#বেলা_শেষে [০৬]
দাঁত দিয়ে হাতের নোখ কামড়াচ্ছে আর আকাশ পাতাল ভেবে যাচ্ছে ভূমিকা। দিগন্ত যখন ড্রয়িংরুমে আসবে তখন কি করবে, প্রথমে বোরখাটা ওর মুখের উপর ছুঁড়ে দিবে। না, এটা করা ঠিক হবে না। যতই হোক দিগন্ত সম্পর্কে ভূমিকার স্বামি হয়। তাহলে কি করবে ভূমিকা। রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে তার। শপিং ব্যাগ থেকে বোরখা বের করে সেটা আবার পরখকরে নিলো। তারপর মনে মনে ভাবলো, ওই খবিশটার গার্লফ্রেন্ড মনে হয় খাটো। তার মাপেই হয়তো কিনেছে এই বোরখাটা। কুমির কোথাকার। সারাক্ষণ মিমি বিবির সাথে থেকে থেকে চোখে পর্দা পরে গেছে। তাই যার জন্যে জিনিস কিনতে যায়না কেন, সব মিমির সাইজেই কিনবে। হাতের বোরখাট দলা পাকিয়ে নিচে ফেলে দিতে চেয়েও দিলো না। সুফার এক কোনে রেখে দিলো আর বিরবির করে বলল,
-এটা আপনার মিমিকেই দিয়েন। জলহস্তী কোথাকার। সামনে তাকাতেই ভূমিকার মুখ হা হয়ে গেলো। দিগন্ত আসছে। এ্যশ কালারের প্যান্টের উপর শুভ্র রাঙা শার্ট। মনে হচ্ছে এখনি শাওয়ার নিয়েছে। চোখমুখ স্নিগ্ধ লাগছে দিগন্তের । তার উপর ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি।ভূমিকার বুকের ভেতরে ধুকবুক করছে। মুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ভূমিকা। ভূমিকার এমন ধারা চাহনি দেখে দিগন্তের ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলল,
-এভাবে হা করে কি দেখছেন।
ভূমিকা যতটা সম্ভব নিজের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রনেয় রাখারা চেষ্টা করছে। কিন্তুু ওর অবাধ্য চোখ যেন বারবার বলছে, আর একটু দেখি। ভুল কি তাতে। ভূমিকা ওর দৃষ্টিকে বুঝাতে গিয়েও ব্যার্থ হয়। সেই অবাধ্য দৃষ্টি দিগন্তের চুলের দিকে। ভূমিকা পড়লো মহা ফাসাদে, এবার যেন তার হাতটাও অবাধ্য হতে চাইছে। সে বারবার করে চাইছে দিগন্তের মাথার চুল ছুইয়ে দিতে।
-ও হ্যালো, কোথায় হারালেন। ভূমিকার সামনে তুরি বাজিয়ে বলল দিগন্ত।
-হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
-এত কি ভাবছো হ্যাঁ। তারপর ভূমিকাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
-তোমার বোরখা কোথায়?? এভাবে যাবে নাকি কলেজে?
-হ্যাঁ। মানে ওই বোরখা। না মানে আসলে, বোরখা।
-কি মানে মানে করছো বলোতো। বলেই পাশে তাকায় দিগন্ত। আর সুফার উপর দলা পাকানো বোরখা দেখতে পায়। দিগন্ত ভুমিকার দিকে ভ্রু কুচকিয়ে বিরবির করে বলে, বোরখা পছন্দ হয়নি ম্যাডামের। তারপর বোরখা হাতে নিয়ে সেটা মেলে দেখে। এদিকে ভূমিকা কিছু বলতে পারছেনা। কিছুক্ষণ আগেই মনেমনে দিগন্তের দফা রফা করছিলো আর এখন ভেজা বেড়ালের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। কিছু যে বলবে সেটাও পারছে না। সব কথা গলার মাঝে কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দিগন্তকে দেখে যাচ্ছে।
দিগন্ত মুখটা বাকা করে বোরকাটা আগের জায়গায় রেখে দিলো। তারপর ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি কিছু খেতে দিবে।
-হ্যাঁ দিচ্ছি। তারপর বড়বড় পা ফেলে রান্নাঘরে চলে যায়। দিগন্তর গিয়ে ড্রাইনিং এ বসে। একএক করে দিগন্তের সামনে সব খাবার সাজিয়ে দেয় ভূমিকা। দিগন্ত খাওয়া শুরু করে। আর ভূমিকা সেখানে বসে বসে তাকিয়ে থাকল দিগন্তের দিকে। খাওয়ার এক পর্যায়ে দিগন্ত বলে,
-একটু লবন দাও। ভূমিকা পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলে, লবন। দিগন্ত অবাক চোখে তাকায় ভূমিকার দিকে। কারনটা হলো এত বড় ভুল তাও আবার ভুমিকা। অসম্ভব। দিগন্ত ভাবলো হয়তো ভূমিকা ঠিকমতো শুনতে পায়নি।কিছুক্ষণ পরে আবারও বলল,
-ভাজির বাটিটা দাওতো। ভূমিকা একটা চামিচ এগিয়ে দিলো। দিগন্ত ভ্রু কুচকিয়ে ভূমিকার দিকে তাকালো। তখন খেয়াল করলো ভূমিকা কাঁপছে।
-আর ইউ ওকে ভূমি। দিগন্তের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে ভূমিকা শুধু মাথা নাড়ালো কোন কথা বলল না।
-ভূমি। তুমি এরকম উদ্ভট আচরন কেন করছো। তুমি ঠিক আছতো।
-আ- আমি আসছি। কথাটা কোন রকমে বলে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ভূমির এমন আচরনে একটু বেশীই অবাক হলো দিগন্ত। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভূমিকার চলে যাওয়ার দিকে।
ভূমিকা ওয়াশরুমে এসে মুখে পানির ছিটা নিলো। বুকের উপর হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নিলো কয়েকবার। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই নিজেকে গালি দিতে লাগলো সে। ছিহ্ ভূমি, এটা তোর থেকে আশা করিনি। আচ্ছা বলতো, একটু আগে কি হয়েছিল তোর। এখন ওই লোকটা কি ভাবছে তোর সম্বন্ধে। বড় করে শ্বাস ফেলে দু-চোখ বন্ধকরে নিলো ভূমিকা। আর তখনি দিগন্তের সেই হাসিমাখা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে ভূমিকার। চট করে চোখ খুলে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে শুকনো ডুক গিলে। বুকের ভেতর এখনো কেমন ধুকধুক শব্দ করছে।
এদিকে দিগন্তে খাওয়া শেষ করে বসে আছে। ভূমিকা আসলে ওকে নিয়ে একসাথে কলেজে যাবে। কিন্তুু ভূমিকার আসার কোন নামই নেই। হাতের ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে সে উঠে ভূমিকার রুমের দিকে রওনা দিলো। ভূমিকা তো রুমে নেই, তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা। আশ্চর্য। ওয়াশরুমে, কিন্তুু এত সময় ধরে ওয়াশরুমে কি করছে। দিগন্ত ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ওয়াশরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই সে পানি পড়ার শব্দ পায়। তার মানে ভূমিকা ভেতরেই আছে। দিগন্ত হাত দিয়ে দরজায় বারি দিলো। তারপর বলল,
-ভূমি, আর ইউ ওকে??
দিগন্তের কথা কানে আসতেই চমকে উঠলো ভূমিকা। আয়নার দিকে তিক্ষ্ম দৃষ্টি রাখলো সে। তারপর বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো। এদিকে ভূমিকার জবাব না পেয়ে বেশ চিন্তিত দিগন্ত। আচ্ছা সে কি ওয়াশরুমের ভেতরে যাবে। যদি ভূমিকার কোন বিপদ হয়। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সে ওয়াশরুমে ডুকে পরে। ওয়াশরুমে ডুকতেই দেখে ভূমিকা বড় বড় চোখ করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
-এই স্টুপিড মেয়ে, তোমার কি কোন কান্ডঞ্জান নেই নাকি।
পিছনের দিকে ঘুরে তাকালো ভূমিকা। কিন্তুু দিগন্তের দিকে তাকালো না সে।
-কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নেই??
-হুম চলুন। বলেই ভূমিকা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। আর দিগন্ত বিরবির করে বলল, স্টুপিড মেয়ে। তারপর সেও চলে আসলো সেখান থেকে।
রাস্তায় এসে দুজনে দুদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকা সে দিগন্তের সাথে কলেজে যাবে না। আর দিগন্ত সে ভূমিকাকে একা ছাড়বে না। কারন ভূমির কিছু হলে তার জবাবদিহি তো দিগন্তকেই করতে হবে। দিগন্ত কোন রকমের রিক্স নিতে চাচ্ছে না। এই কথাটা সে ভূমিকাকে বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ। ভূমিকার এক কথা সে নিজের প্রটেকশন নিজেই দিতে পারে। তার জন্যে কারো হেল্প তার প্রয়োজন নেই।কিছুক্ষণ পর একটা নিয়ে ভূমিকা ওর কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দিগন্ত সে বেচারা ভূমিকার দিকে কিছুক্ষণ ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে তার বাইক নিয়ে চলে যায়।
প্রথম দিন কলেজে এসেই দুজন বন্ধু পেয়েছে ভূৃমিকা।তাদের মধ্যে একজন ছেলে আর অপর জন মেয়ে। নিতু আর রাতুল। দুজনেই খুব মিশুক টাইপের। বন্ধুদের সাথে গল্পআড্ডায় বেশ জমে উঠেছে তার কলেজ। যেহেতু আজ তার প্রথম দিন কলেজের, তাই সে বেশী ক্লাস করতে ইচ্ছুক নয়। ভূমিকা চায় আজ পুরো কলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখবে সে। তার বন্ধুরাও তার কথা সমর্থন করে। তারপর তারা তিনজনে মিলে কলেজের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে। কিন্ত এত বড় কলেজের অর্ধেকটাও দেখা হয়না তাদের। এদিকে ভূমিকার পায়ে ব্যথা করছে। তাই ভূমিকা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আর নয়। পরে আরেকদিন দেখবে।
ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছে দিগন্ত। আজ ওদের সাথে মিমিও আছে। মিমি দিগন্ত পাশাপাশি ই বসে আছে। মাহিন আজ নেই। কোন কারনে আজ সে কলেজে আসে নি। কথা বলার এক পর্যায়ে দিগন্তের চোখ পরে ক্যান্টিনের সামনে। আকাশি কালারের থ্রি-পিছ পরিহিতা এক প্রানউচ্ছল মেয়ের দিকে। যে হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলে তাদের দিকেই আসছে। দিগন্ত সেই রমনীর হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আনমনে বলে ফেললো, খিটখিটে মেয়েদের হাসি বুঝি একটু বেশীই কিউট হয়।
-কোন খিটখিটে মেয়ে? কার কথা বলছিস তুই দিগন্ত। নওশাদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে ঘোর কাটে দিগন্তের। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– নাহ কেও না?? মিমি ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো দিগন্তের দিকে। দিগন্ত আড় চোখে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে দেখতো ওরা ক্যান্টিনেই একটা টেবিলে বসেছে।
হঠাৎই তপু খেয়াল করলো ভূৃমিকাকে। ওদের থেকে চার টেবিল পরে ভূমিকা তার বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তপু ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূৃমিকার দিকে। কাজের লোক হলেও ওকে ঠিক কাজের লোকের মতো লাগে না। তপুর কেন জানি মনে হয় দিগন্তের ওদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। একটু বাজিয়ে দেখা যাক। মেয়েটার কথা চালচলন খুব ইউনিক। আজকালের মেয়েদের মাঝে এটা খুব কমই লক্ষ করা যায়। তপু ভূমির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দিগন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-এটা ভূমিকা না, যে তোর বাসায় কাজ করে???
তপুর কথা শুনে দিগন্ত ভূমিকার দিকে তাকালো। সে এখনো বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কিন্ত দিগন্ত এখন কাজের লোক কথাটা হজম করতে পারলো। সেদিন ভেবেছিল ঘটনাটা সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। কলেজে এসেও ওকে কাজের লোক তকমাটা পেতে হবে এটা ভাবেনি দিগন্ত। তপু উঠে দাঁড়ায়। ওর সাথে সাথে দিগন্ত মিমি নওশাদ সবাই উঠে দাঁড়ায়। আর ভূমিকাদের টেবিলের সামনে যায়।
দিগন্তের বন্ধুদের টেবিলের চারিপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় ভূমিকা। তখনি তপু প্রশ্ম করে,
-কাজের লোক হয়ে এত বড় কলেজে পড়তে এসেছো।
-তাতে আপনার কোন সমস্যা আছে?? [ভূমিকা]
-তা নেই। তবে এত বড় একটা কলেজে কাজের মেয়ে পড়বে ব্যপারটা কেমন দেখায় না। [তপু]
-আচ্ছা। কলেজের কোথাও কি লেখা আছে এখানে কাজের লোক কিংবা তাদের ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করতে পারবে না। শুনুন, এটা কলেজ,এখানে পড়াশুনা করা হয়। তাই কেন বড়লোক আর কে গরীব সেটা দেখার কারো টাইম নাই। এখানে সবাই তাদের যোগ্যতায় আসে। আপনাদের মতো লোকেরা টাকার জোরে আসলেও আমরা আসছি মেধার জোরে। ভূমিকার কথা শুনে দিগন্তের অধরে হাসি ফুটে উঠলো। ওষ্ঠদ্বয় চেপে হাসলো সে।
চলবে,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা