বলতে পারলো না লিয়ানা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হুমায়রা প্রশস্তা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন,

“আমি জানতাম আমার মেয়ে ইয়াদকে বিষণ ভালোবাসে। মা তো বুঝতে পেরেছিলাম। ইয়াদ যে কোন দিন হুরায়রার পাগলামি গুলোতে সায় দেয় নি সেটাও জানতাম। আমি নিজেই চেয়েছিলাম ইয়াদ যেনো হুরায়রাকে বাঁধা দেয়। মেয়েটা বড্ড সরল চাই নি কষ্ট পাক।”

“মি.ইয়াদ খুব কঠিন মানুষ আমি কাল রাতেই উনাকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। উনার ব্যাক্তিত্বকে কেউ এক তিল টলাতে পারে এমন শক্তি নেই। আমার বাবাও হিমশিম খেয়ে গেছেন উনার বুদ্ধির কাছে কিন্তু শেষে কি হলো জানি না উনি নিজেই রাজী হয়ে গেলেন বিয়েটা করতে।”

“এসব আর বলে কি হবে। অনেক রাত হয়েছে তুমজ ঘরে যাও আমি ইয়াদকে পাঠাচ্ছি তোমার ঘরে।”

“উনাকে এখানে থাকতে দিন। হুরায়রার উনাকে দরকার।”

হুমায়রা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“আর দরকার হবে না।”

“এ কথা কেন বলছেন।”

“প্রয়োজন পুরিয়ে গেলে আর কি দরকার থাকে।”

“আপনি চাননি ইয়াদ হুরায়রাকে ভালোবাসুন।”

“না চাই নি। আর এখনো চাই না।”

“কিন্তু কেন?”

“ওই যে একটু আগে বললে ওকে টলায় সাধ্য কার।”

“হুরায়রার ব্যাপারটা কিন্তু আলাদা উনিও হুরায়কে।”

“নিজের স্বামীকে নিয়ে এসব বলতে নেই লিয়ানা রাত হয়েছে ঘরে যাও।”
লিয়ানা আর কিছু বলতে পারলো না। এক নজর ঘরের ভেতর দেখলো। ইয়াদকে এত বেসামাল দেখে বুঝার বাকি নেই সে নিজেও হুরায়রাকে সমান ভাবেই ভালোবেসেছে।#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্ব-২২(বাকি অংশ)

(৬০)

সাপ্তাহ খানেক কেটে গেছে হুরায়রা নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। মা ছাড়া এই বাড়ির কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলে না সে। তিয়াশা নাবাদ চেষ্টা করেও হুরায়রাকে কথা বলাতে পারে নি। মাঝে মাঝে হুমাশার সাথে দুই একটা কথা বলে তাও প্রয়োজন হলে। লিয়ানা বেশ কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে হুরায়রার ঘরের সামনে থেকে সাহস হয়নি ভেতরে প্রবেশ করার। মেহেরিমা আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক তবে লিয়ানাকে তিনি চোখের সামনে সহ্য করতে পারেন না। ইয়াদ মাকে বুঝাতে চেয়েছিলো কিছু তবে পারে নি। তার শব্দভাণ্ডারে এমন কোন শব্দ অবশিষ্ট নেই যার দ্বারা মাকে বুঝাতে পারবে তাই চেষ্টা করা অনর্থক মনে করলো।

দিন এগারো পরে হুরায়রা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। মোটামুটি নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছে সে। সকালের সোনালী রোদ পুকুরের উত্তর কোণে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছের আগায় এসে পড়েছে। হুরায়রা খালি পায়ে উঠোনে নেমে সোজা হাঁটা ধরলো পুকুর ঘাটের দিকে। ঘাটে এসে বুক পানিতে নেমে ইচ্ছে মতো কয়েকটা ডুব দিয়ে নিলো। পরপর কতগুলো ডুব দিয়ে উঠে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে এসে বসলো হুরায়রা। তার চিবুক অনবরত কাপছে। এক সঙ্গে কতগুলো ডুব দেয়ায় চোখ নাক রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে উঠেছে। হুরায়রার দৃষ্টি অবনত পানির দিকে। পানির উপর নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে নিজেকে বেশ খানিকটা সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। নিজের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আনমনে হেসে উঠে সে। সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক ছিঁড়ে। এই কয়দিন নরকযন্ত্রণা কি তা দেখে নিয়েছে সে। অনেক কেঁদে, নিজেকে কষ্ট দেয়ার আর কোন পথ সে বাকি রাখে নি অথচ যার বিরহে সে কাতর সে তো দিব্যি মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইয়াদের কথা মনে পড়তেই মাথাটা টন টন করে উঠলো হুরায়রা। না সে আর চায় না ইয়াদকে মনে করতে। যে লোকটা জেনে বুঝে তাকে এতটা নরকযন্ত্রণা ভোগ করিয়েছে তাকে আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না। যে ভালোবাসার মুল্য দিতে জানে না সে অপরের ভালোবাসা পাবে কি রুপে। হুরায়রা নাক টেনে পুনরায় বুক পানিতে নামলো। পরপর আরো কয়েকটা ডুব দিয়ে চোখ বুজে স্থির হয়ে দাঁড়াল পুকুরের জলে। পুকুরের শান্ত শীতল জল তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বেশ শান্তি অনুভব করলো হুরায়রা। ভেতর থেকে লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকালো চারদিকে। রঙ্গিন পৃথিবীটা চোখের সামনে কি করে এতটা বেরঙ্গিন হয়ে উঠছে তাই দেখলো চারপাশে তাকিয়ে। ভালোবাসা অদ্ভুত রকমের নির্মম। হুরায়রা এই কয়দিনে তাই উপলব্ধি করেছে। যার ভালোবাসায় সে কাতর সে ছাড়া বাকী দুটি পুরুষ তাকে ভালোবেসে তার বিরহে কাতর। কি অদ্ভুত নিয়ম ভালোবাসায় যে তাকে চায় না মন বারবার তারই কাছে ছুটে যায়, আর যে তাকে চায় তাকে সে চায় না। আজ আবরারে কথা মনে উঠতেই হুরায়রার ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। আবরার হয়তো তাকেও এমন করে ভালোবেসেছিলো আর প্রতিনিয়ত ভালোবেসে না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটপট করেছে। অথচ তার করার কিছু ছিলো না সে তো ইয়াদকে ভালোবেসেছে কি করে অন্য কাউকে মন দিতো। কিন্তু আজ আর ইয়াদের প্রতি তার মন নেই। এই কয়দিনে সে বুঝে গেছে। স্বার্থপরতার কাছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কেবল দাবার গুটি মাত্র।

ধীরেধীরে পুকুর থেকে উঠে আসে হুরায়রা। ওড়না ভালো করে মাথায় পেছিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেলো। পুকুরের অপর পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ হুরায়রাকে অবলোকন করছিলো ইয়াদ। এই কয়দিনে হুরায়রা যেন কত বড় হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নিতেও শিখে গেছে মেয়েটা। “আচ্ছা আঘাত পেলে কি মানুষ এক ধাক্কায় অনেকটাই বড় হয়ে যায়? তাই হবে হয় তো।” মনে মনে ভাবলো ইয়াদ।

বাড়িতে এসে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো হুরায়রা। ভেজা কাপড় ছেড়ে কলাপাত রঙ্গের শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিলো। ভেজা চুলগুলো সামান্য মুছে পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। রাহেলা বেগম সিঁড়ির কাছটায় বসে ছিলেন। হুরায়রাকে বেড়িয়ে যেতে দেখে ডেকে বললেন,

“ও হুর এমনি চুল ছাইড়া কই যাস। দেখ চুল থেইকা কেমনে টপ টপ কইরা পানি ঝরতাসে।”
হুরায়রা দাদীর কথায় বাঁধা প্রাপ্ত হলো। দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো দাদীকে। বৃদ্ধা পান চিবুতে চিবুতে কথাটা বলছিলেন। হুরায়রা দাদীর মুখে নজর বুলিয়ে পাশের লোকটার মুখের দিকে তাকালো। ইয়াদ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বসে আছে নানীর পাশে। হুরায়রা কয়েক পা পেছনে এসে দাদীকে বলল,

“চুলের পানি পড়লে কেউ মরে না দাদী। মরার যদি হইতো তবে এগারোদিন আগেই মরে যাইতাম। তখন যেহেতু মরি নাই আর এখন সামান্য চুলে পানিতে আমার কিছু হবে না।”

“মুখে মুখে কথা কস ক্যান হুর। আয় আমার সামনে আইয়া বয় আমি মুইছা দেই।”

“তোমাকে কষ্ট করে মুছে দিতে হবে না দাদী। আমি আমার খেয়াল রাখতে জানি। এই সামান্য চুলের পানি হুরায়রার কিছু করতে পারবে না।”
ইয়াদ বুঝলো হুরায়রা কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। অবশ্য বলাটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কম অপরাধ তো সে করে নি। এখন যে পাবে সেই তো কথা শুনাবে।

কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না হুরায়রা। ধুপধাপ পা পেলে হেঁটে চলে গেলো। খুব রাগ হচ্ছে তার। ইয়াদকে দেখে রাগটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। এতটুকু অপরাধ বোধ নেই নিজের মধ্যে। এমন ভাব নিয়ে বসে আছে যেন সে কিছুই করে নি। এত কিছু হওয়ার পরো কি করে নির্লজ্জের মতো স্বাভাবিক থাকতে পারে। না হুরায়রা আর ভাবতে পারলো না। দ্রুত এগিয়ে গেলো ইয়াদের ঘরের দিকে।

লিয়ানা নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে রাখছে আলমারিতে। ইয়াদের আলমারির একপাশ এখন তার দখলে। হুরায়রা ঘরে ঢুকতেই দৃশ্য চোখে পড়লো। অন্তঃকরণে কিঞ্চিৎ ব্যাথা অনুভব হতেই সে নিজেকে সামলে নিলো। প্রশস্ত দম নিয়ে এগিয়ে এসে লিয়ানার সামনে দাঁড়াল। লিয়ানা আলমারি বন্ধ করে পেছন ফিরতেই চমকে গেলো। আচমকা হুরায়রাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। হুরায়রা নিজের মধ্যে কিছুটা কঠিনতা ধারণ করে বলল,

“আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে আশা করি সময় হবে আপনার।”

“অবশ্যই। কি বলতে চাও বলো। আসলে এই কয়দিন আমিও চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু পারি নি। তুমি তো কারো সঙ্গে,,।”

“আমি এখানে আপনার কথা শুনতে আসি নি। বলতে এসেছি।”
হুরায়রার কোমলমতি কন্ঠে দৃঢ়তাভাব স্পষ্ট ফুটে উঠলো। লিয়ানা অবাক হয়ে দেখলো হুরায়রাকে। এই কি সেই হুরায়রা যার কথা সে পবাদের কাছে রোজ শুনতো। হুরায়রা কোন ভণিতায় গেলো না সরাসরি বলল,

“আপনি কি করে পবাদ ভাইকে ঠকাতে পারলেন। আমার ভাইতো আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। শুনেছি আপনিও তাকে কম ভালোবাসেন নি তবে কি করে আমার ভাইকে ঠকাতে পেরেছেন। আপনার কি একবারো বুক কেঁপে উঠেনি যে যাকে ভালোবেসেছেন তারই পরিবারের আরেকজন সদস্যকে বিয়ে করে তারই বাড়িতে উঠেছেন।”

“হুরায়রা আমি পরিস্থিতির স্বীকার। পরিস্থিতি আমার পক্ষে ছিলো না।”

“পরিস্থিতি কখনো কারো পক্ষে থাকে না। আপনি ভুল করেছেন। আপনি শুধু এই বাড়ির মানুষগুলোকেই অপমান করেন নি আমার ভাইয়ের জীবনটাও নষ্ট করেছেন। কি ভুল ছিলো আমার পবাদ ভাইয়ের? আপনি তাকে এতটা কষ্ট দিতে পারলেন কি করে।”

“তোমরা সকলেই আমাদের ভুল বুঝছো হুরায়রা।”

“আমরা কেউই ভুল বুঝি না। আমি আমার কথা না হয় বাদই দিলাম আমি না হয় ঘুরেও একজনের মন পেলাম না কিন্তু আপনি কি করেছেন আমার ভাইয়ের সাথে ভালোবাসা দেখিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করে আমাদের বাড়ি চলে এলেন। এতটুকু লজ্জা করে নি আপনার। ওহ হ্যাঁ আপনার লজ্জা করবে কি করে আপনি তো বাহিরের মেয়ে এই বাড়ির ছেলেই তো লাজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছেন। নিজের পরিবার বাবার সম্মান মামাদের সম্মান কিছুই মাথায় রাখেন নি।”

“তুমি কি মি ইয়াদকে বলছো?”

“আপনার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে নাকি বাংলা বুঝেন না ঠিক কিরে?”

“হুরায়রা আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। আমি জানতাম না মি.ইয়াদ তোমাদের পরিবারের একজন।”
হুরায়রা লিয়ানার মুখের দিকে তাকালো না। রাগে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। লিয়ানা আর কিছু বলতে যাবে তখনি সে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনি কাজটা ভালো করেন নি। আমার ভাই জানলে কতটা কষ্ট পাবে ভেবে দেখেছেন একবার? সে আপনাকে ভালোবেসেছিলো।”

“আমিও পবাদকে ভালোবেসেছি হুরায়রা। আমি তো ইচ্ছা করে কিছু করি নি। বাবার বলির স্বীকার হয়েছি। আমার কি দোষ বলতে পারো।”

হুরায়রা এবার কিঞ্চিৎ হাসলো। লিয়ানা হুরায়রা মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার মুখে আলাদা একটা মায়া যেন উপচে পড়ছে যেন। হাসিটাও বিষণ রকমের সুন্দর। সেদিন গাড়িতে ইয়াদের মুখে হুরায়রার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছিলো খুব। পবাদ যদিও এতটা বলে নি কখনো ছবিতে দেখিয়েছিলো। আজ নিজের সামনে হুরায়রাকে দেখে যেন সে চোখ সরাতে পারছে না। একজন মেয়ে হয়ে তার বড্ড হিংসে হচ্ছে হুরায়রার মুখশ্রী দেখে। এতটাও সুন্দর হতে পারে কোন মানুষ।

হুরায়রা ঘর থেকে বেরোতে নিলে ইয়াদকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখলো। ইয়াদ বাহুতে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হুরায়রা মুখোমুখি হতেই সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“এই ঘরে তোর বিশেষ কোন প্রয়োজন আছে হুর?”
হুরায়রা জবাব দিতে ইচ্ছে করলো না তাও অগত্যা দিতে হলো বলল,

“আমার কোথায় কি প্রয়োজন সেটাকি আপনাকে জানাতে হবে?”

“ধরে নে তাই।”

“ভুলে যাবেন না বাড়িটা আমার। তাই প্রয়োজনে এই বাড়ির যে কোন ঘরে যাওয়ার অধিকার রাখি আমি।”

“বাড়িটা তোর হতে পারে কিন্তু ঘরটা আমার।”

“পরোয়া করছি না।”

“তা করবি কেন দিন দিন অসভ্যে পরিণত হচ্ছিস।”
ইয়াদের শেষের কথায় ফোঁস করে উঠলো হুরায়রা। চটজলদি জবাব দিয়ে বলল,

“একজন অসভ্যই পারে অন্য অসভ্যকে চিনতে। কথা বলে না যে রতনে রতন চিনে।”

“তুই আমাকে অসভ্য বলছিস হুর।”

“তার চেয়ে কম কিছু ভাবছেন নিজেকে। আমরা তো মনে হয় আপনি অসভ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন।”

“হুর।”
বলেই ইয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলল,

“হুরায়রা তুই কিন্তু।”

“আমাকে কিছু বলার অধিকার আপনি হারিয়েছেন। তাই নতুন করে কিছু বলে নিজের সম্মানটা হারাবেন না। মনে রাখবেন আমি আর আগের হুরায়রা নেই। আপনি আমাকে ভেঙ্গে ছুড়ে গুঁড়িয়ে দিলেও আমি নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলেছি। আজ আমায় ভাঙ্গে সাধ্য কার।”

ইয়াদ আর কথা বলতে পারলো না। তার ভেতরট ধুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে হুরায়রা। মেয়েটা কথার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে শিখে গেছে। ইয়াদ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। হুরায়রা কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না ইয়াদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সঙ্গে করে নিয়ে গেলো ইয়াদের বেদনাতুর হৃদয়ের হাহাকার রেখে গেলো শুধুই প্রেমিক পুরুষের দীর্ঘশ্বাস।

চলবে,,।

(গতপর্বে ক্রমিক নং ভুল হয়েছিল। ২২পর্বকে ভুল করে ২১ পর্ব লিখা হয়েছে। এডিট ছাড়া পর্ব। গল্প প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আশা করছি সবাই ঘটনমুলক মন্তব্য করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here