বেসামাল প্রেম পর্ব – ৩+৪

#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩
” ছ’বছর আগে মাহেরের প্রেমিকা রশ্নি’কে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ খবর শোনার পর ঢাকা থেকে সরাসরি হসপিটালে এসেছিল মাহের৷ বেডে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা রশ্নির একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেছিল,

– ” উইল ইউ ম্যারি মি রশ্নি? ”

রশ্নি উত্তর দেয়নি। তার গাল বেয়ে শুধু দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। মাহের নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়িয়ে রশ্নির মা, বোন’কে বলেছিল,

– ” আগামীকাল আমার অভিভাবক পাঠাব আন্টি। এনগেজমেন্ট হসপিটালেই হবে। ”

কেবিন থেকে বেরোনোর পথে ওর জলপূর্ণ দু’টো চোখ স্পষ্ট দেখেছিলাম আমরা। পরেরদিন সকালেই রশ্নিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়৷ মাহের’কে রশ্নির মা জানায়, এনগেজমেন্ট তাদের বাড়িতেই হবে। কথামতো, ঠিক দুপুর তিনটায় মা, বোনকে পাঠায় মাহের। কিন্তু এনগেজমেন্ট হয়নি। ”

ফোনের স্ক্রিনে ইংরেজি বার্তায় এ পর্যন্ত দেখেই বুক ধড়ফড় শুরু হলো সূচনার। কপাল ঘামছে তার, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, এক ঢোক গিলে দ্রুত টাইপ করল,

– ” হলো না কেন? তাড়াতাড়ি বলুন। ”

মিনিট পাঁচেক পর উত্তর এলো,

– ” রশ্নি সুইসাইড করেছিল! ”

যে ছেলেটা ম্যাসেজ করেছে তার নাম নিলয়। মাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহেরের মা হামিদা বেগম মাহেরের বিষয়ে সমস্তটা জানাতে বলেছেন নিলয়কে। মাহের সূচনার ফেসবুক একাউন্টে এড হয়েছে গতকাল রাতে। নিলয় মাহেরের থেকে সূচনার আইডি নিয়ে সকাল বেলা নক দিয়েছে। সূচনা ব্যস্ত থাকায় সারাবেলা কথা হয়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণ আগে সীমিত পরিচয়ের পাশাপাশি মাহেরের অতীত জানাল। অতীত নিয়ে কথা বলতে পারে না মাহের। রশ্নি’কে নিয়ে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করতে পারে না৷ ছ’বছর ধরে মাহেরকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি। রশ্নিকে নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। উচ্চ মানসিকতার মানুষদের অনুভূতিও উচ্চমানের হয়। মাহেরের জায়গায় অন্য ছেলে হলে নিশ্চয়ই প্রেমিকার মৃত্যু শোকে পড়াশোনা, পরিবার ভুলে নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবনটা ধ্বংস করে দিত। কিন্তু মাহের তা করেনি। সে প্রেমিকাকে ভুলে গেছে কিনা বোঝা যায় না। তার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে কিনা তাও স্পষ্ট নয়। তাকে কতটুকু ভালোবেসেছিল সেটা যেমন স্পষ্ট নয় তার জন্য ঠিক কতটা কষ্টে জর্জরিত সেটাও অজানা। সাদাসিধে মানুষদের অনুভূতি হয় রহস্যেঘেরা। মাহের সাদাসিধে মানুষ। নিজের অমায়িক আচরণের জন্য সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠেছে ঠিকি তবে ব্যক্তিত্ব কঠিন খোলসে মোড়ানো। তার ব্যক্তিত্বের একাংশ সম্পর্ক সকলেই অবগত। প্রফেশনালি সে একজন লেকচারার। সকলের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, দায়িত্ব বোধে সদাসর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাবাহীন পরিবারে মা, বোনের একমাত্র অবলম্বন, বটবৃক্ষ সে।

ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বিচলিত ভঙ্গিতে বসে আছে সূচনা৷ তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নিঃশ্বাসে অস্থিরতা। পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে রুদ্র। একমনে ড্রাইভ করছে সে। হঠাৎ সূচনার দিকে নজর যেতেই রাশভারী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” এসি চলছে তবুও ঘামছিস সমস্যা কী? ”

কিঞ্চিৎ চমকে সূচনা বলল,
-” কিছু না কিছু না। ”

-” নার্ভাস লাগলে আমি তোর সঙ্গে থাকব। ”

চোখ বড়ো বড়ো করে রুদ্রর দিকে তাকাল সূচনা৷ রুদ্রর দৃষ্টি সম্মুখে স্থির, মুখে গম্ভীর্যতা অবিচল। ড্রাইভ করছে বিরতিহীন। এক ঢোক গিলে বারকয়েক চোখের পলক ফেলল সূচনা। কী বলছে তার ভাই! যার সঙ্গে ছোটো বোনের বিয়ের কথা চলছে, তার সঙ্গে প্রাইভেট কথা বলা কালীন সে সঙ্গে থাকবে! তার ভাইটা অমিশুক, নীরস, আবেগহীন জানতো। কিন্তু সম্পর্কের বিষয়গুলোতে এত অজ্ঞ তা তো জানতো না। জোরপূর্বক মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল সূচনা। বলল,
-” না না তোমার থাকতে হবে না। আসলে উনি আমার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। ”

ভ্রুকুটি করে তাকাল রুদ্র। বলল,
-” তোরা পরিচিত নস, একান্তে কথা আবার কী? আমি আশপাশেই থাকব। ”

ঢোক গিলল সূচনা। বলল,
-” উনি হয়তো উনার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাতে চান। তুমি পাশে থাকলে আনইজি ফিল করতে পারে। ”

কুঁচকানো ভ্রুজোড়া আর সোজা হলো না রুদ্রর। লম্বা করে শ্বাস টানল শুধু। ঠোঁট টিপে হাসল সূচনা। সে হাসি রুদ্রর থেকে আড়াল করার জন্য জানালার দিকে মুখ ফেরাল।

গাড়ি থামল লেকের পাশের রাস্তাটায়। লেকের ধারে সারি সারি কফিশপ এবং ফুচকার দোকান। এখানে পরিচিত এক কফিশপ রয়েছে সূচনার৷ তার বান্ধবীর ভাইয়ের কফিশপ এটা। মাঝে মাঝেই বান্ধবী নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে আসে এবং এই কফি-শপেই বসে। গাড়ি থেকে ভাই বোন নেমে দাঁড়াতেই ঝিনুক, পনির সহ আরো অনেকেই এগিয়ে এলো। ঝিনুকের মুখে হাসি যেন উথলে পড়ছে। পান খাওয়া লাল টকটকে ঠোঁটের ফাঁকে আঁধ সাদা দাঁতগুলো দেখে গা জ্বলে ওঠল সূচনার। ক্রোধনে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাইয়ের দিকে তাকাল। ঝিনুকরা ততক্ষণে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রুদ্র সূচনার ক্রোধের মাত্রা টের পেলো, ঝিনুক’কে কঠিন একটি ধমক দিয়ে বলল,
-” সামনে এসে দাঁত ক্যালাতে বলেছি? দূরে যা। ”

ঝিনুকের মুখের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। সূচনার দিকে এক পলক তাকিয়ে পনিরের ঘাড়ে থাবা মেরে বলল,
-” তোরে বললাম সূচনা আপা রাগ করব আমাদের দেখলে। শালা তবুও আমারে জোর করলি। ”

পনির বোকার মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-” হ আফা আমিই বলছিলাম এইখানে আসতে। আপনি ভালো আছেন আপা? ”

এরা কী পরিমাণ ঢপ মারতে পারে খুব ভালো করেই জানে সূচনা৷ তাই অগ্নি দৃষ্ট ছুঁড়ে তাকাল পনিরের দিকে। সে দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়েই ঝিনুক পনির সহ আরো তিনজন ক্ষিপ্র গতিতে পালিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সূচনা৷ পাছে লোকে তার ভাইকে গুন্ডা, মস্তান বলে। সন্ত্রাস হিসেবে খ্যাতি কম নেই। এসবে এখন আর লজ্জা লাগে না অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার হবু বর এবং হবু বরের পরিবার এসবে অবগত। তাই বলে ভাইয়ের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হবু বরের সঙ্গে মিট করতে আসা সমীচীন নয়৷ এরা এসেছে দেখলে বা জানলে মাহের খানও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে৷ সে নম্র, ভদ্র স্বভাবের মানুষ। একজন সম্মানিত ব্যক্তি। শহরে তার মোটামুটি সম্মানীয় একটা পরিচয় আছে। কলেজের লেকচারার। এমন একজন মানুষ শুধু এক চরিত্রহীন নারীর সন্তান নয় এক সন্ত্রাসের বোনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! এইতো মাথা সমান। এতটুকুতেই মাথা তুলে কথা বলার জো নেই। সেখানে আবার এই চ্যালাফ্যালারা উপস্থিত থাকা নিন্দনীয়ই বটে।

সূচনার বলা নামের কফিশপটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মাহের৷ হঠাৎ দু’টো ছেলে মেয়ে’কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। মেয়েটার পরনে পারপেল কালার কারুকার্যে শোভিত থ্রিপিস। মাথায় পারপেল কালার উড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। পেছনের লম্বা বিনুনির শেষ অংশ হাঁটার তালে তালে কোমড়ের পাশ দিয়ে সম্মুখে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। লম্বাটে ফর্সা মেয়েটার মায়াবী মুখটা দেখতেই চিনে ফেলল মাহের৷ হ্যাঁ এটাই তার হবু বউ! মা’য়ের পছন্দের পাত্রী। মনে মনে তিনবার মাশাআল্লাহ পড়ল সে। ততক্ষণে রুদ্র, সূচনা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সূচনা সালাম দিতেই অমায়িক একটি হাসি উপহার দিয়ে সালাম ফেরাল মাহের। রুদ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য৷ স্বভাবতই গম্ভীর মুখে হাত বাড়াল রুদ্র। প্রথম পরিচিতি শেষে মাহের দু’জন’কেই কফিশপে ঢুকতে বলল। বয়সের দিকে রুদ্র, সূচনা উভয়ই তার ছোটো তাই নাম ধরেই ডাকল। সূচনা ধীরপায়ে কফিশপের দিকে এগোলেও রুদ্র রাশভারী কণ্ঠে বলল,
-” আপনারা কথা বলুন আমার কিছু কাজ আছে এদিকে। ”

মাহেরকে কথাটা বলে সূচনার দিকে তাকাল। বলল,
-” আমি এদিকটায়ই আছি৷ ফোন করিস। ”

সূচনা ঘাড় কাৎ করল। রুদ্রও গম্ভীর চিত্তে মাহেরকে বলল,
-” আসি। ”

মাহের মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-” জি। নাইস টু মিট ইউ। ”

বাঁকানো হাসি হেসে বিদায় নিলো রুদ্র। কফিশপের ভেতরে গিয়ে বসল মাহের, সূচনা৷ একে অপরের মুখোমুখি বসেছে তারা৷ মাঝে ব্যবধান শুধু একটি ছোটো টেবিলের। দীর্ঘক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর গলা খাঁকারি দিয়ে মাহের প্রশ্ন করল,
-” সূচনা আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? ”

নিম্নমুখী সূচনা মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। আলতো হেসে মাহের পুনরায় বলল,
-” অস্বস্তি হচ্ছে? ”

এবারেও না করতে উদ্যত হলো সূচনা। তার পূর্বেই মাহের বলল,
-” হবু বরের সামনে প্রথম আলাপে লজ্জা পাচ্ছেন না। এ কথা হজম করেছি কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে না এটা কিন্তু হজম হবে না। ”

বুকের খুব গোপন স্থানে কিঞ্চিৎ শিহরন জাগল সূচনার। সন্তর্পণে মাথা তুলে তাকাল সম্মুখের মানুষটার দিকে। নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ তার সামনে বসে আছে। সুগঠিত দেহের বলিষ্ঠ শরীরটা বসে আছে অসাধারণ ভণিতায়। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। ফর্সা বললেও ভুল বলা হবে না। হেয়ার স্টাইল খুবই সাধারণ। ফ্যানের তীব্র বাতাসে সিল্কি কয়েকটা চুল কপাল দিয়ে উড়ছে। গভীর একজোড়া চোখ। নাকের এক পাশের কালো তিলটা বেশিই চোখে লাগছে। শেভ করার সময় হয়তো কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে৷ ফর্সা ত্বকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো তার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
চোখেমুখে লেপ্টে আছে অমায়িক হসি৷ এমন পুরুষদেরই বোধহয় মি. পারফেক্ট বলা হয়ে থাকে।

-” পাত্র পছন্দ হয়েছে? ”

কেঁপে ওঠল সূচনা। দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই বেসামাল হয়ে ওঠল। মাহের বিচলিত হয়ে বলল,
-” ওহ শীট! লজ্জা দিয়ে ফেললাম। লজ্জা পাবেন না শান্ত হন। যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাবেন তাকে এভাবে দেখেশুনে নেওয়াটাই ব্যাটার। ”

ইতোমধ্যে দুটো কফি দেওয়া হয়েছে ওদের। কফির মগ সূচনার দিকে এগিয়ে মাহের পুনরায় বলল,
-” কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আমরা কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি। ”

সূচনা মাথা নাড়িয়ে কফির মগ হাতে নিলো। মাহেরও কয়েক চুমুক দিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ সূচনা বলল,
-” বিয়ের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত কী? ”

-” মা’য়ের ছেলের বউ প্রয়োজন, বোনের ভাবি প্রয়োজন, আর আমার একজন বন্ধরূপী ব্যক্তিগত মানুষ প্রয়োজন। এটাই সিদ্ধান্ত। ”

কিছুক্ষণ আবারও নীরবতা কাটল। কফির মগে আস্তেধীরে চুমুক দিতে থাকা সূচনার দিকে একমনে তাকিয়ে মাহের বলল,
-” আপনার মতামত? ”

এক পলক তাকিয়ে কফির মগ টেবিলে রেখে স্বাভাবিক হয়ে বসল সূচনা। ধীরেসুস্থে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” আপনার মতো মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া যে কোন মেয়েরই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমায় বউ হিসেবে গ্রহণ করলে নিজেকে সৌভাগ্যবতীই মনে করব। কিন্তু আমার বিষয়ে পুরোপুরি জানার পর আপনার সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারে। ”

নড়েচড়ে বসল মাহের। বলল,
-” ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বদলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ”

-” আমার দীর্ঘদিনের রিলেশন ছিল! ”

অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে মাহের বলল,
-” ছিল, নেই তো। ”

বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকাল সূচনা। ঢোক গিলে বলল,
-” না। ”

-” আমার আপত্তি নেই। আর কিছু? ”

-” আমি তাকে ভালোবাসতাম। ”

-” স্বাভাবিক। ”

-” বিয়েতে রাজি হলেও আমার সময় লাগবে। ”

-” কীসে? ”

-” আপনাকে স্বামীর স্থান দিতে। ”

-” বন্ধুর জায়গাটা দিলেই হবে। ”

চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ল সূচনা। বলল,
-” আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যাই নেই? ”

-” সমস্যা থাকবে কেন? আপনার চোখ তো টেরা নয়, নাকও বোচা নয়। আপনার আমাকে নিয়ে সমস্যা আছে কিনা বলুন৷ বুড়ো বর পেতে আপত্তি নেই তো?”

আশ্চর্য হয়ে সূচনা বলল,
-” কে বুড়ো আপনি! ”

-” গুণে গুণে ছ’বছরের বড়ো। আটাশ বছর বয়সী বুড়ো। ”

মৃদু মৃদু হাসতে লাগল মাহের। সূচনা আহত সুরে বলল,
-” আপনার বয়সে অনেকে চৌদ্দ, পনেরোর মেয়ে বিয়ে করে। আমার তো বাইশ চলছে। ”

-” তাহলে পারফেক্ট ম্যাচ কী বলেন? ”

সূচনা পুনরায় মাথা নিচু করল। বলল,
-” একটি প্রশ্ন করি? রাগ করবেন না তো? ”

-” ওহ ম্যাডাম প্রথম পরিচয়ে রাগ দেখালে আপনি তো পালিয়ে যাবেন। নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করুন। ”

-” কখনো পারবেন রশ্নির জায়গাটা আমাকে দিতে? ”

নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেল মাহের৷ সে জানতো নিলয় সূচনাকে সবটা জানিয়েছে। যা নিজ মুখে জানানোর সাধ্য তার নেই। তারপরও বুকের ভিতর ভীষণ রকম মুচড়ে ওঠল৷ সত্যিই কি পারবে রশ্নির জায়গা সূচনাকে দিতে। সূচনা তাকিয়ে আছে মাহেরের দিকে। সত্যি বলতে নিলয়ের ম্যাসেজ পাওয়ার পর থেকেই মাহেরের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী হয়েছে সূচনা। যে পুরুষ ধর্ষিত হওয়া নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে ঐ পুরুষের মানসিকতা নিয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহও রাখা উচিৎ নয়। সূচনাও রাখেনি। বিয়েতে দ্বিধাহীন হয়েছে মাহেরের সত্যিটা জানার পরই। সূচনা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘসময় পর মাহের বলল,

-” আমি কখনো আপনাকে রশ্নির জায়গা দিতে পারব না৷ কারণ রশ্নি আমার ভালোবাসার মানুষ। সূচনা, আপনি সত্যি ভাগ্যবতী কারণ রশ্নি যে জায়গাটা পায়নি সে জায়গাটা আপনি পাবেন। কারণ আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবেন। শুধু প্রেমিকা হওয়াটাকে তো প্রাপ্তি বলে না। ওর জায়গাটা না হয় আপনি নাই নিলেন। আপনার স্থান আমার এখানে থাকবে। ”

বুকের বা’পাশ দেখিয়ে বলল মাহের। ভাষাহীন হয়ে পড়ল সূচনা। অদ্ভুতভাবেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। বিরবির করে শুধু একটা কথাই বলল,
-” আপনি অনন্য মাহের। আপনি অনন্য। ”
_____
পরেরদিন ভোর ছ’টায় সূচনার ফোনে কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহের বলল,
-” শুভ সকাল ম্যাডাম। বিরক্ত হলেন? ”

ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল সূচনা। স্ক্রিনে ভালোভাবে নাম্বারটা দেখে জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-” না না বিরক্ত হইনি। বলুন আপনি বলুন। ”

-” পাশে পানি থাকলে পানি খেয়ে নিন। তারপর বলছি। ”

গলা শুঁকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। সত্যি ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। তাই দেরি না করে ফোন রেখে সত্যি সত্যি ওয়াটার বোতল থেকে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলো সূচনা। তারপর বিছানায় এসে ধীরেসুস্থে ফোন কানে ধরে বলল,
-” জি বলুন। ”

-” আমার বোন হৈমী। আপনাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। বায়না ধরেছে আজ কলেজ শেষ করে আপনার ওখানে যাবে। ”

মৃদু হেসে সূচনা বলল,
-” তাই আসুক না আজ আমি বাসায়ই থাকব ভার্সিটি নেই। ”

-” আচ্ছা আমি দিয়ে আসব। হবু ননদ সম্পর্কে জানেন তো? ”

-” জি অল্পস্বল্প। ”

মুচকি হেসে মাহের বলল,
-” পুরোটা জেনে যাবেন আজ। খুব বেশি বিরক্ত করলে আমায় ফোন করবেন। ”

-” একদম না৷ আমি মানিয়ে নেবো। ”

-” এই সেরেছে মানিয়ে নেওয়ার আপনি কী বুঝেন? বাচ্চা একটা মেয়ে ওসবে জড়াবেন না। বিয়ের সময় মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ জ্ঞান দেওয়া হয়। অথচ মানিয়ে নেওয়া উচিৎ আমাদের অর্থাৎ ছেলে সহ ছেলের পরিবারদের। আপনি একা মানুষ সবার সাথে কি করে মানিয়ে নেবেন? আমি বোনকে বুঝিয়ে পাঠাব যেন বিরক্ত না করে চিন্তা করবেন না। ”

গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহের, হৈমী। সূচনাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখছে হৈমী। হঠাৎ মৃদু চিৎকার করে বলল,
-” ভাইয়া তোমার শশুর তো হেব্বি বড়োলোক!”

মাহের চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” ভাষা ঠিক করো। ”

জিব কেটে হৈমী বলল,
-” সরি সরি তোমার শশুর তো ভীষণ বড়োলোক! কতবড়ো বাড়ি। ”

বলেই কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-” আচ্ছা ভাইয়া ভাবির কোন ভাইটাই নেই? ”

-” চুপপ হৈমী… সূচনা আসছে কন্ট্রোল করো নিজেকে। নয়তো কানে ধরে বাড়ি নিয়ে যাব। ”

হৈমী দমে গেল। বিরবির করে বলল,
-” বয়েই গেছে ভাবির ভাইদের সঙ্গে লাইন মারতে। মরেছি গুন্ডা দেখে বেয়াই টেয়াইয়ের ভাত আছে নাকি হুহ! ”

সূচনা এসে গেটের তালা খুলতেই হৈমী হৈহৈ করে ওঠল। দৌড়ে এসে সূচনাকে জড়িয়ে ধরল। সূচনা ভয় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হৈমী তাকে জাপ্টে ধরায় পড়ে যায়নি। হৈমী খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
-” উফফ ভাবি তুমি কী সুন্দরী গো! তোমার ননদিনীও কিন্তু কম সুন্দরী না… আগে আমাকে দেখোতো দেখে বলোতো পছন্দ হয়েছে কিনা? ”

মাহের দ্রুত এসে হৈমীকে ধমক দিলো। সূচনা বলল,
-” ইস ধমকাচ্ছেন কেন? আমার তো ভালোই লাগছে। ভেতরে আসুন। হৈমী ভেতরে গিয়ে কথা বলি আমরা।”

এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। মুহূর্তেই ডোর খুলে বেরিয়ে এলো রুদ্র! সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল হৈমী। সূচনার এক বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
-” সর্বনাশ! গুন্ডাটা আমার প্রপোজাল পাওয়ার পর থেকে নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছে। নয়তো তোমার বাড়ি চিনল কীভাবে? ভাবি, এটা আমার ক্রাশ তাই বোধহয় বাঁশ দিতে এসেছে প্লিজ বাঁচাও আমায়। ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪
হৈমীর কথার আদি অন্ত কিছুই বুঝতে পারল না সূচনা৷ বোকা চোখে চঞ্চলিত মেয়েটার দিকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল৷ রুদ্র তার স্বভাবসুলভ এগিয়ে এসে মাহেরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মাহেরও সৌজন্যপূর্ণ হেসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাতে হাত মেলাল। এ দৃশ্য দেখে যেন হালকা করে মরে গেল হৈমী। চোখ বড়ো বড়ো করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল সে। সূচনার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
– ” ভাবি ও ভাবি এটা কী হচ্ছে? ”

সূচনা মুচকি হেসে বলল,
-” আমার ভাইয়া রুদ্র। ”

হৈমী’কে কথাটা বলেই রুদ্র’কে বলল,
-” ভাইয়া ও হৈমী, উনার বোন। ”

সূচনার কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হলেও হৈমীর দিকে ফিরে তাকাল না রুদ্র৷ মাহের’কে বাড়িতে ঢোকার ইশারা করে সে গটগট পায়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। মাহের কিছুটা অবাক হলো। সূচনা বলল,
-” কিছু মনে করবেন না৷ ভাইয়া আসলে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না। আমার সঙ্গেও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা কম বলে। ”

মাহের স্মিত হেসে বলল,
-” ইট’স ওকে রুদ্র সম্পর্কে কিছুটা জানি। ”

হৈমী ‘না’ শব্দ উচ্চারণ করে মৃদু আর্তনাদ করল।চমকে তাকাল মাহের সূচনা উভয়ই। তাদের চমকানো চাহনি দেখে হৈমী মাথা ধরে বলল,
-” আমার মাথা ঘুরছে ভাইয়া। গলা শুকিয়ে গেছে আমি পানি খাব। ”

বিচলিত হয়ে মাহের বলল,
-” আই থিংক রুদ্রকে দেখে ঘাবড়ে গেছে। ”

তীব্র লজ্জায় গাল দু’টো লাল হয়ে গেল সূচনার৷ সত্যি তার ভাই’টা এমন বেশভূষায় থাকে, অপরিচিত’রা প্রথম দেখায় ভয় পাবারই কথা। অথচ লম্বায়, ফর্সায়, দেহের সুগঠনে একজন তামিল হিরোর চেয়ে কম নয় তার ভাই৷ লজ্জায় থমথমে মুখ করে দু’জন’কে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল সে। বাড়ির ভেতর গিয়ে মাহের বেশিক্ষণ দেরি করল না। বিকেলের দিকে হৈমী’কে এসে নিয়ে যাবে। এখন তার কিছু কাজ রয়েছে তাই চলে যাবে। সূচনার দাদিনের জোরাজোরিতে শুধু দুপুরের খাবার খেল। খাওয়া শেষে কয়েক মিনিট বসে বেরিয়ে পড়ল। তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো সূচনা। গেট থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে হঠাৎ সূচনার খুব কাছে এসে শীতল কণ্ঠে মাহের বলল,
-” আপনি খুবই যত্নশীল সূচনা৷ মাত্র এক ঘন্টাতেই আপনার যত্নশীল আচরণে অভিভূত হয়ে গেছি। নিজেরও যত্ন নেবেন, আসছি । ”

মাহের চলে গেল। বেসামাল করে গেল সূচনা নামক ভগ্নহৃদয়ের অধিকারিনীর হৃৎস্পন্দন’কে। কেউ একজন অযত্নে তার হৃদয় ভেঙেছে। কেউ একজন সে ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগাতে যত্নের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এটাই জগতের নিয়ম। কেউ গড়ে, কেউ ভাঙে।

হৈমী দাদিনের সঙ্গে দারুণ গল্প জমিয়েছে। দাদিনের তাকে বেশ লেগেছে। গুমোট পরিবেশে থাকতে থাকতে মনটা বেশ তিক্ত ছিল তার। আজ হৈমী’কে পেয়ে সমস্ত তিক্ততা চলে গেল। গল্পের ফাঁকে হঠাৎ রুদ্রর প্রসঙ্গ এলো। কথায় কথায় হৈমী জানতে পারল রুদ্র’দের ঢাকায় দু’টো বাড়ি একটা গার্মেন্টসের বিজনেস আছে। বাড়ি দু’টোর একটিতে ছোটো চাচার পরিবার, রাদিফের স্ত্রী সন্তান, থাকে। আরেকটি ভাড়া দেওয়া। দেশের বাইরেও একটি ফ্যাশন গার্মেন্টসের বিজনেস আছে। দেশের ব্যবসা সামলায় বড়ো চাচা দিলওয়ারের বড়ো ছেলে রাদিফ শেখ এবং ছোটো চাচা রিজওয়ান শেখ। বিদেশের ব্যবসা সামলায় রুদ্রর বাবা রিদওয়ান শেখ। রুদ্রর এসবে মন নেই৷ গতবছর মাস্টার্স কমপ্লিট করে ভবঘুরে জীবন কাটাচ্ছে সে। ব্যথিত সুরে দাদিন কথাগুলো বলতেই পিটপিট করে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” উনি বিজনেসে মন দিলে গুন্ডামি কে করবে দাদিন? ”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দাদিন। সূচনা এসে বলল,
-” কতদিন পর তোমার হাসি শুনছি দাদিন। ”

-” হাসব না? মেয়েটা কেমন তোতাপাখির মতো কথা বলে দেখ। তোরা তো সারাবছরই বোবাপাখি হয়ে থাকিস। ”

হৈমী বলল,
-” তোমরা কী ভালো! আম্মু আর ভাইয়া শুধু শুধু আমাকে শাসন করল। ভয় দেখাল। বলল, হৈমী একদম বেশি কথা বলবে না। হৈমী কুটুম বাড়ি যাচ্ছ রয়েসয়ে কথা বলবে। হৈমী আমি যেন না শুনি ও বাড়িতে তোমার বাচালতার জন্য মন্দ কথা হয়েছে। উফফ পাগল করে দিয়েছিল দু’জন মিলে। তুমিই বলো ভাবি, তুমিই বলো দাদিন। এই যা! ”

জিব কেটে পুনরায় বলল,
-” আম্মু ভাইয়া দু’জনই তোমাদের’কে আপনি সম্বোধন করতে বলেছে। কিন্তু আমি তো সবাইকে আপনি বলতে পারি না৷ শুধু যারা সম্পর্কে দুলাভাই হয় আর একদম অপরিচিত হয় তাদের আপনি করে বলি। আমার গুন্ডা বেয়াইকেও আপনি বলতে পারব। তোমাদের তুমি বললে মাইন্ড করবে? ভাববে ইস মেয়েটা কী বেয়াদব, ম্যানারলেস? ”

সূচনা এসে তার পাশে বসল৷ আলতো ভাবে গাল টিপে দিয়ে বলল,
-” একদম ওসব ভাববো না তুমি করেই বলো। শুধু ভাইয়াকে আপনি বলো সে খুব রাগি মানুষ তো। ”

দাদিনও সম্মতি দিলো। বলল,
-” তুমি বড়ো মিশুক মেয়ে৷ তোমার কথায় ভীমড়ি খাওয়া যায় রাগ করা যায় না। কিন্তু ঐ আমাদের কপালের দোষ অকারণেই রেগে যায় নাতিটা। ”

হৈমী ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বসল। ফিসফিস কণ্ঠে বলল,
-” আমার কাছে একটা ওষুধ আছে রাগ কমানোর। ”

সূচনা বলল,
-” কী? ”

-” বেয়াইমশায়কে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে এসো। বউ কিন্তু আমার মতো সুন্দরী, কিউটের ডিব্বা হতে হবে। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে কিউটনেসে ভরা বউয়ের মুখ দেখবে আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগে দেখবে। ব্যস রাগ কমে পানি হয়ে যাবে। ”

খিলখিল করে হাসতে লাগল হৈমী৷ তার কথা শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে সূচনাও হেসে ফেলল। দাদিন ভ্রু কুঁচকে ভাবুক কণ্ঠে বলল,
-” ওষুধটা মন্দ না। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা কথাত আমার মাথায়ই আসেনি! ”
__
হৈমীকে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাল সূচনা। ঘুরতে ঘুরতে হৈমী তার ছোটোবেলার গল্প করল। আম্মু ভাইয়ের সম্পর্কে অনেক অজানা কথাও জানাল। মাহেরের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানল সূচনা৷ যা কেবল তাকে ভালোলাগা উপহার দিলো। অনুভব করল তার মনের বিষাদ বিষাদ অনুভূতি অনেকটাই কমে এসেছে। কেমন অদ্ভুত, নতুন অনুভূতিতে হৃদয় সিক্ত হচ্ছে। হঠাৎ হৈমী তার হাত ধরল বলল,
-” ভাবি তোমার শাড়ি আছে? ”

সূচনা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। হৈমী আনন্দিত হয়ে বলল,
-” আমি শাড়ি পরব। তুমি তোমার ফোনে সুন্দর করে ছবি তুলে দেবে আমায়। আমার পার্সোনাল ফোন নেই আম্মুর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দিয়ে যাব। ছবিগুলো দিয়ে দিবে কেমন? ”

সূচনা মাথা দুলিয়ে হাসল মনে মনে বলল,
-” ভাই বোনে আকাশপাতাল পার্থক্য থাকলেও মনের দিকে দু’জনই অনন্য। মাহের যেমন ভীষণ ম্যাচিওর হৈমী তেমন ভীষণ ইমম্যাচিওর। ”

হৈমী’কে শাড়ি পরিয়ে সাজানোর পর মুগ্ধ হয়ে গেল সূচনা। চিবুক ছুঁয়ে অভিভূত কণ্ঠে বলল,
-” একদম পুতুলের মতো লাগছে। ”

হৈমী নিজের প্রশংসা শুনতে যেমন খুবই ভালোবাসে তেমনি নিজের প্রশংসা নিজে করতেও ভালোবাসে। তাই বলল,
-” আমি জানতাম তুমি ঠিক এটাই বলবে। আম্মু থাকলে সেও সেম কথা বলত। আচ্ছা বেয়াইমশায় আমাকে এভাবে দেখে নিশ্চয়ই রেগে থাকতে পারবে না। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো। ”

আঁতকে ওঠল সূচনা। বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
-” একদম না হৈমী ভাইয়া ভীষণ রাগি। আমার আরো ছোটো ছোটো ভাই আছে। কাজিন ব্রাদার ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো। তোমার যত মজা ওদের সঙ্গে করো কিন্তু ভাইয়া না। ”

ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল হৈমী। বিরবির করে বলল,
-” আমার তো গুন্ডাটাকেই চাইইই। ”

সূচনা মোবাইল এনে হৈমীর গুটিকয়েক ছবি তুলল। মাঝপথে মাহের কল করায় ছবি তোলায় বাঁধা পড়ল। হৈমী শাড়ি পরেছে শুনতেই রেগে গেল মাহের। তাকে শান্ত করল সূচনা। আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছে। দুপুরের কড়া রোদ সময়ের তালে তালে মিলিয়ে গেছে। হিমশীতল হাওয়া বইছে চারিদিকে এই বৃষ্টি নামল বলে। ফোনে ব্যস্ত সূচনাকে রেখে বেরিয়ে গেল হৈমী। বৃষ্টি নামবে তাকে ভিজতে হবে। নতুন বাড়ি, নতুন শাড়ি, নতুন ছাদ, রোমান্টিক ওয়েদার পুরো জমে যাবে। শাড়ি জড়ানো, বৃষ্টি মাখানো বিকেল উপভোগ করতে হবে। তার একটি স্বভাব হচ্ছে যখন যা ইচ্ছে হবে তাই করবে। মাঝরাতে ঘুরতে ইচ্ছে করলে ছাদে চলে যাবে৷ কিছুক্ষণ আপনমনে ঘোরাঘুরি করার পর মনে হবে ছাদের পাশের আম গাছটায় ভুতটুত জাতীয় কিছু একটা আছে! মনে হওয়া মাত্র দৌড়ে নিচে নামবে৷ সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে কখনো হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। কান্নাকাটি করে আম্মু, ভাইয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বকা খাবে বিরতিহীন। ভরদুপুরে সাইকেল নিয়ে শহরে বের হতে ইচ্ছে করবে। রোদে পুড়ে শহর ঘুরে লাল টকটকে হয়ে বাড়ি ফিরবে৷ সন্ধ্যা নামতেই জ্বর, ঠান্ডায় একাকার অবস্থা। রাতবিরেতে হুটহাট আইসক্রিম খেতে মন চাবে। বাড়িতে থাকলেও খাবে না৷ লুকিয়ে চুড়িয়ে বের হবে। দোকান খোলা থাকুক বা না থাকুক সে আইসক্রিম খাবেই। প্রয়োজনে দোকানির বাড়ি গিয়ে হামলা করবে। দোকানি মনে মনে তাকে গালমন্দ করবে। আইসক্রিম নিয়ে ফেরার পথে সে বলবে,
-” মামা আপনি যে মনে মনে আমাকে গালি দিয়েছেন এতে আমি একটুও মাইন্ড করিনি। ”

মামা হতভম্ব হয়ে তাকাবে সে খিলখিল করে হাসতে হাসতে সাইকেল টান দেবে। এরকম আরো অসংখ্য ইচ্ছে হুটহাট মনে জাগে সকল ইচ্ছে পূরণও করে সে। তার জীবনের একমাত্র শখ নিজের ইচ্ছেগুলো’কে পূর্ণতা দেওয়া। এমন স্বভাব লোকের কাছে বদ অভ্যাস হলেও তার কাছে উত্তম অভ্যাস বলে মনে হয়। তার ভাষ্যমতে প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। লোকের কথাকে নয়। লোকে না হয় দু’টো মন্দ কথা বলবে তাতে তো আর তার গায়ে ফোস্কা পড়বে না! এ মুহূর্তে তার ইচ্ছে হয়েছে বৃষ্টিতে ভিজতে। ভিজতে ভিজতে রোমান্টিক মুডে চলে যেতে। দুহাত মেলে সাবধানে পা ফেলে পুরো ছাদজুড়ে ঘুরে বেড়াতে। বাড়ির মতো নিশ্চয়ই ছাদটাও অনেক বড়ো?

ছাদে পা রাখতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্রাণবন্ত মনটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। ছুটে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুরতে শুরু করল। দু-হাত দুদিকে মেলে দেওয়াতে শাড়ির লম্বার আঁচলখানা মেঝেতে লুটোপুটি খেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কয়েক মুহূর্ত পরই ঝুমঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হলো৷ হৈমী এবার ঘুরতে ঘুরতে চিৎকার করে বলতে লাগল,
-” আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দিব মেপে… ”

বাকিটুকু বলার পূর্বেই আঁচলে পা আঁটকে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল। কোমড়ে লাগল খুব৷ এমন সময় চোখ গেল ডান পাশের কোণার দিকে। সটান হয়ে পিছনমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। ঠিক যেন সুঠাম দেহের রোবট একটা! কষ্টে ভারাক্রান্ত মনে হৈমী সেদিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে গাইতে লাগল,
-” আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দিব মেপে, ধানের ভিতর পোকা রুদ্র বেয়াই বোকা! ”

ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর চেহেরায় পেছনে তাকাল রুদ্র৷ ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে একাকার শরীর তার। চুল দাঁড়ি সবটাই পানির ছোঁয়ায় নুইয়ে রয়েছে। সিগারেটে পোড়া গোলাপি ঠোঁটজোড়া বৃষ্টির ছোঁয়ায় ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে হৈমী বলল,
-” বোকা না হলে কি আর অমন সুন্দর ঠোঁট দু’টো জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে রাখে কেউ? ”

কান দু’টো গরম হয়ে গেল রুদ্রর। বিশ্রী ভঙ্গিতে বাম দিকে থুথু ফেলে এমন ভাবে হৈমীর দিকে এগুলো যেন দু’পায়ে নয় চার পায়ে হেঁটে এলো সে। হৈমীর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে ওঠল। তাকে ওঠার সময়টুকু দিলো না রুদ্র। নিমিষেই তেড়ে এসে তার এক কাঁধ চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল।
-” অসভ্য, বেয়াদ বাজে মেয়ে। ”

শক্তপোক্ত হাতে চেপে ধরার ব্যথায় কোঁকিয়ে ওঠল হৈমী৷ সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র তাকে ছেড়ে পিছন ফিরে বড়ো বড়ো করে শ্বাস ছাড়ল। ঠান্ডা আবহাওয়াতে রিলাক্স হতে ছাদে এসেছিল। অসভ্য মেয়েটা এসে বিরক্ত করায় মাথা খুব গরম হয়ে গেছে। হৈমী শাড়ি জড়িয়ে ধরে ওঠে দাঁড়াল। রুদ্র ধীরপায়ে আবারও রেলিঙয়ের কাছে গেল৷ বারকয়েক ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো হৈমী। মনে তীব্র সাহস জুগিয়ে রুদ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল,
-” এই যে শুনুন। আপনি নিজেকে কী মনে করেন? আমি অসভ্য, বেয়াদব, বাজে মেয়ে! তাহলে আপনি কী? দেখুন নেহাতই আমি একটা ভদ্র মেয়ে তাই মাইন্ড করলাম না। অন্য কেউ হলে আপনাকে এখুনি ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে ভবলীলাসাঙ্গ করে দিত! ”

রুদ্রর ভবলীলাসাঙ্গ হওয়ার বদলে আকস্মাৎ হৈমীর ভবলীলাসাঙ্গ হয়ে গেল। আকস্মাৎ গালে ঠাশ করে একটা থাপ্পড় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না রুদ্র৷ একহাতে ছোঁ মেরে মেয়েটাকে টেনে ছাদের নিচে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। ভয়ে চোখমুখ অন্ধকার করে চিৎকার দিলো হৈমী৷ দু’হাতে রুদ্রর একটি হাত খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। ভয়ে পা ছোঁড়াছুড়ি করতে করতে বারবার বলল,
-” আম্মু, ভাইয়া এ্যা.. ”

এতে রুদ্রর কোন ভাবান্তর হলো না৷ সে আরামসে দাঁড়িয়ে রইল রেলিঙের এপাশে একহাত সন্তর্পণে পকেটে গুঁজে দিলো। আরেকহাত রেলিঙের ওপাশে হৈমীর জীবন রক্ষা করতে ব্যস্ত। বৃষ্টি না পড়লে একটা সিগারেট ধরালে পরিস্থিতিটা সুন্দর ভাবে উপভোগ করা যেত। তবুও মন্দ লাগছে না ভেবেই হৈমীর চেপে রাখা হাতটা একটু নাড়া দিলো। অমনি আবারও মজাদার একটি চিৎকার ভেসে এলো হৈমীর মুখ থেকে। রুদ্র অনুভব করল বহুবছর পর তার বুকে অদ্ভুত আনন্দানুভূতি হচ্ছে। হাসতে ইচ্ছে করছে ভীষণ রকম৷ খুব কষ্টে নিজের গাম্ভীর্যতার সহায়তায় হাসিটুকু আড়াল করে নিলো। এদিকে যে হাত, পা’য়ের ছোঁড়াছুড়ি তে হৈমীর আঁচল খুলে শাড়ির কুঁচি অর্ধেক খুলে গেল তার কী হবে? কোন দিকে মায়া করে কাঁদবে মেয়েটা? সে না হয় বেয়াইমশায়ের সঙ্গে একটুখানি মশকরাই করেছিল। তাই বলে তিনি তার জীবন, ইজ্জত দু’টো নিয়েই মশকরা করবে!

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here