#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২২
রুদ্রর বন্ধু আবিরের বিয়ে আজ। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই রুদ্রকে জানানো হয়েছে। ব্যস্ততায় সে গুরুত্ব দেয়নি। আজ সকাল সকাল সব বন্ধুরা তার বাড়ি হাজির। তাদের প্ল্যান বরযাত্রীতে বর ব্যাতীত সকল পুরুষই এক রঙের একই পোশাক পরবে। এ পরিকল্পনা থেকে বৃদ্ধরা মাফ পেতে পারে। কিন্তু যুবকদের একজনও পাবে না৷ সে রুদ্র যতই রসকষহীন কাঠখোট্টা মানুষ হোক না কেন। বন্ধুরা কেউ ছাড় দেবে না তাকে। বাধ্য হয়ে তাই কিছু কেনাকাটা করতে বের হলো রুদ্র। সঙ্গে থাকল ঝিনুক, পনির।
গতকাল হৈমীর বিয়ের কথা সূচনা শুনেছিল। মাহেরের আদেশ অনুযায়ী এ ব্যাপারে তেমন ভাবেওনি। সকাল সকাল এবার শাশুড়ি মায়ের আদেশ, ননদকে নিয়ে একটু কেনাকাটা করতে হবে। যে যা হুকুম করছে সূচনা বাধ্য মেয়ের মতো তাই পালন করছে। হৈমীকে সকালবেলাই জানানো হলো আগামীকাল তার বিয়ে! আকস্মাৎ এমন কথা শুনে শ্বাসরোধ হয়ে এলো তার। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” ও আম্মু আমার বিয়ে? আমিত জানি না। পাত্র কে? ”
হামিদা সহজ গলায়ই উত্তর দিল,
-” তোর চেনাই টিশার চাচাত ভাই আমান। ”
বিস্মিত গলায় হৈমী বলল,
-” আমান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে! আমিত অনেক ছোটো আম্মু। বিয়েটা এক বছর পর দাও প্লিজ, এখন দিলে বাল্যবিবাহ হয়ে যাবে। ”
হৈমীর কথা শুনে সূচনা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। এই মেয়ে কি বিয়েটা মজা হিসেবে নিচ্ছে? ওর লাইফে কি সিরিয়াস বলতে কিছুই নেই? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। হামিদা চোখ গরম করে বিয়ের ব্যাপারটি কতটা সিরিয়াস বোঝালেন মেয়েকে। সব বুঝে হৈমী শুধু চুপ মেরে গেল। সূচনা যখন রেডি হয়ে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বের হতে চাইল, ঠিক তখনি তার টনক নড়ল। ঢোক গিলে দুরুদুরু বুকে প্রশ্ন করল,
-” ও ভাবি সত্যি আমার বিয়ে কিন্তু কেন? ”
সূচনা অধরকোণে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
-” সত্যি তোমার বিয়ে হৈমী। কেন এই উত্তর আমিও জানি না। শুধু জানি এই বিয়েটা হলে তুমি ভালো থাকবে। ”
-” আমিত আমান ভাইকে পছন্দ করি না ভাবি… ”
বাকিটুকু বলতে পারল না হৈমী। তার মা এসে তাড়া দিল রেডি হতে। বাকি কথাটুকু ঢোক চিপে গিলে ফেলল সে, বিরস মুখে ওয়ারড্রব থেকে জামা বের করে ঢুকে গেল বাথরুমে। হামিদা যদি আর কয়েক সেকেণ্ড পর আসতো তাহলেই সূচনা শুনতে পেত হৈমীর গিলে ফেলা বাকি বাক্যটুকু,
-” আমিত তোমার ভাইকে পছন্দ করি! ”
প্রচণ্ড সিরিয়াস সময়টায় হৃদয়ে দোলা দেয়া কঠিন সত্যটুকু হৈমীর বলা হলো না, শোনা হলো না সূচনার। মনের অতি গোপনে যেই সত্যিটুকু যত্ন করে রেখেছে হৈমী সে সত্যটুকু শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বার বার স্মরণ করল। সেদিন রুদ্রকে প্রথমবার দেখা, চিঠি দিয়ে প্রপোজ করা সবটাই কি মজা ছিল? ওসব মজা হলেও এরপরের ঘটনাগুলো? রুদ্রকে দেখার জন্য মন আনচান করা, তার চোখের নাগালে থাকতে চাওয়া, তাকে নিয়ে শতশত কল্পনা, জল্পনা, অসংখ্য কৌতূহল, অন্য নারীর আশপাশে দেখলে গা জ্বালা অনুভূতি, এসব তো মিথ্যে নয়। আর এই যে হঠাৎ বিয়ে! বিয়ে তো কষ্টদায়ক কোনো ঘটনা নয়। তবুও তার কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? সে তো কারো কাছে কমিটেড নয়। কারো সাথে তার প্রেমঘটিত বিষয়াদিও নেই৷ তাহলে এ ব্যথার মানে কী? তার কি রুদ্রর সঙ্গে অদৃশ্য কোনো বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে?
আপনমনে প্রশ্ন উঠতেই চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিল হৈমী। স্মরণ করল রুদ্রর রাশভারি মুখটাকে। ঐ দৃঢ় দৃষ্টিজোড়াকে। শরীর, মন আহত হওয়া সেই স্পর্শগুলোকে! মুহুর্তেই হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠল, চোখ দু’টো হলো ঝাপসা। বুক ভারীও হলো। বিরবির করে বলল,
-” সবার পছন্দ যে ভালো হয় তার তো মানে নেই। সবারই যে ভালো জীবনসঙ্গী পেতে হবে এমন কোনো নিয়মও নেই। রুদ্র বেয়াই না হয় গুন্ডা টাইপ, কর্কশ মানুষ তাই বলে সে কি পুরুষ মানুষ না? তারও অধিকার আছে আমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার। ”
কিছুক্ষণ চুপ করে আবারো নিজেই নিজেকে বোঝাতে লাগল। যেন তার ভিতরের সত্তা তাকে বোঝাচ্ছে।
-” আমি যদি একটু বেশি দয়ালু হয়ে উনাকে ভালোবাসি ক্ষতি কী হবে শুনি? তবুও তো মানুষকে দেখাতে পারব আমার জামাই দ্যা গ্রেট ডন রুদ্র। সবচেয়ে বড়ো কথা আনকমন একটা জামাই হবে। দেখতেও মন্দ না ইয়া লম্বা, ফর্সা বোধহয় আমার চেয়ে কমই হবে। এটা সমস্যা না ছেলেরা একটু কম ফর্সাই ভালো লাগে। তবে হেব্বি স্মার্ট উনি, ইউনিক হেয়ার স্টাইল, দাঁড়ি স্টাইল, এক পলক তাকালেই তো চোখ ঝলসে যায়। কত পুরুষ দেখি বুকের পাটা নাই, এর দিকে তাকালেই তো ব্ল্যাক বোর্ডের মতো মসৃণ, সমান বুকের পাটা দেখতে পাই। দেখেই বোঝা যায় কী শক্ত, মজবুত। অমন তরতাজা যুবক চোখ লাগিয়ে দেওয়া সুন্দর পুরুষটা না হয় একটু গুন্ডামিই করে। করুক না, পৃথিবীতে একটা দু’টো গুন্ডাকে আমার মতো সুন্দরীরা ভালোবাসতেই পারে। এতবড়ো পৃথিবীতে গিজগিজে মানুষের ভীড়ে একটা দু’টো আনকমন কাপল থাকতেই পারে৷ এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া শুনেছি বউ পেলে অনেক জামাই ভালো হয়ে যায়। ”
কত কথা সহজ ভাবে আপন মনে বিরবিরিয়ে যাচ্ছে হৈমী। অথচ মেয়েটা জানেই না সামনে তার ঠিক কতটা কঠিন সময় আসবে। রুদ্রর প্রতি তার আবেগটা সত্যি। আজ হয়তো তার হৃদয় কিশোরী বয়সের আবেগে জর্জরিত। কিন্তু এই আবেগ কতটা অনেস্ট তা পৃথিবীর কেউ বুঝবে না কেউ না। কেবল যারা এই আবেগে জর্জরীভূত তারাই টের পাবে।
অদৃশ্য ঘোর থেকে সহসা আঁতকে ওঠল হৈমী ভাবল,
-” আমার যে আমান ভাইয়ের সাথে বিয়ে। এই ভাবনা গুলো আগে কেন এলো না? আরেহ আগে আসবে কী করে আগে তো আমার বিয়ে ঠিক হয়নি। কিন্তু এবার কী হবে? আমার তো বিয়ে! রুদ্র বেয়াইকে কি জামাই হিসেবে পাবো না? আমার তো উনাকেই ভালো লাগে একটু ভয় পাই তবুও তো উনাকেই পছন্দ হয়। ”
হৈমীর বের হতে দেরি হচ্ছিল তাই সূচনা বাথরুমের দরজায় টোকা দিল। বলল,
-” হৈমী তাড়াতাড়ি বের হও। এত দেরি হচ্ছে কেন? মা কিন্তু বকছে। ”
________________
কেনাকাটা করে গাড়িতে বসে ঝিনুক পনিরের অপেক্ষা করছিল রুদ্র। এই দু’জন গেছে সিগারেট আর পান কিনতে। পনির সিগারেট তেমন খায়না। সে খুব পানভক্ত। পান খেয়ে দাঁত, ঠোঁট লাল করে চেহেরায় আলাদা মাধুর্য আনে সে। আর ঝিনুক রুদ্রর মতোই দুঃসহ সিগারেটখোর। ওদের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকেই চোখ দু’টো আশপাশে ঘোরাচ্ছিল রুদ্র। এমন সময় সহসা চোখজোড়া স্থির হয় ডান পাশের রিকশাতে। যে রিকশায় বসে আছে দুটো পরিচিত মুখ। আর এই দু’টো পরিচিত মুখই রুদ্রর অতি প্রিয়। হ্যাঁ সূচনার মতোই হৈমীও তার অতি প্রিয়। কারো প্রিয়জন হয়ে ওঠতে খুব বেশি সময় যেমন লাগে না তেমনি খুব বেশি কারণও লাগে না। হৈমীর ক্ষেত্রে রুদ্রর এই অনুভূতিটা তেমনি হয়ে গেছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে হৈমীকে নিয়ে সূচনা শপিংমলে ঢুকে পড়ল। রুদ্র এ দৃশ্য দেখতে দেখতেই পকেট থেকে সেলফোন বের করে কল করল সূচনাকে। কল রিসিভ হতেই প্রশ্ন করল,
-” তোকে শপিংমলে দেখলাম, কিছু কিনবি? ”
থতমত খেয়ে ঢোক গিলে সূচনা বলল,
-” হ্যাঁ ওই তো হৈমীর কিছু কেনাকাটা আছে। মা বলল ওর সঙ্গে আসতে…”
রাশভারি স্বরে রুদ্র বলল,
-” আমাকে ফোন করতি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। এভাবে একা দু’জন মেয়ে আসা ঠিক হয়নি। মাহের ব্যস্ত থাকলে আমায় ফোন করা উচিৎ তোর। ”
-” আসলে ভাইয়া.. হৈমীর জন্য। ”
-” কার জন্য এসেছিস সেটা ফ্যাক্ট না। তুই আরেকজনের দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়েছিস সেটাই ফ্যাক্ট। আমি মনে করি দায়িত্ব নেয়ার বয়সটা তোর এখনো হয়নি। মাহেরের উচিৎ ছিল তোদের সঙ্গে আসা। হোয়াটএভার, যেখানে আছিস দাঁড়া আমি আসছি। ”
রুদ্র তাদের কাছে আসবে শুনেই সূচনার বুক ধড়ফড় শুরু হলো। কেমন ভয় ভয় করছে। যেন বিপদের গন্ধ চারপাশে ছেয়ে গেছে। বারকয়েক ঢোক গিলে হৈমীর হাত শক্ত করে ধরল সে। চাপা স্বরে সতর্ক করল,
-” হৈমী কাল তোমার বিয়ে এটা যেন ভুলেও ভাইয়ার সামনে উচ্চারণ করো না। বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত সবার কাছেই গোপন থাকবে। ”
হৈমীর হৃদয়টা ঠুস করে ভেঙে গেল। হায় হায় করে আর্তনাদ ওঠল সেখানে। শেষ পর্যন্ত চুরি করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে। ইস কী বিচ্ছিরি বিয়ে! এক মিনিটও অতিবাহিত হলো না। রুদ্র এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। হৈমীকে দেখেও না দেখার ভাণ করে বলল,
-” দেড় ঘন্টার মধ্যে কেনাকাটা শেষ কর। আমি তোদের পৌঁছে দিয়ে আসব। ”
রুদ্রকে দেখে হৈমীর মনটা একটু বেশিই বিষাদীয় ঠেকল। আজ যদি তার সঙ্গে রুদ্রর ভালো সম্পর্ক থাকত, প্রেমঘটিত ব্যাপার থাকত হঠাৎ করে এই বিয়ে ঠিক নিয়ে দুজন দুজনের গলা জড়াজড়ি করে একটু শোক পালন করা যেত। ইস, কেন যে অমন টাইপ সম্পর্ক হলো না ধূরর!
শাশুড়ি বলে দিয়েছেন লাল রঙের বেনারসি কিনতে। হৈমী কিনবে সাদা রঙের আঁচল টা অবশ্য লাল। রুদ্র ওদের থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। শাড়ি তাও আবার বেনারসি দেখেই এগিয়ে এলো। কেনাকাটা হৈমীর জন্য শুনল অথচ কিনতে দেখছে শাড়ি! এসব শাড়ি তো বিয়েতেই পরে মেয়েরা। এই মেয়ে এসব শাড়ি চুজ করছে কেন? ভ্রু কুঁচকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল রুদ্র। কিন্তু কিছুই বলল না। সূচনা ভয় ভয় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে হৈমীকে বলল,
-” তুমি কিন্তু বলবে না তোমার বিয়ে। ”
হৈমী মাথা নাড়াল। এমন সময় কল এলো মাহেরের। সূচনা রিসিভ করে হৈমীর পাশ থেকে সরে গেল। কারণ মাহের কোনো প্রশ্ন করলে রুদ্রর সামনে উত্তর দিতে গিয়ে সমস্যা হবে। যদি বুঝে যায় আগামীকাল হৈমীর বিয়ে? বুঝতে পেরে যদি কোন পাগলামি করে? যদিও রুদ্রর অনুভূতি সম্পর্কে তেমন জানেনা সূচনা। যা জেনেছিল সব অতীত। তবুও সতর্ক থাকতেই হবে। হৈমী মাথা নিচু করে শাড়িটা দেখছিল এমন সময় শাড়ি বিক্রেতা একটি দোপাট্টা এগিয়ে বলল,
-” আপু দোপাট্টা নেবেন না? এই শাড়ির সঙ্গে কিন্তু এটা বেশ মানায় দেখুন। ”
এহেন কথা শুনে ধীরপায়ে রুদ্র এসে বসল হৈমীর পাশে। কপাল কুঁচকে রাশভারি আওয়াজে বলল,
-” ইডিয়টের মতো এগুলো কিনছ কেন? মাথায় কি বউ সাজার ভুত চাপল ? ”
আকস্মিক তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল হৈমী। হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে বলল,
-” ইডিয়ট কে ইডিয়ট আমি? হ্যাঁ আমিত ইডিয়টই এজন্যই তো কাল বিয়ে আর জানতে পারলাম আজ। ইডিয়ট বলেই তো আমার সঙ্গে এসব হচ্ছে। আমার মা আমার ভাই শেষ পর্যন্ত বালিকা হৈমীকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছে!”
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। চোখ কটমট করে তাকিয়ে রইল রুদ্রর হতভম্ব মুখশ্রীতে। কয়েক পল চলল পিনপতন নীরবতা। রুদ্র স্থির বসে স্থির চোখে তাকিয়ে ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” কার বিয়ে? ”
চমকে ওঠল হৈমী। মুহুর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার। আমতাআমতা করে পূর্বের স্থানে বসল। মুখটা কাচুমাচু করে রুদ্রর দিকে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” ভাবিকে প্লিজ বলবেন না। ”
-” কী বলব না? ”
-” কাল আমার বিয়ে এই কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। আগামীকাল গোপনে বিয়ে দেওয়া হবে আমাকে। আমান ভাইয়ের সঙ্গে, টিশাকে তো চেনেন ওর চাচাত ভাই। আমান ভাই দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু আমার জানি কেন পছন্দ হয় না। মানে জামাই হিসেবে আর কী…. ”
কথার ছলে রুদ্রর চোখের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠল হৈমী৷ সরে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে বলল,
-” ওমা ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনি কি রেগে যাচ্ছেন? রাগ করছেন কেন? গোপনে আমার বিয়ে তাই? রাগ করবেন না থাক, আপনাদের পরে জানানো হবে, দাওয়াতও দেবে। ”
কাঁচের দেয়ালের ওপাশে সূচনাকে আসতে দেখে হৈমী নিচু কণ্ঠে চটপটে বলল,
-” ভাবি আসছে আপনি কিন্তু কিছু না জানার ভাণ করে থাকবেন। ”
সূচনা আসার পরও রুদ্র একই ভাবে একই চোখে হৈমীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার নিশ্বাস চলছে কিনা এটুকুও বোঝা যাচ্ছে না। হৈমী শাড়ি আর দোপাট্টা দেখায় মন দিল। সূচনা এসে রুদ্রর পাশে বসল। শাড়ির দামদর ঠিক করার প্রস্তুতি নিল। হৈমী শাড়ি দেখার ফাঁকে রুদ্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার শাড়ির দিকে তাকাল। বিরবির করে বলল,
-” ইস যদি আমার বয়ফ্রেন্ড হতেন নিশ্চয়ই আমার হাতদুটো ধরে বলতেন, হৈমী এই বিয়ে তুমি করো না। অন্যের বাসরে তুমি যেও না। আমি কিন্তু বাঁচব না। ধূর ছাই ফাটা বাঁশের কপাল আমার! ”
শাড়ি, দোপাট্টা কেনা শেষে সূচনা হৈমী ওঠল। রুদ্র একই ভাবে বসে। সূচনা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে রুদ্রকে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে রোবটের ন্যায় ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। সূচনার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভরাট সুরে বলল,
-” সময় দিলি না আমাকে? আমিও তোদের সময় দেব না। আমি আবারো বুঝে গেলাম এই সমাজ, সংসার অনেস্ট এন্ড উইকদের জন্য নয়। ”
কথাগুলো বলে আচমকাই বাঁকা হাসল রুদ্র। পাশফিরে তাকাল হৈমীর দিকে। ছোট্ট গোলগাল মুখটায় প্রগাঢ় দৃষ্টি ছুঁড়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
-” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা মিস. হৈমন্তিকা। ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৩
শপিং করে বাড়ি ফেরার পর রুমে দরজা আঁটকে বসে আছে হৈমী। তার ভিতর রুদ্র যে তোলপাড় সৃষ্টি করে গেল সেটার নাম কী জানা নেই। শুধু জানে নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনটা কেমন কেমন করে ওঠছে। বার বার মনে পড়ছে রুদ্রর বলা শেষ বাক্যটুকু,
-” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা মিস. হৈমন্তিকা! ”
দু-চোখে ভেসে ওঠছে রুদ্রর চোখের শেষ ভাষাটুকু। মানুষটা যতই বদমেজাজি হোক, যতই কঠিন হোক, রসকষহীন হোক, দায়িত্ব পালনে একটুও কুণ্ঠা বোধ করে না। তাই তো বোন এবং বেয়ানকে দায়িত্ব সহকারে পৌঁছে দিয়ে গেল। গাড়ি থেকে নামার পর সে যখন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ঐ রাশভারি মানুষটার পানে, গম্ভীর মুখের গভীর দৃষ্টিজোড়াও তো তাকিয়ে ছিল তারই পানে৷ ঐ চোখের ভাষা বুঝি অনেক বেশিই কঠিন ছিল? কঠিন বলেই তো সে বুঝতে পারল না, পড়তে পারল না। মানুষটা এত কঠিন কেন? একটু সহজ হলে কী খুব ক্ষতি হতো? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হৈমী। তার মন, মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একজনকে নিয়েই ভাবনারা উতলে ওঠল। ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে কখন যে চোখ লেগে গেল টেরও পেল না। পুরো দু’ঘন্টা ঘুমিয়ে চারটার দিকে ওঠল সে। শুনতে পেল দরজায় ঠকঠক শব্দ। হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে রুমে ঢুকল নয়ন। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-” কী রে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিস? প্রিপারেশন তো ভালোই নেওয়া হচ্ছে। ”
কাঁধে ঠোকা দিয়ে টিপ্পনী কেটে কথাটা বলল নয়ন। হৈমী মেজাজ খারাপ করে দরজা আঁটকে দিল। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল বিছানায়। নয়নও ওর পাশে গিয়ে বসল। আবারো উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
-” এত জলদি বিয়ে করে নিবি ভাবতেও পারছি না। শোন..”
নয়নকে বাকি কথা বলতে না দিয়ে হঠাৎ হৈমী ডুকরে ওঠল। নয়ন হতভম্ব হয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রিয় বান্ধবীটিকে। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” তুই কাঁদছিস! ”
হৈমী দীর্ঘক্ষণ কাঁদল। নয়ন ওকে সামলানোর চেষ্টা করে আবারো প্রশ্ন করল,
-” এই হৈমী কী হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন? ”
-” আমি আমান ভাইকে বিয়ে করতে চাই না নয়ন। ”
ক্রন্দনরত গলায় বলল হৈমী। নয়ন বলল,
-” হ্যাঁ জানি তো। ”
অবাক হলো হৈমী। বলল,
-” জানিস? ”
নয়ন মাথা দুলিয়ে বলল,
-” হ্যাঁ জানি। কিন্তু কেন করবি না সেটা বল? ”
হৈমীর মুখটা একটু উদাস হলো। নয়ন সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ঐ তাকানোতে চোখ পড়তেই মাথা নত করে সে বলল,
-” আমি মনে হয় রুদ্র বেয়াইকে সত্যি সত্যি পছন্দ করি রে। কিন্তু আম্মু, ভাইয়া হঠাৎ আমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। ”
নয়ন তৃপ্তি ভরে হাসল। হৈমী ওর হাসি দেখে গাল ভারী করে বলল,
-” আমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে নয়ন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুই তো জানিস সিরিয়াস বিষয়ে আমার একটু বুদ্ধি কম। প্লিজ দোস্ত একটু বুদ্ধি দে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। ”
-” কান্না কেন পাচ্ছে? ”
-” আমি রুদ্র বেয়াইকে পছন্দ করি। ”
-” এজন্য কান্না কেন পাবে? এটাত সুখবর। ”
-” তুই আমাকে গুলিয়ে দিচ্ছিস নয়ন৷ আমি বলছি আমি উনাকে পছন্দ করি কিন্তু কাল আমার আমান ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে। এটাই কান্নার কারণ। ”
-” আরে ইয়ার পছন্দই তো করিস ব্যাপার না। কাল যখন আমান ভাইকে বিয়ে করে তার সঙ্গে বাসর করবি ওসব পছন্দ, টছন্দ হাওয়া হয়ে যাবে। ”
-” ছিঃ আমি আমান ভাইয়ের বাসরে যাব না। ”
-” ও মা গো কার বাসরে যাবে রুদ্র বেয়াইয়ের? ”
থমথমে কণ্ঠে হৈমী জবাব দিল,
-” তুই তো জানিস উনি আমায় জোর করে কয়েকবার চুমু খেয়েছে। একজনের চুমু খেয়ে আরেকজনের বউ হবো, বাসর করব এটাত ঠিক না। এক দেহে দুই পুরুষের স্পর্শ নিতে আমি পারব না। ”
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল হৈমী৷ নয়ন মুচকি হেসে হৈমীকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” আহারে সোনা গো আমার, বড়োই কষ্ট তোমার। তোমার এই কষ্ট কী করে যে কমাই, ”
হৈমী ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই নয়ন সহসা আঁতকে ওঠল। বলল,
-” এই এই কান্না থামা। আন্টি বলল, তুই নাকি ব্লাউজ কিনিসনি। চল চল মার্কেটে যাই, ব্লাউজ কিনে ফিটিং করে তারপর ফিরব। ”
-” আমি যাব না। ”
-” যাবি না মানে যেতেই হবে। ”
জোরপূর্বক হৈমীকে নিয়ে বের হলো নয়ন। কিন্তু মার্কেটের পথে না গিয়ে রিকশা চলল অন্য পথে। হৈমী অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকায় বিষয়টা খেয়াল করল না। শীত মৌসুমে আকস্মাৎ মেঘেরা গর্জন তুলল। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। তখনি চমকে ওঠল হৈমী। চারপাশে তাকিয়ে নয়নের দিকে ভীত চোখে তাকাল। বলল,
-” এই আমরা কোথায় যাচ্ছি এটা তো কলেজের পথ। ”
নয়ন সাবলীল ভাবে বলল,
-” কিন্তু আমরা কলেজ যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি রুদ্র বেয়াইদের ক্লাবে। ”
-” ক্লাব! রুদ্র বেয়াই! কী বলছিস! ”
বাকিপথ অসংখ্য প্রশ্নে নয়নের কান ধরিয়ে ফেলল হৈমী। রিকশা থামল রুদ্রদের ক্লাবের সামনে। হৈমী দেখল পরিচিত দু’টো মুখ। একটি সাদমানের আরেকটি ঝিনুকের। বুকের ভিতরটা তার ধড়াস করে ওঠল। চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে তাকাল সে। নয়ন বলল,
-” আরে নাম ভিজে যাচ্ছি তো! ”
হুঁশ ফিরল হৈমীর। তড়াক করে নেমে ক্লাবের সামনের জায়গাটায় দাঁড়াল। নয়ন ভাড়া না দিয়েই হৈমীর পাশে এসে দাঁড়াল। হৈমী তাকে ভাড়ার কথা বলতে উদ্যত হতেই খেয়াল করল ঝিনুক ভাড়া দিচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে দাঁতে দাঁত চেপে সে নয়নকে বলল,
-“আমাদের ভাড়া উনি দিচ্ছে কেন? ”
-” আরে দিক না সমস্যা কথায়? আমাদেরই টাকা বেঁচে গেল। ”
নয়নের কথা শেষ হতেই সাদমান এসে নয়নের পাশে দাঁড়াল। মৃদু হেসে নয়নকে বলল,
-” থ্যাংকস। ভেতরে এসো তোমরা। ”
বিনিময়ে নয়ন একটু ভেঙচি দিয়ে বলল,
-” থ্যাংকসের প্রয়োজন নেই। ”
বলতে বলতে হৈমীর হাতটা শক্ত করে ধরে ক্লাবের ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। ভেতরে প্রবেশ করে আরেক ধাপ চমকাল হৈমী। সাথে হাত, পা কাঁপতে শুরু করল তার। অনেক বড়োসড়ো খোলামেলা একটি রুম৷ একপাশে একটি টেবিল আর গুণে গুণে বারোটা চেয়ার। সেই চেয়ারগুলোর একটিতে সাদা পাঞ্জাবি, টুকি পরা মৌলবি ধরনের একজন বসে আছেন। টেবিলে রাখা কিছু কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করছেন তিনি। তার পাশে সুঠাম, বলিষ্ঠ দেহের রুদ্র বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। দৃষ্টিজোড়া মৌলবির কাগজপত্রের দিকে নিবদ্ধ। সম্পূর্ণ মনোযোগ সেখানেই। হৈমীদের আগমনে বিন্দু মাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাল না সে। যেন সে আর মৌলবি ব্যাতীত কেউ নেই রুমে। অথচ জ্যান্ত চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বারকয়েক ঢোক গিলল হৈমী। নয়নের হাত শক্ত করে চেপে ধরে কাঁপা গলায় শুধাল,
-” নয়ন তুই আমাকে এখানে নিয়ে এলি কেন? আমার ভয় করছে রে আয় চলে যাই। এই দেখ বুক কাঁপছে, কান্না পাচ্ছে। ”
-” ভয় পাস না যা হচ্ছে, যা হবে ভালোর জন্যই হবে। রুদ্র বেয়াই তোকে খুব ভালোবাসেরে। ”
বুকের ভিতর তিনবার ধড়াস ধড়াস ধড়াস করে ওঠল হৈমীর৷ নয়ন মাথা নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-” হ্যাঁ রে আজ সকালে সাদমান ভাই আমাকে সবটা জানিয়েছে। উনি তোকে পাওয়ার জন্যই নিজেকে পরিবর্তন করছে। মাহের ভাইয়ার সামনে তোর যোগ্য পাত্র হয়ে দাঁড়ানোর জন্য নিজেদের রেডি বিজনেসে যোগ না দিয়ে নিজেই নতুন করে নতুন বিজনেস শুরু করছে। বখাটে জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে শুরু করেছে। প্রত্যাশা একটাই তোর পরিবার যেন ভরসার সঙ্গে তার হাতে তোকে তুলে দেয়। হৈমী, কোনো মানুষ ভালো হতে চাইলে তাকে সুযোগ দিতে হয়। রুদ্র বেয়াইয়ের অতীতটা খুবই নির্মম। যার রেশ ধরেই আজকে সে এমন। তবুও তোকে পাওয়ার লোভে অনেকটা রিকভার করেছে। উনার সমস্যা উনি সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। বুঝিয়ে তোকে বলতে পারছেনা, কাউকেই বলতে পারছে না৷ হঠাৎ করে তোর বিয়ে শুনে উনি অদ্ভুত আচরণ করছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তোকে তুলে আনবে। রাদিফ ভাই আর সাদমান ভাই সূচনা ভাবির কথা ভেবে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা চায় কিছু হলে মিউচাল ভাবে হোক। আমি প্রথমে রাজি হইনি। কারণ তোর অনুভূতি সম্পর্কে জানতাম না৷ অবশ্য রুদ্র বেয়াই অনেক কনফিডেন্টলি বলেছে তুই আমান নয় তাকেই চাস। আমি জাস্ট সিয়র হতেই তোর বাড়ি গেছি যখম সিয়র হলাম তখনি তাদের সাহায্য করতে মন থেকে রাজি হয়েছি। আর তোকে নিয়ে এখানে এসেছি। এই হৈমী রুদ্র বেয়াই সবার থেকে আলাদা। তা তুই জানিস। তার মতোই তার ভালোবাসার ধরণটাও আলাদা এটা তো জানিস না। উনি তোকে খুব ভালোবাসেরে নয়তো এত অল্প সময়ে তোর প্রতি আসা অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে লাইফের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো সহজ করে নিত না। আর তুই! শা’লি তুইও উনাকে ভালোবাসিস। শোন ভালোবাসা হতে বেশি সময় লাগে না, ভালোবাসা বোঝাতেও বেশি কিছু লাগে না। সব বুঝে শুনেই আমি তোকে এভাবে নিয়ে এলাম। তুই যদি আমান ভাইকে বিয়ে করতে রাজি থাকতি, ওভাবে কান্নাকাটি না করতি আর মুখে না বলতি রুদ্র বেয়াইকে পছন্দ করার কথা, তাহলে আমি উনাদের হেল্প করতাম না৷ বিশ্বাস কর। রিকোয়েস্ট বোন যা হচ্ছে ভালোয় ভালোয় হতে দে। বিয়ে কিন্তু সারাজীবনের ব্যাপার। এটা ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় না। ”
নয়নের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল হৈমী। বুঝলও তবু ক্রমেই তার ভয় বাড়তে লাগল, বুক কাঁপতে লাগল। এদিকে সমস্ত কিছু রেডি করে কাজি বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করতে চাইল। নয়ন হৈমীকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল রুদ্রর পাশে। ভয়ে গা শিউরে ওঠল হৈমীর৷ কাঁপাকাঁপির মাত্রা বেড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে একদমে বলল,
-” আমি বিয়ে করব না, আম্মু, ভাইয়া খুব কষ্ট পাবে।”
পাশ থেকে ঝিনুক করুণ কণ্ঠে বলল,
-” বিয়েটা না করলে রুদ্র ভাই খুব কষ্ট পাবে ভাবি। ”
নয়ন বলল,
-” মনে রাখিস হৈমী এই বিয়েটা না করলে কাল তোকে আমানের নামে কবুল পড়তে হবে, আমানের বাসরে যেতে হবে। ”
দাঁড়ি ভর্তি চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল রুদ্রর। দৃষ্টিজোড়া টেবিলে রাখা কাগজপত্রের দিকে স্থির রেখে সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” তোরা সবাই বাইরে যা। ”
কাজিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” চাচা আপনি আমাকে দশমিনিট সময় দিন। ”
রুদ্রর আদেশানুসারে সবাই বেরিয়ে গেল। একাকী এক ঘরে রুদ্রর সঙ্গে থাকতে হৈমীর আত্মা সায় দিল না। এই মানুষটাকে ভীষণ ভয় লাগে তার। যে সে ভয় না বুক ধড়ফড় করা, গলা শুকিয়ে যাওয়া ভয়। গলায় জড়ানো ওড়নাটা ভালভাবে গায়ে চেপে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। তার ভাবগতি বুঝে চোখ গরম করে কঠিন এক ধমক দিল রুদ্র! ধমক খেয়ে আপনাআপনিই দাঁড়ানো মানুষটা বসে পড়ল। পরিবেশ হয়ে ওঠল থমথমে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। অসময়ে এই বৃষ্টি, হিম শীতল বাতাসে শরীরের লেমকূপ দাঁড়িয়ে পড়েছে। হৈমীর শুভ্র মুখটাও লালচে আভায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। সে মুখের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল রুদ্র। একবার রুদ্রর গাঢ় চাহনি দেখে মাথা নত করে ফেলল হৈমী। রুদ্র বেশি সময় নষ্ট করল না। পকেট থেকে ফোন বের করে একজন সুন্দরী মেয়ের ছবি বের করল। তারপর হৈমীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” মেয়েটার নাম রিমঝিম, বেশ সুন্দরী। তোমার মতোই ফর্সা, উচ্চতায় পাঁচ ফুট পাঁচ, বডি ফিটনেস দেখো এর ধারেকাছেও তুমি নেই। আমার সঙ্গে একদম পারফেক্ট ম্যাচ করবে। গতমাসে প্রপোজ পেয়েছি একসেপ্ট করিনি। এবার বোধহয় একসেপ্ট করা উচিৎ। তোমাকে এমনিতেই আমার সাথে মানায় না তারওপর বিয়েতে রাজিও হচ্ছো না। বিয়ে তো জোর করে করার মতো জিনিস না। তাহলে এক কাজ করি এই মেয়েটাকে ফোন করে এখানে নিয়ে আসি বিয়ে যখন করতেই হবে একেই করি। তারপর আমরা দু’জন মিলে কাল তোমার বিয়ের দাওয়াত খাবো। ”
অপমানে কাঁদো কাঁদো মুখে তাকাল হৈমী। হিংসায় জ্বলে গেল বুকের ভিতরটা। মেয়েটা সত্যিই সুন্দরী। তাই বলে তাকে এভাবে অপমান করতে হবে? কষ্টে বুক ভারী হলো, দুঃখে মরে যেতে মন চাইল। তার অবস্থা টের পেয়ে রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” কাঁদবি না, হয় বিয়েতে রাজি হবি নয়তো চোখের সামনে আমার বিয়ে দেখবি! ”
হৈমীর চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রুপাত ঘটল। তা দেখে ক্ষেপে গেল সে তাড়াক করে ওর গাল দু’টো শক্ত হাতে চেপে ধরল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” আমানকে বিয়ে করবি? ”
ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলল হৈমী। মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। সে আমানকে বিয়ে করবে না। রুদ্র কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল। লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” তাহলে এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা। ”
গালে চেপে ধরায় হৈমীর ঠোঁটজোড়া গোল হয়েছিল। সেভাবেই সে বলল,
-” আপনার সঙ্গে তো আমাকে মানায় না। ”
গালজোড়া ছেড়ে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে চেয়ার সহ হৈমীর দিকে এগিয়ে বসল সে। মাথা নিচু করে গাঢ় চোখে তাকাল হৈমীর লাল টকটকে মুখশ্রীতে। বলল,
-” সেটা আমি বুঝে নিব। ”
-” আম্মু, ভাইয়াকে কী জবাব দিব? ”
-” জবাব আমি দিব। ”
-” ওরা কষ্ট পাবে। ”
-” অল্প সময়ের জন্য। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
-” আপনি আমাকে ভালোবাসেন? ”
এ প্রশ্নে থমকে গেল রুদ্র। উত্তর হ্যাঁ হলেও বলতে নারাজ সে। তাই চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। গম্ভীর স্বরে বলল,
-” না। ”
অভিমানে সিক্ত হয়ে হৈমী বলল,
-” তাহলে বিয়ে করবেন কেন? ভালো না বাসলে আমি বিয়ে করব ন। ”
বিরক্ত স্বরে বলল,
-” একশবার করবে। ”
বলেই সাদমানকে হাঁক ছেড়ে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই এসে হাজির। বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হলো খুবই দ্রুত। এরপর দু’জনকে দিয়ে তিন কবুলও পড়ানো হলো। তিনবার কবুল বলার সময় হৈমী তেমন কিছু অনুভব করেনি। মেয়েরা নাকি এ সময়টা অনেক সময় নিয়ে কবুল বলে। কিন্তু হৈমী সময়ও নেয়নি। কিন্তু কবুল পড়ার পর হঠাৎ করেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। কারণ তার মনে বার বার প্রশ্ন জাগছে,
-” সে কোনো ভুল করে ফেলল না তো? ”
অসংখ্য প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিতেই ভয় বাড়তে লাগল তার। ঝিনুক কাজিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাদমান নয়নকে নিয়ে বাইরে গেল বর, বউকে একটু সময় দেয়ার জন্য। হৈমীর চিন্তান্বিত মুখটা দেখে রুদ্র ওঠে দাঁড়াল। সটানভাবে দাঁড়িয়ে দু-হাত পকেটে ঢুকাল। হৈমী এক পলক তাকাল তার দিকে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত লম্বা মানুষটাকে আপাদমস্তক দেখল সে। মাথা ভর্তি চুলগুলো ছোট্ট ঝুঁটি বাঁধা। একপাশ থেকে দাঁড়ি ভর্তি শক্ত চোয়াল দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। চোখ ফিরিয়ে ভাবতে লাগল অনেক কিছুই। কানে ভেসে এলো রুদ্রর ভরাট সুর,
-” আগ বাড়িয়ে চিন্তা করতে হবে না। রিলাক্স থাকো।”
বোকার মতো প্রশ্ন করল হৈমী,
-” এখন কী করব আমি? ”
ঘাড় ফিরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্র। পারপেল কালার সেলোয়ার-কামিজ পরিহিত কিশোরীর অবুঝ মুখটা দেখে প্রাণখুলে হাসতে ইচ্ছে করল। কিন্তু স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসতে পারল না। রাশভারি স্বরে আদেশ করল,
-” সামনে এসো। ”
থতমত খেয়ে সে বলল,
-” কেন? ”
-” বলেছি তাই। ”
ঢোক গিলে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। ধীরপায়ে জড়তার সঙ্গে সামনে এলো রুদ্রর। রুদ্র সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে তার গলায় জড়িয়ে থাকা ওড়নাটা খুলে নিল। আঁতকে ওঠে পিছিয়ে গেল হৈমী। রুদ্র বিরক্ত হয়ে এগিয়ে ওড়না দিয়ে তার মাথায় ঘোমটা তুলে দিল৷
বলল,
-” এবার কিছু টা মানাচ্ছে। ”
চোখ তুলে তাকাল হৈমী। রুদ্র বলল,
-” এবার মিসেস রুদ্র লাগছে। ”
অদ্ভুত এক লজ্জায় সাড়া অঙ্গ শিহরিত হয়ে ওঠল তার। সে লজ্জা, শিহরণকে আরো একটু গাঢ় করতে মাথা নিচু করে ছোট্ট ললাটে ওষ্ঠ দ্বারা গভীর স্পর্শ এঁকে দিল। মৃদুস্বরে বলল,
-” সম্পর্ক বদলে গেল, পেয়ে গেলাম পূর্ণ অধিকার। ইউ আর মাইন, অনলি মাইন! ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৪
রুদ্র সিদ্ধান্ত নিল এবার হৈমীকে নিয়ে শাশুড়ি, বোন জামাইয়ের মুখোমুখি হবে। কিন্তু শঙ্কিত হৈমী লাগামহীন অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অতিরিক্ত ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। নয়ন তাকে থামাতে পারছে না। সাদমান চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে। ঝিনুক তাকিয়ে আছে রুদ্রর গম্ভীর মুখটাতে। বোঝার চেষ্টা করছে তাদের বসের মনোভাব। রুদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে কতক্ষণ হৈমীর কান্না দেখল। এরপর বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। বিরবির করে বকা দিল হৈমীকে,
-” ইডিয়ট! ”
ক্ষণকাল পর হৈমীর কর্ণগোচর হবে এমন স্বরে দৃঢ়চিত্তে বলল,
-” কেঁদে লাভ নেই। যা ঘটার ঘটে গেছে। ”
সহসা কান্না থেমে গেল হৈমীর। নাক টেনে রুদ্রর রাশভারি মুখটায় তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
-” আপনার ভয় লাগছে না? ”
উত্তর দিল না রুদ্র। নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-” চলো ”
আঁতকে ওঠে হৈমী বলল,
-” কোথায়? ”
-” আমার শাশুড়ির বাড়িতে! সুসংবাদটা দিতে হবে না? ”
আতঙ্কিত স্বরে হৈমী বলল,
-” আমি যাব না। ”
-” বেশ তাহলে তোমার শশুর বাড়ি চলো। ”
দু-হাত পকেটে গুঁজে দীর্ঘাকৃতির দেহটা টান টান করে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল রুদ্র। বিচলিত হয়ে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। বলল,
-” আমি কোথাও যাব না। ”
এবার রুদ্রর মেজাজ খারাপ হলো। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” ফাইজলামি না করে যা বলি শোনো, চলো তোমার মা, ভাইকে বুঝিয়ে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে আসি। নয়তো কালকে গণ্ডগোল বাঁধবে। ”
হৈমী স্থির চোখে তাকিয়ে। রুদ্র কথাগুলো বলেই যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আকস্মাৎ হৈমী বলে ওঠল,
-” না না আপনি যাবেন না। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমী কিঞ্চিৎ কাঁপা স্বরে বলল,
-” আমি যাব, প্লিজ আপনি যাবেন না। আমি গিয়ে ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলব সবটা। ভাইয়া আম্মুকে বলবে। ”
-” তুমি বোঝাবে! ”
বিশ্বাস হলো না রুদ্রর। ভরসা করতেও পারল না। তাই ভ্রু কুঁচকেই জিজ্ঞেস করল,
-” বোঝাতে পারবে? বলতে পারবে তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে আমার সঙ্গে? ”
ঘনঘন মাথা উপর নিচ করল হৈমী। রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঝিনুককে বলল,
-” ঝিনুক রিকশা ডেকে আন। ”
ক্লাব থেকে বেরিয়ে হৈমী আর নয়ন গেল টেইলর্সে। তারা রিকশায় ওঠার পর রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিল। হৈমীর কাজ শেষ হবার পর বাড়ির পথে রিকশা ঘুরাতেই নয়ন খেয়াল করল তাদের পেছনে রুদ্রর গাড়ি। হৈমীদের বাড়ি থেকে বেশ দূরেই গাড়ি থামাল রুদ্র। দূর থেকে দেখল হৈমী, নয়ন দু’জনই নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। এ দৃশ্য দেখে স্বস্তি মনে সে ফিরে গেল৷ হৈমীকে পৌঁছে দিয়ে নয়নও ফিরে গেল।
ঘরে বসে প্রচণ্ড ছটফট করছিল হৈমী৷ সাহস দেখিয়ে খুব তো বলল মা, ভাইকে বোঝাবে বলবে। কিন্তু এখন যে সাহস করে ওঠতে পারছে না। অদ্ভুত এক শক্তি বলে তার সমস্ত সত্তা নির্জীব হয়ে আছে। কী হবে এবার? কী করে বলবে সবটা সবাইকে? হঠাৎ করে কী সব ঘটে গেল তার সঙ্গে এবার কোনদিকে মোড় নেবে জীবন?
রাতে খাবার সময় হামিদা খেয়াল করে মেয়েটা কেমন নির্জীব হয়ে আছে। ধারণা করে নিল আগামীকাল বিয়ে তাই তার এই নির্জীবতা স্বাভাবিক। খাওয়ার ফাঁকে মাহের আর হামিদার মধ্যে বিয়ে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা চলল। হৈমীকে কিছু বলা হলে সে শুধু হু, হা করে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল। অতিরিক্ত চুপচাপ ভাব দেখে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে মাহের একবার তার ঘরে এলো। সস্নেহে বোনের মাথায় হাত রেখে বোঝাল অনেক কিছুই। প্রথমে হৈমী মনে মনে তীব্র সাহস জুগিয়েছিল রুদ্র আর তার বিয়ের ব্যাপারটা বলতে। কিন্তু পরবর্তীতে মাহেরের আদর, স্নেহে তার সমস্ত সাহস পালিয়ে গেল। বুকের ভিতর হুহু করে ওঠল। একি করে ফেলল সে? তার মা, ভাই জানলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে!
আমাদের আশপাশে এমন কিছু মানুষ আছে যারা অতিরিক্ত চিন্তার ফলে রাতে ঘুমাতে পারে না। এই চিন্তা নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ নির্ঘুম রাত কাটায় হিসেব নেই। আবার এমন কিছু মানুষ আছে যাদের অতিরিক্ত চিন্তায় শুধু ঘুম পায়। জীবনের প্রতিটা প্রতিকূল পরিস্থিতি এরা দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এই মানুষদের মধ্যে হৈমীর নামটি গাঢ় করেই আঁকা। তাই তো চিন্তা, ভাবনা করতে করতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সে। রাত সাড়ে দশটায় ঘুমানো মেয়েটার ঘুম ভাঙল একদম সকাল আটটায়। যখন তার মা, আর ভাবি মিলে তার না হওয়া বরপক্ষদের জন্য রান্নার তোরজোর শুরু করেছে। টিশার চাচাদের পক্ষ থেকে বরসহ লোক আসবে মোট ছয়জন। ছ’জনের রান্না দু’জন মিলে শুরু করল৷ মাহের বাকি থাকা টুকটাক বাজার করতে গেছে। হৈমী ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ করে জড় বস্তুর মতো বসে রইল বিছানায়৷ গতকাল যে ভয়াবহ ঘটনাটি সে ঘটিয়েছে তা মনে পড়তেই ক্ষণে ক্ষণে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠতে থাকল। চিন্তা করল আর সময় নষ্ট নয় এবার সবাইকে সবটা বলতেই হবে। তীব্র সাহস সঞ্চয় করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে ভাইকে খুঁজল। সূচনা জানাল সে নেই বাজারে গেছে। ঠুস করে সাহস ফুরাতে শুরু করল তার। কিন্তু না এবার সাহস ফুরানোর আগেই সবাইকে সবটা বলতে হবে। ভাই নেই কী হয়েছে মা আছে, ভাবি আছে। প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে রান্না ঘরে ঢুকল সে৷ খাবারের গন্ধে পেটের ভিতর ক্ষুধা ভাব সৃষ্টি হলো। হামিদা মেয়ের শুঁকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” ক্ষিদে পেয়েছে? ভাত দিচ্ছি খেয়ে নয়নকে ফোন দে। পার্লার তো যাবি না। ও এসেই সাজিয়ে দিবেনি।”
-” আম্মু তোমার সাথে আমার কথা আছে একটু এদিকে এসো। ”
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল হৈমী। হামিদা সুক্ষ্ম নজরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। দৃঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
-” কী হয়েছে? ”
মা’য়ের সুক্ষ্ম দৃষ্টি, দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে গলা শুঁকিয়ে গেল। বারকয়েক ঢোক গিলে কথার খেই হারিয়ে ফেলল। বলল,
-” ক্ষিদে পেয়েছে। ”
হামিদা আচমকা হেসে ফেলল। বলল,
-” আমি তো তাই বললাম। তুই পারিসও আর বড়ো হলি না। আল্লাহ কবে যে একটু জ্ঞানবুদ্ধী দেবে। আজকের পর একটাই চাওয়া আমানের সাথে থেকে থেকে তোরও যেন ওর মতো জ্ঞান হয়, বুদ্ধি বাড়ে। ”
______
হৈমীকে বউয়ের সাজে সাজিয়ে সূচনা নিজের ঘরে এলো। দেখল উন্মুক্ত বক্ষে, গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে বেলকনি থেকে ঘরে প্রবেশ করল মাহের। সূচনাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-” হৈমীকে রেডি করিয়েছেন? ”
মৃদু হেসে সূচনা এগিয়ে এলো বিছানায় বসে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,
-” হ্যাঁ খুবই সিম্পল সাজ কিন্তু দেখতে ভীষণ গর্জিয়াস লাগছে। ননদ আমার মাশাআল্লাহ। ”
থমথমে মুখে সূচনার পাশে বসল মাহের। বলল,
-” খুব আদরের ও আমার। এত অল্প বয়সেই আদরটাকে বিয়ে দিতে হবে ভাবতে পারিনি। ”
মাহেরের কণ্ঠ ভারী লাগল খুব। সহসা সূচনা তার হাত চেপে ধরল। ভরসার সাথে বলল,
-” চিন্তা করবেন না। হৈমীর খুব ভালো হবে দেখবেন।”
চোখ দু’টো ভার হয়ে এলো মাহেরের। মাথা নিচু করে বলল,
-” বোনটা অনেক সহজসরল সূচনা। চিন্তা এজন্যই বেশি হচ্ছে। ”
সন্তর্পণে মাহেরের কাঁধে মাথা রাখল সূচনা। বলল,
-” যারা ভালো তাদের সঙ্গে সব সময় ভালোটাই হয় মাহের। আপনি চিন্তা করবেন না। ”
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মাহের। ঈষৎ হেসে বলল,
-” মুখটা ক্লান্ত লাগছে আপনার। অনেক বেশি খাটুনি হলো তাই না? ”
মাথা তুলে অকপটে জবাব সূচনার,
-” কই না তো ঠিক আছি। বাড়িতে একটা আয়োজন হচ্ছে এটুকু খাটুনি কোনো ব্যাপার না। ”
-” আচ্ছা গোসল সেরে নিন বেশি সময়ও নেই আর। ”
-” আপনি যাবেন তো। আমি পরে যাই। ”
গলায় ঝুলিয়ে রাখা তোয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল সূচনা৷ মাহের থম মেরে বসে থেকে আচমকাই প্রস্তাব রাখল,
-” চলুন একসঙ্গে যাই। ”
লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সূচনা। আমতা আমতা করে বলল,
-” আপনি যান আমার আরো কিছু কাজ আছে সেরে আসি। ”
রুম ছাড়তে ত্বরিত বেগে দুপা বাড়াল সে। চট করে ওঠে খপ করে সূচনার হাত টেনে ধরল মাহের। বলল,
-” একটা ধৈর্য্যশীল পার্টনার পেয়েছেন বলে বেশ আয়েশ করে পালাই পালাই করতে পারছেন। একটাবার ধরা দিয়ে দেখুন, এই পালাই পালাইয়ের রিভেঞ্জ কীভাবে নিই। ”
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল সূচনা। চাপা স্বরে বলে গেল,
-” এজন্যই ধরা দিচ্ছি না! ”
বিস্মিত হয়ে দরজার পানে তাকিয়ে রইল মাহের। ক্ষণকাল অতিবাহিত হওয়ার পর মাথা চুলকে, ঠোঁট কামড়ে আনমনে হেসে ফেলল। বিরবির করে বলল,
-” তো ম্যাডাম এই ব্যাপার? আচ্ছা, বিষয়টা হৃদয়ে গোপন রেখে দিলাম। ”
___________
হঠাৎ করেই বাড়িতে রুদ্রর আগমন! আতঙ্কিত হয়ে পড়ল হামিদা, মাহের দু’জনই। রুদ্র খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে এসে বসার ঘরে বসল। মাহেরকে জিজ্ঞেস করল,
-” সূচনা কোথায়? ”
মাহের এগিয়ে এসে জানাল সূচনা গোসলে গেছে। রুদ্র এরপর প্রশ্ন করল,
-” আমার বউ কোথায়? ফোন বন্ধ কেন ওর? ”
নিমিষেই পুরো বাড়িতে বজ্রপাত ঘটল। রুদ্র খুবই স্বাভাবিক, শান্ত হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। অশান্ত হলো মাহের। মায়ের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
-” রুদ্র সিনক্রিয়েট করবেন না। ”
সহসা ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। হাঁক ছেড়ে ডাকল,
-” হৈমী, হৈমী, হৈমী… ”
ভেতরের ঘরে বসে থাকা হৈমীর এই হাঁকডাক শুনে
অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠল। তড়াক করে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল সে। নয়নকে বলল,
-” নয়ন আমার মাথা ঘোরাচ্ছে প্লিজ তুই আমাকে ধর। ”
মাহের আজ প্রচণ্ড রেগে গেল। যে কোনো সময় তাদের মেহমানরা এসে পড়বে। যে করেই হোক তার পূর্বে রুদ্রকে বিদায় করতে হবে। নয়তো সবটা মেনে নিয়ে আত্মীয় হিসেবে পাশে থাকতে হবে। সব ভেবে চিন্তে মাহের উচ্চস্বরে সূচনাকে ডাকল। এ প্রথম মাহেরের এমন ডাকে বিচলিত হয়ে ছুটে এলো সূচনা। এসেই রুদ্রকে দেখে চিত্ত চমকে ওঠল। মাহের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
-” প্লিজ আপনার ভাইকে বোঝান। ”
রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। শক্ত চোখে মাহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বউ নিতে এসেছি। কারো বোঝাবুঝি শুনতে আসিনি।”
-” ভাইয়া এসব কী বলছ! ”
সূচনার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল,
-” গতকাল আমাদের বিয়ে হয়েছে সূচনা। যেখানে আমি মরে গেলেও কেউ ওর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে পারবে না, সেখানে বেঁচে থাকা অবস্থায় তোরা দ্বিতীয় বিয়ে দিচ্ছিস! ”
মাহের নিজের ক্রোধটুকু নিয়ন্ত্রণে এনে শান্ত গলায় রুদ্রকে বোঝাতে লাগল৷ কিন্তু রুদ্র নিজের কথায় অটল। রুদ্রর ভাবগতিক বুঝে সূচনা মাহেরকে বলল,
-” দেখুন ভাইয়া যেমনি হোক সে মিথ্যা বলার মানুষ না। আপনি প্লিজ হৈমীর কথাটা একবার শুনুন। কাল থেকে হৈমীকে খেয়াল করছি আমার মন বলছে ভাইয়ার কথাটা সত্যি। ”
সূচনার কথা শুনে হামিদা ছুটে গেল মেয়ের ঘরে। এক প্রকার হামলে পড়ল মেয়ের ওপর। চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে একের পর এক জিজ্ঞেস করতে লাগল। ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে হৈমী গতকালের বিয়েটা অস্বীকার করে দিল। দরজার বাইরে হৈমীর কথা শুনে স্বস্তি পেল মাহের। ফিরে গিয়ে রুদ্রকে কঠিন স্বরে হৈমীর অস্বীকারের কথা জানাল। বলল,
-” এবার প্লিজ আর ঝামেলা করবেন না। আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কটা নষ্ট করবেন না। নিজের বোনের কথা ভাবুন। আপনার বাড়াবাড়ি যদি না থামে তাহলে আমাকে আমার ভদ্রতা ভুলে যেতে হবে। আপনার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হবে। মনে রাখবেন আমার সঙ্গে আজ সূচনাও জড়িয়ে। স্ত্রী হিসেবে সে নিশ্চয়ই আমার কথার অবাধ্য হবে না। ”
মেজাজ বিগড়ে গেল রুদ্রর। দাঁতে দাঁত চেপে মাহেরকে কিছু বলতে উদ্যত হয়েও সূচনার চোখের পানি দেখে দমে গেল। কাউকে তোয়াক্কা না করে বড়ো বড়ো পা ফেলে ছুটে গেল হৈমীর রুমে। রুদ্রকে ঝড়ের গতিতে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই হৈমীর শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। রুদ্র সরাসরি ওর সামনে গিয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া আমি পরে করব। বিয়ে যখন করেছি, বউ যখন হয়েছ প্রাইভেটলি অবশ্যই বোঝাপড়া হবে। এই অজ্ঞতার চরম মূল্য দিতে হবে তোমায়। সো বি প্রিপেয়ার্ড সুইটহার্ট! এবার তোমার মিথ্যাবাদীতার প্রমাণ দিই কেমন? ”
দরজার বাইরে এসে উপস্থিত মাহের, সূচনা, হামিদাকে দেখে ফোন করল ঝিনুককে। মিনিট দেড়েক পরই ফাইল ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে ঝিনুক এলো। রুদ্র এবার বেশ উঁচু গলায় বলল,
-” ঝিনুক রেজিস্ট্রি পেপার গুলো দেখাও। ”
ঝিনুক একে একে দেখাল মাহেরকে। সবটা দেখে দাঁড়িয়ে থাকা মাহের শরীর ছেড়ে বসে পড়ল। হামিদা মুখে আঁচল চেপে উচ্চরবে কেঁদে দিল। রুদ্র চুপ থাকল না। কাগজপত্র দেখানো শেষে গতকালকের বিয়ের সম্পূর্ণ ভিডিয়ো দেখাল মাহের, সূচনাকে।
পুরো বাড়ি স্তব্ধ। এই স্তব্ধতাকে কাটিয়ে মাহের পকেট থেকে ফোন বের করল। আমানের বাবার নাম্বারে কল করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। এদিকে নিজের দূর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সর্ব সম্মুখে হামিদা হৈমীর গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিল। ডুকরে ওঠল হৈমী। হামিদা ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-” অনেক বড়ো হয়ে গেছিস, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারিস, যা তোর স্বামী এসেছে তোকে নিতে চলে যা। ”
আচম্বিত হামিদার পা দুটো জড়িয়ে ধরল হৈমী। হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,
-” আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমি যাব না বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। ”
পা ঝাড়া দিয়ে হামিদা বলল,
-” কে তোর মা? আমার তো কোনো মেয়ে নেই। আমার মেয়ে তো মরে গেছে। যাকে ন’মাস গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছি সে আজ থেকে আমার কাছে মৃত। ”
কথাগুলো বলেই হামিদা সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” বউ মা, যদি আমার ছেলের সংসার করার ইচ্ছে থাকে তোমার ভাইকে বলো তার বউকে নিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে! ”
করুণ চোখে সূচনা রুদ্রর দিকে তাকাল। রুদ্র সূচনাকে বলল,
-” ওকে নিয়ে আয়, আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। ”
-” ভাইয়া প্লিজ তুমি পাগলামি করো না। মা রেগে আছে, মাহের আসুক তুমি শান্ত হও। ”
মাহের এসে তার মায়ের বক্তব্য শুনে সূচনাকে বলল,
-” আপনি হৈমীকে নিয়ে আসুন। ”
সূচনা অবাক হলো। সে অন্তত মাহেরের থেকে এ আচরণ আশা করেনি। তার অবাক দৃষ্টি দেখে মাহের বলল,
-” ভুল করেছে শাস্তি পেতেই হবে। কারণ মা’কে বোঝানোর সাধ্য আজ আমার নেই। কেন নেই এই উত্তর সেদিন পাবেন যেদিন আপনি মা হবেন। আমার মাকে ভুল বোঝার আগে মনে রাখবেন, বাবার মৃত্যুর পর তার বেঁচে থাকার অবলম্বনই ছিলাম আমি আর বোন। ”
মাহেরের কথায় হৈমীকে নিয়ে এলো সূচনা। মাহের হৈমীর মাথায় হাত রেখে বলল,
-” বোনরে ভালো থাকিস। ”
আর কিছু বলতে পারল না মাহের। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে ঘরে চলে গেল। হৈমী বিধ্বস্ত মুখে সূচনাকে বলল,
-” আমি যাব না। ”
সূচনা বলল,
-” সব ঠিক হয়ে যাবে হৈমী। তুমি ভাইয়ার সঙ্গে যাও।”
হঠাৎ করেই রুদ্র হৈমীর হাত চেপে ধরল। সূচনাকে বলল,
-” তুই মাহেরকে সামলা, একে আমি দেখে নিব। ”
বলেই হিড়হিড় করে টানতে টানতে বেরিয়ে গেল রুদ্র। নয়ন হতবুদ্ধি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী অনুভব করল সে। আর এক মিনিট এখানে নয়। এক্ষুনি চলে যেতে হবে।
সূচনা যখন ঘরে এলো দেখল মাহের মেঝেতে হাত, পা ছড়িয়ে বসে আছে। স্বামীর এমন অবস্থা দেখে বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠল তার। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে পাশে বসল। কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” মাহের আপনি শক্ত হন, শান্ত হন। আমি জানি ভাইয়া উদ্ধতস্বভাবের কিন্তু অমানুষ নয়। তার মাধ্যেও ভালোবাসা আছে মায়া আছে। হৈমী কোনো ক্ষতিকারক মেডিসিন সেবন করেনি যে এভাবে ভেঙে পড়বেন। প্লিজ মাহের, প্লিজ। ”
আকস্মাৎ সূচনাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো মাহের। সূচনাও চমকে ওঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বার বার করে বলতে লাগল,
-” প্লিজ শান্ত হন, প্লিজ। ”
__________
হৈমীকে গাড়িতে বসিয়ে হঠাৎ আবার টেনে ওঠাল রুদ্র। ভয় ভয় চোখে হৈমী তাকাল রুদ্রর কঠিন মুখের দিকে। রুদ্র তার রক্তিম দৃষ্টিজোড়া তীক্ষ্ণ করে হৈমীর ডান গালটা নিরীক্ষণ করল। স্পষ্ট দেখতে পেল লালচে দাগগুলো। যা তার ক্রোধের মাত্রা দ্বিগুণ করে দিল।হৈমীর বাহু চেপে রাখা হাতটা আরো শক্ত হলো। ব্যথায় অসহনীয় হয়ে ওঠল হৈমী। রুদ্র ক্রোধী স্বরে বলল,
-” কাল যদি ভুলটা না করতাম আজ এটা দেখতে হতো না। ”
বলেই এক প্রকার ছুঁড়ে ফেলল হৈমীকে। মেয়েটা ভয়ের তাড়নায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। ডোর লোক করার পূর্বে রুদ্র আবারো বলল,
-” আশা করি এই থাপ্পড়টা জন্মের মতো এ বাড়ির স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছে। ”
রুদ্র কখনো মায়ের ভালোবাসা পায়নি। মা’দের নিয়ে মসৃণ কোনো অনুভূতিই তার মধ্যে কাজ করে না। তাই তো হামিদার দেয়া থাপ্পড়টাকে সে অপমান, আঘাত হিসেবে ধরে নিল। অথচ হৈমী জানে কতটা তীব্র কষ্ট থেকে তার মা তার গায়ে হাত তুলেছে।
গাড়ি বাড়ির পথে স্টার্ট করলেও বাড়ি যাওয়া হলো না। কারণ মাঝপথেই দাদিন কল করে রুদ্রকে জানায়, যে বাড়িতে তাদের মেয়ে দিয়েছে সে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে সে বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করা তার উচিৎ হয়নি৷ যে পর্যন্ত সূচনার শাশুড়ি হাসিমুখে এই বিয়ে মেনে না নেবেন, রুদ্রকে মেয়ের জামাই হিসেবে গ্রহণ না করবেন, সে পর্যন্ত যেন শেখ বাড়ি না ফেরে। যদি ফেরে তৎক্ষনাৎ গৃহত্যাগী হবেন তিনি৷ তাই যেন ভালোই ভালোই মাহের আর হামিদার কাছে ক্ষমা চেয়ে, মাথা নত করে তাদের সন্তুষ্টি নিয়ে তাদের মেয়েকে শেখ বাড়ি নিয়ে আসে।
দাদিনের এসব কথায় ঘাড়ত্যাড়া রুদ্র কান দিল না। ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। কারণ সে ভুল কিছু করেনি। যদি ভুল কেউ করে থাকে করেছে মাহের আর তার মা। গোপনে হৈমীর বিয়ে ঠিক করে চরম অন্যায় করেছে তারা। যার শাস্তি সে তাদের দিয়ে দিয়েছে।
টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে পনির আর ঝিনুক দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্রর গাড়ি এসে তাদের সামনে থামল। ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এলো সে। ঝিনুক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে পনির তার বাম পাশে বসল। রুদ্র পেছনের ডোর খুলে বধূ সাজে কাচুমাচু হয়ে বসা হৈমীর দিকে তাকাল। ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল তার পাশে। লাল, সাদা সংমিশ্রণের বেনারসি পরিহিত হৈমীকে দেখে মেজাজ কিছুটা শান্ত হলো। বধূরূপের করুণ মুখশ্রীতে আরো একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ভরাট গলায় বলল,
-” কী দূর্ভাগ্য আমার একটা মিথ্যাবাদীর সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে হবে! ”
কথাটা বলেই হঠাৎ চমকে ওঠল সে। নিমিষেই মেজাজ ক্ষিপ্ত হলো। রক্তিম চোখ দুটো গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” বললে মা, ভাইকে বোঝাবে কিন্তু বোঝাওনি। একজনকে বিয়ে করে, একজনের বউ হয়ে আরেকজনের বউ সেজেছ! কার জন্য সেজেছ আমাদের বিয়ে কাল হয়েছে রাইট? তাহলে আজ সাজ কেন? হুয়াই? উহুম, নেভার এটা মেনে নেয়া যায় না। ”
কথাগুলো বলতে বলতেই হৈমীর বাহু চেপে কাছে টেনে আনল। এক এক করে ওর পরিহিত সকল গয়নাগুলোও খুলতে শুরু করল। গয়না খোলা শেষে পুরুষালি শক্ত হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ঠোঁটে লাগানো লিপস্টিক মুছতে লাগল। হৈমীকে কিছু বলার সুযোগও দিল না। নিজের মতো সাজ মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এরপর পকেট থেকে টিস্যু বের করে হাতে লাগা লিপস্টিক মুছে চোখের কাজল মুছতে উদ্যত হলো। হৈমী নড়েচড়ে, রেগেমেগে অস্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিল। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
-” এ পর্যন্ত ঠিক আছে। শাড়িটা বাসায় গিয়ে খুলব।”
চলবে…