তোর নামেই এই শহর পর্ব -২৫ ও শেষ

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#পর্বঃ২৫_(শেষ পর্ব)

(৬৫)

“আমার অতন্দ্রিতা। আমার নিশি জাগরণকারিণী। কতশত রাত তার মুখ চেয়ে কাটিয়েছি জানা নেই।”

“তবে ছেড়ে এলেন কেন?”
হাসলো ইয়াদ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“মাঝে মাঝে ভালো থাকার উপায় খুঁজতে হয় ধরে নিন তেমনই কিছু। তাছাড়া কাউকে না কাউকে তো ছেড়ে আসতেই হতো”

“আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবেসেছেন তবুও কেন এত দূরত্ব।”

“ভালোবাসায় দূরত্ব না থাকলে প্রেমের স্বাদ আস্বাদন হবে কি উপায়ে।”

“হেয়ালি করছেন?”

“উঁহু। ভাবছি,,।”

“কি ভাবছেন?”

“তিয়াশা আপনাকে ভালোবাসে।”

“আপনার ভুল ধারণা।”

“তিয়াশাকে ছোট থেকেই দেখছি, ওর চোখ কখনো মিথ্যা বলে নি। মানুষ মিথ্যে বললেও চোখ কখনো তা পারে না।”

“মি.ইয়াদ আমরা নিশ্চই এসব আলোচনা করতে এখানে আসি নি। তাছাড়া মিস.তিয়াশা এই ব্যপারে আমাকে কিছু বলেন নি কখনো।”

“তার কারণ আমি। ভয়ে ছিলো মেয়েটা যদি আপনাকে ভালোবাসে বলে আমি কষ্ট পাই। যাই হোক বোন টা তো আমারই কি করে ভাইয়ের শত্রুকে বলবে ভালোবাসি।”
সামির কিছুটা অস্বস্তি তে পড়ে গেলো। সত্যিই কি তিয়াশা তাকে ভালোবেসেছিলো? কই সে তো কখনো বুঝতে পারে নি কিছু। তিয়াশার কথা মনে হতেই মনে হলো সেদিন তিয়াশা তাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, বুঝিয়েছিলো সেও কাউকে ভালোবাসে আর সেই কেউটা যে নিজেই হবে তা মনে আসে নি।

সামিরকে ভাবতে দেখে ইয়াদ সরাসরি প্রশ্ন করে বসলো,
“কি ভাবছেন, তিয়াশা কেন সব বলতে চেয়েও পারে নি?”
“সেসব নিয়ে ভাবছি না।”
“আপনি হুরায়রাকে ভালোবেসেছেন সামির , অথচ হুরায়রা আমাকে আর আমি,,,।”
“নিজের ভালোবাসাটা এবার স্বীকার করেন নিন মি.ইয়াদ। লিয়ানার কথা না হয় বাদ ই দিলেন। আপনাদের মাঝে সে এসেছে ঠিকই কিন্তু,,,।”
“সে আমার স্ত্রী। আমি পারি না তাকে অবহেলা করতে।”
“তাই তো করেছেন এতদিন।”
ইয়াদ চুপ করে গেল। ইয়াদকে চুপ থাকতে দেখে সামির অধর প্রসারিত করলো। বলল,
“মাঝে মাঝে বুদ্ধিমানরা ও বোকামি করে। আর আপনি তাই করেছেন। এত চেয়েও কিছুই করতে পারেন নি। সব কিছুই ছিলো পাতানো ফাঁদ, আর আপনি তাতেই জড়িয়েছেন।”

“পরিহাস করছেন।”

“আপনাকে পরিহাস করার মতো ইচ্ছা আমার কোন কালেই ছিল না, আপনি ফেঁসেছেন তাতে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু খুশি আর হতে পারলাম কোথায়।”

“আপনার খুশি হওয়ার মাঝে তো কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি তবে অখুশি হবার কারণ কি।”

“তা যদি বুঝতেন তবে এই কঠিনতার খোলস ছেড়ে সেদিন ই বেড়িয়ে আসতেন।”

“আপনি বড্ড একরোখা। সেই ইনিয়েবিনিয়ে হুরকে টেনে আনবেন। আর আমি চাই না আমাদের সব কথায় হুর চলে আসুক।”

“আপনি পালিয়ে এসেছেন।”

“নিজেকে বাঁচাতে নয়।”

“হুরের মুখোমুখি দাঁড়ানো সাহস আপনার নেই।”

“বাহ, হুরায়রা থেকে সোজা হুরে চলে গেলেন?”

হাসলো সামির। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পার্কে লোকজনের সমাগম কমে এসেছে। প্রচণ্ড শীত পড়েছে এই কয়দিন। গত দুদিন তো বাসা থেকে বের হওয়ার উপায় ছিলো না। আজকে রোদ পড়েছে লন্ডন শহরে। আবহাওয়াও বেশ চমৎকার আর তাই সময় ব্যয় না করে ইয়াদের সঙ্গে দেখা করতে চলে এলো।

পার্কে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। গন্তব্য টেমস নদীর তীর। অবশ্য লন্ডন শহরটা টেমস নদীর তীরেই অবস্থিত। ইয়াদ কিছুদূর এগিয়ে এসে থামলো। সামিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি করে জানলেন আমি লন্ডনে আছি?”
“লিয়ানা বলেছে।”
“আমি তাকে জানাই নি আমি কোথায় আছি।”
“পবাদ জানিয়েছে।”
“সে এটা করবে না।”
“যদি বলি হুরায়রা এখন লন্ডনে ই আছে।”
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো ইয়াদ। কপালে ভাঁজ ফুটে উঠেছে তার। প্রায় তিন ঘন্টা দুজন একসাথে রয়েছে অথচ সামির একবারো সে কথা জানালো না?
ইয়াদকে অবাক হতে দেখে সামির বলল,
“জানালে কি করতেন আপনি? আবারো পালাতেন?”

“আমি পালাবো কে বলল আপনাকে?”

“তবে তাকে না জানিয়ে রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়েছিলেন কেনো?”

“আমি চাই না হুর আমাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখুক। সে সময় চলে গেছে তা আর ফিরে আসবে না তাছাড়া সে আমাকে এখন ঘৃণা করতে শিখে গেছে। আমি নতুন করে তার মনে ফাগুনের ফুল ফুটাতে চাই না।”

“আপনি চিরকাল তাই চেয়ে এসেছেন। কিন্তু কি করা যাবে বলুন আমি তো কথা দিয়ে এসেছি। আপনার জন্য টেমস নদীর তীরে অপেক্ষা করছে সে।”

“আমি বিবাহিত। আমার পক্ষে যা কখনো সম্ভব নয় তা আমি কোন কিছুর বিনিময়ে করতে পারবো না। হুরকে আমায় ছাড়ায় জীবনে এগিয়ে যেতে হবে। ওর মোহ কেটে গেছে অনেক দিন আগে আর অবশিষ্ট যেটুকু অনুভূতি বাকি ছিলো তা শেষ হতে কয়েক মুহূর্ত যথেষ্ট। ”

“আপনি কি করতে চাইছেন বলুন তো। মেয়েটা এতদূর ছুটে এসেছে শুধু আপনার মুখোমুখি হবে বলে।”

“লিয়ানা প্রেগন্যান্ট সামির।”

“বাচ্চাটা আপনার নয় তা আমি জেনে গেছি।”

“শত্রু পক্ষের এত কিছু জানা ভালো খবর নয়।”

“আমি হুরায়রার জন্য সব করেছি।”

“তাতে লাভ কি হলো?”

“কেন জেদ করছেন ইয়াদ। মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে আপনাকে।”

“আমার অঘোষিত প্রেম শুধু হুরের জন্য, তবে আমাদের পরিণতি বড্ড করুণ। সব ভালোবাসা সবার জন্য নয়, আর সবার ভালোবাসা পরিণতি পাওয়া উচিৎ নয়। কিছু প্রেম বিচ্ছেদেই সুন্দর।”
বলে সামিরকে রেখে উলটো পথে হাঁটা ধরলো ইয়াদ। সামির উপায় না পেয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ। কি জবাব দিবে সে হুরায়রাকে।

টেমস নদীর তীরে একা দাঁড়িয়ে আছে হুরায়রা। অতিত হাতরে বেড়িয়েছে এতসময়। সেদিন ইয়াদের ডাইরির শেষের পাতা টুকু পড়ে বুঝেছিলো ইয়াদও তাকে ভালোবেসে প্রতিনিয়ত কতটা যন্ত্রণায় কাটিয়েছিলো। পুরো তিনটে বছর সে একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বেড়িয়েছিলো শুধু। কেন এত ভালোবাসার পরো তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো ইয়াদ, কেন এত অবহেলা এত অবজ্ঞা? এত লুকোচুরির কি খুব দরকার ছিলো। একটা সহজ স্বীকারোক্তি দিতে কেন এত অভিনয়? সব জানতে চায় সে।

“পলাশ বনে লাগিছে আগুন, মনের বনে বইছে হাওয়া, কে যেন এসে বলিছিলো কানে কানে ফাগুন যে এসেছে মনের কোণে রেখেছো কি খবর?
আমি দেখছিলুম তাকে আগুন রাঙা শিমুল ডালে কোকিল ডাকা স্নিগ্ধ ভোরে,
সে যে ঘুরে বেড়িয়েছিলো আমার চারিপাশে।
ধোঁয়া উঠা শীতল দিঘির জলে নিজেকে দেখিতে মত্ত ছিলো মোর অতন্দ্রিতা,
তাহারই এক ফাঁকে আমি কাতর চোখে দেখেছিলুম তাকে,
সে বুঝেনি আমার ব্যাকুল হৃদয়ের আকুলতা। তাকে ভালোবেসে নিস্বঃ হয়েছি কতশত বার,
সে আর কেউ নয়,আর কারো নয়,
সে আমার হুরপরী, আমার অতন্দ্রিতা।”

হলুদ খামের ভেতর একটুকরো চিরকুট। টেবিলের একপাশে অনাদরে পড়েছিলো। হুরায়রা পুনরায় সেটা জায়গায় রেখে ইয়াদের খাটের একপাশে এসে নিশ্চুপে বসলো। হঠাৎ এতদিন পর বুকের বা পাশটা কেমন যেন চিন চিন করে ব্যথা করছে। নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। কাউকে ভুল বুঝে ভুল প্রমাণিত হওয়ার মত যাতনা বোধ হয় আর কিছুতে মেলে না। ইয়াদ তাকে নিভৃতে ভালোবেসেছিলো। ভালোবেসে তা গোপন করার মতো যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বয়ে চলেছিল প্রতিনিয়ত অথচ কেউ তা বুঝতেও পারে নি। ইয়াদের ব্যথাতুর চোখের ভাষা সে পড়তে পারে নি।
ডুকরে কেঁদে উঠলো হুরায়রা। সেদিনের কথা মনে করে ভেতরটা মুচরে উঠলো তার। চিরকাল নিজের ভালোবাসাকেই বড় করে দেখেছে আর বিশ্বাস করেছে ইয়াদ নামক নিষ্ঠুর মানুষটা শুধু অবহেলা করতেই জানে ভালোবাসা নামক বস্তুটা তার অস্তিত্বের কোথাও নেই। অথচ সব কিছুর অবসান গঠিয়ে যেদিন সে সত্যিটা জানলো তখন মানুষটা তার থেকে শত যোজন দূরে। অদৃশ্য অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছিলো মনে তাই তো খুব দেরি করে ফেলেছে জানতে। তবে আজ আর কোন অপেক্ষা নয় এইতো আর কিছুটা সময় বাকি তারপরই সকল অপেক্ষার অবসান।

টেমস নদীর তীরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। হুরায়রা বুক ভরে শ্বাস নিলো। চোখ বুজে ইয়াদের মুখটা কল্পনা করলো। অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হতে চাইছে না। অপেক্ষা যে মাঝে মাঝে সুখকর হয় তা প্রথম অনুভব করলো হুরায়রা। তার বুক ডিব ডিব করছে, চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে না সে। এক পা দু’পা করে কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে। পায়ের শব্দ তার থেকে কিছুটা দূরে এসে মিলিয়ে গেলো। হুরায়রার ঠোঁট দুটো অচিরেই প্রসারিত হলো। দীর্ঘ তিনি বছরের জমানো রাগ, অভিমান, অপেক্ষার অবসান। এক্ষুনি বুঝি ইয়াদ তাকে ডেকে বলবে,
“হুরমতি।”

“হুরায়রা”
আচমকা ডাকে চোখ মেলে তাকালো হুরায়রা। সামীর পেছনে থেকে করুন কন্ঠে তার নাম ধরে ডাকলো। বিস্ময়ে ভ্রু যুগল কুচকালো হুরায়রা। পেছন ঘুরে দেখলো সামির উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। হুরায়রা দুই একবার ইতিউতি তাকিয়ে বলল,
“উনি বুঝি আমার অপেক্ষা করছেন কোথাও? আচ্ছা চলুন যাই আমরা।”
“ইয়াদ আসেন নি।”
“জানি তিনি আসবেন না। আমাকেই যেতে হবে চিরকাল তো তাই করে এসেছেন। আমিই সারাদিন পেছন পেছন ঘুর ঘুর করেছি। আজ কি আর নতুন করে তিনি অভ্যাস পরিবর্তন করবেন বলুন?”
হুরায়রার চঞ্চলতা দেখে সামির মনে মনে দমে গেলো। সে কি করে বলবে ইয়াদ তাকে ফিরে যেতে বলেছে। ইয়াদের নিষ্ঠুরতার কাছে যে হুরায়রা প্রেম নিছক অর্থহীন।

সামিরকে নিশ্চুপ দেখে মন ভার হয়ে উঠলো হুরারার। সামিরের নীরবতা যেন তাকে কিছু বুঝাতে চাইছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মৌন হয়ে গেলো সে। সামীরের নীরবতা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে ইয়াদ আসে নি আর তার জন্য কোথাও অপেক্ষাও করছে না।
অপেক্ষার ফল সমসময় সুখকর হয় না এটাই বোধহয় নিয়তির লেখন। হুরায়রার বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছু। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও কেন যেন পারছে না, নেত্রযুগল ভারী হয়ে এলো।
“আবারো ঠকে গেলাম। এতদিন না জেনে ঠকেছি আর আজ জেনে। মাঝে শুধু এতটুকু বদলেছে, একটা সময় আমি জানতাম তিনি আমাকে ভালোবাসেন না বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন আর জানলাম ভালোবেসে সেচ্ছায় বিচ্ছেদ উপহার দিলেন।”
“আমি দুঃখীত। কিছুই করতে পারি নি।”

“চলুন যাই।”

“কোথায় যাবেন।”
জবাব দিলো না হুরায়রা। সামির কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। এই গল্পে পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার সংখ্যাটাই বেশি।

(৬৬)

টেমস নদীর তীরে একা দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদ। ঠিক যে জায়গাটায় এতক্ষণ হুরায়রা দাঁড়িয়ে ছিলো সে জায়গাটায়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো হুরায়রাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কষ্ট হাল্কা করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো কই। চোখ জুড়ে তার ঠোঁট ফুলানো হুরমতির মুখটাই ভাসছে। এই শহর জুড়ে শুধু তারই আধিপত্য, যার নামে লিখে রেখেছে হৃদয় সমুদ্রের অতল গভীরে লুকিয়ে রাখা একটুকরো শহর।
“তোর নামেই এই শহর! শত পথ, শত যোজন হেঁটে বেড়িয়েছি, গড়েছি তুই নামক একটি শহর। লিখে রেখেছি অনন্তকালের বহ্নিশিখায় পুড়ে ছাঁই হওয়া অশ্রুকণার নিঃশেষিত বিন্দু কুড়িয়ে। আমি পালাই নি শুধু এতটুকু স্বস্তি চেয়েছি। কিন্তু তা আর পেলাম কোথায় মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে কাটিয়ে দিয়েছি বহুকাল, বেলা ফুরিয়ে এসেছে যে তুই নামক শহরটিতে। এই অবেলার কালবেলায় ফুরিয়ে এসেছে সময়।”

ধীরেধীরে হেঁটে গাড়ির কাছে এলো ইয়াদ। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। লিয়ানা অনেক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছে। আজকাল সর্বক্ষণ ডাক্তারের চেক আপে থাকছে সে। সময় ঘনিয়ে এসেছে, কয়দিন পর ছোট্ট প্রাণটা পৃথিবীর আলো দেখবে।

হাসপাতাল এসে ইয়াদ সরাসরি লিয়ানার কেবিনে চলে গেলো। এই সময়টা লিয়ানার জন্য খুব কষ্টকর। নিজের প্রিয় মানুষটা কাছে নেই। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটাকে জন্মদিতে গিয়ে প্রাণটাই না দিতে হয় মেয়েটার। ইয়াদকে দেখে মুচকি হাসলো লিয়ানা। শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলো। ইয়াদ ইশারায় উঠতে বারণ করে নিজেই পাশে গিয়ে বসলো।
লিয়ানা নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
“ছেলেটা আর আঁধারে থাকতে চাইছে না ইয়াদ। পৃথিবীর আলো দেখতে বড্ড তাড়া তার।”
ইয়াদ লিয়ানার হাত ধরে বলল,
“আরেকটু অপেক্ষা করতে বলো তাকে, এক্ষুনি তার বাবা এসে যাবে।”
“আমার হাতে বেশি সময় নেই ইয়াদ।”
“এমন কথা বলতে নেই। বাচ্চা জন্মদিতে গিয়ে সবাই মরে যায় না। এক্ষুনি এতটা ভেঙ্গে পড়ছো কেন?”
“পবাদ কে আসতে বলুন যতদ্রুত সম্ভব।”
“পবাদ এয়ারপোর্ট গেছে।”
লিয়ানা অবাক হলো। বলল,
“এই সময় কেন?”
“হুরায়রাকে প্লাইটে তুলে দিয়েই এখানে আসবে।”
“আপনি কি চাইছেন বলবেন একটু?”
“তা জেনে আপনার বিশেষ কাজ নেই। আপনি ছোট্ট প্রাণটার কথা ভাবুন।”
“আমি আপনাদের আলাদা করে দিয়েছি।”
“আমরা কখনো এক হইনি তাহলে সেখানে আলাদা হবার কথা আসছে কোথায় থেকে। আর নিজেকে দায়ী করবে না একদম। আমি যা করেছি তা আপনি এবং পবাদের ভালোবাসা বাঁচানোর জন্য করেছি। আপনার বাবার ষড়যন্ত্রের শিকার যেন আপনারা দুজন না হন তাই আমি সকল অপমান অপবাদ ঘাড়ে তুলে নিয়েছি। আর কয়টা দিন বাকি। আপনার বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত এখানে আসবেন।”
লিয়ানা আর কথা বাড়ালো না চুপ করে চোখ বুজলো।

হোটেলে ফিরে নিজের সব গুছিয়ে নিলো হুরায়রা।
সব কিছু গুছিয়ে রুম থেকে বের হতেই তার নামে একটা চিঠি এলো। চিঠি হাতে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো সে। খামে ইয়াদের নাম লেখা। একটুকরো আশার আলো পুনরায় দেখা দিলো মনে। দ্রুত খাম ছিঁড়ে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো,

“প্রিয় কিংবা অপ্রিয়,
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। আমার জন্যও তোর জীবন থেমে থাকবে না, এই অধ্যায়ে আমাদের বিচ্ছেদই শ্রেয়। বিচ্ছেদে পূর্ণতা পাক আমাদের এই প্রণয়। তুই আমার সেই ফুল যার মধু আস্বাদন করার উপায় আমার নেই। তোকে কল্পনায় হাজার বার ছোঁয়া যায় কিন্তু বাস্তবতা বড্ড করুণ। তোর নামেই এই শহর লিখে রেখেছি বহুকাল আগে যখন প্রথম যৌবনে দেখেছিলাম ফাগুনের কোকিল ডাকা ভোরে।
আমি লন্ডন ছেড়ে যাচ্ছি। এবার আর পবাদ কিংবা লিয়ানাকে বলে নয়, এইবার সমগ্র পৃথিবীকে না জানিয়ে আত্ন গোপন করছি আমায় খুঁজিস না।
সময় যদি হয় কখনো তবে আমি নিজে এসে ধরা দেবো।
জানালার কাছে এসে একটিবার দাঁড়া তোর রাগ করে গাল ফুলানো মুখটা একটিবার দেখে যেতে চাই। আর এটাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র খোরাক যোগাবে।
ইতি
তোর,,,,,।

হুরায়রা জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখলো চেরি গাছের নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ইয়াদ। তার মুখটা বুঝা যাচ্ছে না। হুরায়রার পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইয়াদ ক্ষানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা ধরলো। হুরায়রা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বিচ্ছেদে সাক্ষী হয়ে রইলো। অঘোষিত প্রেমের অঘোষিত বিচ্ছেদ কি নিদারুণ যন্ত্রণা।

হোটেল থেকে বেরিয়ে টেমস নদীর তীরে এসে দাঁড়াল হুরায়রা। সামির নিশ্চুপে বসে আছে একটা টুলের উপর। হুরায়রার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বলল,
“কিছু কিছু গল্প বিচ্ছেদেই সুন্দর আর কিছু প্রেম মিলনেও অমলিন।”

“কাউকে জোর করে ধরে রাখা যায় না, তাই আমিও চাই না। অপেক্ষা যতই কষ্টদায়ক হোক না কেন আমি নিজেকে এই নামহীন সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়েছি আজ। অন্তত এতটুকু তো জেনেছি আমার ভালোবাসা বিফলে যায় নি, তিনিও তো ভালোবেসেছেন আমায়। হোক না বিচ্ছেদ তাবুও আমি তার অতন্দ্রিতা।”

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here