বেসামাল প্রেম পর্ব -১+২

তিনদিন আগে ঠিক হওয়া বিয়েটা আজ ভেঙে গেল। পাত্রীর নাম সূচনা৷ বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ, সূচনার মা তার বড়ো চাচার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে আজ থেকে বিশ বছর আগে স্বামী, সন্তান এবং সংসার ত্যাগ করেছেন। ভেঙেছেন দু’টো স্বপ্নের সংসার। বাবা, মা হারা করেছেন চারটে শিশুকে। বড়ো চাচার বড়ো ছেলের বয়স তখন সাত, ছোটো ছেলের বয়স চার। আর সূচনার বয়স ছিল দুই, বড়ো ভাইয়ের বয়স পাঁচ বছর। এই চারটে শিশুর শৈশব’কে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল দু’জন বিকৃত রুচির মানব,মানবী। কে জানতো আজ এত বছর পরও সেই ঘন অন্ধকার দূর হবে না। অন্ধকার রুমে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে সূচনা। তার কর্ণে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাত্রের মা’য়ের বলা শেষ কথাগুলো,

-” দেখো মা লিমনের সঙ্গে তোমার চার বছরের সম্পর্ক আছে বলে চোখ বন্ধ করে তোমাকে পুত্রবধূ করে নেওয়ার মতো মানুষ আমি না। তোমার পারিবারিক বিষয়ে লিমন আমাকে কিচ্ছু জানায়নি। গতকাল পর্যন্তও আমি অন্ধকারে ছিলাম। বিয়ের মতো একটা বিষয়ে কোন কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না। এক্ষেত্রে তোমরা ভারী অন্যায় করেছ। জীবিত মানুষ’কে মৃত বানিয়েছ। কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। আমাদের কানে ঠিক এসেছে তোমার মা দিব্যি বেঁচে আছেন। তোমার চাচার সঙ্গে দিব্যি সুখে সংসার করছেন। এমন বেহায়াপনা যে নারী করতে পারে সেই নারীর গর্ভজাত সন্তান আমার বাড়ির বউ হবে! এটা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না৷”

-” আমিতো কোন দোষ করিনি আন্টি। তাহলে আমি কেন শাস্তি পাবো? ”

-” সার যত ভালোই হোক চাল কুমড়ার বীজে মিষ্টি কুমড়া ধরবে না মা। ”

দু’হাতে কর্ণদ্বয় চেপে ধরলো সূচনা। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে তার। দু-চোখ বেয়ে নোনাপানির স্রোত নামছে। চারদিক থেকে যেনো বিরতিহীন ভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,

-” সার যত ভালোই হোক চাল কুমড়ার বীজে মিষ্টি কুমড়া ধরবে না মা। ”

আকস্মিক চিৎকার করে ওঠল সূচনা,

-” আমি ঘেন্না করি, ঘেন্না করি ঐ মহিলা’কে। ভাইয়া, ভাইয়া তুমি কোথায়? ঐ মহিলার জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল ভাইয়া। তুমি কেন আমাকে সেই দু’বছরে গলা টিপে মেরে ফেললে না। আমি সহ্য করতে পারছি না, এই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছি না। ”

দরজায় কট করে শব্দ হলো। রুমে প্রবেশ করল, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী একজন পুরুষ। এলোমেলো পায়ে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সুইচ টিপ দিলো। ঝকঝকে আলো ফিরে এলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটায়। বড়ো ভাই রুদ্র’কে দেখে সূচনা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। অসহায় চোখে ক্ষণকাল ভাইকে দেখে হঠাৎ ডুকরে ওঠল। দু’হাতে মুখ চেপে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল পূর্বের ন্যায়। কালো রঙের কাবলিতে আচ্ছাদিত দেহখানা ধপাৎ করে মেঝেতে বসে পড়ল। বোনের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। ফলশ্রুতিতে তার এলোমেলো উষ্কখুষ্ক ঘাড় ছোঁয়া সব গুলো চুল সামনের দিকে নেমে দাঁড়ি, গোঁফ ভর্তি গুরুগম্ভীর মুখটা ঢেকে দিলো। বারকয়েক তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। সূচনার কান্না তখনো থামেনি। কোন প্রকার স্বান্তনার বাণী শোনালো না রুদ্র। আদুরে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনেও নিলো না বোনকে। মাথায় হাত রেখে ভরসাও দিলো না। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে শুধু একটি প্রশ্ন করল,

-” লিমনের মতামত কী? ”

সঙ্গে সঙ্গে ক্রন্দনরত কণ্ঠে জবাব দিলো,
-” ওর পরিবারে ওর মা’য়ের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। লিমনের হাত, পা বাঁধা। ”

রক্তিম চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” ঐ বাঁধন ছাড়িয়ে চামড়া তুলে মরিচ দিয়ে তোর সামনে আনব। এবার বল এরপর আর কাঁদবি? ”

কেঁপে ওঠল সূচনা। আতঙ্কিত হয়ে কান্না থেমে গেল তার। উষ্কখুষ্ক চুলের ফাঁকে ভাইয়ের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিজোড়া দেখে অন্তরাত্মা পুনরায় কেঁপে ওঠল। সে খুব ভালো করেই জানে তার ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। ভীষণ রগচটা, ভয়ানক জেদি, তীব্র খ্যাপাটে! এখন যদি সম্মত হয় তাহলে লিমন’কে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সে চায় না লিমন’কে। যে পরিবার তার করুণ সত্যিটা জেনে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই পরিবারে কোনমতেই সে যেতে চায় না। সবচেয়ে বড়ো কথা যাকে ভালোবেসে ঐ পরিবারে যেতে চেয়েছিল, সেই লিমনই এখন অন্য সুরে কথা বলছে। যে সুরে আর যাই থাকুক ভালোবাসা নেই। ভালোবেসে ভালোবাসাহীন সম্পর্কে জড়ানোর মতো ব্যর্থতা এ পৃথিবীর বুকে আর একটিও নেই। সারাজীবন সঙ্গীহীন কাটাবে, দরকার নেই তার ঘরবাঁধার। যে মেয়ের জন্মদাত্রী দুটো ঘর ভেঙেছে সেই মেয়ের সত্যি ঘরবাঁধার অধিকার নেই। সমাজের লোকেরা তো আঙুল দিয়ে তাই দেখিয়ে দিলো।
-” না ভাইয়া। যে ছেলে চার বছরের সম্পর্ক’কে গুরুত্ব না দিয়ে পরিবারের পরামর্শ’কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সে ছেলেকে জীবনসঙ্গী করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

রুদ্রর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠল। ঐ চোখের ভাষা পড়ে ফেলল সূচনা। মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” আমি তোমার বোন। আমার ভালোবাসা ঠুনকো বলে আমার আত্মসম্মান ঠুনকো নয়। ”

স্বস্তির শ্বাস ফেলে রুদ্র বলল,
-” কান্না থামবে কীভাবে? ”

-” আজ কাঁদতে দাও না ভাইয়া? যে মহিলা আমাদের বাবার ঘর ভেঙেছে, সে মহিলার জন্য আমার কোনদিন ঘর, সংসার হবে না। এতদিন লোকমুখে শুনেছি। আজ সচক্ষে দেখলাম, দু’কানে স্পষ্ট শুনলাম। কাঁদতে না পারলে মরে যাব কাঁদতে দাও। ”

-” বাবা ঠিক বলেন মানুষ মরার চেয়েও স্বপ্ন মরার কান্না বেশি ভয়ংকর। ”

নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলে ওঠে দাঁড়ালো রুদ্র। দু-হাতে সম্মুখে আসা চুলগুলো পিছনে ঠেলে দু’ঠোঁট ফাঁক করে বড়ো বড়ো শ্বাস ছাড়ল। কিছু সময় রুম জুড়ে পায়চারি করে হঠাৎ জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা সূচনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বলল,
-” তোর ঘর হবে, তোর বর হবে, তোর একটা ভরা সংসার হবে। ঐ মহিলার জন্য তোর জীবন আমি নষ্ট হতে দেবো না। ”

দু-চোখ বন্ধ করে সূচনা বলল,
-” আমার এসব কিচ্ছু চাই না। স্বাদ মিটে গেছে। ”

-” আমি লিমনের কাছে যাচ্ছি। ”

রুদ্র পেছন ঘুরে পা বাড়াতেই তড়াক করে তার পা আঁকড়ে ধরল সূচনা। মিনতির সুরে বলল,
-” তুমি যাবে না। আমি ওকে চাই না বিশ্বাস করো। ”

-” তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে তোর উপযুক্ত পাত্র নিয়ে আসছি। উপযুক্ত ঘর, উপযুক্ত বর দু’টোই এনে দেবো। ”

উন্মাদের মতো ‘না না’ করে ওঠল সূচনা। খ্যাপা রুদ্রও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো,
-” হয় তুই উপযুক্ত পাত্রকে গ্রহণ করবি। নয়তো আমার বোনকে প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে হাড়গোড় ভাঙা লিমনকে দু-চোখ ভরে দেখে বুকের জ্বালা মেটাব আমি।”

ভয়ে শিউরে ওঠল সূচনা। ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
-” না না। ”

জেদি কণ্ঠে রুদ্র পুনরায় বলল,
-” আমার বোনের এক ফোঁটা অশ্রুর মূল্য ঐ লিমন’কে দিতে হবে। আর যদি তুই সেটা না চাস তাহলে তোর সুখের জন্য যা কিছু করব সব মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। ”

কয়েক পল পিনপতন নীরবতা চলার পর রুদ্র বলল,
-” বল কাকে চাই লিমন নাকি আমার বাছাই করা উপযুক্ত পাত্র? ”

ফুঁপিয়ে ওঠে সূচনা বলল,
-” তুমি যা বলবে সব মেনে নেবো। শুধু যার থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছি তার সঙ্গে যেনো আমার এ’জীবনে আর দেখা না হয়। আর হ্যাঁ তুমি ওর কিছু করবে না, কিছু না। ”

-” পা ছাড় দাদিন’কে দিয়ে খাবার পাঠাচ্ছি খেয়ে নিস। আমি যেন এর মাঝে আর কোন কথা না শুনি।”

পা ছেড়ে দিলো সূচনা৷ রুদ্র দরজা অবধি যেতেই হঠাৎ বলে ওঠল,
-” বাবাকে জানিয়েছ? ”

-” জানিয়ে দেবো। ”
___
বেলা বারোটায় রুদ্রর ফোনে কল এলো। বিছানা জুড়ে শরীর ছেড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিল সে। হঠাৎ ফোনের শব্দে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার চ্যালা ঝিনুক নামের ছেলেটা বলল,
-” বস দাদিন যে ছেলের খোঁজ নিতে বলেছিল নিয়েছি। সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু এখন তার বাইকে একটা মেয়ে’কে দেখতে পাচ্ছি। ”

-” পিছু নিয়ে দেখ কাহিনী কোন পর্যন্ত গড়ায়। ”

ঝিনুক’কে আর কিছু বলতে না দিয়ে শোয়া অবস্থায়ই পাশ থেকে সাদা রঙের কাবলিটা তুলে গায়ে জড়াতে জড়াতেই ওঠে বসল৷ দু’চোখ ডলে চট করে বিছানা ছেড়ে ওয়ালেট, মোবাইল, গাড়ির চাবি, আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ত্বরিতগতিতে বেরিয়ে পড়ল। পনেরো মিনিটের মাথায় পরিচিত শহরের একটি ন্যাশনাল ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো। তার গাড়ি দেখেই ঝিনুক রাস্তার ওপাশ থেকে ডাক দিলো,
-” বস। ”

ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রুদ্র বেরিয়ে এলো। ঝিনুক সহ আরো চার, পাঁচ’টা ছেলে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরলো তাকে। বলিষ্ঠ বুক, পেশিবহুল হাত টান টান করে দাঁড়িয়ে ঝিনুকের দিকে সরু চোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে গড়গড় করে ঝিনুক বলতে লাগল,
-” মেয়েটার সাথে সেই যে ঢুকছে আর বের হয়নাই।”

ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল রুদ্রর। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সিগারেটে ঘনঘন টান দিয়ে বলল,
-” কোথায় ঢুকেছে? ”

-” কলেজের ভিতরে। ”

পাশ থেকে অল্পস্বল্প হাসির শব্দ ভেসে এলো। রুদ্র দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-” শালা কথার ধরন তো অন্য কিছু বোঝালো!’

ঝিনুক মাথা চুলকালো। তৎক্ষনাৎ পাশ থেকে আবির নামে রুদ্রর বন্ধু বলে ওঠল,
-” এই রুদ্র ঐ তো ঐ মেয়ে ঐ মেয়েই ছিল। ”

আবিরের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতেই চট করে বা দিকে ঘার বাঁকালো রুদ্র। দেখতো পেলো, ছোটোখাটো দু’টো মেয়ে এগিয়ে আসছে। গেট পেরিয়ে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাঁটা ধরল মেয়ে দু’টো। এদের মধ্যে একজন ননস্টপ কথা বলছে। কথাগুলো শুনতে না পেলেও মুখের ভঙ্গি আর হাত দু’টোর নাচানাচি দেখে বুঝলো ভয়াবহ রকমের ইন্টারেস্টিং কোন টপিক নিয়ে বর্ণনা চলছে। এতটাই ইন্টারেস্টিং যে পাশের জন’কে একটি কথা বলার সুযোগ দিতেও সে রাজি নয়। ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল রুদ্রর। বিরক্তিতে কপালে তিনটা ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
-” দু’টোর মধ্যে কোনটা ছিল সেটা বল নাকি দু’টোই ছিল!”

ঝিনুক জিব কেটে বলল,
-” ঐ যে জিন্স প্যান্ট, গোলাপি জামা পরা মেয়েটা।”

আবির বলল,
-” যেটা বকবক করছে থামছেই না ঐটা। ”

সিগারেটে শেষ দু’টো টান দিয়ে সন্তর্পণে শেষ অংশটুকু ফেলে দিলো রুদ্র। তর্জনী দিয়ে কপালের মাঝবরাবর কয়েকপল চুলকে গম্ভীর স্বরে আদেশ করল,
-” ঝিনুক তুই যা। সরাসরি প্রশ্ন কর মাহেরের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক। রিলেশন থাকলে সেটা কত দিনের? জেনে আয় কুইক। ”

বেশ ভাবসাব নিয়ে চেহেরায় পাক্কা ভিলেনের ছাপ ফুটিয়ে মেয়ে দু’টোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ঝিনুক। সরাসরি প্রশ্ন করল,
-” এই যে বকবকানি মাহের ভাইয়ের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? কতদিন চলছে এই সম্পর্ক? ”

কথার মাঝে বাঁধা পেয়ে গোলাপি গাউন পরা মেয়েটি পিটপিট করে তাকিয়ে রইল ঝিনুকের দিকে। পাশের মেয়েটিকে অর্থাৎ বান্ধুবীকে বলল,
-” নয়ন পাঁচ সেকেণ্ড ওয়েট কর। ”

নয়ন ভ্রু কুঁচকে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এই হৈমী এই ছাগলটা আবার কে? ”

নিমিষেই ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো নয়নের দিকে। হৈমী ওসবে ধ্যান না দিয়ে ঝিনুক’কে উদ্দেশ্য করে চটপটে গলায় বলল,
-” আপনি একটু দাঁড়ান। আমি নয়ন’কে গতকালকের ঘটনাটা বলে শেষ করি। তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলছি। ”

ঝিনুকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরু হয়ে হৈমীর মুখের দিকে পড়ল। হৈমী বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটি হাসি উপহার দিয়ে নয়নের দিকে ফিরে আবার কথা বলতে শুরু করল। দু’মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর ওপাশ থেকে রুদ্র চোখ রাঙালো ঝিনুক’কে, আবির গালাগাল শুরু করল। ঝিনুক পুনরায় হৈমীকে প্রশ্ন করতে উদ্যত হলে হৈমী ঝিনুক, নয়ন দু’জনকেই গল্প শোনাতে লাগলো। গল্পের শেষ প্রান্তে যেতেই হাওয়াই মিঠাইওয়ালাকে দেখতে পেলো সে। তৎক্ষনাৎ চিল্লিয়ে ওঠে ঝিনুক’কে বলল,
-” এ ভাই আপনি একটু দাঁড়ান আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবো৷ এখন দিতে গেলে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা চলে যাবে। ”

বলতে বলতেই রাস্তার ওপাশে চলে গেল। তার পেছন পেছন নয়নও গেল। ঝিনুক এক ঢোক গিলে হা করে রুদ্রর দিকে তাকাল। আবির বলল,
-” এই শালা আহাম্মকের মতো হা করে মেয়েটাকে দেখেই গেলি। কিছু শুনছোস? আয় এদিক আয়।”

এপাশে এসে ঝিনুক বলল,
-” ভাই আমারে তো সুযোগই দিলো না। কি সব যে বলল কিছু বুঝলামও না। কানের ভেতর গড়গড় শব্দ শুনলাম। আমার মাথা কিলবিল করতেছে। ”

বিরক্তিসূচক শব্দ করে রুদ্র বলল,
-” প্রশ্ন করার পর কী বলল? ”

হৈমীর বলা কথাটা বলতেই রুদ্র গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওদিকে হৈমী হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আবির বলল,
-” দোস্ত এদিকে আসতাছে।”

সকলেই রুদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে রইল। রুদ্রও তীক্ষ্ণ চোখে একবার দেখল, মেয়েটা তাদের দিকে আগাচ্ছে। তাই দৃষ্টি সরিয়ে ঝিনুক’কে ইশারা করল কথা বলতে। হৈমী যখন তাদের থেকে এক হাত দূরত্বে এসে দাঁড়ালো ঝিনুক বলল,
-” আপা উত্তর’টা? ”

আবারও দাঁত ক্যালিয়ে হেসে দিলো হৈমী। বড়ো বড়ো চোখজোড়া কতক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,
-” উত্তর দিতেই আসছি ভাই। প্রশ্ন যেন কী ছিল? আপনার মাহের ভাই আর আমার সম্পর্ক কী? কতদিন চলছে এই সম্পর্ক এটাই তো? ”

কিঞ্চিৎ মাথা হেলিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে রইল হৈমী। ঝিনুক সহ আবিরও হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠল। রুদ্র কানখাড়া করে একটি সিগারেট ধরালো। এমন সময় হঠাৎ হৈমী হাতে থাকা আধখাওয়া হাওয়াই মিঠাই নয়নের হাতে ধরিয়ে তর্জনীতে বুড়ো আঙুলের মাথা ঠেকিয়ে ঝিনুক’কে বলল,
-” এক মিনিট দাঁড়ান আমি এই যাব আর এই আসব। আপনার উত্তর দেবো দাঁড়াবেন কিন্তু… ”

হৈমী ছ’জন ছেলেকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
নয়ন ঠোঁট টিপে হেসে তাকে অনুসরণ করল। ঝিনুক আশ্চর্য হয়ে রুদ্রর দিকে তাকালো। রুদ্র বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে। ধীরে ধীরে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। কতক্ষণ পর ফোঁস করে ওঠে জ্বালিয়ে পুড়য়ে ছারখার করে দেবে আন্দাজ করা গেল না। আবির অধৈর্য্য হয়ে বলল,
-” এইটা কোন প্রজাতিরে ভাই! মানে হয় কোন? ”

রুদ্রর আশপাশে থাকা প্রত্যেকেই হৈমীর কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করতে লাগল। রুদ্র একের পর এক সিগারেট শেষ করতে ব্যস্ত। মেয়ে মানুষদের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। শুধু প্রশ্নের উত্তর চাই। কিন্তু তার চারপাশে ঘিরে থাকা ছেলেরা দেখতে পেলো। হৈমী নামক মেয়েটা গেটের পাশে একটা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বাটে হ্যাংলা, পাতলা ছেলেটা মিটিমিটি হাসছে। ঝিনুক বলল,
-” লুইচ্চার মতো হাসতাছে না পোলাডা?”

আবির বলল,
-” হ কাহিনী কী দেখি আগে। ”

হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা প্যান্টের পকেট থেকে একটি লাল গোলাপ বের করল। হৈমী চটপটে গলায় বলল,
-” তাড়াতাড়ি প্রপোজ করো আমার বেশি সময় নেই। ঐ যে দেখো চার, পাঁচ, ছয়টা ছেলে ওদের মধ্যে ঐ খাটো ছেলেটার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ”

ছেলেটার নাম পালন। আজ সে এসেছে হৈমীকে প্রপোজ করতে। গতকাল ম্যাসেন্জারে নক দিয়ে এ ব্যাপারে জানিয়েছিল। প্রেম করবে না হৈমী কারণ হ্যাংলা পাতলা ছেলে তার পছন্দ নয়৷ তবে তার দয়ার শরীর। সেধে এসে প্রপোজ করলে কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। ফুল টুল বা গিফ্ট টিফ্ট আনলে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। পরবর্তীতে যদি প্রেম, ভালোবাসার জন্য ফোর্স করে সোজা ব্লক। সামনে এলে দু’চারটা চর,থাপ্পড় ব্যাস কাহিনী খতম! পালন চারপাশে লাজুক চোখে তাকিয়ে গোলাপ দিয়ে ” আই লাভ ইউ ” বলে প্রপোজ করল হৈমীকে। হৈমী ঝটপট গোলাপটা নিয়ে বলল,
-” আমাকে ভালোবেসে ফুল দেওয়ার জন্য থ্যাংকিউ। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রেমটেমও চলবে না আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২
-” আমাকে ভালোবেসে ফুল দেওয়ার জন্য থ্যাংকিউ। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রেমটেমও চলবে না আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”

এমন একটি উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল পালন। কারণ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া এই মেয়েটি মাত্র তিন মাসেই কলেজে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রথমত, বাংলা বিভাগের নতুন লেকচারার মাহের খানের একমাত্র ছোটো বোন সে। দ্বিতীয়ত এই মেয়েটি ভয়াবহ রকমের বিচ্ছু। সর্বক্ষণ তার মাঝে একটা ছটফটে ভাব বিরাজমান। সিনিয়র আপু, ভাইয়াদের অনেকেই তাকে ভীষণ ভয় করে চলে, অনেকে আবার খুব ভালোওবাসে। সবচেয়ে বড়ো কথা সিনিয়র আপুরাই তাকে বেশি স্নেহ করে। এর পেছনে অনেক বড়ো একটি কারণ তার সুদর্শন লেকচারার ভাইটি৷ আটাশ বছর বয়সী অবিবাহিত সুদর্শন লেকচারার পেলে অনার্স পড়ুয়া অবিবাহিত মেয়েরা বেসামাল অনুভূতিতে লুটোপুটি খাবেই। বয়স সবে সতেরো হলেও ভাইয়ের মতো বোনটিও কম নয়। ভাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বল গায়ের রঙ তার৷ গায়েপায়ে খুব একটা বড়ো না হলেও ধবধবে ফর্সা ত্বক, গোলগাল শুভ্র মুখশ্রীর ঘন-কালো বড়ো বড়ো পাপড়িতে বেষ্টিত চোখজোড়া দেখেই সমবয়সী, সিনিয়র ভাইরা কপোকাত। তিন মাসে কম প্রপোজ পায়নি সে। বরাবরই পালনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়েও তার খ্যাতির শেষ নেই৷ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হওয়ার দরুন ইন্টার, অনার্স, ডিগ্রি, মাস্টার্স সকল পর্যায়ের স্টুডেন্ট’স রয়েছে এখানে। পালন অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। পালন’কে দিয়ে মোট তেরোটা প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল হৈমী। এই তেরো বারে বারোটা গোলাপ ঠিক গ্রহণ করেছে৷ বাকি একটা গোলাপ প্রপোজকারী প্রপোজ একসেপ্ট না করাতে দেয়নি। এ নিয়ে অবশ্য এক চোট ঝগরা করেছিল ছেলেটার সঙ্গে। ছেলেটার বাইকের সিটে চুইংগাম লাগিয়ে প্রতিশোধ নিতেও ভুলেনি! বর্তমানে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই ইঁচড়ে পাকা। কিন্তু হৈমীর বেলায় শুধু ইঁচড়ে পাকা নয়৷ মেয়েটি যেমন বাচাল, তেমনি দুরন্ত। শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মিষ্টিভাষী একজন গুণী শিক্ষকের বোন এমন অশান্ত কী করে হলো ভাবতে গেলেই মাথা ঘুরে যায়।

রুদ্র সহ তার সাঙ্গোপাঙ্গ’রা মোটেই হৈমীর এইরূপ আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। রুদ্র চোখ, মুখ কুঁচকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। আগ্রহ নেই অথচ বিরক্তি আকাশ ছোঁয়া। ঝিনুক আবির সহ বাকি সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এরা একে অপরের দিকে বিস্মিত চোখে চাওয়া চাওয়ি করছে! গোলাপ ফুল নিয়ে চঞ্চল পায়ে ঝিনুকের সামনে এসে দাঁড়াল হৈমী। পালন ক্লান্ত মুখে সেই তখনি ভার্সিটিতে ঢুকে পড়েছে। তার ইনকোর্স পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার সময় হয়ে যাওয়াতে আর দেরি করেনি।

-” তো ভাইয়া কী বলছিলেন? মাহের ভাইয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক তাই তো? ”

হৈমী এসে একদমে কথাটা বলতেই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়াল ঝিনুক। আবির ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। তার দৃষ্টি একবার হৈমীর মুখের দিকে তো আরেকবার হাতে থাকা লাল গোলাপটির দিকে ছুটোছুটি করছে। হৈমীর উত্তর দেওয়ার তেমন তাড়া নেই। সে এক এক করে সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ যখন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী রুদ্রর দিকে পাকাপোক্ত নজর পড়ল কিঞ্চিৎ চমকাল। ঘন ঘন চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে আপাদমস্তক রুদ্র’কে দেখতে শুরু করল। চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল ভীষণভাবে। চোখের পাতা এলোমেলো নড়চড় করতে করতেই গোলাপটা নয়নের হাতে দিলো। নিজের দু-হাত কোমড়ে রেখে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো সুক্ষ্মভাবে তাকিয়ে রইল। আবির রুদ্রর পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
-” দোস্ত দেখ তোকে কেমনে দেখতাছে। রোহিঙ্গাদের যেমনে দেখি অমনে তোরে দেখতাছে। এইটা কোন কথা হইল! তুই কিছু বল আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ লাগতাছে। ”

আবিরের কথা শুনে রুদ্র ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে এক পলক তাকাল হৈমীর দিকে৷ সত্যি সত্যি মেয়েটা ভুত দেখার মতো দেখছে তাকে। গোলগাল মুখের গোল গোল চোখ যেন গিলে খাচ্ছে। পা থেকে মাথা অবধি বিরক্তি ভঙ্গিতে অতি সুক্ষ্মভাবেই দেখল রুদ্র। বডি ফিগার দেখেই চট করে বুঝে নিলো নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। এর সঙ্গে মাহেরের কোনকিছু থাকতে পারে বলে মনে হলো না। আবার সন্দেহও হলো, যতটুক বুঝল মেয়েটার চরিত্রে ঘাপলা আছে। ভালো মেয়েরা নিশ্চয়ই এত কথা বলে না, এভাবে একটা ছেলের থেকে গোলাপ ফুল নেয় না। তাছাড়া আজকাল পুরুষদের এমন কচি মেয়েদের প্রতিই ঝোঁক বেশি। যত শিক্ষিতই হোক অল্পবয়সী মেয়েদের প্রতি লোভ বেশিরভাগ পুরুষেরই রয়েছে। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভরে গেল। ত্বরিতবেগে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ক্ষণকাল সময় পেরোতেই হৈমীর দিকে আঙুলে তুরি বাজিয়ে গম্ভীর, রূঢ় কণ্ঠে বলল,
-” এই, মাহেরের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? যা প্রশ্ন করেছি জাস্ট সেটার উত্তর দিয়ে বিদায় হও। নয়তো এমন হাল করব, মানুষ’কে মুখ দেখাতে পারবে না। ”

আঁতকে উঠল হৈমী। সম্বিত ফিরে পেয়ে কোমড় থেকে দু’হাত সরিয়ে এক ঢোক গিলল। পিটপিট করে কতক্ষণ তাকিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে অমনি পেছন থেকে নয়ন ওর মুখ চেপে ধরল। শঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
-” মাহের স্যার ওর আপন বড়ো ভাই। ”

ব্যস আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না নয়ন। প্রাণের বান্ধবীটিকে নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে একটি রিকশা ডেকে ওঠে পালিয়ে গেল। রিকশা চলছে হৈমীর বাড়ির দিকের রাস্তায়। একমিনিট সময় ধরে নয়ন ভয়াতুর কণ্ঠে অনেক কথাই বলেছে হৈমীকে। তার ধারণা রুদ্র সহ ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা সন্ত্রাস হবে। আর তাদের লিডার হচ্ছে রুদ্র। ঐতো লম্বা লম্বা চুল, মুখ ভর্তি বড়ো বড়ো দাঁড়ি। চোখ, মুখের ভাব, কণ্ঠস্বর সবটাতেই পাক্কা সন্ত্রাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। কী বিশ্রী ভাবে সিগারেট খায়। নাক কুঁচকে রইল নয়ন। বাড়ির সামনে রিকশা আসতেই হঠাৎ হৈমী চিৎকার করে ওঠল। নয়নকে আকস্মিক জড়িয়ে ধরে বলল,
-” দোস্ত ফাটাফাটি। ”

-” কী! ”

-” ফাটাফাটি রকমের ক্রাশ খেয়েছি। ”

ভয়কাতুরে কণ্ঠে নয়ন বলল,

-” প্লিজ এটা বলিস না তুই ঐ সন্ত্রাসটাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিস। ”

-” দোস্ত এ জীবনে আমি কাউকে দেখে ভয় পাইনি। কারো কথায় আমার গলা শুকিয়ে যায়নি। বুকের ভিতর ধড়াস করেও ওঠেনি। কিন্তু আজকে! হায়! আমি ভাবতে পারছি না। তাড়াতাড়ি নাম একটা সেলিব্রেশন হওয়া উচিৎ। ”

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নয়নকে নিয়ে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল হৈমী। নয়নের হাত পা এখনো কাঁপছে তখনকার পরিস্থিতি মনে করে৷ কী চেহেরা! কী কণ্ঠস্বর! কী ভয়াবহ হুমকি! পুনরায় গা শিউরে ওঠল তার। অথচ হৈমী কিনা ক্রাশ খেলো! মেয়েটা কি সত্যি পাগল?
_
যুব উন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি রাদিফ শেখ। রুদ্রর বড়ো চাচার বড়ো ছেলে। তার ফোন পেয়েই ক্লাবে ছুটে গেছে রুদ্র। সেখানে যাওয়ার পর দেখল, ছোটোখাটো একটি জটলা বেঁধে আছে। রুদ্র’কে দেখে অনেকে জড়োসড়ো হয়ে গেল। রাদিফ জটলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রুদ্রর কাছে গেল। রুদ্রকে দেখে জটলার ভিতরে থাকা প্রতিটি মানুষের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ ক্লাবের পেছনের জঙ্গলে দু’টো ছেলেমেয়ে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়েছিল। তখনই ক্লাবের কয়েকজন সদস্য ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। এখন তারা জটলার মাঝখানে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। সমস্ত ঘটনা শুনতেই রুদ্রর চোখ, কান উভয়ই রক্তিম হয়ে ওঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারল না৷ তড়াক করে এসে জটলার ভেতর ঢুকে ছেলেটাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করল। মেয়েটার গালেও কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছে। রাদিফ ওকে টেনেটুনে সরিয়ে এনে থমথমে কণ্ঠে বলল,
-” রুদ্র মাথা ঠান্ডা কর একটা সমাধান দে। ছেলেটা আমার বন্ধুর ছোটো ভাই৷ ”

বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নীরস কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” মেয়ের পরিচয় কী? ”

রাদিফ মেয়ের পরিচয় দিতেই রুদ্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেডি করে কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলল। ছোটো ভাইয়ের পরামর্শে রাদিফ তার ছেলেপুলেদের দিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। বিকাল গড়াতে গড়াতে ছেলে, মেয়ে উভয়ের পরিবারের সম্মুখেই বিয়ে পড়ানো হলো। পাত্রপাত্রী বিদায় করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ পনির নামের রুদ্রর একজন চ্যালা বলল,
-” বস আপনার নামে একটা চিঠি আছে। ”

বাইকে বসতে বসতে ভ্রু কুঁচকে রুদ্র বলল,
-” ঝেড়ে কাশ। ”

-” ইয়ে মানে লাভ লেটার পাঠিয়েছে এক মেয়ে। ”

আশ্চর্য হয়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল রুদ্র। বাইকের পেছনে ঝিনুক বসতে নিয়ে আবার নেমে দাঁড়িয়েছে। সেও অবাক চোখে পনিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– “আমি একজন সন্ত্রাস। একজন সন্ত্রাস’কে যে মেয়ে লাভ লেটার পাঠায়, সে মেয়ে আরো বড়ো সন্ত্রাস। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম, চব্বিশ ঘন্টা। এরমধ্যে ঐ মেয়ে’কে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। প্রয়োজনে ঘরে ঘরে তল্লাশি করবি। ”

পনির বলল,

– “ভদ্র ঘরের মেয়ে বস। বড়ো একটা ভাই আছে কলেজে লেকচার দেয়। ”

– ” নাম কী? ”

– ” মাহের খান। ”

-” বোনের নাম? ”

– ” হৈমন্তীকা জাহান হৈমী। ”

ঝিনুক আতঙ্কিত হয়ে মুখে হাত দিলো। রুদ্র কপাল কুঁচকে ঝিনুকের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” বোনের তো লুস ক্যারেক্টার দেখছি! ভাইয়ের বিষয়ে আরেকটু খবর নে ঝিনুক। আমার বোনের গোটা জীবনের বিষয় এটা। ”

ঝিনুককে কথা গুলো বলেই পনিরকে বলল,

-” লাভ লেটার কার কাছে। ”

– ” বাবু ভাইয়ের কাছে। ”

সিগারেট ধরাতে ধরাতে রুদ্র গর্জন ছাড়ল,

– ” এই বাবু, কী লিখছে পড়তো। ”

পনিরের পেছন থেকে এগিয়ে এলো বাবু। মৃদু কাঁপছে তার হাতদুটো। কম্পিত হাতেই দু’ভাঁজ করা সাদা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করল,

– ” এই যে মি. গুণ্ডা, থুরি গুণ্ডাদলের হেড। আপনাকে
আই লাভ ইউ। অর্থ হচ্ছে, আপনাকে আমার মতো এই দুষ্টু, মিষ্টি, সুন্দরী রমণীটি ভালোবাসে। আপনাকে আমি আমার প্যারাসিটামল হিসেবে চাই, আপনাকে আমি আমার এন্টাসিড হিসেবে চাই। আপনাকে চাই, আপনাকে চাই ও গুণ্ডা আপনাকে কিন্তু চাই’ই। আসসালামু আলাইকুম গুণ্ডা। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব, আশা করি, দু’দিনের ভেতরে জবাব পাবো। ”

চিঠিতে লেখা ভাষাগুলো কর্ণগোচর হতেই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধতার সঙ্গে তেড়ে এলো রুদ্র। খপ করে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলিষ্ঠ হাতে মুচড়ে মাটিতে ফেলল। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” বেয়াদব মেয়েটার আজ এমন অবস্থা করব যে পরবর্তীতে আমাকে লাভ লেটার তো দূরের কথা আমাকে কল্পনা করতেও ওর রূহ কেঁপে উঠবে! ”

ত্বরিতগতিতে বাইকে ওঠে ঝিনুক’কে পেছনে বসতে বলল৷ ঝিনুক বসতেই বলল,
-” মাহের খানের বাড়ির পথ বল। ”

ঝিনুক মাহেরের বাড়ির ঠিকানা বলতেই রুদ্র সেদিকে বাইক ঘোরাল। পনেরো মিনিটের পথ মাত্র পাঁচ মিনিট গিয়েছে। এমন সময় কল পেলো বড়ো চাচি জেরিনের৷ সে জানাল, সূচনা’কে দেখতে এসেছে তার বান্ধবী। তাই রুদ্রকে যত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে৷ ফোনে কথা শেষ করে রুদ্র বাইক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
-” মেয়েটার কপাল ভালো। ”

বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলো বোরখা পরিহিত একজন মহিলা সূচনার পাশে বসে আছে। নিকাব খোলা থাকায় মহিলাটির বয়স আন্দাজ করল পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। রুদ্রকে দেখতেই চাচি জেরিন বলল,
-” এইতো আমাদের রুদ্র এসে গেছে। হামিদা এটাই আমার ভাতিজা। সূচনার বড়ো ভাই। ”

মহিলাটি সৌজন্যপূর্ণ হেসে রুদ্রকে বলল,
-” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো বাবা। ”

আমতা আমতা করে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে রুদ্র বলল,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”

বাকিটুকু জবাব দিলো না সে। দোনোমোনো করে দাদিনের পাশে গিয়ে বসল। হামিদা রাগ করলেন না। জেরিনের বান্ধবী হওয়ার সুবাদে রুদ্র, সূচনা সম্পর্কে পুরোপুরিই অবগত তিনি। মা হারা ছেলেমেয়ে দু’টোর প্রতি মায়ার অন্ত নেই। সে মায়া থেকেই একমাত্র ছেলে মাহেরের জন্য সূচনাকেই নির্বাচন করেছেন।ছেলে সম্পর্কে মোটামুটি যতটুক ধারণা পেয়েছে সূচনার প্রবাসী বাবা, বড়ো চাচি, চাচাতো ভাইরা এবং দাদিন কারো কোন আপত্তি নেই৷ ছেলের মায়ের স্নেহপূর্ণ আচরণ দেখে সূচনার মন অনেকটাই নরম হয়েছে। মা হারা মেয়ে সে। ছোটোবেলা থেকে মাকে ছাড়া বড়ো হয়েছে। মা, মা গন্ধটা কখনো নাকে আসেনি। বড়ো চাচি অনেকগুলো বছর অভিমানে বাপের বাড়ি কাটিয়েছেন। এখন পর্যন্তও ছেলে, ছেলে বউয়ের সঙ্গে শশুর ঘর থেকে দূরেই আছেন। বছরখানেক হলো রুদ্র আর সূচনার সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ বয়স বেড়েছে বুদ্ধিও খুলেছে। এক সময় অতি সরলা ছিল বলেই স্বামী ছোটো ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে তাকে ত্যাগ করেছেন। সেদিনের জেরিনের সাথে আজকের জেরিনের মধ্যে রাত দিন তফাৎ। নিজের বাচ্চাদের বুকে টেনে রুদ্র, সূচনার থেকে এতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকলেও এখন তিনি বুঝতে পরেছেন এই সন্তান দুটোর কোন দোষ নেই। মায়ের পাপের অংশীদার তারা কোনভাবেই নয়। ঠিক যেমন তার ছেলেরা বাবার পাপের অংশীদার নয় তেমনি রুদ্র, সূচনাও। তাই তো সূচনার এমন খারাপ পরিস্থিতিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে বান্ধবী হামিদার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা এগিয়েছেন। এ নিয়ে চাচির প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই রুদ্রর। সূচনাও ভাই আর চাচিকে ভরসা করে একজন মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বিয়েতে মত দিয়ে দিলো৷ কথাবার্তা শেষে সকলেই মিষ্টি মুখ করল। দাদিন জানে মাহেরের বাবা নেই। বছর চারেক আগে পরলোকগমন করেছেন। মা, বোন নিয়েই তার সংসার৷ তাই বললেন,
-” হামিদা, তোমার মেয়েটাকে নিয়ে আসলে না তো?”

শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে ঠোঁট টিপে হাসল জেরিন৷ হামিদাকে কিছু বলতে না দিয়ে সেই বলল,
-” আসলে মা ওর মেয়েটা বড্ড ছেলেমানুষ। অতিরিক্ত সহজসরল। হাতেপায়ে বড়ো হলেও বুদ্ধি তেমন নেই। হৈহৈ রৈরৈ করতে পছন্দ করে। প্রথম দিন এসেই যদি অমন হৈহৈ শুরু করে আপনারা ভুল বুঝতে পারেন। তাই নিয়ে আসেনি। ”

লজ্জিত হয়ে হামিদা বলল,
-” আসলে মেয়েটা সহজেই সবার সাথে এমনভাবে মিশে যায় এরজন্য অনেক সময় লজ্জায় পড়তে হয়। বাচালও বলতে পারেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ওকে কোথাও নিয়ে যাই না। সব ঠিকঠাক হোক নিশ্চয়ই আসবে। আপনাদের পাগল করেও ফেলবে একদম।”

এমন সময় রুদ্র দাদিনের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-” দাদিন আমার কথা আছে। ”

-” কী বল তোর কি আপত্তি আছে? ”

ইতস্ততভাবে রুদ্র বলল,
-” ছেলেকে নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের বোনকে নিয়ে বিরাট সমস্যা। ”

দাদি চোখমুখ ছোটো করে বলল,
-” সেকি! বিয়ে দেবো আমার নাতনিকে ঐ ছেলের কাছে। আমার নাতিকে দিয়েতো আর ঐ ছেলের বোন আনব না। তাহলে তাকে নিয়ে কেন সমস্যা থাকবে? ”

হকচকিয়ে রুদ্র বলল,
-” ছেলের বোনের চরিত্র খারাপ দাদিন! ”

-” কী বলিস আমি জীবনেও বিশ্বাস করব না এটা। হামিদার মেয়ে খারাপ হতেই পারেনা। আর যদি হয়ও তাতে আমাদের কী? তাকে তো আর তোর বউ করে আনছি না। ”
_
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। হৈমীকে তার বেয়াদবির শাস্তি দিতে চেয়েছিল রুদ্র। কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়াতে এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাল না। শতহোক, বোনের শশুর বাড়ির লোক। এদিকে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই মাহেরের। শুধু এনগেজমেন্টের আগে মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলতে চায়৷ মাহেরের এমন ইচ্ছে শুনে সূচনাও স্বস্তি পেলো৷ একজনকে ভালোবেসে আরেকজন’কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাই বলে কাউকে ঠকানোর মানসিকতা নেই। আগামীকাল বিকেল চারটায় মি.মাহের খানের সঙ্গে মিট করতে যাবে সে।

চলবে…
( অনুমতি ছাড়া কপি নিষেধ )
[ ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এই গল্পটি রোমান্টিক জনরার আশা করি ধীরে ধীরে ভালো লাগবে। ]
চলবে..ইনশাআল্লাহ
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here