তোর নামেই এই শহর পর্ব -০২

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০২

(৪)
ইয়াদ খুব যত্ন করে হুরায়রার পায়ে ফাস্টএইড করে দিচ্ছে। ফাস্টএইড করার পুরোটা সময় হুরায়রা শুধু তাকেই দেখছিলো। পৃথিবিতে এই একটি মানুষের প্রতিই তার সব আসক্তি। অথচ কি দুর্ভাগ্য ইয়াদ তার অনুভূতির কোনো মুল্য দেয় না বরং ঠাট্টায় উড়িয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে তার ইয়াদকে একটা পাথর খণ্ড ব্যাতিত আর কিছু মনে হয় না। পাথরের গায়ে যেমন হাজারটা আছড় কাঁটলেও তাতে দাগ পড়ে না ইয়াদও ঠিক তেমন। আচ্ছা একটা মানুষ কি করে এতটা কঠিন হতে পারে? ভাবতে ভাবতে ইয়াদের কথা কর্ণকুহর হতেই ধ্যান ভঙ্গ হয় তার। ইয়াদ পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বলল,
“পা কাঁটলো কি করে?” তখন তো দেখেছি বাড়ির দিকে আসছিস। বাড়িতে না এসে কোথায় গিয়েছিলি? ”
“আম বাগানে। ”

হুরায়রা কথা শেষ হতেই ইয়াদ তার ভ্রু যুগল কুচকে নিলো। এত অকপটে জবাব সে হুরায়রার কাছ থেকে আশা করে নি। মেয়েটা বড্ড বেশি অবাধ্য হয়ে উঠছে আজকাল। হুরায়রা চুপচাপ তার হাতের দিকে দৃষ্টি নত করে বসে আছে। ইয়াদ তাকে ক্ষণকাল পর্যবেক্ষণ করে বলল,

“তোকে না বলেছি আম বাগানের দিকে গেলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দিবো? তাহলে গেলি কেনো সেখানে?”

হুরায়রা একবার মুখ তুলে তার দিকে দেখে আবার দৃষ্টি নত করলো। ইয়াদ স্পষ্ট দেখতে পেলো হুরায়রার চোখ ছলছল করছে কিন্তু তা বলে তো আর তাকে ছেড়ে দেয়া চলবে না। কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি তো পেতে হবেই।

ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ইয়াদ। নিজের মধ্যে কিছুটা রূঢ়তা ভাব ফুটিয়ে কোন ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আজ কাল তুই খুব বেশি পাঁকা হয়েছিস যখন যা খুশী তাই করে বেরাচ্ছিস তাই না হুর?”

হুরায়রা তখনো দৃষ্টি নত করেছিল। ইয়াদের কথা কানে যেতেই সে চোখ তুলে তাকায়।
এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন, চল উঠ।”
“মানে?”
“এত মানে বুঝার অবশ্যকতা তোর নেই। আর আমি কি বলতে চেয়েছি সেটা হয় তো তোর অজানা নয়।”
ইয়াদের দিকে ভীতু চাহনিতে তাঁকালো হুরায়রা। ইয়াদের মুখে কঠিনতার ছাপ ফুটে উঠেছে। হুরায়রার বুঝতে বাকি রইলো না ঠিক কি হতে চলেছে তার সাথে। কথার অবাধ্য হয়ে সে কখনো ইয়াদের শা/স্তির হাত থেকে রুক্ষা পায় নি তবে আজ যা হয়েছে তার জন্য যে তাকে সে ছেড়ে কথা বলবে না এই নিয়ে তার বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। তবুও সে কিছুটা ইতস্ততভাবে বলল,
“কোথায় উঠবো?”
“আমার কোলে।”
“মানে?”

ইয়াদ আর তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না সোজা কোলে তুলে ছাদের সিঁড়ি দিকে চলতে শুরু করলো। হুরায়রা কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। মনে মনে কয়েকবার আল্লাহকে ডেকে বুকে ফুঁক দিলো। ইয়াদ সেটা লক্ষ্য করে কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করলো তবে সেটা একেবারেই হুরায়রার অগোচরে।

(৪)
বাসায় ফিরে নাবাদ দেখলো তার বাবা মায়ের মধ্যে সেই কি তুমুল ঝগড়া চলছে।
মেহেরিমা মেহের রান্না ঘরের দরজার বাহিরে খুন্তি হাতে দাঁড়িয়ে ইশরাক ইহতেসামকে শাসিয়ে যাচ্ছেন।

“এই শুনো একদম ফালতু কথা বলবে না বুঝেছো সব দোষ তোমার আর তোমার দুই ছেলেও ঠিক তোমার মতো ই হয়েছে। ছেঁচড়া বুড়ো কোথাকার। ”

“এই আমাকে একদম ছেঁচড়া বলবে না বলে দিলাম। আর আমাকে বুড়ো বলছো তাই না নিজে যে বুড়িয়ে গেছো সে দিকে কি নজর পড়ে না?”

“এই খবরদার আমাকে একদম বুড়ি বলবে না।”

“এহহহ বুড়ি বলবে না। বুড়ি বলবে না তো কি যুবতী বলবে নাকি।”

“বাপ ছেলে সব একরকম হয়েছে কেউ আমাকে সম্মান করে কথা বলে না।”

“এই বাপ ছেলে বলে খোঁচা দিবে না বলে রাখলাম।আমার ছেলেরা আমার মতোই হয়েছে তোমার মত কুচুটে হয়নি।”
বলেই ইশরাক ইহতেসাম জিভে কামড় দিলেন ।ভুল করে তার মুখ থেকে কুচুটে শব্দটা স্লিপ করে বেড়িয়ে গেছে।

“কি বললে তুমি?”
গর্জন করে বললেন মেহেরিমা মেহের।

“এই না না আমি কিছু বলি নি।”

“তুমি কিছু বলো নি তাই? তবে এক্ষুনি আমায় কুচুটে বলল কে?”

“এই আমি কিছু বলি নি বিশ্বাস করো।”

“তুমি কিছু বলো নি তাই না? কিচ্ছু বলো নি।”
দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বললেন মেহেরিমা মেহের।

মেহেরিমা মেহেরকে এইভাবে গর্জে অগ্নি মূর্তি ধারণ করতে দেখে মনে মনে ভয়ে চুপসে যেতে লাগলেন ইশরাক ইহতেসাম। তিনি বাহিরে যতোই রাগী আর অকপটে হোন না কেনো নিজগৃহে স্ত্রীর কাছে তিনি নিরীহ প্রানীর ন্যায়।
কথায় আছে, “রাজা পুরো রাজ্য শাসন করেন আর সেই রাজাকে শাসন করেন তার রানী”কথাটা যে নেহাত ভুল কিছু নয় সেটা প্রতিনিয়ত হারে হারে বুঝতে পারেন তিনি। প্রত্যেক পুরুষ বহির্বিশ্বের কাছে যতই তেজি আর ক্ষমতাধর হোন না কেনো নিজস্ত্রীর কাছে প্রত্যেকেই তারা পরাজিত সৈনিক। তাদের সকল ক্ষমতা আর গাম্ভীর্য ওই একটি নারীর অগ্নিদৃষ্টি আর ভালোবাসার কাছে নুইয়ে পড়ে। তবে সকল পুরুষের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয়, যার অন্তরের অন্তস্থঃতলে সস্ত্রীক প্রতি প্রেম আর অশীম ভালোবাসা রয়েছে কেবল সেই তার সকল মাহাত্ম্য প্রেয়সীর চরনে নিবেদন করেন।

নাবাদ এতোক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মার ঝগড়া উপভোগ করছিলো। দেখছিলো ঝগড়ার শেষ মুহুর্তে কে জিতে। কিন্তু না আজও বিজয়ী তার মা জননীই হয়েছেন। জগতের কি অদ্ভুত নিয়ম সাংসারিক সকল রসমিশ্রিত ঝগড়ায় সব সময় নারীই বিজয়ী হয়, পুরুষ সেখানে কেবল পরাজয়ী। তারা যেনো পরাজয়স্বীকারেই বিজয়ের সুখ আস্বাদন করেন।
“উফ মামু তুমি ও না? কেনো যে লাগতে যাও মামি মার সাথে।”
তিয়াশার কথায় অশহায় দৃষ্টিতে তাঁকালেন ইশরাক ইহতেসাম। মেহেরিমা মেহের কেঁদে কেঁটে একাকার করে দিচ্ছেন তাকে কেনো তার স্বামী কুচুটে বলেছেন সে জন্য।
“নাবাদ তোর মাকে বুঝা না আমি তাকে ইচ্ছে করে কিছু বলি নি মুখ দিয়ে ভুলবশত বেড়িয়ে গেছে।এই তিয়াশা বুঝা না।”
“বাবা তুমি যে গত ৩৫ বছর ধরে মায়ের কাছে এইভাবে হেরে আসছো তোমার মান সম্মানে আঘাত লাগে না? কবে যে তুমি জিতবে আল্লাহ ই জানেন।”
নাবাদের কথা শুনে মেহেরিমা মেহের ফোঁস করে উঠলেন। বললেন
“দেখ তিয়াশা কিভাবে বাপের দল টানছে?”
” মামিমা তুমি চুপ করো তো চলো উঠো এখান থেকে। এই বয়সে এসেও তোমরা যা করো না?”
“তিয়াশা তুই ও? ”
বলে আবার কেঁদে উঠলেন মেহেরিমা মেহের।মামিকে এইভাবে আবার কেঁদে উঠতে দেখে তিয়াশা ধমকের সুরে বলল,
“মামি মা আবার শুরু করেছো?”
নাবাদ আর কিছু বলল না। সবে অফিস থেকে ফিরেছে। রোজ রোজ বাবা মায়ের এমন তুমুল ঝগড়ার দেখতে দেখতে বড় হয়েছে তারা। তাই এখন আর এই নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না সে। বাবা মায়ের এমন মিষ্টি ঝগড়া মাঝে মাঝে বেশ উপভোগ করে। কে বলবে তারা পঁয়ত্রিশ বছর এক সাথে কাটিয়ে দিয়েছে, এখনো সেই সদ্য নব যোবনা প্রেমিক প্রেমিকার মতো মান অভিমানেই ব্যাস্ত দুজন। বেশ খানিকট সময় পর নাবাদ তিয়াশাকে বলল,
“চলো তিয়াশা। ওদের একটু পর এমনিই ভাব হয়ে যাবে।”

তিয়াশা কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে চলে গেলো।তিয়াশা নাবাদ চলে গেলে মেহেরিমা মেহের ফোঁস করে উঠে আবার রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ইশরাক ইহতেসাম উপরের দিকে তাঁকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন,

“কলেজ জীবনেও এই নারী যেমন ছিলো আজও সে একি আছে। সবই কপাল আমার, চল্লিশ বছরেও এই নারীকে আমি নিজের বশে আনতে পাড়লাম না।”

(৫)
দুহাতে কান ধরে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে হুরায়রা। ত্রিশ মিনিট যাবত ছাদের এক কোণে এইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ইয়াদ বলে গেছে একবার যদি পা নিচে পড়ে তবে এই শীতে কাঁটা পা নিয়ে সারা রাত্রি পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখবে। হুরায়রা এই নিয়ে আর দুকথা বলতে পারে নি। তাকে এখানেই দাঁড়া করিয়ে রেখে ইয়াদ কোথাও একটা গেছে।

প্রায় আধঘণ্টা পর ইয়াদ ফিরে এলো। হুরায়রা তখনো একিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদকে দেখে তার মনে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা দিলো। ভাবলো হয় তো পা কেঁ/টেছে বলে দয়া করে শা/স্তিটা কিছুটা কমিয়ে দিবে।
“কিরে হুরমতি এখনো দাঁড়িয়ে আছিস দেখছি।”
“আপনি তো বললেন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।”

ইয়াদ ছাদের কার্ণিশে এ ভর দিয়ে পায়ের মাঝে পা পেছিয়ে বাহুতে হাত গুজে আরাম করে দাঁড়ায়। হুরায়রার ছলছল চোখে ইয়াদকে একবার দেখলো। বলল,
“আচ্ছা আপনার কি আমার জন্য একটুও মায়া হচ্ছে না?”
“তুই কি মায়া হওয়ার মতো কোনো কাজ করেছিস?”
“আপনি এমন কেন? আমার পা কেঁ/টেছে দেখেও এইভাবে শা/স্তি দিচ্ছেন?”
“বড্ড কথা শিখেছিস তুই। আর শুন এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাক আমি আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত।”

ইয়াদের শেষের কথাটা শুনে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো হুরায়রা । রাগে অভিমানে তার দু কান গরম হয়ে উঠেছে। কারণে অকারণে ইয়াদের দেয়া শা/স্তি গুলো সব সময় মেনে নিলেও আজ সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না হুরায়রা। পায়ে বিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আর এই শীতে খালি পায়ে কান ধরে এক পায়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তাছাড়া ইয়াদ একবার চলে গেলে আর কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। হয়ত সে ভুলেই যাবে তাকে শা/স্তি দিয়ে এইভাবে দাঁড়া করিয়ে রেখে গেছে।

ইয়াদের দেয়া সকল শা/স্তি বিনাবাক্যে মাথায় তুলে নেয় সে। কারন এই মানুষটার মুখে উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যই তার জন্য অমৃত বানী। পৃথিবীর সব মানুষকে সে উপেক্ষা করতে পারলেও এই একটি মানুষকে উপেক্ষা করা তার সাধ্যের বাইরে। যার ফলশ্রুতিতে ইয়াদের বলা সকল কথা এবং শাস্তি উভয় সে বিনাবাক্যে সহ্য করে। শত যন্ত্রনা নিয়েও সে একফোঁটা সুখ হাতরে বেড়ায় যদি কোনভাবে সেই অমুল্য সুখের দেখা মিলে যায়।

একপায়ে উপর ভর দিয়ে বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। কাঁ/টা পা টনটন করে ব্যাথা করছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে হুরায়রার। মনে মনে বারংবার আল্লাহকে ডাকছে সে। যদি জীবন থাকে তো আর কোনো দিন আম বাগানের মুখো হবে না বলে শত দিব্যি কাঁটতে থাকে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর ফিরে এলো ইয়াদ। ততক্ষণে হুরায়রা কান থেকে হাত ছেড়ে নিচে বসে পড়েছে। চার দিকে উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে। ঠান্ডাও পড়ছে খুব। প্রচণ্ড শীতে হুরায়রার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে। মুখচোখ ফুলে লাল হয়ে উঠেছে, নিশ্চই কেঁদেছে বুঝতে পেরে ইয়াদ কোন বাক্য ব্যয় না করে তাকে একটানে কোলে তুলে নেয়। আকস্মিক এমন কিছু ঘটায় হকচকিয়ে উঠে হুরায়রা। কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্রুত পা চালিয়ে ছাদ থেকে বেড়িয়ে আসে ইয়াদ। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সে হুরায়রা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত শ্বাস ছাড়ে। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে,

“কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ দেখছি ফুলিয়ে লাল করে ফেলেছিস। কি বিচ্ছিরী দেখতে লাগছে তোকে।”
হুরায়রা কোন জবাব করলো না। শুধু শক্ত করে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরলো।
“শুন আর কখনো এইভাবে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চোখ মুখ ফোলাবি না টমেটোর মতো দেখতে লাগে।”
হুরায়রা এবারো কিছু বলল না শুধু মাথা দোলাল।
ইয়াদ আরেকবার আড়চোখে দেখলো তাকে। মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে নিচে নেমে এলো।

রাহেলা বেগম সিঁড়ির নিচটাতে বসে পান সাজাচ্ছিলেন। হুরায়রাকে কোলে নিয়ে ইয়াদকে ছাদ থেকে নেমে আসতে দেখে বৃদ্ধা খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
“তোর কি আক্কেল জ্ঞান সব গেছে রে ইয়াদ?কাঁ/টা পা লইয়া মেয়েটারে শা/স্তি না দিলে হইতাছিলো না তোর?”
“ওসব তুমি বুঝবে না নানী তুমি পান খাচ্ছো খাও। আর শুনো আমার জন্য এক খীল পান সাজাও মিষ্টি জর্দা থাকে যেনো।”

“তোমাগো ব্যাপার সেপার কিছু বুঝিনা বাপু। যাও মেয়েডারে ঘরে রাইখা আসো আমি পান সাজায় দিতাছি।”

হুরায়রার সামনে বসে আয়েশ করে পান চিবাচ্ছে ইয়াদ। কিছুক্ষণ পর তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে পিছ করে পানের পিক ছুড়ে ফেলছে।
তার এহেন কাণ্ডে বেশ বিরক্ত হলো হুরায়রা। মাঝে মাঝে তার পান খাওয়ার শখ টা একেবারেই পছন্দ না হুরায়রার। পান চিবাতে চিবাতে তার ঠোঁট দুটো যখন টকটকে রঙ ধারন করে তখন হুরায়রা বেশ রেগে যায়। রাগলে হুরায়রাকে বেশ দেখায় তাই সে মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করে নানীর কাছ থেকে পান চেয়ে খায়।

উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে দাদীর সাথে কি যেনো করছিলো হুমাশা। ইয়াদ তাকে দেখতে পেয়ে হাঁক ছেড়ে ডাকে বলল,
“হ্যাঁ রে হুমাশা আজ নাকি তুই কার গাছের তেতুল চুরি করেছিস? কই আমাকে তো তার ভাগ দিস নি”
ইয়াদের কথায় খুশী হয়ে হুমাশা এইদিকে ছুটে এলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ওমা তুমি কি করে জানলে সেটা?”
“জেনেছি এক ভাবে। তা আমার ভাগটা কোথায়?”
“আমার কাছে তো আর বেশি নেই মেজদির কাছে আছে। তুমি বরং মেজদি থেকে নিয়ে নাও।”

হুরায়রা মনে মনে বেশ চটে গেলো ইয়াদের উপর।সে শুধু আম বাগানে গিয়েছিলো বলে সেবার তাকে দুই ঘন্টা ঠান্ডা পুকুরে চুবিয়ে রেখেছিলো, দুই ঘন্টার আগে উঠতে দেয় নি। আজও তাকে সেখানে যাওয়ায় কাঁটা পা নিয়ে দুই ঘন্টা এক পায়ের উপর দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। অথচ হুমাশা যখন কার গাছের তেতুল চুরি করে এনেছে তার বেলায় কিছু তো বলছেই না বরং সেটার ভাগ চাইছে।
“বাহ আমাকে আগে ভাগ না দিয়ে সব মেজদি কে দিয়ে দিলি?”
“মেজদি তো বলেছিলো তেতুল চুরি করলে যাতে আগে ওকেই ভাগ দেই।”
ইয়াদ চোখ পিট পিট করে হুরায়রার দিকে তাঁকাতেই হুরায়রা বলে উঠলো,
“আমি আপনাকে ভাগ দিবো না, চেয়েও লাভ হবে না। আর এই যে তুই সব কথা সব জায়গায় না বললে চলে না তাই না?”
“এমা আমার কি দোষ ভাইয়া ই তো চাইলো।”
“ভাইয়াই তো চাইলো,ভাইয়া বললেই তোকে সব পট পট করে বলে দিতে হবে?”
“তুই যে এত হিংসুটে সেটা তো জানতাম না?”
“আপনাকে জানতে বলেছে টা কে?”
“হ্যারে হুমাশা এই বাড়িতে যে দিন দিন পেটুকের সংখ্যা বাড়ছে এটা কি নানী জানে?”
ইয়াদের কথায় ফিক করে হেসে ফেললো হুমাশা।
তাকে এভাবে হাসতে দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো হুরায়রার। এই মেয়েটাও হয়েছে ইয়াদের মতো।দুটো যেনো এক ঢালের দুই পাখি। একজন কিছু বললে অন্যজন সায় দেয়। দেখলেই গা জ্বলে যায় তার।

হুমাশা ইয়াদ দুজনই যেনো হাসির প্রতিযোগীতায় নেমেছে। হুরায়রা তা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে চোখ রাঙিয়ে হুমাশার দিকে তাঁকালো। মুহূর্তেই হুমাশার হাসি থেমে গেলো।
“হ্যাঁ আরো দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাস আমি দেখি? শয়তান মেয়ে কোথাকার।”
“আমি কি করেছি ভাইয়াই তো,,,।”
হুরায়রা আর কথা বাড়ালো না পায়ে বিষণ ব্যাথা, শরীরটাও ভালো লাগছে না দেখে ধীরেধীরে উঠে ঘরে চলে গেলো। ইয়াদ খানিকটা সময় হুরায়রার যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে দেখলো। পা খুইয়ে হাঁটছে হুরায়রা। হাঁটতে যে তার কষ্ট হচ্ছে তা দেখেই বুঝতে পারলো সে। ভেবেছে একবার উঠে যাবে পরোক্ষণেই কি ভেবে আর গেলো না।

(৬)
সেরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো হুরায়রার। টানা তিন দিনের জ্বরে অবস্থা আধমরা প্রায়। শরীরে একফোঁটা জোর নেই যে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের ক্ষ/তটা শুকিয়ে উঠেছে। তবে ব্যাথা এখনো পুরোপুরি সারে নি। রাহেলা বেগম নাতনীর শিয়রের কাছে পানদানি নিয়ে বসে আছেন। রাত্রি প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। ঘাম দিয়ে সবে জ্বর ছেড়েছে হুরায়রার। আধোআধো চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকাতেই সে দাদীর তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখটা দেখতে পেল। বৃদ্ধা মাথায় হাত ঠেকিয়ে ঝিমোচ্ছেন। হুরায়রা বালিশে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। সারাঘরে হারিকেনের মৃদু লালছে আলো নিভু নিভু জ্বলছে। হাড় কাঁপানো পৌষের শীত। জানালার দুই কবাটের মাঝামাঝি চুল সমান ফাঁকা দিয়ে উত্তরের হিম হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে। মৃদু হাওয়ায় জানালার পর্দা গুলো মাঝে মাঝে দোল খেয়ে উঠছে। হুরায়রা বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা রাখা মাত্রই কেঁপে উঠে। শীতল মেঝেতে খালি পা ফেলা মুশকিল। শরীরে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় সেটা আরো দ্বিগুণ ভাবে অনুভব হচ্ছে তার। মাথাটাও কেমন ঘুরছে, হঠাৎ হঠাৎ ঝিমঝিম করছে। সামনে যে দু পা আগাবে তার উপায় নেই। উপায় না পেয়ে পুনরায় সে বিছানায় উঠে বসে। ইতিমধ্যে তার হাত পা জোড়া হিম হয়ে এসেছে। শরীরটাও বেশ দূর্বল লাগছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে একবার নিজের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করে দেখল সে। জ্বর খানিকটা বেড়েছে বোধহয়। কিন্তু এই মুহূর্তে একবার ঘর ছেড়ে বাহিরে বের না হলে আর চলবে না। উপায়ন্তর না পেয়ে রাহেলা বেগমকে জাগাবে বলে ঠিক করে কিন্তু পাশ ফিরতেই দেখল তিনি বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। দাদীর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বড্ড মায়া হল হুরায়রার। সারারাত হয় তো নিজে না ঘুমিয়ে তাকেই পাহারা দিয়েছিলেন।

টলতে টলতে ঘর ছেড়ে বাহিরে পা রাখে হুরায়রা। সামনে দুটো ঘর পেরুলেই সদরদরজা। হারিকেন ধরে একটি ঘর পার হতেই পেছনে কারো গলার স্বর শুনতে পেল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চারদিকের আঁধার কাটিয়ে পুরো এলাকায় আলো জ্বলে উঠল।
“ঘরে এত এত লাইট থাকতে তোকে হারিকেন নিয়ে বের হতে হলো কেন? হারিকেন ছাড়া কি এখনো চলতে শিখিস নি, নাকি দাদীর দেখায় দেখায় নিজেই হারিকেন নিয়ে চলাটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিস।”
হুরায়রা তৎক্ষণাৎ ইয়াদের কথার জবাব দিতে পারল না। শুধু গভীর দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ইয়াদ নিজের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল এক্ষুনি বেড়িয়ে হুরায়রা মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
“কি হল কথা বলছি না যে? এই ইলেক্ট্রিসিটির যুগে কেউ হারিকেন হাতে করে ঘুরে? আর জ্বর তো মনে হয় না খুব বেশি কমেছে। এইতো টলছিস ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিস না, তবে একা একা ঘর থেকে বের হওয়া হয়েছে কেন শুনি?
“দাদী ঘুমাচ্ছেন কি করে জাগাবো তাই নিজেই,,।”
ইয়াদ খানিকটা সময় ব্যয় করে হুরায়রাকে দেখল। অতি জ্বরে হুরায়রার মুখটা কেমন হলদেটে হয়ে গেছে। সেদিন এতটা নির্দয় সে না হলেও পারতো। মেয়েটাকে কাঁ/টা পা নিয়ে দু ঘন্টা কানে ধরিয়ে না রাখলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? মনে মনে ভাবলো ইয়াদ। হুরায়রার চোখ ফুলে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। শরীরটা বেশ দূর্বল তা দেখেই গেলো। দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পাচ্ছে না এমন অবস্থায় ঘর থেকে একা একা বেরোনোটা একেবারেই উচিৎ হয় নি দেখে ইয়াদ আবার বলল,
“নানী না হয় ঘুমোচ্ছে আমার ঘরটা তো পাশেই ছিল ডাকলেই পারতিস। চল আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
ইয়াদের কথায় হুরায়রা তৎক্ষণাৎ বেঁকে বসল। নতমস্তকে গলা নিচু করে বলল,
“আমি একাই যেতে পারবো আপনাকে যেতে হবে না।”
ইয়াদ কিছু সময় স্থির চাহনিতে হুরায়রাকে দেখল। মেয়েটা আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে উঠছে। সব কথাতে তার নিজের মতামত দেয়া চাই।
“চল আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
“আমি একাই যেতে পারবো।”
“কথা বাড়াস না হুর, এতরাতে এই অবস্থায় একা বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি চল।”
হুরায়রার আর কিছু বলতে পারলো না। অগত্যা ইয়াদের সাথেই তাকে যেতে হলো।

নিশুতি রাত। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। ইয়াদ ওয়াশ্রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে হুরায়রা জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পর হুরায়রা বেড়িয়ে এলে তাকে আলতো হাতে নিজের কাছে টেনে নেয়। শীতের রাত হুরায়রার শরীরের উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে। ইয়াদ হুরায়রার গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিলো। আকস্মিক এমন কিছু ঘটায় হুরায়রা চমকে গেলো। শক্ত করে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপনি এত নিষ্ঠুর কেনো?”
“তুই হতে বাধ্য করিস তাই।”
“আমি মোটেই এমন কিছু করি নি। আমাকে নামিয়ে দিন নিজেই যেতে পারবো।”
“সেটা তো তোর চলার গতি দেখেই বুঝতে পেরেছি কতটা যেতে পারবি।”
“আপনি এমন কেনো?”
“এই এক কথা আর কতদিন চলবে?”
“যতদিন না আপনি উত্তর দিবেন।”
“আমি কি তোর সমবয়সী যে সব সময় তোর কথার উত্তর আমাকে দিতে হবে। খুব পেকেছিস দেখিছি জ্বরের জন্য হাটতে পারছিস না অথচ মুখ দিয়ে যেন খই ফুটছে।”
বলেই আর দাঁড়াল না দ্রুত ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

হুরায়রার ঘরে এসে তাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো ইয়াদ। সে যতক্ষণ কাছাকাছি থাকবে হুরায়রা ততোক্ষণ বকবক করে যাবে। জ্বর কিছুটা কমেছে ঘুমিয়ে পড়লে আরেকবার এসে দেখে যাবে বলে ঠিক করলো সে। তাছাড়া পায়ের ক্ষ/তটা কতটুকু সেরেছে একবার দেখতে হবে। মেয়েটা যতক্ষণ সুস্থ না হচ্ছে তার শান্তি নেই।

চলবে,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here